নিশুতি রাতের ডাক : 02
রান্নাঘর নিয়ে সিনেমা? ভারি অদ্ভুত তো!
না, ওভেন অর্থাৎ তন্দুর বলতে পারেন। তবে ওটা ছিল ছবির থিম।
–সোজা কথায় উনুনকে কেন্দ্র করে সিনেমা।
ঠিক বলেছেন। উইলফ্রেড কোম্পানির ক্যান্টিনের কিচেনে কিছু ব্রিটিশ যুগের প্রকাণ্ড উনুন আছে। বিলিতি উনুন আর কি! রেলের ইঞ্জিনের চুল্লীর ঢাকনা খুললে যেমন আগুনের হলকা বেরোয়, তেমনি এগুলো থেকেও বেরোয়। পাতালে কয়েক দিন ছবিতে থিমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ডিরেক্টর ভদ্রলোক।
দারুণ আইডিয়া বলা যায়। নতুনত্বের চমক আছে।
–হ্যাঁ, কর্নেল। অমিয় বকসীর প্রত্যেকটি ছবিতে এমনি অদ্ভুত সব চমক থাকত।
–কিন্তু তার ডেডবডি পাওয়া গেছে চিমনির ভেতরে তো? উনুনে নয়?
–ঠিক। পোস্টমর্টেমে মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে, মাথার পেছনে ভোতা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত। বাইরে কোথাও ভদ্রলোককে ওইভাবে মেরে চিমনির ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছিল খুনী। শরীরে অনেক জায়গা পুড়ে গিয়েছিল চিমনির ভেতরকার তাপে।
–হুঁ, খুনীর রসবোধ আছে ডার্লিং!
–কেন বলুন তো?
–ছবির নাম শুনে বুঝতে পারছি পাতাল বলতে নরক মিন করছে। ঈশ্বর পাপীদের নরকের আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেন। তাই না? খুনী যেন ঈশ্বরের ভূমিকা নিতে চেয়েছে।
–মাই গুডনেস! এই অ্যাঙ্গলটা তো আমি ভাবিনি।
অমিয় বকসীর অতীত জীবনেই এই হত্যাকাণ্ডের বীজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব, অরিজিৎ! আমার বরাবরকার থিওরি হল, খুনীর পেছনে ছুটোছুটি না করে আগে যে খুন হয়েছে, তার পেছনে ছুটোছুটি করলেই খুনীকে পাওয়া যাবে। তবে তোমরা একালের তদন্ত পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। এ বৃদ্ধের কথা
–প্লিজ কর্নেল! আমরা বিপন্ন শুধু নই, অত্যন্ত অসহায় বোধ করছি এই কেসে।
-কেন বল তো?
সিনেমা প্রযোজক রথীন্দ্র কুশারী এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আত্মীয়। শুধু তাই নয়, উনি আমাদের কমিশনার সাহেবেরও ক্লাসফ্রেন্ড।
–অরিজিৎ, আমি ইদানীং অপরাধ-রহস্যের চেয়ে প্রকৃতি রহস্য নিয়ে মেতে উঠেছি। প্রথম কথা, বয়স হয়েছে। গত এপ্রিলে গেছে আমার পঁয়ষট্টিতম জন্মদিন। দাড়ি আরও সাদা হয়েছে। টাক আরও চওড়া হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কথা–আজকাল হত্যাকাণ্ড ব্যাপারটাই হয়ে উঠেছে ডালভাত। হত্যাকারীকে আর বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। দক্ষতার দরকার হয় না। প্রকাশ্যে অসংখ্য লোকের সামনে সে হত্যা করতে পারে। শাস্তির ভয় করে না সে। ডার্লিং আমি হয়তো আগের যুগের মানুষ। হত্যাকাণ্ড আমার কাছে দস্তুরমতো একটা আর্ট বলে মনে হয়েছে নারকীয় আর্ট তো বটেই। শয়তানের শিল্পকলা! শয়তানের প্রকৃত অনুচর সেই সব হত্যাকারীরা আর কোথায়, যাদের সঙ্গে বুদ্ধির জটিল খেলায় নামব? আইনশৃঙ্খলারও সে ছিল এক স্বর্ণযুগ। তাই অপরাধী হওয়া সহজ ছিল না। দস্তুরমতো বুদ্ধিবৃত্তি, চাতুর্য ও নিপুণ ক্ষমতা না থাকলে বিশেষ করে হত্যাকারী হওয়া কঠিনই ছিল। আজ আমার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্লভ, অরিজিৎ। এ কথায় তুমি আমাকে দাম্ভিক ভাবতে পার। কিন্তু আমি
কর্নেল! প্লিজ, শুনুন। অমিয় বকসীর কেসটা কি তেমন নয়? আমরা তো হিমশিম খাচ্ছি।
হু, অমিয় বকসীর খুনী চতুর। তার ঘটে কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ডেডবডি চিমনির ভেতরে ঢুকিয়ে রাখার তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা অরিজিৎ, চিমনির কপাটে কোনো হাতের ছাপ পেয়েছ কি?
–পেয়েছি। কিচেনবয় ফাগুলালের। সেই কপাট খুলে ডেডবডি দেখতে পেয়েছিল।
স্টুডিও এলাকায় খুঁজেছ কি?
–কোনো সূত্র পাইনি। অমিয়বাবুর ড্রাইভার কমলবাবু বলেছেন, রাত সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে ডিরেক্টর সাহেব তাকে অপেক্ষা করতে বলে স্টুডিওর বাগানের দিকে যান। তিনি ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করে একজনকে নিয়ে খুঁজতে বেরোন। পাত্তা না পেয়ে ফিরে আসেন। গাড়িতেই শুয়ে রাত কাটান। ভোরে বরানগর ফ্ল্যাটে গিয়ে খোঁজ করেন। কিন্তু অমিয়বাবু ফেরেননি। তারপর উইলফ্রেড কোম্পানির কিচেনের চিমনিতে–
বুঝেছি। খুনীর সঙ্গে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল স্টুডিওর বাগানে।
–সেটা আমরাও অনুমান করেছি। যাই হোক, এই কেসে আপনার সাহায্য চাইছি। আপনি বেসরকারি লোক হওয়ার দরুন আপনার যে সব সুবিধে আছে, আমাদের তা নেই। আপনি পুলিস ডিপার্টের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। কর্নেল, আমি আপনার বরাবরকার এক অনুরাগী ভক্ত। বুড়ো হাড়ে ভেলকির খেলা না কি বলে যেন, একবার দেখিয়ে দিন প্লিজ!
–আমাকে তাতাচ্ছ ডার্লিং! ওক্কে। দেখছি কী করতে পারি।…
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বাঁ হাতে একটা মাটি খোঁড়ার খুরপি। ছাদে বিচিত্র প্রজাতির সংগৃহীত ক্যাকটাস, অর্কিড, আরও সব গাছের বাগানে ভোরবেলা থেকে পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ পুলিসের ডিটেকটিভ ডিপার্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ীর ফোন।
একটা শ্বাস ছেড়ে বাথরুমে গেলেন কর্নেল। ভৃত্য ষষ্ঠীচরণকে ডেকে খুরপিটা যথাস্থানে রাখতে বলে কফির হুকুম দিলেন। তারপর হাত ধুয়ে ড্রয়িং রুমের কোণের টেবিলে গেলেন। সচ্ছিদ্র জারের ভেতর রাজস্থানের মরুপ্রজাপতি দুটো চুপচাপ বসে আছে। জুলাই নাগাদ যদি ডিম পাড়ে, একটা দারুণ ব্যাপার হবে।
রাজস্থানের লোকাস কনট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের আমন্ত্রণে গিয়ে এই প্রজাপতি দুটো বাড়তি লাভ হয়েছে। ইচ্ছে আছে, অক্টোবরে আবার একবার ওই অঞ্চলে যাবেন। এদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড খুঁজে বের করবেন।
টুং করে ঘণ্টা বাজল। কেউ বিরক্ত করতে আসছে। কর্নেল ষষ্ঠীকে ডাকার আগেই তার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা ড্রয়িংরুমে হাজির। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। কিন্তু মুখে ও বাকি শরীরে যৌবনের স্পর্ধিত লাবণ্য আছে। তবু এক পলক তাকিয়েই বুঝলেন ওই লাবণ্যের ওপর যেন বিষাদের আবছায়া।
নমস্কার কর্নেল! আমার নাম পারমিতা সান্যাল।
কর্নেল শান্তভাবে বললেন–বসুন।
পারমিতা সোফার একপ্রান্তে বসে মৃদুস্বরে বললেন–আপনার কথা আমি জয়ন্ত চৌধুরীর কাছে সুনেছি। দৈনিক সত্যসেবকের স্পেশাল রিপোর্টার জয়ন্তকে তো আপনি চেনেন। আপনার অনুচর বলে নিজেকে সে।
–হ্যাঁ। ও তো এখন স্টেটসে আছে। নভেম্বরে ফিরবে লিখেছে।
–জয়ন্ত আমার দূরসম্পর্কের ভাই।
কর্নেল হাসলেন। তাই বুঝি? তাহলে তো আপনি আমার আপনজন!
প্লিজ, আমাকে তুমিই বলুন। আমার ডাকনাম মিতা। মিতা বললে খুশি হব।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বললেন–তুমি কী কর?
