অভয় ঘোষাল খুন
পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলিয়াই বলিয়া উঠিলাম, ‘ওহে—!’
ব্যোমকেশ চকিতে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইল, ‘কী ! বিশু পাল খুন হয়েছে?’
বলিলাম, ‘বিশু পাল নয়–অভয় ঘোষাল।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বোকার মত আমার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর কাগজখানা আমার হাত হইতে কড়িয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।
সংবাদপত্রের বিবরণ অতি সংক্ষিপ্ত। গত রাত্রে আমহাস্ট স্ট্রীট নিবাসী অভয় ঘোষাল নামক এক ধনী ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় শয্যায় খুন হইয়াছেন। পুলিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছে; কে খুন করিয়াছে তাহা এখনো জানা যায় নাই। দুই বৎসর পূর্বে অভয় ঘোষাল খুনের অভিযোগে আসামী হইয়া বেকসুর খালাস হইয়াছিলেন। —
মনটা অন্য প্রকার সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত ছিল, তাই অনেকক্ষণ বিমূঢ় রহিলাম। কাল রাত্রি সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমরা তাহাকে দেখিয়াছি, সে হাসিমুখে পরম স্বচ্ছন্দভাবে ব্যোমকেশের সহিত প্রচ্ছন্ন বাকযুদ্ধ করিয়াছে। তারপর কী হইল? সে ব্যঙ্গভরে বলিয়াছিল, তাহার অনেক ‘বন্ধু আছে। ট্যাক্সিতে তবে কি তাহার ‘বন্ধু ওৎ পাতিয়া বসিয়া ছিল, আমরা চলিয়া যাইবার পর ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে খুন করিয়াছে? কিম্বা ট্যাক্সির লোকটি ডাক্তার রক্ষিত? কিন্তু ডাক্তার রক্ষিত তাহাকে খুন করিতে যাইবে কেন?
বেশি জল্পনা-কল্পনা করিবার আগেই দারোগা রমাপতিবাবু উপস্থিত হইলেন।
রমাপতিবাবুর সহিত কর্ম সম্পর্কে আমাদের ঘনিষ্ঠতা না থাকিলেও অল্প পরিচয় ছিল। কাজের লোক বলিয়া পুলিস বিভাগে তাঁহার সুনাম আছে। আমাদেরই সমবয়স্ক ব্যক্তি; মজবুত চেহারা, অমায়িক বাচনভঙ্গী, চোখের দৃষ্টি মৰ্মভেদী।
ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইল, বলিল, ‘কাগজে দেখলাম। আপনার এলাকায় অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে। ‘
রমাপতিবাবু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ‘আপনি অভয় ঘোষালকে চিনতেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিনতাম না, কাল সন্ধ্যেবেলা পরিচয় হয়েছিল। আমরা তার বাড়িতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে?’
‘তাই নাকি ! দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন?’ ব্যোমকেশ সহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘আগে আপনি খবর বলুন, তারপর আমি বলব।’
রমাপতিবাবু ক্ষণেক ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, আমিই আগে বলছি। অভয় ঘোষালের ওপর অনেক দিন থেকে পুলিসের নজর ছিল। লোকটা ভদ্রতার মুখোশ পরে বেড়াতো, কিন্তু এত বড় শয়তান খুব কম দেখা যায়। কত ভদ্রঘরের মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। নিজের একটা স্ত্রী ছিল, হঠাৎ তার অপঘাত মৃত্যু হয়। তারপর এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়েছিল; ভদ্রলোক স্ত্রীকে ডিভোর্স করেন। তখন স্ত্রীলোকটি বোধ হয়। অভয়কে বিয়ে করার জন্যে বায়না ধরেছিল, অভয় তাকে বিষ খাইয়ে মারে।
‘অভয় ঘোষালকে পুলিস অ্যারেস্ট করল, মামলা কোর্টে উঠল। কিন্তু মামলা টিকল না, অভয়ের অপরাধ পাকাপাকি প্রমাণ হল না। ৩০২ ধারার মামলা, হয় এসপার নয় ওসপার, অভয় ঘোষাল ছাড়া পেয়ে গেল।
‘এই হল অভয় ঘোষালের ইতিহাস। কলকাতা শহরেই অন্তত দশজন লোক আছে যারা তাকে খুন করতে পারলে খুশি হয়।
‘কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময় অভয়ের বাড়ির চাকরানী থানায় এসে খবর দেয় যে অভয় খুন হয়েছে। আমি তখন থানায় ছিলাম না, খবর পেয়ে তদন্ত করতে গেলাম। অভয় ঘোষালের আর্থিক অবস্থা এখন পড়ে গেছে; বাড়িতে একলা থাকে, কেবল একটা কম-বয়সী চাকরানী দেখাশোনা করে। এই চাকরানীটাই থানায় খবর দিতে এসেছিল।
‘গিয়ে দেখলাম অভয় দোতলার ঘরে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে, তার পিঠের বাঁ দিকে গুনাহঁচের মত একটা শলা বিধে আছে। চাকরানীকে সওয়াল করে জানা গেল যে অভয় রাত্রি ন’টার সময় খাওয়া-দাওয়া করে শুতে গিয়েছিল; চাকরানী বাড়ির কাজকর্ম সেরে, নিজে খেয়ে, দোর জানলা বন্ধ করে অভয়ের ঘরে গিয়ে দেখল ইতিমধ্যে কেউ এসে অভয়কে খুন করে রেখে গেছে।
‘আমরা চাকরানীটাকে আটক করে রেখেছি, কিন্তু সে বোধ হয় খুন করেনি। কে খুন করেছে। তাও জানা যাচ্ছে না। অভয়ের সঙ্গে যাদের শক্রতা ছিল–মামলায় যারা অভয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল— তাদের সকলের অ্যালিবাই যাচাই করে দেখেছি, তারা কেউ নয় বলেই মনে হয়।
‘এই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি! এখন আপনি কি জানেন বলুন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি যে কিছু জানি তা আপনি জানলেন কি করে?’
