Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুঃসময়ে মুখোমুখি || Shamsur Rahman

দুঃসময়ে মুখোমুখি || Shamsur Rahman

বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুমি, চলে যাও, চলে যাও সেখানে
ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড় ব্যস্ত
এখন তোমার সঙ্গে, তোর সঙ্গে বাক্যলাপ করার মতন
একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে
কষ্ট পাবি বল?

না, তোকে বসতে বলব না
কস্মিনকালেও,
তুই যা, চলে যা।
দেখছিস না আমার হাতে কত কাজ, দু’-ঘণ্টায় পাঠক-ঠকানো
নিপুণ সম্পাদকীয় লিখতেই হবে, তদুপরি
আছে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় দেশ-বিদেশের বহু চিঠির জবাব
এবং প্রুফের তাড়া নিত্য-নৈমিত্তিক
কবিতার সোনালি তাগিদ।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য কিছু ঘণ্টা
বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আমার সময় প্রতিদিন
সুমিষ্ট পিঠের মতো
ভাগ করে নিয়মিত খাচ্ছে হে সবাই।
তোর সঙ্গে বাক্যালাপ করার মতন, বাচ্চু তুই
বল তো সময় কই? কতক্ষণ থাকবি দাঁড়িয়ে,
রাখবি ঝুলিয়ে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি?
তুই তো নাছোড় ভারি, গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে
এক্ষুণি চলে যা
শরৎ চক্কোত্তি রোডে, ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে।
চকোলেট দেব তোকে, দেব তালশাঁস,
তুই যা, চলে যা।
অবুঝ তুই না গেলে আমার সকল কাজ রইবে প’ড়ে।

পাশের বাড়ির তেজপাতা-রঙ বুড়িটার ঘরে
মাঘের সকালে
মায়ের কল্যাণী হাতে-বোনা হলদে সোয়েটার প’রে
যেতাম কিনতে পিঠা মোরগের ডাক-সচকিত
চাঁপা ভোরে, তোর মনে নেই?
মেহেরের সঙ্গে, নতুন মামির সঙ্গে নানির সাধের
আচারের বৈয়ম করেছি লুট দুপুর বেলায়,
তোর মনে নেই?
চকবাজারের ঘিঞ্জি গলির কিনারে
ম্যাজিকঅলার খেলা দেখেছি মোহন সন্ধেবেলা,
তোর মনে নেই?
মিছিলে নাদিরা ছিল, আমি তাকে দেখে চটপট
মিছিলের আলো নিতে হলাম আগ্রহী, চৌরাস্তায়
সুদিনের জন্যে ব্যগ্র দিলাম শ্লোগান অবিরাম,-
তোর মনে নেই?
আমিও সাঁকোর ধারে গোধূলি বেলায়, সঙ্গী পিতা।
চকিতে অদৃশ্যে সাঁকো, জায়গাটা ভীষণ ফাঁকা, খাঁ-খাঁ
মনে হল, যেমন অত্যন্ত শূন্য লাগে ক্যানভাস
চিত্রকর ফেললে মুছে ভুল ছবি তার।
চিকন দিগন্তে হাম্বা রব, বলুন তো পাড়াতলি কতদূর?
সঙ্গে তিনি, হেঁটে যেতে যেতে দিতেন ফুলের নাম বলে;
বলতেন ঐ যে ছোট্র খরগোশ, অনেক দূরের বিল থেকে
সদ্য-আনা শিকারের বোঝাটা নামিয়ে
রঙবেরুঙের পাখিগুলো
শনাক্ত করতে ভিন্ন ভিন্ন নামে কী যে মজা পেতেন শিকারি।
দীর্ঘকাল সত্যি আমি মসজিদে যাইনি, শৈশবে
বাজান যেতেন নিয়ে হাত ধরে মনে পড়ে। ইমামের সূরা
অবোধ্য ঠেকত বলে ঝাড়লণ্ঠনের
শোভা কিংবা দেয়ালে শোভন লতাপাতা, ঠাণ্ডা টালি
দেখে, হৌজে রঙিন মাছের খেলা দেখে
কাটত সময় মসজিদের, তোর মনে নেই?
কখনো ঝড়ের রাতে উথালপাথাল রাতে, ব্যাকুল বাজান
দিতেন আজান, যেন উদাত্ত সে স্বর রুখবেই
অমন দামাল ঝড়, বাঁচাবে থুত্থুড়ে ঘরবাড়ি-তোর মনে নেই?
কী বললি? এসেছিস দেখতে আমাকে?
এখন কেমন আছি? কত সুখে আছি? নাকি তুই
চতুর ছুতোয়
আমার ইন্টারভিউ নিতে চাস এতদিনে পর?
চিঠির খামের গায়ে আমার নামের আগে ‘জবান’ দেখে কি
তোর খুব পাচ্ছে হাসি? শোন,
আমি শামসুর রাহমান, মানে ভদ্রলোক, দিব্যি
ফিটফাট, ক্লিন গাল ব্লেডের কৃপায়
আর ধোপদুরস্ত পোশাকে
এখানে-সেখানে করি চলাফেরা বড় ঝলমলে
সামাজিকতায় ভরপুর,
কখনো উদাস ঘুরি চোরকুঠরিতে।
আমি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক, ক্ষিপ্র ভাষ্যকার;
আমি শামসুর রাহমান, মানে কি…
আইডিয়াভিযানে আমিও
কখনো সমুদ্রে ভাসি, পর্বতশিখরে আরোহণ
করি কখনোবা, পার হই রুক্ষ মরুভূমি, মেরুপথে পুঁতি
আপন নিশান।
একটি অদ্ভুত ঘোড়া আমাকে পায়ের নিচে দ’লে
চলে যায় দূরে তার কেশর দুলিয়ে,
কখনো শিকার করি, হরিণ শিকার করি ঘরে।
আমার অ্যানিমা স্বপ্নে সুদর্শনা হয়ে
আমাকে অনেক কাছে ডাকে মত্ত নদীর ওপারে। আমি তার
সান্নিধ্যের লোভে
আপ্রাণ সাঁতার কাটি। তীরে প্রেতভূমি, সুদর্শনা
অকস্মাৎ পেঁচা হয়ে উড়ে যায়। নদী পেরুনোর
শক্তি লুপ্ত, কেমন তলিয়ে যাই পরিণামহীন।
চিনতিস তুই যাকে, সে আমার মধ্য থেকে উঠে অন্তরালে
চলে গেছে। তুই বাচ্চু, তুই বড় ছেলেমানুষ, অবুঝ।
কী বললি? শামসুর রাহমান নামক ধূসর
ভদ্রলোকটির
সমান বয়সী তুই? তবে কোন ইন্দ্রজালে আজও
অমন সবুজ র’য়ে গেলি, র’য়ে গেলি এগারোয়া হাঁ রে?
এই যে আমাকে দ্যাখ, ভালো করে দ্যাখ, দ্যাখ
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে-
আমার জুলফি সাদা দীর্ঘশ্বাসে ভরা, দন্তশূলে
প্রায়শ কাতর হই, চশমার পাওয়ার
দ্রুত যাচ্ছে বেড়ে…
এখন এই তো আমি, ব্যস্ত অবসন্ন, বিশ্রামের
নেই মহলত।
উজার মাইফেলের প্রেত ঘুরি হা-হা বারান্দায়।
এখন আমিও খুব সহজে ঠকাতে পারি, বন্ধুর নিন্দায়
জোর মেতে উঠতে লাগে না দু-মিনিটও; কখনোবা
আত্মীয়ের মৃত্যুকামনায় কাটে বেলা, পরস্ত্রীর
স্তনে মুখ রাখার সময় বেমালুম ভুলে থাকি
গৃহিণীকে। আমাকে ভীষণ ঘেন্না করছিস, না রে?
এখন এই তো আমি। চিনতিস তুই যাকে সে আমার
মধ্য থেকে উঠে
বিষম সুদূর ধু-ধু অন্তরালে চলে গেছে। তুইও যা, চলে যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress