Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নারান || Moti Nandi » Page 3

নারান || Moti Nandi

কুড়ি বছর কেটে গেছে

০৬.

কুড়ি বছর তারপর কেটে গেছে।

উনিশশো ছিয়াশির ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এক সন্ধ্যায় নারান খেলার বিভাগে এল। মাত্র এক মাস আগে রিটায়ার করে সে ছ মাসের জন্য এক্সেটনশন পেয়েছে।

দোতলা থেকে তিনতলায় উঠে এসেছে সংবাদ বিভাগ, সেই সঙ্গে রিপোর্টিং, প্রুফ রিডিং, টেলেক্স, খেলার বিভাগও। লম্বা হলঘরের এক কোনায়, পুরনো টেবিলটার দু পাশে আগের মতোই চেয়ার পাতা, কিন্তু পুরনো লোকেরা আর কেউ নেই। শৈলেনবাবু আর শ্যামলবাবুর পর আরও তিনজন লোক এসেছে। খুব অল্পবয়সি, নারান তাদের চেনে না।

মাণ্টাবাবু রিটায়ার করেছেন। অফিসের স্পোর্টসের দিন তিনি মাঠে আসেন, তখন দেখা হয়। প্রতিবারই বলেন, তুই আমাকে খুব ঠকান ঠকিয়েছিলি নারান। আটশো, চারশো আর দুশো, পর পর তিনটে রেসে নামতে চাওয়ায় আমি তো ভেবড়ে গেছলুম। তখন তোর বয়সের কথা ভেবে আমি তো রাজিই হইনি তোর এন্ট্রি নিতে। মনে আছে? নারান শুনে যায় আর মিটমিটি হাসে আর বলে, সে বছর যে ওলিম্পিকে জ্যাটোপেক তিনটে সোনা জিতেছিল!…আমাদের যে একই তারিখে জন্ম। মাণ্টাবাবু হেসে শ্যামলবাবুকে বলেছিলেন, বুঝলে শ্যামল, আমি বিরক্ত হয়ে ওকে বলেছিলুম, তুই কি জ্যাটেপেক হয়ে গেছিস ভেবেছিস?

নারান সেদিন খেলার বিভাগে এসে দেখল একজন বসে কপি অনুবাদ করছে। একে সে দেখেছে, কিন্তু নাম জানে না। এ-ও বোধহয় তাকে চেনে না। দেয়ালের ধারে টুলে বসে আছে অমিয়। নারান তাকে জিজ্ঞেস করল, শৈলেনবাবু, শ্যামলবাবু কখন আসেন?

এবার তো মাঠ থেকে আসার সময় হল। আপনি বরং শশধরবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, ওই যে টেবিলে বসে।

নারান কুণ্ঠিতভাবে শশধরের পাশে দাঁড়াল। নমস্কার করে বলল, আমার নাম নারান হালদার, এখানে বেয়ারার কাজ করি। অনেক দিন খেলার বিভাগে ছিলাম, তারপর স্টোরে। অনেক বিভাগ ঘুরে এখন পোস্ট বক্সে আছি। রবিবাবু, টোলুবাবু, মান্টাবাবু আমায় খুব ভালবাসতেন। আপনি বোধহয় ওদের দেখেননি।

শশধর ভ্রূ কোঁচকাল। নাম শুনেছি, মাল্টাবাবু ছাড়া কাউকে দেখিনি।

সংক্ষেপে জবাব দিল শশধর, নিরাসক্ত স্বরে। সে ধরে নিয়েছে, এই কৃশকায়, কৃষ্ণবর্ণ, আধময়লা হাফ-হাতা পাঞ্জাবিপরা লোকটি এবার পকেট থেকে চার ভাঁজ করা ময়লা একটি কাগজ বার করে বলবে, পাড়ার ফাইভ এ সাইড রবারের বল ফাইনাল, খবরটা যদি একটু…

একটা খবর…

কিন্তু এসব আর ছাপা হয় না। বিব্রত স্বরে শুরুতেই নারানকে থামিয়ে দিল শশধর।

থতমত নারান লাজুক গলায় বলল, আজ্ঞে ছাপাতে নয়, একটা খবর জানতে এসেছি।

শশধর এবার লজ্জা পেল, অপ্রতিভও বোধ করল। গত বছর অফিসের স্পোর্টসে এই নারান হালদারকে সে দৌড়তে আর প্রাইজ নিতে দেখেছে।

কী খবর?

কাগজে দেখলুম, এ মাসের সাতাশে ক্রীড়া দিবস হবে। তাতে নাকি এমিল জ্যাটোপেক আর তার বউ ডানা কলকাতায় আসবেন।…সত্যি নাকি?

হ্যাঁ, সেইরকমই তো আমাদের বলেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী।

কোথায়, কখন ওঁদের দেখা যাবে, জানেন নাকি?

এখনও কিছু আমাদের জানানো হয়নি। হলে কাগজে নিশ্চয় দেখতে পাবেন। আজ বেঙ্গল অ্যামেচার অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের একটা প্রেস কনফারেন্স আছে, শ্যামলদা গেছে। হয়তো জ্যাটোপেকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছু জানা যাবে।

নারানের যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। জ্যাটোপেকের আসার কথাটা তা হলে সত্যিই। টোলুবাবুকে একদিন বলেছিল, জীবনে এত বড় দুঃখ সে আর কখনও পায়নি। ওঁকে দেখার ওই প্রথম আর শেষ সুযোগ সে হারিয়েছে। তখন টোলুবাবু বলেছিলেন কোনটে বড় আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষে শুধু মন খারাপ আর সময় নষ্ট হয়।…জীবনে এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পট্যান্ট মনে হবে।

তিরিশ বছর আগের সেই প্রথম আর শেষ সুযোগটা আবার তার সামনে আসছে। এবার আর সে হাতছাড়া করবে না। ট্রেনকে আর বিশ্বাস করবে না। যদি একদিন আগেও কলকাতায় গিয়ে থাকতে হয় তা হলেও সে শেয়ালদার স্টেশনে কিংবা অফিসে রাত কাটাবে।

ইলেকট্রিক ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিরিশ বছর আগের সেই দিনটার কথা তার মনে পড়তে লাগল। ময়দান থেকে অফিসে ফিরে গেছিল নাইট ডিউটি করতে। টেবিলে আলোচনা হচ্ছিল জ্যাটোপেকের দৌড় নিয়ে।

মান্টাবাবু বললেন, বুঝলেন রবিদা, জ্যাটোপেক যখন দৌড়চ্ছিল কীরকম একটা কষ্টের ছাপ ওর মুখে ফুটে উঠছিল। কাঁধটা, দুটো হাত, শরীর যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি মাটিতে লুটিয়ে পড়বে!

মাণ্টা, এটাই ওর দৌড়বার স্টাইল। আসলে এত কষ্ট আর অসুবিধের মধ্যে ট্রেনিং করেছে যে মুখে হাসি ফোটাবার মতো অবস্থা ছিল না। ভাবতে পারো, জ্যাটোপেক যখন দুবছর মিলিটারিতে ছিল, তখন জঙ্গলের মধ্যে ওর ক্যাম্পের কাছে শুধু চারশো মিটারের একটা মাটির রাস্তা ছাড়া দৌড়বার মতো কোনও জায়গা ছিল না। বৃষ্টিতে কাদায়, শীতকালে বরফে ঢাকা। তাই ভেঙে ভারী মিলিটারি বুট পরে আর শরীরের ওজন বাড়াবার জন্য ভারী ভারী ওভারকোট গায়ে দিয়ে, রুকস্যাক পিঠে বেঁধে দৌড় প্র্যাকটিস করত। ওই চারশো মিটার ষাটবার তার মধ্যে দুশো মিটার প্রিন্ট অর্থাৎ, চব্বিশ হাজার মিটার, মানে চব্বিশ কিলোমিটার ওইভাবে প্রতিদিন!

তার মানে প্রায় পনেরো মাইল, প্রতিদিন! টোলুবাবু হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ছিলেন।

প্রতিদিন, দুবছর! কাদায় পা আটকে যেত বলে তাই উঁচু করে হাঁটু তুলে দৌড়ত। এটাই পরে নতুন এক টেকনিক হয়ে যায়। স্পিডের জন্য জোরে দৌড় আর এনডিওরেন্সের জন্য বারবার রিপিট করা। দৌড়ের মধ্যে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে কিছুটা ছুটে যাওয়া, তারপরই আবার সহজ ছন্দে ছুটতে থাকা। এটা নতুন ব্যাপার—একে ইন্টারভ্যাল রানিং বলে।

শুনতে শুনতে নারান রোমাঞ্চ বোধ করেছিল। এইভাবে ট্রেনিং! ওর তো পেটের দায়, সংসার চালাবার দায় ছিল না, তা হলে এমন পাগলের মতো একা একা পরিশ্রম কীসের জন্য? রাতে ডিউটি করার পর খালি পেটে, শুধু চা আর এক আনার বিস্কুট খেয়ে আটাশ মাইল সাইকেল চালানো, নারানের মনে হল, জ্যাটোপেকের ট্রেনিংয়ের কাছে কিছুই নয়।

টোলু, একজন জিজ্ঞেস করেছিল জ্যাটোপেককে, দৌড়বার সময় আপনার মুখে কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে। হাসতে পারেন না? তাইতে উত্তর দিয়েছিল: একই সঙ্গে দৌড় আর হাসি, এই দুটো জিনিস করার মতো যথেষ্ট প্রতিভা আমার নেই।

কথাটা শুনে সবার সঙ্গে নারানও তখন হেসে উঠেছিল। ট্রেনে যেতে যেতে তিরিশ বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ায় তার মুখে হাসি ফুটল। রাতের বনগাঁ লোকালের ভিড়ের মধ্যেও হাসি? নারান নিজেকে নিয়ে অবাক হল। জীবনের পিছন দিকে তাকালে এখন তার হাসিই পায়। কত জিনিস তুচ্ছ, অকারণ, বাহুল্য মনে হয়। যেমন, শিবুর দোকানে রসগোল্লার হাঁড়িটা ভেঙে ফেলার কোনও দরকার ছিল কি? শঙ্কর, নারু, শচীন হালদাররা কেউই আজ বেঁচে নেই। প্রাইজ হাতে নিয়ে গত মাসেও ফিরেছে, কেউ তাকিয়েও আর দেখে না।

এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পট্যান্ট মনে হবে..না না, টোলুবাবু, এটা আপনি ঠিক বলেননি। কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু ঘটনা চিরকাল আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট থেকে যাবে।…আমাকে কেডস কিনে দেওয়া….।

বসে পড়ুন দাদু, সিট খালি হয়েছে। পাঞ্জাবির কোণ ধরে টানল এক ছোকরা। নারান বসে পড়ল।

এখন তার পাকা একতলা বাড়ি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের হাজার পঞ্চাশ টাকা পাবে। তখন দোতলা তুলবে। তিন বছর আগে সে টিভি কিনেছে। অবনী ডবলু বি সি এস। হয়ে এখন বীরভূমে আছে বউ আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে। নবনী জোড়া নিমতলা স্কুলে সায়েন্সের মাস্টার। রজনী বি এস সি পাশ করে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করছে। দুবার ক্লাস এইটে ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়ে গৌতম এখন প্রথম ডিভিসনে ফুটবল খেলছে। মহামায়া প্রবল আপত্তি তুলেছিল, নারান তা নাকচ করে বলেছিল, খেলাটাও তো এক ধরনের শিক্ষার ব্যাপার। যদি টাকা রোজগার করতে পারে তা হলে খেলুক না! নয়নের বিয়ে হয়েছেই শুধু নয়, তার বড় মেয়ে শর্মিষ্ঠা এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। হাবড়া বাজারে জামাইয়ের কাটা ছিট কাপড়ের দোকান।

পরদিন কাগজে খেলার পাতায় নারানের চোখ আটকে গেল একটা খবরে— রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, সারা ভারত আমন্ত্রণী ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা! সল্ট লেক স্টেডিয়াম থেকে সকাল সাতটায় শুরু হয়ে আবার স্টেডিয়ামেই শেষ। সমাপ্তি-সীমায় প্রতিযোগীদের অভিনন্দন জানাতে উপস্থিত থাকবেন জ্যাটোপেক-দম্পতি।

নারান অনেকক্ষণ খবরটার দিকে তাকিয়ে রইল। তা হলে সত্যিই ওঁরা আসছেন। গড়ের মাঠে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে শনিবার দুপুর একটায় মিছিল বেরিয়ে যাবে সল্টলেক স্টেডিয়ামে। জ্যাটোপেক-দম্পতি এগারোটায় দমদমে নামবেন। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে ব্রিগেড প্যারেড মাঠে। তাঁরা মিছিলের সূচনা করবেন।

খবরের আর কিছু জানার দরকার সে বোধ করল না। এমিলকে যদি কাছ থেকে দেখতে হয় তা হলে ব্রিগেড মাঠের বিরাট ভিড়ের মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। পরে ওঁদের সল্ট লেক স্টেডিয়ামেও নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেখানেও ভিড় হবে। ধাক্কাধাক্কিতে কোথায় যে ছিটকে যাবে তার ঠিকঠিকানা নেই। সে কাছের থেকে ওঁদের দুজনকে দেখতে চায়।

ঠিক তিরিশ বছর আগে, মোহনবাগান মাঠে ওঁর দৌড়ের ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। ছবিটা নারান কেটে রেখে দিয়েছে। জ্যাটোপেক সম্পর্কে একটা লেখাও তখন বেরিয়েছিল, টোলুবাবুর লেখা। সেটাও সে কেটে রেখে দিয়েছে।

নারান খাটের নীচে হামা দিয়ে ঢুকে কবজা-ভাঙা একটা টিনের তোরঙ্গ বার করে আনল। এর মধ্যে তার পুরনো জিনিস রাখা আছে। নানারকমের রেশমের, পশমের হেঁড়া জামা কাপড়, কাঠের ভাঙা খেলনা, সাইকেলের টিউব, স্পোর্টসের স্মারক পুস্তিকা ঘেঁটে সে একটা খাম বার করল।

খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া কয়েকটা টুকরো। লালচে হয়ে গেছে। তারই একটা জ্যাটোপেকের দৌড়ের ছবি। সন্তর্পণে সে ভাঁজ খুলল। হাতকাটা গেঞ্জি, পায়ে জুতো। ওঁর পিছনেই খালি পায়ে একজন অনুসরণ করছে। দেখা যাচ্ছে ট্র্যাকের দাগ, ওলটানোে একটা মাটির গ্লাস। পিছনে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে দর্শকরা, মাটিতেও বসে আছে অনেকে। জ্যাটোপেকের মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গেছে। তখন ওঁর বয়স ছিল ছত্রিশ। নারানের মনে হল, এত বছর কেটে গেছে, এখন বয়স ছেষট্টি, নিশ্চয় টাক পড়ে গেছে! ডান পায়ের হাঁটু উঠিয়েছেন, ঊরুর পেশিতে একটা ভাঁজ। নারান অনুমান করতে পারল, কী প্রচণ্ড শক্তি ওই ভাঁজটা থেকে কুঁচকি পর্যন্ত ফুলে-ওঠা অংশে জমা হয়ে আছে।

কিন্তু দৌড়ের সময় ওঁর মুখে নাকি কষ্টের ভাব ফুটে ওঠে, অথচ খুব খুঁটিয়ে দেখেও সে তেমন কিছু খুঁজে পেল না। হয়তো সহজ রেস, তাই সহজ ভাবে দৌড়চ্ছেন। উনি তো জানেনই পৃথিবীতে তাঁকে হারাবার মতো কেউ তখন নেই। অফিসের স্পোর্টসে অমন আলগা মেজাজে সেও তো দৌড়ত। মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ ছবিটা দেখে সে কাগজের আর-এক টুকরো তুলে নিল।

