নীলবসনা সুন্দরী : তৃতীয় খণ্ড – চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে
জোহেরা হরিপ্রসন্ন বাবুকে সঙ্গে লইয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করিলেন । ধুমপানরত মুন্সী সাহেব মুখ হইতে শট্কার নল নামাইয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি মনে ক’রে, উকীল বাবু?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার নিকটে আসিয়াছি । বোধ করি, আপনি শুনিয়া থাকিবেন, পুলিস দিলজানের হত্যাপরাধে মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়া হাজতে রাখিয়াছে ।”
মুন্সী । কই, আমি ত ইহার কিছুই শুনি নাই ।
হরি । ডিটেক্টিভ-ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় তাহার বিপক্ষে । মজিদ এখন বড় সঙ্কটাপন্ন, তাহার প্রণরক্ষা করা দরকার ।
মুন্সী । খুনীর প্রাণরক্ষা! কিরূপে তাহা হইবে?
জোহেরা । মজিদ খুনী নহেন-নির্দ্দোষী হইয়াও এখন তাঁহাকে দোষী হইতে হইয়াছে ।
মুন্সী সাহেব শট্কার ফরসীর উপর দৃষ্টি স্থির রাখিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন “মজিদ খাঁর উপরে এখনও তোমার সেই অন্ধ অনুরাগ সমভাবে আছে দেখিতেছি ।” কথাটা জোহেরাকে বলিলেন কি ফর্সীটাকে বলিলেন, তাহা ঠিক বুঝিতে পারা গেল না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মজিদ খাঁ যে দোষী নহে, আমিও তাহা জানি । অন্যায় ভাবে এই হত্যাপরাধটা তাহার স্কন্ধে চাপিলেও, সে এখন কোন একটা অনির্দ্দেশ্য কারণে মুখ ফুটিয়া কিছু প্রকাশ করিতে পারিতেছে না! এখন যদি আমরা তাহাকে এই বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা না করি, তাহা হইলে তাহাকে বিনা দোষেই ফাঁসী যাইতে হয় ।”
মুন্সী । তা’ আমার দ্বারা আপনার কি সাহায্য হইতে পারে?
হরি । অনেক সাহায্য হইতে পারে । আমার বিশ্বাস, খুবই সম্ভব-আপনার স্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ।
মুন্সী সাহেব বিরক্তভাবে বিবর্ণমুখে বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! কিরূপে তাহা হইবে? আপনি একান্ত অবিবেচক-তাই এই সকল কথা আমার কাছে উত্থাপন করিতে আসিয়াছেন । আমি আপনাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, আপনি ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের সম্ভ্রম রাখিয়া অবশ্য আপনার কথা কহা উচিত ।”
হরি । দায়ে পড়িয়াই আমাকে আপনার পতিতা স্ত্রীর কথা আপনারই সমক্ষে উত্থাপন করিতে হইতেছে; নতুবা একজন নির্দ্দোষীর জীবন রক্ষা হয় না । আপনার স্ত্রীর দ্বারা যে, এই হত্যাকাণ্ড সমাধা হইয়াছে, এমন কথা আমি বলিতেছি না । আমার অনুমান, খুনের রাত্রে এগারটার পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে মজিদ খাঁর সহিত আপনার স্ত্রীর একবার দেখা হইয়াছিল ।
মুন্সী । মজিদ এখন তাহাই বলিতেছে না কি?
হরি । না, মজিদ কোন কথাই প্রকাশ করিতে চাহে না-সে একেবারে মুখ বন্ধ করিয়াছে । একজন স্ত্রীলোকের সহিত যে, সেদিন রাত্রিকালে তেমন সময়ে তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা নিশ্চয়; কিন্তু কে সে স্ত্রীলোক, এ পর্য্যন্ত তাহা আবিষ্কার করিতে পারা যায় নাই । আমার অনুমান, সেই স্ত্রীলোক আপনার পতিতা স্ত্রী ব্যতীত আর কেহই নহে । আমার এই অনুমানটা কতদূর সত্য জানিতে হইলে, আপনারই সহায়তার প্রয়োজন । আপনার স্ত্রী কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিলেন, জানিতে পারিলে আমি এক-রকম সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হইতে পারি; একমাত্র আপনার কাছেই সে সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে ।
মুন্সী । সে সংবাদ আমার কাছে কিরূপে পাইবেন? আমি জানিতে পারিলে কখনই এমন দুর্ঘটনা ঘটিতে না ।
হরি । না, আমি সে কথা বলিতেছি না । আপনার স্ত্রী গৃহত্যাগের কথা কখ্ন আপনি প্রথমে জানিতে পারিলেন? তখন রাত কত-রাত বারটার পূর্ব্বে কি?
মুন্সী । না, রাত তখন শেষ হইয়া আসিয়াছে ।
হরি । রাত বারটার সময়ে আপনার স্ত্রী বাড়ীতে ছিলেন কি না, তাহা জানেন?
মুন্সি । না, তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারিলাম না । আমি কোন কাজে বাহির হইয়াছিলাম; রাত এগারটার পর আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসি । তখন বাড়ীর সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । আমি নিজের শয়ন-কক্ষে শয়ন করিতে গেলাম; দেখিলাম, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ । অনেকবার ডাকিলাম, আমার স্ত্রীর কোন উত্তর পাইলাম না । ঘুরিয়া আসিয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, তখনই এই বৈঠকখানায় আসিয়া শয়ন করিলাম । তাহার পর শেষ-রাত্রিতে উঠিয়া আমি এই দুর্ঘটনার কথা জানিতে পারিলাম । আমি ত পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, আমার নিকটে আপনি বিশেষ কোন সংবাদ পাইবেন না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু কি বলিতে যাইতেছিলেন-এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি কার্ড দিলেন । মুন্সী সাহেব কার্ডখানি একবার চক্ষুর নিকটে লইয়া, তৎক্ষণাৎ হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, “আপনার সেই দেবেন্দ্রবিজয় বাবু আসিয়া উপস্থিত ।আপনি ইচ্ছা করিলে এখন তাঁহার কাছে অনেক সংবাদ পাইতে পারেন । ঠিক সময়েই তিনি আসিয়াছেন, দেখিতেছি । তাহার পর ভৃত্যকে বলিলেন, “তাহাকে এখানে আসিতে বল ।”
ভৃত্য চলিয়া গেলে হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় বাবু লোকটা বড় সহজ নহেন । অবশ্যই একটা কোন গুরুতর মত্লব মাথায় করিয়া এখানে আসিয়া উপস্থিত । যে অভিপ্রায়ে আসিয়াছেন, আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি । তিনি মজিদ খাঁকে গ্রপ্তার করিয়াছেন, এখন মজিদ খাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবার প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছেন ।”
এমন সময়ে সেই প্রকোষ্ঠ মধ্যে ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন । সম্মুখদিকে একটু মাথা নাড়িয়া আগে জোহেরার, তাহার পর মুন্সী সাহেবের সম্মান রক্ষা করিলেন । তাঁহারাও সেইরূপ ভাবে সম্মান জানাইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিলেন ।