দুঃস্বপ্ন – এগারো
সোমার মনে হল কেউ ডাকছে। অনেক দূর থেকে ডাকছে। সে চোখ খুলে তাকালে দেখল, পাশে মনীষ দাঁড়িয়ে। সে মনীষকে ঠিক চিনতে পারছে না বোধহয়। একটা অসীম শূন্যতার ভিতর সোমা ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ডুবে যাচ্ছে কিনা বলা যায় না, কেমন ডুবে যেতে তার ভালো লাগছে। এবং চোখ বুজলেই কেমন সে হালকা, বাতাসে ভর দিয়ে সে যেন অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার দুটো হাত এখন পাখির ডানার মতো। অথবা বাতাসে সাঁতার কাটার মতো সে এগিয়ে যায়, আর এখন কেউ ডাকলে মনে হয়, অনেক দূর থেকে, যেন কেমন অনন্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছোট একটা নক্ষত্রের মতো তাকে বলছে, সোমা, তোমার তো কাজল পরার কথা ছিল না। চোখে কেন যে কাজল পরতে গেলে।
সোমা বলল, আমি কাজল পরি না। কখনও পরি না। সেই যে তুমি বললে, তারপর থেকে পরি না।
মনীষ দেখল সোমা চোখ বুজেই বিড়বিড় করছে। এমন দেখলে কে আর স্থির থাকতে পারে। অসিতের সঙ্গে পরামর্শ দরকার। সে এখন কী করতে পারে। আসলে ভয়ে এমন হয়েছে। ওর চেয়ে সোমা বেশি ভয় পেয়ে গেছে। সে এ—ভাবে এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। সে এবার চিৎকার করে ডাকল, মনোরমা মনোরমা!
মনোরমা ছুটে এল। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
মনীষ বলল, কী হয়েছিল!
কে একজন এসেছিল! বলল সোমা আছে?
সোমা! সোমার কথা বলল!
হ্যাঁ। বলল, ওকে ডেকে দেবে তো।
নাম কী বলল?
নাম বলল না। বলল, এলেই আমাকে চিনতে পারবে।
মনীষ নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে পারলে যেন বেঁচে যেত। সে ব্যালকনিতে ছুটে এসে ডাকল, রসুল! রসুল!
রসুল ছুটে এলে বলল, কে এসেছিল।
কেউ নাতো সাব।
কেউ না!
না।
মনোরমা। সে আকাশ ফাটিয়ে বলল, এসব বাড়িতে কী হচ্ছে! আমি সবাইকে তাড়িয়ে দেব। তোমরা সবাই নেশা করছ।
না দাদাবাবু নেশা করছি না। আমি বললুম, বসুন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দিদিমণিকে দেখতে পেলাম না। বাথরুম বন্ধ। ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। এসে বললাম, বসুন। দেরি হবে।
মনীষ বলল, তুমি বসতে বললে!
মনোরমা দরজার পাশ থেকেই বলল, কিন্তু তিনি বসলেন না। বললেন, ঠিক আছে আমি আবার আসব। হাতে আমার অনেক কাজ। দেরি করলে ক্ষতি হবে।
ইস! কী যে সুযোগ গেল! তারপরই মনে হল সে ছেলেমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। রসুল, রাম অবতার এরা কী যে করল, ওরা দেখতে পেল না কেন! না কী রসুল, রাম অবতার সবাই একসঙ্গে ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যেমন, শান্তির চাকরটা খেতে পেত না, ফুটপাথ থেকে তুলে এনে খেতে দিয়েছিল শান্তি, এখন সেই বেশ বড় বড় পা ফেলে হাঁটে। বাবুরা ভয় পেলে সে মজা পায়। এরা কী শান্তির চাকরের মতো এখন ওর বিপদে তামাশা দেখাচ্ছে। এখন কিছু করা যাবে না। সেই যে সময় এলে এক লাথি, শালা সব তখন উলটে পড়বে। মনীষ খুব নরম গলায় মনোরমাকে বলল, দেখতে কেমন!
রাজপুরুষের মতো দাদাবাবু। খুব লম্বা। চোখ বড়। চুল ঘন। রং একেবারে দুধে আলতায়। চোখে না দেখলে মানুষ এমন সুন্দর হয় কেউ বিশ্বাস করবে না।
মনীষ বলল, ও তারপর চলে গেল!
চলে গেল।
কীভাবে গেল।
কাঠের সিঁড়ি ধরে!
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেছিলে!
হ্যাঁ।
মানুষের পায়ের শব্দ!
একেবারে মানুষের মতো। মনোরমা দেখল, কেমন বলতে বলতে দাদাবাবু ভেঙে পড়ছে। অথবা অন্ধকার রাতে কোনো নিরিবিলি জায়গায় ভূত দেখলে যেমন মানুষ ভয় পায়, তেমনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে। চোখমুখের অবস্থা দেখে মনোরমার ভীষণ কষ্ট হতে থাকল। এত যার দাপট, নিমেষে, কী করুণ চোখ মুখ হয়ে যাচ্ছে। একেবারে গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন কেউ শুনতে না পায়।
মনীষ বলল, তুমি মানুষের পায়ের শব্দ চেনো!
চিনি বাবু।
শব্দটা হালকা ছিল, না দুপদাপ।
হালকা ছিল। খুব চিন্তিত মনে মানুষ সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমনি।
মনীষ বলল, তখনও বাথরুম থেকে সোমা বের হয়নি!
না।
তুমি তখন কোথায় ছিলে!
রান্নাঘরে।
রান্নাঘর থেকে শোনা যায়!
যায় বাবু।
লোকটা সিঁড়িতে নামতে নামতে তুমি রান্নাঘরে যেতে পার!
পারি দাদাবাবু।
কোথায় বসেছিল!
মনোরমা পার্লারে ঢুকে নীল রঙের একটা সোফা দেখাল।
মনীষ বলল, তুমি এখানে বসো।
মনোরমা ভেবে পেল না, দাদাবাবু এমন বলছেন কেন! ঠাট্টা করছেন না তো! তিনি তো কখনও ওর সঙ্গে ঠাট্টা করেন না, সে কেমন হতভম্ব। সে তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল।
কী বললাম!
দাদাবাবু আপনি এ—সব কী বলছেন!
ঠিক বলছি। তুমি বসো!
আমি কবে ওখানে বসেছি।
এখন থেকে তোমরাই ওখানে বসবে।
মনোরমা এখন কী যে করে! সে খুব সংকোচের সঙ্গে এগিয়ে গেল। দাদাবাবু পাগল হয়ে যাচ্ছে, সে ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বসল।
মনীষ বলল, লোকটা আগে বের হয়েছিল পার্লার থেকে, না তুমি।
তিনি ভিতরে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল, আমি গেলাম।
ঠিক আছে। এবারে তুমি আমায় পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটো।
মনোরমা পাগলের পাল্লায় পড়ে গেছে! নতুবা বাড়িটাতে এমনভাবে একটা উপদ্রব দেখা দেবে কেন। এঁরা কী যে হাসিখুশি ছিল, ক’দিনে বাড়ির চেহারা কী হয়ে গেল! যেন চেনা যায় না, কেউ কাউকে চেনে না। সবসময় কী এক ভয়াবহ দৃশ্য ঝুলে থাকে। সবসময় মনে হয় কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। কেবল সময় গুণে যাচ্ছে। যে—কোনো সময় দেখা যাবে, পার্লারে অথবা করিডোর অথবা বাগানে কেউ মরে পড়ে আছে। মনোরমা কথামতো পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল। সে সিঁড়ির দিকে গেলে সে দেখতে পেল, দাদাবাবু রান্নাঘরের দিকে ঠিক একজন মেয়ের যেভাবে হেঁটে যাবার কথা তেমনি হেঁটে যাচ্ছেন। সে এমন দেখে হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। সে শুধু যেমন একজন লোক এসে নেমে যায় সিঁড়ি ধরে তেমনি নেমে গেল।
এটা রান্নাঘর না বলে প্যান্ট্রি বলাই ভালো। প্যান্ট্রিতে ঢুকে মনীষ খুব সন্তর্পণে সেই পায়ের শব্দ শুনতে থাকল। নেমে যাচ্ছে। প্যান্ট্রিতে দাঁড়িয়ে সত্যি তবে শোনা যায়। মনোরমা কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। মনোরমা হুবহু ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ভাঙা রেকর্ডের মতো ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, সে দু—কানে হাত রেখে একেবারে সোজা ঘরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, মনোরমা নিচের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দাও। বাগানের দিকে রসুলকে পাহারা দিতে বল। রাম অবতার গেটে থাকুক। কেউ যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে!
এবং এমন চেঁচামেচিতে মনে হয় সোমা জেগে গেছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, মনীষ এমন করে চিৎকার করছে কেন। সহসা ঝড় উঠলে, যেমন ঘরের দরজা জানালা ছুটে ছুটে বন্ধ করে দিতে হয়, তেমনি মনীষ দরজা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, এটা করছে কেন মনীষ। এখন তো বেশ পরিষ্কার শীতের আকাশ। মনীষ এতক্ষণ কোথায় ছিল, সে কোথায় ছিল! সে তো বাথরুমে ছিল, তারপর, তারপর, হ্যাঁ মনে পড়ছে দুটো চোখ, তারপর তারপর, সে কী ভেবে বলল, তারপর কী মনীষ?
মনীষ দেখল সোমা একেবারে তাজা মেয়ের মতো বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। কে বলবে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। কে বলবে, বাড়িতে এমন তুমুল কাণ্ড ঘটে গেছে। কেউ এসেছিল, সোমার জন্য। সে কে! সোমা কি কাউকে আসতে বলেছিল!
মনীষ বলল, তুমি খাওনি সোমা!
তুমি খেয়েছ?
না।
দরজা জানালা বন্ধ করে রাখছ কেন!
একটা লোক এসেছিল। তুমি তখন বাথরুমে ছিলে।
সে কোথায়!
চলে গেছে।
তাকে চলে যেতে দিলে কেন!
আমি কি বাড়ি ছিলাম! এসে শুনলাম।
দরজা জানালা খুলে দাও। লক্ষ্মী আমার। দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলে শ্বাস ফেলতে পারি না, কেমন কষ্ট হয়।
কিন্তু সে যদি আসে!
এলে তাকে বসতে বলবে।
মাই গড। পুলিশে খবর দেব না?
পুলিশে খবর দিতে নেই। শোনো।
মনীষ কাছে এগিয়ে গেলে সোমা বলল, তুমি ভালো হয়ে যাও। ভালো হলে আমাদের কোনো আর ভয় থাকবে না। না হলে তুমি পাগল হয়ে যাবে মনীষ। আমিও।
মনীষ বলল, আমি কি ভালো হব?
মানুষের অনিষ্ট করে টাকা কামিয়ো না।
মনীষ হাসল। মেয়েমানুষের মতো কথা। সে অবশ্য খুলে কিছু বলল না। কেবল বলল, ভাবা যাবে। এখন তো আমরা দরজা জানলা বন্ধ করে থাকি।
সোমা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মনীষের ভিতর এক পাপ, টাকার পাপ, অথবা লোভ, চারপাশ থেকে এই বাড়ি, ফুল ফল বাগান ঘিরে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, মনীষ আর ইচ্ছে করলেও বোধহয় সরে আসতে পারে না। কিন্তু সোমা বুঝতে পারে এ—ভাবে বাঁচা যায় না। সে উঠে দরজা জানালা খুলে দিতে থাকল। বলল, হাওয়া আসতে দাও।
মনীষ বুঝতে পারল না কী করবে। সে খুব একটা জোরজারও করতে পারে না। সেদিন কেন যে মরতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, আর সেই থেকে এক এক করে উপদ্রব। এবং মনে হয় এ—ভাবে চললে, ভয়ে সে নিজেই আত্মহত্যা করে বসবে। সে বলল, সোমা, আমরা কিন্তু কেউ খাইনি।
এই খাবার নাম শুনলে, অথবা মনীষ খায়নি শুনলে একটু স্বাভাবিক মুখ হয়ে যায় সোমার। সে টেবিলে বসে বলল, এসো।
ওরা দুজনে মুখোমুখি চুপচাপ খেতে থাকল। আজ যত টেলিফোন এসেছে সবার কাছে এক জবাব, মিস্টার দত্ত বাড়ি নেই। মিসেস দত্ত বাড়ি নেই। ওরা বাড়ির ভিতরই ক্যামোফ্লাইজ করে থাকবে ভাবল। কিন্তু বিকেলের দিকে একটা ফোন এল, ফোনে কে একজন কথা বলবেই। যত রসুল বলল, সাহেব বাড়িতে নেই, তত জেদ। বলছে, আমি জানি আছে, তুমি দাও। লাইনটা ওপরে দেবে কী না ভাবছে রসুল। সে যত বলছে, সাহাব নেই, তত সে বলছে, আছে, আমি জানি আছে। আমার সঙ্গে নেই বলে কী হবে!
