Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey » Page 19

নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey

জোহেরা সুন্দরী। অসীম রূপ-লাবণ্য তাহার সর্ব্বাঙ্গে ঝল্মল্ করিতেছিল। যৌবনের প্রথম বিকাশে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটা গভীর প্রগাঢ় প্রশান্তভাবে ও সৌন্দর্য্যে জোহেরা যেন ভরিয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু উদ্দাম যৌবনের বসন্ত-চাঞ্চল্যে তাহা এখনও কূলপ্লাবী হয় নাই। মাধুর্য্যে যাহা কিছু-সকলই যেন সেই সুকুমার অবয়বের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে স্ফুটতররূপে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে-বাহিরের চারিদিকে যেন তাহারই কেবল একটা উজ্জ্বল আভা প্রতিক্ষণে ঠিক্রিয়া পড়িতেছে। যেন তাহার অন্তরাকাশের দূর দিগন্ত হইতে মৃদু মলয়ানিল বহিয়া বিশ্বপৃথিবীকে কি এক মোহন বাসন্তীশ্রীতে ডুবাইয়া দিয়াছে। তাহার সেই কুঞ্চিত-কৃষ্ণ-কুন্তলাবলীপরিবেষ্টিত সুন্দর ঢল ঢল মুখখানি নবীন সূর্য্যাগ্রে বিকাশোম্মুখ পদ্মের সৌন্দর্য্যে, সৌকুমার্য্যে, ভাবে ভঙ্গিতে অতি সুন্দর! দেখিলে যেন দর্শন-বুভুক্ষা আরও বাড়িয়া উঠে-যেন তৎপ্রতি চিত্ত আরও আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। উন্নত পরিপুষ্ট দেহ – সেই দেহের তেমনই সুন্দর, বসন্তসমীরসঞ্চালিত, নবপুষ্পিত ব্রততীর মন্দান্দোলনতুল্য সেই দেহের তেমনই কি সুন্দর ললিত কোমল মনোমোহন ভঙ্গী। একবার দেখিলে আর ভুলিতে পারা যয় না। তিমির-তরঙ্গের ন্যায় কেশদাম, অপ্রশস্ত নির্ম্মল ললাট, তন্নিম্নে তুলিকাচিত্রিতবৎ বিচিত্র ভ্রূযুগ, তন্নিম্নে নীলেন্দীবরতুল্য চক্ষু, তন্মধ্যে মধুময় চঞ্চল দৃষ্টি,পদ্মারক্ত অধরপুটে বিমল হাসির লীলা-একবার দেখিলে তাহা হৃদয়ের মর্ম্মকোষে গাঁথিয়া যায়।
জোহেরা যখন বড় বালিকা, তখন তাহার পিতামাতার মৃত্যু হয়। তাঁহাদিগের কথা স্বপ্নের মত এখনও এক-একবার জোহেরার মনে পড়ে। জোহেরার পিতার নাম নাজিব-উদ্দীন চৌধুরী। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত, অতি সদাশয় জমিদার ছিলেন। তাঁহার জমিদারীর আয় বাৎসরিক প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। ইহার উত্তরাধিকারিণী এক্ষণে একমাত্র জোহেরা। নাজিব-উদ্দীন মৃত্যুপূর্ব্বে মুন্সী জোহিরুদ্দীনকে তাঁহার সমগ্র বিষয়ৈশ্বর্য্যের অছি নিযুক্ত করিয়া যান্। এবং যাহাতে পরে তাঁহার একমাত্র কন্যা, সুশিক্ষিতা এবং সুপাত্রে পরিণীতা হয়, সেজন্য তাঁহার প্রধান নায়েব জোহিরুদ্দীনের উপরে তাঁহার একটি বিশেষ আদেশ ছিল।
মুন্সী জোহিরুদ্দীন, নাজিব-উদ্দীনের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন। নাজিবউদ্দীন সকল রকমে তাঁহাকে খুব বিশ্বাস করিতেন। এমন কি সকল বিষয়ে তাঁহাকে নিজের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ মনে করিতেন। তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া তাঁহার নিজের জমিদারীতে তাঁহাকে নায়েবের পদ দিয়াছিলেন। তখন তাঁহার বার্ষিক আয় চল্লিশ হাজার টাকা ছিল, কিন্তু জোহিরুদ্দীনের নৈপুণ্যে তাহা অচিরকাল মধ্যে পঞ্চাশ সহস্রে পরিণত হইল। জোহিরুদ্দীনেরও মাসিক দেড়শত টাকা বেতন আড়াইশতে পরিণত হইল। মৃত্যুপূর্ব্বে নাজিব-উদ্দীন যখন তাঁহাকে সমগ্র বিষয়ের অছি নিযুক্ত করিয়া গেলেন, তখন তিনি তাঁহার বেতন তিন শত টাকা নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন।
জোহিরুদ্দীন মনে করিলে জোহেরার অনেক সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। একান্ত বিশ্বস্তভাবে তিনি নিজের সেই মৃত বন্ধু বা প্রভুর আদেশ পালন এবং নিজের কর্ত্তব্যসাধন করিয়া আসিতেছিলেন। তিনি প্রভু-কন্যাকে সুশিক্ষিতা করিয়া তুলিলেন; কিন্তু অদ্যাপি তাহাকে সুপাত্রে পরিণীতা করিতে পারেন নাই। পাত্রীকে বিষয়ৈশ্বর্য্যশালিনী দেখিয়া পাত্র অনেক জুটিল বটে; কিন্তু কেহই সে সৌভাগ্যলাভে কৃতকার্য্য হইল না। জোহেরা বিবাহে একান্ত নারাজ-শিক্ষার গুণে সে নিজে অনেক পরিমাণে স্বাধীন প্রকৃতির হইয়া উঠিয়াছিল। কেবল তাহাই নহে, মজিদ খাঁ ইতঃপূর্ব্বে তাহার চিত্তহরণ করিয়াছিলেন। মজিদের সহিত জোহেরার বিবাহ হয়, এ ইচ্ছা মুন্সী জোহিরুদ্দীনের আদৌ ছিল না; তিনি জোহেরার জন্য মনিরুদ্দীনকেই সুপাত্র স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু মনিরুদ্দীনের চরিত্রহীনতার জন্য জোহেরা তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত; সুতরাং বিবাহ স্থগিত রহিল। মজিদ ভিন্ন জোহেরা আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না বলিয়া দৃঢ় পণ করিয়া বসিল; কিন্তু মৃত বন্ধুর আদেশ স্মরণ করিয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন কিছুতেই তাহাতে মত দিতে পারিলেন না-অভিভাবকের বিনানুমতিতে জোহেরাও বিবাহ করিতে পারিল না। এখনও সে নাবালিকা-অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া স্বেচ্ছায় কোন কাজই করিতে পারে না; সুতরাং বিবাহ আপাততঃ স্থগিত রহিল। আইনের নির্দিষ্ট বয়সে যখন সে সাবালিকা হইবে, তখন আর তাহাকে অভিভাবকের মুখপ্রেক্ষী থাকিতে হইবে না; তখন সে নিজেি মজিদকে বিবাহ করিতে পারিবে মনে করিয়া, জোহেরা দিনাতিবাহিত করিতে লাগিল। সত্যকথা বলিতে কি, ইহাতে জোহেরা মনে মনে জোহিরুদ্দীনের উপরে অত্যন্ত উষ্ণ হইয়া উঠিল। জোহিরুদ্দীনও মেয়েটাকে এইরূপ অবাধ্য দেখিয়া মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। জোহিরুদ্দীনের ইহাতে বিশেষ কোন দোষ দেখি না, তাঁহার বিশ্বাস, পাত্র সঙ্গতিসম্পন্ন হইলেই সুপাত্র। বিশেষতঃ মনিরুদ্দীন জমিদার-পুত্র; এক্ষণে তিনি নিজে একজন জমিদার, সমৃদ্ধির ইয়ত্তা হয় না। অতএব জোহিরুদ্দীনের মতে তিনি একটি সুপাত্র। তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহ হইলে তাঁহার পরলোকগত প্রভুর আত্মা নিশয়ই সুখানুভব করিবেন, ইহা জোহিরুদ্দীনের স্থির বিশ্বাস। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, নিজের সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতে না পারিয়া জোহিরুদ্দীন জোহেরার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন; কিন্তু মজিদকে তাঁহার সঙ্কল্পসিদ্ধির অন্তরায় হইতে দেখিতে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। মজিদকে তাঁহাদিগের বাড়ীতে আসিতে নিষেধ করিয়া দিলেন। এবং জোহেরাকেও নিষেধ করিয়া দিলেন, সে যেন মজিদের সাক্ষাতে বাহির না হয় ও তাঁহার সহিত কথাও না কহে।
কাজে তাহার কিছুই হয় না। প্রণয় বাধা মানে না-যেখানে বাধা, সেখানে প্রণয়ের চাতুর্য্য প্রকাশ পায়; এবং সেখানে প্রণয় প্রবঞ্চনা করিতে জানে। প্রায়ই জোহেরা ও মজিদ রাত্রে গোপনে গৃহসংলগ্ন উদ্যান মধ্যে মিলিত হইতেন। পরষ্পর পত্র লেখালেখিও চলিত। তাহাতে তাঁহাদের যেন আরও সুখবোধ হইত। মুন্সী জোহিরুদ্দীন আপনার কাজ লইয়া ব্যস্ত, ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিতেন না। তিনি মনে করিয়াছিলেন, জোহেরার সম্মুখ হইতে মজিদকে কিছুদিনের জন্য সরাইয়া ফেলিতে পারিলে, জোহেরার মন পরিবর্ত্তিত হইতে পারে; কিন্তু সেটি তাঁহার মস্ত ভ্রম। বাধাপ্রাপ্ত প্রণয় ভাদ্রের রুদ্ধ নদীর ন্যায় একান্ত খরপ্রবাহ ও কূলপ্লাবী হইয়া উঠে।
মুন্সী জোহিরুদ্দীন লোকটা বরাবরই মিতব্যয়ী। তিনি যৌবনকাল হইতে এই পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত নায়েবগিরি করিয়া নিজেও অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছেন। কলিকাতার মধ্যে পনের ষোলখানি বড় বড় ভাড়াটীয়া বাড়ী তৈয়ারী করিয়াছেন; জায়গা-জমিও কিছু কিছু করিয়াছেন; বেতন ছাড়াও এদিকেও তাঁহার মাসে অন্যূন তিনশত টাকার আয় হইয়া থাকে। সংসারে ব্যয় কিছুই ছিল না-প্রথম যৌবনে একবার বিবাহ করিয়াছিলেন, সন্তানাদি হয় নাই; তাঁহার চল্লিশ বৎসর বয়সে স্ত্রী-বিয়োগ হয়। আট-দশ বৎসর পরে আবার একটী বিবাহ করেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এবারকার স্ত্রীটি একান্ত অমিতব্যয়িনী ছিলেন; কিন্তু সেজন্য জোহিরুদ্দীনের বিশেষ কিছু আর্থিক ক্ষতি হয় নাই-কিছুদিন পরে সেই স্ত্রীটি হঠাৎ তাঁহার স্কন্ধ পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহারই নাম সৃজান।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress