দাম্পত্য
ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলাই হয় রমেনবাবুর। খাটুনির জীবনে এইটুকুই বিলাসিতা। আজ চোখ মেলে তাকিয়েই তার মনে হল কোথায় যেন এই সকালটার একটু ব্যতিক্রম অনুভব করছেন। বিছানায় শুয়েই চারদিকে তাকালেন। সামনের ছোট টেবিলে ট্রে-তে বেড-টি পট আর পেয়ালা। গত পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি বেড-টি খেয়েছেন মনে পড়ে না। তার আগে অবশ্য ঘুম-চোখে এক পেয়ালা চা কোনরকমে গলাধঃকরণ করে আবার শুয়ে পড়তেন। চোখ মেলে ভালো করে তাকাতেনও না। সুমিত্রার তাগিদে উঠছি উঠছি করে মাথার ওপরের পাখার হাওয়ায় চা কিছুটা ঠাণ্ডা হলে দুচুমুকে পেয়ালা শেষ করে আবার শুয়ে পড়তেন। চা সমস্তদিনে রমেন চৌধুরী অনেকবার খান। কিন্তু ওই সাতসকালে সুমিত্রার তাকে চা গেলানোটা বিরক্তিকর লাগত। না খেলে, সেও যেন কালচারের হানি। রমেনবাবু অবশ্য কখনো এ নিয়ে আপত্তি করেননি। আজ থেকে বাইশ বছর আগে সুমিত্রা এ বাড়িতে পা-দিয়ে যা-কিছু করেছেন তার সব কিছুই তখন রমেনবাবু অম্লানবদনে মেনে নিয়েছেন। তাই পরে আর আপত্তির। কোন প্রশ্নই ওঠেনি।
কিন্তু পাঁচ মাস বাদে রঘু ব্যাটা ভুল করে আবার চায়ের ট্রে রেখে গেছে বোধহয়। পরক্ষণে নিজের গায়ের পাতলা চাদরটার দিকে চোখ গেল। ভোরের দিকে এখন সামান্য ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা পড়ে। তার মধ্যে মাথার ওপর পুরোদমে পাখা ঘোরে। ভোররাতে বেশ শীত করছিল রমেনবাবুর মনে আছে। কিন্তু ঘুম-চোখে পায়ের তলার চাদরটা আর খুঁজে পাননি তিনি।
রঘুটা সেদিন চাদর দিতে ভুলেছে ভেবে কুঁকড়ে শুয়েছিলেন আবার। কিন্তু এখন নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা দেখছেন। ঘুমের মধ্যে। আবার কখন উঠে চাদর হাতড়ে পেয়েছেন এবং গায়ে দিয়েছেন মনে করতে পারছেন না।
আরো অবাক সামনের খোলা দরজার দিকে চোখ পড়তে। রঘু ভুল করে না। হয় বেড-টি রেখে গেল, কিন্তু দরজা দুটোও খোলা রেখে গেল? তাছাড়া তার ঘুমের মধ্যেই দরজায় পাট-ভাঙ্গা নতুন পর্দা লাগিয়ে দিয়ে গেল? ও-রকম মুগোরঙ্গের পর্দাগুলো সব সুমিত্রা নিয়েই গেছে ধরে নিয়েছিলেন। কারণ গত পাঁচ মাসের মধ্যে মাঝে একবার মাত্র এই ঘরের পর্ণা বদলানো হয়েছে, মনে পড়ছে। তাও রঘু নিজের পছন্দমতো ভারী একটা নীল পর্দা এনে লাগিয়েছিল। গত তিন মাস ধরে সেই পর্দাই ঝুলছিল। কি ভেবে বালিশের ওপর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে পিছনের জানলা দুটোর দিকে তাকালেন রমেনবাবু। তার পরেই হাঁ একেবারে। দরজায় ওই মুগোপর্দা লাগালেই তার সঙ্গে ম্যাচ করে জানলায় ওই রংয়ের পর্দাই টাঙাতো সুমিত্রা। এখনো জানলায় সেই ম্যাচ করা ঝকঝকে পর্দাই দেখছেন রমেনবাবু। তিনি ঘুমুচ্ছেন আর সেই ঘরে ঢুকে রঘু নিঃশব্দে এত সব করে গেল দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না।
আস্তে আস্তে শয্যায় উঠে বসলেন তিনি। ঘরের চারদিকে ভালো করে তাকালেন আবার। ড্রেসিং টেবিলটা সাজানো, কোণের আলনাটা গোছানো। পাঁচ মাস আগে যেমন থাকত, সে রকমই অনেকটা।
ঘড়ি দেখলেন। নটা বাজে প্রায়। এত বেলা পর্যন্ত আগে ঘুমোতেন না তা বলে। ইদানীং বেলা হচ্ছে। অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়েন বা জার্নাল-টার্নাল পড়েন। রাতের ঘুম কমেছে, ফলে সকালের ঘুম বেড়েছে।
-বাবা এখনো ওঠেনি রে রঘু?
বাইরে থেকে এই গলার শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা যেন ধপধপ করে লাফিয়ে উঠল রমেনবাবুর। একি শুনলেন তিনি? কার গলা শুনলো? এখন তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন?
ওই গলার স্বর যার, সে পর্দা ঠেলে গলা বাড়ালো। তাকে বসে থাকতে দেখে মুখে হাসি ভাঙল। দুচোখ আনন্দে চকচক করছে।
সুমু– সৌমেন, রমেনবাবুর একমাত্র ছেলে। কুড়ি বছর বয়স। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে একমুখ হেসে বাবাকে প্রণাম করল। বলল, খুব অবাক করে দিয়েছি তো? মা একটা চিঠি লিখে তোমাকে জানাতে বলেছিল আমরা আসছি। আমি বলেছি, না, যাচ্ছি যখন না জানিয়েই যাবো। বাবাকে অবাক করে দেব।
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রমেনবাবু। বুকে চেপে ধরলেন। তারপর কি যে হয়ে গেল, নিজেও অপ্রস্তুত। যা কখনো হয়নি তাই হয়ে গেল। কেঁদে ফেললেন তিনি।
বাবার চোখে জল দেখে ছেলেটাও অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি বলল, তুমি আর কিছু ভেব না বাবা। সব ঠিক হয়ে গেছে। মা আর তোমাকে ছেড়ে যাবে না, আমিও না। কি যে এক মজার কাণ্ড হয়েছে না মাদ্রাজে–একদিনে মায়ের মেজাজ জল– মনই ঘুরে গেল একেবারে, বলবখন তোমাকে–চুপ মেরে যেতে হল, পর্দা সরিয়ে সুমিত্রা ঘরে ঢুকলেন। বাপে-ছেলেতে তখনো জড়াজড়ি, রমেনবাবুর চোখে তখনো জল।
তাড়াতাড়ি ছেলেকে ছেড়ে দিলেন। নিজের ওপর হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হল রমেনবাবুর। এই একজনের কাছে চোখের জলসুদ্ধ ধরা পড়তে চাননি।
সুমিত্রা চুপচাপ তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। সুমুও এই ফাঁকে মাকে দেখে নিচ্ছে।
সুমিত্রা স্নান সেরে এসেছেন। ভেজা চুল। ফর্সা মুখে ফোঁটা ফোঁটা জলের দাগ। আয়নার দিকে চলে গেলেন। ড্রয়ার খুলে চিরুনি বার করলেন।
পাঁচ মাস বাদে দেখা হবার পরে ঘরের তিনজনেই একেবারে চুপ মেরে গেলো অস্বস্তিতে। ছেলে একবার মাকে দেখে নিয়ে অনেকটা বেপরোয়ার মতো বলে ফেলল, তোমাকে প্রথমেই একটা সুখবর দিয়ে রাখি বাবা। এবার থেকে আমি তোমার সঙ্গে কন্ট্রাক্টরির কাজে লেগে যাবো। তোমার কাছে হাতেকলমে কাজ শিখবো।
এ-কথা শুনে রমেনবাবুই যেন ফাঁপরে পড়লেন। তাড়াতাড়ি বললেন, না না, ও-সব তোকে করতে হবে না।
সুমিত্রা মোটা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছিলেন। অনেক চুল। সেই চুলে চিরুনি সুষ্ঠু হাত থেমে গেল। সামান্য মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালেন।
রমেনবাবু ছেলেকে বললেন, মা যা বলবেন তাই করবি।
বা রে, মা-ই তো ওই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে কাজ করব, তোমার কাছে। কাজ শিখব
রমেনবাবু আবারও হতচকিত একটু। এতো বিশ্বাস করতে হবে!
সুমিত্রার হাতে আবার চিরুনি চলছে। আয়নার দিকে মুখ। ছেলেকে বললেন, রঘুকে ওই চায়ের ট্রে নিয়ে যেতে বল, চা-জলখাবার সব একেবারে নিয়ে আসুক, গল্প করতে হয় মুখ হাত ধোওয়া হলে তারপর কর, সকাল নটা বেজে গেল–
পরোক্ষ শেষের উক্তিটা রমেনবাবুর উদ্দেশ্যে সেটা ছেলেও বুঝল। খাট ছেড়ে মায়ের নির্দেশ পালন করতে চলল সে।
সুমিত্রা ধীরেসুস্থে মাথা আঁচড়াচ্ছেন। অত চুলের জন্য শরীরের ওপরের দিকটা একটু বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। লোভীর মতোই দেখতে ইচ্ছে করছে রমেনবাবুর। আগে তাই দেখতেন। আয়নার ভিতর দিয়ে সুমিত্রার সঙ্গে আবার চোখাচোখি হতে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এলেন। যেন তাড়া আছে এমনি ভাব করে মুখ হাত ধুতে চলে গেলেন।
হঠাৎ কি হল বা হতে পারে মাথায় ঢুকছে না। এই ছেলেকে অর্থাৎ সৌমেনকে নিয়েই মর্মান্তিক বিচ্ছেদ সুমিত্রার সঙ্গে। এবারে কোর্টে নিষ্পত্তি হবার কথা। শ্বশুরের শেষ কড়া চিঠিতে এ-রকম আভাসই পেয়েছিলেন তিনি। আর গোঁ ধরে সেই অবাঞ্ছিত পরিণামের অপেক্ষাতে ছিলেন। তার মধ্যে ছেলে নিয়ে সুমিত্রা হঠাৎ ফিরে আসবে এ তিনি ভাববেন কি করে? শুধু তাই নয়, সুমু বাপের কাছে কাজ শিখবে, বাপের সঙ্গে কাজ করবে–সুমিত্রাই নাকি এ-কথা বলেছে! এ কানে শুনলেও সত্যিই বিশ্বাস করেন কি করে?
তোয়ালেতে মুখ মুছে আবার ঘরে ফিরলেন রমেনবাবু। মাথা আঁচড়ানো শেষ করে সুমিত্রা মনযোগ দিয়ে কপালে সিঁদুরের লাল শিখা দিচ্ছে দেখলেন রমেনবাবু। রঘু চা আর সকালের খাবার রেখে গেছে। আয়নায় আবার চোখাচোখি হতে রমেনবাবু। মুখ ফিরিয়ে পট থেকে পেয়ালায় চা ঢালতে লাগলেন।
-আগে টোস্ট আর পোচ খাও, তারপর চা ঢালবে।
আগে যে মেজাজে কথা বলত সুমিত্রা তার খুব একটা রকমফের হয়, নি। হাব ভাব-আহণও বদলায়নি। তবু এরই মধ্যে কোথায় যেন একটু ভিন্ন স্বাদ পাচ্ছেন। রমেন চেরী। টোস্ট আর ডিমের পোচ টেনে নিলেন। সুমিত্রা সামনে এগিয়ে এলেন। তাঁর দিকে চেয়ে রমেনবাবু হাসতে চেষ্টা করলেন একটু। আজ অনেককাল বাদে টোস্ট আর পোচ থেকে হঠাৎ এই মুখখানা ঢের বেশী লোভনীয় লাগল তার। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে বেশী তাকাতেও পারছেন না।
-এই পাঁচ মাসে চেহারার তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি!
সুতির গলায় একটু শ্লেষের আভাস আছে কি নেই ঠিক ধরতে পারলেন না। সহজ হর চেষ্টায় একটু হাসলেন রমেনবাবু।–কেন, খারাপ দেখছ?
রঘু বলল, সকালে তিন চার পেয়ালা চা ছাড়া আর কিছু খেতে না। রাতেও দুটোর আগে ঘরের আলো নিভত না। শরীর খারাপ হবে না তো কি ভালো হবে?
রঘু ব্যাটা এইভাবে তাঁকে ডুবিয়েছে! কিন্তু চেষ্টা করওে তিনি রঘুর উপর রাগ করতে পারলেন না। পারলেন না, কারণ সুমিত্রার সেই চিরাচরিত কর্তৃত্ব আর ব্যক্তিত্বের ফাটল দিয়ে আজ তিনি ভিন্ন রকমের কিছু দেখতে পাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন ছিলে?
–কেমন ছিলাম পাঁচ মাসের মধ্যে একটা চিঠি লিখে তো খবর নিতে পারতে? না কি ভেবেছিলে, দূর হয়েছে ভালই হয়েছে!
জবাবে রমেন চৌধুরী বলতে পারতেন, তিনি চিঠি লেখার জন্যে প্রস্তুত হবার আগেই শশুর দুদুখানা কড়া চিঠি পেয়েছেন। একটাতে তার উপদেশ ছিল, নিজে এসে মেয়ের কাছে মাপ চেয়ে তাকে যেন ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। মাস দেড়েক প্রতীক্ষার পরে শ্বশুর দ্বিতীয় চিঠিতে লিখেছিলেন, তিনি এবং সুমিত্রা দুজনেই ডিভোর্স সুট ফাইল করার কথা ভাবছেন। আশা করা হচ্ছে, এ নিয়ে সে (অর্থাৎ রমেন চৌধুরী) বেশী তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করবে না। এবং সৌমেনের ভবিষ্যতের যথাযথ ব্যবস্থাও তার বাবা বিনা জোরজুলুমেই করবেন।
এই দ্বিতীয় চিঠির জবাব রমেন চৌধুরী শশুরকে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, সৌমেন সাবালক, সে ইচ্ছে করলে তার বাবার কাছে থাকতে পারে, ইচ্ছে করলে মায়ের কাছে থাকতে পারে। আইনগতভাবে তার প্রতি আর কোন দায়িত্ব রমেনবাবুর নেই। তবে ছেলে যদি তার বাবার কাছে থাকা সাব্যস্ত করে, তার ভবিষ্যৎ-চিন্তাও তিনিই করবেন।
এ সব কথা মনে এলেও আজকের এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তা বলা যায় না। টোস্ট চিবুতে চিবুতে সুমিত্রার মুখের দিকে চেয়ে একটু ঠাট্টাই করলেন রমেনবাবু। বললেন, এ-বয়সে স্ত্রী দূর হয়ে গেলে আর ভালোটা কি হতে পারে?
এইটুকুতেই সেই চিরাচরিত অসহিষ্ণুতা সুমিত্রার, থাক! পয়সার গরম হলে ষাট বছর বয়েসটাকেও তোমারা খুব একটা বয়েস ভাব না-বুঝলে?
রমেন চৌধুরী হাসছেন।–আমার ছেচল্লিশ…এটা কি তাহলে পুরো যৌবন?
সুমিত্রা চোখের কোণে মানুষটাকে আর একবার দেখে নিলেন। সকালে যখন পাখার হাওয়ায় কুঁকড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। নিরীহ– ঘুমন্ত মানুষটার দিকে চেয়ে তখনো একটা জোরের দিক আবিষ্কার করছিলেন তিনি। এখনো সেই জোরের দিকটাই দেখছেন। একটুও রাগ হচ্ছে না, বরং ভালো লাগছে। এই ভালো লাগার স্বাদটা আশ্চর্য রকমের নতুন। হঠাৎ হাসলেন সুমিত্রা একটু। বললেন, যাক শোন, সুমু ঠিকই বলেছে- এখন থেকে সে তোমার সঙ্গে কাজে বেরুবে।
শুনে রমেনবাবুই হাঁসফাস করে উঠলেন। সুমিত্রা ফিরেই যখন এসেছে এ প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি আর ঘোঁট পাকাতে চান না। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন, না-না, ও তুমি যা চাও তাই হবে। সুমু চার্টার্ড অ্যাকাউনটেনসিই পড়ক, দেখেশুনে ভালো একটা ফার্মে ভর্তি হয়ে যাক, তারপর টাকা খরচ করলে গাইড করার লোকও ঠিকই পাওয়া। যাবে।
সুমিত্রার চোখদুটো এমনিতেই বড়। মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলে আরো বড় দেখায়। তেমনি চেয়ে রইলেন কয়েক পলক। বললেন, কিন্তু আমি এখন আর তা চাই না–যা চাই তাই তোমাকে বললাম। কাল থেকেই ও তোমার সঙ্গে কাজে বেরুবে।
উঠে চলে গেলেন। রমেনবাবুর ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ। না, সুমিত্রার এ-রকম পরিবর্তনের জন্য তিনি কোনো ঠাকুর-দেবতার দোরে ধর্ণা দেননি। তবু এ কি করে সম্ভব হল ভেবে পাচ্ছেন না। সুমিত্রা যে রাগ করে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বাতিল করে এ-ভাবে ফিরে এসে আত্মসমর্পণ করল, রমেনবাবুর সেরকমও মনে হচ্ছে না। তার নিজের ইচ্ছেটাই সব। সে কোনরকম আপোসের ধার ধারে না।
অথচ এই সুমু আর সুমুর ভবিষ্যৎ নিয়েই পাঁচ মাস আগের সেই চরম ব্যাপার। অবশ্য এর আগেও স্বামী-স্ত্রীতে অনেক ঝগড়া হয়েছে আর সুমিত্রা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। ঝগড়া বলতে যে গোছের বাকবিতণ্ডা বা বচসা বোঝায় তা নয়। সেভাবে কথা-কাটাকাটি করতে সুমিত্রার রুচিতে বাধে। আর রমেনবাবুও সবসময় কটকট করার মানুষ নন। যতক্ষণ সম্ভব সহ্য করেন, আর চুপচাপ দেখে যান বা শুনে যান। তারপর নিতান্ত অসহ্য হলে দুমদাম দু-পাঁচ কথা বলে বসেন। সুমিত্রা তখন এমনভাবে চেয়ে থাকেন যে তার সামনে কোনো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে না ইতরজন– তাই যেন সন্দেহ। তাই দেখে রমেনবাবুর মেজাজ এক-এক সময় দ্বিগুণ বিগড়োতো। তখন মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়েই যেত। ওরকম অশালীনতার একটাই জবাব, সুমিত্রার বাপের বাড়ি প্রস্থান। এরপর রমেনবাবু প্রথমে ছেলেকে পাঠাতেন, তারপরে টেলিফোনে। যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। শেষে মুখ কাচুমাচু করে নিজেই শ্বশুরবাড়ির দিকে পা বাড়াতেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সর্বদাই তাঁদের মেয়ের পক্ষে। শাশুড়ী ঠারেঠোরে কিছু মন্তব্য করেন, শ্বশুর গম্ভীর মুখে দুই-একটা জ্ঞানের কথা শুনিয়েছেন। বড়শালা বা শালার বউও দুই-একটা বিদ্রুপাত্মক কথা শোনাতে ছাড়েন না। তখনও ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকেন রমেনবাবু। কিন্তু তখন তার কানে তুলো, পিঠে কুলো। তবু নিজে গেলেই যে সুমিত্রাকে আনা যেত এমন নয়, তবে তাতে কাজ হত। রাগের মাত্রা অনুযায়ী একদিন বা দুদিন বা পাঁচদিন বাদে সুমিত্রা ফিরে আসতেন।
রমেনবাবুর মতো ঠাণ্ডা মানুষের হঠাৎ-হঠাৎ ধৈর্য্যের বাঁধ কেন ভাঙে সুমিত্রা সেটা কখনো বোঝেননি বা বুঝতে চেষ্টা করেননি। তার কারণ রমেন চৌধুরী মানে এক সাধারণ কনট্রাকটারের জীবনে তিনি দয়া করে পদার্পণ করেছেন এবং নিজের মর্যাদা অনুযায়ী সেখানে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন।
সুমিত্রার বাবা এক মস্ত এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এবং চার আনার মালিক। বড় অবস্থা। তেমনি চালচলন। আর রমেনবাবুর বাবা ছিলেন ওভারসিয়ার। নিজের উদ্যমে কনট্রাকটরি ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বস্ত মানুষ। সুমিত্রার বাবা তাকে পছন্দ করতেন। অনেক কাজও দিতেন। বি.এ পাশ করে রমেনবাবু আর চাকরির চেষ্টায় না গিয়ে বাপের ব্যবসায়ে লেগে গেছলেন, আর নিজের সততা আর পরিশ্রমের ফলে অল্পদিনের মধ্যে তিনিও সুমিত্রার বাবার সুনজরে এসে গেছলেন। বছর দুই-আড়াইয়ের মধ্যে রমেনবাবুর বাবা মারা গেলেন। আর সত্যি কথা বলতে কি, সুমিত্রার বাবা তখন ওই উদ্যোগী ছেলেটা অর্থাৎ রনেমবাবুর প্রতি একটু বেশী উদার হয়েছিলেন। কর্মঠ, বুদ্ধিমান ছেলে। কাছে ডেকে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কাজও আগের থেকে আরও বেশীই দিয়েছেন ক্রমশ। আর তার ফলাফল দেখে খুশীই হয়েছেন।
–রমেনবাবুর তখন পঁচিশ বছর বয়েস। একটা চাপা প্রলোভন দুর্বার হয়ে উঠল। কাণ্ডজ্ঞান খুইয়ে একেবারে মুখথুবড়ে পড়লেন। অর্থাৎ ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের একমাত্র মেয়ে সুমিত্রাকে একখানা চিঠি লিখে বসলেন। তার চার বছর আগে থেকে এ বাড়িতে আনাগোনা। ওই মেয়েকে অনেকবার দেখেছেন। খুব যে রূপসী তা নয়, সুখের ঘরে ওটুকু রূপ অনেক মেয়েরই থাকে। কিন্তু তাকে দেখে দেখে রমেন চৌধুরীর পাগল হওয়ার দাখিল। সুমিত্রার তখন সবে উনিশ। কলেজে পড়ছেন। তাঁর দাদা বিলেতে। সেখানে তিনি এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। ভাবতে গেলে এই লোভ আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর সামিল। কোন যুক্তির দিকে না গিয়ে দীর্ঘদিনের একটা যন্ত্রণার অবসান করে দেবার সংকল্পে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
চিঠিতে চার বছরের স্বপ্ন আর সেই দুঃসহ যন্ত্রণার কথাই লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন, যদি এতটুকু আশা পান তাহলে মৃত্যু পণ করেও তিনি সুমিত্রার যোগ্য হয়ে উঠতে চেষ্টা করবেন।
স্বাস্থ্যবান সুঠাম এবং সুশ্রী লোকটাকে চোখের কোণ দিয়ে সুমিত্রাও বহুবারই দেখেছেন। ও-রকম করে দেখা আর নিজেকে যাচাই করারই বয়েস সেটা। কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্তই। বাবার আশ্রিতজনের প্রতি এতটুকু দুর্বল চিন্তার প্রশ্রয় ছিল না। তাই চিঠি পেয়ে সুমিত্রা প্রথমে স্তম্ভিত। এ দুঃসাহস ছাড়া আর কি? চিঠিটা বাবাকে দেখিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলার ইচ্ছে। কিন্তু লোকটার মুখখানা মনে পড়তে তখনকার মতো ইচ্ছেটা বাতিল করলেন। কেন যেন একটা গুরুতর শাস্তি মাথায় চাপিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। দরকার হলে ধৃষ্টতার জবাব নিজেই দিতে পারবেন। তাছাড়া বাবাকে যখন খুশী বলা যেতে পারে।
সেই বিকেলেই লোকটার দেখা পেলেন। তার খানিক আগেই বাবা বেরিয়েছেন। দূর থেকে তাকে দেখে সুমিত্রা ভুরু কোচকালেন। তারপর হনহন করে সামনে এসে দাঁড়ালেন– কাকে দরকার? বাবাকে না আমাকে?
-উনি তো একটু আগে বেরিয়ে গেলেন দেখলাম। আমতা-আমতা জবাব।
ঘুরিয়ে বলা হল তাকেই দরকার।
সুমিত্রার গলার স্বর এবারে ঝাঝালো।–চিঠির জবাব চাই?
–পেলে নিশ্চিন্ত হতাম।
-তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। বাবা ফিরলে চিঠি তার হাতে যাবে। তিনিই জবাব দেবেন।
রমেন চৌধুরী চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক পলক। ভীত চাউনি নয়– বিমর্ষ বললেন, তাতে আর লাভ কি! চিঠি পড়ে তিনি গলাধাক্কা দেবেন, আর তুমি না চাইলে আমি বরাবরকার মতো চলে যাবো। তোমার কাছ থেকে এটুকু সম্মান অন্তত দুষ্প্রাপ্য ভাবি নি।
-তুমি! তোমার! সত্যিকারের ঝলসেই উঠেছিলেন সুমিত্রা।
বিব্রত মুখে রমেন চৌধুরী বলেছিলেন, খুব অন্যায় হয়েছে।… নিজের মনে তুমি তুমি করে চার বছর এত কথা বলেছি যে ওটা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
এ কথা শুনে ওই মুখ দেখে কেন যেন সুমিত্রা সেরকম জোরের সঙ্গে রাগ। করে উঠতে পারেন নি। তবু তার গলায় ব্যঙ্গ ঝরেছে। নিজেও তুমি করেই বলেছেন।–তাহলে তুমি আশা করছ, জবাবটা আমিই দিয়ে তোমাকে একটু সম্মানিত করব!
-হ্যাঁ।
–আর জবাব পেলে তুমি নিজে থেকেই বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে!
–তা না গেলে নিজের আত্মসম্মানে লাগবে।
–আর সেই জবাবটা যদি অত হৃদয়বিদারক না হয়, তাহলে বাবার অনুগ্রহে থেকে আমার যোগ্য হতে চেষ্টা করবে! সুমিত্রার গলার স্বর একটুও নরম নয়।
-তার অনুগ্রহ ছাড়াই চেষ্টা করব। রমেন চৌধুরীর শান্ত জবাব।
সুমিত্রার এবারে একটু মজাই লাগল।–বেশ, বাবার অনুগ্রহ ছাড়া যোগ্য হতে পারলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে কত বছর লাগবে?
-ভরসা পেলে দুবছরের বেশী লাগবে বলে মনে হয় না।…আমার বাবার একটা জমি কেনাই ছিল, দুবছরের মধ্যে সেখানে তোমার পছন্দমতো একটা বাড়ি তুলতে পারলে যোগ্যতার পরীক্ষায় তোমার যদি পাস-নম্বর দিতে আপত্তি না হয়, তাহলে গড়গড় করে আরো বড় পরীক্ষায় উতরে যাওয়া কঠিন হবে না।
প্রস্তাবে বৈচিত্র্য ছিল। মানুষটার জোরের দিক যাচাই করার লোভও হয়েছিল। সুমিত্রা কথা দিয়েছিলেন, দুবছর অপেক্ষা করবেন।
…শ্বশুরবাড়ির আদবকায়দার সঙ্গে কোনদিনও নিজেকে মেলানো সম্ভব হয়নি রমেন চৌধুরীর। এই রকম অসম বিয়েতে সুমিত্রার বাবা-মায়ের এবং বিলেত-ফেরৎ এঞ্জিনিয়র দাদার একটুও সায় ছিল না। কিন্তু আদবকায়দা ভুলে কালচারড মেয়ের সিদ্ধান্তও সরাসরি কেউ বাতিল করে দেননি। সুমিত্রা বিজয়ীর গলায় মালা যেমন দিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে বাপের বাড়ির আভিজাত্যের ছটাও তেমনি পুরেপুরি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। এদিক থেকে স্বামীটিকে উপযুক্ত করে তোলা যেন একটা বড় দায়িত্ব তার। গোড়ায় গোড়ায় মজাই পেতেন রমেনবাবু। পরে সন্তর্পণে শ্বশুরবাড়ির সংস্রব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতেন। নিরলস প্রবল কর্মী পুরুষ তিনি, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির অন্য সকলের কথা বাদ দিয়ে সুমিত্রারও এজন্যে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা আছে মনে হত না। সুমিত্রার যা কিছু পরামর্শ সব তার বাবা মা দাদার সঙ্গে।
রমেনবাবু সহজে কিছু বলতেন না! আর যদি কখনো কিছু বলেন, সুমিত্রা সঙ্গে সঙ্গে টেনে ধরতেন–তুমি যা বোঝ না তা নিয়ে মাথা ঘামিও না।
এই থেকেই বিরোধের সূচনা ক্রমশ। বছর না ঘুরতেই কোলে ছেলে এলো, সুমিত্রার চোখে এও যেন মেহনতী মানুষের বিবেচনার অভাব। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আর ছেলেপুলে নয়। এই লোকের প্রতি নির্ভর করতে না পেরে নিজেই তিনি সাবধান হয়েছেন। আর এই এক ছেলে সুমুও বড় হতে থাকল তাঁর মায়ের আর মামা-বাড়ির হেপাজতে থেকে। এ ব্যাপারেও রমেনবাবুর বক্তব্য বা বিবেচনা কেউ গায়ে মাখেন না।
কিন্তু ওপরওয়ালা শোধ নিচ্ছেন। ছেলেটা বাপের নেওটা, বাপের কাছে আসতে পেলে মা বা মামারবাড়ির দিকে ঘেঁষতে চায় না। দু-দুটো মাস্টার রাখা সত্ত্বেও স্কুলের পরীক্ষায় কোনদিন প্রথম দশজনের মধ্যেও তার নাম দেখা যায় না। মা শাসন করতে গেলে ছেলে বাপের কাছে পালায়। ওকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বেড়েই চলে। বাপ ছুটির দিনে বাগানের কাজে হাত দিলে ছেলে সোৎসাহে কোদাল দিয়ে মাটি কোপায়, জলনিকাশের নালা তৈরি করে। আর তাই দেখে মায়ের হাড়পিত্তি জ্বলে। সুমিত্রার মনের তলায় সব থেকে বড় আশঙ্কা, ছেলেটা বাপের মতো হয়ে। উঠছে। এই আশঙ্কা চাপাও থাকে না সব সময়। তখন স্বামী-স্ত্রীতে তুমুল ঝগড়া অনিবার্য।
এঞ্জিনিয়র দাদুর ইচ্ছে ছিল নাতি মস্ত ডাক্তার হোক। আর এঞ্জিনিয়র মামার ইচ্ছে ভাগনে বড় এঞ্জিনিয়রই হোক। কিন্তু দুদুটো বাছাই করা মাস্টার রাখা সত্ত্বেও সুমু সকলের আশায় ছাই দিয়ে হায়ারসেকেণ্ডারিতে সেকেণ্ড ডিভিসনে পাস করে বসল। এর ফলে সুমিত্রার যত রাগ গিয়ে পড়ল ছেলের বাপের ওপর। আর বাপ বলল যা হয়েছে হয়েছে, কত ছেলে তো থার্ড ডিভিসনে পাশ করে!
এই নিয়ে শেষে তুমুল বির্তক আর তারপর সুমিত্রার রাগ করে বাপেরবাড়ি প্রস্থান। ইদানীং এই রাগারাগি আর প্রস্থান একটু ঘন-ঘনই হচ্ছিল।
বাবা আর ভাইয়ের পরামর্শে সুমিত্রা এরপর ছেলেকে বি. এসসি অনার্স পড়ালো। উদ্দেশ্য, এতেও ভাল ফল হলে ডাক্তার অথবা এঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হওয়া সম্ভব। অনেক টাকা মাইনে গুনে গোড়া থেকে দুজন প্রোফেসার রাখা হল। পড়াশোনার ব্যাপারে সুমিত্রা এবার ছেলের ওপরেও নির্মম। কিন্তু বি. এসসির ফল বেরুতে এবারেও সুমিত্রার মাথায় বজ্রাঘাত। ছেলে অনার্সই পায় নি, পাস কোর্সে পাস করেছে।
পাঁচ মাস আগের সেই মর্মান্তিক ব্যাপারটা ঘটে গেল এই নিয়ে। দোষের মধ্যে হেসে হেসে রমেনবাবু বলেছিলেন, অনেক তো দেখলে, এবারে ছেলেটাকে রেহাই দিয়ে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমার সঙ্গে বেরোক, কাজকর্ম শিখুক–ভালোই করবে।
শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সুমিত্রা।–ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ তোমাকে মাথা ঘামাতে বলেনি, তুমি কুলিমজুর ঠেঙাচ্ছো ঠেঙাও
রমেনবাবুও সশ্লেষে বলে উঠেছেন, আমাকেও তুমি একটু বড়গোছের কুলিমজুরই ভাবো জানি-আর-ঠিকই জানো, আমার ছেলে ওই কুলিমজুরের কাজটাই ভালো পারবে। আর তাতে লজ্জারও কিছু নেই, সেটা মগজে একটু বুদ্ধি থাকলে এত দিনে বুঝতে। তোমার বাবা আর দাদা শুনলাম এবারে সুমুকে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি পড়াতে বলেছে আর তুমিও তাই শুনে নাচছ–কিন্তু আমার কাছে শুনে রাখো তাতে ভস্মে ঘি ঢালা হবে–আর কিছু হবে না।
সুমিত্রার খরখরে দুচোখ তার মুখের ওপর স্থির খানিকক্ষণ।–অভদের মতো চেঁচিও না, সুমুর ব্যাপারে কেউ তোমার পরামর্শ চায়নি!
রমেনবাবু আরো উগ্র।–কেন কেউ চায় নি? কেন তুমি চাও নি?
-তোমার সে যোগ্যতা আছে ভাবি না।
–সেটা ভাবতে হলে নিজেরও কিছু যোগ্যতা থাকার দরকার। ভাববে কি করে, রক্ত-জল-করা টাকা মুঠো মুঠো খরচা করতে পেলে তোমার মতো কালচারের ছটা সকলেই দেখাতে পারে–বুঝলে?
রাগে মুখ সাদা সুমিত্রার।–আবার বলছি, ছোটলোকের মতো চেঁচিও না। এই কালচারের পিছনেই হাতজোড় করে ছুটেছিলে একদিন
ছোটলোক শুনে মাথায় রক্ত উঠল রমেনবাবুর।–আমি সত্যিকারের গাধা বলেই এমন ভুল করেছিলাম, এখন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি!
খাটের বাজু ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন সুমিত্রা। এখন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছ?
–স্বামীকে ছোটলোক বলার পরেও বুঝতে পারা উচিত নয় ভাবছ?
–ঠিক আছে। বুঝতে যখন পেরেছ, আমার ব্যবস্থা আমি এখনো করব ছেলে সি. এ. পড়বে কি পড়বে না!
পড়বে না, পড়বে না। রমেনবাবু এতকালের সব আক্রোশ উজাড় করে দিতে চাইলেন।-আমার মতো ছোটলোকের ছেলে আমার মতোই ছোটলোক হবে। তোমার বাবা-মাকে গিয়ে বলো, তাদের ঘরের নাতি-নাতনীকে এক-একখানা করে হীরে-জহরত বানাতে–আমার ছেলের দিকে তাকাতে হবে না।
সুমিত্রা শেষবারের মতোই যেন দেখে নিলেন তাকে। তারপর বললেন, তোমার ছেলেও আর তাহলে তোমার ছেলে থাকবে না।
ছেলেকে নিয়ে সুমিত্রা বাপেরবাড়ি চলে গেলেন। সুমুর যাবার ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক, মার অবাধ্য হবার সাহস নেই। এবারে যাওয়াটা অন্যান্য বারের যাওয়ার মতো নয় রমেনবাবু সেটা অনুভব করেও চুপ একেবারে। তার গোঁ চেপে গেছে। শশুরের প্রথম চিঠি পেয়ে আরও তেঁতে উঠেছিলেন। মেয়ের কাছে তাকে মাপ চাইতে বলা হয়েছে! দ্বিতীয় চিঠিতে ডিভোর্সের হুমকি– সে চিঠির জবাব রমেনবাবু দিয়েছেন। আর তারপর থেকে শেষ ফয়েসলার জন্যেই প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছেন।
কিন্তু বুকের ভিতরটা খালি-খালি লাগে। তার ফলে নরম হবার বদলে নিজের ওপরেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি।
পাঁচ মাস বাদে এই সকালে আচমকা পট পরিবর্তন। ছেলেকে নিয়ে সুমিত্রা নিজে থেকে ফিরে এসেছেন। শুধু তাই নয়, ছেলের প্রতি মায়ের নির্দেশ, এবার থেকে সে বাপের সঙ্গে বেরোবে, তার কাছে কাজ শিখবে।
.
রঘুর সঙ্গে সুমিত্রাও রান্নায় হাত লাগিয়েছেন আজ। সেই ফাঁকে সুমুকে আবার কাছে ডাকলেন রমেনবাবু। চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার রে, তোর মায়ের হঠাৎ এরকম মত বদলালো কেন?
শুনে ছেলে প্রথমে হাসতে লাগল। তারপর বলল, মা আমাকে কিছু বলেন। নি, কিন্তু আমি জানি কেন বদলালো।
–কেন? রমেনবাবু আরো উদগ্রীব।
চাপা আনন্দে সুমু এবারে যে চিত্রটি তার সামনে তুলে ধরল, রমেনবাবুর মুখে আর কথা সরে না। দুকান ভরে শোনার মতোই বটে।
…মায়ের মেজাজ খারাপ, সুমুর দাদু তাই সক্কলকে নিয়ে মাদ্রাজে বেড়াতে গেছলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ধীরেসুস্থে ডিভোর্সের মামলার ব্যবস্থা করার কথা। সুমুর মামাও দাদুর দিকে।
…মাদ্রাজে মস্ত সফট ড্রিংক-এর রেস্তোরাঁ আছে। সকলে সেটাকে শেঠজীর ঠাণ্ডা ঘর বলে। বিরাট ব্যাপার। বড় বড় লোকেরা গাড়ি হাঁকিয়ে আসে সেখানে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জমজমাট ব্যাপার। দিশী বিলিতি যাবতীয় কোল্ড ড্রিংক এর বিশাল এয়ারকনডিশন রেস্তোরাঁ। কত বেয়ারা আর বয় খাটছে ঠিক নেই।
সুমুরা দল বেঁধে সেই কোল্ড ড্রিংক-এর রেস্তোরাঁয় তিন-চার দিন গেছে। ঠাণ্ডী ঘরের মালিক আধবয়েসী শেঠজীকে মারসিদিস গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে। কিন্তু সুমুরা তার ওপর মনে মনে খুশী নয় তেমন। গদিতে বসে শ্যেনদৃষ্টি মেলে সকলের কাজের তৎপরতা দেখেন, খদ্দেরকে খুশী করার ব্যাপারে বয় বা বেয়ারাদের এতটুকু ক্রটি দেখলে তাকে কাছে ডেকে চাপাগলায় বেশ করে ধমকে দেন।
এদের মধ্যে একটি বয় সকলের দৃষ্টি কেড়েছিল। বছর তের-চৌদ্দ বয়েস। ফুটফুটে গায়ের রং-ভারী মিষ্টি চেহারা। একমাথা কোঁকড়া চুল। ডাগর চোখ। ছেলেটা যেন সারাক্ষণ উৎসাহ আর উদ্দীপনায় ফুটছে। খদ্দের দেখলেই ছুটে যাচ্ছে, ছাপা মেনু কার্ড সামনে রেখে যাচ্ছে। খদ্দের জিজ্ঞাসা করলে কোন ড্রিংক-এর কি বৈশিষ্ট্য গড় গড় করে বলে যাচ্ছে। প্রথম দিন কি নেবে সুমুরা ঠিক করে উঠতে পারছিল না বলে ছেলেটা মিষ্টি গলায় সুমিত্রাকে বলল, চকোলেট দেওয়া ক্রিম মিল্ক শেক সিন ম্যাডাম, আমি বলছি ভালো লাগবে!
চার্ট দেখে সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, প্লেন পাইনঅ্যাপেল মিলক শেক-এর থেকে দাম বেশী কেন?
সোৎসাহে ছেলেটা বোঝালো কেন দাম বেশী। একটা ইলেকট্রিকে তৈরী হয়, অন্যটা হাতের কাজ। এতে রিস্ক বেশী, মেহনত বেশী। গড় গড় করে আরো কত কি বলে গেল ঠিক নেই।
সমস্ত রেস্তোরাঁয় ওই একটা ছেলে যেন ফুলের মতো মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সকলে তাকে ডাকে, সকলে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ফলে ছেলেটার ছোটাছুটির বিরাম নেই। অমন সুন্দর ছেলেটা যেন এই কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছে।
সুমুর মামী আবার একটু-আধটু গল্প-টল্প লেখেন। তার ধারণা, বড় দুঃখের জীবন নিশ্চয় ছেলেটার। ভদ্রঘরের ছেলে যে তাতেও সন্দেহ নেই। অভাবের দায়ে হয়তো অসুস্থ বাপ-মা এই বয়সের এমন ছেলেকে এমন কাজে ঠেলে দিয়েছে।
সেদিন রাত সাড়ে দশটায় সুমুরা সকলে মিলে সেই ঠাণ্ডীঘরে গেছল।
খদ্দেরের ভীড় তখন বেশ হালকা। এবারে দোকান বন্ধ হবার কথা। তাদের। দেখে সেই ছেলেটা ছুটে এল। এই কদিন তার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। কিন্তু গল্প করার সময় ছেলেটা পায় না, ছেলেটা তখন দস্তুরমতো ক্লান্ত, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম– তবু হাসি মুখ।
তাকে দেখে সুমিত্রার বাবা মা দাদা বৌদি সকলের মায়া হল। আর রাগ হল। দোকানের মালিক ওই শেঠজীর ওপর। দোকান বন্ধের আগে গদিতে বসে তখন কাড়ি কাড়ি টাকা গুনছে। এদের রক্ত-জল-করা পরিশ্রমের ষোল আনা ওই লোকটাই শুষে নিচ্ছে। এরা হয়তো দুবেলা ভালো করে খেতেও পায় না, আর ওই নিষ্ঠুর মালিক মারসিদিস হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে!
ছেলেটার নাম শঙ্কর। সেই রাতে সুমিত্রা তাকে এক গেলাস কোল্ড ড্রিংক খাওয়াতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছেলেটা একবার দূরের মালিকের দিকে চেয়ে হাসিমুখেই মাথা নাড়ল। অর্থাৎ এখন খাবে না। পাছে ছেলেটার কাজের ক্ষতি হয়, সেজন্য কেউ আর তাকে পীড়াপীড়ি করল না। কাজের ক্ষতি হলেই তো ওই অকরুণ মালিকের কাছে। বকনি খাবে। সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, আজও তুমি সেই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এসেছ?
–না, আমি পাঁচটায় আসি। আধ ঘন্টা আগে এসে সব দেখেশুনে নিতে হয়।
সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, সকাল থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কি করো?
সকালে বাড়িতে পড়ি, তারপর স্কুলে যাই- তারপর বিকেলে খেয়েদেয়ে। দোকানে আসি।
–রোজ?
–রোজ।
সুমিত্রার বউদি জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে তোমার কে আছেন?
–সবাই আছে।
–বাবা-মা?
ছেলেটা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আছে। তারপর মিষ্টি হেসে বলল, আমার ভাইবোন দুটো ছোট তো, তাই মা আর দোকানে আসতে পারে না। তারপর সকলকে হতবাক করে দিয়ে অদূরে গদিতে বসা দোকানের মালিক শেঠজীকে দেখিয়ে বলল, ওই তো আমার বাবা, দোকান বন্ধ হলে বাবার সঙ্গেই আমি বাড়ি ফিরি। তারপর লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, বাবা বুড়ো হেয়ে গেলে আমাকেই তো এত বড় দোকানখানা চালাতে হবে, তাই রোজ বিকেলে বাবা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে আর সেই রাতে একেবারে দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বাড়ি যাই।…আমার খুব ভালো লাগে। আর বাবা যখন নিজে কড়া খদ্দের সেজে টেবিলে বসে আমাকে সার্ব করতে বলে আর গম্ভার মুখে মিথ্যে মিথ্যে দোষ বার করতে থাকে, তখন কি মজা লাগে না! আমার কিন্তু তখনো হাসার উপায় নেই, সত্যিকারের খদ্দেরের মতোই তাকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে হয়।
সুমুর শেষ কথায় সম্বিত ফিরল যেন রমেনবাবুর। সুম বলছে, ছেলেটার সেই মিষ্টি মিষ্টি হাসি দেখে আর মিষ্টি কথা শুনে মায়ের মুখখানা যা হয়ে গেল না–তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না বাবা!
তারপর বাড়ি এসেই আমার ওপর ওই হুকুম। শুনে দাদু আর দিদা রাগ করলে, কিন্তু মা আর কোন কথায় কানও দিল না। তারপর আজ হাওড়া স্টেশানে পা দিয়েই আমাকে নিয়ে সোজা এখানে চলে এলো।
সুমিত্রা ঘরে ঢুকতেই ছেলে আর বাবা সচকিত। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সুমু যেন ধরাই পড়ে গেল। লজ্জা পেয়ে তক্ষুনি প্রস্থান করল।
রমেনবাবু সুমিত্রার দিকে চেয়ে আছেন। সুমিত্রা তার দিকে। …বাইশ বছর বাদে দুজনে দুজনকে নতুন করে দেখছেন।