দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 02
শাল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঝরঝরে বাসটা বেয়াড়াভাবে ছুটছিল। গাছের ডালগুলো আছড়াচ্ছে বাসের টিনের ছাদে, নিচে পুরোপুরি শালপাতার মেঝে তাতে শব্দ হচ্ছে খড়মড় করে। ড্রাইভার-ব্যাটা বোধহয় সামান্য টেনেছে। লাল ধুলোয় তার আপাদমস্তক যেন চাদর ঢাকা। মনে ফুর্তি। সে একটু জোরে চালাতে চাইছে, কিন্তু চারপাশের প্রকৃতি বারবার তার পথ আটকে ধরছে। তাই সে এমন অসাধারণ পরিবেশেও চোখা চোখা গালাগালি দিয়ে উঠছে।
—শালা হারামজাদা তোর মুখে আমি মুতে দিই।
ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম কনডাক্টর খুব রসিক লোক। ছোকরা মতন। যশজিৎদের থেকে ছোটই হবে। সে বলল— কার মুখে গো বিপিনদা— ওই শালা বাবলাঝোপের মুখে। —তো ওর ভালোই হবে। যা তুমি ফেলো, ও তাই গেলে। আরও ফুলে ফেঁপে ঝাঁপানো ঝাঁড়ালো হয়ে উঠবে এখন। নেক্সট টাইম তোমার ইস্পিড আরও কমে যাবে বলে—অ্যাসিস্ট্যান্ট বাইরের দিকে মুখ করে জোরে জোরে দুবার বিড়ি ফুঁকে নিল।
তীর্ণা আর যশজিৎ বসেছে একটা সিটে। এত সরু সিটগুলো যে দুজনে ভালোভাবে বসা যায় না। বিশেষ করে এক একটা ঝাঁকুনিতে যশজিতের হাঁটু সামনের সিটের পেছনে বিশ্রীভাবে ঠুকে যাচ্ছে।
তীর্ণা বলল— একদম সামনের সিটটায় একটা ফাঁকা হলেই তুমি গিয়ে বসবে।
যশজিৎ বলল—একটা ফাঁকা হলেই! তোমাকে বলেছে! ফাঁকা হবে!
গোপাল পেছনের সিটে সাত-আটজনের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে ছিল, চেঁচিয়ে বলল— হ্যাঁ রে অনীক, আমাদের দলে একজন বাঁধাকপির চাষ করে, মাসিমাকে বলেছিলি?
অনীক বলল— ধুর, তাই কখনও বলে! তোর আঁতেল দাড়ি আর পাকা জুলফিতেই মা আধমরা হয়ে আছে।
যশজিৎ মাথার গোল্ডেন ব্রাউন রঙের পাগড়িটাতে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল— বাঁধগোবিকী নীচে ফুলগোবি ভি হ্যায়।
সারা বাসের লোক হেসে উঠল। একটি ছেলে বলল— আমার নাম অশোক সাঁতরা, আপনারা কি কোনও কাগজ-টাগজের রিপোর্টার? না …
—আমরা ধান্দাবাজ— গোপাল গাল ফুলিয়ে বলল।
অশোক সাঁতরা আবার হেঁকে বলল—বাসে কেউ রিপোর্টার আছেন?
—কেন দাদা, মারবেন নাকি?
—এই ধরেছি, কোন কাগজ থেকে?
—বেনাচিতি।
—অর্থাৎ?
—বেনাচিতি বাজারে আমাদের ফার্নিচারের দোকান আছে, রিপোর্টার নই।
অশোক সাঁতরা বলল— যাই বলুন দাদা, রিপোর্টাররা কিন্তু মেলাটার চার্ম হাফ নষ্ট করে দিয়েছে।
—কোন হাফ? আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন।
—বলতেসি কোন হাফ, ব্যাটার হাফ নয় তো?— আবার এক দফা হাসি উঠল।
রাংতা বলল— আমি কিন্তু ডিমসেদ্ধগুলো বার করছি অনীক। আর থাকতে পারি না। ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে।
—দেড় সের জিলিপি খেলি সকালে, সব হাওয়া?
—দেড় সের? টোটাল এক সের নেওয়া হয়েছিল, তার হাফই যশজিৎ একা সাবড়েছে।
—অনীক আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল— ব্যাটার হাফ?
ছোট্ট খানিকটা হেসে উঠতেই গোপাল, পেছন থেকে হেঁকে উঠল—ভদ্রমহোদয়গণ, পাবলিকে প্রেম প্রহিবিটেড হওয়া উচিত কি উচিত না বলুন। একখানা কনসেনসাস চাইছি।
রাংতা বলল— বা রে, আমি তো শুধু একটু হেসেছি!
গোপাল বলল— হাসি? হাসি খুব সন্দেহজনক সিমটম। হাসি হল প্রিলিউড। হাসি থেকেই কান্না, কান্না থেকে আর্না, আর্না মানে আরো। দ্যাট মীনস দিল তোড়ো। অর্থাৎ কিনা কুছকুছ হোতা হ্যায়।
গোপালের পাশের ছেলেটি, গ্রাম্য-গ্রাম্য লাজুক লাজুক দেখতে। সে বলল—দাদা, আপনার বোধহয় অসুবিধে হচ্ছে। আমি কি উঠে দাঁড়াবো? মানে কিছুক্ষণের জন্যে?
—আমার তো দারুণ অসুবিধে হচ্ছে, একেবারে গলে মার্মালেড হয়ে গেছি। কিন্তু তার জন্যে আপনি উঠে দাঁড়াতে যাবেন কেন? এ হেন স্যাক্রিফাইস!
—না, মানে আপনি র্যাপ লাগিয়েছেন তো! অ্যাকশনও বেশ দিচ্ছেন। ভালো করে হাত খুলে দিতে পারছেন না। তবু তাতেই যা দু-একটা …
—এ হে হে দাদা— আপনার লেগে গেছে! যাঃ। সরি। ভেরি সরি। এক্সট্রিমলি সরি। কী নাম আপনার?
—গোপাল।
—গোপাল? এ যে সেমসাইড হয়ে গেল ভাই।
—তা বলতে পারেন। ছেলেটি তেমনি লাজুক লাজুক হেসেই বলল— তবে আমার পুরো নাম গোপালগোবিন্দ, মানে অভিভাবকরা কোনও চান্স নিতে চাননি আর কী!
—কিসের চান্স, কেন চান্স?
অনেকেই জানতে চাইল।
ছেলেটি গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল— ছেলেমেয়েদের ঠাকুরদেবতাদের নাম দেবার পেছনের সাইকলজিটা জানেন আশা করি?
—কী সাইকলজি? নামকী পিছে আবার সাইকলজি আসে কেন?— যশজিৎ জিজ্ঞাসু।
গোপালগোবিন্দ বলল— ও জানেন না? সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরে তপস্যা—ঘোর তপস্যা না করলে ঈশ্বর পাওয়া যেত না, জানেন তো? হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বমুখ ঝুলে থাকা। সারাদিন সূর্যের দিকে চেয়ে থাকা, গাছ থেকে আপনি যে পাতাটি খসে পড়বে শুধু সেইটে খেয়ে শরীর ধারণ করা ইত্যাদি ইত্যাদি …
—হ্যাঁ হ্যাঁ— বোগাস সব— অনীক, অশোক সাঁতরা উভয়েই বলে উঠল।
গোপাল দু হাত তুলে বলল— আহা, বাধা দিচ্ছো কেন ওঁকে, বলতে দাও— গোপালগোবিন্দ বলল— কিন্তু কলিতে শুধু নাম। শুধু নাম করলেই জীব উদ্ধার পায়। তাই আমাদের বাবা-মা, দাদু-দিদিমা, ঠার্কুদা-ঠাকুরমা ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের নাম দিতে থাকলেন জগন্নাথ, হরিপদ, নারায়ণ, লক্ষ্মী, দুৰ্গাময়ী বুঝলেন তো? যতবার নামগুলো ধরে ডাকছেন, দেবতাদের নাম নেওয়া হচ্ছে,—আর কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা। সব উদ্ধার হয়ে যাচ্ছে।
—তা আপনার নামে চান্স না নেওয়ার ব্যাপারটা কী? গোপাল জিজ্ঞেস করল।
—ওঃ, ধরুন গোপাল ডাকটা যদি—গোলোকের গোপালের কান ফসকে যায়, আর একটা আরও জবরদস্ত একটা রইল, গোবিন্দ! এই আর কি! আপিসে আমাকে সংক্ষেপে জি.জি. বলে। কিন্তু ঠার্কুদাদা এখন এই তিরাশি বছর বয়সেও গলা ছেড়ে পরিষ্কার উচ্চারণে ডাকেন গোপা—ল গো-ও-বিন্দ-হরি-নারায়ণ-ওম্ শ্রীবিষ্ণো
—এই বাকিগুলোও কি আপনার নাম না কী?
তীর্ণা, রাংতার এগিয়ে দেওয়া ডিম আধখানা খেয়ে বলল।
—বাকিগুলো নাম নয়, তবে ঠার্কুদাও একজন র্যাপ-আর্টিস্ট আর কি, ইন হিজ ওন ওয়ে।
আই অ্যাম ফেথফুল টু দী ইন মাই ওন ফ্যাশন— গোপালের মন্তব্য।
তীর্ণা বলল— কবিতা-টবিতার স্যাংটিটি আর রাখতে দিলি না।
গোপাল বলল— আর। দেব-দেবীরই স্যাংটিটিই থাকছে না। তার কবি-কবিতা।
—কবি কি পিছে ক্যা হ্যায়? যশজিৎ জিজ্ঞেস করলো।
—তখন থেকে এই ধুমসোটাকে অশ্লীল ফিলমি গানের পিশাচে পেয়েছে। অনীক বিরক্ত হয়ে বলল।
—আরে বাবা, থোড়া সোচো তো! ফিল্মি গান কী বাত ছোড়ো। ঠিকসে সোচকে বাতাও কবিকে পিছে ঔর দেবীকী পিছে ক্যা হ্যায়? ক্যা চীজ! থিংক সীরিয়াসলি?
তীর্ণা আমতা-আমতা করে বলল— কী? ভক্তি?
রাংতা বলল— ভাব?
—হাঁ হাঁ, লেকেন থোড়া আগে বাঢ়িয়ে।
আগে কহো আর— হেঁড়ে গলায় গোপাল চেঁচায়।
গোপালগোবিন্দ নামে সেই ছেলেটি বলে উঠল—ইম্যাজিনেশন?
—রাইট য়ু আর। যশজিৎ নিজের ঊরুতে চাপড় মেরে বলে উঠল— ভক্তি, ভাব, ইম্যাজিনেশন সোব সোব কম পঢ়ে যাচ্ছে ভাই। কিছুরই আর স্যাংটিটি নাই। নাই নাই সে পৃথিবী নাই।