Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দানবের ক্ষুধা || Mayukh Chowdhury

দানবের ক্ষুধা || Mayukh Chowdhury

দানবের ক্ষুধা

রামায়ণে বর্ণিত কুম্ভকর্ণ ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই ঘুমিয়ে থাকত, আর একদিন জেগে উঠে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে আবার আশ্রয় গ্রহণ করত নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে।

হ্যাঁ, সারাবছরে মাত্র একদিনই সে আহার গ্রহণ করত বটে, কিন্তু তার সেই একদিনের আহার্য সংগ্রহ করতে স্বয়ং রাবণ রাজা পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যেতেন–বাঘ, ভালুক, হাতি, গণ্ডার, মানুষ, বানর প্রভৃতি বিভিন্ন চতুষ্পদ ও.দ্বিপদ জীবের রক্তমাংসে ক্ষুধা তৃপ্ত করে কুম্ভকর্ণ আবার ঘুমিয়ে পড়ত এবং সারাবছর ধরে একটি লম্বা ঘুম দিয়ে পরবর্তী বছরের শেষ দিনে আবার জেগে উঠত শূন্য উদরে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে।

এই মূর্তিমান বিভীষিকার জন্ম রাক্ষস-বংশে হয়নি, কুম্ভকর্ণ ছিল ব্রাহ্মণ-সন্তান।

কিন্তু ব্রাহ্মণ-সন্তান হলেও ব্রাহ্মণের সংস্কার ছিল না কুম্ভকর্ণের রক্তে, বিপ্রসুলভ সাত্ত্বিক আহারে সে তুষ্ট থাকতে পারেনি, বিভিন্ন প্রাণীর রক্তমাংসে তৃপ্ত হত তার ভয়াবহ ক্ষুধা।

পশুজগতে সন্ধান করলে এমন অনেক পশুর সন্ধান পাওয়া যায়, যারা কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রাবিলাসী না হলেও আহারে-বিহারে তার মতোই পূর্বপুরুষের প্রচলিত সংস্কার মেনে চলতে রাজি হয়নি।

এইসব চতুষ্পদ কুম্ভকর্ণ শাকসবজি, ঘাসপাতা প্রভৃতি নির্জীব খাদ্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে হঠাৎ একদিন আহার্যতালিকা পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করেছে এবং তাদের ক্ষুধিত দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে রক্তমাংসের দেহধারী সজীব খাদ্যের প্রতি।

কেন এমন হয় বলা মুশকিল। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষ যখন এইসব অর্থহীন ঘটনাগুলো ঘটতে দেখে, যুক্তি আর বুদ্ধি নিয়ে ওই ঘটনাগুলির কার্যকারণ সে যখন বুঝতে পারে না, তখন সে হয়ে পড়ে হতভম্ব।

হ্যাঁ, হতভম্ব হয়ে পড়েছিল জর্জ নুজেন্ট।

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যামেরুন প্রদেশের এক অখ্যাত গ্রামের খুব কাছেই কয়েকটা পায়ের ছাপ তার চোখে পড়েছে, কিন্তু চার আঙুলবিশিষ্ট ওই গভীর পদচিহ্নগুলির কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সে হয়ে পড়েছে হতভম্ব।

পায়ের ছাপ চিনতে অবশ্য জর্জের অসুবিধা হয়নি।

চারটি অঙ্গুলিবিশিষ্ট ওই গভীর পদচিহ্নগুলির মালিক যে একটি জলহস্তী, সে-কথা দাগগুলো দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল এবং পায়ের দাগগুলি ভালোভাবে পরীক্ষা করে সে জানতে পারল যে, জন্তুটা গ্রামের বাইরে ওই জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ।

কিন্তু কেন? জন্তুটা কি গ্রামবাসীদের লক্ষ করছিল?

ছাগল, গোরু, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশুর মাংসের লোভে গাঁয়ের আশেপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে সিংহ, লেপার্ড অথবা হায়না গ্রামবাসীদের অলক্ষ্যে তারা গ্রামের মানুষ এবং পশুগুলির ওপর নজর রাখে–রাতের অন্ধকারে সুযোগ পেলেই গৃহপালিত পশুর ঘাড় ভেঙে শিকার মুখে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অরণ্যের অন্তঃপুরে।

শুধু গৃহপালিত পশু নয়, অনেক সময় নরমাংসের লোভেও গ্রামের কাছে লুকিয়ে থাকে নরখাদক শ্বাপদ। কিন্তু জলহস্তী নিরামিষভোজী পশু, সে গ্রামের কাছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কেন?

জর্জ নুজেন্ট এই জন্তুটার অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণ বুঝতে পারল না।

সত্যি, ক্যামেরুন অঞ্চলের এই জলহস্তীর আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত। হিপো বা জলহস্তী কখনো কখনো হিংস্র স্বভাবের পরিচয় দেয় বটে, কিন্তু সাধারণত তারা মানুষকে এড়িয়ে চলে। নির্জন নদী এবং জলাভূমি তাদের প্রিয় বাসস্থান। গভীর রাতে জলের আশ্রয় ত্যাগ করে তারা ডাঙায় উঠে আসে এবং জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ঘাস, পাতা, গাছের মূল প্রভৃতি উদ্ভিদজাত পদার্থ উদরস্থ করে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। জলা কিংবা নদী থেকে অনবরত বনের মধ্যে যাতায়াত করার ফলে এই গুরুভার জন্তুগুলির পায়ের চাপে চাপে বনজঙ্গল ভেঙে যায়, বিপুল বপু দানবদের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে নূতন অরণ্যপথ।

বনের মধ্যে যখন তারা আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, তখন কোনো কারণে ভয় পেলে তারা ওই পায়ে চলা পথ ধরে ছুটে যায় জলের মধ্যে আত্মগোপনের জন্য সেই সময় কোনো মানুষ অথবা জানোয়ার যদি তাদের বাধা দেয়, তাহলে তার যে দুর্দশা হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

অতিশয় গুরু দেহ নিয়েও জলহস্তী অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটতে পারে। তার বিকট মুখগহ্বরের মধ্যে যে দাঁতগুলো উদ্ভিদ জাতীয় বস্তু চর্বণ করতে অভ্যস্ত, যুদ্ধের সময় সেই দীর্ঘ দস্তগুলি মৃত্যুর করাল ফাঁদের মতো চেপে ধরে শত্রুর দেহ কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে হতভাগ্য শত্রুর শরীর রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হয় একজোড়া দন্তভয়াল চোয়ালের প্রচণ্ড পেষণে!

জলহস্তীর স্বভাব-চরিত্র জানত জর্জ নুজেন্ট, তাই গ্রামের সীমানার বাইরে অপেক্ষারত জন্তুটির পদচিহ্ন দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল–জলহস্তী মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে, সে তো নিরামিষভোজী, অতএব পশুমাংস বা নরমাংসের লোভে গ্রামের ভিতর হানা দেওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক নয়।

কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা বুলা জাতীয় নিগ্রোরা ভীত হয়ে পড়ল। সারারাত তারা আগুন জ্বালাতে লাগল এবং বদ্ধদ্বার কুটিরের মধ্যে প্রেতাত্মার রোষদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নানারকম ক্রিয়াকলাপ করল।

এত কাণ্ড করা সত্ত্বেও পরের দিন সকালে গ্রামের কাছে আবার সেই পায়ের ছাপ দেখা গেল! অর্থাৎ পদচিহ্নের মালিক জ্বলন্ত আগুন বা মন্ত্রতন্ত্রের পরোয়া করে না কিছুমাত্র!

ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল বুলাদের গ্রামে। তাদের ধারণা হল, এটা কোনো পশুর পায়ের ছাপ নয়–পশুর দেহ ধারণ করে তাদের গ্রামে হানা দিতে চায় এক দুষ্ট প্রেতাত্মা!

বুলারা ঢাকের শরণাপন্ন হল, আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা ঢাকের সাহায্যে দূরদূরান্তরে খবর পাঠিয়ে দেয়। ঢাকের আওয়াজ শুনেই তারা বুঝতে পারে বাদক কী বলতে চায়।

বুলারা ঢাক বাজাতে শুরু করল।

ঢাকের আওয়াজ যেসব গ্রামে পৌঁছে গেল, সেইসব গ্রামের অধিবাসীরা বুঝল, বুলাদের গ্রামে এক প্রেতাত্মার আবির্ভাব হয়েছে। তারা আবার ঢাক বাজিয়ে দূরের গ্রামবাসীদের পাঠিয়ে দিল ওই দুঃসংবাদ বাতাসে ভর করে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল ঢাকের টেলিগ্রাফ

সাবধান! সাবধান! বুলাদের গ্রামে হানা দিয়েছে এক প্রেতাত্মা!

জর্জ ভীত হয়ে পড়ল। সে অবশ্য বুলাদের মতো প্রেতাত্মার ভয়ে কাতর হয়নি, তার ভয়ের কারণ অন্য।

একিন নামক গ্রামে বাস করত জর্জ নুজেন্ট। সে ব্যবসায়ী, ওই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের সঙ্গে তার ব্যাবসাবাণিজ্য চলত। ফল থেকে তৈরি নানা ধরনের খাদ্য, গজদন্ত ও উদ্ভিদজাত দ্রব্য নিয়ে আসত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ একিন গ্রামের শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী জর্জের কাছে এবং ওইসব জিনিসের ব্যাবসা করে জর্জের লাভের অঙ্ক কেঁপে উঠছিল ভালেভাবেই।

কিন্তু ঢাকের আওয়াজ যখন জানিয়ে দিল একিন গ্রামে প্রেতাত্মার আবির্ভাব ঘটেছে, তখন ভিন গাঁয়ের মানুষ আর জিনিসপত্র নিয়ে ওই গ্রামে আসতে রাজি হল না। অতএব আমদানির অভাবে জর্জের ব্যাবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

একদিন সকাল বেলা গ্রামের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হল–আর্তনাদ, চিৎকার এবং ঢাকের ঘনঘন কর্কশ শব্দে চমকে উঠল জর্জ নুজেন্ট। কুঁড়েঘরের আস্তানা ছেড়ে বাইরে ছুটে এসে জর্জ দেখল, নদীতীরে অবস্থিত বাগানগুলি থেকে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে অনেকগুলি বুলা জাতীয় স্ত্রীলোক তাদের মধ্যে একজন নাকি দানবের কবলে পড়েছে!

রাইফেলটা টেনে নিয়ে জর্জ চলল বাগানের দিকে! তার সঙ্গী হল কয়েকজন বর্শাধারী যোদ্ধা।

নদীর তীরবর্তী গাছগুলির নীচে একটা সচল পদার্থ সকলের চোখে পড়ল। জর্জ গুলি চালাল। তৎক্ষণাৎ সেই সজীব বস্তুটি পলায়ন করল দ্রুতবেগে।

আর একটু এগিয়ে যেতেই জর্জ এবং যোদ্ধাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল এক ভয়াবহ দৃশ্য–রক্তধারার মধ্যে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে একটি তরুণীর মৃতদেহ।

দেখলেই বোঝা যায়, কর্দমাক্ত মাটিতে চেপে ধরে মেয়েটির শরীর ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। টুকরো টুকরো করে।

পৈশাচিক কাণ্ড!

জর্জের সঙ্গে ছিল বুড়ো হাফোর্ড, সে দেখিয়ে দিল মেয়েটির একটা হাত নেই, হত্যাকারী হাতটাকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। মৃতদেহের চারপাশে কাদামাখা মাটির ওপর খালি জল আর জল–সেই ঘোলাটে জলের মধ্যে হত্যাকারীর পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

জর্জ ভেবেছিল, হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী একটি কুমির। কিন্তু মেয়েরা আর্তকণ্ঠে জানিয়ে দিল, : কুমির নয়, স্বয়ং শয়তান ওই মেয়েটিকে হত্যা করেছে।

মেয়েদের ঘোষণা শুনে সমবেত জনতা জর্জের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

জর্জ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বুলাদের অসীম শ্রদ্ধা। তারা আশা করছে। জর্জের রাইফেল এবার শয়তানকে শাস্তি দেবে। জনতা কথা কইছে না বটে কিন্তু তাদের চোখগুলো যেন নীরব ভাষায় বলছে, তুমি থাকতে শয়তান আমাদের গাঁয়ে হানা দেবে? নারীহত্যা করবে? বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।

জর্জ স্থির করল, যেমন করেই হোক এই খুনে জন্তুটাকে মরতে হবে। মানুষ হিসাবে এটা তার কর্তব্যও বটে, তা ছাড়া এখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। জন্তুটাকে মারতে পারলে ভিন গাঁয়ের লোক জিনিসপত্র নিয়ে একিন গ্রামে আবার যাতায়াত শুরু করবে। আবার জমে উঠবে জর্জের ব্যাবসা।

তবে, ব্যাপারটা সহজ নয় খুব।

জর্জ বুঝেছিল, শয়তানকে শিকার করতে গিয়ে সে নিজেও হঠাৎ শয়তানের শিকারে পরিণত হতে পারে।

বড়ো বড়ো বঁড়শিতে পচা মাংসের টোপ গেঁথে নদীতে ফেলে দেওয়া হল। সেগুলো সাধারণ বঁড়শি নয়, এই বঁড়শি গলায় আটকালে বড়ো বড়ো কুমির পর্যন্ত ঘায়েল হয়ে যায়।

কিন্তু বঁড়শির টোপ বঁড়শিতেই রয়ে গেল, মাংসলোলুপ কোনো দানব সেই ফাঁদে ধরা দিতে এল না।

এইবার জর্জ অন্য উপায় অবলম্বন করল।

বাগানের শেষ সীমানায় নদীর কাছে গাছের সঙ্গে একটা ছাগল বেঁধে রাইফেল হাতে জর্জ সারারাত জেগে পাহারা দিল। অন্ধকার রাত্রি রাইফেলের নলের সঙ্গে বাঁধা ছিল বিশেষ। ধরনের বিজলি বাতি বা ফ্ল্যাশ লাইট।

কিন্তু জর্জের রাত্রি জাগরণই সার, কোনো জানোয়ারই ছাগমাংসের লোভে অকুস্থলে পদার্পণ করল না। পরের দিন জায়গাটা ভালো করে দেখা হল–নাঃ, আশেপাশে কোথাও নেই কোনো ভয়ংকরের পদচিহ্ন।

তখন নদীর জলে ভাসল ক্যানো (এক ধরনের নৌকা) এবং সেই ভাসমান নৌকার ওপর বসে রাইফেল হাতে সমস্ত নদীটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল জর্জ।

ওই সময়ে চারটি কুমির তার গুলিতে মারা পড়ল।

অনুসন্ধানপর্ব চলল পর পর দু-দিন। তৃতীয় দিবসে আবার বুলাদের গ্রামের কাছে দেখা দিল সেই বিরাট পদচিহ্নগুলি!

একজন স্থানীয় শিকারিকে নিয়ে জর্জ পায়ের ছাপগুলিকে অনুসরণ করল।

অসংখ্য লায়ানা লতার বেড়াজালের নীচে হামাগুড়ি দিতে দিতে পায়ের ছাপ লক্ষ করে এগিয়ে চলল জর্জ এবং নিগ্রো শিকারি।

অবশেষে স্যাঁৎসেঁতে ঝোপজঙ্গল ভেদ করে তারা এসে যেখানে থামল, সেখানে একটা মস্ত জলাভূমির উপর মাথা তুলেছে অনেকগুলো ম্যানগ্রোভ গাছ।

সেই গাছের সারির শেষ সীমানায় এসে দাঁড়ায় দুই শিকারি। জলাশয়ের তীরে এক জায়গায় অল্প জল জমেছিল নিগ্রো শিকারি হঠাৎ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।

জর্জ সচমকে লক্ষ করল, সেখানে অগভীর জলের ভিতর শুয়ে আছে প্রকাণ্ড কুমির! এত বড়ো কুমির কখনো তার চোখে পড়েনি! হলুদ, কালো আর গাঢ় সবুজ রঙের বিচিত্র সমাবেশ ছড়িয়ে আছে জলবাসী সরীসৃপটার সর্বদেহে, বিকট হাঁ-করা মুখটা ভেসে আছে জলের উপর, দুই চক্ষু অর্ধনিমীলিত, কিন্তু ক্রুর দৃষ্টিতে ভয়ংকর।

এটা নিশ্চয় নরখাদক–জর্জ রাইফেল তুলে নিশানা স্থির করল। সেই মুহূর্তে নিগ্রো শিকারি অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠল, আর চমকে রাইফেল নামিয়ে নিল জর্জ।

জলার বুকে তখন এক ভয়াবহ নাটকের সূচনা দেখা দিয়েছে!

জলার উপর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে একটা জলহস্তী কুমিরের দিকে। অগভীর জলাশয়ের তলদেশে মাটির উপর পা ফেলে এত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেই বিশালকায় পশু যে, জলের উপর সামান্য দুই-একটা ঢেউ ছাড়া অন্য কোনো আলোড়নের চিহ্ন বা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

তার মস্ত বড়ড়া শরীর জলের তলায় অদৃশ্য, জলার বুকে ভেসে উঠেছে শুধু নাসিকার অগ্রভাগ, দুই কর্ণ এবং একজোড়া শূকর-চক্ষু।

ধীরে, অতি ধীরে উঠে দাঁড়াল জলহস্তী জলাশয়ের তীরে–তার বেগুনি রঙের চামড়া থেকে ঝরে পড়ছে জলের ধারা।

অতি সাবধানে, মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল জলহস্তী কুমিরটার দিকে।

সে যখন কুমিরের থেকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে এসে পড়েছে, তখন সরীসৃপের উন্মুক্ত মুখগহ্বর বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে।

