দুই বাড়ি (Dui Bari) : 02
সকালে নিধু চলিয়া যাইবে বলিয়া নিধুর মা ভোরে রান্না চড়াইয়াছিলেন৷ বড় মেয়েকে ডাকিয়া বলিলেন—তোর দাদাকে নেয়ে আসতে বল, ও পুঁটি—
পুঁটি বলিল—বড়দা এখনও বিছানা থেকে ওঠে নি—
—সে কি রে! ওকে উঠতে বল৷ কখন নাইবে, কখন খাবে—বেলা দেখতে দেখতে হয়ে গেল!
কিছুক্ষণ পরে নিধু স্নান সারিয়া আসিয়া খাইতে বসিল৷
নিধুর মা বলিলেন—যাবার সময় একবার ওদের সঙ্গে দেখা করে যা না?
নিধু বিস্ময়ের সুরে বলিল—কাদের সঙ্গে?
জজবাবুদের—ওই ওদের—গিন্নীর সঙ্গে, মঞ্জুর সঙ্গে?
—হ্যাঁ, আমি আবার যাই এখন! কি মনে করবে, ভাববে জলখাবার খেতে এসেচে সকালবেলা৷
—তোর যেমন কথা! তা আবার কেউ ভাবে বুঝি? যা না!
—আমার সময় নেই৷ ক’কোশ রাস্তা যেতে হবে জানো?
মুখে একথা বলিলেও নিধু মনে মনে ভাবিতেছিল, মঞ্জুর সঙ্গে একবার যাওয়ার সময় দেখাটা হইলে মন্দ হইত না৷ কিন্তু মা বলিলেই তো সেখানে যাওয়া যায় না৷
নিধুর মা বলিলেন—সামনের শনিবারে আসবি কিন্তু৷ আর পুঁটির জন্যে দু-গজ ফিতে কিনে আনিস—রমেশের জন্যে এক দিস্তে কাগজ৷ ও ভয়ে তোকে বলতে পারে না৷ আমায় এসে চুপি চুপি বলচে, আমি বললাম—তুই গিয়ে তোর দাদার কাছে বল না? বললে—না মা, আমার ভয় করে৷
নিধু মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া রওনা হইবার পূর্বে ছোট ভাই-বোনেরা আসিয়া কাড়াকাড়ি করিয়া পায়ের ধূলা লইবার চেষ্টায় পরস্পর ধাক্কাধাক্কি করিতে লাগিল৷ নিধু শাসনের সুরে বলিল—রমু, চব্বিশখানা ইংরিজি-বাংলা হাতের লেখার কথা যেন মনে থাকে৷ শনিবারে এসে না দেখলে পিঠের ছাল তুলব৷
রমেশ দাদার সম্মুখ হইতে সরিয়া গেল৷ বড় লোকের সম্মুখে পড়িলেই যত বিপদ, আড়ালে থাকিলে বহু হাঙ্গামার হাত হইতে রেহাই পাওয়া যায়৷
পথে পা দিয়াই নিধু একবার জজবাবুর বাড়ীর দিকে চাহিল৷ এখনো বোধ হয় কেউ ওঠে নাই—বড়লোকের বাড়ী, তাড়াতাড়ি উঠিবার গরজই বা কিসের!
ছায়াভরা পথে শরৎ-প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়ায় যেন নবীন আশা, অপরিচিত অনুভূতি সারা দেহের ও মনের নব পরিবর্তন আনিয়া দেয়৷ গাছের ডালে বন্য মটরলতা দুলিতেছে, তিৎপল্লার ফুল ফুটিয়াছে—এবার বর্ষায় যেখানে সেখানে বনকচুর ঝাড়ের বৃদ্ধি অত্যন্ত যেন বেশি৷ নিধু আশ্চর্য হইয়া ভাবিল—এসব জিনিসের দিকে তাহার মন তো কখনো তেমন যায় না, আজ ওদিকে এত নজর পড়িল কেন?
শরৎ-প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়ার সঙ্গে মিশিয়া আছে কাল বিকালে শোনা মঞ্জুর গানের সুর৷
সে সুর তাহার সারারাত কানে ঝঙ্কার দিয়াছে—শুধু মঞ্জুর গানের সুর নয়—তাহার সুন্দর ব্যবহার, তাহার মুখের সুন্দর কথা—ঘাড় নাড়িবার বিশেষ ভঙ্গিটি, বড় বড় কালো চোখের চপল চাহনি!
সত্যই রূপসী মেয়ে মঞ্জু৷ মহকুমার টাউনে তো কত মেয়ে দেখিল—অমন মুখ এ পর্যন্ত:কোনো মেয়েরই সে দেখে নাই জীবনে৷ মঞ্জুর সঙ্গে দেখা না হইলে অমনধারা রূপ যে মেয়েদের হইয়া থাকে—ইহার মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু নাই—ইহা সে ধারণা করিতে পারিত না৷
মঞ্জু স্কুলে পড়ে৷ স্কুলে-পড়া-মেয়ে সে এই প্রথম দেখিল৷ মেয়েদের এমন নিঃসংকোচ ধরন-ধারন সে কখনো কল্পনা করিতে পারিত না৷ এসব গ্রামের অশিক্ষিত কুরূপা মেয়েগুলা এমন অকালপক্ক যে বারো-তেরো বছরের পরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বা পিতৃব্য সমতুল্য প্রতিবেশীর সামনে দিয়া চলাফেরা করিতে বা তাহাদের সম্মুখে বাহির হইতে সঙ্কোচ বোধ করে৷
নিধুর কি ভালোই লাগিয়াছে মেয়েটিকে!
আচ্ছা, অত বড়লোকের মেয়ে সে—তাহার মতো সামান্য অবস্থার লোকের প্রতি অত আদরযত্ন দেখাইল কেন? জীবনে এধরনের ব্যবহার কোনো অনাত্মীয় মেয়ের নিকট হইতে সে কখনো পায় নাই৷
মঞ্জুর সহিত আবার যদি দেখা হইত আজ সকালটিতে!
সামনের শনিবারে—তবে একটা কথা, সামনের শনিবারে মঞ্জু নাও থাকিতে পারে৷ সে স্কুলের ছাত্রী, কতদিন স্কুল কামাই করিয়া এখানে বসিয়া থাকিবে? যদি চলিয়া যায়?
কথাটা ভাবিতে নিধুর যেন রীতিমতো বেদনা বোধ হইতে লাগিল৷ পরের মেয়ের প্রতি এ ধরনের মনোভাব তাহার এই প্রথম৷ সারাপথ নেশায় আছন্নভাবে কাটিয়া গেল নিধুর৷ সামনে ওই সারি সারি আড়ত দেখা দিয়াছে—টাউন আর আধমাইল পথ৷
নিজের বাসায় পৌঁছিয়া সে দেখিল বাড়ীওয়ালার সরকার তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে৷
নিধুকে দেখিয়া বলিল—মোক্তারবাবু, বাড়ী থেকে আসচেন?
—হ্যাঁ, কালীবাবু কি ভাড়ার জন্যে বসে আছেন?
—আজ বাবু বললেন, মোক্তারবাবুর কাছ থেকে ভাড়াটা নিয়ে আসতে৷
—আর দুদিন যাক৷ বাড়ী থেকে আসচি, হাতে কিছু নেই৷ বুধবারে আসবেন—
কোর্টে যদু-মোক্তার তাহাকে বলিলেন—ওহে একটা জামিননামায় সই করতে হবে৷
—জামিন মুভ করলে কে?
—আমি করলাম৷ পাঁচশ টাকার জামিন৷ যা আদায় করতে পার৷
—আপনি বলে দিন৷ ভালো লোক তো?
—কপাল ঠুকে জামিন হয়ে যাও৷ ফি ছাড় কেন?
—তা নয়, আমি বলচি না পালায় শেষকালে! বেশি টাকার জামিন তাই ভয় হয়৷
—কোনো ভয় নেই৷
নতুন মোক্তার সে, জামিননামার ফি প্রধান সম্বল৷ যদুবাবু অনুগ্রহ করেন বলিয়া তা মেলে—নতুবা তাহাই কি সুলভ? এক মাসের মধ্যে একটিবার সে জুনিয়ার হইয়া একটি মোকদ্দমায় জামিনের দরখাস্ত দাখিল করিয়াছিল৷ এ ব্যবসা চলিবে কিনা কে জানে? বুধবার বাড়ীভাড়া দিবে তো বলিল—কিন্তু দিবে কোথা হইতে?
মোক্তার-বারের ঘরের এক কোণে সাধন-মোক্তার সাক্ষী পড়াইতেছেন, অর্থাৎ যে মিথ্যার তালিম একবার সকালে দিয়া আসিয়াছেন—এখন আবার তাহা সাক্ষীদের মনে আছে কিনা তাহারই পরীক্ষা লইতেছেন৷
সাধনবাবু বলিলেন—এই যে নিধিরাম! বাড়ী থেকে এলে নাকি?
নিধু নীরসকণ্ঠে বলিল—এই এখন এলাম৷ সব ভালো?
—ভালো আর কই তেমন? বাতে ভুগচি৷ তোমার সঙ্গে কথা আছে একটা৷
—কি বলুন?
—এখন নয়৷ তিনটের পর ঘর একটু নিরিবিলি হলে তখন বলব৷ চলে যেও না যেন৷
—আচ্ছা, আমি একবার যদুবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি৷ কাজ আছে৷
তিনটার পর ব্রিফহীন মোক্তারের দল বড়-কেউ বার-লাইব্রেরীতে উপস্থিত থাকে না৷ থাকেন দু-একজন প্রবীণ ও পসারওয়ালা মোক্তার, তাঁহাদের কেস থাকে—মক্কেলকে শিখাইতে পড়াইতে হয়৷ হাকিমের এজলাসে অকারণেও দু-একবার ঢুকিয়া অনাবশ্যক মিষ্ট কথাও দু-একটা বলিতে হয়৷
নিধুর আজ মন তত ভালো ছিল না৷ সে তিনটার কিছু পূর্বে লাইব্রেরীতে ফিরিয়া দেখিল—হরিবাবু মোক্তার বসিয়া বসিয়া ধরণী-মোক্তারের সঙ্গে কোর্টে সেদিন প্রতিপক্ষের সাক্ষীকে কি করিয়া জেরায় জব্দ করিয়াছেন—তাহারই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়া যাইতেছেন৷ ধরণী জুনিয়ার মোক্তার, হরিবাবুর কাছে জামিনটা-আসটার আশা রাখে—সে বেচারী ঘন ঘন সমর্থনসূচক ঘাড় নাড়িতেছে৷
হরিবাবু বলিলেন—আরে নিধিরাম যে! কোর্টে দেখলাম না?
—কোর্টে দেখবেন কি বলুন হরিদা! আমরা হলাম তৃণভোজী জীব—আপনারা বাঘ ভালুক, আপনাদের ছেড়ে আমাদের কাছে কি মক্কেল ঘেঁষে যে হাকিমের এজলাসে সওয়াল-জবাব করতে যাব!
হরিবাবু সহাস্যবদনে বলিলেন—তোমার উপমাটা লাগসই হল না যে৷ তৃণভোজী জীবের মধ্যে হাতিও যে পড়ে৷
—আজ্ঞে তা পড়ে৷ তবে আমাদের ওজন কম, কাজেই হাতি নই একথা বুঝতে দেরি হয় না৷ যাঁদের ওজন বেশি, তাঁরা ওটা হবার দাবী করতে পারেন৷
—চল হে ধরণী, যাওয়া যাক৷ বলিয়া হরিবাবু উঠিলেন৷
কিছুক্ষণ পরে সাধন ভট্টাচার্য ঘরে ঢুকিয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলেন—কেউ নেই ঘরে? হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে৷
—কি বলুন?
—তুমি বিয়ে করবে?
নিধু আশ্চর্য হইয়া বলিল—কেন বলুন তো!
—আমার একটি ভাইঝি আছে—দেখতে-শুনতে—মানে—গেরস্তঘরের উপযুক্ত৷ রান্নাবান্না—
নিধু বাধা দিয়া বলিল—খুব ভালো পারে বুঝলাম৷ কিন্তু আমি বিয়ে করে খেতে দোব কি? পসার কি রকম দেখচেন তো?
সাধন ভট্টাচার্য হাসিয়া বলিলেন—ওহে, ওসব কথা ছোকরা মাত্রেই বিয়ের আগে বলে থাকে৷ আর মোক্তারীর পসার একদিনে হয় না৷ আমি চব্বিশ বছর এই কাজ করে চুল পাকিয়ে ফেললাম, আমি সব জানি৷ তুমি যখন যদুদার মতো মুরুব্বি পেয়েচ, তোমার পসার গড়ে উঠতে দু’বছরও লাগবে না৷ ঢুকেচ তো মোটে একমাস—এখুনি বিগ ফাইভদের অন্ন মারবার আশা কর?
—যদুবাবুর ওপর ভরসা করে আমার মতো ব্রিফলেস মোক্তারের বিয়ে করা চলে না৷
—খুব চলে—তা ছাড়া আমি তোমায় সাহায্য করব—আমার জামাইকে আমি দেখতে পারব৷
ইহাতে নিধু খুব আশান্বিত হইল না, কারণ সাধন-মোক্তারের পসার এমন কিছু লোভনীয় ধরনের নয়৷ সে বলিল—না দাদা, ওসব আমাদের সাজে না—আপনিই ভেবে দেখুন না৷
—তোমার সংসারে কে কে আছেন?
—বুড়ো বাবা, মা—মানে আমার সৎমা, একটি বৈমাত্র ভাই, আর আমার কটি ভাই-বোন৷
—বৈমাত্র ভাইয়ের বয়স কত?
বুদ্ধিমান নিধু বুঝিল, সাধন-মোক্তার আসলে তাহার সৎমা’র বয়স জানিবার জন্য এই প্রশ্নটি করিয়াছেন৷ সুতরাং সে বলিল—তার বয়েস এই চোদ্দ-পনেরো, তবে আমার সৎমা আমাকে মানুষ করে এসেচেন ছেলেবেলা থেকে৷ মা’র কথা আমার মনেই পড়ে না৷
—তুমি এই রবিবারে আমার বাড়ীতে খাবে৷
—সে তো হয় না৷ শনিবারে যে বাড়ী যেতে হবে—
—না, না, এই শনিবারে তো গিয়েছিলে৷ যেতেই হবে—না গেলে শুনব না৷ এক শনিবার না হয় নাই গেলে বাড়ী?
নিধিরাম আরও দু-একবার আপত্তি করিল—কিন্তু সাধন-মোক্তার তাহার কথায় আমল দিলেন না৷ নিধিরাম ভালোমানুষ ও লাজুক, বারের অন্যতম প্রবীণ মোক্তার সাধন ভট্টাচার্যের মুখের উপর জোর করিয়া না বলিতে পারিল না৷ ঠিক হইয়া গেল নিধিরাম রবিবার সকালে উঠিয়া তাঁহার বাসায় যাইবে, সেখানেই চা খাইবে—তারপর মধ্যাহ্ন-ভোজন করিয়া চলিয়া আসিবে৷
বাসায় আসিয়া নিধিরাম মনমরা হইয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল৷ এ আবার কোথা হইতে কি উপসর্গ আসিয়া জুটিল দেখ! কোথায় সে শনিবারের অপেক্ষায় আঙুলে দিন গুনিতেছে, কোথা হইতে বুড়ো সাধন ভটচাজ কি বাদ সাধিল!
সে বুঝিতে পারিয়াছে, মঞ্জুর সহিত আর তাহার দেখা হইবে না৷ হয়তো সামনের সোমবারেই সে কলকাতায় তাহার মামার বাড়ী চলিয়া যাইবে৷ এ শনিবারে গেলে দেখাটা হইত৷ এবার যদি দেখা না হয়, তবে আবার সেই পূজার ছুটি ছাড়া মঞ্জু নিশ্চয়ই বাড়ী আসিবে না৷
তাহার এখনো তো কতদিন বাকি৷
মাথাটা একটু প্রকৃতিস্থ হইলে সে ভাবিল, মঞ্জুকে এমন করিয়া সে দেখিতে চায় কেন? কেন তাহার মন এত ব্যাকুল সেজন্য? মঞ্জুর সঙ্গে দেখা করিয়া লাভ কি? আচ্ছা, এবার না হয় সে দেখাই পাইল—কিন্তু জজবাবু যদি আর গ্রামে পাঁচ বছর না আসেন, যদি আদৌ আর না আসেন—তবে মঞ্জুর সঙ্গে দেখাশোনা তো এমনিই বন্ধ হইয়া যাইবে! কিসের মিথ্যা মোহে সে রঙিন স্বপ্ন বুনিতেছে?
রবিবারে সাধন-মোক্তার আটটা বাজিতে-না-বাজিতে নিধুর বাসায় আসিয়া হাজির হইলেন৷ নিধু বসিয়া বসিয়া যদু-মোক্তারের বাড়ী হইতে আনা ক্যালকাটা ল’রিপোর্ট পড়িতেছিল৷ সাধন দেখিয়া বলিলেন—কি পড়ছ হে? বেশ, বেশ৷ নিজের উন্নতি নিয়েই থাকতে হবে৷ যদুদার বই? তা ছাড়া আর কে এখানে বই কিনবে বল?
নিধু বলিল—বসুন, একটু চা খাবেন না?
—না, না, তুমিও আমাদের বাড়ী গিয়েই চা খাবে—সব ঠিক করে রেখেচে মেয়েরা৷ ওঠ—
সাধন-মোক্তারের বাড়ী টাউনের পূর্বপ্রান্তে টিকাপাড়ায়৷ দুজনে হাঁটিয়া আসিলেন, নিধু বাসার চেহারা ও আসবাবপত্র দেখিয়া বুঝিল সাধন-মোক্তারের অবস্থা যে বিশেষ ভালো তাহা নয়৷ বাহিরের ঘরে একখানা ভাঙা তক্তপোশের আধময়লা ফরাসের উপর বসিয়া সাধনের মুহুরী কৃপারাম বিশ্বাস লেখাপড়া করিতেছে—একদিকে মক্কেলদের বসিবার নিমিত্ত একখানি কাঠের বেঞ্চি পাতা৷ একটা পুরোনো আলমারিতে সামান্য দামের টিপকলের তালা লাগানো—ঘরের দোরের বাঁদিকে তামাক খাইবার সরঞ্জাম, জায়গাটা টিকের গুঁড়ো, তামাকের গুল, আধপোড়া দেশলাইকাঠি পড়িয়া রীতিমতো নোংরা৷ দেয়ালে স্থানে-স্থানে পানের পিচের দাগ৷
নিধু ঘরে গিয়া বসিতেই কৃপারাম বিশ্বাস অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে দাঁত বাহির করিয়া বলিল—আসুন বাবু, এ শনিবারে বুঝি বাড়ী যান নি? বেশ৷ বাবু, সোনাতনপুরের মারামারির কেসে কি আপনার কাছে লোক গিয়েছিল?
নিধু বলিল—না, যদুবাবুর কাছে গিয়েচে এক পক্ষ শুনেচি—আমাদের জামিননামা সম্বল, সেটা পাবই৷ পক্ষ কি আমাদের মতো জুনিয়ার মোক্তারের কাছে যায়?
কৃপারাম বিনয়ে গলিয়া গিয়া দু’হাত কচলাইয়া বলিতে লাগিল—হেঁ-হেঁ বাবু, ওটা কি কথা—আপনার মত লোক—ইত্যাদি৷
নিধুর মনে হইল কৃপারাম যে তাহাকে অতখানি বিনয় প্রদর্শন করিয়া খাতির করিতেছে—ইহার মূলে রহিয়াছে তাহার সহিত সাধন-মোক্তারের পরিবারের বৈবাহিক সম্বন্ধের সম্ভাবনা৷ নতুবা প্রবীণ সাধন-মোক্তারের মুহুরী ঘুঘু কৃপারাম বিশ্বাসের কথা নয় তাহার প্রতি এতটা হাত কচলাইয়া সম্ভ্রম দেখানো! কই, বার-লাইব্রেরীতে গত দেড় মাসের মধ্যে কৃপারাম কোনোদিন তাহার সঙ্গে দুটি কথাও বলে নাই তো!
সাধন বাড়ীর ভিতর হইতে আসিয়া বলিলেন—একটা বালিশ দেবে কি নিধিরাম? কষ্ট হচ্ছে বসতে?
নিধিরাম হাসিয়া বলিল—আজ্ঞে না, বালিশ কি হবে আমার? আপনি বরং একটা আনান—
এই সময় চাকরে একখানা রেকাবিতে লুচি, আলুভাজা, পটলভাজা, দুটি সন্দেশ এবং এক বাটি চা আনিয়া নিধুর সামনে রাখিল৷ সাধন ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—জল, জল নিয়ে আয় এক গ্লাস—আর ওরে শোন, পান দুটো অমনি—পান—
নিধু জানাইল সকালবেলা সে পান খায় না৷ সাধনকে জিজ্ঞাসা করিল—আপনি খাবেন না?
—নাঃ, আমার অম্বল৷ কিছু সহ্যি হয় না, কাল রাতে খেয়েচি, এখনো পেট ভার৷ তুমি খাও—তোমরা ছেলে-ছোকরা মানুষ, আরও লুচি দেবে?
—কি যে বলেন! আর কিছু দিতে হবে না৷ আর দিলে খাওয়া যায়?
চা-পানের পরে এ-গল্পে ও-গল্পে বেলা প্রায় দশটা সাড়ে-দশটা হইয়া গেল৷ সাধন বলিলেন—তাহলে নিধিরাম এবার স্নানটা করে নাও এখানেই৷ ও, নেয়ে এসেচ? তবে আমি একবার বাড়ীর মধ্যে থেকে আসি!
কিছুক্ষণ পরে আসিয়া তিনি নিধুকে বাড়ীর মধ্যে ডাকিয়া লইয়া গেলেন৷
ক্ষুদ্র বাসা, দু-তিনখানি মাত্র ঘর, কিন্তু বাসায় লোকজন ও ছেলেমেয়ে নিতান্ত মন্দ নয় সংখ্যায়৷ নিধু মনে মনে ভাবিল—বাবা, এ পঙ্গপাল সব থাকে কোথায় এই কটা ঘরে?
বারান্দায় দুখানি কার্পেটের আসন পাতা৷ একখানিতে নিধুকে বসাইয়া সাধন তাহার পাশের আসনটিতে বসিয়া বলিলেন—ও বুড়ি, নিয়ে এস মা—
একটি চৌদ্দ-পনেরো বছরের না-ফরসা না-কালো রঙের রোগা গড়নের মেয়ে দুজনের সামনে ভাতের থালা নামাইয়া চলিয়া গেল এবং পুনরায় আর একখানা থালার ওপর বাটি সাজাইয়া ঘরে ঢুকিয়া দুজনের সামনে তরকারির বাটিগুলি স্থাপন করিল৷ তখন সে চলিয়া গেল বটে, কিন্তু সাধন তাহাকে বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে থাকিতে দিলেন না৷ কখনো নুন, কখনো লেবু, কখনো জল ইত্যাদি এটা-সেটা আনিবার আদেশ করিয়া সব সময় তাহাকে ঘর-বার করাইতে লাগিলেন৷ সে এই থাকে এই যায়, আবার আসে সাধনের ডাকে৷ নিধু মনে মনে হাসিল, সে ব্যাপারটা আগেই বুঝিয়া লইয়াছে—এই সেই ভাইঝিটি, যাহাকে কৌশল করিয়া দেখাইবার জন্যই আজ এখানে তাহাকে খাওয়াইবার এই আয়োজন৷ এমন কি নিধুর ইহাও মনে হইল, পাশের ঘরের কবাটের ফাঁক দিয়া বাড়ীর মেয়েরা তাহাকে দেখিতেছেন৷ একবার তো একজোড়া কৌতূহলী চোখের সহিত অতি অল্পক্ষণের জন্য তাহার চোখাচোখিই হইয়া গেল!
সাধন বাহিরে আসিয়া বলিলেন—নিধিরাম, আমার সামনে লজ্জা কোরো না, তামাক খাও তো চাকরে দিয়ে যাচ্ছে—কৃপারাম, যাও গিয়ে নেয়ে নাও গে—বেলা হয়েছে অনেক৷
নিধিরাম বিড়িটি পর্যন্ত খায় না৷ সে বলিল—আমি তামাক খাই নে, বরং পান আর একটা—
—একটা কেন, তুমি চারটা খাও—ওরে ও ইয়ে—আরও পান নিয়ে—
সাধন-মোক্তার খুব ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন৷
কৃপারাম মুহুরীকে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে, ঘরে কেহ নাই—সাধন একটু উসখুস করিয়া নিধুকে জিজ্ঞাসা করিলেন—তাহলে নিধিরাম, আমার ভাইঝিকে কেমন দেখলে?
নিধিরাম আশ্চর্য হইবার ভান করিয়া বলিল—কৈ, কে বলুন তো!
সাধন-মোক্তার বলিলেন—বেশ, ওই তো তোমাকে পরিবেশন করলে!
—ও! তা—তা বেশ, ভালোই৷ দিব্যি মেয়েটি৷
এটা অবশ্য নিধু বলিল নিছক ভদ্রতা ও শোভনতার দিক লক্ষ্য করিয়া, কোনো প্রকার বৈবাহিক মনোভাব ইহার মধ্যে আদৌ ছিল না৷ সাধন কথা শুনিয়া খুশি হইলেন বলিয়া মনে হইল নিধুর৷ কিন্তু এ সম্বন্ধে তিনি আপাতত কোনো কথা না উঠাইয়া কয়েকদিন পরে আবার তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন৷
নিধু গিয়া দেখিল সাধন-মোক্তার আসামী পড়াইতেছেন৷ সকালবেলা মক্কেলের ভিড় যাহাকে বলে তাহা না থাকিলেও দু-পাঁচটি মক্কেল গরুর গাড়ী করিয়া দূর গ্রাম হইতে আসিয়াছে৷
—বস নিধিরাম, একটু বস৷ আমি কাজ সেরে নিই—তারপর বল, তোমায় মেরেছিল কেন?
যাহাকে শিখানো হইতেছে সে বৃদ্ধা, মারপিটের নালিশ করিতে আসিয়াছে, সঙ্গে দু-তিনটি প্রতিবেশীও আনিয়াছে৷ বৃদ্ধা শিক্ষামতো বলিয়া যাইতে লাগিল, আমার বাছুর ওনার ধানখেতে গিয়ে নেমেছিল, তাই উনি মারামারি করে বাছুরডাকে, আমি তাই দেখে বকি ওনাকে—
—দাঁড়াও দাঁড়াও, সব ভুলে মেরে দিলে? তুমি বকবে কেন? তুমি কি বললে?
—আমি দু-একটা গালমন্দ দেলাম, বুড়োমানুষ, মুখি এখন তো আর ছুট নেই—
—ওকথা বললে তোমার মোকদ্দমা কাত হবে—কি শিখিয়ে দিলাম? বলবে, আমি বললাম ওঁকে, তুমি বাছুর মারছ কেন? তোমার ধান খেয়ে থাকে তুমি পণ্টঘরে দাওগে যাও—মারো কেন?
বুড়ী বলিল—হুঁ৷
সাধন-মোক্তার মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন—কি বিপদেই পড়েচি রে! ‘হুঁ’ কি? কথাটা বলে যাও আমার সঙ্গে সঙ্গে৷ তুমি কি বললে বল?
—এই বললাম, তুমি বাছুর মারচ কেন, আমার আজ দুই জোয়ান বেটা যদি বেঁচে থাকত, তবে কি তুমি আমার বাছুরের গায়ে হাত দিতি—তোমারও যেন একদিন এমনি হয়—
—আহা-হা—কোথাকার আপদ রে! জোয়ান বেটার কথায় কি দরকার আছে? জোয়ান বেটা মরুক বাঁচুক কোর্টের তাতে কি? বল আমি বললাম—বাছুর তুমি মারচ কেন, পণ্টঘরে দাও যদি অনিষ্ট করে থাকে—
—হুঁ—
—আবার বলে হুঁ! আমি যা বলে দিলাম তা বলে যাও না বাপু, এখানে আমার সময় নষ্ট করবে আর কতক্ষণ, দু-ঘণ্টা তো হয়ে গেল! তারপর যা শিখিয়ে দিলাম, কোর্টে গিয়ে এজাহারের সময় সব ভুলে তাল পাকিয়ে—ভোঁতা মুখ নিয়ে বাড়ী ফিরে যেও এখন৷ তুমি ওকথা বলতে সে তোমায় কি বললে?
—বললে—ধান আমার যা লোকসান হয়েচে পণ্টঘরে দিলি তা পূরণ হবে না—ওর দাম দিতি—
—ওরে না বাপু না! ও কথা বললে মোকদ্দমা সাজানো যাবে না৷ বলে দিলাম হাজার বার করে যে! কতবার শেখাব এক কথা? বল—আমার কথার উত্তরে সে আমায় অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দিলে—
—কি বলব বাবু—সে আমায় কি বললে?
—এমন গালাগালি দিলে যা হুজুরের সামনে বলা যায় না৷ বল?
—এমনি গালাগালি দিলে যা হুজুরের সামনে উশ্চারণ করা যায় না—
—হুঁ৷ বেশ হয়েচে—যাও, এখন কোথায় খাওয়া-দাওয়া করবে করে ঠিক বেলা এগারোটার সময় কাছারী যাবে৷ সকালে কাছারীতে না গেলে মোকদ্দমা রুজু হবে না—তারপর হ্যাঁ নিধিরাম, চা খাবে একটু? এই একটু অবসর পেলাম সকাল থেকে৷
—আজ্ঞে না, চা খাব না৷ কি বলছিলেন আমায়?
সাধন-মোক্তার কিছু ভূমিকা ফাঁদিয়া পুনরায় ভাইঝির বিবাহের প্রস্তাব তুলিলেন৷ নিধিরাম বড় লজ্জিত ও বিব্রত হইয়া পড়িল—বিবাহের সম্বন্ধে সে এ পর্যন্ত কোনো কথাই ভাবে নাই, তাহার মাথার মধ্যেই একথা নাই৷ কি কুক্ষণেই সাধনের বাড়ী নিমন্ত্রণ খাইতে আসিয়াছিল৷
সে বলিল—দেখুন আমি তো এ বিষয়ে কিছু ঠিক করি নি, তা ছাড়া আমার বাবা রয়েচেন—
সাধন ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—আহা-হা, তোমার মত আছে যদি বুঝি তবে তোমার বাবার কাছে এক্ষুনি যাচ্ছি৷ তোমার কথা আগে বল—
নিধু মহা বিব্রত হইয়া পড়িল৷ অন্তত দুদিন সময় নেওয়া দরকার—তারপর ভাবিয়া একটা ভদ্রতাসঙ্গত উত্তর অন্তত দেওয়া যাইতে পারে৷
সে বলিল—আচ্ছা কাল শনিবার বাড়ী যাচ্ছি, মা’র কাছে একবার বলে দেখি, সোমবার আপনাকে—
সাধন খপ করিয়া হঠাৎ নিধিরামের হাত দুটি ধরিয়া বলিলেন—একাজ করতেই হবে নিধিরাম৷ আমাদের বাড়ীসুদ্ধ সব মেয়েদের তোমাকে দেখে বড্ড পছন্দ হয়েছে৷ আর ও টাকাকড়ি, পসার-টসারের কথা ছেড়ে দাও৷ কপালে থাকে হবে, না থাকে না হবে৷ বলি যদু-দার কি ছিল? ভাঙ্গা থালা সম্বল করে এসেছিলেন এখানকার বারে মোক্তারী করতে৷ কপাল খুলে গেল, এখন লক্ষ্মী উছলে উঠচে ঘরে৷ অমনিই হয়৷ তাহলে সোমবারে যেন পাকা মত পাই—একটু কিছু মুখে দিয়ে যাবে না?
শনিবারে দীর্ঘ পথ হাঁটিয়া বাড়ী যাইবার সময় ছায়াস্নিগ্ধ ভাদ্র অপরাহ্নে�সুনীল আকাশের গায়ে নানা রঙের মেঘস্তর দেখিতে দেখিতে নিধুর মন কিসের আনন্দে ও নেশায় যেন ভরপুর হইয়া উঠিল৷ মঞ্জুকে আজ সে দেখে নাই দীর্ঘ তেরো দিন—যদি সে থাকে, যদি তাহার সঙ্গে দেখা হয়! কথাটা ভাবিতেই নিধুর বুকের মধ্যে যেন কেমন তোলপাড় করিতে লাগিল৷ দেখা হওয়া কি সম্ভব? নাও তো হইতে পারে! মঞ্জু কি আর তাহার জন্য গ্রামে বসিয়া থাকিবে পড়াশুনা ছাড়িয়া?
ভাবিতে ভাবিতে গ্রামের কাছে সে আসিয়া পড়িল৷
আর বেশি দূর নাই৷ ওই কেঁদেটির বিলের আগাড় দেখা যাইতেছে৷
নিধু অনুভব করিল তাহার বুকের ভিতরটাতে যেন কেমন এক অশান্ত, চঞ্চল আবেগ, এতদিন এ ধরনের আবেগের অস্তিত্ব সে অবগত ছিল না৷ বাড়ী পৌঁছিয়াই প্রথমে নিধুর চোখে পড়িল, তাহার মা বসিয়া বসিয়া কচুর ডাঁটা কুটিতেছেন৷ তাহাকে দেখিয়াই হাসিমুখে বলিলেন—ওই দ্যাখ এয়েচে! আমি ঠিক বলেচি সে এ শনিবার আসবেই৷ তাই তো কচুর শাক তুলে বেছে ধুয়ে—ওরে ও পুঁটি, শিগগির তোর দাদাকে হাত-পা ধোয়ার জল এনে দে—
হাতমুখ ধুইয়া সুস্থ হইয়া ও কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া নিধু মায়ের সহিত গল্প করিতে বসিল৷ প্রথমে এ কেমন আছে, সে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করিয়া সে বলিল—জজবাবুদের বাড়ির সব ভালো?
নিধুর মা বলিলেন—হ্যাঁ ভালো কথা—তোকে যে মঞ্জু একদিন ডেকে পাঠিয়েছিল, গেল শনিবারে৷ তা আমি বলে পাঠালাম সে এ হপ্তাতে আসবে না লিখেচে৷ এই তো পরশু না কবে আবার জজবাবুর ছেলে এসে জিগগেস করে গেল তুই আসবি কিনা৷
নিধু বলিল—ও৷
—তা একবার যাবি নাকি?
—আজ এখন? সন্দে হয়ে গেল যে একেবারে! কাল সকালে বরং—
কথা শেষ না হতেই বাহিরে মঞ্জুর ছোট
নিধু বাহিরে গিয়া দাঁড়াতেই ছেলেটি বলিল—আপনি এসেচেন? বেশ, বেশ৷ আসুন আমাদের বাড়ী, মঞ্জুদিদি ডেকে পাঠিয়েচে৷ আমায় বললে—দেখে আসতে আপনি এসেচেন কিনা—যদি আসেন তবে ডেকে নিয়ে যেতে বলেচে৷
—বীরেন কোথায়?
—মেজদা কাল কলকাতা চলে গেল৷
নিধু ছেলেটির পিছু পিছু মঞ্জুদের বাড়ী গিয়া বাহিরের ঘর পার হইয়া ভিতরের বাড়ী ঢুকিল৷ সেদিনকার সেই ঘরের সামনে প্রথমেই তাহার চোখে পড়িল মঞ্জু দাঁড়াইয়া বাড়ীর ঝিকে কি বলিতেছিল৷ তাহাকে দেখিয়া মঞ্জুর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল৷ সে ছুটিয়া রোয়াক হইতে উঠানে নামিয়া বলিল—একি, নিধুদা যে! আসুন আসুন—ও মা—নিধুদা এসেচে—
মঞ্জুর মা রান্নাঘরের ভিতর হইতে বলিলেন—নিয়ে গিয়ে বসা দালানে—যাচ্চি আমি—
নিধুর বুকের ভিতর যেন ঢেঁকির পাড় পড়িতেছে৷ সে কি একটা বলিবার চেষ্টা করিয়া মঞ্জুর পিছু পিছু দালানে গিয়া বসিল৷
মঞ্জু কাছেই একটা টুলের উপর বসিয়া বলিল—তারপর, ও শনিবারে এলেন না যে!
—বিশেষ কাজ ছিল একটা—
—আমি ডাকতে পাঠিয়েছিলাম আপনাকে, জানেন?
—হ্যাঁ শুনলাম৷
—কেন জানেন না নিশ্চয়ই! আচ্ছা চা খেয়ে নিন আগে, তারপর—ও তার মধ্যে আপনি তো চা খান না আবার! জলযোগ করুন বলতে হবে আপনার বেলা, না?
—যা খুশি বলুন—
—সেদিন যে বলে দিলাম আমাকে ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করবেন না? ভুলে গেলেন এরি মধ্যে?
—আচ্ছা বেশ, এখন থেকে তাই হবে৷
—বসুন আপনি, আমি আসচি—
একটু পরে মঞ্জু একটা রেকাবিতে লুচি, আলুভাজা ও হালুয়া লইয়া আসিল, নিধুর হাতে দিয়া বলিল—খেয়ে নিন আগে—
নিধু রেকাবির দিকে তাকাইয়া বলিল—এত?
—ও কিছু না৷ খান আগে—আমি জল আনি—
জলযোগের পাট চুকিয়া গেলে মঞ্জু বলিল—শুনুন৷ কাল রবিবার বাবার জন্মদিন৷ বাবা জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে চান না, আমরা মাকে ধরেচি, বাবার জন্মদিন আমরা করবই৷ আপনি এসেছেন খুব ভালো হল৷ আপনি অবিশ্যি আসবেন, জ্যাঠাইমাকেও কাল বলে আসব—আমরা একটা লেখা পড়ব, সেটা একবার আপনি শুনে বলুন কেমন হয়েচে—এই জন্যেই আমি ও-শনিবার থেকে—
নিধু হাসিয়া বলিল—বা রে, আমি কি লেখক নাকি? লেখার আমি কি বুঝি?
মঞ্জু বলিল—ইস! আমি বুঝি জানিনে—আপনার ভাই রমেশ আপনার একটা খাতা দেখিয়েচে আমাদের—তাতে আপনি কবিতা লিখেচেন দেখলাম যে! বেশ কবিতা, আমার খুব ভাল লেগেচে—মাও শুনেচেন—
নিধু লজ্জায় সঙ্কোচে অভিভূত হইয়া পড়িল৷ রমেশ বাঁদরটার কি কাণ্ড! ছেলেমানুষ আর কাকে বলে! দাদাকে সব দিক হইতে ভালো প্রতিপন্ন না করিতে পারিলে তাহার মনে যেন আর স্বস্তি নাই!
কি দরকার ছিল ইহাদের সে খাতা টানিয়া বাহির করিয়া দেখাইবার? নিধু আমতা-আমতা করিয়া বলিল—সে আবার লেখা! তা—সে সব—রমেশের কথা বাদ—
—কেন, সে কিছু অন্যায় করে নি৷
—সে-সব কবিতা স্কুলে থাকতে লিখতাম—কাঁচা হাতের লেখা—
মঞ্জু প্রতিবাদের সুরে বলিল—কেন, আমাদের বেশ ভালো লেগেচে কবিতাগুলো৷ খুকুকে উদ্দেশ করে যে সিরিজ, ওগুলো সত্যিই চমৎকার! খুকু কে?
নিধু লজ্জিতভাবে বলিল—ও আমার ছোট বোন—ওর ডাকনাম নেবু৷ তিন বছর বয়েস ছিল তখন, এখন বছর আট-নয় বয়েস৷ দেখো নি তাকে?
—না, আমি দেখি নি৷ এখুনি তাকে ডাকতে পাঠাচ্ছি—আজ দেখতেই হবে৷ কবির প্রেরণা যে যোগায়, সে বড় ভাগ্যবতী৷
—সে তো এখানে নেই৷ মামার বাড়ী রয়েচে দিদিমার কাছে—দিদিমা বড় ভালোবাসেন কিনা৷ পুজোর সময় আসবে৷
—তবে আর কি হবে৷ আমাদেরই কপাল! দেখা অদৃষ্টে থাকলে তো!
এই সময়ে মঞ্জুর মা আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—নিধু এসেচ বাবা? মঞ্জু তো কেবল তোমার কথা বলচে কদিন তোমার কবিতা পড়ে৷ ও নাকি কি কাগজ বার করবে, তাতে তোমায় লিখতে হবে!
মঞ্জু কৃত্রিম ক্রোধের সহিত মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল—মা সব কথা ফাঁস করে ফেললে তো! আমি সেকথা বুঝি এখনও বলেচি নিধুদাকে! যেমন তোমার কাণ্ড!
নিধু বলিল—কেন, কাকীমা ঠিক বলেচেন৷ শুনতেই তো পেতাম একটু পরেই—
মঞ্জু হাসিয়া বলিল—একখানা হাতের-লেখা কাগজ বের করব ভাবচি, তাতে আপনাকে লিখতে হবে কিন্তু৷
মঞ্জুর মা কন্যার গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিতে ব্যগ্র হইয়া বলিলেন—ও একখানা কাগজ আগেই বের করেছিল, ওঁর সঙ্গে কাজ করেন, বি, দাসগুপ্ত নাম শুনেচ তো? সবজজ—খুব পণ্ডিত লোক, তিনি দেখে বলেছিলেন, এমন লেখা—
মঞ্জু সলজ্জ প্রতিবাদের সুরে বলিল—আচ্ছা, মা—
—কেন আমায় বললি, সব কথা ফাঁস করে ফেলি যে! যখন করলাম ফাঁস, তখন ভালো করেই ফাঁস করা ভালো!
মঞ্জু আবদারের সুরে বলিল—মা, নিধুদাকে রাত্তিরে এখানে খেতে বল না? আমরা সব একসঙ্গে—
মঞ্জুর মা বলিলেন—আজ তো খাবার তেমন কিছু ভালো নেই—কি খাওয়াবি নিধুদাকে? তার চেয়ে কাল দুপুরে ওঁর জন্মদিনে পোলাও মাংস হবে, ভালো খাওয়া-দাওয়া আছে, কাল নিধু এখানে তো খাবেই—
—না মা, মাংস দরকার নেই শুভদিনে, তোমার পায়ে পড়ি মা৷ বাবাকে আমি বলব এখন—আর আমি বলি শোন মা, নিধুদা ঘরের ছেলে, আজও খাবে ডাল ভাত—কাল যা খাবে তা তো খাবেই—
তাহাকে লইয়া মাতাপুত্রীর এত কথা হওয়াতে প্রথমটা নিধু কেমন অস্বস্তি বোধ করিতেছিল৷ কিন্তু ইহারা এত সহজ ভাবে সেকথা বলিতেছে যে নিধুর ক্রমশ বোধ হইতে লাগিল যে, এই পরিবারের সঙ্গে তাহার বহুদিনের পরিচয়—সত্যই সে যেন তাহাদের ঘরের ছেলেই৷ এখানে আজ রাত্রে খাইতে কিন্তু নিধুর যে আপত্তি ছিল—তাহা অন্য কারণে৷ সে বাড়ী ফিরিয়াই বিকালে দেখিয়াছে তাহার জন্য মা বসিয়া বসিয়া কচুর শাক কুটিতেছেন৷ কোনো কিছুর বিনিময়েই সে মা’র রান্না কচুর শাককে উপেক্ষা করিয়া মা’র প্রাণে কষ্ট দিতে পারিবে না৷ কথাটা সে অন্যভাবে ঘুরাইয়া মঞ্জুকে বলিল৷
মঞ্জু ইহা লইয়া বেশি নির্বন্ধাতিশয্য দেখাইল না, নিধু সেজন্য এই বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে মনে মনে প্রশংসা না করিয়া পারিল না৷
আরও ঘণ্টাখানেক পরে নিধু চলিয়া আসিবার সময় মঞ্জু বলিল—কাল সকালে উঠেই এখানে আসবেন কিন্তু৷ আপনার পরামর্শ নিয়ে আমরা সব সাজাব—অনুষ্ঠান কি রকম হবে-না-হবে সবতাতেই আপনার সাহায্য না পেলে—
—সে জন্যে ভাবনা নেই৷ আমি আসব এখন—
—শুধু আপনি নন নিধুদা—আপনাদের বাড়ীসুদ্ধ সব কাল নেমন্তন্ন৷ মা বলে দিলেন আপনাকে বলতে—কাল সকালে আমি গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসব৷
রাত্রে বাড়ী ফিরিয়া আহারাদি করিয়া শুইয়া পড়িতেই নিধুর মা আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—কি বললে ওরা? কাল ওদের বাড়ী কি রে নিধু, রমেশ বলছিল—
—জজবাবুর জন্মদিন৷
—ওমা, ওই বুড়োর আবার জন্মদিন!
—পয়সা থাকলে সব হয় মা—তোমার পয়সা থাকলে তোমারও জন্মদিন হত৷
—আমার জন্মদিন মাথায় থাকুক বাবা—পয়সার অভাবে তোর, রমেশের, পুঁটুর জন্মদিন কখনো করতে পারিনি৷ এদেশে ওর চলনই নেই৷ থাকবে কি, অবস্থা সব সমান৷
নিধু কি সব বলিয়া গেল খানিকক্ষণ ধরিয়া ইহার উত্তরে—কিন্তু নিধুর মা কি যেন ভাবিতেছিলেন—তাঁহার কানে সম্ভবত কোনো কথাই ঢোকে নাই৷
নিধুর কথা শেষ হইলে তিনি অন্যমনস্কভাবে বলিলেন—আচ্ছা, তোর জন্মদিন কবে মনে আছে তোর? আশ্বিন মাসে তো জানি—কিন্তু তারিখটা—
মায়ের কথা শুনিয়া নিধুর হাসি পাইল৷ বলিল—কেন মা, জন্মদিন করবে নাকি?
—না, তাই বলচি—বলিয়াই নিধুর মা ঘর হইতে চলিয়া গেলেন৷ যাইতে যাইতে আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন—জল আছে ঘরে? এক গ্লাস জল হবে তো রে? আমি যাই—
পরদিন সকালে প্রায় সাড়ে-আটটার সময় মঞ্জুই তাহার ভাইয়ের সঙ্গে নিধুদের বাড়ী আসিল৷ নিধুর মা তাহাদের দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন—কোথায় বসান, কি করেন যেন ভাবিয়া পান না এমন অবস্থা৷ তাড়াতাড়ি একখানা আসন পাতিয়া দিয়া বলিলেন—এস মা, বস৷ এস বাবা—বড় ভাগ্যি যে তোমরা এলে—
মঞ্জু কুণ্ঠিত ভাবে বলিল—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না জ্যাঠাইমা৷ নিধুদা কোথায়?
—সে এইমাত্র যে কোথায় বেরুল—এখুনি আসবে, বস মা৷
—আপনারা সবাই পায়ের ধুলো দেবেন আমাদের বাড়ী, মা বলে দিলেন৷ ওখানেই দুপুরে খাবেন সবাই কিন্তু—জ্যাঠাবাবুকে বলবেন৷
নিধুর মা চোখমুখ ও কথার ভাবে বিনয় ও সৌজন্য প্রকাশ করিতে গিয়া যেন গলিয়া পড়িলেন৷
মঞ্জু খানিক বসিয়া চলিয়া যাইবার সময় বার-বার করিয়া বলিয়া গেল, নিধুদা আসিলেই যেন সে তাহাদের বাড়ী যায়৷
বেলা সাড়ে-নটার সময় নিধু মঞ্জুদের বাড়ী গেল৷ ওই সময় হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমস্ত দিনটা যে বিচিত্র অনুষ্ঠান, আমোদ ও পান-ভোজনের ভিতর দিয়া কাটিয়া গেল, নিধু বা তাহাদের বাড়ীর কেহই জীবনে ওরকম কিছু কখনো দেখে নাই৷ মঞ্জুর বিশেষ অনুরোধে নিধু ছোট একটি কবিতাও লিখিয়া দিল মঞ্জুর বাবার জন্মদিন উপলক্ষে৷ তাহাতে তাঁহাকে ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু, বরুণের সঙ্গে তুলনা করা হইল, যুগপ্রবর্তক ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করা হইল, মহামানব বলা হইল—বলিবার বিশেষ কিছু বাদ রহিল না৷ মঞ্জু নিজের একটি ক্ষুদ্র রচনা পাঠ করিল, কয়েকটি গান গাহিল, একটি কবিতা আবৃত্তি করিল৷ সে যেন এই অনুষ্ঠানের প্রাণ, সে যেখানে থাকে তাহাই মাধুর্যে ও সৌন্দর্যে ভরিয়া তোলে—সে যেখানে নাই—তাহা হইয়া উঠে প্রাণহীন—অন্তত নিধুর তাহাই মনে হইল৷
মঞ্জুর বাবাকে মঞ্জু নিজের হাতে স্নান করাইয়া শুভ্র গরদ পরাইয়া পিঁড়িতে বসাইল৷ গলায় নিজের হাতে তৈরি ফুলের মালা দিয়া কপালে নিজের হাতে চন্দন লেপন করিল৷ তাহার পর যাহা কিছু অনুষ্ঠান হইল, সবই তাঁহাকে ঘিরিয়া৷
নিধুর মা এমন ধরনের উৎসব কখনো দেখেন নাই—দেখিয়া-শুনিয়া তাঁহার মুখে কথা সরে না এমন অবস্থা৷ মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর নিমন্ত্রিতের দল চলিয়া গেল—নিধুকে কিন্তু মঞ্জু যাইতে দিল না৷ বৈকালে তাহারা ছোট একটি মূক-অভিনয় করিবে, নিধুর বসিয়া এখনই দেখিতে হইবে তাহাদের তালিম দেওয়া৷ কোথায় কি খুঁত হইতেছে তাহা দেখিবার ভার পড়িল নিধুর উপর৷
মঞ্জুর অভিনয় দেখিয়া নিধু মুগ্ধ হইয়া গেল৷ সুঠাম দেহযষ্টির কি লীলা, হাত-পা নাড়ার কি সুললিত ভঙ্গি, হাসির কি মাধুর্য—সামান্য একটি তক্তপোশ ও দড়ির গায়ে ঝুলানো কয়েকখানি রঙিন শাড়ী ও ফুলের মালার সাহায্যে যে এমন মায়া সৃষ্টি করা যায় দর্শকদের সামনে—তা নিধু এই প্রথম দেখিল৷ অবশ্য অভিনয়ের সময় নিধুর মা উপস্থিত ছিলেন৷
সন্ধ্যার পূর্বে নিধু মঞ্জুকে বলিল—যাই তাহলে এখন—
—এখনই কেন?
—সারাদিন তো আছি—
—আরও থাকতে যদি বলি?
—থাকতে হবে তাহলে—তবে কাল সকালেই তো আবার—
—কাল ছুটি নেই?
—কিসের ছুটি কাল—না৷
—সামনের শনিবার আসবেন তো?
—তা ঠিক বলা যায় না—সব শনিবার তো—
—শুনুন নিধুদা—ওসব শুনচিনে৷ আসতেই হবে শনিবার—আমাদের হাতের লেখা কাগজের ওই দিন একটা উৎসব করব ভাবচি৷
—বেশ তাহলে আসব—
—আজ রাত্রে এখানে কেন খেয়ে যান না?
—দুপুরে ওই বিরাট খাওয়ার পরে রাত্রে কিছু চলবে না মঞ্জু, ও অনুরোধ কোরো না—
—সে হবে না৷ মাকে বলি—
—লক্ষ্মী, ছেলেমানুষি কোরো না—বলি শোনো—
—তাহলে এখন যাবেন না বলুন—
নিধুও বোধহয় মনে মনে তাহাই চাহিয়াছিল৷ সে কেবল বলিল—থাকতে পারি, কিন্তু তোমার মূক অভিনয়টি আর একবার দেখাতে হবে—
—মঞ্জু উৎসাহের সঙ্গে বলিল—বেশ দেখাব৷ ভালো লেগেচে আপনার?
—চমৎকার৷
—সত্যি বলচেন নিধুদা?
—মন থেকে বলচি বিশ্বাস কর—
—তা যখন বললেন—তখন ওর চেয়েও ভালো একটা করি আমি৷ স্কুলে প্রাইজ পেয়েছিলাম কবে—সেটা করব এখন৷
—তাহলে রইলাম আমি৷ না দেখে যাচ্ছিনে—
সন্ধ্যার কিছু পরে ‘কচ ও দেবযানী’র মূক অভিনয় মঞ্জু করিল৷ ছোট ভাইকে কচের ভূমিকায় সহযোগী করিয়াছিল৷ নিধুর মনে হইল মঞ্জুর ভাই জিনিসটাকে নষ্ট করিল—মঞ্জুর অভিনয় সর্বাঙ্গসুন্দর হইত যদি সে ছোট ভাইয়ের কাছে বাধার পরিবর্তে সাহায্য পাইত৷
অনেক রাত্রে নিধু যখন মঞ্জুদের বাড়ী হইতে ফিরিল—তখন মাথার মধ্যে ঝিম-ঝিম করিতেছে—কিসের নেশা যেন তাহাকে মাতাল করিয়া দিয়াছে, কত ধরনের চিন্তা ও অনুভূতির জটিল স্রোত তখন তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে, কোনো কিছু ভালোভাবে ভাবিয়া ও বুঝিয়া দেখিবার অবসর ও ক্ষমতা নাই তখন৷
নিধুর মা বলিলেন—এলি বাবা? কেমন হল বল দিকি? একেই বলে বড়লোক! বড়লোক যে হয়, তাদের সব ভালো না হয়ে পারে না৷ জন্মদিন যে আবার ওভাবে করা যায়—তা তুমি-আমি জানি?
নিধু হাসিয়া বলিল—জানব কোত্থেকে মা? পয়সা আছে?
—আর কি চমৎকার মঞ্জু মেয়েটা! কেমন পালা গাইলে হাত-পা নেড়ে? মুখে কিছু না বললেও সব বোঝা গেল৷
—সব বুঝেছিলে মা?
—ওমা, ঠাকুর-দেবতার কথা কেন বুঝব না?
—কোনটা ঠাকুর-দেবতার কথা হল মা? তুমি কিছুই বোঝনি৷ ও আমাদের ঠাকুর-দেবতার নয়, তুমি যা ভাবচ৷ বুদ্ধ নাম শুনেচ? ও সেই বুদ্ধদেবের—
—তা যাক গে, দেবতা তো, তাহলেই হল৷ কিন্তু যাই বল, মঞ্জু চমৎকার মেয়ে, না? কি সুন্দর দেখতে?
মঞ্জুর কথায় নিধু বিশেষ কোনো উৎসাহ দেখাইল না৷ একবার সমর্থনসূচক ঘাড় নাড়িয়া ঘরের মধ্যে চলিয়া গেল৷
পরদিন সকালে উঠিয়া নিধু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা বেদনা অনুভব করিল৷ কিসের বেদনা ভালো করিয়া বোঝাও যায় না; অথচ মনে হয় যেন সারা দুনিয়া শূন্য হইয়া গিয়াছে; অন্য কোথাও গেলে কিছু নাই কোথাও৷ আছে কেবল এখানে মঞ্জুদের বাড়ী৷
মঞ্জুদের বাড়ী ছাড়িয়া বিশ্বের কোথাও গিয়া সুখ নাই৷
বাড়ী হইতে বিদায় লইয়া নিধু উদাস-মনে পথ চলিতে লাগিল৷ ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি, পথের ধারে ঝোপে বনকলমী ফুটিয়াছে—বাঁশঝাড়ের ও বড় বড় বিলিতি চটকা গাছের মাথায় সকালে নীল আকাশ, পূজার আর বেশি দেরি নাই, স্কুলে, জলে, আকাশে, বাতাসে আসন্ন পূজার আভাস যেন৷ পাড়াগাঁয়ের ছেলে নিধুর তাহাই মনে হইল৷
কৃষকেরা পাট কাটিতে শুরু করিয়াছে, পথের ধারে যেখানে যত খানা-ডোবা তাহাতেই পচানো পাটের আঁটি৷ দুর্গন্ধে এখন হইতেই পথ চলা দায়৷ নিধু অন্যমনস্ক ভাবে চলিতে চলিতে প্রায় নোনাখালির বাঁওড়ের কাছে আসিয়া পড়িল৷ এখান হইতে টাউন আর মাইল দুই—নিধু বাঁওড়ের ধারে ঘাসের উপর বসিল৷ আজ এখনো সকাল আছে৷ তাড়াতাড়ি কোর্টে হাজির হইয়া কি হইবে? মক্কেলের তো বড় ভিড়!
মহকুমা টাউনে তাহার কেহ নাই৷ একেবারে আত্মীয়স্বজনশূন্য মরুভূমি এটা৷ জগতের যাহা কিছু সে চায়—তাহার প্রিয়, তাহার কাম্য—পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছে, তাহাদের গ্রামে৷ মনের মধ্যে দারুণ শূন্যতা—তা কে পূরণ করিবে? যদু-মোক্তার না তার মুহুরী বিনোদ?
নিধু বুদ্ধিমান লোক, সে কথাটা ভালো করিয়া ভাবিল৷ মঞ্জুর প্রতি তাহার মনোভাব এমন হওয়ার হেতু কি? মঞ্জু সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু সুন্দরী সে একেবারে দেখে নাই তাহা তো নয়, সেজন্য সে আকৃষ্ট হয় নাই৷ তাহাকে আকৃষ্ট করিয়াছে—তাহার প্রতি মঞ্জুর সদয় ও মধুর ব্যবহার, মঞ্জুর আদর, সৌজন্য—অত বড়লোকের মেয়ে সে, শিক্ষিতা ও রূপসী, তাহার উপর এত দরদ কেন তার?
এ এমন একটা জিনিস—নিধুর জীবনে যাহা আর কখনো ঘটে নাই, একেবারে প্রথম৷ তাই মঞ্জুর কথা ভাবিলেই, তাহার মুখ মনে করিলেই নিধুর মন মাতিয়া ওঠে—তাহাকে উদাস ও অন্যমনস্ক করিয়া তোলে—
সব কিছু তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর মনে হয়৷
অথচ ইহার পরিণাম কি? শুধু কষ্ট ছাড়া?
বুদ্ধিমান নিধু সে কথাও ভাবিয়া দেখিয়াছে৷
মঞ্জুকে সে চায় কিন্তু মঞ্জুর বাবা কি কখনো তাহার সহিত মঞ্জুর বিবাহ দিবেন? মঞ্জুকে পাইবার কোনো উপায় নাই তাহার৷ মঞ্জুকে আশা করা তাহার পক্ষে বামন হইয়া চাঁদে হাত দিবার সমান৷
কেন এমন হইল তাহার মনের অবস্থা?
অত্যন্ত ইচ্ছা হয়, মঞ্জুর মনের ভাব কি জানিতে৷ মঞ্জুও কি তাহাকে এমন করিয়া ভাবিতেছে? একথা কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা শক্ত৷ কি তাহার আছে, না রূপ, না গুণ, না অর্থ—মঞ্জু তাহার কথা কেন ভাবিবে? সে গরীবের ছেলে, মোক্তারী করিতে আসিয়া পাঁচটাকা ঘরভাড়া দিয়া নিজে দুটি রাঁধিয়া খাইয়া মক্কেল শিখাইয়া, যদু-মোক্তারের দয়ায় জামিননামা সই করিয়া গড়ে মাসে আঠারো-উনিশ টাকা রোজগার করে—কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে যে তাহার মতো লোকের দিকে চাহিয়া দেখিতেও পারে—ইহা বিশ্বাস করা শক্ত৷
নিধু বাসায় পৌঁছিয়া দেখিল বিনোদ-মুহুরী তাহার অপেক্ষায় বারান্দার বেঞ্চিতে বসিয়া আছে৷ তাহাকে দেখিয়া বিনোদ-মুহুরী বলিল—বাবু এলেন? বড্ড দেরী করে ফেললেন যে!
—কেন বল তো?
—দুটো মক্কেল এসেচে—চুরির কেস৷ আমি ধরে রেখে দিয়েচি কত চালাকি খেলে৷ তারা হরিহর নন্দীর কাছে কি মোজাহার হোসেনের কাছে যাবেই৷ আজই এজাহার করাতে হবে—বলেচি বাবু আসচেন, বস—এই এলেন বলে৷ ধরে কি রাখা যায়?
—আসামী না ফরিয়াদী—
—ফরিয়াদী, বাবু৷ আসামী গিয়েচে যদুবাবুর কাছে৷ এদের অনেক করে ধরে রেখেচি, বাবু৷ খেতে গিয়েচে হোটেলে৷
নিধু নির্বোধ নয়, বিনোদ-মুহুরীর চালাকি বুঝিতে পারিল৷ বিনোদ-মুহুরী টাউটগিরি করিয়া কিছু কমিশন আদায় করিবে, এই তাহার আসল উদ্দেশ্য৷ নতুবা আসামীপক্ষ যখনই যদু-মোক্তারের কাছে গিয়েছে, অপরপক্ষ নিধুর কাছে আসিবেই—তাহাই আসিতেছে আজ দু’মাস ধরিয়া৷ বিনোদের টাউটগিরি না করিলেও তাহারা এখানে আসিত৷ বিনোদের খোশামোদ করা ইত্যাদি সব বাজে কথা৷
নিধু বলিল—টাকার কথা কিছু বলেছিলে?
বিনোদ বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিল—না বাবু, আপনি এসে যা বলবেন ওদের বলুন—আমি টাকার কথা বলবার কে?
—আচ্ছা আমি কোর্টে চললাম৷ তুমি ওদের নিয়ে এস—
—বাবু, ওদের এজাহারটা একটু শিখিয়ে নেবেন কখন?
—কোর্টেই নিয়ে এস—যা হয় হবে৷
বার-লাইব্রেরীতে ঢুকিতে প্রথমেই সাধন-মোক্তারের সঙ্গে দেখা৷ সাধন তাহাকে দেখিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন—আরে এই যে! আমি ভাবচি, আজ কি আর এলে না? দেরি হচ্চে যখন, তখন বোধ হয়—শরীর বেশ ভালো? বাড়ীর সব ভালো?
তাহার স্বাস্থ্য ও তাহার পরিবারের কুশল সম্বন্ধে সাধন-মোক্তারের এ অকারণ ঔৎসুক্য নিধুকে বিরক্ত করিয়াই তুলিল৷ সে বিরস মুখে বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ, সব মন্দ নয়৷
সাধন ভটচাজ বলিলেন—ভালো কথা, একটা জামিননামায় সই করতে হবে তোমায়৷ মক্কেল পাঠিয়ে দেব এখন—
নিধু ইহার ভিতর সাধন ভটচাজের স্বার্থসিদ্ধির গন্ধ পাইয়া আরও বিরক্ত হইয়া উঠিল—কিন্তু বিরক্ত হইলে ব্যবসা চলে না, অন্তত একটা টাকা তো ফি পাওয়া যাইবে জামিননামায় সই করিয়া, সুতরাং সে বিনীতভাবে বলিল—দেবেন পাঠিয়ে৷
—আজ একবার নতুন সাবডেপুটির কোর্টে তোমায় নিয়ে যাই চল—আলাপ হয়নি বুঝি?
—না, উনি তো শুক্রবার এসেচেন, সেদিন আমার কেস ছিল না, ওঁকে চক্ষেও দেখিনি—
—হাকিমদের সঙ্গে আলাপ রাখা ভালো৷ চল যাই—
নবাগত সাবডেপুটির নাম সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, বয়স বেশি নয়৷ লম্বা ধরনের গড়ন, চোখে চশমা, গায়ের রঙ বেশ ফরসা৷ এজলাসে কোনো কাজ ছিল না, সুনীলবাবু একা বসিয়া নথির পাতা উল্টাইতেছিলেন, সাধন ভটচাজ ঘরে ঢুকিয়া হাসিমুখে বলিলেন—হুজুরের এজলাস যে আজ ফাঁকা?
—আসুন সাধনবাবু, আসুন৷ এ মহকুমায় দেখচি কেস বড় কম—ভাবচি দাবা খেলা শিখব না ছবি আঁকা শিখব—সময় কাটা তো চাই? ইনি কে?
—হুজুরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলে নিয়ে এলাম, এঁর নাম নিধিরাম রায়চৌধুরী—মোক্তার৷ এই সবে মাস দুই হল—
বেশ, বেশ৷ বসুন নিধিরামবাবু, কেস নেই, বসে একটু গল্পগুজব করা যাক—
নিধিরাম নমস্কার করিয়া বসিল৷ এজলাসে হাকিমদের সামনে বসিতে এখনো যেন তাহার ভয়-ভয় করে৷ কথা বলিতে তো পারেই না৷
সুনীলবাবু বলিলেন—নিধিরামবাবুর বাড়ী কি এই সাবডিভিশনেই?
নিধিরাম গলা ঝাড়িয়া লইয়া সসম্ভ্রমে বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ—এখান থেকে ছ’ ক্রোশ, কুড়ুলগাছি—
সুনীলবাবু চোখ কড়িকাঠের দিকে তুলিয়া কথা মনে আনিবার ভঙ্গি করিয়া বলিলেন—কুড়ুলগাছি? কুড়ুলগাছি? আচ্ছা, আপনাদের গ্রামেই কি লালবিহারীবাবুর বাড়ী?
—আজ্ঞে হ্যাঁ৷
উনি বুঝি আজকাল কন্টাইয়ের মুন্সেফ—না?
—কন্টাই থেকে বদলি হয়েছেন মেদিনীপুর সদরে৷ দেশে এসেছেন তিন মাসের ছুটি নিয়ে—
—ছুটিতে আছেন? কেন অসুখ-বিসুখ নাকি?
—না, শরীর বেশ ভালোই৷ বাড়ীতে এবার পুজো করবেন শুনচি—আর বোধ হয় বাড়ীঘর সারাবেন—
—তাই নাকি? বেশ, বেশ৷ আমার বাবার সঙ্গে ওঁর খুব বন্ধুত্ব কিনা৷ কলকাতায় আমাদের বাড়ীর পাশেই ওঁর শ্বশুরবাড়ী৷ সিমলে স্ট্রীটে—আমাদের সঙ্গে খুব জানাশোনা—ওঁরা ভালো আছেন সব?
—আজ্ঞে হ্যাঁ—ভালোই দেখে এসেছি৷
—আমার নাম করবেন তো লালবিহারীবাবুর কাছে৷
—নিশ্চয়ই করব—এ শনিবারে গিয়েই করব—
—বলবেন একবার সময় পেলে আমি যাব—কি গাঁয়ের নামটা বললেন? কুড়ুলগাছি—হ্যাঁ কুড়ুলগাছিতে৷
—সে তো আমাদের সৌভাগ্য, হুজুরের মতো লোক যাবেন আমাদের গ্রামে৷
—নিধুর বিনয়ে সুনীলবাবু পরম আপ্যায়িত হইয়াছেন বলিয়া মনে হইল তাঁহার মুখ দেখিয়া৷ নিধুর দিকে তাকাইয়া খুশির সুরে বলিলেন—আজ আসবেন আমার ওখানে? আসুন না—একটু চা খাবেন বিকেলে? সাধনবাবু আপনিও আসুন না?
নিধু মুগ্ধ হইয়া গেল হাকিমের শিষ্টতায় ও সৌজন্যে৷ সাধনবাবুর তো মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না৷ তিনি বিনয়ে সম্ভ্রমে বিগলিত হইয়া বলিলেন—আজ্ঞে নিশ্চয়ই যাব৷ হুজুর যখন বলছেন—নিশ্চয়ই যাব—
—হ্যাঁ আসুন—এই ধরুন—ছ-টার সময়—
এই সময় হরিবাবু মোক্তার দুজন মক্কেল লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন—হুজুর কি ব্যস্ত আছেন? একটা এজাহার করতে হবে আমার মক্কেলের—
নিধু ও সাধন ভটচাজ নমস্কার করিয়া বিদায় লইতে উদ্যত হইলে সাবডেপুটিবাবু বলিলেন—তা হলে মনে থাকে যেন নিধুবাবু—
—আজ্ঞে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷
বাহিরে আসিয়া সাধন ভটচাজ বলিলেন—সব হুজুরের সঙ্গে আমার খাতির—বুঝলে? তোমায় সব এজলাসে একে একে নিয়ে যাব৷ তবে কি জানো—এস. ডি. ও. আর সাবডেপুটি এঁদের নিয়েই আমাদের কারবার৷ দেওয়ানী কোর্টে আমাদের তত তো হয় না, ফৌজদারী হাকিমদের সঙ্গে ভাব রাখলেই চলে যায়—
বার-লাইব্রেরীতে আসিবার পূর্বে সাধন ভটচাজ নিম্নসুরে বলিলেন—ভালো কথা, আমার সেই প্রস্তাবটার কি হল হে?
নিধুর গা জ্বলিয়া গেল৷ সে এতক্ষণ ইহারই অপেক্ষা করিতেছিল৷ ইতস্তত করিয়া বলিল—এখনো তো ভেবে দেখিনি—
—বাড়ীতে কিছু বল নি?
—আজ্ঞে না—
—তোমার মেয়ে পছন্দ হয়েচে কি না বলো—আসল কথা যেটা!
নিধু ভদ্রতার খাতিরে বলিল—আজ্ঞে না, মেয়ে ভালোই৷
—তোমার সঙ্গে সামনের শনিবারে তোমাদের বাড়ী যাই না কেন?
—আপনি যাবেন আমার বাড়ীতে সে তো ভাগ্যের কথা৷ তবে আমি বলচি কি, এ শনিবারে না হয় আমি একবার জিগগেস করেই আসি বাবাকে—
—খুব ভালো৷ তাই কোরো৷ সোমবারে যেন আমি নিশ্চয়ই জানতে পারি—