টোলুবাবুর লেখা। চার ভাঁজ করে রাখা। খোলা মাত্র ভাঁজ থেকে কেটে আলাদা হয়ে গেল কাগজটা। সযত্নে আবার তুলে রাখতে গিয়ে সে কী মনে করে একটা টুকরো তুলে পড়তে শুরু করল:

তারপর ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকে ৫০০০ মিটার, ১০০০০ মিটার এবং ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ীর মঞ্চে যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন দৌড়ের বিস্ময়, নব-ইতিহাসের স্রষ্টা এবং রক্তমাংসের বাষ্পীয় যান নামে অভিহিত করল তাঁকে বিশ্বের অগণিত নরনারী। পঞ্চদশ ওলিম্পিকের নতুন নামকরণ করল জনসাধারণ ওই বিজয়ী বীরের নামে—হেলসিঙ্কি ওলিম্পিক—জ্যাটোপেকের ওলিম্পিক।

নারান আর একটা কাগজের টুকরো তুলে নিল।

কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। স্বামীর কৃতিত্বে উদ্বেলিত হৃদয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন ওই দৌড়বীরের সাধ্বী স্ত্রী। সহধর্মিণী শুধু নন, সহকর্মিণী হিসাবে স্বামীর গৌরবকে আরও গৌরবান্বিত আরও মহিমান্বিত করার জন্য এগিয়ে এলেন বর্শা হাতে বীর নারী। বর্শা ছুড়ে দিলেন প্রিয় স্বামীকে স্মরণ করে। ঝলসিয়ে উঠল সূর্যকিরণে সেই বর্শাফলক। তির বেগে এগিয়ে চলল সেই বর্শা। শ্যামল কোমল দূর্বাদলের মধ্যে যখন সেই শাণিত বর্শার মুখ গিয়ে বিধল মাটিতে তখন বিচারকেরা বিস্মিত বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন সেই কম্পমান বিদ্ধ বর্শার দিকে। ঘোষণা করা হল বর্শা নিক্ষেপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নূতন ওলিম্পিক রেকর্ড। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়ের গৌরবে আলিঙ্গন করলেন একে অপরকে।

পড়তে পড়তে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নারান। কী মিষ্টি ভাব, কী মিষ্টি ভাষা দিয়ে টোলুবাবু লিখেছেন। চোখের সামনে যেন ঘটনাটা দেখা যায়।

কী দেখছ অমন করে হেঁড়া কাগজে? মহামায়া পিছন থেকে বলল।

কিছু না, পুরনো একটা খবর। নারান কাগজগুলো যত্ন করে খামে ভরে পিছনে তাকাল।

আজকের কাগজ কি পড়া হয়েছে? নবু চাইছে একটা খবর দেখার জন্য।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যাও। কাগজটা মহামায়ার হাতে দেবার আগে সে আর-একবার খেলার পাতাটায় চোখ বোলাল। আমন্ত্রণী ম্যারাথন প্রতিযোগিতার খবরটার নীচে ঘন গভীর কালো অক্ষরে লেখা। লাইনগুলোয় তার চোখ আটকে গেল। সোমবার

সন্ধ্যায় সিটি ক্লাব তাঁবুতে জ্যাটোপেক-দম্পতিকে বাংলার অ্যামেচার অ্যাথলেটিক সংস্থা সংবর্ধনা জানাবেন। তিনি আরও বলেন তখন ম্যারাথন বিজয়ীর হাতে ট্রফি তুলে দেবেন সেই কিংবদন্তির মানুষটিই যিনি বলেছিলেন, দৌড়তেই যদি চাও তা হলে দৌড়ও এক মাইল। যদি অন্য এক জীবনের অভিজ্ঞতা চাও তা হলে দৌড়ও ম্যারাথন।

অন্য এক জীবন!

কী সেই জীবন? কেমন সেই জীবন?…তার হাত থেকে কাগজটা তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মহামায়া। নারান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আবার ভাবল, এখন আমার বয়স ছেষট্টি, আর কী অভিজ্ঞতা, আর কী জীবন বাকি আছে?

সন্ধ্যার সময় সে খেলার বিভাগে অনাদিবাবুর সামনে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার নারান, অফিস স্পোর্টস তো হয়ে গেছে, তা হলে আবার যে তুমি…এবারই তো ছিল শেষবারের মতো মাঠে নামা?অনাদিবাবু প্রশ্নটা করার সময় স্বর নামিয়ে নিলেন। নারান লক্ষ করল, ওঁর মাথার চাঁদিতে টাক পড়েছে। অনাদিবাবুর চাকরিও প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল।

নারানদাকে একটা ফেয়ারওয়েল দিতে হবে যেদিন ফাইনালি রিটায়ার করবেন। শ্যামল বলল।

ম্পোর্টস থেকে না চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টের ফেয়ারওয়েল, শ্যামল? শৈলেন পকেট থেকে নোটবই বার করে টেবলে রাখল। নারানদাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, আরও বছর দশেক প্রাইজগুলো নিতে পারেন।..শশধর মোহনবাগান টু ফিফটি টু অল আউট, অরুণলাল হান্ড্রেড টেন।…আমি ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসছি।

একটা কথা ছিল অনাদিবাবু।নারান ঝুঁকে, লাজুক স্বরে বলল, খবর দেখলাম, একটা আমন্ত্রণী ম্যারাথন প্রতিযোগিতা হবে, জ্যাটোপেক তার ফিনিশিংয়ে রানারদের অভিনন্দন জানাবেন।…সত্যি?

ও অ্যাথলেটিকসের ব্যাপার, তুমি বরং শ্যামলকে জিজ্ঞেস করো। ওই খবরটবর করে।

নারান টেবল ঘুরে শ্যামলের পাশে গেল।

সে জিজ্ঞেস করার আগেই শ্যামল বলল, হ্যাঁ, জ্যাটোপেক থাকবেন ফিনিশিং পয়েন্টে।

অভিনন্দন জানাবেন..মানে হ্যান্ডশেক করবেন?

হ্যান্ডশেক করবেন কি আলিঙ্গন করবেন, তা আমি কী করে বলব? হয়তো গালে চুমুও খেতে পারেন…সাহেব তো! শ্যামল গোছা করা কপি টেনে নিল।

আমি ম্যারাথনে নামব…ব্যবস্থা করে দেবেন?

এত মৃদু স্বরে নারান কথাটা বলল যে, টেবলের কেউই শুনতে পেল না। সে সেকেন্ড কুড়ি অপেক্ষা করে, একটু জোরে বলল, যে ম্যারাথনটা হবে তাতে আমি দৌড়তে চাই…শ্যামলবাবু আপনার তো চেনাশোনা…।

কী বললেন? সিধে হয়ে বসল শ্যামল। আর একবার বলুন!

ম্যারাথনে আমি দৌড়ব।

নারান এবার স্পষ্ট স্বরে বলল। তিনজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে, পাতলা হাসিতে মুখ ভরিয়ে সে আবার বলল, কোথায় কাদের কাছে নাম দিতে হবে জানি না। আমায় দেখলে হয়তো তারা নাম নিতে রাজি হবে না, তাই আপনাদের সাহায্য চাই।

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। তিনজনই তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। অবশেষে অনাদিবাবু একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, নারান এটা অফিসের স্পোর্টস নয়..ম্যারাথন কী জিনিস জাননা?

ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ…

দূরত্বটা কতখানি সে সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে? শ্যামল জানতে চাইল।

প্রায় অতটাই আমি রোজ সাইকেল চালিয়ে কাগজ বিলি করেছি, আট বছর ধরে।

কবে? শশধর তার জ্যেষ্ঠদের কথার মাঝে নিজের প্রশ্নটা গুঁজে দিল।

তা প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে।

আর তারই জোরে আপনি এখন ম্যারাথন দৌড়তে চান? শ্যামল জ্ব তুলে, কপালে ভাঁজ ফেলে তেরছা চোখে তাকাল।

গত কুড়ি বছর ধরে রোজ সকালে আমি দৌড়ই। আমার বউ হাঁটে।…কুড়ি বছর ধরে, আমরা দুজনে…বৃষ্টি হলে অবশ্য বেরোই না, মাটি পিছল হয়ে থাকে।

ক মাইল দৌড়ন?

তা কি আমি মেপে দেখেছি? পাঁচটার সময় বেরোই, সাড়ে ছটার মধ্যে ফিরে আসি। বউকে রান্না করতে হবে, আমাকে অফিসের ট্রেন ধরতে হবে তো।

দেড় ঘণ্টা! তার মানে… শ্যামল জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল অনাদিবাবুর দিকে। ওই সময়ের মধ্যে কতটা দৌড়োনো সম্ভব সেটারই আন্দাজ পাবার জন্য সে সাহায্য চাইছে।

দেড় ঘণ্টায় কতটা দৌড়বে, শশধর? অনাদিবাবু সাহায্য চাইলেন, বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকা শশধরের কাছে।

দেড় ঘণ্টায়…তা ধরুন গিয়ে…এখন তো পুরুষদের ম্যারাথন দুঘণ্টা দশ মিনিটে দৌড়োনোটাই ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। শশধর গাম্ভীর্য টেনে দিল মুখের উপর।

তুমি কি বলতে চাও, নারান রোজ একটা থ্রি-ফোর্থ ম্যারাথন দৌড়য়? কী যে বলো!

না না তা বলছি না, শশধর কাঁচুমাচু হল। নারানদের পক্ষে…আচ্ছা এখন আপনার বয়স ঠিক কত?

ছেষট্টি।

অ্যাঁ! শুধু শশধরেরই নয়, আরও দু জোড়া চোখ নারানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

পুরো ছেষট্টি নয়, এখনও সাতমাস বাকি। ওঁর আর আমার জন্ম তারিখ একই, উনিশে সেপ্টেম্বর। নারানের স্বরে ঈষৎ গর্ব চাপা রইল না।

ওঁর মানে? শ্যামলের প্রশ্ন।

জ্যাটোপেকের।

কিন্তু নারান, এই বয়সে তুমি ম্যারাথনে নামবে! কেন? এখন তো বানপ্রস্থে যাবার কথাই তোমার ভাবা উচিত।

অনাদিবাবু, আজীবন সংসারের জন্য খেটে এসেছি। বানপ্রস্থ ফ্রস্থ নিয়ে মাথা ঘামাবার টাইম আর পেলাম কই? ম্যারাথন মানে তো অন্য এক জীবনের অভিজ্ঞতা পাওয়া! এইটে পাওয়া হলেই রিয়াটার করব সব জায়গা থেকে।…আমার জন্য যদি আপনারা একটু ব্যবস্থা করে দেন। নারান হাত জোড় করল।

নারানের কণ্ঠস্বরে এমন এক মিনতি, উৎকণ্ঠা, অসহায়তা আর সারল্য মিলিয়ে রয়েছে যা প্রত্যেকের মন ছুঁয়ে গেল।

শ্যামল বলল, ঠিক আছে, নারানদা কাল আপনি ঠিক ছটায় সিটি টেন্টের সামনে থাকবেন। ওখানেই অ্যাথলেটিকসের কর্তাদের পাওয়া যাবে। আমি আপনাকে নিয়ে গিয়ে কথা বলব। তবে একটা কথা, ওরা যদি আপনার বয়সের জন্য রিস্ক নিতে না চায়, তা হলে কিন্তু আমি কিছু করতে পারব না।

নারানকে তো অনায়াসে পঞ্চাশ বলে চালানো যায়, যায় না শশধর? ওর মুখের চামড়া কোঁচকায়নি, ঝুলে পড়েনি। চুল তো সবই কালো শুধু কয়েকটা মাত্র সাদা হয়েছে। অনাদিবাবু বললেন।

কিন্তু ওরা পঞ্চাশ বছর বয়সিকেও কি দৌড়তে দেবে? শশধর সন্দেহ প্রকাশ করল।

দেখা যাক। নারানদা তা হলে কাল ছটায়, সিটি টেন্টের সামনে।

নারান যখন চলে যাচ্ছে, ওরা তিনজনই মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখতে লাগল।

রোজ দেড়ঘণ্টা দৌড়োনো কি সোজা ব্যাপার! অতক্ষণ হাঁটতে বললে তো পারব না।

এই বয়সে।

গাঁজা দিয়ে গেল না তো।

পরদিন সাড়ে পাঁচটা থেকেই নারান দাঁড়িয়ে রইল সিটি টেন্টের সামনে। শ্যামল এল ছটায়।

দেরি হয়ে গেল। চলুন ক্যান্টিনে চা খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তো…যা ট্র্যাফিকের অবস্থা!

চা খেতে খেতে শ্যামল নিচু গলায় বলল, বয়স টয়স যা বলার আমি বলব, আপনি শুধু সায় দিয়ে যাবেন।

চা খাওয়ার পর শ্যামল তাকে টেন্টের বাইরে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ভিতরে গেল। নারান দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে রইল। জনা চারেক লোক টেবলে, শ্যামল তাদের সঙ্গে কথা বলছে। নোটবই বার করে কী সব টুকতে লাগল। নারানের মনে হল, শ্যামলের সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা যথেষ্টই ভাল, বন্ধুর মতোই।

মিনিট-পনেরো পর শ্যামল তার কাছে এসে বলল, হয়ে যাবে। এন্ট্রি ফর্মটা নিন।

ফর্মটা হাতে নিয়ে নারান অবিশ্বাসীর মতো দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, হবে? সত্যি!

হবে না? এত মিথ্যে কথা তা হলে কী জন্য বললুম! দিল্লিতে ম্যারাথনে ফিফটিথ, পুণে ম্যারাথনে এইটিন্থ, আপনি তো উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের লোেক, এখন বাংলায় থাকেন…সার্টিফিকেট দেখাবেন কী, আমার মুখের কথাই তো যথেষ্ট! আসলে কী জানেন—নারানের কনুই ধরে শ্যামল তাকে টেনে আনল বাইরে ফুটপাথে। আসলে যত এন্ট্রি পাবে ভেবেছিল তা আর পাচ্ছে না। বাংলার প্রথম সারিতে পড়ে যারা, তারা নামছে না। বলল, বাইরে থেকে বিরাশি জন আর বাংলার বাহান্ন জন, মোট একশো চৌত্রিশ জন নামবে। কিন্তু কথা শুনে মনে হল এর অর্ধেকও হবে না। প্রাইজ মানি নেই তো, তাই নামকরাদেরও কোনও উৎসাহ নেই।…আপনার বয়স সম্পর্কে আমি কোনও উচ্চবাচ্য করিনি। যা বলার এন্ট্রি ফর্মে লিখে দেবেন।

কিন্তু জ্যাটোপেকের সামনে ফিনিশ করবে, এর থেকে বড় প্রাইজ আর কী হতে পারে! নারান অবাক হয়ে তাকাল শ্যামলের দিকে।

আরে দূর! জ্যাটোপেকের নামই এরা শোনেনি। আপনাদের সময়ের হিরো ছিল বলে কি এখনও তাই থাকবে? খেলার দুনিয়ায় আজ যে ওয়ার্লড রেকর্ড করে হিরো, কালই আর একজন সেটা ভেঙে দিয়ে হিরোকে জিরো করে দিচ্ছে।

কিন্তু জ্যাটোপেকের তিনটে বড় দৌড় সাতদিনের মধ্যে জেতা..আজও তো পৃথিবীতে কেউ পারল না!

পারবে। স্পোর্টস টেকনোলজি তেমন অ্যাথলিট ঠিকই তৈরি করে দেবে। বাহান্ন সালে মানুষ মহাকাশে যাবার কথা ভাবতেই পারেনি আর এখন তো ডজন ডজন যাচ্ছে আর আসছে।

নারান চুপ করে গেল। শ্যামলের কথাগুলো মিথ্যে নয়। তবু সে কেন জানি মন থেকে সায় দিতে পারল না। মানুষের শরীরের এতবড় একটা কৃতিত্ব বিজ্ঞান ভেঙে দেবে?

পরদিনই সে এন্ট্রি ফর্ম পূরণ করে শ্যামলের হাতে দিল জমা দেবার জন্য।

.

০৭.

রবিবার সকাল সাতটায় যখন তারা সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ফটকের সামনে দাঁড়াল তখন অল্প কয়েকজন অফিসিয়াল ছাড়া আর ছিল বেলেঘাটার স্থানীয় কয়েকজন দর্শক। নারান গত রাত্রেই এসে স্টেডিয়ামের একতলায় একটা বড় ঘরে অন্যদের সঙ্গে ছিল।

নারান ছেলেদের কিছু বলেনি। সে ধরেই নিয়েছে, বললে অবশ্যই ওরা তাকে ম্যারাথন দৌড়তে বাধা দেবে। শুধু মহামায়াকে সে বলেছিল, একটা রোড রেস হবে কলকাতায়। অফিসের তিন-চারজন নাম দিয়েছে, আমিও দিয়ে দিলাম।

কতটা দৌড়তে হবে? মহামায়া জানতে চায়।

বেশি নয়, দু মাইল। ভোরবেলায় শুরু হবে, তাই রাতে ওখানে গিয়ে থাকতে হবে। থাকার জায়গা ওরাই দেবে, খাওয়াও। আমাকে নিয়ে যেতে হবে বিছানা আর মশারি। তুমি হাওয়া-বালিশ, সুজনি আর আলোয়ানটা দাও। মশারি লাগবে না। একটা রাত তো, কত আর কামড়াবে!

কী প্রাইজ দেবে? রুপোর কাপ?

হ্যাঁ। তবে আমি পাচ্ছি না। এই বয়সে কি জেতা যায়!

মোটে দুমাইল তো! একটু জোরেই শুরু থেকে ছুটবে।

মহামায়ার অলক্ষে নারান হেসেছিল।

শনিবার সে অফিসে ছুটি নিল। দুপুরে ঘুমিয়ে ছটা চব্বিশের ট্রেন ধরল। বিধাননগর স্টেশনে নেমে উল্টোডাঙা—ভি আই পি রোডের মোড়ে এসে দেখল প্রচুর লোক। হেঁটে, লরিতে তারা ফিরছে। একজনের কাছে শুনল, এমন মিছিল হয়েছে যে সারা কলকাতায় ট্রাফিক জ্যাম! লোকেদের খুব অসুবিধা হয়েছে। ব্রিগেড প্যারেড মাঠ থেকে সল্ট লেক স্টেডিয়াম প্রায় আট মাইল পথ। স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা হেঁটে আসতে পারছিল না। অনেকে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পরও মিছিলের শেষভাগ স্টেডিয়ামে পৌঁছতে পারেনি।

ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে স্টেডিয়ামের দিক থেকে যারা হেঁটে ফিরে আসছে তাদের একজনকে সে জিজ্ঞেস করল, জ্যাটোপেক এসেছেন কি?

আরে দূর মশাই জ্যাটেপেক! ব্রিগেড গ্রাউন্ডে অপেক্ষা করে করে শুনলাম তাঁর প্লেন সাড়ে চারঘণ্টা লেট। এতটা পথ হেঁটে এসে আর মশাই পারছি না। স্টেডিয়ামের কাছে যা ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, তাতে আর ভেতরে যেতে ইচ্ছে করল না। কাগজে কাল ছবিতেই ওঁকে দেখে নেব।

লোকটিকে বিরক্ত, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নারান আর কোনও প্রশ্ন না করে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে হাঁটতে শুরু করে। যত এগোচ্ছে ভিড় ততই বাড়ছে। বিছানার পোঁটলাটা বগলে নিয়ে চলতে অসুবিধা হচ্ছে। রাত বেশি হয়ে যাবার ভয়ে, ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা স্টেডিয়ামে না ঢুকেই ফিরে যাচ্ছেন। নারানের মনে হল, এত বিশৃঙ্খলা বোধহয় সে জীবনেও দেখেনি।

স্টেডিয়ামটা সে দেখতে পাচ্ছে। আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। থোকা থোকা বেলুন, পতাকা। দেখে নারানের মন ভরে উঠল খুশিতে, শরীরে চনমনানি লাগল।

ভাই, জ্যাটোপেক কি এসেছিলেন? নারান মাঝবয়সি একজনকে জিজ্ঞেস করল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ, অল্প অল্প ঠাণ্ডা, কিন্তু লোকটি ঘামছে।

হ্যাঁ। এই তো চলে গেলেন।

চলে গেলেন! নারানের ভিতরটা চোপসানো বেলুন হয়ে গেল। দেখা হল না। একটু দেরি হয়ে গেল। আপনমনে সে বলল।

লোকটি অবাক হয়ে বলল, একটু বলছেন কী, জ্যাটোপেকের প্লেন কত দেরি করে এসেছে জানেন?

সাড়ে চারঘণ্টা, শুনলাম।

তবে? তার ওপর এই মিসম্যানেজমেন্ট।

ওঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে তো? উৎকণ্ঠিত দেখাল নারানকে।

নিশ্চয় হয়েছে। আমি কিছুই দেখতে পাইনি। বক্তৃতার একটু একটু কানে এল, এই পর্যন্তই। লোকটি পা বাড়াল যাবার জন্য, নারান তার হাত টেনে ধরল।

কী বললেন?

লোকটি হাত ছাড়িয়ে বিরক্তভাবে বলল, শুধু টাকা রোজগারটাই। খেলোয়াড়-জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। লোকটি চলে যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল। আর একটা কথা বলেছেন, একজন অ্যাথলিট আসলে একজন ডাকপিওনের মতো। তার সামাজিক দায়িত্ব আছে। সেটা পালনের জন্য তাকে দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে। এখন আর খেলা শুধুই মজার জিনিস নয়।

লোকটি ভিড়ে মিশে যাবার পরও নারান তাকিয়ে ছিল। কথাগুলোর অর্থ সে ধরতে পারছে না। অ্যাথলিট দরজায় দরজায় ঘুরে ডাকপিওনের মতো কড়া নেড়ে চিঠি পৌঁছে দেবে, মানে খবর পৌঁছে দেবে। কী খবর পৌঁছে দেবে? স্পোর্টসম্যান হও! জীবনের সর্বক্ষেত্রে খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাও! জীবনে হারজিতকে সমানভাবে হাসিমুখে মেনে নাও…এইসব খবর কি পৌঁছে দেওয়া খেলোয়াড়দের। কাজ?

রাতে বড় হলঘরে সারি দিয়ে শোওয়া অ্যাথলিটদের সঙ্গে নারানও আলোয়ান মুড়ি দিয়ে শুয়ে ভেবে যাচ্ছিল। তার কানে এল একজনের নিচুগলার কথা: আমি তো দশ বারো মাইল দৌড়েই বসে যাব। কী লাভ বল এইসব আজেবাজে কম্পিটিশনে মিছিমিছি দৌড়ে? কী পাব? একটা সার্টিফিকেট আর কিছু স্যুভেনির! তার জন্য এই পরিশ্রম করব কেন?

ঠিক বলেছিস। ন্যাশানাল মিট হলেও নয় কথা ছিল, চাকরিতে কিছু সুবিধে করা যেত। স্টেট আমাকে কী দেয় যে বাংলার হয়ে নামব? ন্যাশনাল মিটে আমার সিলেকশন পাওয়ার জন্যই তো তুই এখানে নামছিস? আমার ওসব চিন্তা নেই, আমি অটোমেটিক সিলেকশন পাব আমার অফিস স্টিল অথরিটি থেকে।

বাংলা থেকে কজন কাল নামছে জানিস? মোটে বারোজন!

বলিস কী!

হ্যাঁ। এর মধ্যে আট জন জীবনে কখনও আগে ম্যারাথনই করেনি। বোঝ তা হলে?

বারোজনে আটজন নভিস?

শুধু তাই নয়, কাউকে বলিসনি, আমি খুব ভাল জায়গা থেকেই শুনেছি, তার মধ্যে একজনের বয়স নাকি ষাটের ওপরে!

সেরেছে। পথেই কোলা করে, মরে টরে না যায়!

ফিনিশ করার সময় বেঁধে দিয়েছে—দুঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট। ওর মধ্যে পৌঁছতে না পারলে রাস্তা থেকেই কম্পিটিটারদের তুলে নেওয়া হবে। দেখা যাক, অতক্ষণ কজন দৌড়তে পারে।

দাঁতে দাঁত চেপে নারান শুনল এই কথোপকথন। মুখ ঢাকা আলোয়ানটা আর একটু টেনে সে কাত হয়ে গেল। কাল তাকে শেষ করতেই হবে। কিছুতেই সে। নিজেকে তুলে নিতে দেবে না। যেভাবেই হোক।…হেঁটে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে…যেভাবেই হোক, সে দরজায় দরজায় যাবে…কড়া নাড়বে। খট খট খট…খট…খট…খট…। কড়া নাড়তে নাড়তে নারান ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল সাতটায় স্টেডিয়াম-ফটক থেকে রওনা হল সাতান্নজন। নারানের বুকে আঁটা নম্বর হল: ৫১। শ্যামলবাবু তা হলে ঠিকই বলেছিলেন, যা বলেছিল কর্তারা, তার অর্ধেকও হয়নি। নারান একটু দমে গেল। তার চারপাশে সবাই অচেনা। যে রাস্তা দিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে সেটা অবশ্য তার চেনা। বাসে কয়েকবার সে ধান্যকুড়িয়া থেকে কলকাতায় এসেছে।

দৌড়ের রুট খুব সহজ। প্রথমে দক্ষিণ মুখে রওনা। ইস্টার্ন বাইপাস থেকে ডাইনে বেলেঘাটা মেইন রোড। তারপর আবার ডাইনে ফুলবাগান। এরপর সোজা উত্তরে দমদম এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে, সি আই টি রোড কাঁকুড়গাছি মোড়, উল্টোডাঙার মোড়, কেষ্টপুর মোড়, বাগুইআটি মোড়, কৈখালি পিছনে ফেলে যশোর রোড। ডান দিকে পুবে ঘুরে মধ্যমগ্রাম, বারাসত যাবার বাসরুট ধরে, এয়ারপোর্টের পাঁচিল ডানদিকে রেখে ছুটতে হবে। তারপর একসময় আসবে একটা মোড়। যশোর রোড বাঁ দিকে ঘুরে মধ্যমগ্রামের দিকে, আর একটা রাস্তা সোজা গিয়ে গঙ্গানগরের মধ্য দিয়ে কাটাখালের পোল পার হয়ে বাঁ দিকে ঘুরে আবার মিশেছে যশোর রোডে। এই কাটাখালের পোল পর্যন্ত গিয়ে ম্যারাথনারদের ফিরে আসতে হবে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে।

মন্থরভাবে সবাই শুরু করল। নারান রয়েছে ঝাঁকের মাঝে। এত লম্বা রেসে আরম্ভ থেকেই কেউ জোরে দৌড়য় না। দম যাতে শেষ পর্যন্ত থাকে, সেটাই আগে দেখতে হবে। নারান ঠিকই করে রেখেছে, কোনওভাবেই জোরে ছোটার জন্য প্রলোভিত হবে না। কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পটা আজ সকালেও তার মনে পড়েছে। তাকে স্লো। আর স্টেডি থাকতে হবে।

নারান ফুলবাগানের মোড় থেকে দেখল সে সবার পিছনে। সবার আগে সাদা পতাকা বাঁধা একটা মোটর, তার আগে একটা পুলিশভ্যান। প্রথমে যাচ্ছে যে রানার সে তাকে দেখতে পেল না। দেখার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। তার সামনে শুধু অনেক মাথা আর কাঁধ, দুলছে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে উঠছে। যাক সবাই এগিয়ে, সে প্রাইজ জেতার জন্য দৌড়চ্ছে না।

ফুটপাথে লোক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বারান্দায় বাচ্চা বুড়ো, মেয়েরা। রবিবার সকালে ছুটির মেজাজ। এখন হালকা রোদ। নারানের কষ্ট হচ্ছে না। সে একই গতিতে দৌড়ে পৌঁছল উল্টোডাঙার মোড়ে। সামনেই একটা ব্রিজ। বোর্ডে লেখা রয়েছে: নজরুল ইসলাম সরণি। লোকে এটাকেই ভি আই পি রোড বলে।

দাদা, আরও জোরে ছুটুন। সবাই যে এতক্ষণে লেকটাউনে পৌঁছে গেছে। একজন চেঁচিয়ে বলল।

লেকটাউন কী বলছেন! প্রথম ঝাঁকটা কতক্ষণ আগে গেছে জানেন? আর একজন বলল।

নারান মাথা নামিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। শুনতে চায় না সে। এগুলোই প্রলোভন। এই সব কথাবার্তাই ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, তাতিয়ে দেয়। সে কোনও কথা শুনবে না, ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবে না। রোজ সকালে যেভাবে দৌড়য় সেইভাবেই দৌড়বে।

মাথাটা একটু বাঁকিয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে নারান ছুটে চলল। পাশ দিয়ে বাস, মোটর, ট্রাম ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির জানলা দিয়ে কৌতূহলী মুখ তাকে দেখছে। সে ভ্রূক্ষেপ করল না।

একটা মোটরবাইকে দুজন অফিসিয়াল। তার পাশে এসে গতি মন্থর করে বলল, শেষ করতে পারবেন তো?

হ্যাঁ। নারান ওদের দিকে তাকাল না।

দুঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে ফিনিশ করতে হবে, না হলে কিন্তু তুলে নেওয়া হবে গাড়িতে। বলেই ওরা বিকট শব্দ করে মোটরবাইকটা চালিয়ে দিল। নারান একবার মুখ তুলে দেখল, সামনে কোনও রানার আর চোখে পড়ল না।

রাস্তার ধারে টেবল পেতে গ্লুকোজ মেশানো জল, বরফ নিয়ে ভলেন্টিয়াররা রয়েছে। তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু খাওয়াটা কি উচিত হবে? ঘাম দিচ্ছে শরীরে। গেঞ্জি সপসপ করছে। সে একটা গ্লাস তুলে নিল।

খুব পিছিয়ে আছেন।

আপনি ব্যস্ত হবেন না দাদা, যেমন যাচ্ছেন যান। ফিনিশটা করুন।

একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। যশোর রোডে লরি আর বাস বড্ড বেপরোয়া চলে।

গ্লাস রেখে মাথা হেলিয়ে হেসে নারান আবার ছুটতে শুরু করল। ফুসফুস সমান তালে কাজ করছে। উরু আর পায়ের গোছ ভারী লাগছে না। নারান নিরুদ্বিগ্ন বোধ করল। এয়ারপোর্ট হোটেল ছাড়িয়ে ডান দিকে ঘুরে সে আটকে গেল বাস আর সাইকেল রিকশর ভিড়ে। ট্র্যাফিক দেখার জন্য বিশেষ পুলিশ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আর কোনও রানার নেই ভেবে তারা ঢিলে দিয়েছে।

এইবার রাস্তা সত্যিই বিপজ্জনক। পিচবাঁধানো রাস্তার উপর দিয়ে ছুটতে তার ভয়। করল। পিছন থেকে যে কোনও সময় গাড়ির ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে রাস্তার ধারের মাটির কাঁচা পথ ধরে ছুটতে শুরু করল। এখানেও পদে পদে বাধা। মানুষজন রিকশ, গোরুর গাড়ি, বাজার–ছোটা অসম্ভব।

এইবার তার বাঁ হাঁটুতে সামান্য একটা চিড়িক দিল। থমকে থমকে ছোটার জন্য তো বটেই, দু বার গর্তে পা পড়েছিল। পতন সামলাতে গিয়ে হাঁটুতে ধাক্কা লাগে। কাঁচারাস্তা ছেড়ে সে এইবার পিচের রাস্তায় উঠল। এখানেও ভাঙাচোরা, পাথরকুচি ছড়ানো। তবু কাঁচারাস্তার থেকে তো ভাল!

বিশাল একটা প্লেন নামছে তার মাথার উপর দিয়ে। এত কাছ থেকে নারান কখনও প্লেন দেখেনি। বড় একটা সাদা পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে হালকাভাবে ভেসে এল। জানলায় মুখ দেখা যাচ্ছে। মেঘ গর্জনের বদলে একটা তীক্ষ্ণ শিশের মতো শব্দ করে রানওয়েতে চাকা ছুঁইয়েই ঝাঁকুনি খেল। নারান দেখতে দেখতে দৌড়চ্ছিল, এবার মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়েই অবাক হল।

পুলিশের জিপ তার পিছনে ছ-সাতজন রানার ফিরে আসছে গঙ্গানগর থেকে। তাকে দেখে সবাই তাকাল। দু-তিনজন হাত তুলল। সবাই অল্পবয়সি। মাথায় টুপি, রোদ থেকে চোখ বাঁচানোর জন্য। আঠারো, চব্বিশ, ছাব্বিশ…এই কটা নম্বর সে পড়তে পারল।

যাক। জোয়ান ছোকরারা আগে যাবে না তো কি ছেষট্টি বছরের বুড়ো প্রথমে যাবে।

আর একটু এগিয়ে সে আরও কয়েকজনকে ফিরতে দেখল। সেই মোটরবাইক আবার তার কাছে এল।

এইভাবে চললে ফিনিশ করবেন কখন? তেইশ জন ইতিমধ্যেই গাড়িতে উঠে পড়েছে।

উঠুক..আমাকে নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না..আমি শেষ করবই।

কবে? আজকেই কি? অধৈর্য, বিরক্ত প্রশ্ন।

নারান হাসল।

আমরা কি সারাদিন স্টেডিয়ামে বসে থাকব ভেবেছেন?

নারান জবাব দিল না। মোটরবাইক চলে গেল। আরও কয়েক জন রানার ফিরে চলেছে। ক্লান্ত পদক্ষেপ, চোখ মুখ বসা। দেখে মনে হল, আর একটু পরেই এরা বসে যাবে। একজন হুমড়ি খেয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়ল। তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যরা এগিয়ে গেল। কেউ ফিরে তাকালও না। একটা ভ্যান এসে দাঁড়াল। রানারটিকে দুজন তোক ধরে তুলছে। নারানও আর তাকাল না। তাকে এখন অনেক পথ দৌড়তে হবে।

গঙ্গানগর কাটাখাল থেকে ফেরার সময় সে অনুভব করল, শরীরে গোলমাল ঘটছে। কোমরের পিছন দিকে একটা খচখচানি শুরু হয়েছে। আগে কখনও এখানে ব্যথা হয়নি। আজই প্রথম। বাঁ পায়ের ডিমের কাছে শিরাটা মাঝে মাঝে টেনে ধরছে। কেসটা গরম হয়ে পায়ের তলা জ্বালা করছে। ফোসকা পড়ার মতো অবস্থা। রোদুরে চোখ-করকরানি শুরু হয়েছে।

এইবার ক্লান্ত লাগছে। উরু দুটো ভার ভার লাগছে। একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নেবে কি? নারান মনে মনে ইতস্তত করল। এখন কটা বাজে?

.

না, ঘড়ি দেখবে না। আর সেজন্যই তো সে বাড়িতে হাতঘড়িটা রেখে এসেছে। সময় নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তার দরকার দৌড়টা শেষ করা…জ্যাটোপেকের সামনে।

ছোটো…ছোটো..নারান হালদার, ছোটো। বিড়বিড় করে সে নিজেকে বলল।

পায়ের জ্বালাটা এবার অসহ্য লাগছে। নারান উবু হয়ে বসে কেডস জোড়া খুলে হাতে নিয়ে, খালি পায়েই আবার ছুটতে শুরু করল।

সারা জীবন পরিশ্রম করেছ, আর এটুকু পরিশ্রম করতে পারবে না?…ছোটো, ছোটো..থামছ কেন…পায়ের শির টেনে ধরছে? তা হলে কি শেষ করতে পারবে না?

নারান দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঝুঁকে বাঁ পায়ে হাত বোলাতে গিয়ে আবার সিধে হয়ে। ছুটতে শুরু করল।

টোলুবাবু, আপনি আমার সঙ্গে নেমেছিলেন। বলেছিলেন, ফাঁকা মাঠে গোল দিলে সম্মান থাকে না, অসম্মান নিয়ে জিতবে কেন? আমাকে সম্মান দিতে আপনি সে দিন নেমেছিলেন।..আর এই দেখুন এই রেসে এখন আমি সবার পিছনে একা ছুটছি। কেউ নেই সঙ্গ দেবার জন্য..বলেছিলেন স্পোর্টসম্যানশিপ দেখাতে জানি। টোলুবাবু, আপনি বলেছিলেন, নারান আমি ফিনিশ করবই।…আমি ফিনিশ করবই… স্পোর্টসম্যানশিপ…ডাকপিওনের মতো দরজায় দরজায় পৌঁছে দিতে হবে।

নারান ছুটে যাচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে। সেই একই রাস্তা ধরে তার ফিরে যাওয়া। যশোর রোড থেকে নজরুল ইসলাম সরণি। কৈখালি..রাস্তার ধারে টেবলে জল নিয়ে বসা লোকেরা আর নেই। পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়ে তারা চলে গেছে।

বাগুইআটি। মোড়ে জমাট ভিড়। অবাক চোখে সবাই দেখছে। নারান কিন্তু কিছুই দেখছে না। শূন্য দৃষ্টি সামনে রেখে সে ছুটছে। যতক্ষণ ফুসফুস কাজ করবে থামা চলবে না।

একের পর এক, কেষ্টপুর, বাঙুর, লেক টাউন, শ্রীভূমি আর বাঁদিকে সল্ট লেক উপনগরী পিছনে রেখে নারান উল্টোডাঙা মোড়ে পৌঁছল। এবার বাঁদিকে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে সোজা স্টেডিয়াম। বলে দিয়েছে, পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। একটা চক্কর দিয়ে থামতে হবে মঞ্চের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এমিল আর ডানা।

আরে দেখে, দেখে মশাই, মোটরের সামনে পড়তেন যে।

মাথা নাড়ল নারান। এসব কথা গ্রাহ্য করার মতো অবস্থা তার এখন নেই। সে ছুটছে, না হাঁটছে তাও সে জানে না। শুধু অনুভব করছে সে এগোচ্ছে, ফিনিশিং লাইনের দিকে ক্রমাগত নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।…পাঁচ নম্বর গেট তার চাই।

বাইপাসের ধারে টিনের ঘর। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। জুতো হাতে নারানকে ছুটে আসতে দেখে তারা এগিয়ে এল। মজা পাওয়ার জন্যই তারা ওর পাশে পাশে ছুটতে শুরু করল। কিছু দূর গিয়ে তারা থেমে পড়ল।

বাঁ দিকে কাদাপাড়ার মাটির পাহাড়ে জঙ্গল। এবার বাঁ দিকে স্টেডিয়ামের পাঁচিল ধরে এগোলে ঢোকার গেট। রাস্তাটা নির্জন! একটা মিনিবাস আসছে। নারান ধারে সরে গেল।

পাঁচ নম্বর গেট। খোলাই রয়েছে। ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে চক্কর শুরু করতে হবে।

নারান ডান হাতটা তুলল। কী সুন্দর, হলুদ, নীল রঙের চেয়ার দিয়ে ফুলের মতো সাজানো। সে কি কখনও ভেবেছিল এমন একটা জায়গায় দৌড়বে।

কিন্তু লোকজন কই। নিস্তব্ধ। কয়েকজন মজুর ছাড়া একটা লোকও নেই। এ কী, মঞ্চটা ভোলা হচ্ছে কেন? এমিল কই, ডানা কই? নারান সমাপ্তি-সীমায় দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করল।

ধুতি-শার্ট পরা এক প্রৌঢ় নারানকে দেখে, মঞ্চ খোলায় ব্যস্ত মজুরদের কাছ থেকে এগিয়ে এল।

আপনি কি ম্যারাথন রেসে ছিলেন?

হ্যাঁ।

লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

সব গেল কোথায়? নারান হাঁফাচ্ছে। চোখে মুখে হতাশা।

সবাই তো চলে গেছে। কটা বাজে দেখেছেন? লোকটি বাঁ হাত তুলে ঘড়ি দেখাল। এগারোটা পঞ্চাশ! এতক্ষণ কি কেউ বসে থাকে?

জ্যাটোপেক কোথায়, তাঁর যে থাকার কথা।

তাঁর কি আর কাজকর্ম নেই! আপনি আসবেন পাঁচ-ঘণ্টা পর, আর সেজন্য বসে থাকবেন? শেষ তো করেছে মাত্র দশজন, আপনি হলেন এগারো। দু ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেছে মাত্র চারজন। আমি তখন ছিলাম না। শুনলাম ওদের কনগ্রাচুলেট করেই সস্ত্রীক তিনি চলে গেছেন। চাঁপাদানিতে ওদের রিসেপশন দেওয়া হবে?

নারান শূন্য স্টেডিয়ামের চারধারে চোখ বোলাল। ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠল অদ্ভুত এক হাসি। মাথা নাড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে তার হাসিটাও উজ্জ্বল হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল সারা মুখে।

সন্ধ্যাবেলায় পোঁটলা বগলে নারান বিধাননগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সি, কোট-প্যান্ট-টাই-পরা একটি লোক তাকে কয়েকবার লক্ষ করে এগিয়ে এসে বলল, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

বলুন।

আচ্ছা আপনি কি এক সময় সাইকেলে ঝাউডাঙায় খবরের কাগজ বিক্রি করতেন?

হ্যাঁ।

লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঠিক ধরেছি আমি। আপনাকে চিনতে পারলাম, কারণ আপনি এত বছরে…প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ তো হবেই, একটুও বদলাননি, একই রকম রয়ে গেছেন। আমি হলাম ঝাউডাঙার বাদল নস্করের নাতি। আপনার জন্য আমি রোজ তখন অপেক্ষা করতাম।

নারান হাসিমুখে তাকাল। সেদিন এই লোকটি এক কিশোর ছিল। হ্যাঁ, মুখখানি চেনা ঠেকছে।

আপনাকে আরও মনে রেখেছি কেন জানেন?…বোকার মতো বলেছিলাম, কে জ্যাটোপেক?…রেকর্ড তো কতই হচ্ছে কে মনে করে রাখে?

হ্যাঁ আমার মনে আছে।

তখন কত বোকা ছিলাম।…আপনি এখানে কোথায় এসেছিলেন?

এসেছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। একটু দেরি করে ফেলায় তার সঙ্গে আর দেখা হল না। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

ম্লান, বিষণ্ণ হাসিতে নারান কথাগুলোকে মুড়ে দিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোড়কটা খুলে বলল, অবশ্য সেজন্য আমার কোনও দুঃখ নেই।

আগে খবর দিয়ে না এলে এইরকম হয়রান হতে হয়। আপনি বন্ধুকে বোধহয় আগে বলে রাখেননি?

না, বলে রাখিনি। ভেবেছিলাম হঠাৎ দেখা করে অবাক করে দেব।

এখন কি বাড়ি ফিরবেন?

হ্যাঁ, ধান্যকুড়িয়া। ওখানেই সাতচল্লিশ সাল থেকে আছি।

ওখান থেকে সাইকেলে ঝাউডাঙায় রোজ আসতেন কাগজ বিক্রি করতে! ভদ্রলোকের বিস্ময় গলা আর চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল। নারান শুধু হাসল।

আপনি কি এখনও ঝাউডাঙায় থাকেন?

দমদমে বাড়ি করেছি। ওখানেই আমার কারখানা, জানলা দরজার গ্রিল তৈরি করি। এখানে এসেছিলাম জ্যাটোপেককে দেখার জন্য।

দেখলেন? নারান উত্তেজনা দমন করে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল।

হ্যাঁ। বেশ মোটা হয়ে গেছে। মাথার চুল তো কম ছিলই, এখন একেবারেই টাক।

আর কী দেখলেন?

আর কী দেখার আছে। এখন তো উনি নিবে যাওয়া আগ্নেয়গিরি।

উনিশশো বাইশের উনিশে সেপ্টেম্বর। অস্ফুটে নারান বলল, দু বছরের ছোট।

অ্যাঁ? লোকটি বুঝতে না পেরে জানতে চাইল।

কিছু না, একটা জন্মসাল মনে পড়ল তাই। আমার বন্ধু যে আমার থেকে দু বছরের ছোট এটা ভুলেই গেছলাম। তা হলে জ্যাটোপেককে দেখে আপনি খুবই নিরাশ হয়েছেন।

ট্রেনের আলো এগিয়ে আসছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লোকেরা লাইনের ধার থেকে একটু পিছিয়ে এল। নারানের কথার জবাব না দিয়ে লোকটি তাকিয়ে রইল স্টেশনে প্রবেশরত ট্রেনের দিকে।

ট্রেনের দরজায় ওঠানামার একটা ধাক্কাধাক্কি প্রথমে হবেই। এই অনুমান করে নারান একটু বেশি পিছিয়ে এল। মুখ পাশে ফিরিয়ে তাকাল প্ল্যাটফর্মের ভিড় আর মন্থর হতে হতে থামা ট্রেনের দিকে। হঠাৎ তার মনে হল এই ট্রেনটাই যেন জ্যাটোপেক আর এই লোকগুলো যেন তার জীবনের পেরিয়ে আসা বছর। দুবার সে চেষ্টা করে এই ট্রেনটা ধরতে পারেনি।

হুড়মুড়িয়ে কামরা থেকে লোক নামছে আর ট্রেন ছেড়ে দেবার ভয়ে মরিয়া লোকেরা ঠেলেঠুলে ঢোকার চেষ্টা করছে। নারান যার সঙ্গে কথা বলছিল সেই লোকটি কোনদিকে যেন ছিটকে গেছে। ধাক্কাধাক্কি শেষ হবার পর সে পুঁটলি বগলে শান্ত ভাবে সামনের কামরায় উঠে দাঁড়াবার মতো জায়গা পেল।

ট্রেন চলতে শুরু করার পর নারান কামরার মধ্যে চোখ বোলাল। নানা ধরনের মানুষ, ছোট বড়, লম্বা বেঁটে, নানারকমের মুখ, পোশাক কথাবার্তা। এতগুলো, এত রকমের বছর! এরই মধ্যে আমলকীর, বাদামের, মুসম্বি লেবুর ফেরিওয়ালা নিজেদের পসরা বিক্রি করে যাচ্ছে। নারানের মনে হল, কত বছর ধরে সে ট্রেনে যাতায়াত করেছে কিন্তু এমন করে কখনও তো সে মানুষজনের দিকে তাকায়নি!

ট্রেনটা দুলছে। নারান চোখ বন্ধ করে পিছনের দিকে যত দূর দৃষ্টি যায় দেখার চেষ্টা করল। চেষ্টা করতে করতে তার মনে হল, জীবন তাকে অনেক কিছুই তো দিয়েছে। তার কোনও অভিযোগ নেই, জ্যাটোপেককে দেখতে না পাওয়ার জন্য কোনও আফশোস নেই। মানুষের সব আকাঙক্ষাই কি পূরণ হয়? পূরণ হলে সেটাকে আর জীবন বলা যায় না।

রাত্রে বাড়ি ফিরে মহামায়ার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নারান বলল, আমি তো বলেই ছিলাম, এই বয়সে কি জেতা যায়?

শেষ করেছিলে তো? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মহামায়া জানতে চাইল।

উদ্ভাসিত মুখে নারান বলল, নিশ্চয়। এইটুকু পথ দৌড়তে পারব না! যতদিন পারি হুসহুস করে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলব।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress