Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj » Page 13

নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj

দুদিন থেকে স্বপনের মনে খটকা লেগেছে। যখনই সে বাইরে কোথাও যেতে চাইছে তার জন্য ক্লাব কর্তৃপক্ষ গাড়ি রেখে রেখে দিয়েছেন। এত বেশি খাতির প্রথম প্রথম ভালই লেগেছিল। কিন্তু পরে একটু অবাক হয়েছিল। এ কথা সত্যি রোজ যে রোজ কাগজে ফুটবল ভক্তদের তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি বেরুচ্ছে। খেলার পাতায় তার নামে খবর থাকছে। খেলা-সাংবাদিকরা প্রায় ব্রোঞ্জ সাক্ষাৎকার নিয়ে যাচ্ছেন। তার ছবি বেরুচ্ছে কাগজে। এটা যেন বড় বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে তাকে নিয়ে। কিন্তু সন্দেহের কারণ ওই গাড়ির ব্যাপার। যখনই বাইরে যাচ্ছে, গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে দুটো কাঠখোট্টা চেহারার লোক থাকবেই এবং পেছনে একটু দূরে পুলিসভ্যান।

তাকে যে খুন করতে চেয়েছিল, সে ধরা পড়েনি-কাজেই ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার জন্য কি বডিগার্ড দিয়েছেন? তাহলে পুলিসভ্যান ফলো করে কেন? সে কি এখন ভি আই পি হয়ে গেছে যে এতখানি প্রয়োজন?

নাকি আসলে সে পুলিসের নজরবন্দী? তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে সম্ভবত। হয়তো এটা একটা ফাঁদ–পুলিস আসলে তাকে কোনো অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়নি।

বৃহস্পতিবার সকালে সীমন্ত এলে সে বলল–গাড়ি এনেছিস তুই!

-হ্যাঁ। কেন রে?

চল। আজ মাকে দেখে আসি। রোজ ভাবছি যাব, যাওয়া হচ্ছে না!

দুজনে বেরুল। গেটের কাছে যেতেই এক পুলিস অফিসার কোত্থেকে এসে সবিনয়ে জিজ্ঞস করলেন কোথায় চললেন স্বপনবাবু?

স্বপন গম্ভীর মুখে বলল–আসছি।

ক্লাবের গাড়ির ড্রাইভার সেলাম দিয়ে বলল–আসুন, স্যার!

স্বপন বলল–আমার বন্ধুর গাড়িতে যাচ্ছি। সীমন্ত তোর গাড়ি কোথায়?

সীমন্ত বলল–ওই যে!

স্বপন হনহন করে এগিয়ে গাড়িটার কাছে গেল। বডিগার্ডদ্বয় হন্তদন্ত হয়ে এসে গাড়িতে চাপতে যাচ্ছিল। স্বপন বললনা, না। আপনারা যান তো! খালি ঝামেলা!

সীমন্ত দরজা খুলে দিলে সে গাড়িতে উঠে বসল। সীমন্তকে বলল–জোরে বেরিয়ে যা। ফাজলেমি পেয়েছে রোজ! আর শোন, পুলিসভ্যান স্টার্ট দিচ্ছে দেখছিস? গাড়িটা কাটিয়ে যেতে হবে।

–ওকে! বলে সীমন্ত উল্টোদিকে গাড়ি ঘোরাল। তারপর স্পিড দিল। প্রচণ্ড।

পার্ক স্ট্রিট হয়ে ঘুরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, তারপর এস. এন. ব্যানার্জি রোড পেরিয়ে লেনিন সরণি ডিঙিয়ে গণেশ এভেন–তারপর নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, বাটার দোকানের কাছে ঘুরে কেশব সেন স্ট্রিট, আবার বাঁয়ে ঘুরে রামমোহন সরণি–তারপর মানিকতলার কাছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্ট্রিট ধরে শ্যামবাজারের দিকে। দুজনে মুখে টিপে হাসছিল। পুলিসভ্যানটা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে নিশ্চয়!

বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যাবে না। গলির মুখে গাড়ি রেখে দুজনে এগিয়ে গেল। তারপর নিরাশ হয়ে দেখল, দরজায় তালাবন্ধ। স্বপনকে দেখেই পাড়ায় সাড়া জাগার লক্ষণ। কাগজগুলো তাকে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। ওপরতলার লীনা বউদি বলল–তোমার মা রাখীকে নিয়ে উত্তরপাড়া গেছে। ফিরবে ওবেলা। তা তুমি তো আমাদের ঘরে বসবে কিছুক্ষণ, না কি? কতদিন পরে দেখছি। তোমাকে।

স্বপন আর দাঁড়াল না। ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল। যেতে যেতে বলল–মায়ের ব্যাপারটা দেখছিস সীমন্ত? উত্তরপাড়া যেতে পারল, আর আমার কাছে একবার যেতে

সীমন্ত বলল–তোর কাছে যাবেন, না তুই আসবি? কথা শোনো।

–এই তো এলুম!

–খবর দিয়ে এসেছিলি?

স্বপন চুপ করে গেল। যতীন্দ্রমোহন এভেন্যুতে পৌঁছে সীমন্ত আয়নার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। স্বপন বলল–কী রে?

–পেছনে পুলিসভ্যান!

ঘুরে দেখে স্বপনের চোয়াল আঁটো হয়ে গেল। একটু পরে বললসীমন্ত, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা কি কোনো ট্র্যাপ?

–হয়তো তোকে গার্ড দিচ্ছে। বনবিহারী এখনও ধরা পড়েনি–মাইন্ড দ্যাট।

স্বপন চুপ করে থাকল। সীমন্ত ফের বলল–পুলিস নেটওয়ার্ক অসাধারণ মাইরি! ওয়্যারলেসে নিশ্চয় আমার গাড়ির নম্বর দিয়ে মেসেজ ছড়িয়েছিল। এখানে আমার গাড়িকে পিক-আপ করেছে।….

ক্লাবের টেন্টে পৌঁছে স্বপন দেখল, রোজকার মতো একগাদা চিঠি ওর টেবিলে রাখা আছে। খবরের কাগজ হুজুগ তুলে দিয়েছে। রোজ তার নামে। ক্লাবের ঠিকানায় অসংখ্য চিঠি আসছে। বিরক্তি লাগে পড়তে। সে বলল–আর এই ঝামেলা! লোকদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই–খালি এই সব! জানিস কত প্রেমপত্র আসছে?

সীমন্ত বলল বলিস কী?

-তোকে দেখাব। মেয়েরা ফুটবল-ফ্যান হয়েছেষ ভাবা যায় না! কস্মিনকালে আমার খেলা দেখেছে কি না সন্দেহ হয়েছে,–অথচ প্রেমপত্র! স্বপন ক্লান্তভাবে ইজিচেয়ারে বসল। এতে একদা অমর্ত্য রায় বসতেন। সেই ঘর। সীমন্ত, চিঠিগুলো তুই খুলে চোখ বোলা! যদি কিছু ইমপর্টান্ট চিঠি থাকে পড়ে শোনা, আমি টায়ার্ড! বলে সে ডাকল–পরিমলদা! দুটো বিয়ার পাঠিয়ে দাও।

সীমন্ত চিঠি নিয়ে পড়ছে। জগাই বিয়ার দিয়ে গেল। দুটো গ্লাসে ঢেলেও ল্লি। তারপর নির্বিকার মুখে চলে গেল ভেতরে। বিয়ারে চুমুক দিয়ে স্বপন বলল–বাজে কথাবার্তা লেখে, তাই না?

সীমন্ত একটা ইনল্যান্ড লেটার খুলে পড়ছিল। ক্রমশ তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল–স্বপন! শোন!

উ?

–অদ্ভুত চিঠি! এ কি—

–আঃ! পড় না জোরে জোরে!

সীমন্ত আস্তে বলল–জোরে পড়ার নয়। তুই নিজে পড়ে দেখ।

–ভ্যাট! পড়!

সীমন্ত চাপা গলায় পড়তে থাকলঃ

কল্যাণীয়েষু,
বাবা স্বপন, তুমি আমাকে চেন না। কখনও দেখ নাই। আমি সেই হতভাগিনী চন্দ্রার পিতা। তোমার সহিত আমার জরুরী কিছু কথা আছে। তোমার মুখে আমার চন্দ্রার শেষ জীবনের কথাগুলি শুনিতে বড় ইচ্ছা হয়। কিন্তু তুমি তো জান, ভাগ্যচক্রে আমি পুলিসের নজরে পড়িয়াছি। তাই গোপনে ছাড়া প্রকাশ্যে তোমার সহিত সাক্ষাৎ সম্ভব নহে। তুমি যদি আগামী শুক্রবার রাত্রি ঠিক দশটায় গঙ্গার ধারে Man of War জেটির মূলে উপস্থিত হও, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। নির্ভাবনায় আসিবে। এই কথা ঘুণাক্ষরে কেহ যেন না জানিতে পারে। যদি আমাকে অবিশ্বাস করিয়া পুলিসে জানাও, খুব দুঃখ পাইব। চন্দ্রার আসল পরিচয় তোমার জানা থাকিবে না। তুমি তাহাকে ভালবাসিতে। কাজেই তাহার প্রকৃত পরিচয় তোমার জানা উচিত। একটা কথা, তুমি যদি পেছনে পুলিস মোতায়েন রাখিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করিতে যাও, আমি তাহা জানিতে পারিব। স্বপন, সত্যের সম্মুখে দাঁড়াইবার জন্য সাহস দরকার হয়। তোমার সে সাহস নিশ্চয় আছে। চন্দ্রার জীবনের সত্য কথা তুমি জান না। আমি তাহা জানাইব। অবশ্যই আসিতে অন্যথা করিবে না। ইতি–

সীমন্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–নাম সই নেই। ঠিকানা পর্যন্ত নেই। ডেঞ্জারাস চিঠি!

স্বপন হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। পড়তে থাকল।

সীমন্ত বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলল–যাস নে। বনবিহারী সাংঘাতিক লোক। আমার ধারণা অমিয়দাকে ঠিক এমনি করে ডেকে নিয়ে খুন করেছিল সে। তা ছাড়া চন্দ্রা লিখেছে কেন? ও নিজের মেয়ের নাম জানে না? যদি মনে কুমতলব না থাকত, অপালা লিখত। বল, লিখত না?

স্বপন বিরক্ত হয়ে বলল–আঃ। চুপ কর! সে চিঠি পড়ছে। তার নাসারন্ধ্র ফুলে উঠছে। চাপা শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। তার চোখ দুটো তীব্রতায় জ্বলজ্বল করছে।

সীমন্ত গ্রাহ্য করল না। মনে কুমতলব না থাকলে চিঠিতেই জানাতে পারত না? তা ছাড়া অপালা বেঁচে নেই। তোর সঙ্গে ওর কিসের সম্পর্ক? তুই কখনো যাস নে।

স্বপন মুখ তুলে বলল–তুই বিয়ার খেয়েই মাতাল হয়ে গেলি যে!

না। দিস ইজ এ ডেঞ্জারাস ট্র্যাপ, স্বপন।

চিঠিটা ভাজ করে প্যান্টের পেছনের পকেটে গুঁজে স্বপন একটু হাসল। ট্র্যাপ তো এখানে, সীমন্ত! এই ক্লাবে।

–তার মানে তুই যাবি?

–আমি লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে চাই, আমাকে সে যা ভেবেছে, আমি তা নই। চন্দ্রাকে আমি উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলুম। চন্দ্রার জন্যই আমি অমর্ত্যদার সঙ্গে মারপিট করেছিলুম। নিজের কেরিয়ার নষ্ট করার রিস্ক নিয়েছিলুম। স্বপন শাস ছেড়ে বলল–ওকে সেই কথাটা বলা দরকার। বরং আমিই ওকে মনে মনে খুঁজছিলুম। ভাবছিলুম, যদি মুখোমুখি পেয়ে যাই, সব কথা আমিই বলব। বলে জিজ্ঞেস করব–এবার বল, আমি দোষী কি না। দোষী হলে তুমি আমারও মাথায় হাতুড়ি মার–এবার মাথা পেতে দিচ্ছি। ইচ্ছেমতো মার। সেদিন ফস্কে গিয়েছিল, আজ

–তুইও দেখছি বিয়ার খেয়ে মাতাল হয়ে গেলি স্বপন! আমায় বলছিলি! স্বপন একটু চুপ করে থেকে বলল সীমন্ত, আমি যাব। তোকে শুধু একটা অনুরোধ-তুই যদি আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাস, কাকেও বলবি নে এ কথা। বল, বলবি নে। আমার গায়ে হাত দিয়ে বল, সীমন্ত।

সীমন্ত চুপ করে থাকল।

–সীমন্ত তাহলে তোর সঙ্গে এই শেষ।

সীমন্ত বলল–তুই বুঝতে পারছিস নে, ও তোকে আসলে খুন করতে চায়।

আমি তৈরি হয়ে যাব। তুই ভাবিস নে। স্বপন একটু হাসল। তা ছাড়া আমি তো সাবধান থাকব। অমিয়বাবু অসাবধানে যেতে পারেন, কিংবা বাবা নেশাখোর মানুষ ছিলেন, তিনিও অসাবধান ছিলেন। কিন্তু আমি তো সব জানি।

–তোর বাবাকে যে খুন করেছে, তাকে ধরিয়ে দেওয়া তোর উচিত নয়?

–উচিত-অনুচিত আমার মাথায় আসে না সীমন্ত।

–স্বপন! কী বলছিস তুই? তোর বাবার খুনীর মুখোমুখি দাঁড়াবি–ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবিকঁদুনি গেয়ে নিজের দোষ স্বালন করবি! অথচ তাকে

স্বপন আস্তে বলল–জানি না কী করব শেষ পর্যন্ত। তবে ওর মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। ওকে আমিই জানিয়ে দিতে চাই, সবাই জানোয়ার নয়। এখনও পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছে।

সীমন্ত বিয়ার ঢালতে লাগল। ওর মুখ উত্তেজনায় থমথম করছে।

–এমন সুযোগ আর নাও পেতে পারি। তাই না সীমন্ত?

–যা! আমি কিছু জানি নে। যা খুশি কর!

–তাহলে তুই কাউকে বলছিস না। রাখীকে পর্যন্ত না।

সীমন্ত তাকাল ওর চোখের দিকে। তারপর বলল–আচ্ছা!

না, আমাকে ছুঁয়ে বল।

সীমন্ত অগত্যা রাখীর সঙ্গে তার প্রেমের কথা ভেবেই স্বপনের হাতটা একবার ছুঁল।…

শুক্রবার বিকেলে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ইলেভেন টাইগার্সের ফ্রেন্ডলি ম্যাচে স্টেডিয়াম উপচে পড়ছিল। পুলিসকর্তারা প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। অরিজিতের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও শুধু কর্নেল আসেননি। মরুপ্রজাপতি দম্পতির ডানায় ফুটকির সংখ্যা বেড়েছে। প্রসারিত হয়েছে ডানার পরিধি। বর্ষার আগেই ওদের প্রজননক্ষেত্র প্রস্তুত। মেক্সিকান ক্যাকটাসটার ফুলের কুঁড়ি মোটা হয়েছে। টোরাদ্বীপ আর ডায়মন্ডহারবারের অর্কিডগুলো রঙ বদলাচ্ছে। এবার ওদের পার্থক্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে! কর্নেল কীটনাশক স্প্রে করছিলেন সারা বেলা। কাক তাড়াচ্ছিলেন। ও পাশের প্রকাণ্ড নিমগাছটায় অসংখ্য কাকের আস্তানা।

খেলা ড্র গেল। স্বপন তুমুল খেলেছে। কয়েকদিনেই আগের ফর্মে ফিরে এসে গেছে। প্রচণ্ড হাততালি পড়ছিল সে বল ছুঁলেই।

স্টেডিয়াম শূন্য হয়ে গেল। পুলিসকর্তাদের কেউ কেউ মাঠের প্রান্তে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। বাইরে চারদিক ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র পুলিস বাহিনী। এ এক বিশাল অপারেশন। ব্যায়ামাগারের দিকে, সুইমিং পুলের কাছে, টেন্টের কাছে সবত্র সাদা পোশাকের পুলিস।

দিনের আলো কমে এল। খেলোয়াড়রা টেন্টে আড্ডা দিচ্ছে কোচ ও কর্ম কর্তাদের সঙ্গে। আগামী প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে আলোচনা চলেছে। স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড ফাঁকা। অরিজিৎ লাহিড়ী উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললেন–অ্যাকশান স্টার্ট।

একটু পরেই তিনটি দলে ভাগ হয়ে পুলিস বাহিনী এবং তাদের কম্যান্ডিং অফিসার টর্চ আর রিভলবার হাতে এগিয়ে চললেন স্টেডিয়ামের তিনটি অংশে–উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ তিনটি অংশ স্টেডিয়ামের। সর্বমোট চারটে গেট। চারটে গেটের ভেতর ঢুকে গেল ওরা। কম্বিং অপারেশন শুরু হল। স্টেডিয়ামের আসনের তলায় একসঙ্গে অসংখ্য টর্চের আলো পড়ছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টে মানুষ-টিকটিকির অনুসন্ধান চলেছে। প্রতিটি কোণ, খাঁজ, আড়ালসবখানে। টেন্টের দিকে কেউ টের পাচ্ছেন না এখানে কী ঘটেছে। জালে মাছ পড়েছে ধরে নিয়েই দম আটকে অস্ত্র উঁচিয়ে তল্লাশি। কিন্তু কোথায় শিবশংকর?

সাতটা পর্যন্ত ইঞ্চি ইঞ্চি খুঁজে বেরিয়ে এল পুলিস বাহিনী। অরিজিৎ গুম হয়ে বললেন-ব্যায়ামাগারের দিকটা দেখুন।

–ওখানে আমাদের লোক অলরেডি আছে। তারা অ্যাকশনে রয়েছে।

জেনে আসুন।

তার আগেই অফিসার এলেন ওদিক থেকে। নট ইভন এ মোল, স্যার। নাথিং এনিহোয়্যার।

অতি ধূর্ত লোক শিবশংকর। একটু বাড়াবাড়ি রকমের পুলিস মোতায়েন হয়েছিল। আঁচ করে কেটে পড়েছে। অরিজিৎ বললেন–ওকে। ডিসপার্স!

বাইরের ফোর্স?

ডিসপার্স!

–অন্য কোনো প্ল্যানিং করতে হবে। স্বপন টোপ হিসেবেই রইল। রোজকার রুটিন ব্যবস্থা বজায় রাখা হল। একে একে কেউ টের না পায় এভাবে পুরো বাহিনী বেরিয়ে গেল স্টেডিয়াম ছেড়ে। ব্যর্থতায় অরিজিতের মুখে গাম্ভীর্য থমথম করছে। একবার ভাবলেন, কর্নেলের কাছে যাবেন নাকি। গেলেন না। হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। জরুরি কনফারেন্স ডাকতে হবে।

সীমন্ত খেলা দেখতে যায়নি। গম্ভীর মুখে তার স্টুডিওতে বসেছিল। স্বপন জেদী। ক্রিমিনালদের সঙ্গে থেকে ওই রকম বেপরোয়া হয়ে গেছে। আতঙ্কে মাঝে মাঝে সীমন্তের দম আটকে আসছিল। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। সাতটা….আটটা….নটা বাজলে তার কর্মচারীরা চলে গেল। সেও উঠে পড়ল। তালা এঁটে ভেতরের সিঁড়িতে পা রেখেই থমকে দাঁড়াল।

একটা মানুষের প্রাণ বেশি দামী, না গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করাটা দামী? স্বপনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটবে। ঘটুক। স্বপনের চাইতে রাখী তার কাছে দামী এখন। রাখীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটার কারণ নেই। রাখী তার বড়দাকে পাত্তা দেয়নি কোনোদিন। ভবিষ্যতেও দেবে না–যাই ঘটুক।

কিন্তু স্বপনের একটা কিছু ঘটে গেলে রাখী কী বলবে তাকে? স্বপনের বিপদ ঘটলে আসল কথাটা তো তাকে বলতেই হবে পুলিস বা কর্নেলকে। তখন রাখী জানতে পারবে। রাখী বলবে–কেন তুমি বড়দার বিপদ জেনেও চুপ করে থাকলে?

সীমন্ত সিঁড়িতে উঠল না। গ্যারেজে গেল। গাড়ি বের করল।

এলিয়ট রোডে কর্নেলের ফ্ল্যাটের দরজায় সে কঁপা কাঁপা হাতে বোতাম টিপল। ষষ্ঠী দরজা খুলে একগাল হেসে বলল–আসুন বাবুদা! আজ স্বপনবাবুর খেলা দেখতে যাননি? আমি টিভিতে দেখেছি। উঃ! যেন চিতেবাঘ, বাবুদা! অতদিন থাকল তো বুঝতেই পারিনি কে লুকিয়ে রয়েছে ঘরে।

সীমন্ত ঢুকে বলল–কর্নেল নেই?

বাবামশাই? আপনি বসুন! ডেকে আনছি। দোতালায় অ্যাংলো সায়েবের ঘরে গল্প করছেন।

–শিগগির ডাক। বল, সীমন্তবাবু এসেছেন জরুরি কাজে।

–তা কি আর বলব না ভাবছেন? বলে ষষ্ঠী চলে গেল।

নটা কুড়ি হয়ে গেছে। তখন সময় কাটছিল না। এখন হু-হু করে ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলেছে রাত দশটার দিকে। বেরুবার আগেই স্বপনকে আটকানো দরকার।

ষষ্ঠী ফিরে এসে বলল–আসছেন। একটু বসুন।

–তুমি বললে না জরুরি দরকার?

বললুম তো! বললেন, বসতে বল। যাচ্ছি। লিন্ডার আন্টি এয়েছেন অস্টেলি থেকে। ওনার সঙ্গে কথা বলছেন।

সীমন্ত বলল–কোন্ ফ্ল্যাটে বল? আমি যাচ্ছি।

ষষ্ঠী বলল–যান। দোতলায় নেমেই ডানদিকের দরজা। ফেলাট নম্বর ছয়।

সীমন্ত নেমে গেল। ছনম্বরে বোতাম টিপল। দরজা খুলতেই চায় না কেউ। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে ভেতর থেকে আবার টিপল অসহিষ্ণু হাতে। কোনো মহিলার গলা শোনা গেল। ইংরেজিতে গজগজ করে কিছু বলল। তারপর দরজা খুলে গেল। কর্নেল বললেন–সরি ডার্লিং! এক ভদ্রমহিলা অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন। ক্যাঙারু আর একজাতের ক্যাকটাসের সম্পর্ক নিয়ে থ্রিলিং ব্যাপার–

কর্নেল! ভীষণ জরুরি ব্যাপার। এক্ষুনি আমার সঙ্গে আসুন।

কর্নেল চমকে উঠলেন কী হয়েছে সীমন্ত?

–এক্ষুনি ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের টেন্টে গিয়ে স্বপনকে আটকানো দরকার। দশটায় তাকে গঙ্গার ধারে ম্যান অফ ওয়ার জেটির কাছে ডেকেছে বনবিহারী। স্বপন যাবেই। বারণ করেছি, শুনতে চায়নি।

বনবিহারী, মানে শিবশংকর তাকে ডেকেছেন?

–হ্যাঁ। কাল সকালের ডাকে চিঠিটা এসেছিল। স্বপন আমাকে দিব্যি খাইয়ে বারণ করেছিল কাউকে বলতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর পারলুম না চেপে রাখতে। চলে এলুম আপনাকে জানাতে।

কর্নেল হিসেব করছিলেন মনে মনে। সোমবার বিকেলে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে শিবশংকরের। তারপর যদি ডাকে চিঠি দিয়ে থাকেন

অবশ্য আজকাল ডাকে চিঠি আসতে বড্ড দেরি হয়। তার সঙ্গে দেখা হবার পর যদি চিঠি লিখে থাকেন স্বপনকে, তাহলে স্বপন নিরাপদ। তাকে মনের কথা বলতেই ডেকেছেন অনুশোচনা প্রকাশ করার জন্যই।

যদি তার আগে চিঠি লিখে ডাকে দিয়ে থাকেন, তাহলে–

তার বিশ্বাস, তাহলেও স্বপন নিরাপদ। শিবশংকরের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলেন, তিনি তার কথা বিশ্বাস করেছেন।

না। স্বপনের জীবন বিপন্ন নয়। এক যদি

যদি স্বপন তার পিতৃহত্যাকারীকে ক্ষমা না করে। কিন্তু বলা যায় না, যা বেপরোয়া দুর্দান্ত ছেলে! বাবার খুনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হঠাৎ যদি সে আত্মসম্বরণ না করতে পারে? তাহলে শিবশংকর মরবেন। কিন্তু তার চেয়ে সর্বনাশের কথা, আবার স্বপনের জীবনে ঝুঁকি এসে যাবে। পুলিস তদন্ত করবে। শিবশংকরের খুনীকে খুঁজে বের করতে চাইবে। স্বপন তো স্বভাবদুবৃত্ত নয়, ধূর্ত নয়। সরলচেতা ছেলে। হয়তো ভুল করবে, ফেলে আসবে নিজের কোনো চিহ্ন–তাড়াহুড়োয় একপাটি জুতো, কিংবা ড্যাগারের বাঁটে তার আঙুলের ছাপ!

কর্নেল শিউরে উঠলেন। বললেন হু, চল!

এত রাতেও পার্ক স্ট্রিটে চৌরঙ্গির মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম। পাতাল রেলের ধাক্কা। নটা পঞ্চাশ হয়ে গেল। ইলেভেন টাইগার্সের গেটের কাছে গাড়ি রেখে দুজনে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। এক পুলিস অফিসার এসে সামনে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলেন–কোথায় যাবেন?

–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কর্নেল পকেট থেকে তার পরিচিতি পত্র দেখালেন।

অফিসার স্যালুট করে বললেন–যান স্যার!

টেন্ট নিঝুম। পরিমল বেরিয়ে এল। কর্নেল বললেন–স্বপন আছে?

–স্বপনবাবু খেলার পর কখন বেরিয়ে গেছেন আমরা লক্ষ্য করিনি স্যার। ওঁকে খোঁজা হচ্ছে।

কর্নেল আর দাঁড়ালেন না। বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে চাপলেন। বললেন– সীমন্ত! ম্যান অফ ওয়ার জেটি! কুইক!

ইডেন পেরিয়ে স্ট্যান্ড রোডের মোড়ে দশটা বাজল কাঁটায় কাটায়।

ম্যান অফ ওয়ার জেটির সামনে আজ কোনো জাহাজ নেই। অধিকাংশ দিন নৌবাহিনীর কোনো-না-কোনো জাহাজ থাকে। দূর থেকে চোখে পড়ছিল ছোট্ট একটা ভিড় জেটির মুখে। ওখানে পুলিসের একটা গুমটি ঘর আছে। দুজন পুলিস ভিড়ের কাছে লাঠি উঁচিয়ে সবাইকে হটাচ্ছে। এত রাতেও কিছু লোক থেকে যায় এ তল্লাটে। নৌকোয় মাঝিরা, ভবঘুরে ভিখিরি, প্রেমিক-প্রেমিকা, কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ! প্রকৃতিস্বরূপা গঙ্গার কাছে সান্ত্বনা খুঁজতে আসে কেউ কেউ।

কর্নেল আগে সীমন্ত পেছনে! বলে উঠল–ওই তো স্বপন।

স্বপন দাঁড়িয়ে আছে। একটা হাত অন্য হাতের কনুই আঁকড়ে ধরেছে, সেই হাতটা উঠে গেছে চিবুকে। আঙুল মুঠো করে শুধু চিবুকে রেখে একটা তর্জনী সোজা ঠোঁটের ওপর রেখেছে। মুখটা নিচু।

তার পায়ের কাছে চিত হয়ে শুয়ে আছে একটা লোক। পাশে একটা ব্যাগ। ওই ব্যাগে একটা হাতুড়ি আছে। আবছা আলোয় তার মুখটা দেখা যাচ্ছে। কর্নেল উঁকি মেরে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। শিবশংকর ন্যায়দণ্ড ফেলে দিয়ে শুয়ে আছেন।

সীমন্ত ডাকল–স্বপন।

স্বপন তাঁর দিকে একবার তাকাল। কর্নেল গলা ঝেড়ে কনস্টেবলদের জিজ্ঞেস করলেন-কী ব্যাপার?

একজন কনস্টেবল বলল–ক্যা মালুম সাব? সুইসাইড কেস হোনে লাগে।

মাঝিদের একজন বলল বিষ খেয়েছে। ওই দেখুন মাটির ভাঁড় পড়ে আছে। আর ওই দেখুন কাগজের ছেঁড়া পুরিয়া সাদা গুঁড়োর মতো! ভঁড়ের চায়ের সঙ্গে গুলে খেয়েছে মনে হচ্ছে।

অন্য এক মাঝি বলল–লোকটা সন্ধ্যা থেকে ওখানে বসেছিল। যখনই এসেছি দেখি চুপচাপ বসে আছে। তারপর কখন এই কম্মটি করে ফেলেছে।

কর্নেল কনস্টেবলদের বললে–টর্চটা জ্বালুন তো কাইন্ডলি!

টর্চের আলোয় শিবশংকরকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন। নাকে রক্ত জমে আছে। মুখে চাপ চাপ ফেনা। পাশে একটা ভাঁজ করা কাগজ রয়েছে। তুলতে গেলে কনস্টেবলরা বাধা দিল। –মাৎ ছুঁইয়ে সাব! থানাসে অফিসার আয়েগা আভি। খবর ভেজা হ্যায়।

কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না। কাগজটা খুলে পড়লেন : আমি নিজহস্তে আমার জীবন লইলাম। এজন্য কেহ দায়ী নহেন। এতদর্থে সুস্থ শরীরে সজ্ঞানে স্বাক্ষর করিলাম। শ্রীশিবশংকর গুপ্ত, পিতা নলিনীমোহন গুপ্ত। কেয়ার অফ শ্রীসরল সেন; কন্ট্রাক্টার মায়াপুরী সিনে স্টুডিও, টালিগঞ্জ, কলিকাতা।

কাগজটা ভাঁজ করে যেখানে ছিল সেখানে রেখে একটু করো চিল চাপা দিলেন। তারপর স্বপনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, এস স্বপন।

গাড়ির কাছে গিয়ে স্বপন আস্তে বলল–আমাকে একটা পাপ থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল চন্দ্রার বাবা। আমি ওকে

–জানি। সেই ভেবেই দৌড়ে এসেছিলুম।

কর্নেল ওকে নিয়ে পেছনে বসলেন। সীমন্তের গাড়ি চলতে থাকল। স্বপন বলল–আমাকে টেন্টের সামনে নামিয়ে দিবি।

কর্নেল বললেন–আমরাও নামব। তোমার ওখান থেকে অরিজিৎকে ফোনে পাই নাকি দেখি। ডি সি ডি ডির জরুরি কনফারেন্স চলবে অনেক রাত অব্দি। তবে এখন আর কোনো কনফারেন্স–কোনো স্ট্রাটেজিই নিরর্থক। শিবশংকর গঙ্গার ধারে শুয়ে আছেন। তার ন্যায়দণ্ডটি এখন ব্যাগের ভেতর তার মতোই নিষ্ক্রিয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
Pages ( 13 of 13 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1112 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress