নীলবসনা সুন্দরী : দ্বিতীয় খণ্ড – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দ্বিতীয় পত্র
দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রের নিকট হইতে পত্রখানি লইয়া, খুলিয়া ফেলিয়া তখনই পড়িতে আরম্ভ করিলেন।
“দেবেন্দ্রবিজয়!
এখনও তুমি তোমার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিলে না? ক্রমেই তুমি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিলে। তোমার নিতান্তই মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছে, দেখিতেছি।
মাথায় দুই এক ঘা লাঠী না পড়িলে, তুমি কিছুতেই সোজা হইতেছ না। কেন বাপু, আর মিছিমিছি জ্বালাও? তুমি যে আমাকে কখনও ধরিতে পারিবে, ইহা মনেও স্থান দিয়ো না। আমি তোমার মত অনেক গোয়েন্দা দেখিয়াছি, তোমার চোখের সাম্নে হত্যাকারী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে-আর তুমি তাহাকে দেখিয়াও দেখিতে পাইতেছ না?
এতদিন গোয়েন্দাগিরি করিলে, সাধারণে সুনাম হইয়াছে; আর আমার কাছে তুমি একেবারে বোকা বনিয়া গেলে? কি লজ্জার কথা! এই তুমি পাকা ডিটেকটিভ্? এই তোমার নাম-ডাক? ছি-ছি-ধিক্-ধিক্? সত্যকথা বলিতে কি আমি তোমার মত নিরেট বোকা গোয়েন্দাকে গ্রাহ্যই করি না। আমি তোমাকে বার বার সাবধান করিয়া দিতেছি, আর বেশীদূর অগ্রসর হইয়ো না-একদিন ভারী বিপদে পড়িবে-এমন বিপদে পড়িবে, একদম্ এ জগৎ ছাড়িয়া যাইতে হইবে প্রিয়তম স্ত্রীর বৈধব্য যদি তোমার একান্ত প্রার্থনীয় হয়-তবে আমার উপদেশে কর্ণপাত করিবে না।
আমি তোমাকে একটা সৎপরামর্শ দিতে চাই-শুনিবে কি? তুমি যদি এই কেস্টা ছাড়িয়া দাও, এরূপে আমাকে আর বিরক্ত না কর-আমি তোমাকে কিছু টাকা দিতে পারি, হাজার টাকা-কি বল, মন উঠিবে? যদি রাজী হও, কাল ঠিক রাত নয়টার সময়ে গোলদীঘীর ভিতরে যেয়ো। আমি সেইখানে তোমার সঙ্গে দেখা করিব। আর যদি তুমি আমাকে ধরিবার জন্য লোক বন্দোবস্ত ক’রে রাখ-আমার দেখা পাইবে না। কেবল দেখা পাইবে না নহে, তাহা হইলে বুঝিবে, তোমার মৃত্যু সন্নিকটে। আমি আর তখন তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করিব না। আমি এখনও তোমাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমার কাছে গোয়েন্দাগিরি ফলাইতে চেষ্টা করিয়ো না।
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী।”
এ কি ভয়ানক পত্র! শুনিয়া রেবতীর আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিল। শচীন্দ্র চিন্তিত হইল। বুঝিতে পারিল, তাহার মাতুল মহাশয় এবার একজন শক্ত লোকের পাল্লায় পড়িয়াছেন। শ্রীশচন্দ্র খুব মনোযোগের সহিত পত্রের আদ্যোপান্ত শুনিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমানের ন্যায় মস্তকান্দোলন করিয়া বলিল, “হাঁ, দেখা যাবে!”
শচীন্দ্র বলিল, “আমিও তবে আপনার সহিত যোগ দিব না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, শচী, তুমি এই সেদিন অসুখ হইতে উঠিয়াছ; তোমার শরীর এখনও ভাল রকম সারে নাই। তাহা না হইলেও তোমাকে দরকার নাই; আমি নিজেই সব ঠিক করে ফেলিব।”
শচীন্দ্র বলিল, “পত্রখানা দেখিয়া বুঝিতে পারা যাইতেছে, লোকটা বড় সহজ নহে; তাই বলিতেছিলাম।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোকটা সহজ না হইতে পারে; কিন্তু আমিও তাহার অপেক্ষা বড় সহজ নহি। লোকটা আমাকে ঠিক জানে না; তাহা হইলে কি সে আমাকে এমন পত্র লিখিতে সাহস করে? নারী-পিশাচী জুমেলিয়ার ঘটনা তোমার মনে পড়ে?”
শচীন্দ্র সহাস্যে বলিলেন “খুব! জুমেলিয়ার কথা এ জীবনে ভুলিবার নহে।”
জুমেলিয়ার নামে রেবতীর অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল। পিশাচী তাঁহাকে কত কষ্ট না দিয়াছে-কি ভয়ানক বিপদেই না ফেলিয়াছে-সমুদয় মনে পড়িয়া গেল! রেবতী শিহরিয়া কহিলেন, “সে কি মেয়ে? পুরুষের বাবা!”
শ্রীশ বলিল, “ডাকিনী – ডাকিনী-মাগীটা আমাকে ত আর একটু হ’লেই গঙ্গায় ডুবিয়ে মারত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহার কথা ছাড়িয়া দাও, পিশাচী আমার শিক্ষাগুরু অরিন্দম বাবুকে পর্য্যন্ত নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিয়াছিল। (শচীন্দ্রের প্রতি) অরিন্দম বাবুকে এখিতে গিয়াছিলে?”
শচীন্দ্র বলিল, “হাঁ, এই কতক্ষণ হইল, আমি সেখান হইতে ফিরিতেছি।”
দে। তিনি কেমন আছেন?
শ। বড় ভাল নহে। বোধ হয়, তিনি এ যাত্রা রক্ষা পাইবেন না। একেবারে স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছে। ডাক্তারেরাও চিন্তিত।
দে। এই কেস্টা হাতে লইয়া অবধি আমি কয়দিন একবারও দেখিতে যাইতে পারি নাই-সময় পাই নাই। আমার কথা তাঁহাকে বলিয়াছ যে, আমি একটা খুনের মাম্লা লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি, সেজন্য কয়েকদিন যাইতে পারি নাই?
শ। বলিয়াছিলাম। এই খুনের সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতাম, তাহাও আমি তাঁহাকে সমুদয় বলিয়াছি।
দে। শুনিয়া তিনি কি বলিলেন?
শ। আপনাকে একবার যাইতে বলিয়াছেন।
দে। কিছু মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন?
শ। আপনার নাম করিয়া বলিলেন যে, অনুসন্ধানের ঠিক পথ এখনও অবলম্বন করিতে পারেন নাই।
দে। তা’ হইবে। আজিকার কথা শুনিলে তিনি কখনই এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিতে পারিতেন না। ভাল, দুই-একদিনের মধ্যে আমি একবার তাঁহার সহিত দেখা করিব।
রেবতী বলিলেন, “মা কালী করুন, দাদামশাই যেন শীঘ্র ভাল হইয়া উঠেন। তাঁহার মত সদাশয় পরোপকারী লোক থাকিলে এ জগতের অনেক উপকার আছে। আমাদের জন্য তিনি অনেক করিয়াছেন; তাঁহার কথা চিরকাল মনে থাকিবে। আমি আর একদিন তাঁহাকে দেখিতে যাইব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “চল শ্রীশ, তোমাকে একবার আমার সঙ্গে যাইতে হইবে। আর বিলম্ব করিলে চলিবে না।”
শ্রীশ বলিল, “কোথায়? আমাকে কি করিতে হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যাহা বলিব, তাহই করিতে হইবে। কোন একটা বাগানে তোমাকে লুকাইয়া থাকিতে হইবে। সেখানে দুইজন লোককে পরে দেখিতে পাইবে, একজন স্ত্রীলোক, একজন পুরুষ। তাহাদের কি কথাবার্ত্তা হয়, সব শুনিয়া আসিবে- খুব মন দিয়া শুনিবে, যেন একটি কথাও ভুল বা ছাড় না হয়।”
রেবতী বলিলেন, “আবার এখনই যাইতে হইবে? তবে একটু জল খেয়ে যাও।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন জল খাবার সময় নয়, ঠিক সময়ে পৌঁছাইতে না পারিলে সব মাটি হইয়া যাইবে।”
রেবতী কহিলেন, “একটু মিষ্টি মুখে দিয়া এক গ্লাস জল খাইতে আর কত সময়ে যাইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এতক্ষণ দিলে কথায় কথায় খাইয়া ফেলিতে পারিতাম-এখন আর নয়। এস শ্রীশ, আর বিলম্ব নয়।” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সত্বর উঠিয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িলেন। শ্রীশচন্দ্র তাঁহার অনুসরণ করিল। শচীন্দ্রও সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
রেবতী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া গৃহকার্য্যে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করিলেন।