নীলবসনা সুন্দরী : তৃতীয় খণ্ড – পঞ্চম পরিছেদ – সাখিয়া
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় সেই লোহার তার ও শিকের সাহায্যে দিলজানের বাক্স ও ড্রয়ারগুলি খুলিয়া ফেলিতে লাগিলেন; এবং তন্মধ্যস্থিত জিনিষ-পত্র সমুদয় উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। প্রায় একঘন্টা কঠিন পরিশ্রমের পর নিজের কাজে লাগিতে পারে, এমন দুই-একটি মাত্র জিনিষ তাঁহার হস্তগত হইল’ তাহা একতাড়া পুরাতন চিঠী এবং দুইখানি ফটোগ্রাফ ভিন্ন আর কিছু নহে। চিঠীগুলি আমীর খাঁ নামক কোন ব্যক্তি মৃজান নাম্নী কোন রমণীকে লিখিতেছে। সকলগুলিই প্রেমপত্র, তাহা ভালবাসার কথা-বিরহের কথা-অন্তরঙ্গতার কথা ও অনন্তবিধ হা-হুতাশে পূর্ণ। ফটোগ্রাফ্ দুইখানির একখানিতে একটি শুক্লকেশ বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। তাহার পরপৃষ্ঠায় লেখা-“মুন্সী মোজাম হোসেন-সাং খিদিরপুর।” অপর ফটোখানি দিলজানের নিজের। ইহাতে দিলজান সালঙ্কারা নীলবসনা নহে, শুভ্রবসনা নিরলঙ্কারা-তথাপি তাহা বড় সুন্দর দেখাইতেছে। অবেণীসম্বন্ধ কেশগুচ্ছ-গুচ্ছে গুচ্ছে সুন্দর মুখখানির উভয় পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া অংসে পৃষ্ঠে এবং বক্ষের উপরে লুটাইয়া পড়িয়াছে। তুলিকাচিত্রিতবৎ আকর্ণবিশ্রান্ত বঙ্কিম ভ্রুযুগল, এবং ভাসা ভাসা প্রচুরায়ত ও কৃষ্ণচক্ষু দু’টী সে সুন্দর মুখমণ্ডলের অপূর্ব্ব শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। সেই ডাগর চক্ষু দুটীতে তেমনিই আবার কি মনোমোহিনী দৃষ্টি! তাহার পর, আরও মনোহর সেই উন্নত গ্রীবার বঙ্কিম ভঙ্গি। প্রসৃত পরিপুষ্ট বক্ষের উর্দ্ধার্দ্ধভাগ উন্মুক্ত। একটি কুসুমিতা লতা মালার সেই মত অংস ও কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া সেই কামদেবের লীলা-ক্ষেত্রতুল্য সমুন্নত বক্ষের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ফটোগ্রাফ্ দুইখানি বিশেষরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া একে একে পত্রগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলেন। দশ-দশখানি সুদীর্ঘ পত্র-দেবেন্দ্রবিজয় সকলগুলিরই আদ্যোপান্ত বিশেষ মনোযোগের সহিত মনে মনে পাঠ করিলেন। পাঠ শেষ করিয়া তিনি লতিমনের মুখের দিকে চাহিলেন। লতিমন এতক্ষণে নীরবে তাহার মুখের দিকে অবাক্ হইয়া চাহিয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, এতক্ষণে সব বুঝিলাম। আপনি যাহাকে দিলজান বলিয়া জানেন, তাহার প্রকৃত নাম দিলজান নহে-মৃজান। খিদিরপুরে তাহার পিতৃগৃহ। তাহার পিতার নাম মোজাম হোসেন। ঘটনাক্রমে পিতৃগৃহে মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার প্রণয় হয়। মনিরুদ্দীন নিজের নাম গোপন করিয়া আমীর খাঁ নামে তাহার নিকটে পরিচিত হইয়া ছিলেন। মৃজান আমীর খাঁকে বিবাহ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করে; কিন্তু আমীর খাঁ সে সকল কথা উড়াইয়া দিয়া তাহাকে গৃহের বাহির করিবার চেষ্টা করে। পরিশেষে মনিরুদ্দীনেরই চেষ্টা সফল হইল। পরে যখন মৃজান বুঝিল, কাজটা সে নিতান্ত বুদ্ধিহীনার মত করিয়া ফেলিয়াছে, নিজে কলঙ্ক-সাগরে ডুবিয়াছে, এবং সেই কলঙ্কের কালিমা তাহার বৃদ্ধ পিতার মুখে লেপন করিয়াছে, তখন আত্ম-পরিচয় গোপন করিয়া দিলজান নাম লইয়া থাকিল।এই যে বৃদ্ধের তস্বীর দেখিতেছেন, ইনিই দিলজানের পিতা, নাম মোজাম হোসেন। আর এইখানি সেই আপনার মৃজান ওরফে দিলজানের তস্বীর।”
লতিমন মনোহর রূপকথার মত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে এই প্রেম কাহিনী একান্ত বিস্ময়ের সহিত শুনিল। সে বুঝিতে পারিল না, দেবেন্দ্রবিজয় কিরূপে ক্ষণকালের মধ্যে এত কথা জানিতে পারিলেন। নিজে সে এতদিন দিলজানের সহিত একসঙ্গে বাস করিতেছে, অথচ সে নিজে ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানে না। লতিমনের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত হইতে ফটোগ্রাফ্ দুইখানি লইয়া, নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া সমুখস্থ টেবিলের উপরে রাখিয়া দিল। এবং একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “হাঁ, একখানি দিলজানের তস্বীর। এখানে আমি তাহাকে কখনও এ রকম পোষাকে দেখি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বার ঠেলিয়া আর একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোক দীর্ঘাঙ্গী, কৃশা শ্যামবর্ণা। তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ হইতে পারে-পঁয়ত্রিশও হইতে পারে-ঠিক করা কঠিন। তাহাকে দেখিয়া সাগ্রহে লতিমন বলিয়া উঠিল, “কে, সাখিয়া না কি? বেশ-বেশ-খুব শীঘ্র এসে পড়েছিস্ ত!”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এই সাখিয়া সৃজান বিবির প্রধানা দাসী। তিনি তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন।
সাখিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়কে তেমন কঠিনভাবে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া ভীতা হইল। একটু যেন থতমত খাইয়া গেল। কি বলিবে, স্থির করিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিল।
তখন লতিমন সাখিয়াকে দেবেন্দ্রবিজয়ের পরিচয় দিল। শুনিয়া সে আরও ভীতা হইয়া উঠিল।
লতিমন বলিল, “সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা কর্তে চান্। যা’ জানিস্ সত্য বলবি।”
সাখিয়া শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, “কি মুস্কিল! আমি কি জানি, আমি কি বলব? থানা-পুলিসের হাঙ্গামে আমি নেই।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সকলই বিগ্ড়াইয়া যায়। তিনি সাখিয়াকে বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, “না-না-থানা পুলিসের হাঙ্গামা ইহাতে কিছুই নাই। যে রাত্রে সৃজান বিবি পলাইয়া যায়, সেই রাত্রের দুই-একটা খবর আমি তোমার কাছে জনিতে চাই। আমি পুলিসের লোক ঠিক নই-একজন গোয়েন্দা। মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তিনি আমার উপরেই সৃজান বিবিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার ভার দিয়াছেন। তা’ তোমাদের মত দুই-একজন লোক যদি এ সময়ে আমায় সাহায্য না করে, তা হইলে আমি একা কতদূর কি করিতে পারি? ইহাতে শুধু আমার উপকার করা হইবে না-তোমার মনিবেরও যথেষ্ট উপকার হইবে।”
শুনিয়া সাখিয়া মনে মনে সন্তুষ্ট হইল। বলিল, “এমন মনিব আর হয় না! বিবি সাহেবাকে তিনি কত ভালবাস্তেন-একদণ্ড চোখের তফাৎ করতেন না! এমন কি-”
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, “তোমার মনিব সাহেবের ভালবাসার কথা পরে শুনিব; এখন বিবি সাহেবার কথা কি জান, তাহাই আগে বল। একটা ভয়ানক খুনের মামলা ইহার ভিতরে রহিয়াছে।”
চোখ মুখ কপালে তুলিয়া সভয়ে বলিল, “খুন! কে খুন হয়েছে-আমাদের বিবি সাহেবা না কি?”
চোখে দুই ফোঁটা জল আনিয়া লতিমন বলিল, “না সাখিয়া, তোর বিবি সাহেবা নয়-আমাদেরই কপাল ভেঙ্গেছে-দিলজান খুন হয়েছে।”
সাখিয়া বলিল, “তাই ভাল-একটা বেশ্যা মাগী খুন হয়েছে, তার আবার কথা। আমি মনে করেছিলুম, আমাদের বিবি সাহেবা।”
লতিমন রাগিয়া বলিল, “রেখে দে তোর বিবি সাহেবা-সে আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে? তার আবার মান! আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা’ না হ’লেও, সে মনিরুদ্দীন ভিন্ন আর কিছু জানিত না। তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই কিন্লে বল্ দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা’হ’লে আমাদের দিলজানই বা খুন হবে কেন?”
সাখিয়া ক্রোধভরে উঠিয়া কহিল, “বেশ-তোমাদের দিলজান খুব সতী-আমাদের বিবি সাহেবার সঙ্গে তুলনা হয় না! তোমরা যে কেন আমাকে ডেকেছ, তা’ আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি; এখন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই খুন খারাপীটা বিবি সাহেবার ঘাড়ে ফেলিতে চাও; আমি সব বুঝিতে পারি। আমি নিতান্ত আর ছেলে মানুষটি ত নই-আমি তোমাদের এ সব কথায় নেই-আমি কিছুই জানি না, ” বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, আগেই খুনের কথা তুলিয়া নিজে আবার সব মাটি করিয়া ফেলিলেন। এখন আর বিনয় ছলে কিছু হইবে, এমন বোধ হয় না; বলপ্রয়োগ প্রয়োজন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থানোদ্যতা সাখিয়ার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া, সজোরে একটা টান্ দিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিলেন, “আরে ব’স মাগী, যবি কোথায়? যা জনিস্, তোকে এখনই বল্তে হবে-চলাকী করতে গেলে একেবারে পুলিসে চালান্ দিব জানিস্?”
সাখিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িয়া, হাঁউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। এবং এক্ষণে যে ধর্ম্মকর্ম্ম ও ভাল মানুষের দিন-কাল আর নাই, এবং ইংরাজের এত বড় রাজত্বটা সহসা মগের মুল্লুকে পরিণত হইয়াছে, অতিশয় বিস্ময়ের সহিত সে তাহাই বারংবার উল্লেখ করিতে লাগিল।