নিশুতি রাতের ডাক : 03
অরিজিৎ লাহিড়ী বললেন–উজ্জ্বলকুমারের ডেডবডি মর্গে পাঠিয়ে লালবাজারে জরুরি কনফারেন্স সেরে তবে আপনাকে ফোন করেছি। কমিশনার সায়েব খাপ্পা। বলছেন, অমিয় বকসীর মার্ডারের পর কেন মায়াপুরী স্টুডিওর ওপর নজর রাখা হয়নি? ওঁর ধারণা, খুনী স্টুডিওর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো লোক। কিন্তু ব্যাপারটা একবার কল্পনা করুন কর্নেল! একটা বিশাল সিনে স্টুডিও। সেখানে অসংখ্য ছবি হচ্ছে। অসংখ্য লোক কাজ করছে। যাতায়াত করছে। প্রত্যেকের দিকে নজর রাখতে হলে সারা ভারতের আই.বি.র লোক এনে জড়ো করতে হয়।
কর্নেল বললেন–উজ্জ্বলবাবুর বডি প্রথম কার চোখে পড়ে? বডিটা কোথায় পড়েছিল?
-গোড়ার কথাটা আগে বলে নিই। কাল রাত্তির এগারোটা অবধি তপোবন ছবির শুটিং হয়েছে। যতক্ষণ দিনের আলো ছিল, তখন বাইরে বাগানের ওখানে, তারপর স্টুডিওর দুনম্বর ফ্লোরে। ক্যান্টিনে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। উজ্জ্বলকুমারকে শেষ দেখা গেছে রাত নটা নাগাদ। ক্যান্টিনে খেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। তার কাজ দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু বাড়ি যাননি! ভোর ছটা নাগাদ স্টুডিওর একজন মালি বাগানে সিডবেড দেখতে যায়। তারই চোখে পড়ে। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে বডিটা পড়েছিল।
–উজ্জ্বলবাবুর বডি সার্চ করেছ আশাকরি?
করা হয়েছে। সিগারেটের প্যাকেট, গাঁজার পুরিয়া, একটা লাইটার, নগদ ষাট টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা পাওয়া গেছে। আর একটা এক হাজার টাকার বেয়ারার চেক। কিন্তু চেকটা ব্যাংক থেকে ফেরত দেওয়া। সঙ্গে স্লিপ আঁটা আছে? পেমেন্ট ইজ পোপনড বাই দা ডিপজিটার। যিনি চেক দিয়েছেন, তিনিই ব্যাংককে টাকা দিতে বারণ করেছেন।
–কোন্ ব্যাংক?
ফেডারেল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। শ্যামবাজার ব্রাঞ্চ। চেকের সই দেখে নাম পড়া যায়নি।
–এখনই ব্যাংকে খোঁজ নাও, ডিপজিটার কে এবং কোথায় থাকে। আর
অরিজিৎ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন। বলতে চাইলেন, উজ্জ্বলকুমার একজন অভিনেতা। খ্যাতি কমলেও নানা ছবিতে অভিনয় করেন। কাজেই কোনো প্রযোজক, তাকে চেকে টাকা দেবেন, এটা স্বাভাবিক।
কর্নেল বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললেন–উজ্জ্বলকুমার ব্ল্যাকমেলার ছিলেন। অমিয় বকসীকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। চেক ইস্যু করে পেমেন্ট বন্ধ করতে বলা হয়েছে, তাই সন্দেহ হচ্ছে। আর যা বলছিলুম, শিগগির উজ্জ্বলকুমারের বাড়ি সার্চ কর। ওঁর সংগ্রহে যদি কোনো ফোটো এবং ফোটোর নেগেটিভ যত্ন করে গোপনে রাখা থাকে, সেগুলো খুব দরকার। আমি একটু দেখতে চাই।
অরিজিৎ একটু অবাক হয়েছিলেন। হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে ডায়াল করলেন। তারপর মৃদুস্বরে কাউকে কিছু বললেন।
ওঁর ফোন করা হলে কর্নেল বললেন-কমিশনার সায়েব ঠিকই বলেছেন অরিজিৎ! মায়াপুরী স্টুডিওর ভেতর কড়া নজর রাখা উচিত। হ্যাঁ, কাজটা সহজ নয়। তবু যতটা পারা যায়। অন্ত গেটে কড়া চেক-আপ না করে ঢুকতে দেওয়া যেন না হয়।
অরিজিৎ হাসলেন। হিতে বিপরীত হবে না তো কর্নেল! একে তো বাংলা ছবির অবস্থা শোচনীয়। তবু টিমটিম করে যেটুকু চলছে, পুলিসের এরকম কড়াকড়িতে বাধা পাবে না তো? মায়াপুরী ছেড়ে যদি প্রডিউসাররা অন্য সব স্টুডিওতে ছবি করতে ছোটেন, মায়াপুরী কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে পুলিসের বিরুদ্ধে ইনজাংশান আনতে যাবেন!
কর্নেল সমস্যাটা ঠাহর করে বললেন হ্যাঁ। তবে যে কাণ্ড হল–পরপর দুটো খুন, এর পর এমনিতেই সিনেমার লোকেরা মায়াপুরী সম্পর্কে একটু ঘাবড়ে যেতে পারে। আতঙ্ক জিনিসটা সংক্রামক। কাজেই মায়াপুরী কর্তৃপক্ষের। নিজেদের স্বার্থেই উচিত হবে পুলিসের সঙ্গে সহযোগিতা করা। খুনী ধরা পড়লে ওঁরা যেমন আর্থিক লোকসান থেকে বাঁচবেন, তেমনি প্রডিউসাররাও।
অরিজিৎ সায় দিয়ে বললেন–ঠিক, ঠিক। আমরা ওঁদের সঙ্গে এখনই কথা বলে সে করে নেব।
ষষ্ঠী এতক্ষণে কফি দিয়ে গেল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন কাল বিকেলে তোমাকে ফোনে সীমন্তবাবুর স্টুডিও থেকে ছবি চুরি যাওয়ার কথা বলেছিলুম। তাছাড়া অমিয়বাবুকে কে শাসাতে এসেছিল
অরিজিৎ বললেন হ্যাঁ। মায়াপুরী ক্যান্টিনের সুরেশ নামে বয়টির কাছে জানা গেছে, ওইদিন সকালে যখন সে প্রতিভা পিকচার্সের অফিসে চায়ের কাপ আনতে যাচ্ছিল, সিঁড়িতে একটা লোকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। সুরেশ বলেছে, খুব রেগেমেগে বেরিয়ে যাচ্ছিল সে। ক্যান্টিনের আরেকজন বয় খোকার মতো তার চেহারা নাকি। একই বয়স। সুরেশ বলেছে। ওকে তার মনে আছে। কারণ ধাক্কা খেয়ে তারও খুব রাগ হয়েছিল। তাই ঝগড়া করার জন্য সে ঘুরে তাকিয়েছিল তার দিকে। কিন্তু সুযোগ পায়নি। হনহন করে গেট পেরিয়ে চলে যায় লোকটা।
কর্নেল বললেন–এখন কথা হচ্ছে, সীমন্তের স্টুডিও থেকে ছবিটা চুরি গেছে অমিয়বাবুর ডেডবডি পাওয়ার তিন দিন পরে। সেই যুবকটিই যে ছবি চুরি করেছে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। ছবিটির সূত্রে তাকে পুলিস খুঁজে বের করতে পারে ভেবেই সে মরিয়া হয়ে একাজ করেছে, কিন্তু মধ্যে এতগুলো দিন ছবিটার কথা তার মনে পড়েনি কেন?
–হয়তো তলিয়ে এতটা ভাবেনি। অমিয়কে খুন করার তিন দিন পরে তার খেয়াল হয়েছে কথাটা।
–তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ছবিটা সীমন্তের কাছে আছে এবং সীমন্ত সেটা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে এনলার্জ করেছে, সে জানল কী করে?
অরিজিৎ নড়ে বসলেন। হাঁ, এ একটা ভাইটাল প্রশ্ন।
কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন। বললেনসীমন্ত্রে সঙ্গে আবার কথা বলা দরকার। অরিজিৎ, তুমি গিয়ে দেখ উজ্জ্বলকুমারের বাড়ি থেকে কী বেরুল। তুমি আমাকে সেগুলো দেখাতে ভুল না। আর ব্যাংকের ব্যাপারটাও।
অরিজিৎ ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল সীমন্তকে ফোন করলেন গড়িয়াহাটের স্টুডিওতে। সীমন্ত সাড়া দিয়ে বলল–আবার মার্ডার, কর্নেল! মায়াপুরীতে উজ্জ্বলকুমারের ডেডবডি
জানি। তুমি এখুনি একবার আমার কাছে চলে এস…
কর্নেল রাজস্থানের মরু প্রজাপতি দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রজাপতি দুটোর ডানার রঙ একটু বদলেছে যেন। নাকি চোখের ভুল? আতস কাঁচটা মাঝে মাঝে তুলে ওদের দেখছেন। প্রকৃতির রহস্যের কোনো অন্ত নেই। হু, কাল ওই হলুদ ফোঁটাগুলো দেখতে পাননি। পেটের তলাটাও এমন লালচে ছিল না। আশ্চর্য! ওদের আবার কি রূপান্তর ঘটছে? হঠাৎ পুরুষ প্রজাপতিটা মেয়ে প্রজাপতিটার দিকে সরে গেল। দুজনের দুটো ডানা কয়েক সেকেন্ড মিশে গেল। তারপর কর্নেল অবাক হয়ে দেখলেন, দুজনেরই ডানার রঙ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
মানুষের ব্যপারেও যেন তাই। প্রেমিক-প্রেমিকা ঘনিষ্ঠ হবার পর কি একই উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে না? এর মধ্যে স্বর্গীয় সুষমা আছে, অস্বীকার করা যায় না। অথচ মানুষের বেলায় প্রকৃতির আরেকটা নিয়ম ক্রিয়াশীল। ওই সুষমা কালো হয়ে যায় কখনও পাপের ছোপ লেগে। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করতে দ্বিধা করে না। তাহলে কি মানুষের প্রেম ব্যাপারটাই অভিশপ্ত? যতক্ষণ মিলিত না হচ্ছে, ততক্ষণ প্রেমিক ও প্রেমিকা প্রেমের উজ্জ্বলতায় সুন্দর। মিলিত হলেই যেন অভিশাপের বিস্ফোরণ। অমিয় বকসী আর মৃদুলা। অমিয় বকসী আর পারমিতা। মৃদুলা স্লিপিং পিল খেয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য কোনো-কোনো প্রেমিক পুরুষ যেন হাঙ্গরের মতো। বিরাট তাদের সে। সর্বগ্রাসী স্বভাবে হাঁ করে ঘুরে বেড়ায়। অমিয় বকসী–
সীমন্ত এসে গেল ব্যস্ত ভাবে। বাছুদার ফোনে খবরটা পেলুম। আমি আর মায়াপুরীর ত্রিসীমানায় যাচ্ছি না–ওঃ! হরিবল!
কর্নেল ডাকলেন–সীমন্ত!
বলুন! সীমন্ত নার্ভাস ভঙ্গিতে ঘাম মুছতে থাকল।
–তোমার স্টুডিও থেকে ছবিটা চুরি গেছে গতকাল। ভাল করে স্মরণ করে বল, গত কয়েক দিনে-ধর, অমিয়বাবুর মৃত্যুর পরদিন থেকেই তোমার স্টুডিওতে কোন রুক্ষ চেহারার ইয়ং ম্যান ছবি তুলতে গিয়েছিল কি না।
সীমন্ত একটু ভেবে নিয়ে বলল–আমি থাকি বাড়িটার ওপরতলায়। স্টুডিও নিচে। সকাল দশটার আগে খুলি। দুজন লোক আছে আমার। দুজনই ছবি-টবি তোলে। ডেভালাপ ও প্রিন্ট সবই করে। খদ্দেরদের তারাই দেখে। আমি তো তালা খুলে দিয়েই বেরিয়ে যাই মায়াপুরীতে। ফিরি রাত সাতটা-আটটা নাগাদ। কোনোদিন আগেও ফিরি–কোনোদিন একটু বেশি রাত হয়। রাত হলে ওরা বউদিকে ডেকে দরজা আটকাতে বলে। কাজেই আমার পক্ষে তেমন কেউ এসেছিল কি না বলা মুশকিল।
–হুঁ, তুমি সেই মেয়েটির ছবি নিজের হতে এনলার্জ করেছিলে?
–হ্যাঁ। এগুলো আমার নিজস্ব ব্যাপার।
–নেগেটিভটাও তো নিয়ে গেছে?
–সব।
বাড়ির ভেতের দিক থেকে তালা ভেঙেছিল বলছিলে?
-হ্যাঁ। তবে সেটা সোজা। কারণ বাড়ির পেছনে গ্যারেজ আছে। তার ওধারে নিচু পাঁচিল। দারোয়ান থাকে–একেবারে সদর রাস্তার ওপর গেট। কাজেই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ির আড়ালে রাত্রিবেলা কেউ এলে কারুর চোখে পড়ার কথা নয়। সামনেই একটা করিডোর আছে। করিডোরের মাথায় সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির নিচে দিয়ে আমার স্টুডিওতে ঢোকার দরজা। ভেতর দিক বলে মাত্র একটা তালা আটকাই।
কর্নেল চোখ বুজে অভ্যাসমতো দাড়ি টানতে থাকলেন। চোর ছবির খোঁজ করতে এসেছে নিশ্চয়, কিন্তু নিজের ছবি তোলানোর মতো আহাম্মক সে হবে না। তবে কি সীমন্তেরই পরিচিত কেউ সে?
বললেন–ছবিটার প্রশংসা নিশ্চয় অনেকের কাছে করেছিলে?
সীমন্ত বলল হ্যাঁ। তা করেছি। মায়াপুরীতে অনেকের কাছে করেছি। তবে ছবি তাদের দেখাইনি।
-তোমার নিশ্চয় সিনেমা জগতের বাইরেও বন্ধুবান্ধব আছে।
–আছে কিছু। তবে তাদের সঙ্গে বিশেষ দেখা-টেখা হয় না। সময়ও পাই না আগের মতো।
–তাদের কারুর কাছে দৈবাৎ ছবিটার কথা বলেছিলে কি?
সীমন্ত জোরে মাথা নাড়ল।–নাঃ! গত এক মাস যাবৎ বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা হওয়া বা ওই ছবি নিয়ে গল্প করার মতো সময়ই পাইনি।
কিন্তু মায়াপুরীতে অনেকের কাছে ছবিটার কথা বলেছিলে?
-হ্যাঁ। সে তো বললুম। সবাই দেখতেও চেয়েছিল। আসলে ইচ্ছ ছিল ছবিটা নেক্সট অল ইন্ডিয়া ফোটো একজিবিশনে দেব অন্য সব ছবির সঙ্গে।
ব্যাপারটা তাহলে খুব জটিল হয়ে গেল। কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে একটা বড়ো শাস ছাড়লেন। মায়াপুরী স্টুডিওর লোক হলে যুবকটিকে সুরেশ চিনত। কাজেই বাইরের লোক। বাইরের লোক প্রতিদিন মায়াপুরীর ভেতর অসংখ্য আসে। সীমন্ত যখন ছবিটার কথা বলছিল, তখন কি তার কানে গেছে দৈবাৎ? কাছাকাছি উপস্থিত ছিল কি তখন?
– এটা বড্ড বেশি আকস্মিকতা হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য ছবিটার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে তার মায়াপুরীতেই ছুটে আসার সম্ভাবনা। প্রতিভা পিকচার্সের লোকজনের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেও পারে–যদি ছবিটার কিনারা করতে পারে। ছবিটার সঙ্গে তার জীবনমরণ সমস্যা জড়িয়ে থাকার কথা। ছবিটার সূত্রে পুলিস তাকে খুঁজে বের করতে পারত। কারণ ছবির মেয়েটির হয়েই সে শাসাতে এসেছিল অমিয় বকসীকে।
কর্নেল চোখ খুললেন।–আচ্ছা সীমন্ত, ছবির মেয়েটির–আই মিন, ছবিটার মধ্যে তুমি এমন কী দেখেছিলে যে তোমার অত ভাল লেগেছিল এবং একজিবিশনে দেবার কথা ভেবেছিলে?
–আপনাকে তো আগেই বলেছি কর্নেল, কাব্য করে বলা যায় বিষাদ প্রতিমা। সীমন্ত একটু হাসল। তাছাড়া সরলতা। একটা আলাদা এসথেটিক ডাইমেনসন!
–উঁহু, আর কোনো বৈশিষ্ট্য? একটু ভেবে বল!
সীমন্ত সোজা হয়ে বল।–কেন? মেয়েটি সুইসাইড করেছে বলেই তো আমার কাছে
–হোয়াট?
কর্নেলের বাজ ডাকার মতো হাঁকরানিতে সীমন্ত ঘাবড়ে গেল।–হ্যাঁ। অমিয়দা বললেন, মেয়েটি সুইসাইড করেছে। তাই শুনেই তো আমার ইন্টারেস্ট বেড়ে গেল।
কথাটা কাল তুমি বলনি! কর্নেল কণ্ঠস্বর নরম করে বললেন।
–ভুলে গিয়েছিলুম।
কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।–হ্যালো! ডি সি ডি ডিকে চাইছি। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…ফেরেনি এখনও? ঠিক আছে। ফিরলেই প্লিজ আমাকে রিং করতে বলবেন। আমার নাম্বার অরিজিৎ জানে।…ওকে! থ্যাংক ইউ ম্যাডাম!
সীমন্ত মুখ চুন করে বসেছিল। কর্নেল সস্নেহে তার পিঠে হাত রাখলেন। ডার্লিং! টেক ইট ইজি। এ একটা মূল্যবান পয়েন্ট। আশা করছি, স্যুইসাইড কে যখন, পুলিস রেকর্ডে তার ডেডবডির ছবি থাকতেও পারে। বাঁধাধরা নিয়ম কিছু নেই। তবে, বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রে বা সন্দেহজনক কেসে ফোটো রাখা হয়। দেখা যাক।
সীমন্ত আস্তে বলল–দেখলে আমি চিনতে পারবই।
–হুঁ, তুমি ছাড়া আর কে সনাক্ত করবে? বস, একটু কফি খাও। ততক্ষণ আমি একটা ছোট্ট কাজ সেরে নিই। প্রজাপতি দুটোকে কিছুক্ষণ রোদ্দুরে রাখা দরকার।
অরিজিৎ এলেন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। বললেন–আজ দিনটা যে গেল, বলার নয়! আপনি ফোন করেছিলেন শুনলুম। কিন্তু ফোনে অত কথা বলা যেত না। তাই আর রিং করিনি।
কর্নেল ইজিচেরারে বসে দুলতে দুলতে বললেন, বল ডার্লিং!
–উজ্জ্বলবাবুর বাড়ি সার্চ করে আলমারির লকারে একটা খাম পাওয়া গেছে। দেখাচ্ছি। খামের ভেতর একটা নেগেটিভ এবং তার নতুন দুটো প্রিন্ট আছে।
–অমিয় বকসী আর মণিদীপা নামে অভিনেত্রীর ছবি। অশালীন ঘনিষ্ঠতার নমুনা।
অরিজিৎ অবাক হলেন।–আপনি কী করে জানলেন?
–জানব বলেই তো তোমরা আমার সাহায্য চেয়েছ, ডার্লিং! কর্নেল হো হো করে হাসলেন।
অরিজিৎ হাসতে হাসতে অ্যাটাচি খুলে একটা খাম বের করে দিলেন। খামের ভেতর থেকে সেই নেগেটিভ আর দুটো প্রিন্ট বেরুল পোস্টকার্ড সাইজের। কর্নেল প্রিন্ট দুটো দেখে নেগেটিভটা টেবিল ল্যাম্পের সামনে ধরে মিলিয়ে নিলেন। ছবিটা সত্যি অশালীন অবস্থার। মণিদীপার হয়তো তত দোষ ছিল না। ফিল্মের জীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে বাধ্য করেছিল আত্মসমর্পণে। কিন্তু অমিয় বকসী কামনাতাড়িত হয়ে এমন পশু হয়ে যেতে পারেন, ভাবলে অবাক লাগে। স্থানকাল জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না ভদ্রলোকের।
আরও কয়েকটা ছবি–সবই নানা সাইজের প্রিন্ট। বিভিন্ন পোজে তোলা এক মহিলার তিনটে ছবি। দুটো ছবিতে উজ্জ্বলকুমারের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন। তত কিছু সুন্দরী নন। কেন্তু সেক্সি চেহারা। মডেল গার্লদের মতো দেখাচ্ছে। কর্নেল বললেন–এ মহিলা কে?
উজ্জ্বলবাবুর স্ত্রীকে দেখিয়েছি এ ছবি দুটো। উনি বললেন, চিনি না।
–ওঁদের বাড়ির, মানে আর্থিক অবস্থা কেমন দেখলে?
–ভীষণ খারাপ। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। হাতিবাগান এলাকায় একটা ঘিঞ্জি গলির ভেতর বাড়িটা। উজ্জ্বলবাবুর স্ত্রীও রুণ মানুষ। দুটি ছেলে একটি মেয়ে। বড় ছেলে স্বপন নাকি একসময় ভাল ফুটবল প্লেয়ার ছিল। হঠাৎ খেলা ছেড়ে দেয়। এখন দাগী আসামী। গোটাকতক কেস ঝুলছে ওর নামে। অ্যাবসকন্ড করে বেড়াচ্ছে। ছোট ছেলে তপন কারখানায় চাকরি করে। তার নামে থানায় কোনো রেকর্ড নেই। তার আয়েই সংসার চলে। মেয়ের নাম রাখী। রাখী…..অরিজিৎ একটু হাসলেন।
–কী?
–থানার রেকর্ডে দেখলুম রাখী কলগার্ল। কয়েকবার ওকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্রেটনিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ওর বাবার অনুরোধে।
কর্নেল উজ্জ্বলকুমার এবং অপরিচিতা মহিলার ছবিটা দেখতে দেখতে বললেন–উজ্জ্বলবাবুর স্ত্রী কিছু বলতে পারলেন না?
না। বললেন, অনেক মেয়েই তো ওঁর সঙ্গে ছবি তুলত একসময়। তুলতে পেলে ধন্য হত।
তাই বললেন বুঝি?
হ্যাঁ।
–এই একটা ছবি আমি রাখছি। তুমি এক কাজ কর। বাকি ছবির সাহায্যে মহিলাটিকে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা কর।
অরিজিৎ একটু দ্বিধা দেখিয়ে বললেন কাজে লাগবে মনে করছেন?
লাগতেও পারে। হু–এমন যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলেন ভদ্রলোক। তাই মনে হচ্ছে, এই সূত্রটারও গুরুত্ব আছে।
অরিজিৎ খামটা ঢুকিয়ে রেখে একটা নোট বই বের করলেন। বললেন– আর ফেডারেল ব্যাংকেও তদন্ত করা হয়েছে।
কর্নেল ঘুরে বললেন, হু বল!
–চেকটা ইস্যু করেছেন মণিদীপা সরকার। এখন বোম্বাতে হিন্দি ছবির অভিনেত্রী।
–মাই গুডনেস! উজ্জ্বলবাবু মণিদীপাকেও ব্ল্যাকমেইল করতেন তাহলে?
মণিদীপা সম্প্রতি কলকাতা এসেছিলেন একটা ছবির শুটিং-এ। শুটিং হয়েছিল অন্য একটা স্টুডিওতে।
–মণিদীপার সঙ্গে শিগগির যোগাযোগ কর। এই চেকটার ব্যাপারে এক্সপ্ল্যানেশান চাও।
–অলরেডি বলে এসেছি যোগাযোগ করতে।
বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছ, ডার্লিং!
কর্নেল ইজিচেয়ারে আবার দুলতে শুরু করলেন। চোখ দুটো বন্ধ। ষষ্ঠী যথারীতি কফির ট্রে রেখে অরিজিতের দিকে আড়চোখে চাইতে চাইতে ভেতরে গেল। অরিজিৎ বললেন-ষষ্ঠীর কফি কাওয়ার পর অন্য কোথাও কফি রোচে না!
কর্নেল চোখ খুলে চমক খেয়ে বললেন কী করেছে ষষ্ঠী? প্রজাপতি দুটো।
অরিজিৎ হাসলেন,–না, না। ওর কফির প্রশংসা করছি।
কর্নেল সন্দিগ্ধ মুখে উঠে দাঁড়ালেন। উঁহু, একবার দেখে আসি। কিছু বলা যায় না। বলে হন্তদন্ত হয়ে ল্যাবরেটরি ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। মিনিট দুতিন পরে বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে।
ইজিচেয়ারে বসে কফির পেয়ালা তুলে বললেন-জুনের শেষাশেষি ছাদে ওদের একটি ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি করা দরকার। কী ভাবে সেটা করা যাবে, সেই সমস্যা! বড় কাকের উপদ্রব।
অরিজিৎ বললেন–হ্যাঁ, আমাদের আর্টিস্ট ভদ্রলোককে বলেছি, সেই যুবকটির মোটামুটি একটা স্কেচ করে দিতে। ওঁকে মায়াপুরী স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ক্যান্টিন বয় সুরেশের কাছে চেহারার বর্ণনা নিয়েছেন। তাছাড়া সুরেশ বলেছিল খোকা নামে আরেকজন ক্যান্টিন বয়ের সঙ্গে তার চেহারার মিল আছে। খোকাকেও দেখে এসেছেন মোহনবাবু–আর্টিস্ট। জানেন তো কর্নেল? গতবার মোহনবাবুর আঁকা ছবির সঙ্গে ব্যাংক ডাকাত রবি ছেত্রীর চেহারা আশ্চর্যভাবে মিলে গিয়েছিল। জাস্ট বর্ণনা শুনে এঁকেছিলেন মোহনবাবু! খুব ট্যালেন্টেড লোক।
–ছবিটা আঁকা হলে তদন্তের সুবিধে হবে তোমাদের। সব থানার রেকর্ডে রাখা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারবে। যেভাবে হোক, ওকে খুঁজে বের করা দরকার।
অরিজিৎ একটু চুপ করে থেকে বললেন–আপনি কি ওকেই খুনী বলে মনে করছেন?
–অমিয় বকসীকে খুন করার জন্য এখন একমাত্র ওর মোটিভটাই জোরালো দেখছি। কারণ প্রথম কথা, সে অমিয়বাবুকে শাসাতে এসেছিল। দ্বিতীয় কথা, আরও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটা, ছবি চুরি। ছবিটা সে অমিয়বাবুর কাছে ফেরত নিতে আসেনি। কিন্তু যেই অমিয়বাবু খুন হলেন, ব্যাপারটা তার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল। সে যদি দোষী না হয়, তাহলে এই সতর্কতা কেন?
–ঠিক ঠিক। অরিজিৎ সিগারেট ধরালেন। কিন্তু উজ্জ্বলকুমারকে খুনের মোটিভ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব্ল্যাকমেলারের মুখ চিরতরে বন্ধ করা। মণিদীপা ফেঁসে যাচ্ছেন যুক্তিসঙ্গত ভাবেই।
–অরিজিৎ! দুটো খুনেরই মডুস অপারেন্ডি হত্যাপদ্ধতি কিন্তু হুবহু এক। একইভাবে রাতে স্টুডিওর বাগানে মাথার পেছনে হাতুড়ি বা এই জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত। আমার ধারণা, উজ্জ্বলকুমারের বডিটাও উইলফ্রেড কোম্পানির। ক্যান্টিনের চিমনিতে ঢোকানোর ইচ্ছে খুনীর ছিল। যে কোনো কারণে হোক, পারেনি। বডিটা ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
অরিজিৎ শুনছিলেন কান খাড়া করে। কর্নেল থামতেই বললেন–দ্যাটস রাইট! স্টুডিও এরিয়ার ভাঙা পাঁচিলের অংশটাতে উইলফ্রেড কোম্পানি শক্ত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন। অমিয়বাবুর ডেডবডি পাওয়ার পর পুলিস ডিপার্ট থেকে কোম্পানিকে বলা হয়েছিল বেড়া দিতে। স্টুডিও কর্তৃপক্ষকেও বলা হয়েছে শিগগির ভাঙা অংশটা মেরামত করতে। এঁদের তো সবতাতেই গড়িমসি। একটা ডিসিসান দিনতে দশ মাস লেগে যায়। এক সময় মায়াপুরীর অবস্থা কী ছিল, এখন কী হয়েছে ভাবা যায় না।
কর্নেল হাসলেন! বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির দুর্দশার প্রতিফলন ঘটা স্বাভাবিক,ডার্লিং!
যা বলেছেন! বলে অরিজিৎ লাহিড়ী উঠে দাঁড়ালেন।–আসি, কর্নেল! রাত্তিরে তো ঘুম-টুম চলে গেছে। তার ওপর আজ সারাটা দিন যা গেল!
এক মিনিট, অরিজিৎ! এই কয়েকটা পয়েন্ট নোট করে নাও তোমার ডাইরিতে।
অরিজিৎ অ্যাটাচি খুলে নোটবই বের করলেন। বলুন!
কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন–লেখো : (১) অজ্ঞাতপরিচয় যুবক এবং ছবির মেয়েটির সম্পর্কে তথ্য চাই। (২) উজ্জ্বলবাবুর পাশে দাঁড়ানো মহিলার পরিচয় চাই। (৩) উজ্জ্বলবাবুর বড় ছেলে স্বপনের একটি ছবি চাই। (৪) তার বোন রাখীর একটি ছবি চাই। (৫) মণিদীপার ওই চেক সংক্রান্ত একটি বিবৃতি চাই এবং সেই সঙ্গে তার জীবন সম্পর্কে তথ্য–অতীত ও বর্তমান সব তথ্যই চাই। লিখেছ?
হা! আর কিছু?
–লেখো : (৬) ইলেভেন টাইগার্স ফুটবল ক্লাবের কোচ অমর্ত্য রায়ের একটি বিবৃতি চাই।
অরিজিৎ তাকালেন। অমর্ত্য রায়? কেন বলুন তো? –তিনি মণিদীপার প্রেমিক ছিলেন এবং অমিয়র ঘোর শত্রু। –ও! আচ্ছা! তবে ভদ্রলোক বড় টা। এ হার্ড-নাট টু ক্র্যাক!
জানি। এই খুনোখুনি সম্পর্কে ওঁর কী বক্তব্য জানা খুবই দরকার। এই পয়েন্ট থেকে ওঁর বিবৃতি নেবে এবং অ্যালিবাই কী, তাও বিশদ জেনে নেবে। অর্থাৎ অমিয়বাবুর খুনের রাতে কোথায় ছিলেন উনি এবং উজ্জ্বলবাবুর খুনের রাতেই বা কোথায় ছিলেন, কী করেছেন। কথাগুলো সত্য না মিথ্যা, তদন্ত করে দেখার পর আমাকে জানাবে।
অরিজিৎ একটু ইতস্ততঃ করে বললেন বরং আমার সঙ্গে আপনি চলুন না একদিন। ওঁকে ময়দানে ক্লাবের টেন্টেই পাওয়া যাবে সকালের দিকে। আটটার মধ্যে যেতে হবে। আপনার চোখ দিয়ে এঁকে যাচাই করার মূল্য অনেক বেশি!
কর্নেল হাসলেন–ঠিক আছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমাকে জানিয়ে দিও।
অরিজিৎ ঝটপট নোটবই অ্যাটাচিতে ঢুকিয়ে বললেন–আসি কর্নেল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল হাসছিলেন। আরও পয়েন্ট নোট করার ভয়ে বেচারা কেটে পড়ল। স্বাভাবিক সেটা। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল খুব ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছে। ওপরতলার তাগিদে তার মতো অফিসারকেও গা ঘামাতে হচ্ছে। না হলে চেয়ারে বসে হুকুম চালিয়ে ক্ষান্ত থাকত। ওর দোষ নেই। আজকাল এরকমটি হয়েছে। প্রশাসন যন্ত্রের জগদ্দল নড়তে চায় না সহজে। ভাগ্যিস অমিয় বকসীর প্রযোজক ছিলেন রথীন্দ্র কুশারী–কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যাঁর আত্মীয় এবং স্বয়ং কমিশনার সায়েব সুহৃদ!
সমস্তটা এখনও জটিল। জটিলতর হয়ে উঠছে। রহস্যের প্রগাঢ় অন্ধকারে এক পা এক পা করে সাবধানে এগুতে হচ্ছে। শুধু একটা ক্ষীণ–অতি ক্ষীণ সূত্র বহু দূরের আলোর বিন্দুর মতো আভাস দিচ্ছে যেন। ওভেনের চিমনি! নরকের আগুনে পাপীর শাস্তি।
আবার চোখ বুজলেন কর্নেল। আলোর বিন্দুটা একটু ঝিকমিক করল যেন। সিনেমার একজন পরিচালক, তারপর একজন অভিনেতাকে নরকে ঢোকানোর ইচ্ছা খুনীর। কে এই খুনী? কোনো নীতিবাগীশ উন্মাদ–ম্যানিয়াক নয় তো, যে মনে করে সিনেমা মানুষের নৈতিক পতন ঘটাচ্ছে?
তাহলে বেছে বেছে প্রথমে অমিয় বকসী, তারপর উজ্জ্বলকুমারকে কেন? এঁরা দুজনে ব্যক্তিগতভাবে কতটুকু দায়ী এই ব্যাপক সামাজিক অধঃপতনের জন্য?
কর্নেল মনে মনে একটু চমকে উঠলেন। ব্যক্তিগত-ভা-বে! হু, খুনী ওঁদের ব্যক্তিগতভাবেই দায়ী করেছে যেন। চোখ খুলেই দেখলেন লোডশেডিং। ঘরে অন্ধকার। ষষ্ঠীকে আলোর জন্য ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন। যতক্ষণ না সে নিজে থেকে আলো আনে, ততক্ষণ অন্ধকারেই তার চিন্তাশক্তি বেশি সক্রিয় থাকবে।
সকাল দশটা নাগাদ রথীন্দ্র কুশারী এলেন। সঙ্গে একটি যুবতী। ছিপছিপে চেহারায় মাদকতা আছে। স্লিভলেস ব্লাউস, মেরুন রঙের সিন্থেটিক ফাইবারের শাড়ি পরনে। প্লাক করা ভুরু একটু উঁচুতে আঁকা। ঠোঁটে গাঢ় রঙ শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা এবং সেই রঙের টিপ। নাকের বাঁ দিকে সরু রিং। চুলেও ফ্যাশান ছমছম করছে। কর্নেল তাকে দেখে নিয়ে বললেন, বসুন মিঃ কুশারী!
রথীন্দ্র বললেন–উজ্জ্বলের মেয়ে রাখী। হঠাৎ আমার কাছে হাজির। কীসব অদ্ভুত কথাবার্তা বলল, মাথায় ঢুকল না। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলুম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমি এঁকে খুঁজছিলুম। ভালই হল। বলুন কি আপনার কথা?
রাখী আস্তে বলল–আমাকে তুমি বললে খুশি হব স্যার!
–বেশ, বেশ! বল!
ম্যানিকিওর করা আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে রাখী ধরা গলায় বলল–কথা আমার বড়দা স্বপন সম্পর্কে। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, বাবাকে সেই মার্ডার করেছে। অমিয়বাবুকেও। ওর শাস্তি হওয়া দরকার।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন–কেন সন্দেহ হচ্ছে তোমার?
রাখী মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল বড়দা খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে মাস্তান হয়ে গিয়েছিল। ওর নামে পুলিসের ওয়ারেন্ট ঝুলছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাড়ি আসে। আবার চলে যায়। মার্ডার হবার একদিন আগে–সেদিন। ছিল সানডে, বাবা বাড়ি ছিলেন। ড্রিংক করেছিলেন। তখন রাত এগারোটা হবে। বড়দা এল সেই সময়। বাবা ওকে দেখে বললেন–অমিয়কে মেরেছিস। তোকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাব। অমিয় আমাকে অমর্ত্যের ভয়ে টাকা দিত মাসে মাসে। তুই আমার রোজগার বন্ধ করে দিলি!
বড়দা বলল-বেশ করেছি। এবার তোমাকেও জানসুদ্ধ মেরে দেব। তুমিই নন্দিতাকে অমিয়র সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়েছিলে–সিনেমায় নামার লোভ দেখিয়ে। অমিয় ওর সর্বনাশ করে ছেড়েছিল। বেচারী শেষ পর্যন্ত সুইসাইড করে মরল। এ কি আমি সহজে ভুলব ভেবেছ? বাবা বলেও খাতির করব না।
বাবা খুব রেগে গিয়ে বললেন,–থাম, তোকে ধরিয়ে দিচ্ছি। রোজ তুই মায়াপুরী স্টুডিওর ভেতর ঘুর ঘুর করে বেড়াস, দূর থেকে দেখতে পাই। পুলিসকে বলব, ওত পেতে থাকবে।
বড়দা সঙ্গে সঙ্গে ড্যাগার বের করল। তপুদা–আমার মেজদা এসে না ধরলে তখনই ও বাবাকে স্ট্যাব করত। তারপর শাসাতে শাসাতে চলে গেল। বাবা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন–তোরা সাক্ষী রইলি। সুপু আমাকে খুন করবে বলে গেল।
নন্দিতা কে?
বড়দার সঙ্গে লাভ অ্যাফেয়ার ছিল। আমার এক বন্ধু ছিল সে।
–এক মিনিট। বলে কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করলেন। প্লিজ পুট মি টু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী। হ্যালো অরিজিৎ! কর্নেল বলছি। শোন– তোমার আর্টিস্ট কি ছবিটা এঁকেছে? উজ্জ্বলবাবুর ছেলে স্বপনের সঙ্গে মিল আছে তো? আরে না না, অন্তর্যামী হব কোন্ দুঃখে? হা–সেই যুবকটির নাম স্বপন। ছবির মেয়েটির নাম নন্দিতা। জাস্ট হোল্ড অন! বলে ফোনের মাউথপিসে হন্তদন্ত রেখে কর্নেল রাখীর দিকে ঘুরলেন। নন্দিতা কী? কোথায় থাকত?
রাখী বলল-নন্দিতা দাশগুপ্ত। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। মা ছাড়া কেউ নেই।