Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দিনের শেষে || Lila Majumdar

দিনের শেষে || Lila Majumdar

লখনউ থেকে ওস্তাদ এসেছে। দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়িতে গান শুনতে গেছেন, ফিরতে রাত হবে।

ঝগড়ু বললে, তা তোমরা যদি সবকিছুই বিশ্বাস না করে আনন্দ পাও, তাহলে আমার আর কিছু বলবার নেই। তবে সর্বদা মনে রেখো, বোগিদাদা, যা বিশ্বাস করবার মতো নয়, তা যে সত্যি করে হয় না, এ-রকম কোনো কথা নেই।

ঝগড়ু রাগ করে উঠে দাঁড়াল। ওর পেছনে কুচি কুচি ঘাস লেগেছিল, তার কতকগুলো ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। তাই দেখে বোগি নরম গলায় বললে, তাই বলে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারেও মানুষ চোখে দেখতে পায়, সেকথা কী করে বিশ্বাস করি? অসম্ভব জিনিস যে হয় না, ঝগড়ু।

ঝগড়ু আরও রেগে গেল। অসম্ভব বলেই সে-জিনিস হবে না? এ কি একটা কাজের কথা হল, বোগিদাদা?

.

বাগান যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা মরচে ধরা কাঁটাতারের বেড়া। তার পরেই রেলের লাইনের বাঁধ আকাশ পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে। দুপুরে দুখু ঘাস কেটেছে, যেখানে-সেখানে কুচি কুচি ঘাস পড়ে আছে; পাখিরা সব বাসায় ফিরে আসছে; শ্যামলবাবুদের গোয়ালে এখন গোরু দোয়া হচ্ছে। বাঁধের ওপারে কিছু দেখা যায় না; বাঁধের উপরে একটা ন্যাড়া মনসার ঝোঁপ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে; পিছন দিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।

কারো মুখে কথা নেই। কানে এল একটা শব্দ, টংলিং টংলিং টংলিং। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চেন-শেকল ঝোলাতে ঝোলাতে একটা মালগাড়ি বাঁধের উপর দিয়ে চলে যেতে থাকে।

যেই সূর্যের সামনে আসে, অমনি সেই গাড়িটা কুচকুচে কালো হয়ে ফুটে ওঠে। শেষ গাড়িটার দু-দিককারই বড়ো টানা দরজা খোলা। সেই খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে ওপারের সূর্যটাকে এই মস্ত হয়ে দেখা গেল। আর দেখা গেল, সূর্যের সামনে গাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, কালো পাতলা ছিপছিপে একটা মানুষ। তার মাথার উপর খাড়া দুটো শিং।

.

বোগি, রুমু, ঝগড়ু কেউ আর কথা বলে না। ঠিক সেই সময় বাঁধের পিছনে সূর্যও টুপ করে ডুবে গেল। আর অমনি চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া আবছায়া হয়ে উঠল। শীত শীত মনে হতে লাগল। বকের মতো একটা সাদা পাখি কেঁ-ও-ও-ও কেঁ-ও-ও-ও বলে ডাকতে ডাকতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ঝগড়ু উঠে পড়ে গা ঝাড়া দিয়ে নিল, আর নয়, এখন ভিতরে চলো।

রুমু বললে, ঝগড়ু, লুচি ভাজতে বলো-না, আমার খিদে পেয়েছে।

ঝগড়ু রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই বোগি বললে, স্—স–স, দেখ।

বাঁধের ধার বেয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে নেমে, এক লাফে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, শিংওয়ালা লোকটা একেবারে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। ওর পিঠে একটা লম্বা ঝোলা।

–এই, শোনো! আমাকে লুকিয়ে রাখবে? বোগি রুমু ওর মুখের দিকে তাকায়, এ ওর মুখের দিকে তাকায়।

লোকটা বললে, আমার পা ব্যথা করছে, তেষ্টা পাচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে। রাখবে লুকিয়ে? তাহলে তোমাদের জাদু পড়া, গুণ করা, ভেলকিবাজি সব শিখিয়ে দেব। দেখবে? বলেই লোকটা দিদিমার মার হাতে-লাগানো সাদা গোলাপ ফুলের ঝোঁপের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে ডেকে বলল, এই দেখো। বলে টুপ করে একবার বসেই আবার উঠে দাঁড়াল। বোগি রুমু অবাক হয়ে দেখলে কোথায় কালো পোশাক, কোথায় শিং। সাদা চুল, সাদা দাড়ি, সাদা পোশাক, মাথায় মুকুট। লোকটা একটু হেসে আবার টুপ করে একবার বসেই উঠে পড়ল। আবার কালো পোশাক, মাথায় শিং যে কে সেই।

বোগি রুমু উঠে একবার গোলাপ গাছের পিছনটা ভালো করে দেখে এল। কোথাও কিছু নেই।

–কী দেখছ, দিদি? ভেলকি লাগিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ঠকাই না।

বোগি বললে, এসো, তোমাকে লুকিয়ে রেখে দেব, শোবার জন্য দড়ির খাট দেব, জল খেতে দেব, কিন্তু আমাদের অন্ধকারে দেখতে শিখিয়ে দিতে হবে, মাটিতে কান পেতে এক মাইল দূরে বনের মধ্যে হরিণ-চলা শুনতে শিখিয়ে দিতে হবে।

রুমু বললে, আর সেই?

লোকটা অবাক হয়ে বসলে, কী সেই, দিদি?

সেই যে, বাঁশি বাজালে জন্তু-জানোয়ার বশ হয়?

–হ্যাঁ, তা-ও শিখিয়ে দেব, চোখের সামনে আমের আঁঠি থেকে আম গাছ করে তাতে ফল ধরাতে শেখাব, দড়ি বেয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে শেখাব–

বোগি বললে, ধ্যেত!

লোকটা বললে, ধ্যেত? এই নাও ধরো। বলেই পাশের পেয়ারা গাছ থেকে একটা প্রকাণ্ড নীল রঙের কাকাতুয়া ধরে দিল।

বোগি ঢোক গিলে বললে, চলো। লোকটা তক্ষুনি নীল পাখিটাকে অন্ধকারে উড়িয়ে দিল। বলল, হরিণ-চলার শব্দ আর এমন কী। আমাদের মণিপুরে উঁতফলের গাছে রেশমি গুটির শুয়োপোকারা থাকে। রাত্রে যদি গাছতলায় দাঁড়াও, ওদের পাতা চিবুনোর শব্দ শুনতে পাবে।

দূরে রান্নাঘরের আলো দেখা যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে লোকটা বললে, আমার মা দুধ দিয়ে কমলালেবু দিয়ে মেখে শীতের রাত্রে বাইরে রেখে দিত, আর পাহাড় দেশের বেঁটে মানুষরা এসে সেসব খেয়ে যেত। তাই আমাদের কোনো অভাব থাকত না।

রুমু বললে, তুমি তাদের দেখেছ?

বোগি বললে, রুমু, বোকার মতো কথা বোলো না।

দুখু ভূতের ভয় পায়, মালীর ঘরে থাকে না। ঘরের পাশে জলের কল আছে। তাই শিংওয়ালাকে ওরা সেখানে থাকতে দিল। যাও, ঢুকে পড়ো। ঝগড়ু দেখলে আবার মুশকিল হবে।

লোকটা একটু ইতস্তত করে বললে, একটা মোমবাতি হলে হত না? যদি ইয়ে মাকড়সা টাকড়সা থাকে?

বোগি বললে, তবে-না বললে, অন্ধকারে দেখতে জান?

সে বললে, আহা, আমি দেখতে পারি কখন বললাম? বলেছি, তোমাদের শিখিয়ে দেব। আমার অন্ধকারে ভয় করে।

রুমু বললে, দাদা, দাওনা তোমার নতুন টর্চটা ওকে।

রান্নাঘরের বারান্দা থেকে ঝগড়ু ডাকল, বোগিদাদা– আ আ, রুমুদিদি-ই-ই। আর অমনি ওরাও লোকটার হাতে টর্চ গুঁজে দিয়ে ধুপধাপ দৌড় লাগাল।

সব শেষের পেটফোলা গরম লুচিটা লাল কাশীর চিনি দিয়ে খেতে হয়। রান্নাঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওরা মুখ ধোয়। যেখানে মুখ ধোয়া জল পড়ে, সেখানে একটা মস্ত লঙ্কা গাছ হয়েছে। দুখু বলেছে, ওকে কেউ লাগায়নি, আপনা থেকেই হয়েছে। তাতে ছোট্ট ছোট্ট তারার মতো সাদা ফুল ফুটেছে আর রাশি রাশি লাল টুকটুকে লঙ্কা ঝুলে রয়েছে। মাথার উপর আকাশটার ঘন বেগনি রং, কিন্তু দূরের আকাশ আলো হয়ে রয়েছে; কালো বাঁধের উপর দিয়ে কালো শুয়োপোকার মতো একটা মালগাড়ি যাচ্ছে। টং লিং, টং লিং, টং লিং করে চেন-শেকল ঝোলাতে ঝোলাতে।

শুনে শুনে ঘুম পায়। রুমু বায়না ধরে, আজ কিছুতেই একলা শোবে না। ঝগড়ু বিড়বিড় করে কীসব বলতে বলতে বোগির খাটে ওর বালিশটা দিয়ে দেয়। বোগির কানে কানে রুমু বলে, দাদা!

–কী, রুমু?

–ওর যদি ভয় করে?

বোগি কোনো উত্তর দেয় না। তারপর বিরক্ত হয়ে বলে, ও কী রুমু, আবার কান্নার কী হল?

–ওঘরে মাকড়সা আছে দাদা, আমি দেখেছি।

বোগি বললে, ওকে টর্চ দিয়েছি তো, রুমু।

–ঝগড়ুর ঘরে অনেক জায়গা।

ঝগড়ু বললে, কী কানাকানি হচ্ছে। ওসব ভালো নয় বলে দিচ্ছি। কী, লুকোচ্ছে কী! আজ গল্প শুনবে না?

বোগি বললে, তুমি যাওনা, তোমার কত কাজ বাকি আছে। যাও-না রান্নাঘরে।

কিন্তু ঝগড়ু কিছুতেই যাবে না। চৌকাঠের উপর বসে পড়ল। অসম্ভব জিনিস হয় না বলে?

বোগি পাশ ফিরে শুল। হয়, ঝগড়ু হয়, আমি ভুল বলেছিলাম।

ঝগড়ু রাগ করে আলো নিভিয়ে সত্যি করেই চলে যাচ্ছে দেখে রুমু হাত বাড়িয়ে ওর ফতুয়ার পকেটে গুঁজে দিল।

–কী করো দিদি, তামাকের গন্ধ হবে হাতে। কী, চাও কী?

–অসম্ভবের গল্প বলো ঝগড়ু।

ঝগড়ু খাটের পায়ের দিকের রেলিং ধরে দাঁড়াল। তোমরা হয়তো বলবে পরশপাথরও অসম্ভব?

বোগি গায়ের ঢাকা খুলে ফেলে উঠে বসল। পরশপাথর অসম্ভব জিনিস নয়? পরশপাথর থাকলে এত গরিব লোক হবে কেন?

রুমু বললে, তুমিই তো বলেছ, এত গরিব যে, বিচিসুদ্ধু কুল ছেঁচে খায়।

ঝগড়ু বললে, বেশ, তাহলে পৌষ মাসের সন্ধ্যা বেলায় কম্বল গায়ে দিয়ে বুড়ো লোকটা আমার ঠাকুরদার কাছে আসেনি। ঝগড়ু আবার উঠে দাঁড়াল।

–না, ঝগড়ু না, দাদা কিচ্ছু জানে না, তুমি বলো।

ঝগড়ু শুরু করলে, চারদিক চাঁদের আলোয় ঝিমঝিম করছে এমন সময় সে লোকটা এল। বলল, খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। ঠাকুরদা বললেন, কোত্থেকে দেব, এ-বছর অজন্মা, আমাদেরই খাবার কুলোয় না, মুরগি সব মরে গেছে, শাল কাঠ ভালো দরে বিকোয়নি, দেব কোত্থেকে বল? লোকটা বললে, তোমাদের এ বেলাকার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে? না। বেশ, তবে তোমার ভাগটাই নাহয় দাও আমাকে। বাড়িতে যা ছিল চেঁচেপুঁছে ঠাকুরদা সব তার সামনে ধরে দিলেন। বলেছিল তো, দুমকার ব্যাপারই আলাদা। লোকটা দাওয়ায় বসে বাড়িসুদ্ধ সবাকার ভুট্টা দিয়ে ভাত দিয়ে সেদ্ধ সবটুকু খেল, তারপর আমাদের পাহাড়তলির কুয়োর মিষ্টি জলও এক ঘটি খেল। তারপর আঁচিয়ে উঠে ট্যাক থেকে একটা হরতুকি আর একটা ছোট্ট কালো পাথর বের করে হরতুকিটা মুখে ফেলে বলল, বড় অভাব তোমাদের, তাই না? বলে পাথরটা দিয়ে পাথরের বড়ো থালাটাকে ছুঁয়ে দিল, অমনি থালাসুদ্ধু সোনা হয়ে গেল।

সকলে তো থ! বুড়ো লোকটিও কালো পাথরটাকে ট্যাকে গুঁজে জঙ্গলের দিকের পথ ধরল। তখন সকলের চোখ চকচক করে উঠল, সোনা থাকলে দুর্ভিক্ষেরও কোনো ভয় থাকবে না। চারদিক থেকে একটা ধর, ধর, গেল, গেল রব উঠল। বুড়ো লোকটি এক বার ওদের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একটা লাফ দিয়ে হরিণ হয়ে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

বোগি রুমু কিচ্ছু বলল না।

ঝগড়ু বললে, বলো এ-ও অসম্ভব।

বোগি বালিশে মুখ গুঁজে বললে, অসম্ভব হবে কেন?

ঝগড়ু তো অবাক! এমনি সময় দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। সে এক কাণ্ড শুনে এলাম রে। রামহাটি স্টেশনে কে একটা জাদুকর নানারকম খেলা দেখাচ্ছিল, দেখতে দেখতে দারুণ ভিড় জমে গেল, তারপর কী নতুন খেলা দেখাবে বলে সে এর ঘড়ি ওর আংটি, তার টর্চ সব নিয়ে দে লম্বা! ওই ভিড় স্টেশনের মধ্যে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল, সবাই মিলে আঁতিপাঁতি খুঁজেও তার টিকিটি পেল না। কিন্তু তোদের ঘুমুবার সময় হয়ে গেছে, তোরা এখন ঘুমো।

অনেকক্ষণ পরে রুমু বললে, দাদা!

–কী?

–টর্চ তো ছিল না ওর কাছে।

বোগি চুপ করে রইল। রুমু আবার ডাকল, দাদা!

–কী বল?

–ওর কপাল কেটে গিয়েছিল।

বোগি বললে, আঃ, রুমু, ফের কাঁদছ কেন?

–রক্ত বেরোচ্ছিল যে দাদা, টর্চের আলোতে দেখলাম।

বোগি রুমুর পিঠে মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়ে রইল।

ঘড়ির শব্দ দূরে সরে যেতে লাগল। আরও দূরে বাঁধের উপর মালগাড়ি যাচ্ছিল টংলিং টংলিং টংলিং।

পরদিন সকালে মালীর ঘরে গিয়ে বোগি রুমু দেখল, দড়ির খাটে টর্চটা রয়েছে, আর একটা ছোটো বাঁশি। লোকটা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *