Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু || Humayun Azad

নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু || Humayun Azad

বাহাত্তরে, স্বাধীনতার অব্যবহিত-পরবর্তী কয়েক মাস,
একটি প্রতীকী চিত্রকল্প–রাইফেলের নলের শীর্ষে রক্তিম গোলাপ
আমাকে দখল করে থাকে। সেই চিত্রকল্পরঞ্জিত কোনো এক মাসে,
মধ্য-বাহাত্তরে, এখন আবছা মনে পড়ে, আমি
প্রথম দেখেছিলাম নাসিরুল ইসলাম বাচ্চুকে। সদ্য গ্রাম থেকে আসা
ওই ঝলমলে সবুজ তরুণকে দেখে আমার স্বাধীনতালব্ধ
চিত্রকল্প আরো জ্বলজ্বল করে উঠেছিলো, এবং এখন ব্যাপক
স্মৃতিবিনাশের পরেও আমার মনে পড়ে সংক্রামক আশাবাদের
বাহাত্তরে আমিও কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম।
স্বপ্ন দেখেছিলাম রাজিয়ার নখের মতো উজ্জ্বল লাল দিন,
সব ভুল সংশোধিত হবে, সংশোধিত হবে, সংশোধিত হবে
ব’লে আমিও অন্তর্লোকে জপেছিলাম অত্যন্ত অসম্ভব মন্ত্র।

কিন্তু আশা–অন্ধ আর নির্বোধের দুঃস্বপ্ন–টেকে নি; আরেক ডিসেম্বর
আসতে-না-আসতেই আমার স্বাধীনতালব্ধ প্রতীকী চিত্রকল্প
নষ্ট হয়ে যায়। আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে যাই, আর তিন বছরে
বাঙলাদেশ অনাহার, হাহাকার, অসুস্থতা, পরাবাস্তব খুনখারাবিতে
ভরে ওঠে অ্যালান পোর গল্পের মতোন। ফিরে এসে দেখি
বাঙলাদেশে বিদ্রোহ-বিপ্লব-স্বপ্ন ও আশার যুগের পর গভীর ব্যাপক
এক অপ্রকৃতিস্থতার যুগ শুরু হয়ে গেছে। এবং তখনি
এক দিন রাস্তায় আবার দেখা হয় নাসিরুল ইসলাম বাচ্চুর সাথে :
দেখি সেও নষ্ট হয়ে গেছে আমার স্বাধীনতালব্ধ চিত্রকল্পের
মতোই–সূক্ষ্ম তন্তুর এপারের বাস্তবতা পার হয়ে বাঙ্গু অনেক দূরে
চলে গেছে তন্তুর ওপারে। এরপর তার ক্রমপরিণতি, অনেকের
মতো, আমিও দেখেছি। সে আবর্তিত হতে থাকে রোকেয়া হলের
স্বপ্নদরোজা থেকে নীলখেতের দুঃস্বপ্ন পর্যন্ত– বিড়বিড়
করতে করতে হাঁটে আর ভাঙা দেয়ালের ওপরে বসে ‘প্রেম, প্রেম,
বিপ্লব, বিপ্লব’ বলে চিৎকার করে থুতু ছুঁড়ে দেয় শহর-স্বদেশ
সভ্যতা-স্বাধীনতা প্রভৃতি বস্তুর মুখে। কয়েক বছরে
যৌবন জীর্ণ হয়ে নাসিরুল ইসলাম বুড়ো হয়ে যায়,
(এ-সময়ে, আমি লক্ষ্য করেছি, যুবকেরাই যৌবন হারিয়েছে
দ্রুতবেগে, আর বাতিল বুড়োরা সে-যৌবন সংগ্রহ করে
বেশ টসটসে হয়ে উঠেছে দিন দিন) তার চোয়াল দিকে দিকে
ভেঙে পড়ে, মাথায় জন্ম নেয় বাঙলাদেশের মতো এক ভয়ংকর জট,
আর সে বাঁ-হাতে আস্তিনের তলে বইতে থাকে একখণ্ড ইট।

পাঁচ বছরে আমার বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প–রাইফেলের নলের শীর্ষে
রক্তিম গোলাপ–রূপান্তরিত হয় একমাথা ভয়ংকর জট আর
আস্তিনের তলে একখণ্ড ইটে। স্বাভাবিক বাস্তবতা পেরিয়ে যারা
অস্বাভাবিক বাস্তবতায় ঢুকে পড়ে, তারা নতুন বাস্তবতায় ঢোকার
আশ্চর্য মাসগুলোতে সবখানে দেখতে পায় নিজের প্রভাব। নাসিরুলও
তার দ্বিতীয় বাস্তবতায় ঢোকার প্রথম পর্যায়ে বাঙলা ভাষার
সমস্ত গদ্যেপদ্যে দেখতে পেতো নিজের প্রভাব। কলাভবনে একদিন
সে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে, এবং টেবিল থেকে সঞ্চয়িতা
তুলে ওই অমর গ্রন্থের প্রত্যেকটি ছত্রে সে নিজের সুস্পষ্ট প্রভাব
দেখে প্রচণ্ড চিৎকার করে ওঠে। বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের
সমস্ত কবিতা ওর কবিতার অক্ষম নকল বলে দাবি করে। আমি
ওর দিকে আমার একটি কবিতা বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাই
কবিতাটি ওর কোনো কবিতা নকল করে লেখা কি না?
নাসিরুল কবিতাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে, দ্বিতীয় স্তবকে
‘ভালোবাসি’ শব্দটি পেয়েই শোরগোল করে বলে, ‘এইটা আমার শব্দ,
আমার কবিতা থেকে মেরে দিয়েছেন।’ খলখল করে হাসে নাসিরুল।
আমি জানি নাসিরুল ইসলাম বাচ্চুর কবিতার কোনো প্রভাব পড়ে নি
কারো ওপরেই– কিন্তু আজকাল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, রাস্তায়
হাঁটি, ক্লাবের আড্ডায় বসি, বন্ধুর সংসর্গে আসি, খবরের কাগজ
পড়ি, টেলিভিশনের বাক্স খুলি, তখন বুঝতে পারি চারদিকে কী গভীর
তীব্রভাবে পড়ছে নাসিরুল ইসলাম বাচ্চুর ব্যক্তিগত প্রভাব।
নাসিরুলকে অনুসরণ করে দলে দলে লোকজন চলে যাচ্ছে তন্তুর ওপারে।
একুশের উৎসবে বাঙলা একাডেমিতে এক স্টলের সামনে
দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা কয়েকজন, দেখলাম রিকশা থেকে নামছেন
এক অর্ধপল্লী অর্ধআধুনিক কবি,–লাল টাই অদ্ভুত জাকেট
গায়ে তাঁর, সব কিছু অবহেলা করে আমাদের কাছাকাছি এসে
কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেনো বাঙলা একাডেমির
বুড়ো বটের শাখায় দেখতে পাচ্ছিলেন গোটা দুই ফেরেশতার ডানা।
তিনি কথা শুরু করতেই আমি দেখলাম সরু সুতো পেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি,
রূপান্তরিত হচ্ছেন–তাঁর বিকট মাথায় জড়ো হয়ে উঠছে জট, জামা
ছিঁড়ে যাচ্ছে, দড়িতে রূপান্তরিত হচ্ছে টাই, এবং বাঁ-হাতে আস্তিনের
কাছাকাছি ধরে আছেন একখণ্ড হলদে ইট। কলাভবনের বারান্দায়
প্রিয় কবিতার খণ্ড খণ্ড পংক্তি বিড়বিড় করতে করতে
আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন এক তরুণ অধ্যাপক, কুশলবিনিময় ছাড়াই
বললেন, ‘আমার যে-লেখাটিতে আমি এক নতুন তত্ত্ব…আপনি
সেটা’…অমনি দেখতে পেলাম আমি তরুণ অধ্যাপক রূপান্তরিত
হচ্ছেন জট-ছেঁড়া শার্ট-ইটখণ্ডের সমষ্টিতে। অত্যন্ত আতংকে
দৌড়ে আমি ঘরে ঢুকে হাঁপাতে লাগলাম। বেইলি রোডে এক আমলার
সাথে দেখা হলো, দীর্ঘ সিগারেট বের করে যেই তিনি আত্মপ্রকাশ
আরম্ভ করলেন, অমনি তাঁর অভ্যন্তর থেকে এক মাথা জট, বাঁ-হাতে
হলদে ইট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু।

এক জনতাজাগানো রাজনীতিকের সাথে দেখা হলো পানশালায়।
‘নাসিরুল এখানেও আসে?’ আমি বিস্মিত হয়ে যেই স’রে পড়ছিলাম,
তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, ‘হেই ডকটর আজাদ, আমাকে কি
চিনতে পারছেন না?’ আমি দেখলাম নাসিরুল আমার পেছনে ছুটছে,
আর বাঁ-হাতের ইট তুলে আমাকে ডাকছে। পানটান ভুলে আমি
লাফিয়ে রাস্তায় নামলাম। আমার একটি ছাত্রী, ‘আসি স্যার’
বলতেই দরোজা জুড়ে দেখলাম এক স্ত্রীলিঙ্গ নাসিরুল;
আমার ক্লাশের বিনম্র ছেলেটি একদিন এমনভাবে তাকায় আমার
দিকে যে আমি তার জট আর ইট দেখে দৌড়ে বেরিয়ে
আসি, সাত দিন আমি আর ক্লাশে যাই না।

এখন যখনি রাস্তায় হাঁটি, খবরের কাগজ উল্টোই, টেলিভিশনের
চব্বিশ ইঞ্চি বাক্সটা খুলি, ক্লাবে বা বাজারে যাই,
সচিবালয়ে ঢুকি, আলোচনা কক্ষে বা সভায় গিয়ে বসি, দেখতে পাই
আমাকে ঘিরে ফেলছে অসংখ্য নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু
মাথায় বাঙলাদেশের মতো জট, ছেঁড়া শার্ট, বাঁ-হাতে হলদে ইটের খণ্ড।
সেদিন সন্ধ্যায় তিনটা আধাশিক্ষিত কবি, দুটি দ্বান্দ্বিক
প্রবন্ধকার, একটা দালাল, তিনটি লুম্পেন, দুটি এনজিও, পাঁচটি আমলার
সাথে সমাজ ও শিল্পের সম্পর্ক, শিল্প আর জীবনের বৈপরীত্য,
অর্থের মূলতত্ত্ব, তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির নোংরা ব্যাকরণ,
গণতন্ত্র, জলপাইরঙের উত্থান ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র বাক্য ছুঁড়ে
যখন রাস্তায় একা হেঁটে ফিরছিলাম, তখন চমকে উঠে টের পাই :
আমার মাথায় শক্ত হয়ে উঠছে জট, শার্ট ছিঁড়ে যাচ্ছে, গাল ভাঙা,
বাঁ-হাতে অত্যন্ত যত্নে আমি ধরে আছি একখণ্ড হলদে ইট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *