বাবা এলেন
বাবা এলেন।
এল দাদারা।
সিদ্ধার্থের মাথা নিচু, কিন্তু কথা স্পষ্ট।
হ্যাঁ! আরও আগেই বলা উচিত ছিল আমার।
তা হলে ওই পুণ্যের নিশানটি সমেতই বিয়ে করছ?
দেখি!
অনেক বড় বড় কথা কয়ে এসেছ চিরদিন, এত ছোট কাজটা করতে লজ্জা করা উচিত ছিল।
সিদ্ধার্থ মাথা তুলে বলে, জীবনে উচিত কাজ কে কটা করতে পারে বাবা? এইবার ভাবছি, দেখি তেমন কাজ একটা করা যায় কি না।
তোমার থেকে যে বংশে এই কলঙ্ক হবে ধারণা করিনি।
ধারণা করেননি? আশ্চর্য তো! গোড়াগুড়িই ধারণা করা উচিত ছিল, চিরদিনই তো আমি আপনাদের কুলাঙ্গার ছেলে।
সিদ্ধার্থ চলে যায়।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন এঁরা।
চরম অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি এমনভাবে মাথা উঁচু করে, আর উপরওলাদের ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করে চলে গেল যে, মনে হল অপরাধী এঁরাই।
কান্তিকুমারও ঠিক ওই একই সময় একই কথা ভাবছিলেন। এ যুগে অপরাধীরাই নিরপরাধীকে ব্যঙ্গ করে বিদ্রূপ করে। তাকেই অপরাধী বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
নিজের ঘর সংসারের কথা নিয়ে নয়, একটা কেস নিয়ে ভাবছিলেন।
সহসা ভাবনার জাল ছিঁড়ে একটি নম্র মূর্তি এসে সামনে দাঁড়াল।
সুমনা।
কতদিন পরে বাবার ঘরে এসে দাঁড়াল।
বাবা!
কিছু বলবে?
হ্যাঁ! সুমনা বলল। টেবিলের উপর নখের একটা আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, প্রফেসর আর. কের কাছে গিয়েছিলাম।
ভাল।
সুমনা বাবার এই নির্লিপ্ত স্বরের মধ্যে থেকেই বুঝি সাহস সংগ্রহ করে নেয়।
তাই এবার স্পষ্ট গলায় বলে,উনি এখন ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন, আমাকে আসতে বলেছিলেন, নিয়ে নিলেন।
ও! তা হলে ভর্তি হলে? আচ্ছা। ভাল, শুনে সুখী হলাম।
একটু চুপচাপ।
কয়েকটা নিশ্বাসের শব্দ।
তারপর আবার কথার শব্দ।
বাবা, হয়তো তোমাদের খুশি করবার মতো আর একটা খবরও দিতে পারব–তোমাদের
কান্তিকুমার হাতের বই থেকে চোখ তুলে সচেতন হয়ে প্রশ্ন করেন, কী বলছ?
বলছি–খরবটা হয়তো তোমাদের খুশি করবে; ওকে একটা শিশু আশ্রমে রাখবার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। অনাথ আশ্রম বলতে পারল না।
কান্তিকুমার কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের ওই দৃঢ় নম্র মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেমে থেমে বলেন, তুমি! তুমি ব্যবস্থা করেছ? তুমি নিজেই?
টেবিলে আর কয়েকটা আঁকিবুকি পড়ে।
আমি একা নয়, সিদ্ধার্থ সাহায্য করেছে।
সিদ্ধার্থ! সিদ্ধার্থ তোমায় সাহায্য করেছে?
হ্যাঁ বাবা!
কান্তিকুমার যেন মেয়ের দিকে চাইতে পারছেন না, যেন মেয়ের কাছে বড্ড বেশি ছোট হয়ে গেছেন। অথচ উলটোই হওয়া উচিত ছিল তো। কান্তিকুমারই তো পারতেন মেয়েকে ধিক্কার দিয়ে উঠতে। বলতে পারতেন, এই সিদ্ধান্তই যদি করলে, সেটা আমাদের জানালেই কি শোভন হত না? তোমার কাছে এইটুকুর জন্যে যে মাথা খুঁড়ে ফেলেছিলাম আমরা। এখন তুমি পাড়ার ছেলের সাহায্য নিতে গেলে। যেন কত অসহায় তুমি, কত দুঃখী।
কিন্তু বলতে পারলেন না।
কেন পারলেন না সেইটাই আশ্চর্য!
শেষ পর্যন্ত যে সেই এক থোকা ফুলের মতো ছোট্ট শিশুটার জায়গা হল না তাঁর বাড়িতে, তাকে বিদায় করে দিতে হল, এই লজ্জাটাই হয়তো মূক করে রাখল তাঁকে।
হয়তো এমনিই হয়।
যাকে দুরছাই করি, আপদ বালাই করি, সে যদি একদিন স্বেচ্ছায় বিদায় গ্রহণ করে, যদি বলে, তবে গেলাম, তখনই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। উঠতে বসতে যার কথায় বলি, মরেও না–সে যখন মরে তখন মনে হয়, একটা চাবুক খেলাম বুঝি।
এমন চাবুক থাকেই মানুষের জন্যে।
সুমনা যখন বলল, তোমাদের খুশি করবার মতো খবর, তখন কি কান্তিকুমার ধারণা করতে পেরেছিলেন এতবড় একটা চাবুক আসছে তাঁর জন্যে?
চাবুক-খাওয়া মানুষ আর বেশি কী বলবে?
কান্তিকুমারেরও আর সাধ্য হল না বেশি কথা বলবার।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে কথার ঢেউ উঠল।
কে যে প্রথম বলল! কী করে যে রাষ্ট্র হল, এই এক রহস্য। সুমনা তো বাবাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। আর কান্তিকুমারও বলতে যাননি কাউকে। তবু প্রকাশ হয়ে গেল।
হয়তো অসাবধানী অলকের কথার মধ্যে থেকেই আবিষ্কৃত হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ উঠল। সে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বালুবেলায়।
বটে, বটে, তাই নাকি?…সত্যি? তা হলে সুমতি হল?..ঘাড়ের ভূত নামল তবে এতদিনে?
আরে বাবা, বুঝছ না, গ্রহে করেছিল, কুগ্রহে…হ্যাঁ তবু দুর্মতি কেটেছে তাও ভাল। তবে কিনা সেই তো মান খসালি, লোকটাই যা হাসালি!
এইরকম চলতে লাগল প্রথমদিকে।
তারপর বাতাসটা ঈষৎ অন্যমুখো বইতে শুরু করল।
…দেখ মানুষের মন! ছেলেটাকে নিয়েই সংসারে যত অশান্তি, অথচ চলে যাবে শুনে পর্যন্ত…আহা যতই হোক কচি ছেলে তো! নইলে চোখেই দেখছি না, কোলেও নিচ্ছি না, তবু
অতঃপর বাতাস আরও মস্ত এক মোড় নিল।
ছোটখুড়ি বললেন, মনে করেছিলাম ছেলেটাকে একটা সোয়েটার বুনে দেব, লাল পশম খানিকটা রেখেওছিলাম, কিন্তু সুমনার ভয়ে সাহস হয়নি। চলে যাবে শুনে মনটা এত ইয়ে হচ্ছে! ছোট বাচ্চার নাম করা জিনিস
দুদিনের মধ্যে একটা হাতকাটা সসায়েটার বুনে ফেলে সুমনার ঘরে রেখে গেলেন তিনি।
আর সেই সোয়েটারের কাটা খাল বেয়েই আসতে লাগল কাঠের পুতুল, তুলোর হাতি, প্লাস্টিকের ভালুক, রবারের বল…এটা ওটা সেটা।
দাতা-ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমা, মায় ছোটকাকা এবং বুড়ো ঝিটা পর্যন্ত।
সকলেরই নাকি ছেলেটাকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, শুধু সুমনার মেজাজের ভয়েই
এখন আর কেউ ভয় পাচ্ছে না।
এখন সুমনার ছেলের জিনিসে সুমনার ঘর ভরে যাচ্ছে।
আর আক্ষেপের বুলিতে বাড়িতে বাতাস ম ম করছে।
আহা সেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়াই হল, শুধু জেদ করে কতকগুলো মাস বাড়িতে রেখে রেখে বাড়িসুদ্ধ লোকের মায়া বাড়িয়ে দিল…ছোট ছেলেমেয়েগুলো মরছে কেঁদে কেঁদে…
আহা আজকাল আবার বুলি ফুটেছে..কী মিষ্টি করে দাদা-দাদা ডাকে..বুক ঘষটে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসতে শিখেছে তো…সবাইয়ের চোখে পড়ছে।…বড় খাসা ছিরিখানি হয়েছে কিন্তু!
হয়তো এ আক্ষেপের সুর একেবারে ফাঁকা নয়। হয়তো ওই উপহারের সম্ভার ভুয়োনয়। ছোট স্বার্থ ছোট চিন্তা আর ছোট বুদ্ধির সম্বল নিয়ে আবরণ রচনা করে নিজেকে যে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখে মানুষ, সে গণ্ডির বাইরে আছে মানবিকতার নির্মল নীল আকাশ।
কেউ যখন বলে গুডবাই তখন সে গণ্ডিতে ফাটল ধরে, ছোট স্বার্থের আবরণ ভেদ করে সেই গণ্ডির বাইরে গিয়ে পড়ে মানুষ। সেই আকাশে, সেই নীল নির্মলতায়।…
তাই সুমনার ছেলের জন্যে উপঢৌকনের সমারোহও ভুয়ো নয়।
এতদিনের নীচতার আর সংকীর্ণতার অনুতাপ দেখা দিয়েছে লাল হাতি, নীল ঘোড়া, সাদা খরগোশের মূর্তি নিয়ে।
কিন্তু সুমনার ঠোঁটের রক্ত নীল হয়ে উঠছে কেন?
ওই খেলনা পুতুল জামা জুতোর স্থূপের মাঝখানে উদ্দাম খুশিতে পিছলে বেড়ানো ছেলেটাকে ছিনিয়ে তুলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কেন তার?
যেন ওর প্রাণের পুতুলটিকে ওই অপমানের গ্লানির মধ্যে ডুবে থাকতে দেখতে পারছে না সুমনা।
কী লজ্জা!
কী অপমান!
বড়জেঠি দিয়ে গেছেন একটি কাঠের রাধাকেষ্ট! বলেছেন, পুতুলের ছলে এখন থেকেই রাধাকেষ্টর স্পর্শ পাক।
অথচ সুমনা বসে আছে। সে দৃশ্য দেখছে।
কিন্তু কত আর দেখবে সুমনা?
একসেট নতুন বিছানা আনল সুজাতা। চোখটা ছলছল করে বলল, এটাও বেঁধে দিস সুমি! আহা যেখানে থাকুক ভাল থাকুক।
সুজাতার চোখের কোলে জলের চিকচিকিনি।
না, সুমনার চোখে জল নেই।
সুমনা ধারালো কণ্ঠে বলে ওঠে, কী হবে এসব?
কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে সুজাতা। জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে দেখে। থতমত খেয়ে বলে, কী আর হবে, সঙ্গে দিয়ে দিবি।
মনে রেখো মা, ওকে অনাথ আশ্রমে পাঠানো হচ্ছে। অনাথ কথাটার মানে জানো নিশ্চয়ই? নতুন জামা জুতো বিছানা খেলনার পাহাড় নিয়ে অনাথ আশ্রমে ঢুকতে যাওয়ার মতো নির্লজ্জ ঠাট্টা আর কিছু আছে?…এসব কিছু নেবে না ও। যেমন নিঃসম্বল হয়ে এসেছিল, তেমনি নিঃসম্বল হয়ে চলে যাবে।
সুজাতা ভয় পেল।
সুজাতা অপমানিত হল।
সুজাতা নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সরে গেল। তবু ভাবতে লাগল, ছেলেটা চলে যাবে।
আর ভাবল, আমার মেয়েটা? কী নিষ্ঠুর!
.
চলে যাবে।
কাল চলে যাবে।
সঙ্গে সিদ্ধার্থ যাবে, অলক যাবে, সুমনা যাবে।
সুমনা না হলে কে নেবে দায়িত্ব, সাবধানে পৌঁছে দেবার? সুমনা কুড়িয়ে এনেছিল, সুমনাই যাবে ফেলে দিতে।
বুদ্ধিমান পৃথিবীর সমস্ত বিবেচনা দাঁড়িপাল্লার একদিকে, আর একদিকে শুধু সুমনার ব্যাকুল ভালবাসাটুকু…অবুঝ হৃদয়খানি।
সুমনা জিতবে কীসের জোরে?
সবাই যখন চলে গেছে, শুয়ে গেছে, রাত্রি গম্ভীর হয়ে গেছে, ঘুমন্ত শিশুটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে বসে আছে সুমনা।
কাল থেকে সুমনার বিছানার পাশের এই জায়গাটুকু শূন্য পড়ে থাকবে।…অবোধ শিশুটা জানে না কী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সুমনা তার বিরুদ্ধে। একান্ত নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত সুখে এলিয়ে শুয়ে আছে ভয়ংকর সেই বিশ্বাসহন্ত্রীর বুকের কাছে।
ওরে সোনা, ওরে মানিক! ওরে পাগলঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত শিশুটাকে বুকের মধ্যে চেপে পিষে ফেলতে চায় সুমনা।
ছাড়বে না। কিছুতেই ছাড়বে না সে।
কিছু চাই না তার। কিছু না।
চাই না উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ…সুখময় দাম্পত্য জীবন…সামাজিক প্রতিষ্ঠা। এই চরম পাপের মূল্যে সেই পরম প্রাপ্তিকে কিনতে চায় না সুমনা। সুমনা ওকে এমনি করে আঁকড়ে ধরে থাকবে। জগতের কে পারে ছিনিয়ে নিতে দেখবে সে!
কান্তিকুমার সিদ্ধার্থকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এসে দাঁড়াতেই একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কান্তিকুমার রুদ্ধস্বরে বলেন,তোমার বাবা এসে আমায় যাচ্ছেতাই করে গেলেন।
কেন গেলেন, বুঝতে দেরি হয় না সিদ্ধার্থের, তবু মাথা চুলকে বলে,আজ্ঞে—
কেন, তা তুমি অবশ্যই বুঝতে পারছ। আশ্চর্য! আমার কুমারী মেয়ের নামে অকারণ এই অপবাদ দেবার কী উদ্দেশ্য তোমার? আমি তো কোনওদিন এতটা নীচ ভাবিনি তোমাকে।
কুমারী মেয়ে!
সিদ্ধার্থ কুণ্ঠিত ভাবটা পরিহার করে বলে, আপনার কুমারী মেয়ের নামে অপবাদ যা রটাবার তা আপনার নিজের বাড়ি থেকে রটানো হয়েছে। আমি শুধু সেই অপবাদের কদর্যতাকে একটু মোলায়েম আচ্ছাদন দিয়ে ঢাকতে চেয়েছি। আর ওইটুকু না করলে আমার বাড়িতে সংঘর্ষ উঠত প্রবল। তার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে অনেক শক্তি ক্ষয় হত। বৃথা শক্তিক্ষয়ে দরকার কী?…আপনি তো উকিল মানুষ, আপনাদের নীতিতে তো ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক কার্যোদ্ধার!
নীতিকথা থাক। আমি বলছি, তোমার এই পদ্ধতিকে সমর্থন করি না।
কান্তিকুমার জোরের সঙ্গে বলেন।
সিদ্ধার্থ মুখ নিচু করে বলে, এ ছাড়া উপায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। এলগিন রোডের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়েছি, হয়তো অতটুকুর মধ্যে ওর কষ্ট হবে, তবু আমার বিশ্বাস, ও পারবে।
কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদটা কি অপরিহার্য ছিল?
হয়তো ছিল না। হয়তো ছিল। অপবাদটা যে এসেইছিল। আমার পরিবার আমার স্ত্রীকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে, ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে, এ আমি সইতে পারছিলাম না, তাই অপবাদটা ভাগ করে নিলাম। আপনি আমার ওপর অপ্রসন্ন হবেন না কাকাবাবু, আমি বলছি এ ভালই হল।
.
অলক গাড়ি বার করে রেখে এসে মাথায় হাত দিয়ে পড়ল।
সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেটাকে দুহাতে বুকে চেপে ধরে খাঁচার বাঘের মতো ঘরের মধ্যে পদচারণা করে বেড়াচ্ছে।
ব্যাপার কী?
অলক অবাক হয়ে বলে।
সুমনা নীরব।
শুধু পদচারণায় অস্থিরতা বেড়ে ওঠে।
মনা! কী হল? টাইম দেওয়া আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
ও যাবে না।
দৃপ্তম্বর ঠিকরে ওঠে।
যাবে না।
অলকের বিস্ময়ের পালা।
এত ব্যবস্থা, এত বলা কওয়া, টাকাপত্র জমা দেওয়া! এখন বলছিস যাবে না?
হ্যাঁ বলছি।
সুমি, তুই কি পাগল হলি?
সুমনা ঘরের কোণের দিকে চলে যায়। ক্রুদ্ধস্বরে বলে, হ্যাঁ হয়েছি। কী করবি?
আমি আর কী করব? আমি তো হাঁ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সিদ্ধার্থটা সেইখানে বসে থাকবে।
বসে থাকবে?
হ্যাঁ সেইরকমই তো কথা আছে। সিদ্ধার্থ বসে থাকবে, আর আমি তোদের নিয়ে।
না! কোনও কথা নেই। তোদের কোনও কথা থাকবে না। তোর কথা, তোর সিদ্ধার্থের কথা সব উড়িয়ে দেব আমি। আমি একে নিয়ে চলে যাব।
চলে যাবি! কী সর্বনাশ! কোথায় চলে যাবি?
যেখানে খুশি। শুধু তোদর এই বাড়ির মধ্যে থেকে। বনে জঙ্গলে যেখানে হোক চলে যাব।
মনা! মাথাখারাপ করিস না। এত ভেবেচিন্তে একটা ব্যবস্থা করা হল, তুই রাজিও হলি, এখন উলটো-পালটা করলে চলবে কেন?
চলবে! আমি চালাব।
সিদ্ধার্থ বলবে কী?
জানি না। যা ইচ্ছে বলুকগে।
জানিস, ও ওর বাড়িতে মনোমালিন্য করে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছে। বিয়ে করবে বলে সাজিয়েছে! এখন তুই ।
দাদা তুই যা! যা এখান থেকে।
তুই যাবি না?
না।
বেশ। যাই সেখানে। খবর দিই গে। ওই কথাই বলি গে। বেশ বুঝতে পারছি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে তোর।
অলকের একা বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
অলক খবর দিতে যাচ্ছে, সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেকে ছাড়বে না!
গত কদিনের অনুতাপদগ্ধ মনোভাব মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আশাভঙ্গের আক্রোশে আবার হিংস্র হয়ে ওঠে ওরা।
এও হয়। এই রকমই হয়।
গুডবাইয়ের পর আবার যদি কেউ থেকে যাবার বায়না করে, শুকিয়ে যায় সকলের সব স্নেহধারা।
যোগমায়া সুজাতার কাছে এসে দাঁড়ান, মেজোবউমা, এটা কী হল?
সুজাতার মন ভেঙে গেছে।
মন কেমন একটু করছিল সত্যি, কিন্তু মস্ত একটা আশাও সৃষ্টি হচ্ছিল বইকী!
কালো ছায়াটা সরে যাবে। যে ছায়া গ্রাস করে রেখেছে সুমনাকে।
ভেবেছিল, সুমনা প্রথমটা অবশ্যি মনমরা হয়ে থাকবে, কিন্তু কলেজ যাবে, পড়াশোনা করবে, ভুলে যাবে। বলে সত্যিকার ছেলে মরে গেলে তার মৃত্যুশোক ভুলে মা আবার খাচ্ছে পরছে হাসছে। আর এ তো!
ভুলে যাবে। সুমনা ভুলে যাবে, লোকেও ভুলে যাবে। নিন্দেটাও মুছে যাবে।
তারপর মেয়ের বিয়ে দেবে সুজাতা। ঘটা করে।
সেই ছেলেবেলা থেকে যার মেয়ের বিয়েতে যত ঘটা দেখেছে, সব মনের মধ্যে আঁকা আছে সুজাতা। ভাঙা আশা আবার জোড়া লাগছিল।
সে আশা গুঁড়িয়ে গেল।
ক্রমশ পাগলামির লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে সুমনার মধ্যে। হায় ভগবান! মায়ের জাত হয়েও চুপিচুপি বলছে সুজাতা, জগতে এত শিশুমৃত্যু, শুধু যেখানে তেমন একটা মৃত্যু ঘটালে সব দিক বজায় থাকত সেখানে তুমি উদাসীন।
মেয়ের রণমূর্তি দেখে পর্যন্ত ছাইপাঁশ পাপ মহাপাপ অনেক কিছুই ভাবছিল সুজাতা, এহেন সময় শাশুড়ির ওই তীক্ষ্ণ প্রশ্নে তার সহ্যের বাঁধ ভাঙল।
বিরক্তস্বরে বলল, কী হল–তার আমি আর কী বলব বলুন। আপনিও দেখছেন, আমিও দেখছি।
যোগমায়া ক্রুদ্ধ।
আমি শুধু দেখছিই মেজোবউমা-জানছি না কিছুই। যা জানবার সেটা তোমাদের কৌটোতেই লুকনো আছে।
আছে তো থাক।
বলে জীবনে যা না করেছে সুজাতা তাই করে। যোগমায়ার সামনে থেকে উঠে চলে যায়।
যায় মেয়ের কাছে।
তীব্রতর হয়ে বলে, যাবি না? ছেলে দিবি না?
না।
শেষ অবধি কী করবি ভেবেছিস, তাই আমাকে বল লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে!
তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাব, এইটুকুই শুধু ভেবেছি এখন। আর বেশি কিছু ভাবিনি।
তবে ছেলে কোলে করে রাস্তায় গিয়ে হাত পাতগে যা পাজি মেয়ে!…ক্ষোভে দুঃখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে সুজাতা। আরও বলে, ছেলে গলায় বেঁধে তো আর চাকরি করা হবে না। ওই ভিক্ষে করাই হবে। তাই করাবে তোকে ওই শনি।
কান্না চাপতে চাপতে চলে যায় সুজাতা।
ওদিকে, রান্নাবাড়ির দিকে স্বর্ণপ্রভা উদ্দাম ঝড় তুলেছেন। ঘোষণা করেছেন, তিনি না হয় বলে পাপের ভাগী হয়েছেন, দশেধর্মে দেখুক এবার ছেলে কার! শুধু মানুষ করলেই যদি এই অবস্থা হত, তা হলে আর কাজীর বিচারের সেই গল্পটা সৃষ্টি হত না।
জয়ন্তীকুমার চটি ফটফটাতে-ফটাতে এল। ন্যাকা সাজল। বড়বউদি–জয়ন্তী বলে, অলক গাড়ি নিয়ে সুমিকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে বলল, একা চলে গেল যে?
বড়বউদি বলেন, কী জানি ছোট ঠাকুরপো! অলক তো আমার ছেলে নয়। ও হচ্ছে সংসারের ধানচালের মতন। সর্বজনীন! ও যে আমার ছেলে, সে কথা ও তিলেক মনে রাখে না। আমিও মাঝে মাঝে ভুলে যাই।
হা! সত্যিকার কিনা, তাই ভুলে যাও। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতে তা হলে টানের জোর হত।বলে অদূরস্থিত মেজোবউয়ের ওপর একটা তীব্র দৃষ্টিপাত করে চলে যায় জয়ন্তীকুমার।
কারও কিছু এসে যাচ্ছে না।
তবু সবাই হিংস্র হয়ে উঠেছে।
উঠবে বইকী!
আহা ভাবের কণিকাটুকুও মুছে ফেলছে। একটা অসুবিধে, একটা অনিয়ম, একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন চিরতরে থাকবে কেন সংসারে? চলে যাচ্ছিল, আহা করছিলাম! ফের থাকছে যে আর আহা থাকে?
বলে একটা ভাগ্নে ভাইপো পুষে, চিরকাল তাকে ঘরের ছেলের আসনে ঠাঁই দিয়ে, সে বড় হয়ে গেলে লোকে তাকে বলে, হল তো বাপু অনেক, এবার খুঁটে খেতে শিখেছ, এইবার পথ দেখো!…চিরদিনের বুড়ো চাকর, কর্তাকে মানুষ করেছে, তার অসুখ করলে লোকে বলে, ওরে সর্বনাশ! হাসপাতালে দাও।
যেখানে আইনত দাবি নেই, সেখানে আর সব দাবিই অচল।
অলক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যায়।
জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান বাজছে–কিন্তু সে গান মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করছে কই?
না কি গভীরতাই নেই কোথাও কোনখানে!
শুধু তার ভান করে মানুষ?
যে মুহূর্তে নিজের গায়ে আঁচড় এসে পড়ে, ভেঙে যায় সব উদারতার ভান। ধরা পড়ে গভীরতার ছদ্মবেশ।
কে জানে মানুষ সম্পর্কে বেশি অবিচার করে ফেলেছে কিনা অলক। যাক এখন আপাতত কর্তব্যে মন দেওয়া যাক। মনুষ্যপ্রকৃতির বিচার পরে করলেও চলবে।
আগে গেল সিদ্ধার্থের বাড়ি, সিদ্ধার্থ আছে?
বয়সে অলক বছর তিনেকের ছোট হলেও বরাবর সিদ্ধার্থই বলে,দাদা বলে না। ছেলেবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গী, বড় হয়ে বড় বড় আলোচনার সঙ্গী।
আবাল্য এসে ডেকেছে সিদ্ধার্থ আছে?
সিদ্ধার্থের বাড়ির যে কেউ সস্নেহ সুরে জানিয়েছে, সে বাড়ি আছে কি নেই। থাকলে ডেকে দিয়েছে।
আজ কিন্তু যেই প্রশ্ন করল, সিদ্ধার্থের দাদা বিরক্ত মুখে ভুরু কুঁচকে বলল,কেন, সিদ্ধার্থের খবর তুমি রাখো না? এত বন্ধু!
অলক অবাক হল। বলল, কী খবর?
তিনি আর এ বাড়িতে থাকেন না।
কবে থেকে?
বিমূঢ় প্রশ্ন। কারণ এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথা তো ছিল না।
কথা ছিল রেজেস্ট্রিটা হয়ে গেলে যাবে।
কবে থেকে?
মনে নেই। অগ্রাহ্যভরে বলেন দাদা, কাল না পরশু কবে যেন। যাক, অন্যত্র থাকাই মঙ্গল। সর্বদা যদি তাঁর সেই চন্দ্রবদন দেখতে না হয়, সেটাই সুখের। দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দেন দাদা।
বুঝতে অসুবিধে হল না একটা রাগারাগির বিপর্যয় ঘটে গেছে।
আর তাতে আশ্চর্যও হল না অলক।
এটাই স্বাভাবিক। এই দেখতেই অভ্যস্ত সবাই। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে বলেই যে আপন জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে নেবার স্বাধীনতা থাকবে তার, এত আবদার আসেনি এখনও দেশে।
আমরা তোমায় ভালবাসি, প্রাণের থেকে ভালবাসি, সেই পাওয়াটাই কি যথেষ্ট নয় তোমার পক্ষে? তুমি আবার অপর একজনকে ভালবাসতে যাও কী বলে? গর্হিত! নিতান্ত গর্হিত! হ্যাঁ, করছ বটে তোমরা আধুনিকেরা, কিন্তু আমরা অনুমোদন করছি না সেটা। কিছুতেই প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলছি না তোমার ভালবাসার ওপর।
তোমার কষ্ট হবে?
তুমি সারাজীবন নিশ্বাস ফেলবে? তাতে কী! আমাদের আওতা ছাড়িয়ে আমাদের বাদ দিয়ে তোমার যে সুখ, সে সুখে সহানুভূতি নেই আমাদের।
এই তো!
এই রকমই তো।
এর ওপর আবার সিদ্ধার্থ আলাদা বাসা করে নব-বিবাহিতাকে নিয়ে সংসার পাততে চায়। এর পরেও ক্ষমা করা হবে!
কথায় কথায় ওদেশ দেখাই বলে, আর ওদেশের ফ্যাশানগুলো রপ্ত করে নিয়েছি বলে, সত্যি তো আর ওদেশি হয়ে যাইনি আমরা।
একটা সন্দেহযুক্ত মেয়েকে বিয়ে করা গর্হিত।
বিয়ে করেই আলাদা হওয়াটাই গর্হিত।
মা বাপের সঙ্গে চোটপাট করা তো আরও গর্হিত! তিন-তিনটে গর্হিত কাজ করেও পরিত্যক্ত হবে না সিদ্ধার্থ?
সিদ্ধার্থকে তবে খুঁজতে যেতে হবে তার নতুন বাসায়। সে বাসা অলক আগে দেখে এসেছে।
তবু বুদ্ধি করে সেই শিশু প্রতিষ্ঠানে ফোনে খোঁজ করল।
ওখানে কি উপস্থিত আছেন উনি? সিদ্ধার্থ মজুমদার! আজ একটি বেবিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল যাঁর?
একটু পরেই যাবার কথা!
না।
যায়নি।
অতএব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল সেই নতুন বাসায়।
আর অবাক হয়ে দেখল চারদিকের ঝড় উপেক্ষা করে ঘর সাজাচ্ছে সিদ্ধার্থ।
এটা কী হচ্ছে?
টবে গাছ প্রতিষ্ঠা।
ওদিকে সংসার প্রতিষ্ঠা তো মাথায় উঠল।
কেন? মানে?
সুমি এখন বলছে, ছেলে ছাড়বে না!
ছেলে ছাড়বে না!
সিদ্ধার্থ হাসল।
বলল, বলবে জানতাম।
বলবে জানতে?
হ্যাঁ অলক!
সিদ্ধার্থ একটু রহস্যময় হাসি হাসে, জানতাম। কারণ সুমনাকে যে জানি। তাই তো বাড়ির লোককে একটা মিথ্যে কথা বলে চটিয়ে এলাম।
মিথ্যে কথা।
হ্যাঁ, হিসেবমতো মিথ্যেই! তবে জানো তো কোনও মিথ্যেকে যদি বারবার সত্যি বলে ঘোষণা করা যায়, সেটা আর মিথ্যে থাকে না, সত্যি হয়ে ওঠে।
তুমি যে রহস্যময় হয়ে উঠেছ সিদ্ধার্থ! বাড়ির লোককে চটিয়েছ সেটা বুঝে এলাম।
গিয়েছিলি বুঝি?
হ্যাঁ। তোমার দাদা বললেন তোমার এই চন্দ্রবদন যত না দেখতে হয় তাঁদের ততই মঙ্গল! ব্যাপার কী?
বাপার বলতে কিছু না। ওই ছোট্ট একটু অনৃতভাষণ! ভেবে দেখলাম, সুমনা যখন ছেলেটাকে ছাড়বেই না, তখন ওটাকে দুজনে ভাগ করে নিলেই ওর ভার কমে। ছেলেটাকে নিজেরই কুকীর্তির ফল বলে চালিয়ে দিলাম আর কি
সিদ্ধার্থ!
আহা হা চমকাচ্ছিস কেন বাবা? তোর বোনের তো আর তাতে জাত যাচ্ছে না। কান্তিকাকা ডেকে ধমকালেন। বললেন, আমার কুমারী মেয়ের নামে দুর্নাম রটাচ্ছ কোন সাহসে! দিলাম একটু শুনিয়ে। বললাম, দুর্নাম তো আপনারাই রটিয়ে বেড়িয়েছেন। বেচারা ভদ্রলোককে শুনিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তখন টাটকা বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসেছি। কিন্তু তুই অমন বজ্রাহত বনস্পতি মেরে গেলি কেন? বুদ্ধিটা কিছু খারাপ হয়েছে?
কিন্তু এ তুমি কী করলে সিদ্ধার্থ?
ঠিকই করলাম অলক! চল এখন সেই বিদ্রোহিণীকে জানিয়ে আসি, তোমার পোষা বৎসটিকে আর বিদায় দিতে হবে না। তাকে মজুমদার শাবক নামে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হবে।
স্বপ্নহতের মতোই বাড়ি ফেরে অলক।
ভাবতে পারে না, এ সিদ্ধার্থের উদারতা, না নির্বুদ্ধিতা!
কিন্তু নির্বুদ্ধিতা কি একা সিদ্ধার্থেরই?
কতবড় নির্বোধ সুমনা!
.
সুমি! সুমি!
সুজাতা এসে আছড়ে পড়ল, সুমিকে তা হলে তোরা নিয়ে যাসনি? আর আছড়ে না পড়ুক ভিড় করল বাড়ির সবাই।
না তো। ও তো যাবে না বলে জেদ ধরে
তাই তো জানি অলক, হঠাৎ দেখছি নেই। জানি না কোথায় চলে গেল, আর কী করে চলে গেল। কেউ তো দেখতেও পায়নি। ঘরভরা জিনিস, সব পড়ে বাবা! সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সুজাতা,ছেলেটা বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে, পাঁচজনে দিয়েছিল আদর করে খেলনা পুতুল জামা জুতো। সব ফেলে রেখে শুধু ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল।
সিদ্ধার্থ শুকনো মুখে বলে, এমনি কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যায়নি তো
কোথাও যায় না বাবা! এই ঘরটার ভিতর পড়ে থাকে। কী খেয়াল হল নিজেই বলল, কোথায় আশ্রমে ভর্তি করে দেবে, নিজে কলেজে ভর্তি হয়েছে–আজ হঠাৎ কী মতি হল, বলল, যাব না। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! কিন্তু সত্যি চলে যাবে, ভাবিনি।
কেঁদে ফেলল সুজাতা।
কিন্তু পুরুষদের তো আর কাঁদা চলে না।
তাই তাঁদের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে যেতে হয়, কোথায় পালাল খেপে যাওয়া মেয়েটা, তাই খুঁজতে।
হ্যাঁ, বাপ কাকা জেঠা দাদা প্রেমিক, সবাই ছোটাছুটি করছে।…ব্যাপারটার গুরুত্ব আর অস্বীকার করা যায় না।
থানায় থানায় খবর চলে যায় একটি শিশু-সমেত একটি তরুণী মেয়ে নিখোঁজ। বুদ্ধি ঈষৎ অপ্রকৃতিস্থ। মেয়েটি লম্বা ফরসা…চশমা চোখে…বাচ্চাটি গৌরাঙ্গ স্বাস্থ্যবান।
কিন্তু আশ্চর্য, এত তাড়াতাড়ি এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সুমনা!
সন্দেহ নেই বাড়ি থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি চেপেছে। কিন্তু কোন্ দিক লক্ষ্য করে?
.
তা হয়রানি হয় বইকী!
সকলেরই হয়।
আরও হয়রানি হয় থানার কার্যতৎপরতায়। বাচ্চা সমেত মেয়েছেলে এক-একটা ধরে ফেলেছে প্রায় সকলেই।
তাই শনাক্ত করতে ছুটতে হয় মুচিপাড়া থানায়, তালতলা থানায়, বড়বাজার থানায়।
একটা আধবয়সী ঝি মনিবের ছেলে কোলে রাস্তা পার হতে বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তার সেই বিভ্রান্তির সুযোগ তৎপর পুলিশ ছাড়েনি।
একটা বাজারের শাকওয়ালী দিনের শেষে খালি ডালা আর ভর্তি গেঁজে নিয়ে ফিরছিল, সঙ্গে একটা বছর আষ্টেকের ছেলে, তাদের আটকে রেখে চৌদ্দপুরুষান্ত গালাগালি খাচ্ছে পুলিশ।
ধরে রেখেছে একটা স্কুলের মেয়েকে।
শুকনো মুখ, শ্রীহীন শাড়ি, ছেঁড়া চটি। অপরাধের মধ্যে তার চোখে চশমা।…সঙ্গে বাচ্চা নেই। তা না থাক–চশমাটা তো রয়েছে।
তাঁতির মাকুর মতো কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত টানাপোড়েন করে বেড়ান কান্তিবাবু, অলক, সিদ্ধার্থ।
আর বেলা যখন পাঁচটা, তখন টেলিফোন বেজে ওঠে কান্তিকুমারের ঘরে, থানা থেকে নয় রেলওয়ে স্টেশন থেকে। মেয়ে গলা।
না, সে বলবেনা কোথা থেকে বলছে। হাওড়া কি শেয়ালদা। শুধু জানাচ্ছে…তাকে যেন আর খোঁজা হয়, সে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
.
সুজাতা তীব্র তিরস্কারে বিঁধে রেখে চলে গিয়েছিল।
সুজাতা ভাবেনি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সুমনা। যেতে পারবে।
ছেলে কোলে করে যাবে কোথায়!
তাই নিজের ঘরে গিয়ে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকছিল আর ভাবছিল আরও তীব্র কিছু বলতে পারলে ভাল হত। আরও কঠিন আরও মর্মান্তিক। যাতে রাগে-অপমানে ছটফটিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে সুমনা।
ছেলেটাকে একবার চোখ ছাড়া করে রেখে এলেই যে সুমনার ঘাড়ের ভূত নামবে, এ বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই সুজাতার। নিজের হাত যদি থাকত সুজাতার, কবে মেয়েকে ওই ভূতের হাত থেকে উদ্ধার করত। কিন্তু সুজাতার নিজের হাতে কিছুই নেই। হাত না থাকলেই সব বিষ জিভে উঠে আসে। এই নিয়ম। তাই সুজাতা ভাবছিল আরও বিষ ছড়িয়ে আসতে পারলে হয়তো কাজ হত।
ভাবেনি, কাজ হচ্ছে তখন অন্য পথে।
.
মা চলে যাবার পর সুমনা ড্রয়ার খুলল। গুনে টুনে দেখল না। সে ধৈর্য নেই এখন। যত যা টাকা পয়সা ছিল, মুঠো করে তুলে নিয়ে বটুয়ায় ভরল। পোস্ট অফিসের পাশবইটা নিল।
আগে মাঝে মাঝেই আদর করে টাকা দিয়েছে সবাই, বই কিনতে শাড়ি কিনতে। সব ফুরোয়নি। সুজাতাই জোর করে জমা দিইয়ে দিয়েছিল, সুমনার ঘোরতর আপত্তি অগ্রাহ্য করে।
জীবনে এই প্রথম মায়ের বুদ্ধিটা সত্যিকার বুদ্ধি বলে মনে হল সুমনার।
টাকা নিল, গয়না নিল না।
গলার হারটা আর হাতের বালা দুটো খুলে ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারের চাবিটা রেখে দিল ড্রয়ারের ওপর। তারপর ছেলেটাকে তুলে কাঁধে ফেলল।
সিঁড়ি দিয়ে নামা চলবে না।
সবাই দেখতে পাবে।
বাথরুমের দিকে জমাদার ওঠবার লোহার সিঁড়িটার দিকে তাকাল। ওই ওইটাই এখন ভরসা।
নেমে গেল ঘুরে ঘুরে।
দেখতে পাবে না। কেউ এদিকে আসে না।
যদি দেখতে পায়?
বলবে, বেশ করেছি চলে যাচ্ছি। আমাকে আটকাতে পারো না তোমরা। আমি নাবালিকা নই।
অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেন ঝগড়া করে সুমনা।
দামাল হয়ে ওঠা ভারী ছেলেটাকে কাঁধে ফেলে রাখা সহজ নয়। অনবরত তাকে চেপে ধরতে হচ্ছে। তবু দ্রুত পায়ে বাড়ির পিছনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ে সুমনা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা চেনা মুখের সামনে পড়ে না।
কলকাতা শহর এমনিই।
পাড়ার লোকও তাকিয়ে দেখে না।
অথবা দেখলেও কিছু বলে না।
সামনের নীল বাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিল নীল বাড়ির একটা মেয়ে। মাকে গিয়ে বলল, কান্তিবাবুর বড় মেয়ে সেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কোথায় বেরোল।
মা বলল, একলা?
তাই তো দেখলাম।
তা হলে ডাক্তারের কাছেটাছে গেল বোধহয়। শুনেছি তো বাড়ির লোকের সঙ্গে নন কো-অপারেশন! লজ্জাও করল না ঘাড়ে করে রাস্তায় বেরোতে?
ও দিকের হলদে বাড়ির বারান্দা থেকে দেখলেন হলদে বাড়ির গিন্নি। মেয়েকে ডেকে বললেন, দেখ, দেখ কান্তি উকিলের মেয়েটা সেই ছেলেটাকে ঘাড়ে করে একটা ট্যাক্সিতে উঠছে। কোথায় যাচ্ছে বল দিকি?
মেয়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, অনাথ আশ্রমে।
অনাথ আশ্রমে?
হ্যাঁ। এইবার তো বলেছে দিয়ে দেবে।
কে বললে তোকে?
ওর খুড়ি ছোটপিসির চেনা নয়?
এটা একটা উত্তর নয়, তবু উত্তর বলে মেনে নিল মা।
দেখল পাড়ার কটা ছোট ছেলে।
যারা রাস্তার মাঝখানে ইট খাড়া করে ক্রিকেট খেলছিল। দেখল এ বাড়ি ও বাড়ির কটা চাকর, যারা একটা বাড়ির রোয়াকে বসে গুলতানি করছিল। ওরা শুধু দেখল, কোনও মন্তব্য করল না।
কিন্তু সুমনার বাড়ির কেউ দেখতে পেল না। সুমনা নির্বিবাদে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
আপাতত লোকের চোখ থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাক, তারপর ভাবছি, অতঃপর কী করব! ভাবল সুমনা।
.
প্রফেসর আর কের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?
বলবে, আপনার নির্দেশ মানতে পারলাম না। হেরে গেলাম। এখন বলুন এর পর কী করব।
না। তা হয় না।
প্রফেসর যখন বলবেন,আমি তোমায় ইনটেলিজেন্ট বলেই জানতাম সুমনা
.
কোথায় যাবেন?
ড্রাইভার জানতে চাইছে।
ঠিক যে কথাটা সুমনা নিজেই নিজের কাছে জানতে চাইছিল এতক্ষণ।
বলল, শেয়ালদা স্টেশন।
শেয়ালদা কেন বলল?
গন্তব্যস্থান কি তবে নির্বাচন করা ছিল সুমনার?
না, তা নয়।
ওর হঠাৎ মনে হল হাওড়ায় অনেক ভিড়, হয়তো অনেক চেনা মুখ বেরোবে। শেয়ালদা একটু লুকোনো, একটু চাপা, একটু নিশ্চিন্তের।
স্টেশনে নেমে কী করবে? তা জানে না সুমনা।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই বুঝি সন্ধ্যা হয়।
গাড়ি থেকে নামবার আগেই দেখল কাকিমার ভাই আর ভাজ। ওঃ রানাঘাটে যাচ্ছেন ওঁরা। যেটা কাকিমার বাপের বাড়ি। গতকাল যেন ওঁরা এসেছিলেন না সুমনাদের বাড়িতে? কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে? অবশ্যই সবই জেনে গেছেন, শুনে গেছেন।
ওঁদের সামনে নামা চলবে না।
ব্যাকুল হয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে নিবেদন জানাল, দেখুন, শুনছেন? আমার বলতে ভুল হয়েছিল, শেয়ালদা নয়, হাওড়া।
বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল!
শেয়ালদা নয় হাওড়া! পাগল নাকি!
বয়েস মারাত্মক, সঙ্গে একটা কচি ছেলে।
বাঙালি ড্রাইভার রিস্ক নিতে রাজি হয় না। বলে,ঠিক আছে, অন্য গাড়ি দেখে নিন না।
না। সময় নেই!
ড্রাইভার বেঁকে বসেছে। যাবে না।
কাঠকবুল। কিছুতেই না।
অন্য গাড়ি নিন না। অভাব তো নেই।
তা আপনারই এত আপত্তি কীসের? অমনি তো যাবেন না, পয়সা দেব তো?
পয়সা!
পয়সা দেখাতে এসেছেন!
ড্রাইভারি করছি বটে, কিন্তু আমরা ভদ্রলোকের ছেলে। আমাদের পয়সা দেখাতে আসবেন না।
বেশ তো আপনারা ভদ্রলোকের ছেলে, সেটা তো মস্ত একটা সুবিধে আমাদের। ভদ্রঘরের মেয়ের সুবিধে অসুবিধে অবশ্যই দেখবেন।
না। আমার মিটারটা মিটিয়ে দিন।
সুমনা এবার চোখ গরম করে।
এভাবে আমাকে নামিয়ে দিতে আপনি পারেন না। পাবলিকের প্রয়োজন আপনাকে দেখতেই হবে।
মাপ করবেন।
গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়েছে ও।
অগত্যাই নামতে হল সুমনাকে।
আর হঠাৎ মনে হল, টাকা থাকলেই কি সব হয়? বজায় থাকে মান মর্যাদা? সামান্য একটা গাড়ির ড্রাইভার! সেও এমনভাবে অপমান করল কেন তবে? কই প্রতিকার তো নেই সুমনার হাতে!
বাড়িতে প্রতিপদেই মনে হয়েছে, অপমানিত হচ্ছি। এতটুকু এদিক ওদিক হলেই মনে হয় আর, আর না। চলে যাব।
চলে যাব। মান মর্যাদা বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
যেন সমস্ত বাইরেটা সম্মানের রাজ-সিংহাসন পেতে বসে অপেক্ষা করছে।
এই তো তার প্রমাণ।
আর এই তো তার শুরু।
এরপর যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরবে? কে জানে কত অপদস্থ হতে হবে। হয়তো ছেলে সম্পর্কে প্রশ্নের আর শেষ থাকবে না। হয়তো তারা মন্তব্য করবে কটু। হয়তো বলবে, না না ওরকম একটা দুধের বাচ্চা সমেত শিক্ষয়িত্রী আমরা রাখি না।
বিধবা?
তাতে কি, ছেলের বাপের একটা নাম পরিচয় তো ছিল।
বানাবে সুমনা?
যা খুশি?
তাতেই কি অপমানের হাত থেকে রেহাই পাবে?
তা যদিই বা রেহাই পায়, ত্রুটি তো হবেই প্রতিপদে। একজন কুমারীর চেয়ে, একজন পরিবারের গণ্ডির মধ্যকার বিবাহিতা মেয়ের চেয়ে। অসুখ করতে পারে ছেলের, আবদার করতে পারে। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাতে পারে।
শিউরে উঠল সুমনা।
কিন্তু সেই ত্রুটির খেসারত ত দিতে হবে তাকে নীরবে গঞ্জনা খেয়ে। হয়তো ওরা বলবে, আপনার দ্বারা চলবে না।
সুমনাকে মিনতিতে ভেঙে পড়ে বলতে হবে, দেখুন আমার না হোক, এই বাচ্চাটার মুখের দিকে চান একবার! চাকরি গেলে, কী খেতে দেব ছেলেটাকে?
যে সুমনা বাড়িতে কারও এতটুকু কথা সইতে পারে না, বাবার নয়, মায়ের নয়, জেঠি জ্যেঠা কাকা কাকি ঠাকুমা পিসিমা, কারও কথা নয়, সেই সুমনা!
না, স্বাবলম্বন মানেই সসম্মান জীবন নয়। সেই অবলম্বনটুকু রক্ষা করতেও ক্ষেত্র বিশেষে অসম্মান বহন করতে হয়!
.
হাওড়ায় এসে পৌঁছল।
গিয়ে বসল থার্ড ক্লাসের ওয়েটিং রুমে।
এই ভাল। সুমনার পরিচিত জগতের সবাই তো প্রথম শ্রেণীর, তারা কেউ এলে এদিকে উঁকি দেবে না।
ছেলেটা কাঁদছে।
স্টেশন থেকে কিছু কি খাওয়াবে ওকে?
কী খাওয়াবে?
একমাত্র খাওয়ানো চলে ফল। লেবু কলা। কিনল, খাওয়াতে চেষ্টা করল একটু। কিছু বা খেল, কিছু খেল না। সুমনার মনে হল, এতটা অবিমৃষ্যকারিতা না করলেই হত! অন্তত অচিনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল।
খাওয়ার, পরার।
কিন্তু সে জিনিসগুলো কি একটা আধটা?
ফুড স্টোভ স্পিরিট দেশলাই, সসপ্যান বাটি চামচ, ফিডিং বটল, সেগুলো সাফ করবার জন্যে ব্রাশ সাবান। তা ছাড়া স্নানের প্রসাধনের তোয়ালে তেল সাবান চিরুনি, পাউডার কাজল, জামা জুতো মোজা, কাঁথা বালিশ–আরও কত কত!
অবশ হয়ে এল সমস্ত শরীর।
সুমনার ঘরটা ভর্তি যা কিছু যত কিছু সবই তো ওর দরকারি। প্রত্যেকটি মুহূর্তে দরকার।
সেই জিনিসের বোঝা কীসে নিত সুমনা? মস্ত একটা সুটকেসে? সেটা কে বইত? মুটে? মোটঘাট আর ছেলে নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠলে বেশ শোভন হত, সুন্দর হত!
কে সসম্মানে দরজা খুলে দিয়ে বলত, এসো এসো!
নাঃ ঘরে বাইরে কোথাও সম্মানের আশা নেই, এই নাম-গোত্রহীন ছেলেটাকে নিয়ে। তবু তো হতভাগা ছেলেটার জন্যে ভেবে আকুল হচ্ছে সুমনা। ভাবছে, কতক্ষণ খায়নি, কতক্ষণ ভাল করে শোয়নি।
কোলের ভিতর কতক্ষণ থাকতে পারে–দুষ্ট দুরন্ত ছেলে? কতক্ষণ ভাল লাগে?
আচ্ছা, সুমনা যে চলে এল, পালিয়ে এল, তাকে কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছে না? বেড়াচ্ছে অবশ্যই। অলক, সিদ্ধার্থ, বাবা!
সিদ্ধার্থ অপদস্থ হবে।
সেই আশ্রমের কর্তৃপক্ষের কাছে।
সিদ্ধার্থ জীবনে আর কখনও ক্ষমা করবে না সুমনাকে।
কিন্তু সুমনাও তো আর কারও ক্ষমা চায় না, ভালবাসা চায় না, প্রতি প্রেম স্নেহ সহানুভূতি কিচ্ছু চায় না। সুমনা শুধু একটা জেদের অহংকার নিয়ে পৃথিবীটা দেখতে চায়। আর পৃথিবীকে দেখাতে চায়।
এতক্ষণ এত আলোড়নেও যা হয়নি, তাই হল। হঠাৎ একঝলক জল এসে চোখ উপচে গাল ভাসিয়ে দিল।
.
অ মেয়ে, যাবে কোথায়?
একটি নিতান্তই গাঁইয়া বুড়ি প্রশ্ন করে, কোথায় যাবে?
সুমনা ইচ্ছে করলেই উত্তর না দিয়ে থাকতে পারে। মুখ ঘুরিয়ে বসতে পারে। কিন্তু তা পারতে দেয় না তার শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতা।
চোখের জল মুছতে গেলে বেশি প্রকাশ।
তাই মুখ ফিরিয়ে ধরা গলায় বলে,শ্রীরামপুর।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে স্থান নির্বাচন করে ফেলেছে সুমনা। শ্রীরামপুরেই যাবে। সেখানে দীপা আছে। অসামান্য নয়, সামান্য বন্ধু। তবু এই ভয়ংকর মুহূর্তে তার নামটাই মুখে এসে গেল।
বুড়ি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সবিস্ময়ে বলে,ওমা, ছিরামপুর যাবে তো সেই এস্তক বসে কেন? দু দুখানা গাড়ি তো ছেড়ে দিল।
ছেড়ে দিল!
আর নেই গাড়ি?
থাকবে না কেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় আছে। তুমি একা যাচ্ছ বুঝি?
সেখানে স্টেশনে লোক থাকবে।
এবার থেকে অহরহই মিথ্যা বলতে হবে সুমনাকে। মিথ্যার জাল রচনা করেই কাটাতে হবে জীবন।
বুড়ি বলে, ছেলেটি বুঝি প্রথম?
হ্যাঁ।
খাসা গোপালের মতন চেহারাখানি! তা যাই বলো বাছা, দুরন্ত ছেলে নিয়ে এমন একা যাওয়া আসা করা ঠিক না। বড় ভয়। আর কাউকে নিতে হয় সঙ্গে।
সুমনা তীব্রস্বরে বলে ওঠে, বাড়িতে আর যদি কেউ না থাকে?
অ। কেউ নেই বুঝি? মনে কিছু কোরো না বাছা, বুড়োমানুষ কী বলতে কী বলি। তবে যাবে যদি উঠে পড়ো। এই আবার একটা ট্রেন ছাড়বে।
সুমনা উঠে যায়।
কেউ চুপ করে থাকবে না।
সবাই কথা বলবে। তোমার নিভৃতে যে কথাকটি মনের মণিকোঠায় তুলে রাখতে চাও, সেই কটিকে পেড়ে নামানোতেই আনন্দ সবাইয়ের।
একটা কথাহীন পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে সুমনা নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনটা কাটাতে পারে?
সে-পৃথিবীকে আবিষ্কার করতেই হবে।
কিন্তু ওরা যদি খুঁজে বার করে?
সুমনা স্টেশন থেকে বাড়িতে ফোন করবে। জানিয়ে চলে যাবে। বলে যাবে, আমায় খুঁজো না।
.
কিন্তু খুঁজো না বললেই কি না খুঁজে থাকবে এরা? বাপ, ভাই প্রেমিক?
কলকাতা যেমন বড় শহর, তেমনি হাতের মুঠোর শহর।
রেলপুলিশকে জানাতেই বা কতক্ষণ? রেলপুলিশেরই বা জানতে কতক্ষণ? শেষ অবধি ওরকম একটি কে-এর খবর দিয়ে দেয় তারা।
এবার বর্ণনাটা নিখুঁত দেওয়া হয়েছিল এদের কাছে। রং গড়ন উচ্চতা, নাম ধাম বয়েস। দেওয়া হয়েছিল সঙ্গের বাচ্চাটির বিবরণ।
শ্রীরামপুর স্টেশন।
কী ভেবে ওখানে গেল সুমনা? এমন কে আছে ওর ওখানে?
না, তেমন কেউ নয়।
তবু ভেবেছিল দীপার কাছে আগে যাবে।
তারপর গুছিয়ে নেবে।
তারপর দেখবে পৃথিবীটা কত বড়।
ভেবেছিল সুমনা। সারাদিন হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসে ভেবেছিল। বাড়িতে বাথরুমের বারান্দা থেকে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতেও ভেবেছিল, একবার এদের চোখের আওতা থেকে চলে যেতে পারলে হয়! তারপর দেখব।
সুজাতা বলেছিল, ছেলে কোলে করে রাস্তায় ভিক্ষে করিস, তা ভিন্ন আর কী গতি হবে তোর।
সুমনা দেখবে আর কোনও গতি হয় কি না।
এতবড় বিরাট পৃথিবীতে কখনও কি কোনও সত্যি-মা এমন করে শিশু বুকে চেপে রাস্তায় নামে না? সুমনা মিথ্যে মা, কিন্তু সুমনার ভালবাসাটা তো মিথ্যে নয়?
আর সুমনার জেদ!
সুমনার জেদের অহংকার।
যে অহংকার দেখিয়ে দিতে চায় পথে পথে ভিক্ষে করা ভিন্ন আর কোনও পথ আছে কিনা।
সারাটা দিন বৃথা ভাবনায় কাটিয়েছে সুমনা। সামান্য একটা ড্রাইভারের ঔদ্ধত্যে ভেবেছে সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি উদ্ধত দৃষ্টি মেলে উদ্যত হয়ে আছে অপমান করবে বলে। তা কেন? পৃথিবী অনেক বড়!
সুমনা একদিন ওর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলে, নিয়ে গিয়ে দাঁড়াবে ওদের সেই বাড়িতে। ঢুকবে জমাদার আসার চোরা সিঁড়ি দিয়ে নয়, সদর দরজা দিয়ে। সুমনার সেই অহংকারী মাকে বলবে, শোনো, শুনে যাও, আমি ভিক্ষে করিনি, আমি সম্মান হারাইনি। আমি আমার ছেলেকে মানুষ করে তুলেছি।
ভয়ানক একটা উত্তেজিত মানসিক অবস্থায় কোনও পরিকল্পনা দাঁড়ায় না। তবু আকাশের গায়ের দ্রুত চলন্ত মেঘের মতো চিন্তাভাবনাগুলো ছুটোছুটি করে।
বি.এ. পাশের ডিগ্রিটাকে সম্বল করে কোনও মফস্বলের স্কুলের টিচারির জন্যে দাঁড়ালে, দাঁড়ানোটা ব্যর্থ হবে না। মাস্টারি একটা ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারবে। আর মাস্টারি-ই একমাত্র পেশা, যাতে ছুটি আছে অনেক।
গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি, এই দুটো বড় ছুটিতে অচিনকে সে যত্নে ডুবিয়ে রাখবে। খুচরো ছুটিও তো আছেই। বাকি সময়টার জন্যে রাখতেই হবে একটা ঝি। উপায় নেই। কিন্তু? হঠাৎ চমকে উঠল সুমনা, যদি সুমনার অনুপস্থিতির অবকাশে সেই ঝিটা অচিনকে চুরি করে নিয়ে পালায়?
ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা ঠাণ্ডা হয়ে এল সুমনার। ছেলেটাকে অকারণেই আরও চেপে ধরল।
অথচ এমন চাপাচাপির মধ্যে থাকতে সে একান্ত নারাজ। ট্রেনের কামরায় বেদম দৌরাত্ম্যি করবে সে।
কী সুন্দর ছেলেটি আপনার!
বলল একটি সহযাত্রিনী। লেডিস কম্পার্টমেন্টটাই বেছে নিয়েছে সুমনা। সহযাত্রিনী ফের বলে, একা এত দুরন্ত ছেলে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন?
সুমনা গম্ভীর ভাবে বলে, না। পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে।
এর বাবা! মেয়েটি হাসে,আপনার কেউ নয় তো?
না! আমার কেউ না।
বলে সুমনাও হাসির ভান করে।
হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটির কৌতূহল আরও প্রবল হত, হয়তো বলে বসত, আপনি বুঝি সিঁদুর চিঁদুরকে কুসংস্কার ভাবেন?হয়তো বলত, কই এর বাবা তো একবারও খোঁজ নিতে এলেন না? কিন্তু ঈশ্বরের অপার অনুগ্রহ, মেয়েটা কোন্নগরে নেমে গেল।
আর সুমনা ভাবতে লাগল।
খুব অবলীলায় মিথ্যে কথাটা বলে ফেলতে পারল সে। একটুও বাধল না, বা ওর প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠতে পারল না, তা একা ছাড়া গতি কী? এটা যে আমার কুড়োনো ছেলে!
সহজেই বলল পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে। তা হলে পারবে সুমনা অবিরত মিথ্যার জাল রচনা করতে।
কে বলতে পারে সত্যিই আছে কি না!
হয়তো আছে। এই গাড়িতেই ওর মা কিংবা ওর বাবা আছে। তারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে বসে আসে। তাদের আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না।
শুধু সুমনাকেই রচনা করে চলতে হবে সহস্র মিথ্যার জাল।
না করে উপায় নেই।
সত্যি কথা কেউ শুনতে চায় না, বুঝতে পারে না। সত্যি কথাকে হজম করবার ক্ষমতাই নেই। কারও। সরাসরি সত্যিকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখলে থতমত খাবে। আহত হবে।
ওদের বাঁচাবার জন্যেই মিথ্যার জালের দরকার। ওরা সেই বানানো মিথ্যা শুনে সন্দেহ করবে, মুখ বাঁকাবে, মুচকি হাসবে, তবু সেটাই হজম করতে পারবে।
কিন্তু দীপার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে কোন মিথ্যার মাধুরী রচনা করে?
দীপা!
তার সহপাঠিনী।
যাকে সুমনা বলত, ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে পড়া! বাস্য! তোর মতো অবস্থা আমার হলে, স্রেফ খাতা থেকে নাম কাটিয়ে দিয়ে বাড়ি বসে কুটনো কুটতাম বাটনা বাটতাম!
সেই দীপা।
যে সুমনার সৌভাগ্যর দিকে করুণ নয়নে তাকাত। যে বলত, তা তুই আর বলবি না কেন? ভগবান তোকে জগতের সব সুবিধেগুলো একঙ্গে ঢেলে দিয়েছেন। আমাদের তো খেটেপিটে মানুষ হতে হবে? বেঁচে থাকতে হবে?
আজ সুমনার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকাবে দীপা? যে সুমনাকে খেটে-পিটে শুধু নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখলে চলবে না। আরও একটি প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, মানুষ করতে হবে।
দীপা যদি বলে, এ কী, তোর এ কী হাল?
তার উত্তরে কী বলবে সুমনা?
কী বলবে, ভাবতে ভাবতে শ্রীরামপুর এসে গেল।
ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।
কিন্তু এই রাত্তিরে এই ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি? তার তো মা বাপ আছে, সে তো একা নয়!
তবে কী করবে সুমনা?
ঠিকানাও তো জানা নেই।
শুধু নাম।
কোনও রিকশাওলা চিনবে দীপা সান্ডেলের বাড়ি?
ওঃ সান্ডেল বাড়ি যাবেন?
বলল একজন সবজান্তা।
তা অনেক পথ পার করে সারা টাউনটা ঘুরিয়ে নিয়েও গেল কোনও এক সান্ডেল বাড়ি। কিন্তু ডাকাডাকিতে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি দীপা সান্ডেল নাম্নী কাউকে না জানলেও, জেরায় সুমনার সমস্ত কিছু জেনে ফেলবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন।
তাঁর জেরার হাত এড়িয়ে ছাড়ান পেতে সময় লাগল।
অগত্যা সেখান থেকে বিদায়।
সাইকেল রিকশাওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে বলে,ঠিকমতন ঠিকানা না জেনে কি এত রাত্রে আসতে আছে দিদিমণি? আমি বলি কি, আপনি আজকের মতন ফিরে যান। ট্রেন এখনও আছে। কাল আবার তখন–কোনও বেটাছেলেকে সঙ্গে করে
থাক তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না। ধমকে ওঠে, সুমনা, কখন তোমাদের লাস্ট ট্রেন?
আজ্ঞে এগারোটা পঁয়তাল্লিশ।
রাগের মাথায় হাতের ঘড়িটাও হাতে বেঁধে নেওয়া হয়নি। যেটা নিতান্তই দরকার ছিল।
এইসব নিচু ক্লাশের লোকেরা যখন মুরুব্বিয়ানা করতে আসে, তখন তাদের ধমক দিয়ে দাবিয়ে দেওয়াই ঠিক; তাই ধমকে ঠাণ্ডা করে দিতে উদ্যত হয় সুমনা, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটা জেগে উঠে পরিত্রাহী চিৎকার জুড়ে দেয়।
আর সেই কান্না ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সুমনার মনে পড়ে, সাত আট ঘণ্টা ছেলেটা কিছু খায়নি। হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে সেই যা খাওয়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বসে খানিক খানিক সময় বাদ শুধু জল খাইয়েছে। এখন কটা ঘণ্টা জলও নেই।
ঘুমিয়ে পড়েছিল।
খিদেয় আর খেলার ক্লান্তিতে।
জেগে উঠে রসাতল করতে চায়।
ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সুমনা বলে, এই শোেনন। দুধ পাওয়া যাবে কোথাও?
দুধ!
লোকটা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত সুরে বলে, এত রাতে দুধ কোথা?
দুধ কোথা? সুমনা ধমকে ওঠে, বলতে চাও বাচ্চাটা না খেয়ে মারা যাবে?
আজ্ঞে আমি কী করব? ছেলের দুধ সঙ্গে নেই?
না নেই। থাকলে তোমায় বলা হত না।
কিন্তু কথা কার কানে যাচ্ছে?
ছেলেটা যেন শত্রুতা সাধার ভূমিকা নিয়েছে।
সুমনা কী করবে?
সুমনা কি ওকে ঠাস করে একটা চড়িয়ে দেবে?
সুমনা কি নিজে হাউহাউ করে কাঁদবে?
সুমনা কি আশপাশের কোনও বাড়ির দরজায় করাঘাত করে বলবে, একটু দুধ দিতে পারেন? একটু দুধ? বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে
ভাষাটা কী রকম শোনাল? ঠিক রাস্তার ভিখিরির মতন না?
ভাবতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সুমনা।
তা হলে সুজাতার কথাই ঠিক? ছেলে নিয়ে ভিক্ষেই করতেই হবে তাকে? মাত্র এই ঘণ্টা কয়েক বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে চলে এসেছে সুমনা, এর মধ্যেই ভিক্ষাবৃত্তির ভাষা মুসাবিদা করছে?
এই নোটটা তোমায় দিচ্ছি–সুমনা বলে, যেখান থেকে হোক একটু দুধ এনে দিতে হবে।
ব্যাপারটা যে গোলমেলে, তা বুঝতে দেরি হয় না লোকটার। সে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাতে চালাতে বেজার মুখে বলে, নোট নিয়ে কী করব? এখন দুধ পাওয়া যাবে না। আপনি বরং স্টেশনে চলে যান। মাস্টারমশাইকে বলে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়–
স্টেশনমাস্টারকে দিয়ে দুধের ব্যবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা যে কতখানি, সে কি আর জানে না সুমনা?
তবু ভাবে, যাক, স্টেশনে তো চায়ের দোকান থাকে, রাত অবধি খদ্দেরও থাকে তাদের। সেখানেই যদি–
সে দুধ আদৌ দুধ কি না, সে দুধ খেলে ছেলের পেটের অসুখ করবে কি না, দুধ পেলে খাওয়াবে কীসে করে, এসব কথা কিছু ভাবছে না সুমনা। শুধু ওর সমস্ত একাগ্রতা, সমস্ত ইচ্ছাশক্তি ঝিনুক কয়েক দুধের স্বপ্নের কাছে মাথা খুঁড়ছে।
না, চিন্তাশক্তি এখন নেই সুমনার। থাকলে হয়তো ভাবত, ভাগ্য কত সহজেই মানুষকে নতিস্বীকার করায়। বুঝতে পারত ভদ্রঘরের মেয়েরা এত সহজে ভিক্ষার হাত বাড়ায় কেন? শিশু, শিশুই হচ্ছে সমস্ত নিরুপায়তার মূল।
আশ্চর্য, পথের দুধারে তো লোকের বসতি আছে। একটা ছোট ছেলে যে কেঁদে হন্যে হয়ে যাচ্ছে, কারও কানে যাচ্ছে না? কেউ একবার ঘরের জানলা খুলে বাড়ির দরজা খুলে বলতে পারছে না, এ কী এত কাঁদছে কেন?
সুমনা আশ্চর্য হতে পারে।
সুমনা জগতের কী জানে?
পৃথিবীর কতটুকু দেখেছে সে?
সুমনা কি জানে অহরহ এ কান্না শুনতে শুনতে কানে ঘাঁটা পড়ে গেছে পৃথিবীর! ক্ষুধার্ত শিশুর দুরন্ত কান্না, তার গা সহা!
.
এই তো স্টেশন। নেমে পড়ল সুমনা। উদ্দাম ক্রন্দনরত ছেলেটাকে রিকশাওলাটারই কোলে দিয়ে বটুয়া থেকে পয়সা বার করে দিল।
যে বটুয়াটা সম্বল করে এসেছে সুমনা। ভাগ্যিস শুধু এইটুকু জ্ঞান তার ছিল যে, এই বিশ্ব সংসারে টাকাটাই মূল জীবনীরস!
কোথায় তোমাদের স্টেশনমাস্টার?
ওই তো ইদিকেই আসছে, লোকটা বলে।
আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এগিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী ইনস্পেক্টরকে উদ্দেশ করে বলেন, এই তো, এই ইনিই তো ঘণ্টাতিনেক আগে
পৃথিবীটা কত বড়, দেখা হল না।
তার আগেই সন্ধানী পুলিশ দেখে ফেলল সুমনাকে।
এখানে বসে ছিল এরা।
কান্তিকুমার, সিদ্ধার্থ, অলক।
রেল-পুলিশের টেলিফোন পেয়ে যারা সুমনা ফেরার আগেই এসে পৌঁছে গেছে।
পুলিশ যা প্রশংসনীয় কাজ করল, তার তুলনা কী?
এই যে এদিকে আসুন। দেখুন দিকি—
আমি! আমি যাই! দৃঢ়স্বরে বলে সিদ্ধার্থ, সন্দেহের সৃষ্টি হবে না তাতে।
কান্তিকুমার মোটা চশমার ভিতর থেকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,তাতে সন্দেহের সৃষ্টি হবে না?
না। আপনি বুঝে দেখুন কাকাবাবু। স্ত্রী পুত্র এই পরিচয়ই সবচেয়ে সন্দেহহীন। আমার স্ত্রী আর পুত্র। স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ছেলে নিয়ে চলে এসেছে।
পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে? স্বভাববহির্ভূত তীব্ৰস্কর কান্তিকুমারের
করবে। নিশ্চয় করবে, সিদ্ধার্থ ব্যগ্রভাবে বলে, যদি আপনি সহযোগিতা করেন, যদি আপনি সে পরিচয় অস্বীকার না করেন।
কান্তিকুমার আজ অবোধ হয়ে গেছেন, দিগভ্রান্ত হয়ে গেছেন, তাই সিদ্ধার্থ তাঁকে বোঝাতে আসছে, কোন জবাবটা সন্দেহহীন হবে, কীভাবে কথা ফেললে পুলিশ বিশ্বাস করবে।
হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমারকে!
হাতি আর ব্যাঙের প্রবাদটা তা হলে মিথ্যে নয়?
কিন্তু কান্তিকুমার বুঝি তাঁর মেয়ের উপর সিদ্ধার্থের ওই আধিপত্য বিস্তার সহ্য করতে পারছেন না। না কি এই ভয়ংকর একটা লজ্জার বিপদে পড়ে সত্যিই অবুঝ হয়ে গেছেন?
তাই আবার বিচলিত কণ্ঠে বলেন, পুলিশ মানেই বোকা নয় সিদ্ধার্থ, বিবাহিতা অবিবাহিতা বোঝার ক্ষমতা ওদের আছে।
হঠাৎ অলকও বলে ওঠে, তা সত্যি, সিঁদুর টিদুর কিছু নেই—
পাগলামি করিসনে। সিদ্ধার্থ বলে, সিঁদুর আজকাল অনেকেই পরে না। আর হিন্দু বিয়ের এই একটা সুবিধে, কাগজেপত্রে পাকা প্রমাণ দেখাতে হয় না। বিশ্বাসভাজন সাক্ষী দুএকজন থাকলেই হল। তা বাবা আর দাদা, এই চাইতে উপযুক্ত বিশ্বাসভাজন সাক্ষী আর কে হতে পারে? আপনারা বলবেন–
.