–অধ্যাপনা, মূরলীধর গার্লস কলেজে। পারমিতা কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন। কর্নেল, আমি এসেছি একটা ব্যাপারে। আপনার সাহায্যের আশায়।
কর্নেল তাকালেন। পারমিতার সিঁথিতে সিঁদুর নেই। অবশ্য আজকালকার শিক্ষিকা কালচার্ড বধূদের কেউ কেউ সিঁদুর পরে না। শাঁখা-নোয়া তো দূরের কথা। একটু হেসে বললেন–তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হব। কিন্তু সমস্যা হল, আমি ইদানীং নিজের কিছু হবির ব্যাপারে এত ব্যস্ত যে বাইরের কিছুতে মন দিতে পারি না। তবু তুমি যখন জয়ন্তর দিদি বলে পরিচয় দিয়েছ, তখন তোমার কথায় কান না দিয়ে উপায় কী? বল!
–আপনি কি বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক অমিয় বকসীর নাম শুনেছেন?
কর্নেল অবাক হয়ে বললেন। কিন্তু তিনি তো সম্প্রতি খুন হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?
পারমিতা মুখ নামিয়ে বললেন–আপনাকে বলতে সংকোচ নেই। আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। হয়তো কিছুদিন পরে আমরা বিয়ে করতুম। আমি এর আগে একজনকে বিয়ে করেছিলাম। সেই বিয়ে টেকেনি।
–অমিয়বাবু শুনেছি বিপত্নীক ছিলেন?
–হ্যাঁ। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় বহুকালের। বছর দশেক আগে অমিয় স্কটিশে অধ্যাপনা করত। সেই সময় ও বিয়ে করে এক ভদ্রমহিলাকে। এই মহিলা ছিলেন ডিভোর্সি। তার আগের স্বামী সম্পর্কে কিছু জানি না। বয়সে অমিয়র চেয়ে কিছু বড়ই ছিলেন। আগের পক্ষের একটি মেয়ে ছিল। তার বয়স তখন বছর দশেক। নাম ছিল অপালা। আর তার মায়ের নাম মৃদুলা।
–অপালা কার কাছে থাকত?
-মায়ের সঙ্গে অমিয়র কাছে। ওর দাদামশাই, অর্থাৎ মৃদুলার বাবা একসময় বড়লোক ছিলেন। কিন্তু চরস আর মদে সর্বস্বান্ত হয়ে মারা যান। আর কোনো সন্তানাদি ছিল না। কাজেই বুঝতে পারছেন, অপালাকে কোথাও রাখার জায়গা ছিল না। তবে অমিয় ওকে ভীষণ স্নেহ করত। যাই হোক, তারপর অমিয় সিনেমা করতে নামে। অধ্যাপনা ছেড়ে দেয়। সিনেমায় খুব নাম হয় তার। সেই সময় একদিন মৃদুলা আত্মহত্যা করেন স্লিপিং পিল খেয়ে। তার কিছুদিন পরে স্কুল থেকে অপালা আর বাড়ি ফেরেনি।
–ইন্টারেস্টিং! তারপর?
–অমিয় অপালাকে ভীষণ স্নেহ করত। গত তিন বছর সে সিনেমা ছেড়ে দিয়েছিল, তার কারণ নিয়ে সিনেমা পত্রিকায় নানারকম গুজব রটেছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আমি জানি। সে অপালাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল পাগলের মতো।
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। সোজা হয়ে বসে কফিতে চুমুক দিলেন এবং চুরুট ধরালেন। বললেন–অপালার কোনো আশ্রয় ছিল না বললে। কিন্তু তার বাবা তো ছিলেন!
–ছিলেন নিশ্চয়। কিন্তু আমি তার সম্পর্কে কিছু জানি না। অমিয়ও জানলে আমাকে বলত।
–এমন তো হতে পারে অপালা তার বাবার কাছে চলে গিয়েছিল।
হতে পারে। কিন্তু অমিয় তাদের খুঁজে বার করতে পারেনি। মাসতিনেক আগে সে বরানগরে ফ্ল্যাট নিল আমার কথায়। আগে থাকত শ্যামবাজারে। আমার কথায় সে আবার সিনেমা করতে গিয়েছিল। কারণ আমি বুঝতুম, একটা কিছু নিয়ে ওর থাকার দরকার। খুব খামখেয়ালী স্বভাবের মানুষ ছিল অমিয়।
–হুঁ। পাতালে কয়েক দিন ছবির গল্পটা কার?
–ওর নিজের। স্ক্রিপ্টটা প্রতিদিন একটু করে লিখত আর আমাকে শোনাত।
…পারমিতা রুমালে ঠোঁট মুছে বলল, এই ছবিটাতে ওর ভীষণ ইনভলভমেন্ট দেখে অবাক লাগত আমার।
ছবির গল্পটা কিছুক্ষণ আগে অরিজিতের কাছে ফোনে সংক্ষেপে শুনেছেন কর্নেল। এক সংগ্রামী তরুণের উত্থান ও পতনের কাহিনী। একটি কারখানায় সে কাজ করত। মালিক একজন বিধবা সুন্দরী মহিলা। নায়কের প্রেমে তিনি পাগল। তার ফলে নায়ক একদিন উঠে এল ওরতলায়। কিন্তু সে মহিলাটিকে ঘৃণা করে। তার প্রেম অন্য একটি কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে। কাজেই তাকে আবার পথে নামতে হয়। গল্প হিসেবে খুবই মামুলি। কিন্তু অমিয় অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া একটা প্রচণ্ড চমকও রেখেছিলেন। নায়ক শেষ মুহূর্তে আবিষ্কার করে যে তার তরুণী প্রেমিকা অন্য কেউ নয়, সেই মালিক মহিলারই কুমারী জীবনের পরিত্যক্ত সন্তান। নায়ক অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করে। কারণ তার প্রেমিকার মায়ের সঙ্গে সে একদা একই শয্যায় শুয়েছে। সেই সময়টাই তার নরকের বা পাতালের কয়েকটি দিন।…
কর্নেল বললেন তুমি আমার কী সাহায্য আশা করছ, মিতা?
পারমিতার চোখ দুটো মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। তারপর কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। দ্রুত রুমালে চোখ দুটো মুছে বললেন–অমিয়কে এভাবে কে খুন করল আমি জানতে চাই, কর্নেল!
–শুধু জানতে? কর্নেল স্থিরদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন–কেন মিতা? তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
পারমিতা একটু চুপ করে থেকে বললেন–আপনি বাংলা ছবি দেখেন কি জানি না।
মাঝে মাঝে দেখি বৈকি?
–এক সময়কার নামকরা হিরো উজ্জ্বলকুমারের সঙ্গে অমিয়র শত্রুতা চলছিল। অমিয়র ছবিতে সে হিরো হতে চাইছিল। কিন্তু তার বয়স প্রায় চল্লিশ। তাছাড়া নেশা-টেশা করে চেহারাও নষ্ট করে ফেলেছে। তাকে অমিয় নেবে
কেন? অমিয়কে সে প্রায়ই শাসাত। বলত, টালিগঞ্জে ঢুকতে দেবে না। অমিয়র কাছে শুনেছি, তার নাকি হাতে অনেক মস্তান আছে। অমিয় একটু ভয়ও করত ওকে। ঘটনার দিন পাঁচেক আগে, অমিয়র এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সীমন্ত আমাকে বলেছিল, তাকে উজ্জ্বলকুমার শাসিয়ে বলেছে, তোমার ডিরেক্টরকে বল, পাতালে কয়েক দিন করতে গিয়ে নিজেই না পাতালে ঢুকে পড়ে।
কথাটা অমিয়কে বলেছিলুম। অমিয় বলল–ছেড়ে দাও! মাতালের ঠাট্টায় কান দেবার সময় নেই। আর সীমন্তটাও ওকে এত ভয় পায়!
আমি বললুম–ভয় তো তুমিও পাও!
অমিয় হাসতে হাসতে বলল–তা পাই। ওকে তো কিছু বিশ্বাস নেই! তবে ও আমার এক তিল ক্ষতি করতে পারবে না। বাচ্চুর সঙ্গে পুলিসের খুব খাতির আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাচ্চুর কানে তুলে দেব। লালবাজার লকআপে নিয়ে তুলবে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট কামড়ে ধরে অভ্যাসমতো দাড়ি টানছিলেন। বললেন–হুঁ। অমিয়বাবু আর কোনো শত্রুর কথা বলেছিলেন তোমাকে?
না। আর একটা কথা, ঘটনার একদিন আগে সন্ধ্যার পর গিয়ে ওকে ভীষণ অন্যমনস্ক দেখেছিলুম। আমি রাগ করে চলে আসি একটু পরে। এখন মনে হচ্ছে, ওর অন্যমনস্কতার পেছনে কিছু কারণ ছিল নিশ্চয়। আর তা জানার উপায় রইল না।
–ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর কোথায় থাকেন? ঠিকানা জান?
–সীমন্ত থাকে গড়িয়াহাটের মোড়ে। ওর নিজের একটা সাধারণ স্টুডিও আছে। মুনলাইট নাম। তবে ওকে টালিগঞ্জে মায়াপুরীতেও পেয়ে যাবেন।
–প্রডিউসার ভদ্রলোককেও আশাকরি ওখানে পাব?
–হ্যাঁ। ওখানে ওঁদের অফিস আছে।
কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন হঠাৎ।–একটা প্রশ্ন করছি। অন্যভাবে নিও। না। আমার এটা জানা দরকার।
পারমিতা চোখ তুলে শান্তভাবে বললেন-বলুন, কর্নেল!
সচরাচর সিনেমা লাইনে যারা থাকেন, মানে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাই বলছি–সুন্দরীদের সঙ্গে তাদের প্রচুর যোগাযোগ ঘটে। সেটা স্বাভাবিকও বটে! অমিয়বাবুর সঙ্গে
কথা কেড়ে পারমিতা বললেন বুঝেছি, আপনি কী বলতে চাইছেন। সংকোচ করার মানে হয় না। ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, অমিয়কে আমি কখনও সাধুসন্ত ভাবিনি। জীবনের স্বাভাবিক ধর্মের বাইরে কজন যেতে পারে আমি জানতুম, অমিয়র সঙ্গে অনেকেরই সম্পর্ক ছিল। ও নিয়ে আমি মাথা মাইনি। মেনে নিয়েছিলুম।
–কোনো বিশেষ নাম উল্লেখ করতে পার?
পারমিতা একটু ভেবে নিয়ে আস্তে বললেন–নীতা নামে একজন নায়িকা আছে। একসময় অমিয় তার ভীষণ অনুরাগী ছিল। আরও একজনের কথা। জানি। শ্যামলী। সে ক্যাবারে ড্যান্সার। শ্যামলীর জন্য অমিয় একবার মার খেয়েছিল। সেকথা এতদিন পরে সীমন্তর কাছে শুনলুম। সীমন্ত কাল সন্ধ্যায় আমার কাছে গিয়েছিল।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। হু, অমিয়বাবুর প্রতি অনেকেরই আক্রোশ থাকা সম্ভব। ঈর্ষাও থাকতে পারে অনেকের প্রফেশন্যাল জেলাসি আর কি!
তাছাড়া অসংখ্য নতুন মেয়ে সিনেমায় নামবার জন্য অমিয়র কাছে। আসত। আমি জানি, অমিয় তত কিছু মহাপুরুষ ছিল না। কিন্তু সেজন্য আমি ওকে দোষ দিই না। লাইনটাই হয়তো এরকম সব সময়। লোভের ফাঁদ পাতা।
কর্নেল মনে মনে একটু হাসলেন। হয়তো একেই বলে বিশুদ্ধ প্রেম। পারমিতা এত সব জেনেও অমিয়কে ভালবেসে এসেছে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে অমিয়কে আইনসম্মতভাবে পাবে বলে। এদিকে বয়স গড়িয়ে এসেছে যৌবনের অপরাহ্নের দিকে। তবু মিলনদিনের প্রতীক্ষা। আশ্চর্য মানুষের জীবনের এই বাসনাকামনার ব্যাপারটা! যাকে ভালবাসি, তার সাতখুন মাফ। তুমি যা কিছু কর, ক্ষতি নেই–শুধু আমার হও। একটা পজেসনের মনোবৃত্তি যেন–অধিকার করার গুঢ় বাসনা। এই বাসনারই কি পরোক্ষ প্রকাশ ঘটে সম্পত্তি অর্জনে?
কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। চিন্তা কর না। তবে ব্যাপারটা খুবই জটিল মনে হচ্ছে। খড়ে গাদা থেকে সুচ খুঁজে বের করার মতো।
পারমিতা নিজের নাম ছাপানো একটা কার্ড রেখে চলে গেলেন। কর্নেল পেছনে দুটো হাত রেখে পায়চারি করতে থাকলেন। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুটটা নিভে গেছে কখন।
পরদিন উজ্জ্বলকুমারকে পাওয়া গেল মায়াপুরী স্টুডিওতে দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বাগানের পেছনে। সেখানে ঘন গাছপালা। তপোবন নামে একটা পৌরাণিক ছবির শুটিং হচ্ছে। উজ্জ্বলকুমারের মাথায় চূড়ো বাঁধা চুল। মুখে প্রকাণ্ড দাড়ি। গলায় রুদ্রাক্ষ। হাতে কমণ্ডলু। পায়ে খড়ম। সাক্ষাৎ ঋষি দূর্বাসা।
রথীন্দ্র কর্নেলের কানে কানে বললেন ওই যে দেখছেন সব সময় কিন্তু নেশায় চুর।
নাচগান হচ্ছিল মুনিকন্যাদের। বারকতক মনিটরিংয়ের পর টেক শুরু হল। উজ্জ্বলকুমার একটা ছাতিমগাছের তলায় সিমেন্টের বেদিতে বসে সিগারেট টানছিল। রথীন্দ্র কাছে যেতেই খিকখিক করে হেসে বললেন–কি বাচ্চুবাবু, অরুণ মোহান্তকে দিয়ে তোমার নরক গুলজার করাবে নাকি?
রথীন্দ্র বললেন–অগত্যা।
–ওয়েট! মোহান্তদাকে আমিই রাজি করিয়ে দেব। কিন্তু একটা শর্তে।
রথীন্দ্র হাসবার চেষ্টা করে বললেন-তোমাকে হিরোর রোলটি দিতে হবে। এই তো?
উজ্জ্বলকুমার রাঙা চোখে আগুন জ্বেলে বললেন–তুমি আমাকে অপমান করছ, বাচ্চু!
আহা ঠাট্টাও বোঝ না! রথীন্দ্র পকেট থেকে মার্লবরো সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন–তুমি ফিল্ম ওয়ার্লডের একজন নামী লোক। একসময় তোমার রাস্তাঘাটে বেরুনোর উপায় ছিল না ফ্যানদের গুতোর চোটে। তোমাকে ঠাট্টা করব আমি? নাও, অ্যামেরিকান সিগারেট খাও!
উজ্জ্বলকুমার সিগারেট নিলেন। ঋষির দাড়িগোঁফ সাবধানে সামলে ধরে আগের সিগারেটের আগুনে এটা ধরালেন। তারপর বললেন–এখনও কিছু কম নেই। এখনও হিরোর রোল পেলে শালা কত মেয়েছেলের…
একটা অশ্লীল বাক্য বেরুল। রথীন্দ্র জিভ কেটে বললেন–এই উজ্জ্বল! কী হচ্ছে? আমার সঙ্গে গেস্ট আছেন দেখছ না?
উজ্জ্বলকুমার কর্নেলের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন-উরে ব্বাস! আপনিও কি মশাই আমার মতো ঋষির রোল পেয়েছেন? মোহান্তটা মাইরি ডুবে ডুবে জল খায়।
কর্নেল ওঁর পাশে বেদিতে বসে পড়লেন হাসিমুখে।
আপনার অভিনয় আমি দেখেছি। আমিও আপনার একজন ফ্যান।
উজ্জ্বলকুমার বললেন–আমার লেটেস্ট ছবি বসুন্ধরা। রাষ্ট্রপতির পদক পেয়েছিলুম। সে বছর আমি দেশের বেস্ট অ্যাক্টর ছিলুম। বসুন্ধরা দেখেছেন। কি?
–হুউ। কর্নেল মিষ্টি হাসলেন।উজ্জ্বলবাবু, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
উজ্জ্বলকুমার ভুরু কুঁচকে বললেন কথা? কী কথা?
এই ছবিটবি ব্যাপারে আর কি! আমি একটা ছবি করার তালে আছি। তাই–
উজ্জ্বলকুমার সন্দিগ্ধদৃষ্টে একবার রথীন্দ্র একবার কর্নেলকে দেখে নিয়ে তারপর ফিক করে হাসলেন।..বাচ্চু! বুঝে গেছি! অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি এ লাইনের পুরনো লোক। আমার কদর বোঝ! ওই অমিয় শালা একেবারে বেলাইন থেকে ছিটকে এসে এখানে ভিড়েছিল। কেন ভিড়েছিল, তাও তো জানি। বুঝলেন মশাই? অমিয় বকসী ছিল বাচ্চুর নতুন ছবির ডাইরেক্টর। এখন সে নরকের পথে রওনা দিয়েছে। আমি পই পই করে বাচ্চুকে বলেছিলুম, ওই শালা মাগীবাজটাকে দিয়ে আর ছবি করিও না। ভরাডুবি হবে।
কর্নেল বললেন–অমিয়বাবু নরকের পথে রওনা দিয়েছে না কী বললেন যেন?
জানেন না? কাগজে দেখেননি? উজ্জ্বলকুমার খিকখিক করে হাসলেন। উরে শালা! নরক নিয়ে ছবি করতে যাচ্ছিল। তো তাকেই নরকে ঢুকিয়ে ছেড়েছে। ওই যে দেখছেন কালো কালো চিমনি থেকে ভুসভুস করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, ওর ভেতর অমিয়র ডেডবডি পাওয়া গেছে। মশাই, কোথায় আছেন। কি তুলকালাম হয়ে গেল ওই নিয়ে!
–সর্বনাশ। বলেন কী? কে এমন কাজ করল?
রথীন্দ্র একটু তফাতে তপোবনের সেটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন। উজ্জ্বলকুমার চাপা গলায় বললেন-পুলিস স্টুডিওতে এসে কদিন ধরে জনে জনে জেরা করেছে। আমাকেও ছাড়েনি। কিন্তু কিছু বলিনি। বোঝেন তো মশাই, আজকাল পরিস্থিতি বড় গুরতর। কিসে কী হয়ে যায়–কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। কী দরকার?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–ঠিক করেছেন আপনি। খামোকা অন্যের ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী?
এক্সজ্যাক্টলি! উজ্জ্বলকুমার গলার স্বর আরও বাড়ালেন।নইলে দেখুন, অমিয়শালার বিস্তর গোপন ব্যাপার আমি জানি! যেমন ধরুন, রুবি নামে উদীয়মানা একটি মেয়ে। অমিয় তার সর্বনাশ করেছে, তারপর ধরুন, ক্যাবারে ড্যান্সার শ্যামলী। শ্যামলীর বস ও বাবা যেমন বাঘা তেঁতুল, তেমনি বুনো ওল। গুণ্ডা লাগিয়ে মেরে ফ্ল্যাট করে দিয়েছিল। এ সব তিন বছর আগের কথা। অমিয় প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত সিনেমা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন!
বলেন কী! আমি তো অমিয় বকসীকে দিয়েই ছবি করাব ভেবেছিলুম।
–বেঁচে গেছেন মশাই! আপনাকে আমি ভাল ডাইরেক্টার ঠিক করে দেব। ইতিমধ্যে কাউকে কথা দেননি তো?
না। ছবিটা নিজেই করব ভাবছি। আশাকরি আপনার সহযোগিতা পাব।
-খুব ভাল কথা। আমার সমস্ত রকম কো-অপারেশন পাবেন। আই অ্যাসিওর।
ধন্যবাদ উজ্জ্বলবাবু! কর্নেল চাপা গলায় বললেন–তাহলে অমিয় বকসী। দেখছি রীতিমতো লেডিকিলার ছিলেন।
–ওটা মশাই প্রশংসা হল। অমিয় ছিল একটা ঘুঘু লম্পট। উজ্জ্বলকুমার আবার গোপন কথা বলার মুডে ফিরলেন। ফিসফিস করে বললেন আমার কাছে এমন একটা ডকুমেন্ট আছে, দেখাবখন। আপনি ফুটবল কোচ অমর্ত্য রায়ের নাম শুনেছেন?
–হ্যাঁ। শুনেছি। এখন উনি তো ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের কোচ।
–তা জানি না। অমর্ত্যের ফিয়াসেকে চিনতুম। তার নাম ছিল মণিদীপা, বুঝলেন। মণিদীপাকে ছবিতে নামানোর লোভ দেখিয়ে হারামজাদা অমিয় ওর সর্বনাশ করেছিল।….
উজ্জ্বলকুমার খিকখিক করে হাসলেন। অমিয় অর্মত্যকে যমের মতো ভয় করত। আমার এক শ্যালক সুব্রত ছিল অ্যামেচার ফটোগ্রাফার। স্টুডিওতে এসে ঘোরাঘুরি করত। একদিন আমাকে একটা ফটো দিয়ে বলল, কাণ্ডটা দেখ। ফোটোটা দেখে আমি থ। অমিয় আর মণিদীপা…খিক খিক খি!
–অশ্লীল কিছু কি?
–অশ্লীল মানে? চূড়ান্ত অশ্লীল। সুব্রত শালার আবার এ সব বাতিক ছিল। লুকিয়ে শট নিত। ওই যে পুকুরের ওদিকে ঝোঁপঝাড় দেখছেন–ওখানকার সিন। ওদের ফলো করে গিয়ে সুব্রত জিনিসটা ক্যামেরায় ধরেছে। যাই হোক, ছবিটা তো নিলুম ওর কাছ থেকে। নেগেটিভটাও হাতালুম। তারপর মশাই, বুঝতেই পারছেন। অমিয় কাত একেবারে। পায়ে ধরতে বাকি–এমন দশা। করল। অমর্ত্য দেখলে কী হত ভাবুন!
–হুঁ। তাহলে তো পাতালে কয়েক দিন ছবিতে আপনি একটু চাপ দিলেই নামতে পারতেন!
কথা কেড়ে উজ্জ্বলকুমার বললেন–তা কি ছেড়েছিলুম ভাবছেন? ওকে বললুম–অ্যাদ্দিন টাকাকড়ি চেয়েছি। এবার টাকাকড়ি নয় ভাই অমিয়, হিরোর রোলটা চাই। শুনে অমিয় মুখ খিস্তি করল। আমি সটান চলে গেলুম অমর্তের বাড়িতে। আমি মশাই সব সইতে পারি। মা বাপ তুলে কথা বললে মাথার ঠিক থাকে না।
–তাহলে অমর্ত্যবাবুকে সব বললেন?
–হুঁ। আমার মশাই ওই এক জেদ। যা করব ঠিক করেছি, তা করব। অমর্ত্য ছবিটা দেখেই আগুন হয়ে গেল। ও ভীষণ গোঁয়ার। এক সময় নামী খেলোয়াড় ছিল মোহনবাগানে। একেবারে ভিসুবিয়স হয়ে গেল। বলল, আচ্ছা দেখছি।
–মণিদীপা এখন কোথায়?
-বোম্বেতে হিন্দি ফিল্মে খুব নাম করেছে। অমর্ত্যর সঙ্গে বিয়েটা কোনো কারণে হয়নি। না হয়ে ভালই হয়েছে। তাহলেও আফটার অল পুরনো প্রেমিক। অমর্ত্যর খেপে যাওয়া স্বাভাবিক।
–তাহলে কি আপনার ধারণা অমর্ত্যবাবুই অমিয়বাবুকে
সেট থেকে ডাক এল সেই সময়। উজ্জ্বলকুমার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। বসুন, এক মিনিটের ব্যাপার। এসে কথা বলছি। বলে দৌড়ে গেলেন।
রথীন্দ্র এতক্ষণে কাছে এলেন। কী বুঝলেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন–খুব গভীর জলের মাছ, অথবা ভীষণ সরল। জীবনে অনেক মানুষ ঘেঁটেছি মিঃ কুশারী, আপনাদের উজ্জ্বলকুমার একটি চরিত্রই বটে।
রথীন্দ্র বলল-ওর সঙ্গে আরও কথা বলার দরকার আছে কি?
–আপাতত নয়। আমি এবার সীমন্তবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। রথীন্দ্র ঘড়ি দেখে বললেন–আশ্চর্য তো! একটা বাজতে চলল, সীমন্ত আজ এখনও এল না। চলুন, ওর মুনলাইটে একবার ফোন করে দেখি। অসুখবিসুখ হল নাকি।
যেতে যেতে কর্নেল বললেন–উজ্জ্বলবাবু এসে খুঁজে না পেয়ে চটে যাবেন।
–সে আমি ম্যানেজ করবখন। ভাববেন না।
স্টুডিও অফিসে ফোন করলেন রথীন্দ্র। সীমন্ত? কী ব্যাপার? …আঁ? বল কি! …ক্যামেরা-ট্যামেরা চুরি যায়নি তো? …শুধু ছবি? কিসের ছবি? …ধুস? ছেড়ে দাও! ভারি তো একটা ছবি–তার জন্য… তোমার পাগলামি! শোনো, এক্ষুণি চলে এস এখানে। জরুরি দরকার আছে। এক ভদ্রলোক তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ফোন রেখে রথীন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন রাতে চোর তালা ভেঙে ওর স্টুডিওতে ঢুকেছিল। কয়েকটা ছবি চুরি গেছে, তাই মন খারাপ করে বসে আছে। থানায় গিয়েছিল। পুলিস এসে দেখে গেছে। কিন্তু পাত্তা দেয়নি।
দুজনে প্রতিভা পিকচার্সের অফিসে গিয়ে ঢুকলেন। অধঘণ্টা পরে সীমন্ত এল। অত্যন্ত বিষণ্ণ চেহারা। বলল, ভারি অদ্ভুত চুরি। সব কিছু রেখে বেছে বেছে শুধু তিনটে প্রিন্ট আর অরিজিন্যাল ছবি নিয়ে গেছে। ছবিটা আমাকে অমিয়দা দিয়েছিলেন। দারুণ ফেস! একমাথা চুলের মধ্যে ডিমালো মুখ, বড় বড় চোখ। এনলার্জে অসাধারণ এসেছিল।
রথীন্দ্র একটু নড়ে উঠলেন। আচ্ছা! তাহলে সেই ছবিটা। অমিয় আমাকে দেখিয়ে বলেছিল–চেনো নাকি। আমি চিনতে পারিনি। তারপর রথীন্দ্র মাথার চুল আঁকড়ে ধরলেন।-মাই গুডনেস! অমিয় সেদিন সকালে বলছিল কে একটু আগে তাকে শাসিয়ে গেছে! জিজ্ঞেস করতে যাব, তখন কী যেন বাধা পড়ল। ও! সীমন্ত, তুমি এলে ওদের ক্যান্টিনে নিয়ে যেতে। দেখছ? আমার স্মৃতিশক্তি এক্কেবারে গেছে!
কর্নেল বললেন–কে শাসিয়ে গেল বলেননি?
–হ্যাঁ, বলেছিল মনে পড়ছে। এক মস্তানটাইপ ছেলে নাকি শাসিয়ে গেছে। তার সঙ্গে…হ্যাঁ, হা–ওই ছবিটার যোগাযোগের কথাও বলেছিল অমিয়। ছবিটা সম্ভবত সেই এনেছিল। তাই অমিয় বলল, দেখ তো–একে চেনো নাকি।
কর্নেল গুম হয়ে বললেন–তাহলে ছবিটা চুরি যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
–তাই তো দেখছি। আমি যখন ঘরে ঢুকি, এখন অমিয় যেন ওটাই, দেখছিল। খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল ওকে। জিজ্ঞেসও করেছিলুম শরীর খারাপ নাকি? জবাব দেয়নি।
কর্নেল সীমন্তের দিকে ঘুরে বললেন বসুন সীমন্তবাবু। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।…
পরদিন সকালে কর্নেল ছাদে একটা মেকসিকান ক্যাকটাসের পরিচর্যা করছেন, ষষ্ঠী এসে বলল–ফোং বাবামশাই! নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব বললেন শিগগির ডেকে দাও।
জ্বালাতন! বলে কর্নেল নেমে এলেন ড্রইংরুমে। হাতে যথারীতি খুরপি– কী খবর অরিজিৎ?
কর্নেল! আমরা গেছি। ধরাশায়ী একেবারে।
–কী ব্যাপার?
আবার একটা ডেডবডি। মায়াপুরী স্টুডিওর ভেতর পুকুরের পাড়ে পাওয়া গেছে। মাথার পেছনে ক্ষতচিহ্ন।
–লোকটা কে?
প্রখ্যাত অভিনেতা উজ্জ্বলকুমার।
–ও গড! খুনী এ কী শুরু করেছে। যাই হোক, তুমি এক্ষুণি চলে এস অরিজিৎ।
কর্নেল ফোন রেখে ধুপ করে বসে পড়লেন সোফায়। চোখ বুজে বললেন– ষষ্ঠী! খুরপিটা রেখে আয়।