নীলবসনা সুন্দরী : তৃতীয় খণ্ড – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুখবন্ধের কারণ কি?
হরিপ্রসন্ন বাবু হাজত হইতে বাহির হইয়া নিজের বাড়ীর দিকে চলিলেন । বাটীসম্মুখে আসিয়া দেখিলেন বহির্দ্বারের নিকটে একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে । দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন, সে গাড়ী জোহেরার । বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার যাইতে বিলম্ব হওয়ায় জোহেরা নিজে আসিয়াছে । গাড়ীর ভিতরে জোহেরা বসিয়া ছিল । হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে সস্নেহ-সম্ভাষণ করিয়া আপনার বাটীর ভিতরে লইয়া গেলেন । দ্বিতলে একটি প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া তাহাকে বসিতে বলিলেন; এবং একটা স্বতন্ত্র আসনে তাহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বসিলেন । বসিয়া বলিলেন, “আমি এখনই তোমার ওখানে যাইব বলিয়া মনে করিতেছিলাম । একটা বিশেষ কাজ থাকায়-খবর পাইয়াই যাইতে পারি নাই । তা’ তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে । যে জন্য তুমি আমাকে তোমার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছিলে, তাহা আমি অনুভবে তখনই এক প্রকার বুঝিতে পারিয়াছিলাম । আমি এই মাত্র মজিদের নিকট হইতে ফিরিতেছি । মজিদ নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী-তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই ।”
জোহেরা বলিল, “নির্দ্দোষী -তিনি যে নির্দ্দোষী, তাহা আমিও জানি । তাঁহার দ্বারা কখনই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্ভবপর নয়; কিন্তু কিরূপে তাঁহার নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ হইবে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না ।”
চিন্তিতমুখে হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাই ত, যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এখন মজিদের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা বড় শক্ত ব্যাপার! এমন কি সে আমার কাছেও কিছুতেই কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহে না । কেবল সকলই গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে ।”
জোহেরা ব্যাকুলভাবে কহিল, “কি মুস্কিল! তিনি আবার এ সময়ে – এই ভয়ানক বিপদের মাঝখানে দাঁড়াইয়া এমন করিতেছেন কেন? কি কথা তিনি আপনার কাছে প্রকাশ করেন নাই?”
উকীলবাবু বলিলেন, “সেই খুনের রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম । কিছুতেই মজিদ তাহার নাম বলিল না । আমার বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোক আর কেহই নহে-সৃজান বিবি ।”
“সৃজান বিবি!” যেন প্রতিধ্বনি করিয়া জোহেরা বলিল, “কি সর্ব্বনাশ! তিনি সেখানে-তেমন সময়ে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন যাইবেন? আপনার অনুমানই ঠিক নহে ।”
উকীল বাবু বলিলেন, “আমার অনুমানই ঠিক-সৃজান বিবি মনিরুদ্দীনের সহিত গোপনে দেখা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার দেখা না হইয়া ঘটনাক্রমে মজিদের সহিতই তাহার দেখা হইয়া যায় । সৃজান বিবি-যাহাতে মজিদ তাহার নাম প্রকাশ না করে, সেজন্য তাহাকে প্রতিশ্রুত করাইয়া থাকিবে । এইরূপ একটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় মজিদ সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিতে পারিতেছে না । মজিদ এখন বলিতেছে, সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করুতে হইলে, অন্ততঃ মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করা দরকার; কিন্তু এ সময়ে কি মনিরুদ্দীনের সহজে দেখা পাওয়া যাইবে? সে এখন একেবারে নিরুদ্দেশ ।
জোহেরা কহিল, “নিজে এমন বিপদাপন্ন; এ সময়ে সৃজান বিবির নাম প্রকাশ করিতে হইলে কি ক্ষতি আছে? কি আশ্চর্য্য! সামান্য প্রতিজ্ঞার জন্য বিবির যে সম্ভ্রমহানি হইবে, এখন আর এমন সম্ভবনা নাই-সে ত নিজের মান-সম্ভ্রম নিজেই জলাজ্ঞলি দিয়া গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে; তবে তাহার জন্য কেন আত্মোৎসর্গ?”
উকীল বাবু বলিলেন, “আরও একটা কারণ আছে । সৃজান বিবি যে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে, ইহা লোকে শুনিলেও সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে এখন সকলেরই সন্দেহ আছে । কিন্তু এখন যদি মজিদ প্রকাশ করে যে, সৃজান বিবিকেই সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দেখিয়াছে, তাহা হইলে মনিরুদ্দীন যে, সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িয়াছে, সে সম্বন্ধে ত আর কাহারও সন্দেহের কোন কারণই থাকিবে না । যাহা তাহারা শুনিয়াছে, তাহাতেই সকলে কৃতনিশ্চয় হইতে পারিবে । ইহাতে মনিরুদ্দীন দোষী হইলেও মজিদ তাহাকে আপনার ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করে-কিছুতেই সে তাহার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিবে না । সেইজন্যই মজিদ কোন কথা প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে একবার মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে চাহে বোধ হয় ।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া জোহেরা বলিল, “কিন্তু এখন মনিরুদ্দীনকে কোথায় পাওয়া যাইবে- তাঁহার ত কোন সন্ধান নাই । তবে কি হবে?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাই ত, কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না । মজিদের বিরুদ্ধে কয়েকটা প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে ।”
সোৎসুক জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার অনুকূলে কি কোন প্রমাণই নাই? তিনি কি নিজের উদ্ধারের জন্য আপনার নিকটে কোন কথাই প্রকাশ করেন নাই? আত্মরক্ষায় তিনি কি এমনই উদাসীন?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাঁহার অনুকূলে একটা প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-এখন তাহা সপ্রমাণ করা চাই । মজিদের মুখে শুনিলাম, যে ছুরিখানি তাহার বাসায় পাওয়া গিয়াছে, তাহা সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছিল । তাহার পর নিজের বাসায় আনিয়া টেবিলের উপরে সেই ছুরিখানা ফেলিয়া রাখে; কিন্তু ছবির পাশে কে তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা মজিদ নিজে জানে না । তাহার অনুমান, বাড়ীওয়ালীই ঘর পরিষ্কার করিতে আসিবার সময় ছুরিখানি ছবির পাশে তুলিয়া রাখিয়া থাকিবে ।”
জোহেরা বলিল, “তাহা হইলে এখন একবার তাহা আপনাকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে । আপনি হামিদার সহিত একবার দেখা করুন ।”
উকীল বাবু বলিলেন, দেখা ত করিবই; কিন্তু কাজে কতদূর হইবে, বুঝিতে পারিতেছি না ।
জোহেরা ব্যগ্রভাবে কহিল “হতাশ হইবেন না-নিশ্চয়ই আপনি কৃতকার্য্য হইবেন ।”