গাড়ি নিয়েই এসেছে, মস্তবড় মোটরগাড়ি।
এসেছে বাপ, ভাই আর স্বামী!
নিজেরাই যারা খবর দিয়েছে, আর মেয়ে খুঁজতে যারা হন্যে হয়ে এসেছে। আর এসেছে এতবড় গাড়ি চড়ে। তাদের খুব বেশি হয়রান করে না পুলিশ। হয়তো বা করত, যদি শুধু একটা বেওয়ারিশ তরুণী মেয়ে হত!
কিন্তু না। এর অনেক ওয়ারিশান। আর সঙ্গে একটা ক্ষুৎপিপাসায় বিদ্রোহী, উদ্দাম, চিৎকারপরায়ণ বাচ্চা ছেলে। আটকে রাখতে চাওয়া মানেই নিজেদের জীবন মহানিশা করে তোলা। তাই ছেড়ে দিতে দেরি করে না।
তবু জেরার অভিনয় একটু করে বইকী!
বলে, ওঁর মুখ থেকে তো একটাও কথা আদায় করতে পারিনি, ব্যাপারটা কী বোঝান আমাদের।
প্রধান ব্যাপার মাথাটা একটু ইয়ে-বলে ওঠে অলক।
প্রশ্নকারী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আপনি ওঁর কে?
দাদা।
ওঃ দাদা! থাক, আপনার এখন কথা বলবার দরকার নেই। বাবাকেই বলতে দিন। হ্যাঁ আপনি কী বলছেন?
কান্তিকুমার তেমনি গম্ভীর শান্তকণ্ঠেই বলে যান, খুব একটা কিছু ঘোরালো ব্যাপার নয়। শুনছি তুচ্ছি কথা কাটাকাটি থেকেই
আপনার মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না?
ছিল।
মেয়ের মাথায় কোনও
না। শুধু একটু রাগী বেশি।
কতদিন বিয়ে হয়েছে?
বছর দুই।
হু। ঠিক আছে।…আপনার কিছু বলবার আছে? সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সে মর্মভেদী দৃষ্টি হেনে।
সিদ্ধার্থ কান্তিকুমারের মতো স্তিমিত নয়, শান্ত নয়, ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পিত মূর্তি নয়।
সে চটপট বলে ওঠে, বলবার কিছু নেই মশাই, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন দয়া করে–ছেলেটা খেতে না পেয়ে চিল্লাচ্ছে।
কেন, মায়ের কাছে খেতে পায় না?
প্রশ্নকারীর স্বর তীক্ষ্ণ।
কিন্তু সিদ্ধার্থ সপ্রতিভ।
ওসব কথা বাদ দিন না মশাই, মায়ের কাছে আবার কোন ছেলেটা খেতে পাচ্ছে এ যুগে? জন্মাবধি ফুড কিনতে কিনতে তো
আপনারা তো বলছেন হিন্দু। হিন্দু বাঙালি। উনি লোহা সিঁদুর ইত্যাদি ব্যবহার করেন না কেন?
কেন আর! ফ্যাশান! কিন্তু সব কিছুর আগে বাচ্চাটাকে একটু খাওয়াতে দিলে ভাল হত না? ওর খাদ্যটা যখন এসেই গেছে–
এসে গেছে!..সুমনা চমকে তাকায়। বলে ওঠে, কই? কোথায়?
হ্যাঁ, এই যে!…অলক—
অলক তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা তৈরি ফুড ভর্তি ফিডিং বটল বার করে দেয়। যেটা আসার আগে সুজাতা করে দিয়েছে।
এ বুদ্ধি সিদ্ধার্থর।
আর বুদ্ধিটা জোরালো।
পিতৃহৃদয়ের আকুলতাটা প্রকাশ পেল। সুমনা ফুডের বোতলটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় অলকের হাত থেকে। মুখে ধরে ছেলেটার।
আর সন্দেহের কী থাকতে পারে!
তবু চলে টানাটানি।
ঝগড়ার কারণটা কী?
সিদ্ধার্থ সহসা হেসে ওঠে। বলে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কি আর কারণ থাকে মশাই?
তবু। বাড়ি থেকে চলে আসার মতো
ওটা মুডের ব্যাপার।
যাক শেষ পর্যন্ত সুমনার সাক্ষ্যেও গরমিল হল না। সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়েই ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পেরেছিল সে।
বাপ, ভাই আর স্বামী।
ঠিকই তো৷
রাগ! হ্যাঁ রাগ করেই বটে। রাগের কারণ? নেহাত তুচ্ছ।
তুচ্ছ কারণে আপনি এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসতে সাহসী হলেন?
চলে আসা আবার কী? এখন সুমনা জোরালো–এখানে আমার এক সহপাঠিনীর বাড়ি আছে–
সহপাঠিনী!
তার মানে পড়ুয়া মেয়ে।
স্টুডেন্ট আপনি?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ, বি. এ. পাশ করে বেরিয়েছে এবার। এম. এ. পড়ার প্রস্তুতি চলছে। বাপ হাইকোর্টের উকিল।
ও বাবা! যেতে দাও যেতে দাও। তবু–মরণ কামড়!
কিন্তু আগে তো ওই সহপাঠিনীর কথা বলেননি?
রাগ করে বলিনি। আপনারা ধরলেন কেন?
হু, রাগটা আপনার একটু বেশি। হিতাহিত জ্ঞান হরে নেয়। নাম ঠিকানা কী সহপাঠিনীর?
কী দরকার আপনার?
আছে দরকার।
লিখে নিন। দীপা সান্ডেল। শ্রীরামপুর, সান্ডেল পাড়া।
শেষ পর্যন্ত খোলা বাতাসে।
লিখুক না, লিখে নিক। খুঁজুক গিয়ে।
ছেলেটাকে কোলে নেয় সিদ্ধার্থ। হাত বাড়িয়ে।
আর ভাগ্যের দয়া, আদৌ আপত্তি করে না সে। হয়তো এতক্ষণের বন্দিত্বের পর মুক্তির বাতাস পেয়ে। না কি শিশুহৃদয়ের সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে সে, এখানে আশ্রয় আছে।
সুমনাও দিয়েছে সেই প্রসারিত হাতের ওপর।
সুমনা বিশ্বাস করে কাউকে ছেলে দেয় না। সুমনা এগিয়ে দিয়েছে নির্ভয় নির্ভরতায়।
.
উঃ!
গাড়িতে উঠতে উঠতে বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে সিদ্ধার্থ, সামান্য ব্যাপার নিয়ে কী কাণ্ডটাই করলে! বাড়িসুষ্ঠু লোকের ঘাম ছুটিয়ে দিলে একেবারে!
অলক উঠে পড়ে বলে, যা বলেছ! খেতে পাইনি সারাদিন!
খেতে তো আমরাও কিছু পেলাম না মশাই, রেলপুলিশ বলে, আপনি তো স্ত্রী পেলেন, ছেলে পেলেন।
সিদ্ধার্থ পকেটে হাত পুরে বলে,ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
কান্তিকুমার গাড়িতে ওঠেন না।
কান্তিকুমার ট্রেনে যাবেন।
অলক যাবে গাড়ি চালিয়ে।
অলক পারবে? তা আবার পারবে না?
কান্তিকুমারের চেয়ে ভাল পারবে। কান্তিকুমার বড় বেশি টায়ার্ড।
.
বেশি রাতের নির্জন রাস্তা!
অলক গাড়ি চালাচ্ছে নিঃশব্দে, সহজ মসৃণতায়। সময়ের মসৃণতায় মুহূর্তগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
বাচ্চাটা পেটভরে খেতে পেয়ে গাড়ির দোলানিতে ঘুমিয়ে অচেতন। সুমনারও বুঝি কোনও চেতনা নেই। ও ভুলে গেছে বড় ক্লান্ত হয়ে কখন যেন একবার মাথাটা হেলিয়ে সিদ্ধার্থের কাঁধে রেখেছিল, আর তেমনিই রেখে বসে আছে।
সিদ্ধার্থ এক সময় আস্তে আস্তে বলে, তোমার সংসার আমি সাজিয়ে রেখেছি সুমনা! আমার বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, সব কিনে কিনে জড়ো করেছি, শুধু–
সিদ্ধার্থেরও লজ্জা আছে।
সিদ্ধার্থও কথা বলতে গিয়ে থামে?
সুমনা ঘাড় সোজা করে চোখ তুলে তাকায়। সেই তাকানোর মধ্যেই রয়েছে প্রশ্ন। সে প্রশ্ন যেন নরম সুরে বলছে, শুধু কী?
শুধু একটা জিনিস বাকি রেখেছি। কেনাটা তুলে রেখেছি দুজনে মিলে কিনব বলে।
এবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন আসে।
কী? কী জিনিস?
মাথাটা নিচু করে অলকের কান বাঁচিয়ে আস্তে বলে সিদ্ধার্থ, দোলনা! একটা বেতের দোলনা!
দোলনা!
দোলনা কিনবে তারা দুজনে মিলে! বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় সুমনা। ব্যাকুল একটা হাতে হাত চেপে ধরে সিদ্ধার্থর।
সিদ্ধার্থ সে হাতকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলে, হ্যাঁ। পালা করে দুজনে দোল দেব ব্যাটাকে।
সিদ্ধার্থ!
হ্যাঁ। ও থাকবে আমাদের কাছে, আমাদের দুজনের কাছে। এত চমৎকার একটা সমাধান হাতের কাছে ছিল, অথচ কত হাতড়েই বেড়াচ্ছিলাম! আশ্চর্য নয়? তুমি একটা কোথাকার কার ছেলেকে এত ভালবাসবে, এও অসহ্য! তাই বেশ গুছিয়ে একটা দাবি খাড়া করে ফেলেছি। নিজের বলেই চালাতে শুরু করেছি।
সিদ্ধার্থ!
কী, রাগ হল নাকি! কেন, চেহারাটা কি আমার এতই খারাপ যে, আমাকে তোমার ওই রাজপুত্রটির বাপ বললে বেমানান হবে?