দুর্গেশনন্দিনী – ২য় খণ্ড – ১৬-২২
ষোড়শ পরিচ্ছেদ : দাসী চরণে
সেই রজনীতে কতলু খাঁর বিলাস-গৃহমধ্যে নৃত্য চলিতেছিল। তথায় অপরা নর্তকী কেহ ছিল না–বা অপর শ্রোতা কেহ ছিল না। জন্মদিনোপলক্ষে মোগল সম্রাটেরা যেরূপ পারিষদমণ্ডলী মধ্যে আমোদ-পরায়ণ থাকিতেন, কতলু খাঁর সেরূপ ছিল না। কতলু খাঁর চিত্ত একান্ত আত্মসুখরত, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির অভিলাষী। অদ্য রাত্রে তিনি একাকী নিজ বিলাস-গৃহনিবাসিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহাদিগের নৃত্যগীত কৌতুকে মত্ত ছিলেন। খোজাগণ ব্যতীত অন্য পুরুষ তথায় আসিবার অনুমতি ছিল না। রমণীগণ কেহ নাচিতেছে, কেহ গাহিতেছে, কেহ বাদ্য করিতেছে; অপর সকলে কতলু খাঁকে বেষ্টন করিয়া শুনিতেছে।
ইন্দ্রিয়মুগ্ধকর সামগ্রী সকলই তথায় প্রচুর পরিমাণে বর্তমান। কক্ষমধ্যে প্রবেশ কর; প্রবেশ করিবামাত্র অবিরত সিঞ্চিত গন্ধবারির স্নিগ্ধ ঘ্রাণে আপাদমস্তক শীতল হয়। অগণিত রজত দ্বিরদরদ স্ফাটিক শামাদানের তীব্রোজ্জ্বল জ্বালায় নয়ন ঝলসিতেছিল; অপরিমিত পুষ্পরাশি কোথাও মালাকারে, কোথাও স্তূপাকারে, কোথাও স্তবকাকারে, কোথাও রমণী-কেশপাশে, কোথাও রমণীকণ্ঠে, স্নিগ্ধতর প্রভা প্রকাশিত করিতেছে। কাহার পুষ্পব্যজন, কাহারও পুষ্প আভরণ, কেহ বা অন্যের প্রতি পুষ্পক্ষেপণী প্রেরণ করিতেছে; পুষ্পের সৌরভ; সুরভি বারির সৌরভ; সুগন্ধ দীপের সৌরভ; গন্ধদ্রব্যমার্জিত বিলাসিনীগণের অঙ্গের সৌরভ; পুরীমধ্যে সর্বত্র সৌরভে ব্যাপ্ত। প্রদীপের দীপ্তি, পুষ্পের দীপ্তি, রমণীগণের রত্নালঙ্কারের দীপ্তি, সর্বোপরি ঘন ঘন কটাক্ষ-বর্ষিণী কামিনীমণ্ডলীর উজ্জ্বল নয়নদীপ্তি। সপ্তসুরসম্মিলিত মধুর বীণাদি বাদ্যের ধ্বনি আকাশ ব্যাপিয়া উঠিতেছে; তদধিক পরিষ্কার মধুরনিনাদিনী রমণীকণ্ঠগীতি তাহার সহিত মিশিয়া উঠিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে তাললয়মিলিত পাদবিক্ষেপে নর্তকীর অলঙ্কারশিঞ্জিত শব্দ মনোমুগ্ধ করিতেছে।
ঐ দেখ পাঠক! যেন পদ্মবনে হংসী সমীরণোত্থিত তরঙ্গহিল্লোলে নাচিতেছে; প্রফুল্ল পদ্মমুখী সবে ঘেরিয়া রহিয়াছে। দেখ দেখ, ঐ যে সুন্দরী নীলাম্বরপরিধানা, ঐ যার নীল বাস স্বর্ণতারাবলীতে খচিত, দেখ! ঐ যে দেখিতেছ, সুন্দরী সীমন্তপার্শ্বে হীরকতারা ধারণ করিয়াছে, দেখিয়াছ উহার কি সুন্দর ললাট! প্রশান্ত, প্রশস্ত, পরিষ্কার; এ ললাটে কি বিধাতা বিলাসগৃহ লিখিয়াছিলেন? ঐ যে শ্যামা পুষ্পাভরণা, দেখিয়াছ উহার কেমন পুষ্পাভরণ সাজিয়াছে? নারীদেহ শোভার জন্যই পুষ্প-সৃজন হইয়াছিল। ঐ যে দেখিতেছ সম্পূর্ণ, মৃদুরক্ত, ওষ্ঠাধর যার; যে ওষ্ঠাধর ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে, দেখ, উহা সুচিক্কণ নীল বাস ফুটিয়া কেমন বর্ণপ্রভা বাহির হইতেছে; যেন নির্মল নীলাম্বুমধ্যে পূর্ণচন্দ্রালোক দেখা যাইতেছে। এই যে সুন্দরী মরালনিন্দিত গ্রীবাভঙ্গী করিয়া হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেছে, দেখিয়াছ উহার কেমন কর্ণের কুণ্ডল দুলিতেছে? কে তুমি সুকেশি সুন্দরী? কেন উর:পর্যন্ত কুঞ্চিতালক-রাশি লম্বিত করিয়া দিয়াছ? পদ্মবৃক্ষে কেমন করিয়া কালফণিনী জড়ায়, তাহাই কি দেখাইতেছ?
আর, তুমি কে সুন্দরী, যে কতলু খাঁর পার্শ্বে বসিয়া সুরা ঢালিতেছ? কে তুমি, যে সকল রাখিয়া তোমার পূর্ণলাবণ্য দেহ প্রতি কতলু খাঁ ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছে? কে তুমি অব্যর্থ কটাক্ষে কতলু খাঁর হৃদয় ভেদ করিতেছ? ও মধুর কটাক্ষ চিনি; তুমি বিমলা। অত সুরা ঢালিতেছ কেন? ঢাল, ঢাল, আরও ঢাল, বসন মধ্যে ছুরিকা আছে ত? আছে বই কি। তবে অত হাসিতেছ কিরূপে? কতলু খাঁ তোমার মুখপানে চাহিতেছে। ও কি? কটাক্ষ! ও কি, আবার কি! ঐ দেখ, সুরাস্বাদপ্রমত্ত যবনকে ক্ষিপ্ত করিলে। এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বর্জিত করিয়া কতলু খাঁর প্রেয়সী হইয়া বসিয়াছ? না হবে কেন, যে হাসি, যে অঙ্গভঙ্গী, যে সরস কথারহস্য, যে কটাক্ষ! আবার সরাব! কতলু খাঁ, সাবধান! কতলু খাঁ কি করিবে! যে চাহনি চাহিয়া বিমলা হাতে সুরাপাত্র দিতেছে! ও কি ধ্বনি? এ কে গায়? এ কি মানুষের গান, না, সুররমণী গায়? বিমলা গায়িকাদিগের সহিত গায়িতেছে। কি সুর! কি ধ্বনি! কি লয়! কতলু খাঁ, এ কি? মন কোথায় তোমার? কি দেখিতেছ? সমে সমে হাসিয়া কটাক্ষ করিতেছে; ছুরির অধিক তোমার হৃদয়ে বসাইতেছে, তাহাই দেখিতেছ? অমনি কটাক্ষে প্রাণহরণ করে, আবার সঙ্গীতের সন্ধিসম্বন্ধ কটাক্ষ! আরও দেখিয়াছ কটাক্ষের সঙ্গে আবার অল্প মস্তক-দোলন? দেখিয়াছ, সঙ্গে সঙ্গে কেমন কর্ণাভরণ দুলিতেছে? হাঁ। আবার সুরা ঢাল, দে মদ দে, এ কি ! এ কি! বিমলা উঠিয়া নাচিতেছে। কি সুন্দর! কিবা ভঙ্গী! দে মদ! কি অঙ্গ! কি গঠন! কতলু খাঁ! জাঁহাপনা! স্থির হও! স্থির! উ:! কতলুর শরীরে অগ্নি জ্বলিতে লাগিল। পিয়ালা! আহা! দে পিয়ালা! মেরি পিয়ারী! আবার কি? এর উপর হাসি, এর উপর কটাক্ষ? সরাব! দে সরাব!
কতলু খাঁ উন্মত্ত হইল। বিমলাকে ডাকিয়া কহিল, “তুমি কোথা, প্রিয়তমে!”
বিমলা কতলু খাঁর স্কন্ধে এক বাহু দিয়া কহিলেন, “দাসী শ্রীচরণে।”-অপর করে ছুরিকা–
তৎক্ষণাৎ ভয়ঙ্কর চীৎকার ধ্বনি করিয়া বিমলাকে কতলু খাঁ দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং যেই নিক্ষেপ করিল; অমনি আপনিও ধরাতলশায়ী হইল। বিমলা তাহার বক্ষ:স্থলে আমূল তীক্ষ্ণ ছুরিকা বসাইয়া দিয়াছিলেন।
“পিশাচী–সয়তানী!” কতলু খাঁ এই কথা বলিয়া চীৎকার করিল। “পিশাচী নহি–সয়তানী নহি – বীরেন্দ্রসিংহের বিধবা স্ত্রী।” এই বলিয়া বিমলা কক্ষ হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিলেন।
কতলু খাঁর বাঙ্নিষ্পত্তি-ক্ষমতা ঝটিতি রহিত হইয়া আসিতে লাগিল। তথাপি সাধ্যমত চীৎকার করিতে লাগিল। বিবিরা যথাসাধ্য চীৎকার করিতে লাগিল। বিমলাও চীৎকার করিতে করিতে ছুটিলেন। কক্ষান্তরে গিয়া কথোপকথন শব্দ পাইলেন। বিমলা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিলেন। এক কক্ষ পরে দেখেন, তথায় প্রহরী ও খোজাগণ রহিয়াছে। চীৎকার শুনিয়া ও বিমলার ত্রস্ত ভাব দেখিয়া তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?”
প্রত্যুৎপন্নমতি বিমলা কহিলেন, “সর্বনাশ হইয়াছে। শীঘ্র যাও, কক্ষমধ্যে মোগল প্রবেশ করিয়াছে, বুঝি নবাবকে খুন করিল।”
প্রহরী ও খোজাগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে কক্ষাভিমুখে ছুটিল। বিমলাও ঊর্ধ্বশ্বাসে অন্ত:পুরদ্বারাভিমুখে পলায়ন করিলেন। দ্বারে প্রহরী প্রমোদক্লান্ত হইয়া নিদ্রা যাইতেছিল, বিমলা বিনা বিঘ্নে দ্বার অতিক্রম করিলেন। দেখিলেন, সর্বত্রই প্রায় ঐরূপ, অবাধে দৌড়িতে লাগিলেন। বাহির ফটকে দেখিলেন, প্রহরিগণ জাগরিত। একজন বিমলাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কে ও, কোথা যাও?”
তখন অন্ত:পুরমধ্যে মহা কোলাহল উঠিয়াছে, সকল লোক জাগিয়া সেই দিকে ছুটিতেছিল, বিমলা কহিলেন, “বসিয়া কি করিতেছ, গোলযোগ শুনিতেছ না?”
প্রহরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের গোলযোগ?”
বিমলা কহিলেন, “অন্ত:পুরে সর্বনাশ হইতেছে, নবাবের প্রতি আক্রমণ হইয়াছে।”
প্রহরিগণ ফটক ফেলিয়া দৌড়িল; বিমলা নির্বিঘ্নে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
বিমলা ফটক হইতে কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিলেন যে, একজন পুরুষ এক বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া আছেন। দৃষ্টিমাত্র বিমলা তাঁহাকে অভিরাম স্বামী বলিয়া চিনিতে পারিলেন। বিমলা তাঁহার নিকট যাইবামাত্র অভিরাম স্বামী কহিলেন, “আমি বড়ই উদ্বিগ্ন হইতেছিলাম; দুর্গমধ্যে কোলাহল কিসের?”
বিমলা উত্তর করিলেন, “আমি বৈধব্য যন্ত্রণার প্রতিশোধ করিয়া আসিয়াছি। এখানে আর অধিক কথায় কাজ নাই, শীঘ্র আশ্রমে চলুন; পরে সবিশেষ নিবেদিব। তিলোত্তমা আশ্রমে গিয়াছে ত?”
অভিরাম স্বামী কহিলেন, “তিলোত্তমা অগ্রে অগ্রে আশমানির সহিত যাইতেছে, শীঘ্র সাক্ষাৎ হইবেক।”
এই বলিয়া উভয়ে দ্রুতবেগে চলিলেন। অচিরাৎ কুটীর মধ্যে উপনীত হইয়া দেখিলেন, ক্ষণপূর্বেই আয়েষার অনুগ্রহে তিলোত্তমা আশমানি সঙ্গে তথায় আসিয়াছেন। তিলোত্তমা অভিরাম স্বামীর পদযুগলে প্রণত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অভিরাম স্বামী তাঁহাকে স্থির করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ঈশ্বরেচ্ছায় তোমরা দুরাত্মার হস্ত হইতে মুক্ত হইলে, এখন আর তিলার্ধ এদেশে তিষ্ঠান নহে। যবনেরা সন্ধান পাইলে এবারে প্রাণে মারিয়া প্রভুর মৃত্যুশোক নিবারণ করিবে। আমরা অদ্য রাত্রিতে এ স্থান ত্যাগ করিয়া যাই চল।”
সকলেই এ পরামর্শে সম্মত হইলেন।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : অন্তিম কাল
বিমলার পলায়নের ক্ষণমাত্র পরেই একজন কর্মচারী অতিব্যস্তে জগৎসিংহের কারাগারমধ্যে আসিয়া কহিল, “যুবরাজ! নবাব সাহেবের মৃত্যুকাল উপস্থিত, তিনি আপনাকে স্মরণ করিয়াছেন।”
যুবরাজ চমৎকৃত হইয়া কহিলেন, “সে কি!”
রাজপুরুষ কহিলেন, “অন্তপুর:মধ্যে শত্রু প্রবেশ করিয়া নবাব সাহেবকে আঘাত করিয়া পলায়ন করিয়াছে। এখনও প্রাণত্যাগ হয় নাই, কিন্তু আর বিলম্ব নাই, আপনি ঝটিতি চলুন, নচেৎ সাক্ষাৎ হইবে না।”
রাজপুত্র কহিলেন, “এ সময়ে আমার সহিত সাক্ষাতের প্রয়োজন?”
দূত কহিল, “কি জানি? আমি বার্তাবহ মাত্র।”
যুবরাজ দূতের সহিত অন্ত:পুরমধ্যে গমন করিলেন। তথায় গিয়া দেখেন যে, কতলু খাঁর জীবন-প্রদীপ সত্য সত্যই নির্বাণ হইয়া আসিয়াছে, অন্ধকারের আর বিলম্ব নাই, চতুর্দিকে ওসমান, আয়েষা, মুমূর্ষূর অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রগণ, পত্নী, উপপত্নী, দাসী, অমাত্যবর্গ প্রভৃতি বেষ্টন হইয়া রহিয়াছে। রোদনাদির কোলাহল পড়িয়াছে; প্রায় সকলেই উচ্চরবে কাঁদিতেছে; শিশুগণ না বুঝিয়া কাঁদিতেছে; আয়েষা চীৎকার করিয়া কাঁদিতেছে না। আয়েষার নয়ন-ধারায় মুখ প্লাবিত হইতেছে; নি:শব্দে পিতার মস্তক অঙ্কে ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। জগৎসিংহ দেখিলেন, সে মূর্তি স্থির, গম্ভীর, নিস্পন্দ।
যুবরাজ প্রবেশ মাত্র খ্বাজা ইসা নামে অমাত্য তাঁহার কর ধরিয়া কতলু খাঁর নিকটে লইলেন; যেরূপ উচ্চস্বরে বধিরকে সম্ভাষণ করিতে হয়, সেইরূপ স্বরে কহিলেন, “যুবরাজ জগৎসিংহ আসিয়াছেন।”
কতলু খাঁ ক্ষীণস্বরে কহিলেন, “আমি শত্রু; মরি;-রাগ দ্বেষ ত্যাগ।”
জগৎসিংহ বুঝিয়া কহিলেন, “এ সময়ে ত্যাগ করিলাম।”
কতলু খাঁ পুনরপি সেইরূপ স্বরে কহিলেন, -“যাচ্ঞা–স্বীকার।”
জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি স্বীকার করিব?”
কতলু খাঁ পুনরপি কহিতে লাগিলেন, “বালক সব–যুদ্ধ–বড় তৃষা।”
আয়েষা মুখে সরবত সিঞ্চন করিলেন।
“যুদ্ধ–কাজ–নাই–সন্ধি ” কতলু খাঁ নীরব হইলেন। জগৎসিংহ কোন উত্তর করিলেন না। কতলু খাঁ তাঁহার মুখপানে উত্তর প্রতীক্ষায় চাহিয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়া কষ্টে কহিলেন, “অস্বীকার?” যুবরাজ কহিলেন, “পাঠানেরা দিল্লীশ্বরের প্রভুত্ব স্বীকার করিলে, আমি সন্ধির জন্য অনুরোধ করিতে স্বীকার করিলাম।” কতলু খাঁ পুনরপি অর্ধস্ফুটশ্বাসে কহিলেন, “উড়িষ্যা?” রাজপুত্র বুঝিয়া কহিলেন, “যদি কার্য সম্পন্ন করিতে পারি, তবে আপনার পুত্রেরা উড়িষ্যাচ্যুত হইবে না।” কতলুর মৃত্যু-ক্লেশ-নিপীড়িত মুখকান্তি প্রদীপ্ত হইল। মুমূর্ষু কহিল, “আপনি–মুক্ত–জগদীশ্বর–মঙ্গল ” জগৎসিংহ চলিয়া যান, আয়েষা মুখ অবনত করিয়া পিতাকে কি কহিয়া দিলেন। কতলু খাঁ খ্বাজা ইসার প্রতি চাহিয়া আবার প্রতিগমনকারী রাজপুত্রের দিকে চাহিলেন। খ্বাজা ইসা রাজপুত্রকে কহিলেন, “বুঝি আপনার সঙ্গে আরও কথা আছে।”
রাজপুত্র প্রত্যাবর্তন করিলেন, কতলু খাঁ কহিলেন, “কাণ।”
রাজপুত্র বুঝিলেন। মুমূর্ষুর অধিকতর নিকটে দাঁড়াইয়া মুখের নিকট কর্ণাবনত করিলেন। কতলু খাঁ পূর্বাপেক্ষা অধিকতর অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, “বীর।” ক্ষণেক স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, পরে বলিতে লাগিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ–তৃষা।” আয়েষা পুনরপি অধরে পেয় সিঞ্চন করিলেন। “বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা।” রাজপুত্রকে যেন বৃশ্চিক দংশন করিল; চমকিতের ন্যায় ঋজ্বায়ত হইয়া কিঞ্চিদ্দূরে দাঁড়াইলেন। কতলু খাঁ বলিতে লাগিলেন, “পিতৃহীনা–আমি পাপিষ্ঠ–উ: তৃষা।” আয়েষা পুন: পুন: পানীয়াভিসিঞ্চন করিতে লাগিলেন। কিন্তু আর বাক্যস্ফুরণ দুর্ঘট হইল। শ্বাস ছাড়িতে ছাড়িতে বলিতে লাগিলেন, “দারুণ জ্বালা–সাধ্বী–তুমি দেখিও”
রাজপুত্র কহিলেন, “কি?” কতলু খাঁর কর্ণে এই প্রশ্ন মেঘগর্জনবৎ বোধ হইল। কতলু খাঁ বলিতে লাগিলেন, “এই ক–কন্যার–মত পবিত্রা।–তুমি! -উ:! -বড় তৃষা–যাই যে—আয়েষা।”
আর কথা সরিল না; সাধ্যাতীত পরিশ্রম হইয়াছিল, শ্রমাতিরেক ফলে নির্জীব মস্তক ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। কন্যার নাম মুখে থাকিতে থাকিতে নবাব কতলু খাঁর প্রাণবিয়োগ হইল।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : প্রতিযোগিতা
জগৎসিংহ কারামুক্ত হইয়া পিতৃশিবিরে গমনান্তর নিজ স্বীকারানুযায়ী মোগল পাঠানে সন্ধিসম্বন্ধ করাইলেন। পাঠানেরা দিল্লীশ্বরের অধীনতা স্বীকার করিয়াও উৎকলাধিকারী হইয়া রহিলেন। সন্ধির বিস্তারিত বিবরণ ইতিবৃত্তে বর্ণনীয়। এ স্থলে অতি-বিস্তার নিষ্প্রয়োজন। সন্ধি সমাপনান্তে উভয় দল কিছু দিন পূর্বাবস্থিতির স্থানে রহিলেন। নবপ্রীতিসম্বর্ধনার্থে কতলু খাঁর পুত্রদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া প্রধান রাজমন্ত্রী খ্বাজা ইসা ও সেনাপতি ওসমান রাজা মানসিংহের শিবিরে গমন করিলেন; সার্ধশত হস্তী আর অন্যান্য মহার্ঘ দ্রব্য উপঢৌকন দিয়া রাজার পরিতোষ জন্মাইলেন; রাজাও তাঁহাদিগের বহুবিধ সম্মান করিয়া সকলকে খেলোয়াৎ দিয়া বিদায় করিলেন।
এইরূপ সন্ধিসম্বন্ধ সমাপন করিতে ও শিবির-ভঙ্গোদ্যোগ করিতে কিছু দিন গত হইল।
পরিশেষে রাজপুত সেনার পাটনায় যাত্রার সময় আগত হইলে, জগৎসিংহ এক দিবস অপরাহ্নে সহচর সমভিব্যাহারে পাঠান-দুর্গে ওসমান প্রভৃতির নিকট বিদায় লইতে গমন করিলেন। কারাগারে সাক্ষাতের পর, ওসমান রাজপুত্রের প্রতি আর সৌহৃদ্যভাব প্রকাশ করেন নাই। অদ্য সামান্য কথাবার্তা কহিয়া বিদায় দিলেন।
জগৎসিংহ ওসমানের নিকট ক্ষুণ্ণমনে বিদায় লইয়া খ্বাজা ইসার নিকট বিদায় লইতে গেলেন। তথা হইতে আয়েষার নিকট বিদায় লইবার অভিপ্রায়ে চলিলেন। একজন অন্ত:পুর-রক্ষী দ্বারা আয়েষার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন, আর রক্ষীকে কহিয়া দিলেন যে, “বলিও, নবাব সাহেবের লোকান্তর পরে আর তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। এক্ষণে আমি পাটনায় চলিলাম, পুনর্বার সাক্ষাতের সম্ভাবনা অতি বিরল; অতএব তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া যাইতে চাহি।”
খোজা কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “নবাবপুত্রী বলিয়া পাঠাইলেন যে, তিনি যুবরাজের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন না; অপরাধ মার্জনা করিবেন।”
রাজপুত্র সম্বর্ধিত বিষাদে আত্মশিবিরাভিমুখ হইলেন। দুর্গদ্বারে দেখিলেন, ওসমান তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন।
রাজপুত্র ওসমানকে দেখিয়া পুনরপি অভিবাদন করিয়া চলিয়া যান, ওসমান পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। রাজপুত্র কহিলেন, “সেনাপতি মহাশয়, আপনার যদি কোন আজ্ঞা থাকে প্রকাশ করুন, আমি প্রতিপালন করিয়া কৃতার্থ হই|”
ওসমান কহিলেন, “আপনার সহিত কোন বিশেষ কথা আছে, এত সহচর সাক্ষাৎ তাহা বলিতে পারিব না, সহচরদিগকে অগ্রসর হইতে অনুমতি করুন, একাকী আমার সঙ্গে আসুন।”
রাজপুত্র বিনা সঙ্কোচে সহচরগণকে অগ্রসর হইতে বলিয়া দিয়া একা অশ্বারোহণে পাঠানের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন; ওসমানও অশ্ব আনাইয়া আরোহণ করিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া ওসমান রাজপুত্র সঙ্গে এক নিবিড় শাল-বন-মধ্যে প্রবেশ করিলেন। বনের মধ্যস্থলে এক ভগ্ন অট্টালিকা ছিল, বোধ হয়, অতি পূর্বকালে কোন রাজবিদ্রোহী এ স্থলে আসিয়া কাননাভ্যন্তরে লুক্কায়িত ছিল। শালবৃক্ষে ঘোটক বন্ধন করিয়া ওসমান রাজপুত্রকে সেই ভগ্ন অট্টালিকার মধ্যে লইয়া গেলেন। অট্টালিকা মনুষ্যশূন্য। মধ্যস্থলে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ; তাহার এক পার্শ্বে এক যাবনিক সমাধিখাত প্রস্তুত রহিয়াছে, অথচ শব নাই; অপর পার্শ্বে চিতাসজ্জা রহিয়াছে, অথচ কোন মৃতদেহ নাই।
প্রাঙ্গণমধ্যে আসিলে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ সকল কি?”
ওসমান কহিলেন, “এ সকল আমার আজ্ঞাক্রমে হইয়াছে; আজ যদি আমার মৃত্যু হয়; তবে মহাশয় আমাকে এই কবরমধ্যে সমাধিস্থ করিবেন, কেহ জানিবে না; যদি আপনি দেহত্যাগ করেন, তবে এই চিতায় ব্রাহ্মণ দ্বারা আপনার সৎকার করাইব, অপর কেহ জানিবে না।”
রাজপুত্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “এ সকল কথার তাৎপর্য কি?”
ওসমান কহিলেন, “আমরা পাঠান–অন্ত:করণ প্রজ্বলিত হইলে উচিতানুচিত বিবেচনা করি না; এই পৃথিবী মধ্যে আয়েষার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী দুই ব্যক্তির স্থান হয় না, একজন এইখানে প্রাণত্যাগ করিব।”
তখন রাজপুত্র আদ্যোপান্ত বুঝিতে পারিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইলেন, কহিলেন, “আপনার কি অভিপ্রায়?”
ওসমান কহিলেন, “সশস্ত্র আছ, আমার সহিত যুদ্ধ কর। সাধ্য হয়, আমাকে বধ করিয়া আপনার পথ মুক্ত কর, নচেৎ আমার হস্তে প্রাণত্যাগ করিয়া আমার পথ ছাড়িয়া যাও।”
এই বলিয়া ওসমান জগৎসিংহকে প্রত্যুত্তরের অবকাশ দিলেন না, অসিহস্তে তৎপ্রতি আক্রমণ করিলেন। রাজপুত্র অগত্যা আত্মরক্ষার্থ শীঘ্রহস্তে কোষ হইতে অসি বাহির করিয়া ওসমানের আঘাতের প্রতিঘাত করিতে লাগিলেন। ওসমান রাজপুত্রের প্রাণনাশে পুন: পুন: বিষমোদ্যম করিতে লাগিলেন; রাজপুত্র ভ্রমক্রমেও ওসমানকে আঘাতের চেষ্টা করিলেন না; কেবল আত্মরক্ষায় নিযুক্ত রহিলেন। উভয়েই শস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত, বহুক্ষণ যুদ্ধ হইলে, কেহ কাহাকেও পরাজিত করিতে পারিলেন না। ফলত: যবনের অস্ত্রাঘাতে রাজপুত্রের শরীর ক্ষতবিক্ষত হইল; রুধিরে অঙ্গ প্লাবিত হইল; ওসমান প্রতি তিনি একবারও আঘাত করেন নাই, সুতরাং ওসমান অক্ষত। রক্তস্রাবে শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল দেখিয়া আর এরূপ সংগ্রামে মৃত্যু নিশ্চয় জানিয়া জগৎসিংহ কাতরস্বরে কহিলেন, “ওসমান, ক্ষান্ত হও, আমি পরাভব স্বীকার করিলাম।”
ওসমান উচ্চ হাস্য করিয়া কহিলেন, “এ ত জানিতাম না যে রাজপুত্র সেনাপতি মরিতে ভয় পায়; যুদ্ধ কর, আমি তোমায় বধ করিব, ক্ষমা করিব না। তুমি জীবিতে আয়েষাকে পাইব না।”
রাজপুত্র কহিলেন, “আমি আয়েষার অভিলাষী নহি।”
ওসমান অসি ঘূর্ণিত করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, “তুমি আয়েষার অভিলাষী নও, আয়েষা তোমার অভিলাষী। যুদ্ধ কর, ক্ষমা নাই।”
রাজপুত্র অসি দূরে নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না। তুমি অসময়ে আমার উপকার করিয়াছ; আমি তোমার সহিত যুদ্ধ করিব না।”
ওসমান সক্রোধে রাজপুত্রকে পদাঘাত করিলেন, কহিলেন, “যে সিপাহী যুদ্ধ করিতে ভয় পায়, তাহাকে এইরূপে যুদ্ধ করাই।”
রাজকুমারের আর ধৈর্য রহিল না। শীঘ্রহস্তে ত্যক্ত প্রহরণ ভূমি হইতে উত্তোলন করিয়া শৃগালদংশিত সিংহবৎ প্রচণ্ড লম্ফ দিয়া রাজপুত্র যবনকে আক্রমণ করিলেন। সে দুর্দম প্রহার যবন সহ্য করিতে পারিলেন না। রাজপুত্রের বিশাল শরীরাঘাতে ওসমান ভূমিশায়ী হইলেন। রাজপুত্র তাঁহার বক্ষোপরি আরোহণ করিয়া হস্ত হইতে অসি উন্মোচন করিয়া লইলেন, এবং নিজ করস্থ প্রহরণ তাঁহার গলদেশে স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “কেমন, সমর-সাধ মিটিয়াছে ত?”
ওসমান কহিলেন, “জীবন থাকিতে নহে।”
রাজপুত্র কহিলেন, “এখনই ত জীবন শেষ করিতে পারি?”
ওসমান কহিলেন, “কর, নচেৎ তোমার বধাভিলাষী শত্রু জীবিত থাকিবে।”
জগৎসিংহ কহিলেন, “থাকুক, রাজপুত তাহাতে ডরে না; তোমার জীবন শেষ করিতাম, কিন্তু তুমি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিলে, আমিও করিলাম।”
এই বলিয়া দুই চরণের সহিত ওসমানের দুই হস্ত বদ্ধ রাখিয়া, একে একে তাঁহার সকল অস্ত্র শরীর হইতে হরণ করিলেন। তখন তাঁহাকে মুক্ত করিয়া কহিলেন, “এক্ষণে নির্বিঘ্নে গৃহে যাও, তুমি যবন হইয়া রাজপুতের শরীরে পদাঘাত করিয়াছিলে, এই জন্য তোমার এ দশা করিলাম, নচেৎ রাজপুতেরা এত কৃতঘ্ন নহে যে, উপকারীর অঙ্গ স্পর্শ করে।”
ওসমান মুক্ত হইলে আর একটি কথা না কহিয়া অশ্বারোহণ পূর্বক একেবারে দুর্গাভিমুখে দ্রুতগমনে চলিলেন।
রাজপুত্র বস্ত্র দ্বারা প্রাঙ্গণস্থ কূপ হইতে জল আহরণ করিয়া গাত্র ধৌত করিলেন। গাত্র ধৌত করিয়া শালতরু হইতে অশ্ব মোচনপূর্বক আরোহণ করিলেন। অশ্বারোহণ করিয়া দেখেন, অশ্বের বল্গায়, লতা গুল্মাদির দ্বারা একখানি লিপি বাঁধা রহিয়াছে। বল্গা হইতে পত্র মোচন করিয়া দেখিলেন যে, পত্রখানি মনুষ্যের কেশ দ্বারা বন্ধ করা আছে, তাহার উপরিভাগে লেখা আছে যে, “এই পত্র দুই দিবস মধ্যে খুলিবেন না, যদি খুলেন, তবে ইহার উদ্দেশ্য বিফল হইবে।”
রাজপুত্র ক্ষণেক চিন্তা করিয়া লেখকের অভিপ্রায়ানুসারে কার্য করাই স্থির করিলেন। পত্র কবচ মধ্যে রাখিয়া অশ্বে কশাঘাত করিয়া শিবিরাভিমুখে চলিলেন।
রাজপুত্র শিবিরে উপনীত হইবার পরদিন দ্বিতীয় এক লিপি দূতহস্তে পাইলেন। এই লিপি আয়েষার প্রেরিত। কিন্তু তদ্বৃতত্তান্ত পর-পরিচ্ছেদে বক্তব্য।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : আয়েষার পত্র
আয়েষা লেখনী হস্তে পত্র লিখিতে বসিয়াছেন। মুখকান্তি গম্ভীর, স্থির; জগৎসিংহকে পত্র লিখিতেছেন। একখানা কাগজ লইয়া পত্র আরম্ভ করিলেন। প্রথমে লিখিলেন, “প্রাণাধিক,” তখনই প্রাণাধিক শব্দ কাটিয়া দিয়া লিখিলেন, “রাজকুমার,” “প্রাণাধিক” শব্দ কাটিয়া “রাজকুমার” লিখিতে আয়েষার অশ্রুধারা বিগলিত হইয়া পত্রে পড়িল। আয়েষা অমনি সে পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। পুনর্বার অন্য কাগজে আরম্ভ করিলেন; কিন্তু কয়েক ছত্র লেখা হইতে না হইতেই আবার পত্র অশ্রুকলঙ্কিত হইল। আয়েষা সে লিপিও বিনষ্ট করিলেন। অন্য বারে অশ্রুচিহ্নশূন্য একখণ্ড লিপি সমাধা করিলেন। সমাধা করিয়া একবার পড়িতে লাগিলেন, পড়িতে নয়নবাষ্পে দৃষ্টিলোপ হইতে লাগিল। কোন মতে লিপি বদ্ধ করিয়া দূতহস্তে দিলেন। লিপি লইয়া দূত রাজপুত-শিবিবাভিমুখে যাত্রা করিল। আয়েষা একাকিনী পালঙ্ক-শয়নে রোদন করিতে লাগিলেন।
জগৎসিংহ পত্র পাইয়া পড়িতে লাগিলেন।
“রাজকুমার!
আমি যে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করি নাই, সে আত্মধৈর্যের প্রতি অবিশ্বাসিনী বলিয়া নহে। মনে করিও না আয়েষা অধীরা। ওসমান নিজ হৃদয় মধ্যে অগ্নি জ্বালিত করিয়াছে, কি জানি আমি তোমার সাক্ষাৎলাভ করিলে, যদি সে ক্লেশ পায়, এই জন্যই তোমার সহিত সাক্ষাৎ করি নাই। সাক্ষাৎ না হইলে তুমি যে ক্লেশ পাইবে, সে ভরসাও করি নাই। নিজের ক্লেশ–সে সকল সুখ দু:খ জগদীশ্বরচরণে সমর্পণ করিয়াছি। তোমাকে যদি সাক্ষাতে বিদায় দিতে হইত, তবে সে ক্লেশ অনায়াসে সহ্য করিতাম। তোমার সহিত যে সাক্ষাৎ হইল না, এ ক্লেশও পাষাণীর ন্যায় সহ্য করিতেছি।
তবে এ পত্র লিখি কেন? এক ভিক্ষা আছে, সেইজন্যই এ পত্র লিখিলাম। যদি শুনিয়া থাক যে, আমি তোমাকে স্নেহ করি, তবে তাহা বিস্মৃত হও। এ দেহ বর্তমানে এ কথা প্রকাশ করিব না সঙ্কল্প ছিল, বিধাতার ইচ্ছায় প্রকাশ হইয়াছে, এক্ষণে বিস্মৃত হও।
আমি তোমার প্রেমাঙ্ক্ষিণী নহি। আমার যাহা দিবার তাহা দিয়াছি, তোমার নিকট প্রতিদান কিছু চাহি না। আমার স্নেহ এমন বদ্ধমূল যে, তুমি স্নেহ না করিলেও আমি সুখী; কিন্তু সে কথায় আর কাজ কি!
তোমাকে অসুখী দেখিয়াছিলাম। যদি কখন সুখী হও, আয়েষাকে স্মরণ করিয়া সংবাদ দিও। ইচ্ছা না হয়, সংবাদ দিও না। যদি কখন অন্ত:করণে ক্লেশ পাও, তবে আয়েষাকে কি স্মরণ করিবে?
আমি যে তোমাকে পত্র লিখিলাম, কি যদি ভবিষ্যতে লিখি, তাহাতে লোকে নিন্দা করিবে। আমি নির্দোষী, সুতরাং তাহাতে ক্ষতি বিবেচনা করিও না–যখন ইচ্ছা হইবে, পত্র লিখিও।
তুমি চলিলে, আপাতত: এ দেশ ত্যাগ করিয়া চলিলে। এই পাঠানেরা শান্ত নহে। সুতরাং পুনর্বার তোমার এ দেশে আসাই সম্ভব। কিন্তু আমার সহিত আর সন্দর্শন হইবে না। পুন: পুন: হৃদয় মধ্যে চিন্তা করিয়া ইহা স্থির করিয়াছি। রমণীহৃদয় যেরূপ দুর্দমনীয়, তাহাতে অধিক সাহস অনুচিত।
আর একবার মাত্র তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব মানস আছে। যদি তুমি এ প্রদেশে বিবাহ কর, তবে আমায় সংবাদ দিও; আমি তোমার বিবাহকালে উপস্থিত থাকিয়া তোমার বিবাহ দিব। যিনি তোমার মহিষী হইবেন, তাঁহার জন্য কিছু সামান্য অলঙ্কার সংগ্রহ করিয়া রাখিলাম, যদি সময় পাই, স্বহস্তে পরাইয়া দিব।
আর এক প্রার্থনা। যখন আয়েষার মৃত্যুসংবাদ তোমার নিকট যাইবে, তখন একবার এ দেশে আসিও, তোমার নিমিত্ত সিন্দুকমধ্যে যাহা রহিল, তাহা আমার অনুরোধে গ্রহণ করিও।
আর কি লিখিব? অনেক কথা লিখিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু নিষ্প্রয়োজন। জগদীশ্বর তোমাকে সুখী করিবেন, আয়েষার কথা মনে করিয়া কখনও দু:খিত হইও না।”
জগৎসিংহ পত্র পাঠ করিয়া বহুক্ষণ তাম্বুমধ্যে পত্রহস্তে পদচারণ করিতে লাগিলেন। পরে অকস্মাৎ শীঘ্রহস্তে একখানা কাগজ লইয়া নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়া দূতের হস্তে দিলেন।
“আয়েষা, তুমি রমণীরত্ন। জগতে মন:পীড়াই বুঝি বিধাতার ইচ্ছা! আমি তোমার কোন প্রত্যুত্তর লিখিতে পারিলাম না। তোমার পত্রে আমি অত্যন্ত কাতর হইয়াছি। এ পত্রের যে উত্তর, তাহা এক্ষণে দিতে পারিলাম না। আমাকে ভুলিও না। যদি বাঁচিয়া থাকি, তবে এক বৎসর পরে ইহার উত্তর দিব।”
দূত এই প্রত্যুত্তর লইয়া আয়েষার নিকট প্রতিগমন করিল।
বিংশ পরিচ্ছেদ : দীপ নির্বাণোন্মুখ
যে পর্যন্ত তিলোত্তমা আশমানির সঙ্গে আয়েষার নিকট হইতে বিদায় লইয়া আসিয়াছিলেন, সেই পর্যন্ত আর কেহ তাঁহার কোন সংবাদ পায় নাই। তিলোত্তমা, বিমলা, আশমানি, অভিরাম স্বামী, কাহারও কোন উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই। যখন মোগলপাঠানে সন্ধিসম্বন্ধ হইল, তখন বীরেন্দ্রসিংহ আর তৎপরিজনের অশ্রুতপূর্ব দুর্ঘটনা সকল স্মরণ করিয়া উভয় পক্ষই সম্মত হইলেন যে, বীরেন্দ্রের স্ত্রী কন্যার অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে গড় মান্দারণে পুনরবস্থাপিত করা যাইবে। সেই কারণেই, ওসমান খ্বাজা ইসা, মানসিংহ প্রভৃতি সকলেই তাহাদিগকে বিশেষ অনুসন্ধান করিলেন; কিন্তু তিলোত্তমার আশমানির সঙ্গে আয়েষার নিকট হইতে আসা ব্যতীত আর কিছুই কেহ অবগত হইতে পারিলেন না। পরিশেষে মানসিংহ নিরাশ হইয়া একজন বিশ্বাসী অনুচরকে গড় মান্দারণে স্থাপন করিয়া এই আদেশ করিলেন যে, “তুমি এইখানে থাকিয়া মৃত জায়গীরদারের স্ত্রীকন্যার উদ্দেশ করিতে থাক; সন্ধান পাইলে তাহাদিগকে দুর্গে স্থাপনা করিয়া আমার নিকট যাইবে, আমি তোমাকে পুরস্কৃত করিব, এবং অন্য জায়গীর দিব।”
এইরূপ স্থির করিয়া মানসিংহ পাটনায় গমনোদ্যোগী হইলেন।
মৃত্যুকালে কতলু খাঁর মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তচ্ছ্রবণে জগৎসিংহের হৃদয়মধ্যে কোন ভাবান্তর জন্মিয়াছিল কি না, তাহা কিছুই প্রকাশ পাইল না। জগৎসিংহ অর্থব্যয় এবং শারীরিক ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে যত্ন কেবল পূর্ব সম্বন্ধের স্মৃতিজনিত, কি যে যে অপরাপর কারণে মানসিংহ প্রভৃতি সেইরূপ যত্ন প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই কারণসম্ভূত, কি পুন:সঞ্চারিত প্রেমানুরোধে উৎপন্ন, তাহা কেহই বুঝিতে পারে নাই। যত্ন যে কারণেই হইয়া থাকুক, বিফল হইল।
মানসিংহের সেনাসকল শিবির ভঙ্গ করিতে লাগিল, পরদিন প্রভাতে “কুচ” করিবে। যাত্রার পূর্ব দিবস অশ্ববল্গায় প্রাপ্ত লিপি পড়িবার সময় উপনীত হইল। রাজপুত্র কৌতূহলী হইয়া লিপি খুলিয়া পাঠ করিলেন। তাহাতে কেবল এইমাত্র লেখা আছে :
“যদি ধর্মভয় থাকে, যদি ব্রহ্মশাপের ভয় থাকে, তবে পত্র পাঠমাত্র এই স্থানে একা আসিবে। ইতি
অহং ব্রাহ্মণ:।”
রাজপুত্র লিপি পাঠে চমৎকৃত হইলেন। একবার মনে করিলেন, কোন শত্রুর চাতুরীও হইতে পারে, যাওয়া উচিত কি? রাজপুতহৃদয়ে ব্রহ্মশাপের ভয় ভিন্ন অন্য ভয় প্রবল নহে; সুতরাং যাওয়াই স্থির হইল। অতএব নিজ অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন যে, যদি তিনি সৈন্যযাত্রার মধ্যে না আসিতে পারেন, তবে তাহারা তাঁহার প্রতীক্ষায় থাকিবে না; সৈন্য অগ্রগামী হয়, হানি নাই, পশ্চাৎ বর্ধমানে কি রাজমহলে তিনি মিলিত হইতে পারিবেন। এইরূপ আদেশ করিয়া জগৎসিংহ একাকী শাল-বন অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
পূর্বকথিত ভগ্নাট্টালিকা-দ্বারে উপস্থিত হইয়া রাজপুত্র পূর্ববৎ শালবৃক্ষে অশ্ব বন্ধন করিলেন। ইতস্তত: দেখিলেন, কেহ কোথাও নাই। পরে অট্টালিকা মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখেন, প্রাঙ্গণে পূর্ববৎ এক পার্শ্বে সমাধিমন্দির, এক পার্শ্বে চিতাসজ্জা রহিয়াছে; চিতাকাষ্ঠের উপর একজন ব্রাহ্মণই বসিয়া আছেন। ব্রাহ্মণ অধোমুখে বসিয়া রোদন করিতেছেন।
রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনি আমাকে এখানে আসিতে আজ্ঞা করিয়াছেন?”
ব্রাহ্মণ মুখ তুলিলেন; রাজপুত্র জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিলেন, ইনি অভিরাম স্বামী।
রাজপুত্রের মনে একেবারে বিস্ময়, কৌতূহল, আহ্লাদ, এই তিনেরই আবির্ভাব হইল; প্রণাম করিয়া ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “দর্শন জন্য যে কত উদ্যোগ পাইয়াছি, কি বলিব। এখানে অবস্থিতি কেন?
অভিরাম স্বামী চক্ষু মুছিয়া কহিলেন, “আপাতত: এইখানেই বাস!”
স্বামীর উত্তর শুনিতে না শুনিতেই রাজপুত্র প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। “আমাকে স্মরণ করিয়াছেন কি জন্য? রোদনই বা কেন?”
অভিরাম স্বামী কহিলেন, “যে কারণে রোদন করিতেছি, সেই কারণেই তোমাকে ডাকিয়াছি; তিলোত্তমার মৃত্যুকাল উপস্থিত।”
ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, তিল তিল করিয়া, যোদ্ধৃপতি সেইখানে ভূতলে বসিয়া পড়িলেন। তখন আদ্যোপান্ত সকল কথা একে একে মনে পড়িতে লাগিল; একে একে অন্ত:করণ মধ্যে দারুণ তীক্ষ্ণ ছুরিকাঘাত হইতে লাগিল। দেবালয়ে প্রথম সন্দর্শন, শৈলেশ্বর-সাক্ষাৎ প্রতিজ্ঞা, কক্ষমধ্যে প্রথম পরিচয়ে উভয়ের প্রেমোত্থিত অশ্রুজল, সেই কাল-রাত্রির ঘটনা, তিলোত্তমার মূর্ছাবস্থার মুখ, যবনাগারে তিলোত্তমার পীড়ন, কারাগার মধ্যে নিজ নির্দয় ব্যবহার, পরে এক্ষণকার এই বনবাসে মৃত্যু, এই সকল একে একে রাজকুমারের হৃদয়ে আসিয়া ঝটিকা-প্রঘাতবৎ লাগিতে লাগিল। পূর্ব হুতাশন শতগুণ প্রচণ্ড জ্বালার সহিত জ্বলিয়া উঠিল।
রাজপুত্র অনেকক্ষণ মৌন হইয়া বসিয়া রহিলেন। অভিরাম স্বামী বলিতে লাগিলেন, “যে দিন বিমলা যবন-বধ করিয়া বৈধব্যের প্রতিশোধ করিয়াছিল, সেই দিন অবধি আমি কন্যা দৌহিত্রী লইয়া যবন-ভয়ে নানা স্থানে অজ্ঞাতে ভ্রমণ করিতেছিলাম, সেই দিন অবধি তিলোত্তমার রোগের সঞ্চার। যে কারণে রোগের সঞ্চার, তাহা তুমি বিশেষ অবগত আছ।”
জগৎসিংহের হৃদয়ে শেল বিঁধিল।
“সে অবধি তাহাকে নানা স্থানে রাখিয়া নানা চিকিৎসা করিয়াছি, নিজে যৌবনাবধি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি, অনেক রোগের চিকিৎসা করিয়াছি; অন্যের অজ্ঞাত অনেক ঔষধ জানি। কিন্তু যে রোগ হৃদয়মধ্যে, চিকিৎসায় তাহার প্রতীকার নাই। এই স্থান অতি নির্জন বলিয়া ইহারই মধ্যে এক নিভৃত অংশে আজ পাঁচ সাত দিন বসতি করিতেছি। দৈবযোগে তুমি এখানে আসিয়াছ দেখিয়া তোমার অশ্ববল্গায় পত্র বাঁধিয়া দিয়াছিলাম। পূর্বাবধি অভিলাষ ছিল যে, তিলোত্তমাকে রক্ষা করিতে না পারিলে, তোমার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করাইয়া অন্তিম কালে তাহার অন্ত:করণকে তৃপ্ত করিব। সেইজন্যই তোমাকে আসিতে লিখিয়াছি। তখনও তিলোত্তমার আরোগ্যের ভরসা দূর হয় নাই; কিন্তু বুঝিয়াছিলাম যে, দুই দিন মধ্যে কিছু উপশম না হইলে চরম কাল উপস্থিত হইবে। এই জন্য দুই দিন পরে পত্র পড়িবার পরামর্শ দিয়াছিলাম। এক্ষণে যে ভয় করিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। তিলোত্তমার জীবনের কোন আশা নাই। জীবনদীপ নির্বাণোন্মুখ হইয়াছে।”
এই বলিয়া অভিরাম স্বামী পুনর্বার রোদন করিতে লাগিলেন। জগৎসিংহও রোদন করিতেছিলেন।
স্বামী পুনশ্চ কহিলেন, “অকস্মাৎ তোমার তিলোত্তমা সন্নিধানে যাওয়া হইবেক না; কি জানি, যদি এ অবস্থায় উল্লাসের আধিক্য সহ্য না হয়। আমি পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছি যে, তোমাকে আসিতে সংবাদ দিয়াছি, তোমার আসার সম্ভাবনা আছে। এই ক্ষণে আসার সংবাদ দিয়া আসি, পশ্চাৎ সাক্ষাৎ করিও।”
এই বলিয়া পরমহংস, যে দিকে ভগ্নাট্টালিকার অন্ত:পুর, সেই দিকে গমন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়া রাজপুত্রকে কহিলেন, “আইস।”
রাজপুত্র পরমহংসের সঙ্গে অন্ত:পুরাভিমুখে গমন করিলেন। দেখিলেন, একটি কক্ষ অভগ্ন আছে, তন্মধ্যে জীর্ণ ভগ্ন পালঙ্ক, তদুপরি ব্যাধিক্ষীণা, অথচ অনতিবিলুপ্তরূপরাশি তিলোত্তমা শয়নে রহিয়াছে; এ সময়েও পূর্বলাবণ্যের মৃদুলতর-প্রভাবপরিবেষ্টিত রহিয়াছে; -নির্বাণোন্মুখ প্রভাততারার ন্যায় মনোমোহিনী হইয়া রহিয়াছে। নিকটে একটি বিধবা বসিয়া অঙ্গে হস্তমার্জন করিতেছে; সে নিরাভরণা, মলিনা, দীনা বিমলা। রাজকুমার তাহাকে প্রথমে চিনিতে পারিলেন না, কিসেই বা চিনিবে, যে স্থিরযৌবনা ছিল, সে এক্ষণে প্রাচীনা হইয়াছে।
যখন রাজপুত্র আসিয়া তিলোত্তমার শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইলেন, তখন তিলোত্তমা নয়ন মুদ্রিত করিয়া ছিলেন। অভিরাম স্বামী ডাকিয়া কহিলেন, “তিলোত্তমে! রাজকুমার জগৎসিংহ আসিয়াছেন।”
তিলোত্তমা নয়ন উন্মীলিত করিয়া জগৎসিংহের প্রতি চাহিলেন; সে দৃষ্টি কোমল, কেবল স্নেহব্যঞ্জক; তিরস্কারণাভিলাষের চিহ্নমাত্র বর্জিত। তিলোত্তমা চাহিবামাত্র দৃষ্টি বিনত করিলেন; দেখিতে দেখিতে লোচনে দর দর ধারা বহিতে লাগিল। রাজকুমার আর থাকিতে পারিলেন না; লজ্জা দূরে গেল; তিলোত্তমার পদপ্রান্তে বসিয়া নীরবে নয়নাসারে তাঁহার দেহলতা সিক্ত করিলেন।
একবিংশ পরিচ্ছেদ : সফলে নিষ্ফল স্বপ্ন
পিতৃহীনা অনাথিনী, রুগ্না শয্যায়; -জগৎসিংহ তাঁহার শয্যাপার্শ্বে। দিন যায়, রাত্রি যায়, আর বার দিন আসে; আর বার দিন যায়, রাত্রি আসে। রাজপুত-কুল-গৌরব তাহার ভগ্ন পালঙ্কের পাশে বসিয়া শুশ্রূষা করিতেছেন; সেই দীনা, শব্দহীনা বিধবার অবিরল কার্যের সাহায্য করিতেছেন। আধিক্ষীণা দু:খিনী তাঁহার পানে চাহে কি না–তার শিশিরনিপীড়িত পদ্মমুখে পূর্বকালের সে হাসি আসে কি না, তাহাই দেখিবার আকাঙ্ক্ষায় তাহার মুখপানে চাহিয়া আছেন।
কোথায় শিবির? কোথায় সেনা?–শিবির ভঙ্গ করিয়া সেনা পাটনায় চলিয়া গিয়াছে! কোথায় অনুচর সব? দারুকেশ্বর-তীরে প্রভুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। কোথায় প্রভু? প্রবলাতপ-বিশোষিত সুকুমার কুসুম-কলিকায় নয়নবারি সেচনে পুনরুৎফুল্ল করিতেছেন।
কুসুম-কলিকা ক্রমে পুনরুৎফুল্ল হইতে লাগিল। এ সংসারের প্রধান ঐন্দ্রজালিক স্নেহ! ব্যাধি-প্রতিকারে প্রধান ঔষধ প্রণয়। নহিলে হৃদয়-ব্যাধি কে উপশম করিতে পারে?
যেমন নির্বাণোন্মুখ দীপ বিন্দু বিন্দু তৈলসঞ্চারে ধীরে ধীরে আবার হাসিয়া উঠে, যেমন নিদাঘশুষ্ক বল্লরী আষাঢ়ের নববারি সিঞ্চনে ধীরে ধীরে পুনর্বার বিকশিত হয়; জগৎসিংহকে পাইয়া তিলোত্তমা তদ্রূপ দিনে দিনে পুনর্জীবন পাইতে লাগিলেন।
ক্রমে সবলা হইয়া পালঙ্কোপরি বসিতে পারিলেন। বিমলার অবর্তমানে দুজনে কাছে কাছে বসিয়া অনেক দিনের মনের কথা সকল বলিতে পারিলেন। কত কথা বলিলেন, মানসকৃত কত অপরাধ স্বীকার করিলেন, কত অন্যায় ভরসা মনোমধ্যে উদয় হইয়া মনোমধ্যেই নিবৃত্ত হইয়াছিল, তাহা বলিলেন; জাগরণে কি নিদ্রায় কত মনোমোহন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহা বলিলেন। রুগ্নশয্যায় শয়নে অচেতনে যে এক স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, একদিন তাহা বলিলেন–
যেন নববসন্তের শোভাপরিপূর্ণ এক ক্ষুদ্র পর্বতোপরি তিনি জগৎসিংহের সহিত পুষ্পক্রীড়া করিতেছিলেন; স্তূপে স্তূপে বসন্তকুসুম চয়ন করিয়া মালা গাঁথিলেন, আপনি এক মালা কণ্ঠে পরিলেন, আর এক মালা জগৎসিংহের কণ্ঠে দিলেন; জগৎসিংহের কটিস্থ অসিস্পর্শে মালা ছিঁড়িয়া গেল। “আর তোমার কণ্ঠে মালা দিব না, চরণে নিগড় দিয়া বাঁধিব” এই বলিয়া যেন কুসুমের নিগড় রচনা করিলেন। নিগড় পরাইতে গেলেন, জগৎসিংহ অমনই সরিয়া গেলেন। তিলোত্তমা পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন; জগৎসিংহ বেগে পর্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন; পথে এক ক্ষীণা নির্ঝরিণী ছিল, জগৎসিংহ লম্ফ দিয়া পার হইলেন; তিলোত্তমা স্ত্রীলোক–লম্ফে পার হইতে পারিলেন না, যেখানে নির্ঝরিণী সঙ্কীর্ণা হইয়াছে, সেইখানে পার হইবেন, এই আশায়, নির্ঝরিণীর ধারে ধারে ছুটিয়া পর্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন! নির্ঝরিণী সঙ্কীর্ণা হওয়া দূরে থাকুক, যত যান, তত আয়তনে বাড়ে; নির্ঝরিণী ক্রমে ক্ষুদ্র নদী হইল; ক্ষুদ্র নদী ক্রমে বড় নদী হইল; আর জগৎসিংহকে দেখা যায় না; তীর অতি উচ্চ, অতি বন্ধুর, আর পাদচালন হয় না; তাহাতে আবার তিলোত্তমার চরণ-তলস্থ উপকূলের মৃত্তিকা খণ্ডে খণ্ডে খসিয়া গম্ভীর নাদে জলে পড়িতে লাগিল, নীচে প্রচণ্ড ঘূর্ণিত জলাবর্ত, দেখিতে সাহস হয় না। তিলোত্তমা পর্বতে পুনরারোহণ করিয়া নদীগ্রাস হইতে পলাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন; পথ বন্ধুর, চরণ চলে না; তিলোত্তমা উচ্চৈ:স্বরে কাঁদিতে লাগিলেন; অকস্মাৎ কালমূর্তি কতলু খাঁ পুনরুজ্জীবিত হইয়া তাঁহার পথরোধ করিল; কণ্ঠের পুষ্পমালা অমনই গুরুভার লৌহশৃঙ্খল হইল; কুসুমনিগড় হস্তচ্যুত হইয়া আত্মচরণে পড়িল; সে নিগড় অমনি লৌহনিগড় হইয়া বেড়িল; অকস্মাৎ অঙ্গ স্তম্ভিত হইল; তখন কতলু খাঁর তাঁহার গলদেশ ধরিয়া ঘূর্ণিত করিয়া নদী-তরঙ্গ-প্রবাহমধ্যে নিক্ষেপ করিল।
স্বপ্নের কথা সমাপন করিয়া তিলোত্তমা সজলচক্ষে কহিলেন, “যুবরাজ, আমার এ শুধু স্বপ্ন নহে; তোমার জন্য যে কুসুমনিগড় রচিয়াছিলাম, বুঝি তাহা সত্যই আত্মচরণে লৌহনিগড় হইয়া ধরিয়াছে। যে কুসুমমালা পরাইয়াছিলাম, তাহা অসির আঘাতে ছিঁড়িয়াছে।”
যুবরাজ তখন হাস্য করিয়া কটিস্থিত অসি তিলোত্তমার পদতলে রাখিলেন; কহিলেন, “তিলোত্তমা, তোমার সম্মুখে এই অসিশূন্য হইলাম, আবার মালা দিয়া দেখ, অসি তোমার সম্মুখে দ্বিখণ্ড করিয়া ভাঙ্গিতেছি।”
তিলোত্তমাকে নিরুত্তর দেখিয়া, রাজকুমার কহিলেন, “তিলোত্তমা, আমি কেবল রহস্য করিতেছি না।”
তিলোত্তমা লজ্জায় অধোমুখী হইয়া রহিলেন।
সেই দিন প্রদোষকালে অভিরাম স্বামী কক্ষান্তরে প্রদীপের আলোকে বসিয়া পুতি পড়িতেছিলেন; রাজপুত্র তথায় গিয়া সবিনয়ে কহিলেন, “মহাশয়, আমার এক নিবেদন, তিলোত্তমা এক্ষণে স্থানান্তর গমনের কষ্ট সহ্য করিতে পারিবেন, অতএব আর এ ভগ্ন গৃহে কষ্ট পাইবার প্রয়োজন কি? কাল যদি মন্দ দিন না হয়, তবে গড় মান্দারণে লইয়া চলুন। আর যদি আপনার অনভিমত না হয়, তবে অম্বরের বংশে দৌহিত্রী সম্প্রদান করিয়া আমাকে কৃতার্থ করুন।”
অভিরাম স্বামী পুতি ফেলিয়া উঠিয়া রাজপুত্রকে গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন, পুতির উপর যে পা দিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা জ্ঞান নাই।
যখন রাজপুত্র স্বামীর নিকট আইসেন, তখন ভাব বুঝিয়া বিমলা আর আশমানি শনৈ: শনৈ: রাজপুত্রের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছিলেন; বাহিরে থাকিয়া সকল শুনিয়াছিলেন। রাজপুত্র বাহিরে আসিয়া দেখেন যে, বিমলার অকস্মাৎ পূর্বভাবপ্রাপ্তি; অনবরত হাসিতেছেন, আর আশমানির চুল ছিঁড়িতেছেন ও কিল মারিতেছেন; আশমানি মারপিট তৃণজ্ঞান করিয়া বিমলার নিকট নৃত্যের পরীক্ষা দিতেছে। রাজকুমার এক পাশ দিয়া সরিয়া গেলেন।
দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ : সমাপ্তি
ফুল ফুটিল। অভিরাম স্বামী গড় মান্দারণে গমন করিয়া মহাসমারোহের সহিত দৌহিত্রীকে জগৎসিংহের পাণিগৃহীত্রী করিলেন।
উৎসবাদির জন্য জগৎসিংহ নিজ সহচরবর্গকে জাহানাবাদ হইতে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়াছিলেন। তিলোত্তমার পিতৃবন্ধুও অনেকে আহ্বানপ্রাপ্ত হইয়া আনন্দকার্যে আসিয়া আমোদ আহ্লাদ করিলেন।
আয়েষার প্রার্থনামতে জগৎসিংহ তাঁহাকেও সংবাদ করিয়াছিলেন। আয়েষা নিজ কিশোরবয়স্ক সহোদরকে সঙ্গে লইয়া এবং আর আর পৌরবর্গে বেষ্টিত হইয়া আসিয়াছিলেন।
আয়েষা যবনী হইয়াও তিলোত্তমা আর জগৎসিংহের অধিক স্নেহবশত: সহচরীবর্গের সহিত দুর্গান্ত:পুরবাসিনী হইলেন। পাঠক মনে করিতে পারেন যে, আয়েষা তাপিতহৃদয়ে বিবাহের উৎসবে উৎসব করিতে পারেন নাই। বস্তুত: তাহা নহে। আয়েষা নিজ সহর্ষ চিত্তের প্রফুল্লতায় সকলকেই প্রফুল্ল করিতে লাগিলেন; প্রস্ফুট শারদ সরসীরুহের মন্দান্দোলন স্বরূপ সেই মৃদুমধুর হাসিতে সর্বত্র শ্রীসম্পাদন করিতে লাগিলেন।
বিবাহকার্য নিশীথে সমাপ্ত হইল। আয়েষা তখন সহচরগণ সহিত প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিলেন; হাসিয়া বিমলার নিকট বিদায় লইলেন। বিমলা কিছুই জানেন না, হাসিয়া কহিলেন, “নবাবজাদী! আবার আপনার শুভকার্যে আমরা নিমন্ত্রিত হইব।”
বিমলার নিকট হইতে আসিয়া আয়েষা তিলোত্তমাকে ডাকিয়া এক নিভৃত কক্ষে আনিলেন। তিলোত্তমার কর ধারণ করিয়া কহিলেন, “ভগিনি! আমি চলিলাম। কায়মনোবাক্যে আশীর্বাদ করিয়া যাইতেছি, তুমি অক্ষয় সুখে কালযাপন কর।”
তিলোত্তমা কহিলেন, “আবার কত দিনে আপনার সাক্ষাৎ পাইব?”
আয়েষা কহিলেন, “সাক্ষাতের ভরসা কিরূপে করিব?” তিলোত্তমা বিষণ্ণ হইলেন। উভয়ে নীরব হইয়া রহিলেন।
ক্ষণকাল পরে আয়েষা কহিলেন, “সাক্ষাৎ হউক বা না হউক, তুমি আয়েষাকে ভুলিয়া যাইবে না?”
তিলোত্তমা হাসিয়া কহিলেন, “আয়েষাকে ভুলিলে যুবরাজ আমার মুখ দেখিবেন না।”
আয়েষা গাম্ভীর্যসহকারে কহিলেন, “এ কথায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম না। তুমি আমার কথা কখন যুবরাজের নিকট তুলিও না। এ কথা অঙ্গীকার কর।”
আয়েষা বুঝিয়াছিলেন যে, জগৎসিংহের জন্য আয়েষা যে এ জন্মের সুখে জলাঞ্জলি দিয়াছেন, এ কথা জগৎসিংহের হৃদয়ে শেলস্বরূপ বিদ্ধ রহিয়াছে। আয়েষার প্রসঙ্গমাত্রও তাঁহার অনুতাপকর হইতে পারে।
তিলোত্তমা অঙ্গীকার করিলেন। আয়েষা কহিলেন, “অথচ বিস্মৃতও হইও না, স্মরণার্থ যে চিহ্ন দিই, তাহা ত্যাগ করিও না।”
এই বলিয়া আয়েষা দাসীকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন। আজ্ঞামত দাসী গজদন্তনির্মিত পাত্রমধ্যস্থ রত্নালঙ্কার আনিয়া দিল। আয়েষা দাসীকে বিদায় দিয়া সেই সকল অলঙ্কার স্বহস্তে তিলোত্তমার অঙ্গে পরাইতে লাগিলেন।
তিলোত্তমা ধনাঢ্য ভূস্বামিকন্যা, তথাপি সে অলঙ্কাররাশির অদ্ভুত শিল্পরচনা এবং তন্মধ্যবর্তী বহুমূল্য হীরকাদি রত্নরাজির অসাধারণ তীব্র দীপ্তি দেখিয়া চমৎকৃতা হইলেন। বস্তুত: আয়েষা পিতৃদত্ত নিজ অঙ্গভূষণরাশি নষ্ট করিয়া তিলোত্তমার জন্য অন্যজনদুর্লভ এই সকল রত্নভূষা প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তিলোত্তমা তত্তাবতের গৌরব করিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন, “ভগিনি, এ সকলের প্রশংসা করিও না। তুমি আজ যে রত্ন হৃদয়ে ধারণ করিলে, এ সকল তাঁহার চরণরেণুর তুল্য নহে।” এই কথা বলিতে বলিতে আয়েষা কত ক্লেশে যে চক্ষুর জল সংবরণ করিলেন, তিলোত্তমা তাহা কিছুই জানিতে পারিলেন না।
অলঙ্কারসন্নিবেশ সমাধা হইলে, আয়েষা তিলোত্তমার দুইটি হস্ত ধরিয়া তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “এ সরল প্রেমপ্রতিম মুখ দেখিয়া ত বোধ হয়, প্রাণেশ্বর কখন মন:পীড়া পাইবেন না। যদি বিধাতার অন্যরূপ ইচ্ছা না হইল, তবে তাঁহার চরণে এই ভিক্ষা যে, যেন ইহার দ্বারা তাঁহার চিরসুখ সম্পাদন করেন।”
তিলোত্তমাকে কহিলেন, “তিলোত্তমা! আমি চলিলাম। তোমার স্বামী ব্যস্ত থাকিতে পারেন, তাঁহার নিকট বিদায় লইতে গিয়া কালহরণ করিব না। জগদীশ্বর তোমাদিগকে দীর্ঘায়ু: করিবেন। আমি যে রত্নগুলি দিলাম, অঙ্গে পরিও। আর আমার–তোমার সার রত্ন হৃদয়মধ্যে রাখিও।”
“তোমার সার রত্ন” বলিতে আয়েষার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। তিলোত্তমা দেখিলেন, আয়েষার নয়নপল্লব জলভারস্তম্ভিত হইয়া কাঁপিতেছে।
তিলোত্তমা সমদু:খিনীর ন্যায় কহিলেন, “কাঁদিতেছ কেন?” অমনি আয়েষার নয়নবারিস্রোত দরদরিত হইয়া বহিতে লাগিল।
আয়েষা আর তিলার্ধ অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে গৃহত্যাগ করিয়া গিয়া দোলারোহণ করিলেন।
আয়েষা যখন আপন আবাসগৃহে আসিয়া উপনীত হইলেন, তখনও রাত্রি আছে। আয়েষা বেশ ত্যাগ করিয়া, শীতল-পবন-পথ কক্ষবাতায়নে দাঁড়াইলেন। নিজ পরিত্যক্ত বসনাধিক কোমল নীলবর্ণ গগনমণ্ডল মধ্যে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলিতেছে; মৃদুপবনহিল্লোলে অন্ধকারস্থিত বৃক্ষ সকলের পত্র মুখরিত হইতেছে। দুর্গশিরে পেচক মৃদু গম্ভীর নিনাদ করিতেছে। সম্মুখে দুর্গপ্রাকার-মূলে যেখানে আয়েষা দাঁড়াইয়া আছেন, তাহারই নীচে, জলপরিপূর্ণ দুর্গপরিখা নীরবে আকাশপটপ্রতিবিম্ব ধারণ করিয়া রহিয়াছে।
আয়েষা বাতায়নে বসিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিলেন। সে অঙ্গুরীয় গরলাধার। একবার মনে মনে করিতেছিলেন, “এই রস পান করিয়া এখনই সকল তৃষা নিবারণ করিতে পারি।” আবার ভাবিতেছিলেন, “এই কাজের জন্য কি বিধাতা আমাকে সংসারে পাঠাইয়াছিলেন? যদি এ যন্ত্রণা সহিতে না পারিলাম, তবে নারী-জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলাম কেন? জগৎসিংহ শুনিয়াই বা কি বলিবেন?”
আবার অঙ্গুরীয় অঙ্গুলিতে পরিলেন। আবার কি ভাবিয়া কি খুলিয়া লইলেন। ভাবিলেন, “এ লোভ সংবরণ করিয়া রমণীর অসাধ্য; প্রলোভনকে দূর করাই ভাল।”
এই বলিয়া আয়েষা গরলাধার অঙ্গুরীয় দুর্গপরিখার জলে নিক্ষিপ্ত করিলেন।