আর লাইনটা দিয়েই রসুল, সাহাব, বাবুজী বলছে, আপনি আছেন ওকে নেই বলে কিছু হবে না!
মনীষের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। হাত ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে কথা বলতে পারছে না দেখে তাড়াতাড়ি ফোন সোমা কেড়ে নিল। বলল, হ্যালো, কে আপনি।
বিনু বলছি।
বিনু! কেমন কিছুক্ষণ ফোনের ওপর সোমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না। বিনুর গলা, যেন অনেক দূর থেকে কেউ অভয় দেবার মতো কথা বলছে। এবং বিনু খুব সহজে বলে গেল, মনীষের শরীর কেমন!
সোমা ভেবে পেল না, এমন সব কথা বিনু বলছে কেন? সে বলল, ভালো। ভালো বলেও নিস্তার নেই, আর ভেবে পেল না বিনু কুশল নিচ্ছে কেন! বিনু তো কতদিন হয়ে গেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর আর মনীষের কুশল নেয়নি। বিনুর ভাই, কী যেন নাম, এখন সুখী রাজপুত্র, স্বপ্ন দেখছে, পৃথিবী পালটে দেবে, সেই কী খবর দিয়েছে, দাদা তোমার বন্ধুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে খবর নেবে। সোমা বলল, হঠাৎ এ—কথা বললি কেন?
হঠাৎ নয়তো! মনে হল তোদের কিছু হয়েছে। আমাদের খুলে বলছিস না। তুই চলে যাবার পর এটা আমার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, তোর কথাবার্তা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। তারপরই ভাবলাম তোকে একটা ফোন করি, তুই কেমন আছিস, মনীষ কেমন আছে?
সোমা বলল, ও! আমরা ভালোই আছি।
বিনু বলল, আমরা ভালো নেই। ভাইটি আমার ধরা পড়েছে। তবে ভাগ্য আমাদের, গুলি করেনি পুলিশ। তবে যা মেরেছে, ওর আর জীবনে কিছু করে খেতে হবে না।
কবে হল এটা।
তুই যাবার পরই খবর এল। আমরা গেলাম। আসলে সে বেশ ক’দিন আগেই ধরা পড়েছে। আমরা জানতাম না। দেখামাত্রই গুলি—এই নির্দেশ ছিল পুলিশের। যখন জানতে পারলাম, না তা হয়নি, প্রাণে বেঁচে গেছে, তখন সোমা, তোকে কী বলব, কী যে আনন্দ আমাদের। মা এখন আর দুঃখী না। জেলে আছে, আর কিছু হবে না এমন ভেবেছে। জেলেও অবশ্য ঠিক নেই। ওদের মেডিকেল ওয়ার্ডে আছে। দেখে এলাম। পাশ ফিরতে পারছে না। তবে বাঁচবে, মরবে না। ওরা তো এত সহজে মরে না!
কেন মরে না!
মরবে কী, ওরা তো বারবার এ—ভাবে মার খায়।
মার খেয়েও বাঁচে।
তা বাঁচে বোধহয়। না হলে এ—সব হচ্ছে কী করে!
সোমার ভালো লাগছিল না! মনীষ বুঝতে পারছে না এমন অন্তরঙ্গভাবে সোমা কার সঙ্গে কথা বলছে! একবার বলছিল সোমা, বিনু! বিনুর সঙ্গে তবে কথা বলছে! কিন্তু বিনুর সঙ্গে কথা বললে, সোমার তো এ—ভাবে কথা বলার স্বভাব না। কেমন অপরিচিতের মতো কথা বলছে, আসলে কী সেই লোকটা কখনও সোমার কাছে বিনু হয়ে যায় অথবা অশোক, অথবা অঞ্জন। সেই লোকটা কী পৃথিবীর সব ভালো কথা বলে বেড়ায়। সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র এবং আবাসের ব্যবস্থা থাকবে। সেটা তো ভালো কথা। সেটা তো সেও চায়। সব মানুষ সুখে থাকুক। কিন্তু সব মানুষ যখন সুখে থাকতে পারে না, তখন সে একা কী করতে পারে। সব মানুষের জন্য যখন সব থাকে না, কিছু কিছু মানুষের জন্য যখন সব থাকে, তখন তাকে বাধ্য হয়ে কিছু মানুষের দলে ভিড়ে যেতে হয়। সে বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?
বিনুর সঙ্গে।
বিনু কথা বলছে!
হ্যাঁ।
কী বলছে?
বলছে, তুমি কেমন আছো?
তবে আমাকে দাও, আমি কথা বলছি।
সোমার হাত থেকে মনীষ ফোন তুলে নিল। বলল, কীরে ব্যাটা বিনু! খুব উৎফুল্ল দেখাতে চাইল। সেদিন দেখা হবার পর যে ওদের বাড়িতে একটা ভয়ংকর কাণ্ড রাতদিন জেঁকে বসেছে, সেটা সে কথাবার্তায় একেবারে বুঝতে দিল না।
বিনু বলল, সোমা সেই লোকটাকে খুঁজে পেয়েছে!
মনীষ কী বলবে বুঝতে পারল না। সে সোমার দিকে তাকাল। সোমা চোখ টিপে বলল, বলে দাও, পাওয়া গেছে।
মনীষ বলল, পাওয়া গেছে!
যাক তবে নিশ্চিন্ত সোমা।
মনীষ তাকাল সোমার দিকে। সোমা বুঝতে পারছে না কী বলবে। ফোনের মুখে হাত রেখে বলল, বলছে, যাক তবে নিশ্চিন্ত!
বলে দাও, নিশ্চিন্ত।
মনীষ বলল, নিশ্চিন্ত।
বিনু এবার বলল, কে লোকটারে?
মনীষ কী বলবে! সে বলল, দাঁড়া জিজ্ঞেস করি! সে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল, কে লোকটা জিজ্ঞেস করছে!
সোমা বলল, সে আছে।
মনীষ বলল ফোনে, সে আছে।
বিনু বলল, জিজ্ঞেস কর তো আমরা তাকে চিনি কি না?
মনীষ বলল, বিনু জিজ্ঞেস করছে, আমরা তাকে চিনি কি না!
সোমা বলল, না।
মনীষ বলল, না। আমরা কেউ তাকে চিনি না।
বিনু বলল, ভালো কথা না।
নিশ্চয়ই না।
বিনু বলল, সেই লোকটাই যত নষ্টের গোড়া।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
সোমা কেন যে এ—ভাবে ঘুরে বেড়ায় বুঝি না!
আমিও না।
তারপর দুজনই চুপচাপ।
বিনু বলল, শুনেছিস!
কী!
বড়বাজারে হুজুরিমল আগরওয়ালের গলা কেটে দিয়েছে। একেবারে দিনের বেলা হাজার লোকের সামনে। তিন চারটি ছেলে এল। বলল, আপনারা যে যার কাজ করে যান। এদিকে তাকাবেন না। লোকটিকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করেছি। বলে গোটা চারেক বোমা। ব্যাস ট্রাম বাস বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা। দেখা গেল হুজুরিমল রাস্তায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। অত বড় ভুঁড়ি নিয়ে পড়ে আছে যে দেখলে পর্যন্ত কুৎসিত লাগে। পৃথিবীর সবকিছু বেনামিতে লোকটা গিলতে চেয়েছিল। ওরা ঠিক টের পায়। ভালোই হচ্ছে। একদিকে এটা তার কাম্য ছিল। না হলে শালা এই ভারতবর্ষের লোক মানুষ হবে না। এমন অসাম্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানি না। কিছু লোক কেবল ক্রমাগত বড় লোক হচ্ছে,…হচ্ছে…হচ্ছে। সেই ভাঙা রেকর্ডের মতো গলা। কিন্তু আশ্চর্য বিনু ফোনে হাঁ হুঁ শুনতে না পেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। বলল, এই শুনছিস!
হ্যাঁ।
শুনতে পাচ্ছিস। আমি কী বললাম, শুনতে পাচ্ছিস!
হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।
কিছু বলছিস না কেন?
কী বলব!
তোর কী মত!
আমার মত, এভাবে কি সমস্যা সমাধান হবে!
সমস্যা সমাধান কথাটা যেন ভীষণ লম্বা কথা। ভাগে ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। অনেক লম্বা অঙ্ক। অনেকবার, বারবার কষে কষে দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। এবং এ—জন্য বোধহয় ওরা দুজনই চুপচাপ ফোনের দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না।
সোমা আর থাকতে না পেরে বলল, বিনু এত কী বলছে!
মনীষ বলল, একদিন আসিস।
যাব।
ছাড়ছি।
আচ্ছা।
ওরা দুজনেই ফোন ছেড়ে দিল।
কিছু বলছ না যে?
মনীষ সোফাতে গা এলিয়ে দিল। আসলে ও আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর হাত—পা কাঁপছিল। সে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বোধহয় পড়ে যেত। সে বলল, কিছু না।
কিছু না মানে।
কিছু না মানে কিছু না।
সোমা অধৈর্য গলায় বলল, এতক্ষণ কেউ কিছু না বলে থাকে না।
এখন এ—সব কথা ওর বলতে ভালো লাগছে না। সব ব্যাপারটাই ভীষণ গণ্ডগোলের। সে অবিশ্বাসের চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
এমনভাবে কী দেখছ আমার!
আচ্ছা সোমা, সত্যি কি তুমি সেই চোখ দুটোর খবর পেয়েছ!
সোমা হেসে দিল। বলল, বলতে হয় বলা।
মনীষ তবু বিশ্বাস করতে পারল না সোমাকে। সবাই কী তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই বলল, সোমা, সে ওকে দেখেছে। সে বুঝতে পেরেছে লোকটা কে! অথচ এখন বলছে, বলতে হয় বলা। সেও আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারছে না। হুজুরিমল কি সব জেনে ফেলেছিল। ওর সংসারেও কি এমনভাবে একটা লুকোচুরি খেলা, ঠিক ডেথ ডেথ খেলার মতো ব্যাপার ঘটেছে! সে চিৎকার করে বলল, ঠিক তুমি ওকে খুঁজে পেয়েছ। আমার কাছে এখন তুমি মিথ্যা কথা বলছ!
কীসে কী যে হয়ে যায়! সোমা বলল, সত্যি বলছি, আমি জানি না। বিনুর এত ঔৎসুক্য আমার ভালো লাগছিল না। এ—জন্য বলছি সে আছে।
মনীষ আর পারছে না। সে আবার চিৎকার করে বলে উঠল, এখানে আর থাকছি না। আমি ঠিক পালাব।
এবং সে রাতেই মনীষ কলকাতা ছেড়ে একা পালাল। কাউকে কোনো ঠিকানা দিয়ে গেল না। সোমা সকালে সবাইকে ফোনে জানাল, গতকাল থেকে মনীষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এখন কী যে করি!