দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য : 01 – বিজনের বিবৃতি
আনন্দ একদিন এসে বলল–আচ্ছা বল্ তো, প্রেমে পড়লে তবে লোকে গাড়োল হয়, নাকি শুধু গাড়োলরাই প্রেম করে?
অবাক হয়ে বললুম–হঠাৎ এ কথা কেন রে?
সে হতাশভাবে মাথা নাড়ল। তারপর বলল–আমার বসকে খুব বুদ্ধিমান মনে করতুম। ইন দা সেন্স বুদ্ধিমান ছাড়া কেউ পয়সা কামাতে পারে না এ যুগে। কিন্তু আশ্চর্য, কিছুদিন থেকে লোকটার ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে।
বাধা দিয়ে বললুম-প্রেমে পড়েছেন বুঝি ভদ্রলোক?
–প্রেম মানে কী! প্রেমেরও বাবা-মা থাকলে তাদের পাল্লায় পড়েছে। বাপস!
আনন্দ একটু বাড়াবাড়ি সব ব্যাপারেই করে। ওর কথায় গুরুত্ব কখনও দিইনে। তাছাড়া ওর বসকে আমি চিনি। রীতিমতো ঝানু ব্যবসায়-বুদ্ধির মানুষ। চৌরঙ্গি এলাকার একটা বাড়ির চারতলায় আমাদের পারুল অ্যাডভার্টাইজার্স, পাঁচতলায় আনন্দের বসের ভুবনেশ্বরী ট্রেডিং কনসার্ন। বাড়িটা বছরখানেক হয়েছে। এই এক বছরেই সাতটা ফ্লোরে গাদা গাদা ছোট-বড় কনসার্ন এসে ভিড় করেছে। ভুবনেশ্বরী এসেছে মাস ছয়েক আগে। আনন্দর সঙ্গে তারপর থেকে আলাপ ও বন্ধুত্ব। হয়েছে। সে রীতিমতো কোয়ালিফায়েড, গুণী ছেলে যাকে বলে। কমার্সের খাসা একটা ডিগ্রি আছে। অথচ ভীষণ সাহিত্যরসিক সে। আমরা ক’জন ব্যর্থ শিল্পী সাহিত্যিক (কবিও) মিলে এই পারুল ব্যাপারটা গড়ে তুলেছিলুম। অবশ্য পারুল বলে আমাদের কারো কোন প্রেমিকা বা আত্মীয়া নেই, ওটা জাস্ট একটা নাম। অর্থাৎ রূপকথার সেই ‘সাতভাই চম্পার এক বোন পারুল’ আইডিয়া। তা, আনন্দ। কীভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল যে আমরা শিল্প-সাহিত্যের একদল বাউণ্ডুলে ছেলে। যেচে পড়ে সে আলাপ করতে এসেছিল। তাদের বিজ্ঞাপনের সব দায়িত্বও আমাদের মতো খুদে প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেই দিক থেকে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ না ছিল এমন হতে পারে না। তবে, আসলে আনন্দের মধ্যে বন্ধুতার অনেক গুণ তো ছিলই। মাঝে মাঝে বেমক্কা রুচিবিগহিত স্ল্যাং বলে ফেললেও তার মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ সংস্কৃতিবোধ আমরা লক্ষ্য করেছি এবং কালক্রমে আনন্দ আর আমাদের মধ্যে তুই-তোকারিও এসে পড়েছে।
তখন সময় কাটায় কাটায় সাড়ে এগারোটা। শেখর রঞ্জন সেলিম কেউ তখনও আসেনি। তাদের আসতে বারোটা হয় সচরাচর। কোন নিয়মকানুনের বালাই অবশ্য নেই। শুধু আমাকে নিয়মিত সময়ে আসতেই হয়। কারণ এক অলিখিত চুক্তি অনুসারে নেতৃত্ব আমার কাঁধেই বর্তেছে। তাছাড়া, আমাদের কোন কর্মচারী নেই–এক বেয়ারা বা পিওন কাম-বিল কালেক্টর মধুসূদন বাদে।
আনন্দ চোখ বুজে মাথাটা হেলিয়ে পা নাচাচ্ছিল। ওইভাবেই বলল–চা আনতে বল্।
মধু ফাইল ঝাড়পোঁছ করছিল। ধুলো না জমলেও তাকে এসব করতে হয়। চাকরি যাবার ভয় তার প্রচণ্ড। তাকে চা আনতে বললুম। সে তক্ষুণি কেটলি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এবার আনন্দকে একটু তিরস্কারের ভান করে বললুম–মধুর সামনে বসের নিন্দে করছিস! জানিস বেয়ারাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ব্যাপার থাকে? তোদের বেয়ারার কানে তুলতে পারে–তারপর মিঃ গুস্টার কানে ওঠা অসম্ভব নয়।
আনন্দ হাসতে লাগল।–মধু তেমন লোক নয়।
বললুম–মিঃ গুপ্টা কার প্রেমে পড়েছেন রে? ওঁর তো বউ-ছেলেমেয়ে রয়েছে।
আনন্দ বলল–আরে, সে তো প্রথমপক্ষ।
–প্রথমপক্ষ! তাহলে দ্বিতীয়পক্ষ আছে নাকি?
–আছে তা কি আমিই জানতুম? কিছুদিন আগে জানতে পারলুম। আপন গড়, বিশ্বাস কর, এ জিনিস বস কীভাবে ম্যানেজ করল ভাবা যায় না। বছর তেইশ-চব্বিশ বয়েস, স্লিম অ্যান্ড ট্রিম চেহারা, যাকে বলে বিউটিফুল! আর সে কী গ্ল্যামার মাইরি! নির্ঘাত ফিলম-লাইন থেকে বোঁটা ছিঁড়ে তুলে এনেছে।
–দুই বউ এক জায়গায় থাকে না নিশ্চয়?
-পাগল! বড় বউ জানেই না কিছু। তাহলে তো গোড়াতেই জানতে পারতুম। ইনি থাকেন ক্যামাক স্ট্রিটের এক দশতলা বাড়ির সাততলায়। সে ফ্ল্যাটের বর্ণনা আমি দিতে পারব না। ওসব তোদের জিনিস। প্রথমে আমি তো ক্যাবারে গার্ল ভেবেছিলুম!
–কিন্তু আইনে তো দুটো বউ মানা।
আনন্দ উদাসীন সুরে বলল–কে জানে! বড় বউ তো জানে না কিছু।
–তাহলে তোরই ভুল হয়েছে। বউ-টউ নয়-জাস্ট মেয়েমানুষ।
–মোটেই না বিবাহিতা স্ত্রী। এবং বাঙালি মেয়ে।
বাঙালি মেয়ে!
-হ্যাঁ। গুপ্টাসায়েবের মা-ও তো বাঙালি মেয়ে। বুড়ি বোম্বে থেকে মধ্যে মধ্যে আসে। অবশ্য সেও কিছু জানে না। যথারীতি বড় বউয়ের কাছে গিয়েও ওঠে। গুপ্তাসায়েবের এই গুপ্টা ব্যাপারটা আমি আর দু-চারজন ছাড়া কেউ জানে না।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম–তাই গুপ্টাসায়েব অমন চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। অ্যাদ্দিনে বুঝলুম, তাই…
— আনন্দ বাঁকা ঠোঁটে বলল–তুই সাহিত্যিক হলে কী হবে? সবকিছু বড্ড দেরিতে বুঝিস।
–যাক গে! তা আনন্দ, তোর বস অমন দ্বিতীয়পক্ষ থাকতে ফের প্রেমে পড়লেন কোথায়?
আনন্দ অবাক হয়ে বলল–তুই লিখিস কীভাবে? নির্ঘাত বিদেশী নভেল মেরে চালাস। আরে, সুন্দরী তরুণী বউয়ের প্রেমে পড়তে বারণ আছে মানুষের?
হাসতে হাসতে বললুম–ভ্যাট! সে তো দাম্পত্যপ্রেম!
বাঃ! দাম্পত্যপ্রেম প্রেম নয়?
–মোটেও না। ওটা পুরুষের স্ত্রৈণতা।
আনন্দ হতাশ ভঙ্গিতে বলল–তোর সঙ্গে তর্কে আমি পারব না। স্ত্রৈণতা কী জানি না, আমি শালা এক ব্যাচেলার। আমার চোখে ব্যাপারটা প্রেম ছাড়া কিছু নয়। তা না হলে ভাবতে পারিস, আমার বস গাড়ি বেচে ঊর্মিলাসুন্দরীর বায়নাক্কা মেটাচ্ছে! আপন গড়–অত ভালো গাড়িটা সতের হাজারে বেচে দিলে গুপ্টাসায়েব। বললে–আনন্দবাবু, তেলের যা আকাল পড়েছে, আর গাড়ি চাপা যাবে না। ভাবলুম, তাই হবে। উরে হালুয়া! পরদিন আমাকে যেতে বলল ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। গেলাম। তারপর ঊর্মিলাসুন্দরীকে নিয়ে বেরোলেন। ট্যাক্সি করে আমরা চললুম সোজা ব্যারাকপুর। তখন বুঝিনি কিছু। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা পুরনো আমলের বাগানবাড়ি কেনা হচ্ছে। ছোট বউকে ইতিমধ্যে করে এনে দেখিয়েছে। পছন্দও হয়েছে বিবির। এবার অ্যাডভান্স করা হবে। বিবির সামনেই সেটা করতে চায় গুপ্টাসায়েব!….
মধু চা আনল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আনন্দ ফের বলল বাগানবাড়িটা কিন্তু অপূর্ব! সাত একর জায়গার মধ্যে একতলা বাড়ি দুই পার্টে পাঁচটা করে দশটা ঘর। চারপাশে মাঠে অজস্র গাছপালা। ছ-ফুট উঁচু পাচিলের বাউন্ডারি। লোকে বলে, দানিয়েল সায়েবের কুঠি।
–দানিয়েল সায়েবের কুঠি! অবাক হয়ে বললুম।
–কেন, চিনিস নাকি?
নিশ্চয় চিনি। ওর মালিক ভদ্রলোককেও চিনি। সেলিমের এক মাসতুতো ভাই ওঁর কনসার্নে চাকরি করে। চিৎপুরে ব্যবসা আছে মস্তোবড়ো। সেলিমের ভাইয়ের সূত্রে আমরা বার দুই ওখানে পিকনিক করে এসেছি। এবার জানুয়ারিতেও গিয়েছিলুম। রাত্রে ছিলুম আমরা। কিন্তু বাড়িটায় নির্ঘাত ভূত আছে রে!
আনন্দ খিকখিক করে হাসল।–তাহলে তো ভালই জমবে!
–সে এক অদ্ভুত রাত্রি ছিল! শেখররা তো মাল-টাল খেয়ে মেঝেয় গড়াচ্ছিল। আমার একেবারে ঘুম হয়নি। অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছি সারা রাত!
আনন্দ গম্ভীর হয়ে বলল–বাড়িটার একটা হিস্ট্রি আছে।
–শুনেছি।
–দানিয়েল সায়েব ছিল মিলিটারির বড় অফিসার। রিটায়ার করে বাড়িটা বানায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। সিপাহি বিদ্রোহের শুরু তো ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে। ব্যাটা অনেক সিপাহি মেরেছিল। পরে নাকি পাগল হয়ে যায়। তারপর…
আনন্দর বলার দরকার ছিল না। আমি সব জানতুম বাড়িটা অনেকে কিনেছে, তারপর বেচে দিয়েছে। কারণ নাকি যে-ই কিনেছে, তারই একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। ফলে অনেককাল খালি পড়ে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যরা ওখানে ছিল। কী একটা উপলক্ষে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তাদের চারজন খুন হয়ে যায়। দলটাকে ছত্রভঙ্গ করে নানা জায়গায় বদলি করা হয়। তারপর ফের বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। সরকারি সম্পত্তি তখন। সেই সময় শ্রীলঙ্কার এক মুসলমান ব্যবসায়ী সাহস করে বাড়িটা কিনে নেন নেহাত জলের দামে। বাড়ির দোষ কাটাতে খুব ধুমধাম করে মৌলবি এনে মিলাদ অনুষ্ঠান হয়েছিল। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, একা এক বৃদ্ধ মৌলবি ওই ভুতুড়ে জনহীন বাড়িতে সারারাত জেগে সুর ধরে কোরানের শ্লোক উচ্চারণ করে যাচ্ছেন।
মৌলবি বলেছিলেন বাড়িটায় দুষ্ট জিনের উপদ্রব আছে। তবে সবগুলোকে আমি এই আতুরের শিশিতে ভরে ফেলেছি। নিয়ে গিয়ে আরবসাগরে ফেলে দিয়ে আসব।
কিন্তু বর্তমান মালিক ইদ্রিস মিয়া বলেন, তার আগে মৌলবিসায়েবকে জিনগুলো কম জ্বালায়নি। মার্কিনিরা থাকার সময় ইলেকট্রিক লাইন নিয়েছিল। ফাটা ছাদে জল চুঁইয়ে সব ড্যামেজ হয়ে যায়। তারপর আর মেরামত হয়নি। নানাসায়েব (মাতামহ) কিনেছিলেন তো মাত্র দশ হাজারে। মেরামতি খরচা হিসেব করে দেখা গেল, বারো হাজারেও পার পাওয়া যাবে না। তাই উনিও বেচবার ফিকির খুঁজছিলেন। যাইহোক, মৌলবিসায়েব লণ্ঠন জ্বেলেই রাত কাটাতেন। এক রাতে কীভাবে তার মশারিতে আগুন ধরে যায়। মশারির ভেতর বসে উনি কোরান পড়ছিলেন। সে এক কাণ্ড। বেরোতে গিয়ে লেপটালেপটি হয়ে দাড়ি-টাড়ি পুড়ে একাকার হল। তবে অমন তেজী নাছোড়বান্দা মৌলবি দেখা যায় না। কোরান-পাঠ শেষ করে তবে আতরের শিশিতে জিন পুরে নিয়ে মক্কা রওনা হলেন। নানাসায়েব ওঁকে হজে যাবার মতো টাকাকড়ি দিয়েছিলেন।
ইদ্রিস মিয়ার ছেলেপুলে নেই। সুশিক্ষিত আধুনিক যুগের মানুষ। ধর্মকর্মের ধার ধারেন না। ভূত-প্রেতে বিশ্বাস নেই একটুও। নানার মৃত্যুর পর এ সম্পত্তির মালিক হলেন তিনি। কলকাতায় এসে ব্যবসা পাতলেন। কিন্তু দানিয়েল কুঠিতে গিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। তখন দেশ ভাগ হয়েছে। দলে দলে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছে। তাদের একটা দল বাড়িটা জবরদখল করে ফেলেছেন।
ইদ্রিস খান মানুষ হিসেবে দয়ালু সন্দেহ নেই। ছিন্নমূল পরিবারগুলোকে তাড়ানোর কথা তাঁর মাথায় আসেইনি। বরং তাদের সঙ্গে ভাড়ার বন্দোবস্ত করে নিলেন। কিন্তু ভাড়াটা দেবে কোত্থেকে? কেউ মাস গেলে কিছু দেয়, কেউ দেয় না। ভাড়া বাকি পড়তে লাগল। শেষ অব্দি মামলা করতে হল। মামলা চলল। তিন-চার বছর ধরে। তারপর দখল পেলেন। ততদিনে অনেক পরিবার ওখান থেকে চলেও গেছেন। দখল নিতে গিয়ে দেখা গেল, একটি পরিবার বাদে আর কেউ নেই। কারণ?
কারণ, স্রেফ ভূত। কীভাবে হয়তো আতরের শিশির ছিপির ফাঁক গলিয়ে দু একটা ভূত বেরিয়ে পড়েছিল। বেরিয়ে সোজা ফিরে এসেছিল নিজেদের পুরনো আস্তানায়। রাত দুপুরে কড়িকাঠে তারা বাদুড়ের মতো ঝোলে আর নাকি সুরে গান গায়। অদ্ভুত-অদ্ভুত রোগ জন্মায় বাসিন্দাদের শরীরে। নানা অঘটন।
বাড়িটা তো এল হাতে। কিন্তু ওখানে কলকাতায় ব্যবসা রাখা আর এখানে এতবড় বাড়ি খালি ফেলে রাখা, দুটোর তাল সামলাতে ভদ্রলোক হিমশিম খাচ্ছেন। একজন নেপালি দারোয়ান রেখেছেন। সে বাউন্ডারির গায়ে বানানো ছোট্ট ঘরটায় সপরিবারে থাকে। তাহলেও ইদ্রিস খান দুদিন অন্তর রাত্রে এসে ওখানে থাকেন। সঙ্গে থাকে আমাদের শিল্পী সেলিমের সেই মাসতুতো ভাই রনু। রোববার সারাটা দিনরাতই থাকেন ওঁরা। খানিকটা দূরে বসতি এলাকায় হোটেলে খেয়ে আসেন। কখনও নিজেরাও রান্না করেন। কিচেনে রান্নার সব সরঞ্জামই রয়েছে। সামনের বড় হলঘরে দুটো খাঁটিয়া, একটা টেবিল আর গোটা দুই চেয়ার আছে। দেয়ালে পেরেক পুঁতে দড়ি টাঙানো হয়েছে কাপড়চোপড় রাখার জন্যে। একটা ক্যালেন্ডারও দেখেছিলাম–সুন্দরী তরুণীর হাসিভরা মুখ।
দুবার গিয়ে আমরা খুব হই-হল্লা করেছিলুম। ওখানে অনেকেই কলকাতা থেকে ছুটির দিন গিয়ে পিকনিক করে আসে। কিছু চার্জ নেন ইদ্রিস। আমাদের অবশ্য কিছু দিতে হয়নি।
শুনেছিলাম, বাড়িটা বেচবার তালে আছেন ভদ্রলোক। সত্তর হাজার দাম দিতে চেয়েছে কোন এক মারোয়াড়ি। ভেঙে কারখানা বানাবে। কিন্তু লাখের কমে দেবেন না ইদ্রিস। তবে লাখ টাকা পাওয়াও আপাতত লাক। যা বদনাম বাড়িটার! জেনেশুনে কি কেউ নিতে চাইবে? যারা জানে তারাই এসে দরাদরি করে। তারপর পিছিয়ে যায়…
সেই ভুতুড়ে বাড়ি গুপ্টাসায়েব তাঁর তরুণী স্ত্রীর জন্যে কিনছেন শুনে আমি রীতিমতো তাজ্জব বনে গেলুম। ওঁরা নিশ্চয় জানেন না এ বদনাম।
সেদিনই বিকেলে করিডোরে গুপ্টাসায়েবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যথারীতি হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন–হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো!
-কেমন আছেন স্যার?
–ভেরি গুড। কোন তকলিফ নেই।
ইয়ে, সেলিম বলছিল, ওর এক আত্মীয়ের কাছে শুনেছে, নাকি ব্যারাকপুরে দানিয়েল সায়েবের কুঠিবাড়ি আপনি কিনছেন!…খুব স্বাভাবিকভাবে বললুম কথাটা।
মিঃ গুপ্টা একটুও বিচলিত না হয়ে জবাব দিলেন–দ্যাটস্ রাইট। সেলিমের আত্নীয়-ও, বুঝেছি। রনু? খানসায়েবের কর্মচারী তো?
-হ্যাঁ।
–বাড়ি কিন্তু অপূর্ব! আপনাকে নিয়ে যাব একদিন। লেখার ম্যাটার পাবেন যথেষ্ট।
একটু হেসে বললুম–আমি গেছি। একরাত্রে ছিলুমও।
তাই নাকি? বলে হো হো করে হাসলেন মিঃ গুপ্টা।ভূতে জ্বালায়নি তো? কেউ কেউ আমাকে নিষেধ করছে, বাড়িটার খুব বদনাম আছে নাকি।
–আমিও শুনেছি। তবে ওসব সুপারস্টিশন তো থাকেই। সব পুরনো খালি বাড়ি কেন্দ্র করে নানান অদ্ভুত গল্প ছড়ায়।
–ইউ আর রাইট। সুপারস্টিশন! তবে আমার স্ত্রীর ভীষণ পছন্দ হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী, ও গোলমাল হই-চই একেবারে পছন্দ করে না। কলকাতায় এসে হাঁপিয়ে উঠেছে, যা ভিড়! ফ্ল্যাট ছেড়ে একবারো বেরোতে চায় না। বলে, রাস্তায় নামলেই গা ঘিনঘিন করে।
বলেই মিঃ গুপ্টা হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে টানলেন।আসুন না, আমার চেম্বারে। গল্প করা যাক। মনটা খুব ভালো আছে আজ। ইমপোর্ট লাইসেন্সটার জন্যে খুব ছুটোছুটি করছিলাম। এবার নাইনটি পারসেন্ট সফল হওয়া গেছে। শুধু টেন পারসেন্ট ঝুলছে-জাস্ট এ সিগনেচার। হয়ে যাবে! আসুন।
মিঃ গুপ্টার বয়স কমপক্ষে বাহান্ন হবেই। চুলে পাক ধরেছে নিশ্চয়, কিন্তু কলপ করেন। চাঁছাছোলা ঝকঝকে মুখ, খাড়া নাক, ঠোঁটের কোনায় বুদ্ধিময় ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। চোখে চশমা আছে, কিন্তু দৃষ্টি খুব জ্বলজ্বলে। হঠাৎ এই সাড়ে ছ’ফুট উঁচু বলিষ্ঠ ফরসা লোকটিকে দেখলে যুবক বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু একটু পরে বয়সটা ধরা পড়তে বাধ্য। কারণ, হঠাৎ-হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে পড়েন বা গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলে ওঠেন।
তাহলেও মিশুকে লোক। ওঁর চেম্বারে যাবার পথে আনন্দ কোনার টেবিল থেকে আমাকে বক দেখাল।
চেম্বারটা ছোট্ট। কিন্তু রুচির পরিচয় আছে গোছ-গাছে। ছোট্ট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর আর্টসের সামগ্রীও দু-একটা রয়েছে।
–হট না কোল্ড বলুন?
মার্চের দু তারিখ আজ। গরম পড়েও এবার যেন পড়ছে না। রাতের দিকে সিরসির করে শীত আসে। এ সময় হট কোল্ড আমার কোনটাই ভাল লাগে না। বছরের এই সময়টা ভারি অদ্ভুত। ঠাণ্ডা খেলে মনে হয় ঠাণ্ডা লাগবে, গরম খেলে মনে হয় ভীষণ গরম লাগবে।
বললুম-কিছু না। এইমাত্র চা খেয়েছি।
–দেন, কফি?
না, থাক্।
একটু চুপ করে থেকে দুলতে দুলতে মিঃ গুপ্টা বললেন–আপনি কী বলেন?
–কিসের?
বাড়িটা। আমার স্ত্রীর ভীষণ পছন্দ। সে তো এ-বেলায় পেলে ও-বেলায় গিয়ে ওঠে! আসলে হয়েছে কি জানেন, ও বোম্বের শহরতলি এলাকায় এমন জায়গায় মানুষ, যেখানে কোন ভিড় নেই, গোলমাল নেই, স্রেফ নির্জন একটা-একটা বাড়ি–প্রচুর ফাঁকা জায়গা, বাগান, গাছপালা! ছোট ছোট হিলকও রয়েছে, অন্যদিকে সি-বিচ। কলকাতা ওর একদম পছন্দ নয়। এখানকার অ্যাসোসিয়েশনেও ও ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই বাইরে একটা বাড়ি খুঁজছিলাম। মিলেও গেল। কিন্তু…।
ওঁকে চুপ করতে দেখে বললুম–তাহলে আর কিন্তু কী?
–কিন্তু আমি তো সারাদিন এখানে থাকব। ও একা কীভাবে ওখানে কাটাবে?
–একজন আয়া-টায়া ঠিক করে দিন। সারভ্যান্টও দরকার হবে।
–দেখা যাক্। মোটা টাকা অ্যাডভান্সও করা হয়েছে. পাক্কা রিসিপ্ট বা ডিড কিছু হয়নি এখনও। নব্বই হাজারে রফা হয়েছে। ইন ইকোয়াল সিক্স ইয়ারলি ইনস্টলমেন্টে টাকা শোধ করতে হবে। এমন চমৎকার সুযোগ হয় না। ওনার। ভদ্রলোক রিয়্যালি ও ভেরি কাইন্ডহার্টেড ম্যান। যদ্দিন টাকা পুরো শোধ না হয়, আমাকে উনি অর্ধেক অংশে দখল দিচ্ছেন। তবে ভাড়াটে হিসেবে!
–ভাড়াটে হিসেবে! সে কী? ভাড়াও দিতে হবে নাকি?
সামান্য। মাসে একশো টাকা। তবে কিস্তি শোধ হলে ভাড়ার টাকাটা পুরো ফেরত পাব আমি। এর চেয়ে আর কতটা বেনিফিট আশা করা যায় বলুন? তার মানে ছ’বছরে কথামতো টাকা শোধ হলে আমি ফেরত পাচ্ছি বাহাত্তর শো টাকা।
–একেবারে নিলেই তো পারতেন।
হেসে উঠলেন মিঃ গুপ্টা। –মশাই, কী ভাবেন আমাকে! স্রেফ পরের টাকায় ব্যবসা করি। ধার-দেনায় ডুবে আছি। ব্যাঙ্কের লোনের সুদই দিতে হয় মাসে দেড় হাজার টাকা। বাইরে উঁট বজায় রেখেছি মাত্র। তবে ইট ইজ সিওর, ইমপোর্ট লাইসেন্সটা হাতে এসে গেলেই তখন দেখবেন প্রকাশচন্দ্র গুপ্টা কী কাণ্ড করে!
উনি আবার হেসে উঠলেন। আমার মাথায় ওঁর এই স্ত্রীমহোদয়া সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন গজগজ করছিল। কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো যায় না। শেখরটা থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। সে এসব ব্যাপারে যেমন নির্ভীক, তেমনি বেহায়া। কিন্তু আমিও নিজেকে দাবায়ে রাখতে পারলুম না! অভিমানী সুরে বললুম–মিঃ গুপ্টা, এটা কী হচ্ছে বলুন তো?
কী, কী? বলে ঝুঁকে এলেন মিঃ গুপ্টা।
–অমন গুণবতী বউদির সঙ্গে একবারও আলাপ হল না এ অভাগার।
–নিশ্চয়, নিশ্চয়। কেন নয়? আসুন না একদিন!
–বাঃ! কোথায় যাব, কখন যাব–তার ঠিক নেই..
বাধা দিয়ে মিঃ গুপ্টা বললেন–আনন্দ আপনাকে নিয়ে যাবে। সামনের রোববার আসুন। বলে কোন গুপ্তস্থানে চাবি টিপলেন। ঘণ্টা বাজল।
একজন বেয়ারা এল। বললেন–আনন্দবাবুকো বোলাও।
একটু পরেই আনন্দ এসে দাঁড়াল। আমার সঙ্গে তার প্রবল বন্ধুতা–অথচ তার বসের সামনে এখন বসে আছি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া, তাই সে সপ্রতিভ হেসে আমাকে বলল কতক্ষণ? আমি লক্ষ্যই করিনি তুই…।
মিঃ গুপ্টা গম্ভীরমুখে বললেন–আনন্দ, তুমি এঁকে বাসা থেকে নিয়ে সামনের রোববার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে যাবে। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। তোমার আবার কিছু মনে থাকে না। লিখে রেখো। সকাল ন’টা।
–আচ্ছা স্যার।
–ও-কে। এসো।
বেচারা আনন্দ বিরসমুখে চলে গেল। আমি বললুম–কেন? একা আমিও যেতে পারতুম! ওকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী ছুটির দিনে?
না। ওকেও ওদিন যেতে হবে। দরকার আছে। আপনার বাসা হয়ে আসবে। ও চেনে তো? সরি!… বলে ফের বোতাম টিপলেন।
বললুম-ওকে ডাকার দরকার নেই। আমি বলে দেব’খন।
–উঁহু। ভুলে যাবে। …সেই বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছিল। তাকে বললেন ফির আনন্দবাবুকো বোলাও।
আমি মনে মনে হাসছিলুম। এবার আনন্দ এল কঁচুমাচু মুখে। হাতে একটা নোটবই, খোলা কলম। স্যার?
–তোমাকে বললুম যে এঁকে বাসা থেকে নিয়ে যেতে হবে–আর তক্ষুণি ঘাড় নেড়ে বললে–আচ্ছা স্যার। কিন্তু চেনো এঁর বাসাটা কোথায়?
-না স্যার।
মিঃ গুপ্টা হেসে ফেললেন। কে–আনন্দ আপনারাই নিন বিজনবাবু। ও আসলে আর্টসলাইনের ছেলে, ভুল করে কমার্সে এসে পড়েছে! ভীষণভীষণ আত্মভোলা! নিন, বলুন বিজনবাবু।
ওর হাত থেকে খাতাটা নিয়ে ঠিকানা লিখে দিলুম। দেখে আনন্দ বলল আরে! আমার বড়দার বাসার কাছেই তো! ঠিক আছে।
ও চলে গেলে মিঃ গুপ্টা বললেন–আপনার বউদি ভীষণ বই-টই পড়ে। আপনার তো বই-টই আছে। পারলে দু-একটা নিয়ে যাবেন, ভাব হয়ে যাবে।
এই সময় সেই বেয়ারাটা ঢুকে আমাকে বলল–আপকা লিয়ে সেলিম সাহাব ইন্তেজার করছে, স্যার। বহুৎ জরুরি কাম আছে। মধু আভি এসেছিল।
বিরক্তমুখে উঠে দাঁড়ালাম।–চলি মিঃ গুপ্টা।
উনি কাগজের পাতায় চোখ রেখে বললেন–ওকে। উইশ ইউ গুড় লাক। রোববার সকাল ন’টা। রাইট?
–নিশ্চয়।
আমাদের অফিসে আসতেই সেলিম তেড়ে এল।–শালাকে আজ মেরেই ফেলব। কী ফুসুর ফুসুর করতে গিয়েছিলি রে গুপ্টার কাছে? ওর দ্বিতীয় পক্ষ ডাইনী মেয়েছেলে তা জানিস? রক্ত চুষে ছিবড়ে করে ফেলবে–মরে যাবি বলছি। এখন শোন্ মোহিনী জুয়েলার্স পেমেন্ট দেবে না। নট এ সিঙ্গল ফার্দিং!
ঘাবড়ে গেলুম তক্ষুণি। সর্বনাশ! ওদের বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে বরাবর মোটা কমিশন আমরা পেয়ে থাকি। এই বিজ্ঞাপনটা ছিল চারটে দৈনিকে। কম করেও শ’পাঁচেক আমাদের পাওনা। এর দিকে হাপিত্যেশ করে সবাই বসে আছি। দৈনিকগুলো আমাদের কাছে যথারীতি বিল পাঠিয়েছে। অথচ পেমেন্ট দেবে না পার্টি, এর কী মানে হয়?
হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে সেলিম বলল–বিজ্ঞাপনে যা ছবি দিয়েছ তোমরা, মোহিনী জুয়েলার্সের বুড়ো মালিক আগুন হয়ে গেছে। আমাকে তো জুতো ছেড়ে আর কী!
বাঃ! ওরা তো ডিজাইন ম্যাটার সব অ্যাপ্রুভ করেছে!
–কে করেছে? খোদ মালিক করেছে কি? মালিকের নাতি তো একরত্তি চ্যাংড়া। তার সইয়ের কোন দাম নেই।
শেখর চুপচাপ বসেছিল। বলল–সিল তো দিয়েছে। চালাকি নাকি? মামলা করব।
বললুম–বুড়োর বক্তব্য কী?
সেলিম বলল–ছবিটা অশ্লীল। তার ওপর নাকি ভুল হিসট্রি বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে মেয়েরা ন্যাংটো থাকত বলে কোন ব্যাটাচ্ছেলে?
–যা বাবা! ন্যাংটো কোথায়? বুকে কাঁচুলি, কোমরে ঘাগরা! ও তো জাস্ট কালিদাসের নায়িকা!
সেমিল বলল–বোঝা গে না বুড়াকে। আমি ভাই আর যাচ্ছি নে!
রঞ্জন বাইরে থেকে ঢুকে বলল–হলটা কী? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?
বললুমহল মাথা আর মুণ্ডু! সেলিম, তুই কিন্তু ছবিটা এঁকেছিস! মাইন্ড দ্যাট! তখনই আমি বলেছিলুম–যে মেয়েরা অমন ন্যাংটামি মানত, তারা সোনারুপোর গয়না পরত না। স্রেফ ফুল আর পাতা দিয়ে সাজত। তুই শুনলিনে!
সেলিম বলল–থাম। ইতিহাসের পণ্ডিত তুই!
রঞ্জন বলল ঠিক আছে। গোলমাল পরে করিস। আমাকে বুঝিয়ে বল্ তো, কী হয়েছে।
ওকে সেলিম বোঝাতে থাকল। আমি শেখরকে বললুম–এই, চ–তুই আর আমি ব্যাপারটা দেখে আসি।
শেখর বলল–ছেড়ে দে। টাকা ওর বাপ দেবে।
–সবটাতেই তোর ওই? পেমেন্টটা না পেলে আমাদের নামে কেস করে টাকা আদায় হবে জানিস?
শেখর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। চল্, দেখে আসি। এক মিনিট, সেই অজন্তা সংক্রান্ত ইংরিজি বইটা সঙ্গে নিই। বুড়োর তাক লেগে যাবে।
আমরা বিশাল সেই ভারী কেতাবটা নিয়ে এক বুড়ো মক্কেলের সঙ্গে লড়তে বেরোলুম।
সেই রোববার আসার আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে আলাপ হয়ে গেল ঊর্মিলা গুপ্টার সঙ্গে। শনিবার বিকেলে আর সব অফিস তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আনন্দকেও যেতে দেখেছি। যাবার সময় সে একটা অদ্ভুত ইশারা করে গিয়েছিল, তখন বুঝিনি। একটু পরে বুঝলুম–যখন গুপ্টাসায়েব বাইরে থেকে সাড়া দিলেন–মে উই কাম ইন জেন্টলমেন?
আমরা চারজনে কেউ টেবিলে কেউ চেয়ারে পা তুলে গাঁজাচ্ছিলুম। তক্ষুণি সিরিয়াস হয়ে নড়েচড়ে বসলুম। সেলিম লাফ মেরে খাড়া হল। রঞ্জন হকচকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। শেখরের চোখদুটো গোল হয়ে যেতে দেখলুম।
আনন্দর বর্ণনায় বাড়াবাড়ি তো ছিলই না, বরং বেচারার ভাষায় কুলোয়নি– শ্ৰীমতী ঊর্মিলা (পরে জানতে পারি ওঁর নাম আসলে ঊর্মিমালা) প্রচণ্ড পরীমূর্তি, অবিশ্বাস্য শরীর! আমি ওঁর ডানাদুটোও দেখতে পাচ্ছিলুম। পরে রঞ্জন বলেছিল, আরব সাগরের এই ঢেউ হুগলি নদীর সব জেটি ভাসিয়ে দেবে।
হালকা নীল শাড়ির জমিনে সোনালি বিন্দুর ঝিকিমিকি, জোরালো আবেগের মতো দুই স্বাধীন বাহু, ডিমালো খোঁপায় গোঁজা একটি তাজা গোলাপ ইত্যাদি মিলে মিসেস গুপ্টার অস্তিত্ব আমাদের ক্ষুধার্ত ঘর ভরে দিল। তীব্র সুগন্ধের ঝঝ ভনভন করে উঠল।
মনে হল, গন্ধটা এ ঘরে চিরকাল থেকে যাবে।
সুন্দর কিছু দেখলেই বরাবর আমি সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ি। ধুরন্ধর মিঃ গুপ্টা নিশ্চয় টের পেলেন আমাদের চার-আনাড়ি ব্যাচেলারের হকচকানি ভাব। মৃদু হেসে বললেন–আলাপ করিয়েই দিই। ঊর্মি, এনারা সেই শিল্পী-সাহিত্যিক গ্রুপ! আর…
বলার দরকার ছিল না। চারজোড়া হাত এক সঙ্গে নমস্কার করল। জবাবে শ্ৰীমতী ঊর্মিও ঠিক ফিল্মস্টারের ঢঙে নমস্কার করলেন। ঠোঁট থেকে সেন্টের ফোঁটার মতো হাসি ঝরে পড়ল। তারপর বললেন–বিজনবাবু কে?
খুশিতে ভরে গেলুম। মিঃ গুপ্টা বললেন–উনি বিজন আচার্য, ইনি রঞ্জনবাবু…
রঞ্জন বলে দিল রায়!
ইয়া। রঞ্জন রায়। আই থিংক, হি ইজ এ পোয়েট।
শেখর বলল–আমি শেখর ব্যানার্জি। ছবিটবি আঁকি।
সেলিম ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। এবার শুধু বলল–আমি সেলিম আমেদ।
হঠাৎ ঊর্মি তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন। কেমন যেন চমকে উঠলেন মনে হল। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হল–কিন্তু শুধু ‘আচ্ছা’ বলে থেমে গেলেন।
এতক্ষণ বললুম দাঁড়িয়ে কেন আপনারা? বসুন, বসুন।
মিঃ গুপ্টা ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখে বললেন–না ব্রাদার। বসা যাবে না। জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ঊর্মি এল, তো ভাবলুম আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এনিওয়ে, ঊর্মি, এঁদের তাহলে কাল সকালে চায়ে জন্যে ইনভাইট করি?
ঊর্মি একটু হাসলেন–কেন নয়? বিজনবাবুর তো যাবার কথা ছিল, বলছিলে।
শেখররা আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকাল। বললুম–আমার নামটা আপনার জানা আছে দেখছি।. এমন কোন সুকৃতি আমার আছে কি?
মিঃ গুপ্টা বললেন–খু-উ-ব। ঊর্মি ভীষণ ফিল্ম ম্যাগাজিন পড়ে। আপনার লেখার ফ্যান।
এটা মিঃ গুপ্টার বাড়াবাড়ি হতে পারে। কারণ এসব স্ত্রীলোক বাংলায় আদৌ কিছু পড়েন বলে আমার ধারণা নেই। যা পড়েন, তা ইংরিজি ব্ল্যাস ধরনের আজেবাজে সব পত্রিকা–যাতে বিজ্ঞাপনই বেশি টানে পাঠককে।
কিন্তু ঊর্মি বললেন–নববঙ্গ পত্রিকায় আপনার একটা থ্রিলার পড়লুম। ভালো লেগেছে।
বলে কী। থ্রিলার আমি কবে লিখলুম? স্রেফ গুল ঝাড়ছে। আমতা আমতা হাসতে হয় এসব ক্ষেত্রে। ও আর এমন কী লেখা, বাজে, ইত্যাদি বলতে হয়।
ঊর্মি পরক্ষণে ফের বলে উঠলেন–মেয়েরা প্রেমিককে খুন করতে পারে কি না, আই ডাউট। তবে আপনি নিশ্চয় অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। দ্যাটস্ অ্যান এক্সসেপশান, আই থিংক।
তাহলে সত্যি পড়েছেন তো? কিন্তু ওটা থ্রিলার হতে যাবে কেন? নিছক প্রেমের গল্প। প্রেম নিয়ে চিরকাল একটু আধটু খুনোখুনি কি হয়ে আসছে না?
তারপর হঠাৎ আমাদের চমকে দিয়ে সেলিমের দিকে ঘুরে বলে উঠলেন– আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
সেলিম আস্তে জবাব দিল–বোম্বোতে।
ভুরু কুঁচকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন ঊর্মি। ঠোঁটের একটুখানি কামড়ে ধরলেন। বোম্বে ইজ এ বিগ প্লেস। ঠিক কোথায়…
বান্দ্রায়। মিঃ লাহিড়ীর স্টুডিওতে।
লাহিড়ী। ও। দ্যাট–পেইন্টার।
–হ্যাঁ। তাছাড়া অবনীদার পাশেও আমাকে দেখেছেন। ফিল্ম ডাইরেকটার।
তাই বুঝি।… বলে ঊর্মি স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
মিঃ গুপ্টা ঘড়ি দেখলেন আবার। ওকে ফ্রেন্ডস? আজ চলি। তাহলে কথা রইল, আগামী কাল সকালে আপনারা কাইন্ডলি একটু ম্যানেজ করে চলে যাবেন। বাই দ্য বাই, আনন্দকে একটু অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে, ওকে পাচ্ছেন না। আমি রাস্তার ডাইরেকশন দিচ্ছি।…
একটু পরেই গুপ্টা দম্পতি চলে গেলেন। তখন সেলিমকে ধরলুম আমরা, অ্যাই শালা। শিগগির! ফ্ল্যাশ ব্যাক। এক্ষুণি!
সেলিম গম্ভীর হয়ে বলল–আরে বাবা, তেমন কিছু নয়। গত বছর বোম্বেতে কয়েক মাস হন্যে হয়ে ঘুরছিলুম, তখন ভদ্রমহিলাকে নানা জায়গায় নানা ব্যাপারে দেখেছিলুম!
শেখর বলল-নানা ব্যাপারটা কী?
লাহিড়ীদার নাম শুনেছিস? তুই তো একজন শিল্পী।
–জ্ঞানেশ লাহিড়ী? সে তো কমার্শিয়াল আর্টিস্ট।
–পেট চালাতে হবে না? যেমন তুইও চালাচ্ছিস।
শেখর তেড়ে কী বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললুম–স্টপ ইট! সেলিম, ফ্ল্যাশব্যাকটা চালিয়ে যা।
সেলিম বলল–তখন ওঁর নাম ছিল মিলি সেন। মডেল হয়ে পয়সা রোজগার করতেন। কখনও ঘোরাঘুরি করতেন। অবনীদা একটা হিন্দি ছবিতে ছোট্ট রোল দিয়েছিলেনও। তেমন সুবিধে করতে পারেননি। চেহারা থাকলেই তো হয় না! স্ক্রিন টেস্টে তেমন ওত্রাতে পারেননি, তার ওপর ভয়েস কেমন ক্র্যাকপড়া– লক্ষ্য করলি নে?
রঞ্জন বলল–যাঃ অমন চেহারা স্ক্রিন টেস্টে ওত্রাল না। কোন্ শালা ক্যামেরাম্যান ছিল রে?
সেলিম বলল-বাজে বকিস নে! অবনীদা নিজেই নামকরা ক্যামেরাম্যান। তিনটে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
শেখর বলল–গলার স্বর তো বেশ মিঠে লাগল!
সেলিম বলল–না, সাউন্ড রেকর্ডিং ঠিকমতো হয়নি। ও সব তোরা বুঝবি নে!
আমি বললুম–তা ভদ্রমহিলা এই গুপ্টার ঘাড়ে এসে চাপলেন শেষ অব্দি? ব্যাপারটা খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে।
রঞ্জন বলল–তোর অবনীদাকে চিঠি লেখ না।
-কেন?
ব্যাপারটা ডিটেলস জেনে নে।
–লাভটা কী?
শেখর বলল–কিছু জানা। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন। মানুষের এটা স্বভাব। .. জ্ঞানের জন্যেই তো মানুষকে স্বর্গ থেকে চলে আসতে হয়েছিল।
রঞ্জন বলল–তাছাড়া, তোরও টু-পাইস রোজগার হতে পারে সেলিম।
সেলিম বলল কিসে?
ব্ল্যাকমেইল করবি মিসেস্ গুপ্টাকে। বলবি, মালকড়ি না ছাড়লে পুলিশে জানিয়ে দেব যে, আপনি একজন ফেরারি আসামী!
সেলিম চটে গিয়ে বলল–তোরা সবটাতেই বাড়াবাড়ি করিস। উনি ফেরারি আসামী কে বলল তোকে?
এইসব কথাবার্তা বিকেল পাঁচটা অব্দি চলল আমাদের। তারপর আফিসে তালা আটকে একটা বারের দিকে বেরিয়ে পড়লুম।
পরদিন সকালে আমার বাসায় এসে জুটল ওরা। রঞ্জন এল ঢাকুরিয়া থেকে, শেখর এল পাইকপাড়া থেকে, আর সেলিম এল পার্ক সার্কাস থেকে। আমি থাকি রিপন স্টিটের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত বাড়িতে–ছাদের ওপর একটা মোটামুটি ভাল ঘর।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্যামাক স্ট্রিটে গেলুম। গেটে লেখা : দা ইভনিং ভিলা। অদ্ভুত নাম! কোন ধনী সায়েবের বাড়ি ছিল। এও এক বাগানবাড়ি বলা যায়। পুরনো ভিতে মাল্টিস্টোরিড দালান গড়া হয়েছে। টেনিসলন আর বাগিচা আছে। লিফট আছে।
দরজা খুলে মিঃ গুপ্টা আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। এ কোথায় এলুম! প্রকাণ্ড বসার ঘর, পুরোটায় লাল কার্পেট, মধ্যিখানে একটা সোফা সেট। দেয়ালের ধারে বিশাল পিয়ানো রয়েছে। এখানে-সেখানে ছোটবড় ভাস্কর্য, দেয়ালে মডান আর্ট, কোনায় একটা সেলফে চমৎকার গোছানো বইপত্তর। ভঙ্গিটা সেকাল-একালে মেশানো।
আমাদের বসতে বলে গুপ্টা গেলেন। শেখর চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল–মেয়েমানুষের জন্যে কত কী দিতে হয় রে! ভাবা যায় না।
রঞ্জন কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় ঊর্মি একরাশ সেন্টের গন্ধ নিয়ে বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। আজ খোঁপা নেই। সদ্য স্নানের আভাস দিচ্ছে খোলা চুল। ঘিয়ে রঙের তাঁতের শাড়ি পরনে, খুব স্বাভাবিক চেহারা। ঠোঁটে রঙ বা কোন প্রসাধন নেই। আমার তো মনে হল, নিতান্ত কচি কলেজ গার্ল হয়ে উঠেছেন ভদ্রমহিলা! বয়স কম দেখাচ্ছে আজ। স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে। নমস্কার করতে করতে এলেন। কার্পেটেই বসে পড়লেন। আমরাও ব্যস্ত হয়ে সোফা ছেড়ে নেমে বসলুম। সারা ঘর গন্ধে মউমউ করছিল।
ঊর্মি বললেন–ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, আপনারা এসেছেন! ফ্ল্যাটটা বেশ বড়–এত একা লাগে! হাঁপিয়ে উঠি। ও তো কাজের মানুষ! একা থাকতে হয়।
বললুম–মিঃ গুপ্টা বলছিলেন, আপনি নাকি নির্জনতাই পছন্দ করেন!
-কে জানে! বলে অস্ফুট হাসলেন ঊর্মি। তবে বেশি ভিড়ও ভাল লাগে না। আপনাদের কলকাতায় বড্ড ভিড় কিন্তু।
শেখর বলল–যা বলেছেন! কলকাতায় আর থাকা যাবে না। বর্ষার অবস্থা দেখলে তো আরও ভয় পাবেন।
বর্ষার অনেক পরে এসেছি। তবে সব শুনেছি অলরেডি। রাস্তাঘাট সব ফ্লাডেড হয় নাকি।
আমি বললুম–কিন্তু আগামী বর্ষার অনেক আগেই তো ব্যারাকপুরের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন?
ঊর্মি খুশি হয়ে তাকালেন আমার দিকে। কথা তাই। বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
রঞ্জন বলল–আমরা সেখানে মাঝে মাঝে যাই কিন্তু। পিকনিকের স্পট হিসেবে চমৎকার!
তাই বুঝি!
এই সময় মিঃ গুপ্টা বেরিয়ে এলেন। স্ত্রীর কাছাকাছি বসে পড়লেন। বললেন–বেডরুমে এয়ারকন্ডিশনারটা সারানো হচ্ছে। মিস্ত্রী এসেছে, তাই দেরি হল। কিছু মনে করবেন না ব্রাদার!
ওরে বাবা! বউয়ের জন্য শোবার ঘরে এয়ারকন্ডিশন! ভাবা যায় না। আমরা নিশ্চয় চমৎকৃত হয়ে বোকার মতো হাসলুম। তারপর নানান গল্পগাছা চলতে থাকল। একাকে ফের গুপ্টা কাজ দেখতে ভেতরে চলে গেলেন।
এতক্ষণ সেলিম চুপচাপ বসে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে ঊর্মি বলল– আপনি কিন্তু কোন কথা বলছেন না!
শেখর বলল–কী রে? পেটব্যথা করছে নাকি?
আমরা হেসে উঠলুম। সেলিম ঊর্মির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল– আচ্ছা মিসেস্ গুপ্টা, অবনীদার সঙ্গে আপনার আর যোগাযোগ নেই?
ঊর্মি একটা অপ্রস্তুত হলেন যেন। না, মানে, ফিল্মের লাইনে আমার চেনাজানা খুব কমই ছিল। তাই যোগাযোগের প্রশ্ন ওঠে না। …পরক্ষণে একটু হাসলেন। তবে সে একটা চাইল্ডিশ ব্যাপার। আমার নেশা কেটে গেছে অলরেডি।
রঞ্জন সোৎসাহে বলল–কেন, কেন? আপনি তো দুর্দান্ত হিরোইন হতে পারতেন!
ঊর্মি মাথা দোলালেন। কিন্তু লক্ষ্য করলুম, সেলিম যে জেনে বা না জেনে ওঁকে কোথায় আঘাত করে বসেছে। সেলিমটা বড্ড একগুঁয়ে।
গুপ্টাসায়েব আবার এলেন। তার সঙ্গে একটা ছোকরা ট্রেতে চা-ফা আনছে। দেখা গেল। একগাদা সব চানাচুর, কয়েকরকম বিস্কুট, সন্দেশও আছে। কিছুক্ষণ জমকালো ভঙ্গিতে খাওয়া চলতে থাকল।
এক সময় মিঃ গুপ্টা বলে উঠলেন–দা আইডিয়া! ঊর্মি, আমরা তো নাইনটিনথ মার্চ একটা ছোটখাট পার্টি দিতে পারি!
শেখর বলল–অকেশানটা কী?
বাগানবাড়িতে ওদিনই যাচ্ছি আমরা।
ঊর্মি বলল–বেশ তো। ইউ অ্যারেঞ্জ! আমার ভাল লাগবে।
ঊর্মির মধ্যে একটা রূপান্তর ঘটেছে, আমি অন্তত টের পাচ্ছিলুম।
তার সেই স্মার্টনেস, ঔজ্জ্বল্য কেমন যেন মিইয়ে গেছে কখন। সন্দেহ ঘনীভূত হল। সেলিম নিশ্চয় কোথায় আঘাত করে বসেছে। আমাদের দলে ওর. উপস্থিতিটা যেন ঊর্মি সইতে পারছেন না–অস্বস্তি অনুভব করছেন।…
সেদিন চায়ের পার্টিটা অবশ্য জমানোর চেষ্টা করা হল খুব। গুপ্টাসায়েবের রসিকতা, শেষে শেখরের রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেলিম পিয়ানো বাজালও চমৎকার, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঊর্মির ভাবান্তর ঢাকা গেল না। ওঁর সুন্দর মুখের ওপর মাঝে মাঝে একটা ছাইরঙের আভা ভেসে উঠতে লাগল।…
পরদিন সেলিম বলেছিল, অবনীদা শিগগির কলকাতা আসছেন শুনলুম। এলে সব জানতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিলি সেন একটা সাংঘাতিক কিছু করেই বোম্বে থেকে চলে এসেছেন। মিঃ গুপ্টার পাশে ওঁকে স্ত্রী বলে কিছুতেই ভাবতে পারছিনে আমি। দেয়ার ইজ সামথিং মিসট্রিয়াস!
রঞ্জন বলেছিল–কিন্তু দিব্যি তো বাস করছেন দু’জনে একসঙ্গে।
–আজকাল অমন অনেকে থাকে। ওটা কোন ব্যাপার নয়।
আমি বলেছিলুম–তাহলে তুই বলছিস, ওঁকে মিঃ গুপ্টা বিয়ে করেননি?
–হয়তো না!
–কেন না?
–আরে বাবা, গুপ্টার রীতিমতো বউ-ছেলেমেয়ে সব রয়েছে তো! সে আমি খোঁজ নিয়েছি। উনি কাজের অছিলায় সপ্তায় তিনরাত্তির থাকেন মিলি সেনের কাছে, বাকি রাত্তির বড় বউয়ের কাছে। আনন্দটা সব জানে। জিগ্যেস করিস।
শেখরের সাইকলজি নিয়ে বাতিক আছে। মাঝে মাঝে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে সে আলোচনা করে। সে বলেছিল–তবে সবচেয়ে মিসট্রিয়াস ব্যাপার হচ্ছে সেন্ট!
সেলিম ট্যারা তাকিয়ে বলেছিল-সেন্ট মানে?
গন্ধ। সুগন্ধ। সুরভি!
তার মানে?
শেখর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। ভদ্রমহিলা অত কড়া ঋজের সেন্ট ব্যবহার করেন কেন? বাড়াবাড়ি মনে হয় না তোদের? সব সময় সারা গায়ে সেন্ট মেখে থাকেন যেন।
–হ্যাঁ! তুই শুঁকে দেখেছিস?
রঞ্জন বলেছিল–কোথায় নাক ঠেকিয়েছিলি রে?
শেখর রেগে গিয়ে বলেছিল–বুকে।
এরপর রসিকতাটা বাড়তে বাড়তে অশ্লীলতায় পৌঁছে গিয়েছিল নিশ্চয়। তাহলেও শেখরের কথাটা ভাববার মতো। কোথাও একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার না থাকলে সত্যি তো, অত বাড়াবাড়ি কেন সেন্ট নিয়ে? সে-কি ঊর্মির শারীরিক ক্ষেত্রে কদর্য স্মৃতির ব্যাপার? না কি আরও জটিল কিছু? ঊর্মি কি বাইরের সবকিছু নোংরা দুর্গন্ধময় মনে করেন? কেন মনে করেন? সুগন্ধিতে মানুষের বিশেষ করে স্ত্রীজাতির আসক্তি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্তু ঊর্মির আসক্তিটা যেন মাত্রাহীন। আমি কল্পনায় মাঝে মাঝে ঊর্মির দেহের কোথাও কোথাও নাক ঠেকিয়ে পরীক্ষা করছিলুম। উরে ব্বাস! প্রতিটি লোমকূপে একগাদা করে দুর্মূল্য তরল সুরভি চবচব করছে। আমার বুক অজানা ভয়ে ঢিবঢিব করে ওঠে।
ইতিমধ্যে আনন্দ যথারীতি এসেছে। তার ওই এক কথা। তার বস প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। এরপর বড় বউকে না ডিভোর্স করে বসেন, সেই ভয়। কারণ বড় বউ আজকাল আনন্দকে মাঝেমাঝে ডেকে পাঠান। আনন্দ বুঝতে পারে, কৌশলে স্বামীর দ্বিতীয় জীবন বা গতিবিধির খবর আদায় করতে চান ভদ্রমহিলা। আনন্দ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। চাকরি গেলে খুব বিপদে পড়ে যাবে।
এইসব জেনে বেচারা বড় বউটির প্রতি মমতা হচ্ছিল আমাদের। গুপ্টাসায়েবকে আর ভাল চোখে দেখতে পারছিলুম না। যত বেলেল্লাই হই, নীতিবোধ ইত্যাদি আমাদের সংস্কারে শেকড় বসিয়ে রয়েছে। তবে আশ্বস্ত হয়েছিলুম যে গুপ্টাসায়েবের কোম্পানিটি তার বড় বউয়ের নামে। এমন কি কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তার নামে আছে। তাই তার অজান্তে এক পয়সাও তোলা যায় না। আর সেজন্যেই বাগানবাড়ি কিনতে গুপ্টাকে গাড়ি বেচে ফেলতে হয়েছে। আনন্দ বলেছে, প্রথম পক্ষ খুব হিসেবী মানুষ। লেখাপড়াও জানেন। ভাল করে না বুঝে কোথাও সই করেন না।
শুধু একটা ব্যাপার অবাক লাগল। এমন গোপনীয় ব্যক্তিগত ব্যাপার গুপ্টাসায়েব আমাদের কাছে প্রকাশ্য করে তুললেন কেন? আনন্দ তার কাছে। হয়তো বিশ্বস্ত কর্মচারী। কিন্তু আমরা তো বাইরের লোক!
তাছাড়া প্রকাশ্যে ঊর্মি ওঁর অফিসে আসেন মাঝে মাঝে। অফিসের অন্য, কেউ ওঁর প্রথমার কানে তুলে দেবার সম্ভাবনা প্রচুর। আনন্দ এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আজকাল দিশি সায়েসুববাদের এমন সঙ্গিনী থাকে, এটা সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। তাছাড়া চাকরি যাবার ভয় তো সবারই। কেন মিছিমিছি রিস্ক নেবে কেউ? লাভটা কী? চাকরি করতে এসেছে, মাইনে পাচ্ছে। বসের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না কেউ।
তা ঠিক। আজকাল অনেক কিছু গা-সওয়া হয়ে গেছে মানুষের। ক্রমশ সবাই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছে। নিজেদের জীবনেই লক্ষ-কোটি ঝঞ্ঝাট। পরের জীবন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। মুখে পরচর্চা একটু-আধটু করা যেতে পারে, তার বেশি উৎসাহ কারো থাকে না আজকাল।
এবং এ কথা গুপ্টাসায়েব বোঝেন বলেই পরোয়া করছেন না। তিনি জানেন, আমরাও যথারীতি মাইন্ড করবো না–যাকে বলে। নেহাত বড় বউয়ের প্রতি অনেক নৈতিক ও আবশ্যিক দায়-দায়িত্ব আছে, তাই সেক্ষেত্রে চক্ষুলজ্জা মেনে চলছে। তবে কতদিন মেনে চলবেন, তাও অনিশ্চিত। কবে শুনব, ডিভোর্সের মামলা উঠেছে আদালতে। এমন তো আজকাল আকছার হচ্ছে। খবরের কাগজে কত খবরও বেরোচ্ছে।
তবে এই প্রথম কলকাতা শহরটাকে বড় রহস্যময় মনে হল আমার। বাপস, কী প্রকাণ্ড এই শহর! না–আয়তনের কথা ভাবছিনে। আশি-পাঁচাশি লাখ লোক নিয়েই তার বিশালতাটা রহস্যময় হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। এ শহরে যে কেউ তিনটে-চারটে কেন, দশটা বউ দশ জায়গায় মেনটেন করলেও কোন বউ কোন বউয়ের অস্তিত্ব টেরও পাবে না। চিৎপুরের কোন বউ ক্যামাক স্ট্রিটের কোন সতীনের খবর পেতে কয়েক জন্ম লেগে যাবে! তাছাড়া এ শহরের বড় গুণ, কেউ কারো খবর রাখে না, রাখতে চায় না। নাক গলায় না অন্যের পারসোনাল ব্যাপারে। মেট্রোপলিটন শহরের সব বৈশিষ্ট্য এখন কলকাতার গায়ে ঘায়ের মতো দগদগ করছে।….