কুমির এবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

বিকট হাঁ করে তেড়ে এল জলহস্তী, দীর্ঘ একটি স্ব-দন্তের আঘাতে সে কুমিরকে চিত করে ফেলে দিল। কুমির সামলে ওঠার আগেই আবার সগর্জনে তেড়ে এল জলহস্তী, বর্শাফলকের মতো সুদীর্ঘ দন্ত দিয়ে খোঁচা মারতে লাগল কুমিরের দেহে এবং সামনের দুই পায়ের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগল বার বার।

হঠাৎ ভয়ংকর দুই চোয়ালের ফাঁকে ধরা পড়ল জলহস্তীর সামনের একটি পা।

পরক্ষণেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল জলহস্তী, কুমিরের পেটের ওপর সামনের আর একটি পা চাপিয়ে সে এমন চাপ দিল যে সরীসৃপের শক্ত চোয়ালের বজ্ৰদংশন হয়ে গেল শিথিল।

শত্রুর উন্মুক্ত মুখত্বরের ভিতর থেকে ঝটকা মেরে নিজের পা ছাড়িয়ে নিল জলহস্তী, তারপর এক কামড়ে ছিঁড়ে ফেলল কুমিরের পিছনের একটি ঠ্যাং!

কুমিরের প্রকাণ্ড শরীর পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগল, কাটা বসানো লোহার চাবুকের লাঙ্গুল বারংবার আছড়ে পড়ল শত্রুর উদ্দেশে। .

কিন্তু জলহস্তী কাবু হল না।

বিদ্যুদবেগে কুমিরের চারপাশে একবার ঘুরে সে আক্রমণ করল। মুহূর্তের মধ্যে কুমিরের দেহটাকে কামড়ে ধরে সে শূন্যে তুলে ফেলল।

দুই দ্বিপদ দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল সেই ভয়ানক দ্বৈরথ যুদ্ধ।

একটা মস্ত বড়ো কুকুরের মুখে ইঁদুর যেমনভাবে ঝুলতে থাকে, ঠিক তেমনিভাবেই কুমিরটা ঝুলছিল জলহস্তীর মুখ থেকে।

জলহস্তীর দুই চোয়াল নির্মম দংশনে চেপে বসল শত্রুর দেহে। ছটফট করে উঠল কুমির। তার সমস্ত শরীর একবার ধনুকের মতো বেঁকে সিধে হয়ে গেল, ভয়ংকর মুখটা ফাঁক হয়ে আত্মপ্রকাশ করল বীভৎস দন্তের সারি।

জর্জ আর স্থানীয় শিকারি শুনতে পেল, কুমিরের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে হিস হিস শব্দ!

কুমিরটাকে মুখে নিয়ে জলহস্তী জলার মধ্যে নেমে গেল।

দারুণ আতঙ্কে জর্জের শরীর হয়ে পড়েছিল অবশ, তার ঘামে ভেজা আঙুলগুলো শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরেছিল রাইফেল কিন্তু ট্রিগার টিপে গুলি চালানোর ক্ষমতা তার ছিল না।

খাচ্ছে! ও খাচ্ছে! ফিসফিস করে বলল নিগ্রো শিকারি।

একটু দূরেই একটা ঘন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে ভেসে এল কড়মড় কড়মড় শব্দ যেন একটা প্রকাণ্ড জাঁতাকলের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে এক অতিকায় দানবের অস্থিপঞ্জর!

হিপো চিবিয়ে খাচ্ছে কুমিরের শরীরটাকে!

অতি সাবধানে নিঃশব্দে পিছিয়ে এল জর্জ। ওই ঝোপের মধ্যে পদার্পণ করার সাহস তার হল না–উদ্ভিদভোজী জলহস্তী যখন মাংসলোলুপ হয়ে ওঠে, তখন তার আহারে বাধা না-দিয়ে সরে পড়াই ভালো।

গ্রামবাসীরা নিগ্রো শিকারির মুখে সব ঘটনা শুনল, তারা কোনো মতামত প্রকাশ করল না। কিন্তু নিজের ভীরুতার জন্য নিজেকেই ধিক্কার দিল। সে বুঝেছিল, জন্তুটাকে মারতে না-পারলে গাঁয়ের মানুষ তার ওপর আর শ্রদ্ধা রাখবে না। স্থানীয় অধিবাসীদের শ্রদ্ধা হারিয়ে বুলাদের গ্রামে বসে ব্যাবসা চালানো অসম্ভব।

ব্যাবসার কথা ছেড়ে দিলেও জর্জের আত্মসম্মানে ভীষণ আঘাত লেগেছিল। নিজের ভীরুতাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না।

জর্জের কাছে যে রাইফেলটা ছিল, সেটা বিশেষ শক্তিশালী নয়। ও-রকম হালকা রাইফেল নিয়ে মাংসলোলুপ দানবটার সম্মুখীন হওয়া দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তবু জর্জ স্থির করল, ওই অস্ত্র নিয়েই সে জলহস্তীর মুখোমুখি দাঁড়াবে–হয় সে জন্তুটাকে মারবে, আর না হয়তো নিজেই মরবে, জীবন বিপন্ন হলেও আর পালিয়ে আসবে না। হয় মারো, নয় মরো, এই হল তার সংকল্প।

কুমির এবং জলহস্তীর লড়াইয়ের পর পর দু-দিন কেটে গেছে। জর্জ বুঝল, এতক্ষণে জলহস্তীটা নিশ্চয় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। অতএব এখন সে আবার শিকারের সন্ধান করবে।

জর্জ চিন্তা করতে লাগল কেমন করে জন্তুটাকে মারা যায়। জর্জের রাইফেল খুব শক্তিশালী নয়। তাই জন্তুটাকে মারতে হলে তার দেহের সবচেয়ে দুর্বল স্থানে আঘাত হানতে হবে।

জলহস্তীর কর্ণমূলে অব্যর্থ সন্ধানে গুলি বসাতে পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, শরীরের অন্যান্য স্থানে হালকা রাইফেলের গুলি চালিয়ে তাকে কাবু করা সম্ভব নয়।

ঝোপজঙ্গলের মধ্যে জন্তুটাকে গুলি করলে ফলাফল হবে অনিশ্চিত। কানের গোড়ায় গুলি করতে হলে জলহস্তীকে নদী কিংবা জলাভূমির বুকে ফাঁকা জায়গায় পাওয়া দরকার।

বুলাদের সর্দার এবং স্থানীয় শিকারি (যে লোকটি পূর্ববর্তী অভিযানে জর্জের সঙ্গী ছিল) এবারের অভিযানে জর্জের সঙ্গী হতে রাজি হল।

একটা হালকা ক্যানো নৌকা ভাসিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল শিকার অভিযানে। এই ধরনের নৌকাগুলিকে ইচ্ছা করলে খুব দ্রুত চালানো যায়।

জোয়ারের বিপরীত মুখে অনেকক্ষণ নৌকা চালিয়ে নদীর ধারে কাদার মধ্যে তারা একটা কুমির দেখতে পেল।

জর্জ কুমিরটাকে গুলি করে মারল, তারপর মৃত সরীসৃপের দেহটাকে সবাই মিলে পূর্ববর্তী জলাভূমির তীরে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।

টোপ প্রস্তুত। এবার শুধু অপেক্ষা করার পালা।

নদীর স্রোত যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে গিয়ে নদীর মাঝখানে খুঁটি বসিয়ে নৌকার নোঙর করা হল। তারপর শিকারিরা অপেক্ষা করতে লাগল।

সর্দারের মাথা ঝুঁকে পড়ল নিদ্রার আবেশে, কিন্তু নিগ্রো শিকারির দুই চোখের তীব্র দৃষ্টিতে তন্দ্রার আভাস ছিল না কিছুমাত্র কাঠের মূর্তির মতো স্থির হয়ে সে বসে রইল নৌকার পশ্চাদ্ভাগে।

জর্জ তার সঙ্গে কথা কইল না। রাইফেল বাগিয়ে ধরে সে অপেক্ষা করতে লাগল নীরবে।

আফ্রিকার প্রখর সূর্য জ্বলতে লাগল মধ্যাহ্নের আকাশে, সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল মশার উপদ্রব। কুমিরের মৃতদেহটা ফুলে উঠল, বাতাসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল বিশ্রী দুর্গন্ধ। কয়েকটা মাংসলোলুপ টিক পাখি উড়ে বসল মরা কুমিরের উপরে–এমন চমৎকার গন্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে বাতাসে ডানা মেলে উড়ে এল একটা মস্ত বড়ো মাছ শিকারি চিল।

শব্দহীন মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ নদীবক্ষে অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল আফ্রিকার মধ্যাহ্ন সূর্য, তরল পিতলের গলিত স্রোতের মতো জ্বলে জ্বলে উঠল রৌদ্রস্নাত জলধারা আর অসহ্য তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে গেল জর্জের কণ্ঠ, পিপাসায় তার প্রাণ করতে লাগল ছটফট ছটফট…

অপরাহ্ন। দূর গ্রাম থেকে ভেসে এল মানুষের কণ্ঠস্বর। জলাভূমির বুকে উঠল আলোড়নের শব্দ, সঙ্গেসঙ্গে জাগল এক গর্জনধ্বনি। আবার সব শান্ত, নীরব।

আচম্বিতে জর্জের দেহে জেগে উঠল এক অস্বস্তিকর অনুভূতি।

ঘুমন্ত সর্দার হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসল, তার চোখে নেই তার আবেশ।

নৌকায় উপবিষ্ট নিগ্রো শিকারির দীর্ঘ দেহ টান হয়ে গেল ধনুকের ছিলার মতো।

তারা কেউ কথা কইল না, তীব্র অনুভূতি তাদের হঠাৎ জানিয়ে দিয়েছে কিছু একটা ঘটছে।

শিকারির দুই চক্ষুর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হল নদীর তীরে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করল জর্জের চক্ষু, সঙ্গেসঙ্গে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল বিদ্যুত্তরঙ্গ!

নদীর ধারে তাদের নৌকা থেকে প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়াবহ মাংসভুক জলহস্তী!

জর্জ রাইফেল তুলল।

জলহস্তী বিকট হাঁ করে গর্জে উঠল, বজ্রপাতের মতো সেই গভীর গর্জনধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে।

পরক্ষণেই অগ্নি-উদগার করল রাইফেল।

নদীর ঢালু পাড় বেয়ে ধেয়ে এল জলহস্তী। তার প্রকাণ্ড দেহ সশব্দে এসে পড়ল নদীর জলে।

আবার গুলি ছুড়ল জর্জ।

এক ঝটকায় নৌকার নোঙর খুলে ফেলল নিগ্রো শিকারি, আর তৎক্ষণাৎ সজোরে দাঁড় চালিয়ে দিল বুলাদের সর্দার। বন্ধনহীন নৌকা স্যাৎ করে পাক খেয়ে ঘুরে গেল স্রোতের মুখে।

নদীর জলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠল হিপো, মস্ত বড়ো হাঁ করে তেড়ে এল নৌকার দিকে–হিংস্র আক্রোশে উন্মুক্ত মুখের গহ্বর থেকে উঁকি দিল বাঁকা তলোয়ারের মতো দুই দীর্ঘ স্বদন্ত।

আবার গর্জে উঠল জর্জের রাইফেল, একটা দাঁত গুলির আঘাতে ভেঙ্গে গেল সশব্দে।

জলহস্তী আবার ডুব দিল।

হঠাৎ জর্জের হৃৎপিণ্ডটা দারুণ আতঙ্কে বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠল–নিগ্রো শিকারি আর সর্দার ক্যানোটাকে মুহূর্তের মধ্যে টেনে আনল সেইখানে, ঠিক যেখানে ডুব দিয়েছে জলহস্তী।

কিন্তু তারা ভুল করেনি, শিকারের অভিজ্ঞতা জর্জের চাইতে তাদের বেশি ক্যানোটা যেখান থেকে সরে এসেছিল, ঠিক সেই জায়গায় রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ভেসে উঠল জলহস্তী।

এক মুহূর্ত দেরি হলে দানবটার করাল মুখগহ্বরের মধ্যে ধরা পড়ত নৌকা; তারপর কী ঘটত কল্পনা করতেই জর্জের বুক কেঁপে উঠল।

জর্জ আবার গুলি চালাল। মনে হল লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে। চটপট দাঁড় চালিয়ে ক্ষিপ্ত জলহস্তীর নাগালের বাইরে ক্যানোটাকে নিয়ে গেল সর্দার এবং নিগ্রো শিকারি কোনোমতে নিশানা স্থির করে আর একবার রাইফেলের ঘোড়া টিপল জর্জ।

গুলি লেগেছে কি না বোঝা গেল না, জন্তুটা আত্মগোপন করল জলের তলায়। জর্জ দেখল তার রাইফেলে অবশিষ্ট আছে আর একটিমাত্র টোটা। সে চিৎকার করে সঙ্গীদের সাবধান করে দিল।

কিন্তু নিগ্রোদের আদিম রক্তে তখন জেগে উঠেছে হত্যার নেশা–তারা সজোরে দাঁড় চালিয়ে নৌকা ছুটিয়ে দিল এবং মুহূর্ত পরেই নৌকাটা তীরের কাছে মাটিতে আটকে গেল।

