নিঝুমপুরের পিশাচিনী
অনেকদিন একটানা কাজ করার ফলে, একঘেয়ে ও অস্থির লাগছিল মনটা। তাই অফিস থেকে সাতদিনের ছুটে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে। বেশি কিছু সঙ্গে নিলাম না। তিনটে জামা, দু’টো প্যান্ট আর কিছু নগদ টাকা সঙ্গে নিলাম। ট্রেনে করে এসে নামলাম, নিঝুমপুর স্টেশনে। আমি ছাড়া আর কেউই ট্রেন থেকে নামল না। স্টেশনটা নির্জন।
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে, একটা রিক্সা নিয়ে এসে উঠলাম, এক বেসরকারি ডাক-বাংলোয়। বাংলোটা বেশ সাজানো গোছানো। সেদিনটা বাংলোতেই শুয়ে বসে কাটল।
পরদিন বাংলো থেকে বেরিয়ে বিকেলবেলা রূপসা নদীর ধার ঘেষে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে শশ্মান পার হয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। এ’দিকটা খুব নির্জন। আস্তে আস্তে হাঁটছি আর দু’পাশের মনোরম দৃশ্যাবলী তাকিয়ে দেখছি। এমন সময় অদূরে দেখতে পেলাম প্রাসাদের মতো মস্ত এক পোড়ো বাড়ি। ভেঙে চুড়ে যাওয়া লোহার গেটটা দিয়ে ভিতরটা দেখা যাচ্ছে খানিকটা। গাছ-পালায় ঘেরা বিশাল বাগানের মাঝখানে দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে, দেখে মনে হচ্ছে। অযত্নে গাছ-পালাগুলি বর্তমানে বিষণ্ণ রুগ্নতায় মলিন কাতর। একসময় চারপাশে নানা রকম ফুলগাছে ঘেরা বাগান ছিল। তা দেখলে বোঝা যায়। এখন যদিও বুনো দুই-একটা ফুল গাছ ছাড়া আর তেমন কোনও ফুলগাছই নেই।
বাগানটার পরেই বাড়িটার সামনের দিকে উঁচু উঁচু কয়েকটা দেবদারু গাছ। এত সুন্দর বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে ভিতরে যাওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না। আমি আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে, ক্ষয়ে যাওয়া ইটের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। বাড়িটার সামনে বিশাল টানা লম্বা বারান্দা। বারান্দার পরে সেগুন কাঠের তিনটে দরজা। দুই পাশের দুটি দরজা, মাঝখানের দরজাটির চেয়ে অনেক ছোট। মাঝখানের দরজাটি প্রায় দশ বারো ফুট উঁচু। দরজায় মাঝখানে চমৎকার নকশা কাটা। ঝড় বৃষ্টিতে দরজার রঙগুলো ম্লান হলে গেলেও, দেখে বোঝা যায় দরজাগুলো এখনও খুব শক্ত মজবুত। বিশাল বিশাল আটটা জানালা। সেগুলো এখন সব বন্ধ। দোতালায়ও বারান্দা আছে সেখানে কাঠের নকশাদার রেলিং। রেলিংগুলো কালো রঙের দেখে বোঝাই যায় ওগুলো গর্জন কাঠের। এ’গুলো দারুণ শক্ত। বাড়ির ছাদটা টিনের চালের মতো লাল রঙের সিরামিক ইটের টালি দিয়ে ছাওয়া। ইঁটের লাল রঙের জৌলুসটা এখন আর নেই। আমি একমনে এসব দেখছি আর তন্ময় হয়ে ভাবছি, কী সুন্দর বাড়িটা ! যিনি করেছিলেন, তিনি খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। ছিলেন নাকি এখনও আছেন, জানি না।
একটু বাঁয়ে ঘুরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই, বুকের ভিতর হৃৎপিন্ডটা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। নারী কন্ঠে কে যেন আমাকে বলে উঠল? কাকে খুঁজছেন?
পিছনে ফিরতেই দেখি বরফ সাদা রঙের হাল্কা সিফন শাড়ি পরা লম্বা, পাতলা চেহারার এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী সামনে দাঁড়িয়ে। আমি অনেকটা হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম বিস্ময়ে।
তরুণী আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন,
কাকে খুঁজছেন?
আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর হেসে বললাম কাউকেই না।
তবে?
- রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই সুন্দর নির্জন বাড়িটা চোখে পড়ল। তাই ভিতরটা একটু ঘুরে দেখতে এসেছি।
তরুণীটি এবার ফিক করে হেসে ফেলল। তার হাসি আমাকে মোহমুগ্ধ করে ফেলল।
বলল, আপনি যেভাবে বাড়িটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। ভাবলাম কি না কী? এই পুরাতন বাড়িতে তেমন কী আর দেখার আছে? আমি অনেকক্ষণ এসেছি আপনার তন্ময়তা দেখে আর ডাকিনি ।
আপনি? - আমি? আমি এই বাড়িতে থাকি। নাম লিলা ব্রাউন।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
বললাম, আমি যতটুকু শুনেছি, এই বাড়িতে কেউ থাকে না। - আপনি ঠিকই শুনেছেন । আমি কয়েকদিন আগে বার্মিংহাম থেকে এখানে এসেছি বাড়িটা বিক্রি করার ব্যাপারে।
- আপনি?
- আমি আপনাদের স্থানীয় কেউ না, থাকি কলকাতায়। আমার নাম শংকর ব্রহ্ম ।
- সে আপনার কথা বলার ধরণ শুনেই বুঝেছি আপনি শহুরে মানুষ।
- আপনিও তো সুন্দর বাংলা বলেন।
- হ্যাঁ, আমি তো এখানে ছিলাম বহুদিন। তা, আপনি এখানে এলেন কিভাবে?
- বেড়াতে বেড়াতে।
- ও আচ্ছা। চলুন ও’দিকটায় যাওয়া যাক।
- কোথায়?
- বাহ ! বাড়ির সামনের দিকটাই দেখবেন শুধু? আর পিছনের দিকটা দেখবেন না বুঝি?
- পিছনটাও দেখা যাবে নাকি, তাহলে তো বেশ ভালই হয়। বললাম আমি।
তরুণী আমার আগে আগে চলছে, আর আমি তার পিছনে পিছনে হাঁটছি।
সাদা সিফন শাড়িতে অসাধারণ দেখাচ্ছে তাকে। সরু কোমরের নীচে শাড়ির আচল বাতাসে উঠছে আর নামছে। শাড়িটি এমন ভাবে পরেছে যাতে তার পা দু’টি এতটুকুও না দেখা যায়। বাড়ির পিছন দিকে এসে আমি তো আরও অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল এক দীঘি। টলটলে স্বচ্ছ জল তার। পাড়ের চারদিকে বড় বড় অনেক উঁচু নারকেল গাছ, আর দুই একটা তাল গাছও আছে। দীঘির পাড়ে শানবাঁধানো একটি বড়সড় ঘাট, বসার ব্যাবস্থা আছে। তবে সেখানে এখন পুরো শ্যাওলার আস্তরণ পড়ে গেছে।
- চলুন ঘাটে গিয়ে একটু বসি। এখানে দীঘির হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিয়ে, তারপর হাত মুখ ধুয়ে ভিতরে যাব। বলেই সন্মোহনী হাসি হাসল সে। আমি মনে মনে তাই চাইছিলাম। তাই আর কোনও কথা না বাড়িয়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসে পড়লাম। তরুণী এসে বসল আমার পাশে, গা ঘেঁষে। প্রথম দেখাতেই সে যে এ’ভাবে নিসংকোচে আমার পাশে এসে বসবে, আমি ভাবতে পারিনি। আর এতটা কাছে তার আমাকে আসার সুযোগ করে দিয়েছে, তা দেখে আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। বিস্ময়বোধ জাগছে মনে। হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে ইউরোপের মতো মুক্তমনা পরিবেশে বসবাস করার ফলে, মনে মনে ভাবলাম আমি।
- কি ভাবছেন? আমাকে নিয়ে আবার ভাবছেন না তো?
আমি চমকে উঠলাম। আমার চমকে উঠা দেখে লিলা চুড়ি ভাঙা-শব্দে রিনঝিন সুরে হেসে উঠল। - কি? আমি ঠিক বলেছি, তাই না?
আমি অস্বীকার করতে পারলাম না ।
তাই মাথা নেড়ে বললাম, হুম।
তরুণী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, কাজটা আপনি কিন্তু ঠিক করেননি । - কেন?
- কারণ আমাকে নিয়ে যারাই ভাবে, তারাই শেষে ডুবে মরে। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম, ঠিক বুঝলাম না আপনার কথাটা।
- মানে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে মরে,
বলেই লিলা আরও উচ্ছ্বল হয়ে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
নির্জন এই দীঘির পাড়ে তার হাসির বাঁধ ভাঙা তরঙ্গ বাতাসে ঢেউ তুলল। চরাচর কেঁপে উঠল সেই ঢেউয়ের ধাক্কায়। পাখিরা ডেকে উঠল গাছে গাছে। আমি মোহগ্রস্ত হয়ে তার হাসির তরঙ্গে ভেসে যেতে যেতে, যেন অশুভ কোনও কিছুর ইঙ্গিত পেলাম। হাসি থামিয়ে লিলা সিঁড়ি ভেঙে নীচে দীঘিতে নামতে নামতে বলল, আসুন আমার হাত ধরুন। জলে নেমে আগে হাত মুখটা ধুয়ে নিন। তারপর বাড়ির ভিতরটা গিয়ে দেখবেন।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে,পায়ের গোড়ালী ডুবিয়ে জলে দাঁড়ালাম। লিজাও তাই করলো। নীচে জলে ডোবা লিলার পায়ের দিকে আমার চোখ পড়ল। সে দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলাম লিলার হাল্কা সিফন শাড়ি জলের উপরে তার হাঁটু পর্যন্ত ভেসে উঠেছে, ওর পায়ের পাতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। আমি চমকে উঠলাম তা দেখে। ওর পা দেখে ভয়ে, আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে লাগল। লিলার পায়ের গোড়ালী দেহের সামনের দিকে, আর পায়ের আঙ্গুলগুলো দেহের পিছন দিকে। আমাকে চমকে উঠতে দেখেই লিলা বুঝে ফেলল যে, আমি ওর পায়ের বিকৃতিটা দেখে ফেলেছি। তখন সঙ্গে সঙ্গে ও আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমাকে জাপটে ধরল। আমি দেখতে পেলাম ওর দু’চোখ দিয়ে তখন নির্মম নিষ্ঠুর নৃশংসতা ঠিকরে বেরোচ্ছে। চোখ দু’টি হিংস্রতায় জ্বলছে। গলা দিয়ে তীব্র তীক্ষ্ণ এক অপার্থিব চিৎকার করে সে আমাকে জাপটে ধরে দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি কিছুতেই তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না। এমন কঠিন কঠোর তার হাতের বন্ধন। সে আমার মাথাটা জোর করে বারবার জলের নীচে চেপে ধরতে লাগল। জলে ডুবে যাওয়ার আগের মূহূর্তে আমি বাঁচার আকুতি নিয়ে অসহায়ের মতো দেখতে পেলাম, কে যেন একজন ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় তিনদিন পর আমার হুঁশ ফিরল। দেখতে পেলাম একটি মাটির চালাঘরে শুয়ে আছি আমি। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম এক বুড়িকে। যে আমাকে বাঁচিয়েছে। গরু খুঁজতে বেরিয়ে গরু না পেয়ে, ঘাটের দিকে যেতেই সে আমাকে ডুবে যেতে দেখতে পায়, তারপর সে নিজেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে, পাড়ে এনে তোলে। তারপর আমাকে উদ্ধার করে, উপরে তুলে আনে। শেষে সে আমাকে তার নিজের ঘরে এনে তুলেছে। উঠে বসতে চাইলেই সে আমাকে উঠতে বারণ করল। জোর করে আবার শুইয়ে দিল। আমি কখন আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল। তখন আমি মোটামুটি সুস্থ বোধ করলাম। বিছানায় উঠে বসলাম।
আমি এবার আর নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। বুড়িকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল আমার?
বুড়ি তখন বলল, আপনি এক পিশাচিনীর পাল্লায় পড়েছিলেন। পিশাচিনী মানে এক নারী প্রেতাত্মা। এরা গভীর জঙ্গলে, নদী কিংবা দীঘির পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এরা বেশির ভাগ সময় উলঙ্গ নারীর বেশ ধরে যুবক পুরুষদের ভুলিয়ে আকৃষ্ট করে।তারপর এরা পুরুষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে। এরা খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির।
আপনার আগেও অনেক লোক ওই দীঘির জলে ডুবে মারা গেছে। কিন্তু আমরা এলাকার লোকেরা কেউ কিছু বুঝতে পারিনি কিভাবে মারা গেছে তা’রা। এখন আপনার এই ঘটনার পর, আমাদের কাছে সব ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আপনি খুব জোর-বাঁচা বেঁচে গেছেন। আমি সে’দিন গরু খুঁজতে ও’দিকটায় না গেলে আপনি হযতো ডুবে মরে থাকতেন ওই সব আগের লোকদের মতোই।
আমি বুড়ির দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালাম। তাকিয়ে হাসি হাসলাম। তা দেখে বুড়ির মুখে প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ল। আমার মনটা ভরে উঠল।
কিন্তু আমি লিলা ব্রাউনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারলাম না।