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন আনন্দ এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল–শোন, তোকে একবার যেতে বলেছিল, সেকেন্ড লেডি। এক্কেবারে ভুলে গিয়েছিলুম বলতে।
অবাক হয়ে বললুম–আমাকে! কেন?
–ডাইনী তোর মেটেটা খুব পছন্দ করেছে! চলে যাস যে কোন সময়।
কী বলিস যা তা! কেন যেতে বললেন, বলেননি?
না। ফোনে জেনে নে. এই নে, নম্বর দিচ্ছি। কিন্তু খবদার, কাকেও দিবিনে। বসের বারণ আছে। আর একটা কথা, ফোন করার আগে দেখে নিবি, গুপ্টা অফিসে আছে নাকি।
-উনি ফোন করলেন না কেন?
–কেন করলেন না, আমি জানি নাকি? এখন তো গুপ্টা অফিসে আছে। তুই শ্ৰীমতীকে ফোন কর না! কী বলে শোন্।
বলে আনন্দ চলে গেল। ও এক অদ্ভুত ছেলে। যত কৌতূহল, তত ওর নিরাসক্তি সব ব্যাপারে। ভীষণ খামখেয়ালিও।
শেখর পিছনের চেম্বারে ছবি আঁকছিল। সেলিম নেই। রঞ্জন এ ঘরের কোনার টেবিলে ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। ফোন আমার টেবিলে। দুরু দুরু বুকে রিসিভার তুলে ডায়াল শুরু করলুম। রঞ্জন তাকাল না।
চাপা সুদূর রিঙের শব্দ ভয়ে ভয়ে সাড়া দিচ্ছিল ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। বার তিন বাজার পর বন্ধ হল। উত্তেজনায় আমার দম আটকে যাচ্ছিল। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে মিঠে শব্দ ভেসে এল–হ্যালো!
মিসেস্ গুপ্টা বলছেন?
–কে আপনি?
–বিজন আচার্য।
—ও!
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলুম, ওঁর কণ্ঠস্বর কেমন আড়ষ্ট মনে হচ্ছিল এর আগে, হঠাৎ যেন আশ্বস্ত হওয়ার আভাস ফুটে বেরোল ‘ও’ শব্দটার মধ্যে। হয়তো একটু হাসিও শুনলুম। তারপর স্পষ্ট সুন্দর উচ্চারণে ঊর্মি বললেন–আপনি! কিন্তু আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
আনন্দবাবুর কাছে।
–ও! আমি ওকে বলেছিলুম, আপনাকে আমার খুব দরকার। আচ্ছা, আপনি কি এখন খুব ব্যস্ত?
না। তেমন কিছু নয়।
–মিঃ গুপ্টা কি এখন অফিসে? প্লিজ, একবার খোঁজ নিন না!
নিয়েছি। অফিসেই আছেন।
-ওঃ! ওয়েল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, এখনই একটু সময় করতে পারবেন?
-খুব পারব।
–চলে আসুন না, প্লিজ!
–আসছি।
–হ্যালো, হ্যালো!
–আছি। বলুন।
–আপনার বন্ধু সেই আর্টিস্ট ভদ্রলোক কি আছেন এখন?
–শেখর?…..সরি, সেলিম? সেলিম নেই।
–ও। ঠিক আছে। চলে আসুন।
–সেলিমকে কিছু বলতে হবে?
না, থাক। আপনি আসুন। দেরি করবেন না কিন্তু। তাহলে দেখা না হতেও পারে।
-ফোন রাখার শব্দ হল। এক মিনিট পরে আমি আমারটা রাখলুম। এতক্ষণ কানের ভিতর দিয়েই যেন মগজে হুশহুশ করে কড়া সুগন্ধের ঝাঁজ ঢুকছিল। সেই গন্ধ এখনও মউমউ করছে।
–রঞ্জন মুখ তুলে বললকী রে? অমন ভ্যাবলা হয়ে বসে আছিস কেন?
নারভাস হয়ে পড়েছিলুম। সুন্দরী-শ্ৰেষ্ঠাদের সঙ্গে কথা বললে আমার এমন হয়। কিন্তু শ্ৰীমতী ঊর্মিমালা তো আস্ত সৌন্দর্য। হেসে বললুম-তুই শুনছিলি না?
–শুনছিলুম। গুপ্টার ছোট বউয়ের কাছে যাচ্ছিস।
–যাঃ! কিসে বুঝলি?
–ওসব বোঝা যায়। যা। উইশ গুড লাক। কিন্তু সাবধান! কোনরকম বদ মতলব নিয়ে যাসনে।
আমি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালুম। রঞ্জন ডাকল–শোন্।
-কী?
–গুপ্টাকে বেরোতে দেখলে আমি যাতে তোদের খবর দিতে পারি শ্ৰীমতীর ফোন নম্বরটা আমাকে দিয়ে যা!
ও খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল। হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলুম।…
ক্যামাক স্ট্রিটে ট্যাক্সি থেকে নেমে ইভনিং ভিলার কাছাকাছি একটা দোকানে সিগারেট কিনছি, ফুরিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখি গেটের কাছে আরেকটা ট্যাক্সি এসে থামল এবং গুপ্টাসায়েব নামলেন। আমি হতভম্ব।
ফোন লাইনে ট্যাপ করা আছে নাকি? পরে মনে হল, ব্যাপারটা নেহাত আকস্মিক। কিন্তু পয়সা খরচ করে এসে এভাবে অযথা ফিরতে হবে ভেবে রাগে বিরক্তিতে জ্বালা ধরে গেল। লোকটা অমন করে হঠাৎ-হঠাৎ ঊর্মির কাছে চলে আসে জানা ছিল না। এখন তো মোটে দুটো বাজে। একটু সরে গিয়ে গাছের নিচে একটা চায়ের আড্ডায় হাজির হলুম। বেয়ারা ড্রাইভার ইত্যাদি উর্দিপরা লোকেরা সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। মাটির ভঁড়ে চা খেতে খারাপ লাগে না। একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে চা-টা খেলুম। লক্ষ্য রাখলুম গেটের দিকে, কখন গুপ্টাসায়েব বেরিয়ে যান।
একটি ঘণ্টা কেটে গেল। হতাশ হয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াচ্ছি, তখন দেখি গেটের কাছে গুপ্টাসায়েব একা নন, সঙ্গে শ্রীমতী ঊর্মিও রয়েছেন–চোখে সানগ্লাস, গুপ্টা ট্যাক্সির জন্যেই দাঁড়িয়ে রইলেন সম্ভবত।
হ্যাঁ, তাই। একটা ট্যাক্সি এসে খালি হতেই দু’জনে এগিয়ে চেপে বসলেন। ট্যাক্সিটা এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি ঘুরে দাঁড়ালুম এবং লোকগুলোর আড়ালে থাকার চেষ্টা করলুম।
ওঁরা অদৃশ্য হলে তারপর হাঁটা শুরু করলুম।
অফিসে ফিরে দেখি, সেলিম এসেছে। আমাকে দেখে রঞ্জন চেঁচিয়ে উঠল–ফিরতে পেরেছিস? বেঁচে আছিস তো তুই?
সেলিম বলল–কেন ডেকেছিল রে?
শেখর বেরিয়ে এল পিছনের ঘর থেকে। কী? জমেছিল তো খুব? ডিটেলস বলবি কিন্তু। নৈলে মেরে ফ্ল্যাট করে ফেলব।
রঞ্জনের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললুম–এরই মধ্যে সব রটিয়ে বসে আছ!
রঞ্জন বলল–বেশ করেছি! এমন নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছিস, আর আমরা চুপ করে বসে থাকবো? নে–ঝেড়ে ফ্যাল ঝুলি। তারপর অগত্যা একটা করে বিয়ার আন।
সেলিম বলল–ফোনে আমার কথা জিগ্যেস করছিল, রঞ্জন বললে। কেন রে?
আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল ওরা। বসে বললুমব্যাড লাক, বয়েজ! গিয়ে দেখি, গুপ্টা ঢুকছে। একটু পরে শ্রীমতীকে নিয়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি চেপে কোথায় চলে গেল। আমাকে দেখতে পায়নি। কারণ, আমি তখন ভাগ্যিস ঢুকিনি!
রঞ্জন বলল–কিন্তু গুপ্টা বেরোল কখন অফিস থেকে? বুঝেছি–বাথরুমে গিয়েছিলুম–তখনই! যাকগে, নেক্সট চান্স তো পাবি।
–সেলিম বলল–খুব জটিল হচ্ছে ব্যাপারটা। অবনীদা–সেই ফিল্ম ডিরেকটার ভদ্রলোক এসে গেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হল আজ কিছুক্ষণ আগে। গ্রেট ইস্টার্নে উঠেছেন। একজনের কাছে খবর পেয়েই গিয়েছিলুম।
রঞ্জন বলল–তারপর? ঊর্মিমালার কথা নিশ্চয় বললি!
বললুম–সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড রে! মিলি সেন সত্যি ফেরারি আসামী। অবনীদার এক মাদ্রাজি বন্ধু একটা ছবি প্রোডিউস করছিলেন। তার ডাইরেকশানের ভার অবনীদাকে দেওয়া হয়। মাদ্রাজি ভদ্রলোক কোন এক সূত্রে মিলিকে চিনতেন। উনি তাকেই হিরোইন করার জন্যে জেদ ধরেন। এদিকে মিলি তো অবনীদার রিজেক্টেড জিনিস! প্রচণ্ড আপত্তি করলেন। কিন্তু টিকল না–ওকে নিতেই হবে। অগত্যা নিলেন। ওদিকে নায়কও কিন্তু সম্পূর্ণ নবাগত। যাই হোক, স্যুটিং শুরু হল যথারীতি। অবনীদা পাগল হয়ে যাবার দাখিল। ওই শিমূলফুল দিয়ে কাজ করানো দুঃসাধ্য তো! যাই হোক, আউটডোরে গিয়ে এক সাংঘাতিক ঘটনা। নায়িকা হচ্ছে এক ডাকাতের পালিতা কন্যাসেও ডাকাতনী হয়ে উঠেছে। নায়ক এক বড়লোকের ছেলে। বিয়ে করে গাড়ি চেপে বউ নিয়ে আসছে পাহাড়ী পথে। নায়িকা দলবল নিয়ে গাড়িতে হামলা করবে। নতুন বউয়ের গা ভর্তি গয়না, বাপের বাড়ির যৌতুকও রয়েছে প্রচুর। নায়ক গাড়ি থেকে বেরিয়ে রুখে দাঁড়াল মুখোমুখি। মিলি সেন ঘোড়ার পিঠ থেকে রিভলবার তুলেছে তাকে মারতে। দারুণ উত্তেজনার সিন! রিভলভার তাক করেই মিলি সেনের প্রেম জাগবে প্রচণ্ড। একটু হেসে–আচ্ছা! ফির মিলেঙ্গে বলে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাবে। এখন–হল এক অদ্ভুত কাণ্ড! রিভলবারটা তো স্বভাবত নকল মাল। মিলি সেন তুলল। তারপর তিনবার প্রচণ্ড গুলির শব্দ হল এবং নায়ক বাপরে, মার দিয়া’ বলে পড়ে গেল! হই-হই ব্যাপার। অবনীদা দৌড়ে গেলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি–ভেবেছিলেন কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। চিত্রনাট্যে তো এমন ঘটনা নেই! কিন্তু সর্বনাশ!….
শেখর অস্ফুটে বলে উঠল–সত্যিসত্যি খুন নাকি?
–হ্যাঁ। মিলি সেন সত্যিকার রিভলবার দিয়ে হিরোকে মেরে ফেলেছে।
রঞ্জন বলল–কোন সত্যিকার কারণে নিশ্চয়!
–সেলিম বলল–সেটাই রহস্য। কেন রূপেশকুমারকে মিলিকুমারী খুন করল, পুলিস আজও তা জানতে পারেনি। পরস্পর আলাপও ছিল না। তদন্তে সেটা জানা যায়।
আমি বললুম–তারপর কী হল? ঊর্মিমানে, মিলি সেন কী করলেন তারপর?
সেলিম বলল–সেটাই তো ধাঁধা। ঘোড়া ছুটিয়ে তক্ষুণি সে পালিয়ে যায়। যদি এমন হয় যে রূপেশকুমারের কোন শত্রু নকল রিভলবারটার বদলে গুলিভরা আসল রিভলবার রেখে দিয়েছিল যথাস্থানে এবং তা না জেনে মিলি সেন ব্যবহার করেছেন, তাহলে সে পালাবে কেন? তাই না?
–ঠিক বলেছিস! হতভম্ব হয়ে পড়ত। মূচ্ছা যেত। কান্নাকাটি করত।
রাইট। অথচ সে পালাল। ঘোড়াটা পরে একটা নদীর ধারে পাওয়া যায়। মিলি সেন হাওয়া। ওখানে একটা গ্রাম আছে। গ্রামের একজন লোক বলে যে নদীর ব্রিজের পাশে একটা গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। ঘোড়ায় চেপে এক ঔরৎ আসে এবং ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠে। গাড়িটা চলে যায়। তার মানে কেউ অপেক্ষা করছিল সেই গাড়িতে। পুলিস তন্ন-তন্ন চেষ্টা করেও গাড়ি বা তার মালিকের হদিস পায়নি।
শেখর বলল–সব জলের মতো পরিষ্কার হল। মানে সেন্ট রহস্য ইজ ক্লিয়ার।
সেলিম বলল–মোটেও না। অবনীদাকে আমাদের আড্ডায় আসতে বলেছি। সময় পাবেন কি না জানি না। এলে ওর মুখে শুনবি সব। অবশ্য অবনীদা বলছিলেন, ছেড়ে দাও। পুরনো কেস। আর, আমারও ওসব পুলিসকে জানিয়ে এখন নষ্ট করার সময় নেই। মিলিকে নিয়ে আর ঝামেলা বাড়াবো না।
আমি বললুম–আচ্ছা, গুপ্টাসায়েব তো বোম্বেতে ছিলেন শুনেছি। তাহলে কি রূপেশকুমারকে উনিই মিলি সেনকে দিয়ে খুন করিয়েছেন?
রঞ্জন বলল– বাঃ এটা তো ভাবিনি! ঠিক বলেছিস!
এই সময় আনন্দ এল। কী রে, খুব জমেছে মনে হচ্ছে। ইসুটা কী?
রঞ্জন বলল–আবার কী? মিলি সেন।
–সে আবার কে?
–তোদের ঊর্মিমালা গুপ্টা। সেলিম রঞ্জনের দিকে চোখ টিপে বলল–আনন্দ, তোর বস কোথায় গেল রে একটু আগে?
আনন্দ বলল-দানিয়েল সায়েবের বাগানবাড়ি।
–সে তো একুশে মার্চ যাবার কথা।
–উঁহু। ডেট এগিয়ে দিয়েছে।
–পার্টি দেবে বলছিল যে?
–জানি না। গুপ্টার সবই গুপ্ত ব্যাপার।
আমি বললুম–ভ্যাট, ওইভাবে হঠাৎ চলে যাবে কী? জিনিসপত্তর যাবে না?
যাবে। ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা হয়ে আছে। আমি লরিতে ক্যামাক স্ট্রিটের মালপত্তর নিয়ে যাব।
–আজই?
–হাঃ। সব ব্যবস্থা করা আছে।
–আগে বলিসনি তো?
আনন্দ চটে গিয়ে বলল–যা বাবা! আমিও কি জানতুম নাকি! আজই দুপুরে হঠাৎ ডেকে সব বললেন। ট্রান্সপোর্টে ফোন করে নিজেই ব্যবস্থা করলেন। আর তোদেরও শালা খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। যতসব আজেবাজে ব্যাপারে নাক গলাতে যাস। এই আপার ক্লাস লোকগুলো আজকাল কী হয়েছে, জেনেও ন্যাকামি করিস। কই শেখর, সিগ্রেট দে। এক্ষুণি বেরোতে হবে।
এয়ারকন্ডিশনড ঘর ছাড়া যে মেয়ের নাকি ঘুম হয় না, সে দানিয়েল কুঠিতে রাত কাটাবে কেমন করে? ইলেকট্রিক লাইন কবে ওখানে কাটা গেছে, আর দেওয়া হয়নি জানতুম। এবার নিশ্চয় শিগগির নেওয়া হবে। কিন্তু ততদিন শ্ৰীমতী ঊর্মির রাত কাটবে কেমন করে?
আমরা এসব জল্পনা-কল্পনা করছিলুম। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, অমন হুট করে কলকাতা ছেড়ে ওখানে চলে গেলেন কেন? এর সঙ্গে সেলিমের সেই অবনীদার কলকাতা আসার কোন যোগাযোগ নেই তো?
পরদিন দুপুরে সেলিম পরিচালক ভদ্রলোককে নিয়ে এল। নামী মানুষ ফিল্ম জগতের। ছবি দেখা ছিল, প্রত্যক্ষ দেখলাম এতদিনে। ভারি অমায়িক আর ভদ্র। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় টাক রয়েছে। ফরসা ধবধবে গায়ের রঙ। বাংলা উচ্চারণে সামান্য টান আছে, দীর্ঘকাল প্রবাসে অবাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার পর এ টানটা থাকা খুবই স্বাভাবিক। পুরো নাম অবনী ভরদ্বাজ।
আলাপ হওয়ার পর আমরা হিন্দি বনাম বাংলা ছবি নিয়ে খুব জমিয়ে তুললুম। কিন্তু আসল প্রশ্নটা মনে যতই তীব্র হোক, মুখে আসতে প্রত্যকের বাধছিল। হঠাৎ উনি নিজে থেকেই বললেন–মিঃ প্রকাশ গুপ্টার অফিস তো এ বাড়িতেই আছে?
ঘাড় নাড়লুম। অবনীবাবু আমাদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় কিছু আঁচ করলেন। তারপর একটু হেসে বলেন–আমার প্রাক্তন হিরোইনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আপনাদের আলাপ হয়েছে শুনলুম।
সেলিম বলল–অবনীদা, আপনি প্লিজ ওদের সেই স্যুটিংয়ে মার্ডারের। ঘটনাটা বলুন না! আপনার নিজের মুখে ওরা শুনলে খুশি হবে!
অবনীবাবু হেসে বললেন–খুনখারাপির ঘটনা শুনে খুশি হবেন? বল কি সেলিম?
সেলিম অপ্রস্তুত হল। শেখর আগ্রহ দেখিয়ে বলল–আপনি বলুন।
সেদিন সেলিম যা-যা বলেছিল, তা ডিটেলস বর্ণনা করে বললেন অবনীবাবু। শেষে বললেন–যাই হোক, এসব ব্যাপারে আমি তখনও জড়িয়ে পড়তে চাইনি, এখনও চাইনে। কারণ বুঝতেই পারছেন যে এতে আমার কেরিয়ারের পক্ষে অসুবিধের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এমন যদি হত যে মিলি নামকরা নায়িকা ছিল, তাকে না হলে আমার ছবি চলবে না, কিংবা ধরুন, সেই নবাগত রূপেশকুমাব ছেলেটিও কোন সুপারহিট নায়ক ছিল–তাহলে ভিন্ন কথা। অহেতুক এসব স্ক্যান্ডাল বাড়তে দিয়ে আমার ক্ষতি করা ছাড়া কিছু হত না।
শেখর বলল–কিন্তু র্যাদার হিউম্যান পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে…
ওকে বাধা দিয়ে অবনীবাবু বললেন–মশাই, পৃথিবীতে প্রতিমিনিটে লক্ষ লক্ষ অন্যায় বা খুনখারাপি হচ্ছে। আমি তো ত্রাণকর্তা প্রফেট নই। তাছাড়া, কে বলতে পারে যে, রূপেশকুমার মিলি সেনের কিংবা অন্য কারো জীবনে কোন সাংঘাতিক ক্ষতি করেনি? খুন বড় সহজে মানুষ করে না। আর, আমি তো জজসায়েব নই!
অবনীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে থাকার পর ফের আগের মতো সহজ হলেন। বললেন–এনিওয়ে! আমি বুঝতে পারছি–আপনারা সব ব্যাচেলার ইয়ংম্যান– আপনাদের কাছে এটা ভীষণ থ্রিলিং। খুবই স্বাভাবিক তা। আপনারা আসলে তাজ্জব হয়ে গেছেন। কারণ, সত্যি তো, অমন সুন্দর স্ত্রীলোক, তাতে তরুণী, মানুষ খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনাদের কৌতূহল বা চাঞ্চল্য খুবই স্বাভাবিক।
সেলিম বলল–অবনীদা, মিলি সেন রাতারাতি ব্যারাকপুর বাগানবাড়িতে কেন পালাল, তা কিন্তু আমরা টের পেয়েছি। আপনার ভয়ে।
অবনীবাবু বললেন-যাঃ। আমাকে ও জানে। ভয় করে না।
–তাহলে অমন রাতারাতি পালাল কেন?
–মিলির রহস্য আমার জানা নেই। আরও নানা কাণ্ড করা ওর পক্ষে স্বাভাবিক।
অবনীদা, এক কাজ করা যাক। আপনি আজ বিকেলে একটু সময় করুন না!
অসম্ভব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে একগাদা।
–প্লিজ দাদা! চলুন, আমরা বেড়াতে যাবার ছলে কুঠিবাড়িতে হানা দিই। তারপর দেখি, শ্ৰীমতী কী করেন!
সেলিম ও বাকি সবাই হেসে উঠলুম। অবনীবাবু বললেন–সেলিমের চ্যাংড়ামি এখনও যায়নি। ছেড়ে দে! খামোকা বেচারিকে বিব্রত করে কী হবে? লেট হার এনজয় উইথ দা ওল্ড ফেলো!
আমি বললুম-মিঃ গুপ্টাকে আপনি চেনেন না?
অবনীবাবু বললেন–মনে পড়ছে না ঠিক। চিনতে পারি, নাও পারি।
একটু পরে অবনীদা চলে গেলেন। সেলিম ওঁকে বিদায় দিতে নেমে গেল। তারপর ফিরে এসে বলল–অবনীদা অদ্ভুত মানুষ! এমন নির্লিপ্ত আর উদাসীন লোক দেখা যায় না। বিজু, আমার মাথায় কিন্তু কট কট করে পোকা কামড়াচ্ছে!
শেখর নিজের মাথায় টোকা মেরে বলল–আমারও।
রঞ্জন বলল–হ্যাঁ, যা বলেছিস!
আমি বললুম কামড়ানিটা আমারই বেশি। কারণ, মিলি সেন আমাকে ডেকেছিলেন কী জন্যে বলা হল না। শিগগির ওঁর কথাটা না শুনলে মাইরি। আমি মরে যাব!
সেলিম বলল–তাহলে চল, বেরিয়ে পড়ি। এখন তো দুটো বাজে। : পিকনিকের ছলেই যাই। আমি রনুকে ফোনে বলে দিচ্ছি, ও ইদ্রিস সায়েবকে বলবে এবং ঘরের চাবিটা নিয়ে যাবে ওখানে।
শেখর বলল–ও-কে। আয়, আমি ডায়াল করে দিচ্ছি। নাম্বার বন্।
রনুকে ওখানে চাবি নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে আমরা বেরোলুম। রান্নার সরঞ্জাম সব ওখানেই মিলবে। শুধু চাল-ডাল-মসলাপাতি সঙ্গে নিতে হবে। নিউ মার্কেটে গিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে মাংস ইত্যাদি কেনা হল। তারপর সব জিনিসপত্র ভাগাভাগি করে নিজের নিজের ব্যাগে নিয়ে আমরা রওনা দিলুম। পথে হুইস্কির বোতল নেওয়া হল গোটা তিন। ট্যাক্সি বিটি রোডে গিয়ে উঠলে শেখর মনের আনন্দে গান জুড়ে দিল।
ব্যারাকপুর পৌঁছতে তখন সূর্য প্রায় ডুবছে। দানিয়েল সায়েবের বাড়ির গায়ে ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়ে উঠেছে। গাছপালায় পাখিরা তুমুল চেঁচামেচি করছে। গেটের কাছে রনু চাবি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ও মোটর সাইকেলে এসেছে। এক্ষুণি চলে যাবে। ও নিজে এসে দরজা না খুলে দিলে গোঁয়ারগোবিন্দ বাহাদুর ঝামেলা বাধাবে কিনা। অবশ্য ওর দোষ নেই। ইদ্রিস খানের সবসময় ভয়, আবার কেউ এসে জবরদখল না করে ফেলে। তাই কড়াকড়ি বলা আছে। তাছাড়া আজকাল প্রতিদিন উনি আর আগের মতো রাত্রিবাস করতে আসেন না। কলকাতাতেই থেকে যান।
রনু এসব জানিয়ে চলে গেল। ওর কাছে মিঃ গুপ্টার খবরও পেলুম। বাড়ির উত্তরের অংশ এখন ওঁর দখলে। মাঝামাঝি বাড়িটা দু’ভাগ করা। মাঝের দেয়ালে কোন জানালা না থাকায় ওপাশের ঘরগুলোর টু শব্দটিও এপাশে শোনা যায় না। হ্যাঁ, গুপ্টাসায়েব গতকাল থেকে আজ সারাদিনই এখানে রয়েছেন। আমরা পিকনিক করতে আসছি, তাও শুনেছেন রনুর কাছে।
আমরা দক্ষিণের গেটে থাকায় গুপ্টা সায়েব বা শ্ৰীমতী ঊর্মিকে দেখার আশা ছিল না। তবে বাইরে বেড়াতে বেরোলে দেখতে পেতুম।
দরজা খুলে জিনিসপত্র রাখা হল। বাহাদুর এল হাসিমুখে। শেখর জিগ্যেস করল–কী বাহাদুর, কেমন আছ?
বাহাদুর ঘাড় নাড়ল মাত্র। ভাল আছে।
ভূত দেখতে পাচ্ছ তো বাহাদুর?
বাহাদুর তাতেও ঘাড় নাড়ল। পাচ্ছে কিংবা পাচ্ছে না।
–আমি বললুম–পাশের ঘরের সায়েব মেমসায়েবের খবর কী বাহাদুর?
বাহাদুর আবার ঘাড় নাড়ল। ভালই আছেন। না থাকার কী আছে!
এক বালতি জল চাই, বাহাদুর!
বাহাদুর জলের বালতিটা নিয়ে রাস্তার দিকে টিউবয়লে চলে গেলে সেলিম বলল–প্রতিবেশীরা একেবারে সাইলেন্ট ডেড! ব্যাপার কী? গুপ্টাও তো এল না রে! টের পায়নি মনে হচ্ছে! আয়, কোরাসে গান জুড়ে দিই।
শেখর গম্ভীর মুখে বলল–থা। আগে ছিপি খুলি।
চারটে গ্লাস পাশের কিচেন থেকে এনে রীতিমতো সেলিব্রেট করা হল। তারপর আমরা কোরাস গান জুড়ে দিলুম। গানটা লিখেছিল রঞ্জন, সুর শেখরের। খুব প্রিয় গান আমাদের।
দারা দিরি দারা দিরি দ্রও দ্রও দুমুম্বা
ট্র্যাও ট্র্যাও টিরিটিরি টেরেমেরে লুমুম্বা
হুম হুম হুম হুমা
গুম গুম গুমা গুমা
চাঁও চটাস চাঁও চটাস।
ধড়াস ধড়াস বুক কাবুক টাবুক কুক হুড়ম্বা
এ্যাও দুমুম্বা লুমুম্বা….
লারা লিরি হো
দারা দিরি হো.. হোঃ হোঃ হোঃ।
বাহাদুর বালতিভরা জল মেঝেয় রেখে হাঁ। বাবুরা বেদম নাচছেন তখন। এই নাচ খাঁটি তাহিতি দ্বীপপুঞ্জের, তা কি বেচারা জানে? ঘরে তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমরা চালিয়ে গেলুম। পুরনো বাড়িটা ভুতুড়ে নাচগানে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। আক্ষেপ হচ্ছিল, একটা গিটার আনলে ভাল হত। সেলিম ভাল বাজায়।
এক সময় বাহাদুর বলল–আলো, সাব!
হ্যাঁ, আলো জ্বালা উচিত এবার। এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। মোমবাতি বের করে জ্বালা হল। তারপর বাহাদুর চলে গেল। দরকার হলে তাকে ডাকা যাবে আবার।
কিচেনে একটা মোমবাতি নিয়ে গেল সেলিম আর রঞ্জন। আমি আর শেখর মালমসলার প্যাকেট বয়ে রেখে এলুম। সেলিম রাঁধবে। আমরা সব ঠিকঠাক করে দেব। এ ঘরটা বিরাট। ফায়ার প্লেসও আছে। ডানদিকে বাথরুম। ভিতরে আরও অনেকগুলো ঘর। মোমবাতি হাতে আমি আর শেখর সব দেখে এলুম চোর এসে লুকিয়ে আছে নাকি। কেন থাকবে? চুরি করার কী-ই বা আছে? আসলে আমরা প্রতিবেশীদের কোন সাড়া পাওয়ার মতো ঘেঁদা খুঁজছিলুম। দেয়াল একেবারে নিরেট। ফাটলও নেই।
কিচেনটাও বিশাল। ডাইনিং ঘরের সংলগ্ন সেটা। কিন্তু ডাইনিং ঘর এখন আর বলা যাবে না। একেবারে ফাঁকা। সদর দরজা বন্ধ করে সেখানে আমরা মেঝেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসলুম। দরজা দিয়ে সেলিমকে কুকারের সামনে রান্নায় ব্যস্ত দেখতে পাচ্ছিলুম। মদ্যপান টুকটাক চলছে চারজনের। রঞ্জন সেলিমকে খাইয়ে দিয়ে আসছে। মাঝে আমরা গান গাইছি, নাচছিও। কিন্তু গুপ্টা-দম্পতির কোন সাড়া নেই। প্রতিমুহূর্তেই আশা করি ওঁরা কেউ এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়বেন। কিন্তু না, সে আশা যেন নেই-ই।
ফলে উৎসাহ লম্ফঝম্প ক্রমশ মিইয়ে পড়ছিল। এক সময় রঞ্জন বলল– গুপ্টার হল কী রে? একবারও যে টিকি দেখায় না!
শেখর গম্ভীরভাবে বলল–বউ নিয়ে শুয়ে আছে।
–বিজু! রঞ্জন ডাকল। –আয় না, একবার ওদিকটায় ঘুরে দেখে আসি!
উঠে পড়লুম। শেখরকে দেখলুম অমনি সেলিমের কাছে গিয়ে বসল। বাইরে ঘন অন্ধকার। দূরে রাস্তার ধারের আলোগুলো গাছের ফাঁকে গঙ্গার বুকেও আলো দেখা যাচ্ছে। এদিকটা সুনসান নির্জন। মাঝেমাঝে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার গরগর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আমরা সিগারেট টানতে টানতে বাগান ঘুরে উত্তরদিকে গেলুম। অবাক হয়ে দেখলুম, গুপ্টার দিকটা ঘুরমুটি অন্ধকার। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়েও কোন আলো আসছে না। এই সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে পড়ল নাকি ওরা?
যা আছে বরাতে বলে সেদিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে মনে পড়ল, টর্চ আনা হয়নি। কী আর করা যাবে!
পা টিপে ধাপবন্দী বারান্দায় উঠে বুক টিপটিপ করতে থাকল। রঞ্জন আর চুপ করে থাকতে পারল না। একবার কেশে ডাকল–মিঃ গুপ্টা আছেন নাকি?
কোন সাড়া এল না। তখন আমি ডাকলুম-মিঃ গুপ্টা! মিঃ গুপ্টা আছেন?
তবু কোন সাড়া নেই। এবার দরজার সামনে দেশলাই জ্বাললুম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! পর্দা তুলতেই সেটা বোঝা গেল। সেই সময় সেদিনকার সেই কড়া সেন্টের গন্ধ নাকে এল।
আশ্চর্য তো! এই সবে সাড়ে সাতটা বাজে। এরই মধ্যে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা? দরজায় ধাক্কা দিলুম আস্তে। ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছিল।
অমনি দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। কেন কে জানে, অজ্ঞাত ভয়ে দু’জনেরই বুক কেঁপে উঠল। রঞ্জন ফিসফিস করে বলল, দরজা খোলা কেন রে?
দরজাটা ঠেলে মরিয়া হয়ে ভিতরে ঢুকে গেলুম আমরা। তারপর আবার দেশলাই জ্বাললুম! ঘরটা বড়। এরই মধ্যে বেশ সাজানো হয়েছে। আলমারি হোয়াটনট সেলফ সোফাসেট রয়েছে। সামনের দিকে ভিতরের দরজাতেও পর্দা তুলে ভিতরে গেলুম দুজনে। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ তেজী সুগন্ধ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে।
ফের দেশলাই জ্বালাতেই যা নজরে পড়ল, আমাদের দুজনের গলায় একই সঙ্গে অস্ফুট একটা আওয়াজ বের করার পক্ষে যথেষ্টই। মেঝেয় মিঃ গুপ্টা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন। পিঠের দিকে চাপচাপ রক্ত। আর ঊর্মি ওরফে মিলি সেন বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে।
আবার দেশলাই জ্বেলে ব্যাপারটা দেখে নিয়ে আমরা দুজনে দৌড়ে বেরিয়ে এলুম। বিভ্রান্ত হয়ে চেঁচাতে থাকলুম–সেলিম! শেখর! বাহাদুর!
শেখরের সাড়া পাওয়া গেল প্রথমে। তারপর সেলিমের। বাহাদুর একটা হারিকেন হাতে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একতলা ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। লোকটা অদ্ভুত। সে যেন একজন পাথরের মানুষ।