ঠিক সেই সময়ে যদি জলহস্তী আবার আক্রমণ করত, তবে ক্যানোর আরোহীদের আর পলায়ন করার পথ ছিল না, দীর্ঘ দন্তের হিংস্র নিষ্পেষণে শিকারিদের দেহ হয়ে যেত ছিন্নভিন্ন।

একটু পরেই কর্দমাক্ত জলে রক্তর আলপনা ছড়িয়ে ভেসে উঠল জলহস্তী। মাঝ নদীতে ছিল জন্তুটা, আর নৌকাসুদ্ধ আরোহীরা তখন আটকে গেছে তীরবর্তী কর্দমাক্ত ভূমিতে–ভয়াবহ অবস্থা।

রাইফেলে একটিমাত্র গুলি ভরা থাকলেও জর্জের বুক-পকেটে কয়েকটা টোটা তখনও অবশিষ্ট ছিল। পকেট হাতড়ে টোটা খোঁজার সময় কিংবা ধৈর্য ছিল না–একটানে পকেট ছিঁড়ে জর্জ তিনটি টোটা হাতে নিল, তারপর রাইফেলে গুলি ভরে ফেলল কম্পিত হস্তে।

কিন্তু ততক্ষণে হিপো আবার অদৃশ্য হয়েছে জলের তলায়, কাজেই জর্জ গুলি চালাতে পারল না।

নৌকাটা তখন টলমল করে দুলছে।

অনেকটা জল ঢুকেছে ভিতরে, ক্যানোর তলদেশ অর্ধাংশ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে নদীর জলে। মধ্যাহ্নের নির্জন নদীবক্ষ এখন আর নিস্তব্ধ নয়, রাইফেলের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে অনেকগুলো ক্যানো নৌকা ছুটে এসেছে ঘটনাস্থলে ক্যানোর আরোহী স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, সাদা মানুষের জাদুবিদ্যা নিশ্চয় নদীর দানবকে কাবু করে ফেলেছে।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠল নিগ্রো শিকারি, জলহস্তী জল থেকে উঠেছে। একটু দূরে জলাভূমির তীরে যে মরা কুমিরটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা আছে, জন্তুটা সেইদিকেই এগিয়ে চলেছে।

খুব সাবধানে লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়ল জর্জ।

জলহস্তীর মাথার ওপর ফুটে উঠল রক্তধারার চিহ্ন, কিন্তু সে গুলির আঘাত গ্রাহ্য করল না। মাথায় একটা ঝকানি দিয়ে সে ধেয়ে গেল কুমিরের মৃতদেহটার দিকে তপ্ত বুলেটের দংশন তার কাছে মশক দংশনের চাইতে গুরুতর নয়!

জন্তুটার কর্ণ ও গণ্ডদেশের মাঝখানে নিশানা করে জর্জ রাইফেলের ঘোড়া টিপল।

এইবার বোধ হয় দানবের মর্মস্থানে রাইফেলের গুলি কামড় বসাল–পিছন ফিরে সশব্দে সে নেমে পড়ল নদীর জলে, পরক্ষণেই কর্দমাক্ত জলধারার মধ্যে লাল রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে সে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

সারারাত ধরে অনেকগুলো ক্যানো ভাসিয়ে নদীর জলে পাহারা দিল নিগ্রোরা। পরের দিন সকাল জলহস্তীর মৃতদেহ ভেসে উঠল নদীর জলে। জন্তুটাকে নৌকার সঙ্গে বেঁধে বুলারা দাঁড় চালাতে শুরু করল, কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো বলিষ্ঠ বাহুর আকর্ষণে মৃত দানবের দেহটা এসে পড়ল বুলাদের গ্রামের কাছে।

জর্জ দেখল, মৃত জলহস্তীর দেহে রয়েছে সাত-সাতটা বুলেটের ক্ষতচিহ্ন, তার মধ্যে তিনটি বুলেট জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে।

এই মারাত্মক আঘাতগুলো অগ্রাহ্য করে জন্তুটা নদীর জলে আত্মগোপন করেছিল এবং তার মৃত্যু হয়েছে অনেক দেরিতে কী কঠিন জীবনীশক্তি!

জলহস্তীর পেট চিরে দেখা গেল তার মধ্যে রয়েছে চার-চারটি পিতলের ব্রেসলেট জাতীয় অলংকার ও একটি গ্রীবাবন্ধনী।

ওইসব অলংকার ব্যবহার করে বুলাদের মেয়েরা অর্থাৎ একাধিক হতভাগিনীর দেহ উদরস্থ করেছে জলবাসী দানব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *