নীলচাঁদ,কালোচাঁদ ও মলিনমাস (সাহিত্যরসে আকাশ-বিজ্ঞান ও পুরাণ)
সবেধন নীলমণি পৃথিবীর উপগ্রহ একটি– নাম তার চাঁদ , Moon—
রূপের অন্ত নেই, নানা আকারে প্রকারে বিকাশে প্রকাশে, আলোর রোশনাই খেলায় মুগ্ধ যত প্রাণীর বাস তার মায়ের গর্ভে!!!
যদিও চাঁদের মাটির স্পর্শ আমরা পেয়েছি, মাটি নিয়ে এসেছি পৃথিবীতে, তবু আজ অবধি
চাঁদ নিয়ে ত অনেক কাব্য, অনেক গান, অনেক দর্শন, অনেক কল্পনা, অনেক স্বপ্ন অনেক…অনেক…অনেক কিছু, —–
কিন্ত পাই নি “নীল চাঁদ ” ও “কালো চাঁদ” নিয়ে কোন গদ্য, পদ্য, দর্শন, আছে শুধুই বিজ্ঞান। আদিকাল থাক্, আজকের কথা বলি, একটা গান খুব জনপ্রিয়তার শিখরে। প্রতিষ্ঠিত এক গায়কের — “ও, চাঁদ, তোর বান্ধবীদের সঙ্গে যাবো, ও চাঁদ, তোর জন্মদিনে হক্কা খাবো, তোর father যদি জানতে পারে, brother সেজে বক্ষমাঝে ওড়না হবো, ওড়না…. ও চাঁ——দ….” বিষয় গানের বক্তব্য বিচার নয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত যত গান ও কবিতা পেয়েছি, চাঁদ কিন্ত “নারী ” কল্পনায় রঞ্জিত। নারীর রূপের বর্ণনায় অনন্য— সে চাঁদ।
যে শিশুকে ঘুম পাড়ান হতো চাঁদমামার গান শুনিয়ে, সে শিশু বড়ো হয়ে প্রেমিকার রূপ খুঁজে পায় চাঁদের সৌন্দর্যে। কাব্যে, দর্শনে যতই চাঁদকে অপরূপা নারীর সাথে কল্পনা করা হউক না কেন, হিন্দু বৈদিকশাস্ত্রে তিনি সোম, তিনি পুলিঙ্গ, এবং বিশেষ এক দেব। বৈদিক ঋসিদের মতে জীবন ধারণের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় (জড়, উদ্ভিদ ,প্রাণী)রা যাবতীয় সকলই ছিল দেবতার রূপক,স্মরণ করতেন যজ্ঞ পালন করে। আবার ঠিক বেদের অর্থে নয়, তবে পুরাণেও সে এক “গ্রহ” এবং দেবতা। শক্তিশালী পুরুষ –সুদর্শন, সুঠাম, দ্বিভুজবিশিষ্ট– একহাতে সমৃদ্ধ ছড়ি, অপরহাতে সুললিত পলাশ অর্থাত পদ্ম, এক কথায় রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি ।
চরিত্রেও কালিমা আছে, তিনি বৃহস্পতির স্ত্রী “তারা”র প্রেমে পড়েন ও অপহরণ করে আনেন। পরে “তারা ” আবার স্বামী বৃহস্পতির ঘরে ফিরেও আসেন। সোমের সাথে থাকা কালীন তাদের এক পুত্র জন্মায়, সে পুত্র অতি বুদ্ধিমান যিনি বুধ গ্রহ ও দেবতা হিসাবে পরিচিত। তাই বুধের পিতা হলেন সোমদেব বা চন্দ্র। পৃথিবীর সব মাইথোলজিতেই চন্দ্র এক শক্তিমান পুরুষ। কিন্ত আকাশে যে চাঁদ , সে চাঁদের রূপ সত্যিই অতুলনীয়। বাঁকা চাঁদ বা পূর্ণ শশী রাতের আকাশে দেখে কে না মুগ্ধ হয়েছে, কবি, বিজ্ঞানী সকলেই সেখানে একাসনে। পুর্ণচাঁদের ত নানা নাম, সে অনেক কথা।
প্রতিমাসে একটি করে পুর্ণিমা ও একটি করে অমাবস্যা আসে পরপর, চান্দ্রমাস অনুযায়ী। দুটি পূর্ণিমা বা দুটি অমাবস্যার মধ্যে সময় ব্যবধান হলো ২৯.৫৩ দিন। বছরে ১২টি পূর্ণিমা আর ১২টি অমাবস্যা, কিন্ত কখনও ১৩টি করেও হয়ে যায়, একটি বেশি একই মাসে। কখনও পূর্ণিমা, কখনও অমাবস্যা। গণ্ডগোলের শুরু আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানে ঐ সৌরমাস আর চান্দ্রমাসের হিসাব তারতম্যে।
বছরে দিন হলো মোট ৩৬৫/৩৬৬ চান্দ্রমাস ও সৌরমাস এক মিশ্র রীতিতে হিসেব চলে, যেমন মাস গননা চন্দ্র পদ্ধতি হলেও সন গণনা হয় সৌর নিয়মে। সৌরমাসের এপ্রিল মাঝে শুরু হয় বাংলা বৎসর। হিন্দুদের পূজা পার্বন-সহ সকল নিয়ম অনুষ্ঠানও চাঁদের পরিবর্তনের হিসেব অনুযায়ী চলে।
প্রতি তিন সৌর বছর পরে পরে দেখা যায় একটি চান্দ্রমাস বেশি হয়ে যাচ্ছে। তখন ওই মাসটিকে অতিরিক্ত ধরে মূল হিসেব থেকে বাদ দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই অতিরিক্ত মাসকে বলা হয় “অধিমাস” বা “মলমাস” , এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আবার এ কারণে একটি বেশি পূর্ণিমা বা একটি বেশি অমাবস্যাও চলে আসে।যেমন— বাংলা ১৪২৭, এই ভাদ্র মাসেই একটি অমাবস্যা বেশি একের চেয়ে। সে কথাতেও পরে আসছি।
কোন মাসের বাড়তি বা দ্বিতীয় পূর্ণিমা চাঁদকে বলা হয় — “Bluemoon” , ” নীল চাঁদ”। যদিও রঙ তার নীল নয়।
(আক্ষরিক অর্থে নীলাভা চাঁদ কখনও কখনও দেখা যায়, আবহাওয়ার কিছু ধুলিবস্তুকণার (900nm, diameter) উপস্থিতি দরুণ, এরা লাল রশ্মি শোষণ করে ও তার ফলে চাঁদ নীল দেখায়। এ চাঁদ অতি দুর্লভ, সচারাচর দেখা যায় না।)
গত২০১৮ সালে জানুয়ারি ১লা-২রা আর ৩০শে —৩১শে পৃর্ণিমা দরুণ দ্বিতীয়টি Bluemoon” , ” নীল চাঁদ”।
দেখা যায় “সুপারমুন” বৃহদাকার চাঁদ যখন চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে আসে। ২০২০ সালেই ৯ই মার্চ ও ১৮ই এপ্রিল “সুপারমুন” লক্ষিত হয়, শুধু আকারে বড়ো নয়, জ্যোতি রশ্মিও জোরদার।
পূর্ণ শশীর কথা শেষ হবার নয়। চাঁদের কথা এখন থাক।
চান্দ্রমাস ,সৌরমাসে কয়েকটি দিনের গরমিল হেতু বাড়তি মাসটিকে মলমাস বা অধিমাস বলে ও বরবাদ করে দেওয়া হয়, যা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। আবার একটি মাসে দুটি অমাবস্যা পড়লেও(যেমন, ইং২০২০,বাং১৪২৭ বছরে হচ্ছে — ১লা ভাদ্র) ও ৩০শে ভাদ্র ) তার পরবর্তী মাসটিকে “মলিন মাস” বা ঐ মল মাস বলে গণ্য করা হয়।
মাসের দ্বিতীয় অমাবস্যাকে বলে “Blackmoon” “কালোচাঁদ”। গত ৩০শে ভাদ্র ১৪২৭,ঐ অদৃশ্য “কালোচাঁদ” রাতের আকাশে গা-ঢাকা দিয়েছিল, আশ্বিন মাসে শুভকর্মে বাঁধা দেবার জন্য।
মল মাসে কোন শুভকর্ম বা পূজা পার্বন চলে না, শ্রাদ্ধশান্তি ব্যতীত। (২০২০,১৪২৭)মহালয়া ৩১শে ভাদ্র আর মহালয়ার এক মাস বাদে ২৯শে আশ্বিন অমাবস্যার পরে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ মাঝে পড়ে গিয়েছে “মলমাস”— গোটা আশ্বিন মাস বরবাদ ।
চাঁদের কীর্তির অনেক কাহিনী। বিজ্ঞান ও কাব্যে আর বেদ পুরান ও সকল ধর্মেই তাঁর ছোওয়া। বিজ্ঞানীরা চাঁদের মাটিতে পা রেখেও এখনও সে চাঁদ অধরা আর কাব্যে ও ধর্মে রহস্যসত্যে আবদ্ধ।