রামপতিবাবু পকেট হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া ব্যোমকেশের দিকে বাড়াইয়া দিলেন, ‘এই কাগজের টুকরোটা নীচের তলায় অভয়ের বসবার ঘরে টেবিলের ওপর রাখা ছিল।’
গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, কাগজের উপর পেন্সিল দিয়া হিজিবিজি কাটা, তারপর লেখা আছে–ব্যোমকেশ বক্সী–শিশুপাল–। মনে পড়িয়া গেল কাল রাত্ৰে অভয় ঘোষাল আমাদের সামনে বসিয়া হিজিবিজি কাটিতেছিল।
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘আপনার নাম দেখে মনে হল আপনি হয়তো কিছু জানেন। তাই এলাম।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক। এবার আমি যা জানি শুনুন।’
ব্যোমকেশ কাল সকালে ডাক্তার রক্ষিতের আগমন হইতে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বক বর্ণনা করিল। রমাপতিবাবু গাঢ় মনোযোগ দিয়া শুনিলেন; ব্যোমকেশ কাহিনী শেষ করিলে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বলিলেন, ‘সন্দেহজনক বটে। কিন্তু বিশু পালের কোনো মোটিভ পাচ্ছি না। তার ওপর লোকটা পঙ্গু।—আপনার কি মনে হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। কাঁটার সময় মৃত্যু হয়েছে জানেন কি?’
‘পুলিস সার্জন বলছেন, রাত্ৰি ন’টার পর এবং বারোটার আগে।’
‘হুঁ-ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘আমার মনে হয়, বিশু পাল সত্যি পঙ্গু্, কিনা ভাল করে যাচাই করে দেখা উচিত।’
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘তা বটে। আর কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বিশু পালকেই নেড়েচেড়ে দেখা যাক। আপনার ফোন আছে, আমাকে একবার ব্যবহার করতে দেবেন?’
‘নিশ্চয়। আসুন।’ ব্যোমকেশ তাঁহাকে পাশের ঘরে লইয়া গেল।
কিছুক্ষণ পরে রমাপতিবাবু ফিরিয়াস আসিয়া বলিলেন, ‘পুলিস সার্জনকে বিশু পালের বাড়িতে যেতে বললাম। আমিও যাচ্ছি। আপনারা আসবেন?’
‘বেশ তো, চলুন না।’
আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হইয়া রমাপতিবাবুর সঙ্গে বাহির হইলাম।
বিশু পালের বাড়ির সামনে ঈষৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। পুলিস সার্জন বাড়ির দ্বারের কাছে পুলিসের ছাপ-মারা গাড়িতে বসিয়া আছেন, রাস্তায় ভিড় জমিয়াছে। ডাক্তার রক্ষিত দ্বারের কাছে উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা উপস্থিত হইলে সার্জন সুশীলবাবু গাড়ি হইতে নামিলেন। ডাক্তার রক্ষিত আমাদের দিকে আগাইয়া আসিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু! কী হয়েছে?’
ব্যোমকেশ দুই পক্ষের পরিচয় করাইয়া দিল। রমাপতিবাবু ডাক্তার রক্ষিতকে বলিলেন, ‘পুলিসের ডাক্তার বিশু পালকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে?’
ডাক্তার রক্ষিত ক্ষণেক অবাক হইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘আপত্তি! বিন্দুমাত্র না। কিন্তু কেন? কি হয়েছে?’
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল নামে এক ব্যক্তিকে কাল রাত্রে কেউ খুন করেছে।’
ডাক্তার রক্ষিত প্রতিধ্বনি করিলেন, ‘অভয় ঘোষালকে খুন করেছে! ও–বুঝেছি, আপনাদের সন্দেহ বিশুবাবু অভয় ঘোষালকে খুন করেছেন।’ তাঁর মুখে একটু শুষ্ক হাসি দেখা দিল— ‘অর্থাৎ বিশুবাবুর পক্ষাঘাত সত্যিকার পক্ষাঘাত নয়, ভান মাত্র। বেশ তো আসুন, পরীক্ষা করে দেখুন!’
আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিলাম।
দ্বিতলে সেরেস্তা বসিয়াছে। ত্রিতলে সিঁড়ির মুখে গুখা সমাসীন। তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া ডাক্তার রক্ষিত বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন। দরজা অল্প খুলিয়া বিশু পালের স্ত্রী ভয়ার্তা চোখে চাহিলেন। সমস্ত প্রক্রিয়াই কাল সন্ধ্যার মত।
বিশু পালের স্ত্রী পাশের ঘরে চলিয়া গেলেই, আমরা পাঁচজন ঘরে প্রবেশ করিলাম। ডাক্তার রক্ষিত আলো জ্বালিয়া দিলেন।
বিছানায় বিশু পাল বাল্যাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছেন, কলহশীর্ণ কষ্ঠে বলিয়া উঠলেন, ‘কী চাই। ডাক্তার, এত লোক কেন?’
ডাক্তার রক্ষিত তাঁহার শয্যাপার্শ্বেনত হইয়া বলিলেন, ‘পুলিসের পক্ষ থেকে ডাক্তার এসেছেন, আপনাকে পরীক্ষা করতে চান।’
বিশু পালের কণ্ঠস্বর আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, ‘কেন? পুলিসের ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করতে চায় কেন?’
ডাক্তার রক্ষিত ধীর স্বরে কহিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে, তাই–’
বিশু পালের ঊর্ধ্বাঙ্গ ধড়ফড় করিয়া উঠিল, ‘কে খুন হয়েছে! কী বললে তুমি ডাক্তার?’
ডাক্তার আবার বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে।’
বিশু পালের মুখে পরিত্রাণের আলো ক্ষণেক ফুটিয়া উঠিয়াই মুখ আবার অন্ধকার হইয়া গেল; তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে! কিন্তু— আমি যে তাকে ত্ৰিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছি, সুদে-আসলে তেত্রিশ হাজার দাঁড়িয়েছে। আমার টাকার কি হবে?’
ডাক্তার নীরস কণ্ঠে বলিলেন, ‘টাকার কথা পরে ভাববেন। এখন এরা এসেছেন যাচাই করতে সত্যি সত্যি আপনার পক্ষাঘাত হয়েছে কিনা।’
‘তার মানে?’ বিশু পাল তীব্র চক্ষু ফিরাইয়া আমাদের পানে চাহিলেন।
রমাপতিবাবু খাটের ধারে আগাইয়া গেলেন, শান্তভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমাদের কোনো মতলব নেই। আমাদের ডাক্তার কেবল আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে কি?’
‘আপত্তি! কিসের আপত্তি! পুলিসের ডাক্তার আমার রোগ সারিয়ে দিতে পারবে?’
সুশীলবাবু বলিলেন, ‘তা-চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
আরো কিছুক্ষণ সওয়াল জবাবের পর বিশু পাল রাজী হইলেন। সুশীলবাবু তাঁহার অঙ্গ হইতে বালাপোশ সরাইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। বিশু পালের পা দু’টি পক্ষাঘাতে অবশ, ঊর্ধ্বাঙ্গ সচল আছে। সুশীলবাবু পায়ে ভূঁচ ফুটাইয়া দেখিলেন, কোনো সাড়া পাইলেন না। তারপর আরো অনেকভাবে পরীক্ষা করিলেন; নাড়ি দেখিলেন, রক্ত-চাপ পরীক্ষা করিলেন, ডাক্তার রক্ষিতকে নানাপ্রকার প্রশ্ন করিলেন। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বিশু পালের গায়ে বালাপোশ মুড়িয়া দিলেন।
তাঁহার পরীক্ষাকালে এক সময় আমার দৃষ্টি অন্দরের দিকে সঞ্চালিত হইয়াছিল। দেখিলাম বিশুবাবুর স্ত্রী দরজা একটু ফাঁক করিয়া নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে চাহিয়া আছেন। তাঁহার উদ্বেগ যেন স্বাভাবিক উদ্বেগ নয়, একটা বিকৃত ভয়ার্ত উত্তেজনা—
সুশীলবাবু বলিলেন, ‘দেখা হয়েছে। চলুন, যাওয়া যাক।’
আমরা দ্বারের দিকে ফিরিলাম। পিছন হইতে বিশু পালের গলা আসিল, ‘কেমন দেখলেন? সারবে রোগ?’
সুশীলবাবু একটু অপ্রস্তুতভাবে বলিলেন, ‘সারতে পারে। আপনার ডাক্তারবাবু ভালই চিকিৎসা করছেন। — আচ্ছা, নমস্কার।’
পুলিসের গাড়িতে বাসায় ফিরিবার পথে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাহলে রোগটা যথার্থ অভিনয় নয়।’
সুশীলবাবু বলিলেন, ‘না, অভিনয় নয়।’