Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দীন-ইলাহি || Swapnamoy Chakraborty

দীন-ইলাহি || Swapnamoy Chakraborty

জীবন পাত্র রেডিয়োতে চাকরি করেন। গতকাল মেমো খেয়েছেন। এখন সিগারেট খাচ্ছেন। টেনশনে খান। কমিউনাল হারমনির উপর একটা প্রোগ্রাম এক মাসে তিনবার বেজেছে। প্রোগ্রামটা জীবনবাবুরই করার কথা। কারণ পাকেচক্রে প্রোগ্রাম অফিসার হয়ে গেছেন উনি। দিব্যি ছিলেন বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে, যুদ্ধ থামলে একসেস, তখন রেডিয়োতে চালান দিল। তারপর রিটায়ার করার আগে প্রমোশন। এবার বানাও প্রোগ্রাম, পোষায়? আগে দেখতেন সংস্কৃত প্রোগ্রাম। নর শব্দের দ্বিতীয়ার একবচনটাই ‘নরম’ বলে আজও মনে আছে, আর শক্তগুলো সবই ভুলে মারা হয়ে গেছে। একজন সংস্কৃত প্রফেসারের, হেলপে চলে যাচ্ছিল কোনওরকমে, গতমাসে ঘাড়ে চেপেছে ন্যাশনাল ইনটিগ্রেশন আর কমিউনাল হারমনি!

ন্যাশনাল ইনটিগ্রেশন নিয়ে নো প্রবলেম। কত পি ভি এস মানে পেট্রিয়টিক ভোকাল সং আছে, আর এই সাবজেক্টের রিসোর্স পার্সন তো বাম-ডান-মধ্যপন্থী নির্বিশেষে পাড়ায় পাড়ায়, খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল না, কমিউনাল হারমনির আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান— রবীন্দ্রনাথের, সরি, সরি, নজরুলের ওই কবিতাটা পার্থ ঘোষকে দিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ওটারই গায়ে গায়ে ছোন্নত করলে হয় মুসলমান নারীলোকের কী হয় প্রমাণ বাজিয়ে দিলে তিনে চারে সাত মিনিট খেয়ে গেল, বাকি আট মিনিট হাজী গোলাম আহমেদ আর ব্যোমকেশ ভট্টাচার্যের টক (Talk) দু’জনেই এম এল এ-চার চার মিনিট করে বাজিয়ে দিলেই, ব্যস হয়ে গেল। এটাই বাজিয়ে ছিলেন তিনবার। শালা রিপোর্ট হয়ে গেছে।

জীবনবাবু নতুন একটা প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করছিলেন। অনেক সিগারেট পুড়ছিল। স্কুল ফাইনালে আকবরের চরিত্র সংক্ষেপে লিখে ঝাড়া মুখস্থ করেছিলেন। সম্রাট আকবর হিন্দুধর্ম, ইসলাম, জৈন, বৌদ্ধ ইত্যাদি সকল ধর্মের সার লইয়া এক অপূর্ব নতুন ধর্মের চিন্তা করিয়াছিলেন, তাহার নাম দিয়াছিলেন দীন-ইলাহি। দীন-ইলাহি নিয়ে কিছু করা যায় কি না, এ নিয়ে পাশের টেবিলের কিংশুক ভদ্রের সঙ্গে, কিংশুক নতুন এসেছে, ডাইরেক্ট ইউ পি এস সি—একটু আলোচনা করছিলেন, ছেলেটি তখন ওর ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বার করে দিল, তা হলে এটা নিন জীবনদা, একটা গল্প আছে , পড়ে নিন, অনেকগুলো কমিউনাল হারমনি বানাতে পারবেন।

[ওটা অফিসে পড়েননি জীবনবাবু। আজ ছুটির দিন, বাড়িতে পড়ছেন। বউকে ডাকলেন উনি—মাধুরী—এক কাপ চা। ওদের স্বামী-স্ত্রীর নামের মধ্যে যে এত ভাব লুকিয়ে আছে রেডিয়ো না হলে উনি জানতেই পারতেন না। দিনরাত গান হয়, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান’। গল্পটা শুরু করে জীবন পাত্র। গল্পের নাম ‘দীন-ইলাহি’।]

নুরুল বলল যাদবপুর। দশ টাকার একটা নোট দিল। কন্ডাক্টার কুড়ি পয়সা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, টাকা পরে দিচ্ছি। নুরুল বলল, টাকা পরে দিচ্ছি মানে? তা হলে তো টিকিটটাও পরে করলেই হত। কন্ডাক্টার বলল, কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না? নুরুল বলল—না, হচ্ছে না। কন্ডাক্টার বলল, মিনিবাসে নতুন উঠছেন নাকি? নুরুল বলল, এক থাবড়া মেরে মুখ ভেঙে দেব।

[সব শালার মাথা গরম। হবে না? কেমিকাল সার। এখন বর্ষায় টমেটো-কড়াইশুঁটি, শীতে পটল-ঝিঙে, সারা বছর ধনেপাতা হচ্ছে কী করে? সব সারে। কেমিকাল সারে। ওই সারের জিনিস, মাদার ডেয়ারি মানে তো কেমিকাল দুধ, খাচ্ছে সব, মাথাটা গরম হবে না?]

আসলে নুরুলের মেজাজ খুব খারাপ। একটা ঘর খুব জরুরি। দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স চাইল, ভাবা যায়? পকেট থেকে একটা হ্যান্ডবিল বার করল নুরুল। ঘর ভাড়া। গড়িয়া হইতে সোনারপুরের মধ্যে উত্তম উত্তম ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় দুই কামরার ফ্ল্যাট ৭০০্, দক্ষিণ খোলা, একতলায় ৬০০্, ইহা ছাড়া উপরে অ্যাসবেসটাস ছাদ, রান্নাঘর, টিউবল, সেঃ পায়খানা যুক্ত ৫০০্, সত্বর যোগাযোগ করুন—চিত্তর পানের দোকান, রামগড়ের মোড়। দালালের পাল্লায় পড়তে চায় না, বড় হুজ্জোত হয়। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির গেটের সামনেই স্বাতী দাঁড়িয়ে ছিল। নুরুলকে দেখেই জিজ্ঞাসা করল, বৈষ্ণবঘাটা দেখে এলে? নুরুল বলল—ভোগাস। দশ হাজার। চলো চা পেঁদিয়ে আসি।

[হিন্দু মেয়েটাকে নিয়ে মুসলমান ছেলেটা থাকবে নাকি? ঘর চায় কেন? বিয়েও করেছে নাকি?—বাঙালি ঘরের মেয়েগুলো যা হচ্ছে না আজকাল!]

নুরুল বলল, আজ শুধু চা খেয়েই ফুটব। গ্যাঁজানোর সময় নেই, ডিউটি আছে।

নুরুল কলকাতা টেলিফোনে কাজ করে।

[ওঃ, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট সারভেন্ট? তবে কোয়ার্টারের চেষ্টা করছ না কেন? সাঁতরাগাছিতে একগাদা কোয়ার্টার হয়েছে, এস্টেট ম্যানেজারকে লিখতে পারো। বে-জাতে প্রেম করছ, এসব খবর রাখো না?]

নুরুল অফিসে ঢুকতেই একজন মাঝবয়সি দাদা বলল, এই যে ‘কাটা’ এসে গেছ? তখন একজন মহিলা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মুখ টিপে হাসল। উনিই অবিনাশদা। নুরুলকে খুব ভালবাসেন। নুরুলকে কাজ শিখিয়েছেন। ক্যান্টিনে রাতের খাবার বলতে গেল নুরুল। রাতে বিষ্টুবাবু থাকেন। কী তরকারি হচ্ছে? না আলুপটলের। এক তরকারি এক মাস ধরে হচ্ছে, যেন মেশিনে তৈরি। সেম স্বাদ, সেম ভিসকোসিটি, সেম স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি, সেম ফ্লুয়িডিটি। ছ’ মাস আগে, নুরুল যখন এক্কেবারে নতুন, রাতের খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে ছিল, বিষ্টুবাবু নাম জিজ্ঞাসা করেছিল, ও বলেছিল লিখুন টেকনিকাল অ্যাসিসট্যান্ট। বিষ্টুবাবু বলেছিলেন, টি এ তো , এখানে অনেকেই আছে নাম বলুন। ও গলাটা একটু নামিয়ে বলেছিল, নুরুল আলম। গলাটা নামাল কেন নুরুল? নাম বলতে কীসের লজ্জা? কীসের অপরাধ বোধ? এটা সেকুলার স্টেট না? বিষ্টুবাবুর অ্যাঁ? শব্দের সঙ্গে কপাল রেখার কুঞ্চনে নুরুল যে-অর্থ পায়, তার প্রতিক্রিয়ায় ও দ্বিতীয়বারে তীব্র উচ্চারণে জানায়, নুরুল, নুরুল আলম। বিষ্টুবাবু বলেন, ও। নতুন ভরতি হলেন বুঝি, আচ্ছা ঠিক আছে। এখন রাত্রের ডিউটি হলেই নুরুল যে-প্লেটটা পায় তার মাঝখানে গোলাপ ফুলের ছবি, তার মানে এই নয় যে ক্যান্টিনের সব প্লেটেই গোলাপের ছবি মারা।…ঠিক আছে। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে মন খারাপ করলে চলে না।

ট্রানসফরমারের একটা ফিউজ উড়ে গেছে, দুটো ট্রানজিস্টার পালটাতে হবে। আর-একটা রেজিসট্যান্স পালটানো দরকার ছিল, রেজিসট্যান্স বোর্ডে একটা ছোট কমপ্ল্যানের কৌটো মারা আছে। অবিনাশদা, অবিনাশ মজুমদারের ব্রেন। ‘বেল’ থেকে রেজিসট্যান্স কবে আসবে ঠিক নেই। কৌটোটার ‘ওমস’ এখানে ট্যালি করে গেছে। ওটা লুজ হয়ে গিয়েছিল বলে সোলডারিং করছিল নুরুল, তখন বিজনদা বলল, কী, বাড়ি পেয়েছ?

ধুর! কোথায় বাড়ি? পাচ্ছি না।

বউ কোথায়?

বাপের বাড়িতে।

মিট করছ? চোখ টিপল বিজনদা।।

খুব অসুবিধে। ওদের বাড়িতে থাকা যায় না। স্বাতীদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, বাড়িতে নারায়ণ আছে, স্বাতীর দাদু রোজ পুজো করেন।

সিগারেট আছে?

পাউচ আছে। বানিয়ে দিচ্ছি।

বানাও একটা, ছেড়েই দিয়েছি, এই বৃষ্টির জন্য একটা ইচ্ছে করছে , থুথু লাগিয়ো না, আমিই জুড়ে নিচ্ছি।

তা তো নিশ্চয়ই, আপনিই জুড়বেন।

বাড়ি আছে একটা, কেষ্টপুরে, আমার জামাইবাবুর দাদার। খুব মাই ডিয়ার লোক। ওরা গভর্নমেন্ট সার্ভিসের লোক চাইছে, ট্রান্সফারেবল প্রেফারড।

আমাদের দেবে তো? না, মানে আমি তো ইয়ে, মানে…

ধুস। ওদের ওসব প্রেজুডিস নেই , একবার আমার সঙ্গে বিফ পর্যন্ত খেল।

[বিফ বাদ। ১৫ মিনিট প্রোগ্রামের পক্ষে এই পর্যন্তই এনাফ। ওরা ঘর পেয়ে যাবে, বিজনের জামাইবাবুর দাদা বলবে, ওয়েলকাম ওয়েলকাম, অমনি সেতারে ধুন বাজিয়ে দেব, সুপার ইমপোজে দিলীপ ঘোষের ভয়েস যাবে, এইভাবেই দূর করতে হবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভেদাভেদ। আস্তে আস্তে ফেড ইন হবে— ‘এস হে আর্য এস অনার্য হিন্দু-মুসলমান। শক হুন দল…’ হুন কি চিনের লোক? তবে থাক। ‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর—’ সে দ্যাখা যাবে। বাকিটা পড়েই ফেলি।]

বিজনের জামাইবাবুর দাদার বাড়িটা বাসরাস্তা থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে। একটা খালের ধারে। স্বাতীও সঙ্গে ছিল। ও বলল, কত গাছপালা! ও বলল, খালের জল কোথায় যায়? নুরুল বলল, সাগরে। যাতায়াত করতে পারবে তো স্বাতী, যাদবপুর? স্বাতী বলল, একবার তো পালটাতে হবে খালি। বাড়িটার নাম স্বপ্নপুরী। প্লাস্টার হয়নি। ভদ্রলোক ছিলেন না , ইউনিয়নের মিটিং চলছে পুরীতে। ভদ্রমহিলা এলেন, চুলে লক। নুরুল বলল—বিজনদা পাঠিয়েছেন, ঘরভাড়া দেবেন শুনলাম।

আমরা তো গর্ভনমেন্ট সার্ভেন্ট ছাড়া…

আমার গর্ভনমেন্ট চাকরি, বিজনদার সঙ্গেই…

অ, এসো, বসো , তুমি করেই বলছি ভাই, মেয়েটি বউ তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই।

বিয়ে হয়ে গেছে না হবে?

না, না, হয়ে গেছে।

বেশ ভাল, বেশ লাকি বউ হয়েছে ভাই, তবে সামান্য হলেও একটু সিঁদুর ছুঁইয়ে রেখো। কিছু মনে কোরো না যেন, এটা বাঙালির কালচার? কী নাম গো?

স্বাতী। স্বাতী মজুমদার।

কদ্দিন বিয়ে হল?

পাঁচ মাস।

তুমিও চাকরিবাকরি করো নাকি?

রিসার্চ করি, কিছু টাকা স্কলারশিপ পাই।

ডক্টরেট হবে?

হতেও পারি, যদি…

সব সেপারেট, জল, কল, পায়খানা…

দেখব?

দেখতে পারো, তবে আমি ভাই হই-চইটা খুব পছন্দ করি, ওই যে সেপারেট সিস্টেমে একেবারে মুখ গুঁজে সেপারেট হয়ে রইলে, আমাদের সেটা একেবারে ভাল লাগে না।

নুরুল দেখল লেবেল খসানো ওল্ডমংকের খালি বোতলে মানিপ্ল্যান্ট, বিয়ারের বোতলে জল, বোতলের গায়ে জলবিন্দু।

নুরুল বলল—সে তো ভাল কথা, আমরাও হই-চই করব।

ঘরটর দেখল ওরা। ভাড়া? মার্কেটের চেয়ে ৫০্ কম ছাড়া বেশি নয়—তা উনি আসুন, ফাইনাল বলে দেবে। অ্যাডভান্স? মাত্র তিন মাসের, তবে, দু’বছর পর ছেড়ে দিতে হবে কিন্তু। স্বাতীর মুখে হাসি ফুটল। সামনের সপ্তাহে এসে একদিন ফাইনাল করে যাওয়া যাবে।

নামটা তো জানা হল না ভাই, নুরুলকে জিজ্ঞাসা করে ভদ্রমহিলা।

নুরুল আলম।

সেকী? মো-মো-মো—

হুঁ।

অদ্ভুত, বিজনটা অদ্ভুত। হাওয়ায় ফোঁড়ানো চাপা স্বগতোক্তি। তারপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। এ সময় স্বাতীই বলল—তা হলে বোধ হয় ঘরটা আর…ভদ্রমহিলা স্বাতীকে বলল—শোনো, একটু এদিকে এসো। ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন উনি, তারপর বললেন, দ্যাখো, একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না, শিক্ষিত হতে পারো কিন্তু রুচিটা খুবই খারাপ। মুসলমান বিয়ে করলে? জানো না ওরা আমাদের কীরকম মেরেছিল। কী না অত্যাচার করেছে…তাড়িয়ে দিয়েছে..

স্বাতী কথা বাড়ায়নি, চলে এসেছিল।

স্বাতীরা দেশ ভাগ দেখেনি, দাঙ্গা দেখেনি, যুদ্ধও দেখেনি ঠিকমতো। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের সাইরেনের শব্দ আর ঠুলি পরানো রাস্তার আলো খুব আবছাভাবে মনে পড়ে। আচ্ছা ওই বাড়িওলি ভদ্রমহিলাও কি দেশ ভাগ দেখেছে? ওঁর বয়স দেশ ভাগ দেখার মতো নয়।

স্বাতী যখন এসব বলছিল নুরুলকে, নুরুল বলেছিল, মানুষ সহজে ভোলে না। সেই কবে পৃথিবীতে হিম যুগ এসেছিল, প্লাবন হয়েছিল, সেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ তাঁদের মিথলজিতে, তাদের উপকথায়! স্বাতী তখন বলেছিল, আমরা তো দাঙ্গা করিনি তবুও আমাদের ভুগতে হবে বুঝি?

[একেই বলে মেয়েছেলে। আবার ডক্টরেট হচ্ছে। বাঘ আর ভেড়ার গল্পটাই জানে না। সেই যে ভেড়ার কোন পূর্বপুরুষ ঝরনার জল ঘোলা করে দিয়েছিল বলে…]

ময়দানে বসেছিল ওরা, স্বাতী ওর গত রাতের মজার স্বপ্নটার কথা বলছিল। ঠাম্মাকে আনতে গেছি ব্যোমকালীতলায়—তখন খ্যাপা বাবা বলছে—ওরে মেয়ে, তোর মনের কষ্ট আমি বুঝতে পেরেছি। ঘর চাস তো? ওই নে। দেখি ব্যোমকালী মন্দিরের উলটো দিকে একটা হলুদ দোতলা বাড়ি। খ্যাপাবাবা আঙুল উঁচিয়ে দেখাচ্ছে—দোতলায়। দোতলায় কী হাওয়া পর্দা নড়ছে, একটা ঘরের দেওয়াল জুড়ে বুক শেলফ। কী মজা যে লাগছিল…।

[জীবনবাবুরও অনেকক্ষণ ধরেই চোখ লেগে আসছিল। উনিও ইতিমধ্যে একটা ছোট্ট করে স্বপ্ন দেখে ফেললেন। ভক্তিতে নুরুল খ্যাপাবাবার দীক্ষা নিল, নুরুলের গলায় খ্যাপাবাবার ছবিঅলা লকেট। ও সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে বসে থাকে, আর খ্যাপাবাবা অন্যদের বলছে, দ্যাখ-দ্যাখ। একজন যবন কীভাবে আমাতে বিশ্বাস রেখেছে।

চটকা ভাঙলে জীবনবাবু এই স্বপ্নটার সঙ্গে গতকাল বাড়ি আসার পথে শেয়ালদা স্টেশনের ইউরিনালে সাঁটা লিফলেটটার মধ্যে একটা লিঙ্ক পেয়ে যান।

‘জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য বাবা কাঁলাচাদ। বিশ্বাস হারাইয়াছেন? জীবনে শান্তি হারাইয়াছেন? বাবা কালাচাঁদের আশ্রমে আসুন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তসংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেছে।’]

সেই দিনই তোল্লাই হল। মিহি ধুতি আর হাফশার্ট পরা একজন পকেট থেকে একটা কার্ড বের করেই বলল—চলো থানামে। বদমাসি হচ্ছে।

আমরা তো জাস্ট বসে ছিলাম। স্বাতী বলেছিল।

চুপচাপ বসে থাকলে কিছু বলি না, যখনই হাত লাগিয়েছে তখনই ধরেছি।

আমরা হাসব্যান্ড-ওয়াইফ।

সে পুরুফ থানামে দিবেন।

পকেট হাতড়ে ২২ টাকা ৫০ পয়সা পাওয়া গেল। এত কমে রাজি নয়। কমসে কম পঁচাশ দিন।

কিন্তু নেই যে…।

স্বাতী লাইব্রেরি কার্ড বের করেছিল, নুরুল আইডেনটিটি কার্ড। নুরুলের কার্ডটা দেখে ওসি বলল- নুরুল আলম? গভমেন্ট সার্ভিস? ছিঃ একটা হিন্দু মেয়ের সর্বনাশ করছেন? সাসপেন্ড হয়ে যাবেন।

নুরুল বলল, আমরা ম্যারেড।

বললেই হল?

আমাদের সার্টিফিকেট আছে , রেজিষ্ট্রির।

কোথায়, দেখি?

সঙ্গে সঙ্গে কেউ রাখে? ঘরে আছে।

কাল দেখিয়ে যাবেন, এখন যা আছে রেখে যান।

যাবার ভাড়ার জন্য দুটো টাকা রাখি, আঁ?

[তোমরা তো আচ্ছা বুদ্ধু, যাও না, কড়েয়া রাজাবাজারে, পার্কসার্কাস, খিদিরপুরের দিকে। ওদিকে তো তোমার জাতভায়েরা থাকে। মিডল ইস্টের টাকায় মসজিদ উঠছে সব—]

সেদিন অফিসে চুপচাপ কাজ করছিল নুরুল। বনানীদি শাড়ি খসখস করে খেজুর করছে। নতুন শাড়ি পরে এলেই পাবলিক রিলেশন বেড়ে যায় ওঁর। কেউ বলল, খুব ভাল দেখাচ্ছে, কেউ বলল, বয়সটা তোর দশ বছর কমে গেছে রে। মাধুরীদি একটু ঠোঁট কাটা। বলল, ইস কী ক্যাটকেটে, মুসলমান মুসলমান রং, তখনই এই রে বলেই জিভ কাটল। নুরুলের দিকে একবার তাকাল। একটু পরেই মাধুরীদি বলল, কী ভাই, বাড়িটাড়ি পেলে?

ওঁর কী দোষ? স্বাতীও তো বলে। নুরুল একবার বলেছিল, এইসব জায়গায় আমরা ঘর ভাড়া পাব না, চলো আমরা পার্কসার্কাস, কড়েয়া, খিদিরপুরের দিকে চেষ্টা করি। স্বাতী বলেছিল, ওইসব জায়গায় কীরকম মুসলমান-মুসলমান গন্ধ। নুরুল একবার স্বাতীকে নিয়ে গিয়েছিল ওর এক দাদার বাড়ি। ওর বাবার জেঠিমা হন তিনি। নিজেদের বাড়ি। বুড়ি তো স্বাতীকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করল। নুরুলকে বলল, অ্যাদ্দিনে দাদিকে মনে পড়ল, শুনেছি বিয়ে করেছিস, ইজাব-কবুল করেছিলি তো বাবা? নুরুল বলল, দেশে গিয়ে করে নেব দাদি। বুড়ি বলল, সেটা তো জায়েজ হবে না বাবা, ইজাব, কবুল, ওলী, খোৎবা ছাড়া মুসলমানের বিয়ে হয় না ধন। তোর জ্যাঠা খুব দুঃখ করছিল, তুই রোজা রাখিস না, নামাজও পড়িস না, আখেরে খারাপ হবে ধন। এখন তোমরা মিশছ—মেশো, কথাবার্তা কও, কিন্তু খোৎবা না পড়ে স্বামী-স্তিরির ওই কাজটা কোরনি বাপ, ওটা হারাম…

তখন ওই বাড়ির তিন ভাড়াটের রান্নার ফোড়ন। পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ তো পৃথিবীময় একরকম, বৌদ্ধদেরও খেতে দেখেছে দার্জিলিং-এ৷ বিফও। তবে মুসলমানি গন্ধটা, যেটা স্বাতী বলেছিল, সেটা ঠিক কী তা স্বাতীও বলতে পারেনি, তবে নুরুলের নিজেরও এইসব এলাকা ভাল লাগে না। অনেক কারণ। যেমন, হয়তো হঠাৎ দরকার পড়ল গীতবিতান দ্বিতীয় খণ্ডটা, পাশের বাড়ি খোঁজ করে পাওয়া যাবে খিদিরপুরে? রাজাবাজারের মুসলিম পাড়ায়? তা ছাড়া ওইসব অঞ্চলেই কি আর ফাঁকা ঘর আছে? ঘরের ভিতর ঘর হচ্ছে, বারান্দায় পার্টিশন, সংসার বাড়ছে, যাবে কোথায়? তার উপরে আবার বাইরের লোক? দাদিমাকে বললে হয়তো টেম্পোরারি থাকতে দিত, দোতলায় তিনটে ঘর। তার আগে খোৎবা পড়তে হবে, ইজাব-কবুল, দোয়া দরুদ, এটা ফরজ , ওটা ছন্নত, …ভাবা যায়?

মেসে ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকে নুরুল। ইসমাইল বোর্ডিং। স্টুডেন্ট লাইফে হোস্টেলে ছিল। এখন এখানে সত্যি ভাল লাগে না। মাথার কাছে দুলদুলের ছবিওলা ক্যালেন্ডার। রুমমেট রহমতউল্লা বসিরহাটের ছেলে। ঠিকঠাক নামাজ-ফামাজ পড়ে। ব্যাটা এম এর স্টুডেন্ট, বাংলার। এখনই মৌলভি মৌলভি ভাব। নুরুলকে তো নাফেস-ফাসেক বলে খিস্তিই দেয়। গতকাল ঘাড় নাড়িয়ে নুরুলকে উপদেশ দিচ্ছিল—পেট্রোলের সঙ্গে আগুনের যে সম্পর্ক, একজন যুবতীর সঙ্গে পুরুষের সেই সম্পর্ক। টক খাদ্য দেখলে জিহ্বায় পানি আসবেই। সেই জন্যই নবী পর্দার বিধান দিয়েছেন। ক্যাঁঠাল দেখলিই মাছিরা ভোঁ ভোঁ করে ধেয়ে আসে। ক্যাঁঠালের যদি ফোঁকড় থাকে, সেখান থিকে মাছিরা ক্যাঁঠালের মধু খায়, আর যদি খোসাটা ঠিকমতো থাকে, মাছিরা কিছু করতি পারে না। নুরুল তখন ওকে বলেছিল, যাও ভাই, বাথরুমে গিয়ে হাত মেরে এসো। ও খুব খচে আছে।

ওর টেবিলে একটা বই। মলাটে একজন সেন্ট্রাল মিনিস্টারের ছবি। ঈদের নমাজে টুপি পরে সেজদা করছে। এই মন্ত্রীই দু’দিন পরে হনুমান মন্দির উদ্বোধন করবেন, কম্পিউটারে সিঁদুর মাখানো কলা লাগিয়ে মেশিন পবিত্র করবেন, বড়দিনে মাল খাবেন, শিবরাত্রে বেল খাবেন। বইটা হল আনন্দমঠের নোটবুক। শাবাশ। ভাল মলাট দিয়েছে। খুলে দেখল নুরুল। এখানে ওখানে দাগ মারা। ইমপ, ভি ভি ইমপ।

ওখানে শান্তি নামে একটা ক্যারেকটার আছে না, ব্যাটাছেলে সেজে থাকত।

আচ্ছা, একটা মেয়েছেলে যদি নির্বিঘ্নে ব্যাটাছেলে সেজে থাকতে পারে—এক্কেবারে সেই অর্জুনের আমল থেকে, তা হলে ওটাও পারবে। নুরুল অমিতাভর কাছে যায়।

অমিতাভ নুরুলের সঙ্গেই ফিজিক্স পড়ত। এখন স্বাতীদের সঙ্গেই রিসার্চে রয়েছে। অমিতাভ বলেছিল একটা অ্যাকোমডেশন আছে নাকতলার দিকে। ওই টেকনিকাল অসুবিধেটা ম্যানেজ করতে পারলে ঘর হয়ে যেতে পারে। টেকনিকাল অসুবিধেটা হচ্ছে নামটা।

হোয়াট ইজ ইন এ নেইম, একটা ভেগ কথা। নামে আসে যায়। ওর তো আসলে কোনও ধর্ম নেই। ও নিজেকে মুসলমান মনে করে না। হিন্দু তো নয়ই। বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান কিচ্ছু নয়। শুধু নাম। নুরুল। নুর মানে তো জ্যোতি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর নাম আরবিতে নুরুলই বোধহয় হবে।

অমিতাভ বলল, ওদের বাড়িতে আগে পড়াতাম। এখন আর টাইম দিতে পারি না। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। চিঠিতে স্বাতীর কথাই লিখছি। পত্রবাহিকা আমার সহপাঠিনী ও রিসার্চফেলো স্বাতী মজুমদার…। স্বাতীকেই ফেস করতে বলবি। ওরা রাজি হবে, কারণ ওদের ছেলেটা নাইনে উঠেছে।

কাবায় বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন মারা গেছে, সাহাবুদ্দিন হাঁক দিল মুসলিমদের পৃথক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাতে হবে। আর এস এস চাঁচাচ্ছে রাম জন্মভূমি আদায় করবই, আর নুরুল ঠিক করল ও নারায়ণ হবে। নারায়ণ মজুমদার।

অমিতাভর চিঠি নিয়ে নাকতলায় গেল ওরা। দু’জন ‘সাইন্স’ পেয়ে বাড়িওলা তো মহাখুশি। বলছে, ছেলেটাকে দেখিয়ে দিতে হবে আপনাদের। মাধ্যমিকে সাইন্স গ্রুপে যেন স্টার থাকে।

নুরুল বলল, ঠিক আছে, এই জন্য ভাবতে হবে না। আমার পক্ষে তো ভালই হল, চর্চাটা থাকবে।

[বাব্বাঃ অ্যাদ্দিনে ঘর পাওয়া গেল তা হলে। ঘরই যখন পাওয়া গেল ক’দিন আগে পেতে দোষ কী ছিল? অনেক আগেই কমিউনাল হারমনি হয়ে যেতে পারত,—খালি ভ্যাজাং ভ্যাজাং!]

সেদিন সরস্বতী পুজো। বাড়িওলি স্বাতীকে বলেছে সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়ো। ঠাকুরমশাই প্রথমেই আমাদের পুজোটা সেরে দেবে। বাড়িওলার ছেলেটা, যে নুরুলদের ছাত্র, স্বাতীর গ্ল্যাডস্টোনের বইটা নিয়ে গেল কারণ ওইটাই সবচেয়ে মোটা। স্বাতী এলোচুলে। নুরুলের মনে পড়ে কলেজ লাইফে, যখন হোস্টেলের কালচারাল সেক্রেটারি ছিল। হোস্টেলের সরস্বতী পুজো। সারারাত জেগে রঙিন কাগজের শিকল বানানো, খিচুড়ি আর বাঁধাকপি। ঠাকুরমশাই পুজো করার সময় জিজ্ঞাসা করলেন কার নামে সংকল্প বাক্য পড়া হবে? অমিতাভ বললে—কেন, আমাদের সেক্রেটারির নামে।

সেক্রেটারির নাম কী?

নুরুল আলম।

ঠাকুরমশাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে—কী বললে?

অমিতাভ বলে—বলছি তো নুরুল আলম।

গোত্র?

নুরুল বলেছিল, মনুষ্য গোত্র…

নারায়ণবাবু, আসুন, অঞ্জলি দিয়ে যান। বাড়িওলা ডাকছে।

সক্কালবেলায় অফিসে পালিয়ে যাওয়ার কথা মনে হয়েছিল, সেটাই বোধ হয় ভাল হত।

বলো—ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত…

নুরুলের দুই হাতের তালুতে নিস্পাপ ফুল পাপড়িগুলি দলিত, মথিত হতে থাকে…”।

[আর পড়া যায় না।—দেখি, লাস্টে কী আছে?]

একটু দূরে আর একপাটি চটি খুঁজে পেল স্বাতী। নুরুল তখন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নুরুল তখনও বুঝতে পারছিল কে মুছিয়ে দিল ঠোঁটের কোণের রক্ত, কার হাত পিঠের উপর ঘুরছে।

‘আর ভয় নেই। আমরা এবার যাই দিদি। আর কিছু হলে আমাদের জানাবেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমরা রক্ষা করবই’—পার্টির ছেলেরা বলে গেল।

কার হাত পিঠের উপর ঘুরছে নুরুল জানে।

তবু কেন দরজা-জানালা চৌকাঠের গলায় ফিসফাস শুনতে পায় নুরুল—মিথ্যেবাদীটা নারায়ণ নামে এসেছিল, আসলে নুরুল।

নুরুল বিড়বিড় করে—আমি তো একই, আমি তো সেই, সেই একই, শুধু নামটা…

[নামের সঙ্গে কিংশুক ভদ্রের কোনও মিলই নেই। ও অভদ্র। আমাকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছিল। প্রফেশনাল জেলাসি।]

শারদ প্রতিক্ষণ, ১৯৯০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *