নিরুদ্দিষ্ট নাকফুল -2
টেরেসা আবার একদিন এসে ধরে পড়ল।
– শর্মি, আমীর ভাইয়ের গল্প শোনা।
– কী মেয়েরা বাবা! খালি ঘ্যানর ঘ্যানর।শর্মি কিছুটা বিরক্ত হয়।
– আমীর ভাইয়ের গল্প তো তোকে কতবার বলেছি। একই গল্প আর কতবার শুনবি ?
– ভালোবাসার গল্প যে শর্মি। বার বার শুনতেও ভালো লাগে। বল্ না প্লিজ!
ছোট মেয়ের মত ঘাড় কাত করে টেরেসা।
– আমার ঐ একটুখানিই তো ভালোবাসা। কী করবি সেই ভীরু তারুণ্যের নিষিদ্ধ ভালোবাসার গল্প শোনে?
হঠাৎ শর্মি দেখে টেরেসার চোখ বেয়ে গাল বেয়ে জলের ধারা।
– কিরে ? তুই কাঁদছিস কেন ঢঙ্গী?
টেরেসাকে ধাক্কা দেয় শর্মি।
– তোর আমীর ভাইয়ের জন্য খুব খারপ লাগছেরে!
– মাই গড! তুই দেখি আমীর ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছিসরে টেরি ?
টেরেসা ফোঁস করে ওঠে।
– আমি কি তোর মত কাওয়ার্ড নাকি, হ্যাঁ ? আমি হ’লে কোন দিনও আমীর ভাইকে ওভাবে হারিয়ে যেতে দিতাম না।
শর্মি অনেকক্ষণ বেকুবের মতো টেরেসার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফেলে।
শর্মির তখন প্রবল শাসিত যুবতী বেলা। আম্মা সেদিন বাইরে গিয়েছিলেন। বাড়ির অন্যরা যার যার কাজে ব্যস্ত। শর্মির কলেজ নেই। ঘরে একা। জন্মদিনে লুকিয়ে আমীরের দেওয়া উপহার নাকফুলটা হাতে নিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখছিল শর্মি। আমীর ভাই বলেছিল জানি তুমি সবার সামনে এটা পরতে পারবেনা। দুই একবার লুকিয়ে টুকিয়ে পড়ে দেখো। । একদিন ক্যামেরা নিয়ে আসব। তোমার নাকফুল পরা মুখের একটা ছবি তুলবো। শর্মি নাকফুলটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো প’রে দেখার। সেই কবে আম্মা নাক ফুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। অব্যবহারে নাকের ছিদ্রটা প্রায় বুঁজেই গেছে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে অন্যভ্যস্ত হাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। নাক ফুলের ডাঁটাটা বুঁজে আসা ছিদ্রে ঢুকানো যাচ্ছিল না। এ সময় কোথা থেকে আম্মা এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই একেবারে শর্মির কাছে চলে এলেন।
– আয়নায় দাঁড়িয়ে কী করছিসরে শর্মি ? একি! নাকফুল পেলি কোথায় তুই ?
আম্মার কাছে এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ে শর্মি ভীষণ ঘাবড়ে গেল। কী বলবে এখন আম্মাকে ? আম্মার কাছে কিছু লুকানো খুব কঠিন কাজ। ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে না হয় মিথ্যা বলা যায় । ধরা পড়ে গিয়ে এই মুহূর্তে সত্য কথাটাই ফস্ করে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
– আমীর ভাই রেখে গিয়েছিলেন। আমি পরে দেখছিলাম আমাকে নাকফুল পরলে কেমন লাগে আম্মা?
শর্মি ভয়ে সেঁটিয়ে গেছে। ইনোসেন্ট বোকাটে মুখ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে আছে। কী হবে এখন ! কিছুক্ষণ শর্মির দিকে চেয়ে থেকে কী ভেবে আম্মা হেসে ফেললেন।
– ভালোই লাগছে তোকে। কিন্তু এসব এখন নয়। নাকফুল পরবি বিয়ের পরে।
যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল শর্মির। আম্মার এ অবিশ্বাস্য ভুল ভাবনা একটি সম্ভাব্য মহা প্রলয় থেকে বাঁচিয়ে দিলো শর্মি আর আমীর দু’জনকেই।
– সেদিন জোর করে আমরা সাদেকার নাক ফোঁরালাম না ? নিশ্চয়ই আমীর নাকফুলটা সাদেকার জন্য রেখে গেছে। দেখি।
শর্মি সঙ্গে সঙ্গে নাকফুলটি আম্মার হাতে দিয়ে দিলো।
– বাহ্ খুবই সুন্দর তো। সাদেকা কোথায় ? আমীর ভাইয়ের নাকফুল নিয়ে আম্মা সাদেকা মামীর খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। আম্মার এই ভুল ভাবনার পিছনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা কাজ করেছিল। শর্মিদের ড্রয়িংরুমে বিকেলের চায়ের আড্ডা চলছিল একদিন। মেয়েদের গহনা নিয়ে গল্প হচ্ছিল। কথা বলতে বলতে আম্মা হঠাৎ সাদেকা মামীর দিকে চেয়ে বললেন-
– সাদেকা, তোমার এত সুন্দর একটা নাক। নাকফুল পরলে ভীষণ ভালো লাগবে। নাকফুল পর না কেন তুমি ?
সাদেকা মামী লাজুক হেসে নিজের অজ্ঞাতেই হাত দিয়ে নিজের নাক ঢেকে ফেলেন।
– ইচ্ছে তো হয় আপা। আমার যে নাক ফোঁড়ানোই নেই। নাকফুল পরব কেমন করে ?
সাদেকা মামীর ফর্সা মুখে নাকফুল পরতে না পারার দুঃখের ছায়া ভাসে।
এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। হঠাৎ আমীর হোসেন পাশ থেকে বলে উঠল-
– মেয়েদের সব গহনার মধ্যে নাকফুলই হচ্ছে সবচেয়ে স্ট্র্যাটেজিক। এই দৃষ্টিনন্দন গহনাখানি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। নাকফুল মেয়েদের অবয়ব ভূমধ্যসাগরে দিশাহীন নাবিকের জোসনা ভরা বাতিঘর। নাকফুল খুবই একটি ইউজার ফ্রেন্ডলি গহনা। যে কোন মেয়েকেই নাকফুলে মানায়।
আমীরের কথায় সবাই হেসে ওঠে। পেছনের সোফায় বসা শর্মি সাদেকা মামীর ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে সবাইকে লুকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে আমীর হোসেনকে একটি শাসন ছুঁড়ে মারে।
আম্মা বলল- নাক ফোঁড়ানো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার তো নয়। নাকফুল পরার শখ থাকলে যে কোন দিন নাক ফুঁড়িয়ে নিতে পারো।
– মাগো না ! সাদেকা মামী মুখভঙ্গি করে শিউরে ওঠেন। আম্মা সোফা ছেড়ে উঠে কী কাজে যেন শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকেন।
সাদেকা মামী খুব ভীতু মেয়ে। সামান্য হাত পা কেটে গিয়ে এক আধ ফোঁটা রক্ত রেরোলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যান। কেঁদে কেটে সারা বাড়ি মাথায় করেন। অসুখ বিসুখে কখনো ইনজেকশন দেয়া যায় না। বলে ইনজেকশনের ব্যথা আমি সইতে পারবোনা। ইনজেকশন দিতে চাইলে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে নাও। এটা বুঝতে চান না অ্যানেসথেনিয়া দিতে হলেও তো আরেকটা ইনজেকশন দিতে হয়।
তো এসব কারণে সাদেকা মামীর বাবা মা শত চেষ্টা করেও ছোট বেলায় তার নাক ফোঁড়াতে পারেননি। বিয়ের সময়ও এ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। হলুদের দিন বর পক্ষের মেয়েরা প্রচন্ড হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। কনের নাকে ছিদ্র নেই তো নাকফুল পরাবে কেমন করে ? হলুদের অনুষ্ঠানেই দাবী উঠেছিল ডাক্তার ডেকে এখনই কনের নাক ফোঁড়ানো হোক। সেই কথা শুনে সাদেকা মামী হলুদের অনুষ্ঠানেই চিৎকার করে এমন কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন যে বর পক্ষের লোকেরা তো হেসে খুন। এরপর মুরুব্বিদের পরামর্শে শুধু কনের কান্নার দৃশ্যটা ভিডিও করে রাখা হলো। নাকফুলের ব্যাপারটা নিয়ে ওরা আর কোন বাড়াবাড়ি করল না।
একটু পর আম্মা আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে এলেন। হাতে একটা চিকন সুই আর তাতে সাদা সুতা পরানো।
এসো সাদেকা আজই তোমার নাক ফুঁড়িয়ে দেই। আম্মা সাদেকা মামীর দিকে এগিয়ে যান। সাদেকা মামী চিৎকার দিয়ে কী করেন আপা বলে সোফা থেকে উঠে যেতে উদ্যত হতেই আম্মার ইশারায় আমীর হোসেন সোফার পেছনে গিয়ে সাদেকা মামীর দুই কাঁধ সহ হাত চেপে ধরল। আম্মা সেকেন্ডের মধ্যে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় কাঁথা সেলাইয়ের মতো করে সাদেকা মামীর বামদিকের নাকের পাতা সুই দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেললেন। সুতা বেঁধে দিতে দিতে বললেন যাও ভাবী এবার থেকে নাকফুল পরতে পারবা। সাদেকা মামী নাকে হাত চেপে এক দৌড়ে আম্মার শোবার ঘরে চলে গেলেন। আম্মাও হাসতে হাসতে পিছু নিলেন। আমরা সবাই হুড়মুড় করে আম্মার ঘরে সাদেকা মামীকে দেখতে গেলাম। সাদেকা মামী তখন খাটের ওপর বসে নাকে টিস্যু পেপার চেপে হাপুস হুপুস কাঁদছেন আর আম্মাকে বলছেন-
– আপনি এটা কী করলেন আপা ?