রাত্রের খাওয়া শেষ করে
০৪.
রাত্রের খাওয়া শেষ করে টেবিলেই ওরা গল্প শুরু করেছিল। প্রায় রাতেই ওরা চারজন কিছুক্ষণ বসে সারাদিনের ভালমন্দ অভিজ্ঞতার বা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলে থাকে। আজ ঘুনু মিত্তির এবং নিলু গড়গড়ি প্রসঙ্গ ওঠে।
ফুটবলারদের গাধা-গোরু বলল! তার মানে, নাকু তুই… রেখা গুপ্তর অসহ্য বিস্ময় আর প্রচণ্ড রাগ মিশে গিয়ে তাঁকে বাক্য শেষ করার সুযোগ দিল না।
সুযোগ নিল শ্যামলা। একটা গাধা-গোরু। সমীরণ গুপ্ত, নামের পাশে টাইটেল গা গো। তারপর সমীরণের কানে কানে বলল, যেমন তুই বেগার শব্দটা তৈরি করেছিস।
ঠাট্টা নয় মলা, ঠাট্টা নয়। হিমাদ্রির মুখ সিরিয়াস হয়ে উঠল। দাদা তো আর বাংলা কাগজগুলো বাঙ্গালোরে পড়ার সুযোগ পায়নি, পেলে বুঝতে পারত স্টার ফুটবলাররা এক-একটা সত্যিই গা গো। এই তো সারথির রণেন পাল আর দেবী মাইতিকে যাত্রীর পতু ঘোষ দু লাখ আশি হাজার দর দিয়েছিল। ওরা বলে বটা বিশ্বাসের সঙ্গে কথা না বলে কিছু করবে না। ওরা এসে বটাকে বলল যাত্রী এই টাকা দেবে, আপনি দর না বাড়ালে যাত্রীতে চলে যাব। বটা তখন দুজনকে দু লাখ ষাট করে দেবে বলল। আর দুজনের গতবারের বকেয়া ছিল পঁচিশ হাজার করে, সেটাও মিটিয়ে দেবে বলল। ওরা মেনে নিয়ে অ্যাডভান্স নিল। তারপর কী করল জানো? দুজনেই পতু ঘোষের কাছে গিয়ে বলল, আমাদের যদি তিন লাখ করে দেন তা হলে সারথির অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দেব।
এইসব কথা কাগজে বেরিয়েছে, না কি তুই বানিয়ে বানিয়ে বলছিস কানু! রেখা গুপ্ত অবাক হয়ে বললেন।
পিসি, কাগজগুলো এখনও ঘরে রয়েছে তোমাকে সব দেখাতে পারি, লাইন বাই-লাইন সত্যি। কিন্তু তোমাকে দেখাব না।
কেন?
তা হলে তুমি দাদাকে আর ফুটবল খেলতে দেবে না।
কেন দেব না? পরিশ্রম করে খেলা শিখেছে, বছরে এত গাদা গাদা ম্যাচ খেলছে রক্ত জল করে, সেজন্য টাকাকড়ি নেবে না? নিশ্চয় নেবে। মজুরি বাড়াও, মাইনে বাড়াও করে স্লোগান দেবে, মিছিল করবে কুলিমজুর, কেরানিরা, তার বেলা দোষ হয় না, আর ফুটবলাররা দুটো টাকা বাড়াতে চাইলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল! নাকু এবার যারা বেশি টাকা দেবে তুই সেখানেই খেলবি।
সমীরণ হাসল। মাথা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মন্থর ভারী গলায় বলল, নিলু গড়গড়ির কথাগুলোর মধ্যে অনেক সত্যি জিনিস আছে পিসি। ফুটবলাররা নিজেদের মর্যাদা নিজেরাই খুইয়েছে নানানভাবে। দর বাড়াবার জন্য এই যে একবার। পতু একবার বটা আবার পতু, এতে কয়েক হাজার টাকা হয়তো বাড়ানো যাবে কিন্তু ক্লাবের সমর্থকরা কি এদের মানুষ হিসাবে উঁচুতে স্থান দেবে না কি ওরা নিজেরাই নিজেদের সৎ মানুষ ভাববে? ভেবে দ্যাখো পিসি, দেশে এখন অন্যান্য খেলার সঙ্গে তুলনায় ফুটবলের স্থান কোথায়? শুধু বাংলাতেই ফুটবল নিয়ে নাচানাচি হয়। এখানে রাস্তায় হাঁটলে বহু মানুষই তাকায়, ছেলেরা অটোগ্রাফ চায়। কাজকর্ম, দরকার নিয়ে কোথাও গেলে আগে সেটা করে দেয়। কিন্তু বাংলার বাইরে ফুটবলারদের এখন আর কোনও খাতির নেই কেননা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে আমাদের কোনও পারফরমেন্সই নেই। আছে ক্রিকেটের, ওরা বিশ্বকাপও জিতেছে। তাই ক্রিকেটারদের পেছনে সবাই ছোটে। আমি নিজে বড় বড় শহরে, কেরল বাদে সব জায়গায়, এটা লক্ষ করেছি। কেন এমন হবে? সমীরণ তার মর্মবেদনা কণ্ঠস্বরে প্রকাশ করল।
কিন্তু সেজন্য ফুটবলাররা দায়ী হবে কেন? হিমাদ্রি তর্ক চালাবার একটা রাস্তা পেয়ে যুক্তির সাইকেলে উঠে পড়ল। ভারত ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে খেলতেই যায় না, না গেলে ফুটবলাররা তৈরি হবে কী করে? ক্রিকেটে যেসব লোক বোর্ডে যায় তারা বেটার ক্লাস অব পিপল, আর ফুটবলে পতু, বটা, ঘুনু এই তো সব নাম! নামেই বোঝা যায় কী ক্লাসের লোক! হিমাদ্রি ঠোঁট বাঁকাল।
কানু, তুই ভুলে যাচ্ছিস, বিরাশির এশিয়ান গেমস দিল্লিতে হয়েছিল। তাইতে আমাদের ফুটবল টিম তৈরি করার জন্য বহুবার বাইরে খেলতে দল পাঠানো হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্টে। তখনই আমাদের দেশে নেহরু কাপও শুরু হয়। ভারত এই কাপে এখন পর্যন্ত চৌত্রিশটা ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র একটা! ইডেনে যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়েছিল সেই বিরাশিতে। গোল দিয়েছে মোট সতেরোটা, খেয়েছে চৌষট্টিটা। নিজের দেশের মাটিতে এত বছর ধরে ইন্টারন্যাশনাল খেলছি, দেশের লোকের সামনে। এতে আলাদা বাড়তি একটা প্রেরণাও প্লেয়ারদের পাওয়ার কথা। দেশের সম্মান দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্য, বাড়াবার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়াই তখন একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে।
সমীরণ কথা থামিয়ে তিনজনের মুখের দিকে তাকাল। পিসি ও মলা গম্ভীর হয়ে গেছে। কানুর সাইকেলের চাকা থেকে হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যেকবারই ভারত সবার শেষে। ক্যাম্পে নোভাচেক একদিন বলল, স্যাম, আমাকে সমীরণ বলে না, তোমাদের দেশে কি ফুটবল খেলা হয়? কেমন ফুটবল খেলা হয়? হেথ নেই, স্পিড, স্ট্রেংথ, স্ট্যামিনা নেই। কিন্তু বেসিক স্কিলগুলো? এখনও পাস ধরতে পারে না, শুটিং পাওয়ার জিরো, কারেক্ট বল দিতে জানে না, এয়ারে ভেরি পুওর, কখন কোথায় থাকতে হবে সেই জ্ঞানটাও নেই। তোমাদের স্কুল লেভেলে কিছুই শেখবার ব্যবস্থা নেই। অজ্ঞ, আনস্কিলড, খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি বয়সে ক্লাব ফুটবলে আসে। সেখানেও কিছু উন্নতির সুযোগ পায় না। খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে সারা বছরই অবিরাম খেলে খেলে এত ক্লান্ত হয়ে থাকে যে, স্কিল বাড়াবার জন্য। খাটার ইচ্ছে আর থাকে না। তারপর ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে ওরা যখন আসে, আর তখন কী ফুটবল যে খেলে, সেটা তো খেলার ফলই বলে দিচ্ছে।
শুনতে শুনতে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। তারপর রাগও হয়। সমীরণ হঠাৎ সোজা হয়ে বসে রাগী দাঁতচাপা স্বরে বলল, ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করে দিই কলকাতার ফুটবলকে। শুধু ট্রফি জেতা, লিগ জেতা ছাড়া আর কিছু এরা ভাবে না। সারা পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, এমনকী পাশের এই বাংলাদেশও আমাদের ফেলে এগিয়ে গেছে আর আমরা এখানে ট্যাকটিক্স আর স্ট্র্যাটেজি ভেঁজে বড় বড় বুলি কপচাচ্ছি। বাইরে থেকে প্লেয়ার ধরতে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এই দুটো ক্লাব। ভাবতে পারো বিনু জন, আলবুকার্ক, কানাইল এরা কিনা প্লেয়ারের জাত? অথচ এরাই এখন ময়দানের আরাধ্য দেবতা। এদের আনার চেষ্টা হচ্ছে আমাকে কোণঠাসা করার জন্য।
সে কী রে! পিসি আঁতকে উঠলেন। কোণঠাসা তো ওরাই হবে তোর কাছে।
তোকে কি সারথির আর দরকার নেই? হিমাদ্রি জ তুলে জানতে চাইল। তোকে যাত্রীতে যাওয়ার সুযোগ দিলে ইলেকশনে বটার কী অবস্থা হবে?
কথাটা দরকার বা অদরকারের নয়, টাকা দিয়ে আমায় অবশ্যই ধরে রাখবে। বটা বিশ্বাস যতই আমায় অপছন্দ করুক, সে জানে আমি যা সার্ভিস ক্লাবকে দেব, আর কেউ সারা বছর ধরে তা দিতে পারবে না। এটা সারথির জনতাও জানে। কিন্তু বটা বিশ্বাস ওর নিজের তাঁবের কয়েকটা প্লেয়ার দিয়ে মাঠে আমায় সারা বছর খাস্তা করার চেষ্টা করবেই। ম্যাচ গড়বড় হলেই ওর পোষা ছেলেরা টেন্টে ইট ছুড়ে আগুন ধরিয়ে। ঝামেলা পাকাবে আর দোষটা আমার ঘাড়ে ফেলবে। অবশ্য ওর গোষ্ঠীতে যদি ভিড়ি তা হলে কিছুই হবে না।
তুই তো বাঙ্গালোর চলে যাবি, তোকে তো তা হলে আর খেলতে হচ্ছে না। শ্যামলা বলল, ঝামেলা এড়াবার একটা রাস্তা বাতলে।
আরে, চলে যাওয়াটা কি চিরকালের জন্য? ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেবে, তখন। এসে খেলব। আবার ডাকবে, চলে যাব। আমাকে বাইশ তারিখের মধ্যে কোঝিকোড় পৌঁছতেই হবে। নাগজির খেলা শেষ হলে নোভাচেক যদি মনে করে তা হলে ধরে রাখতে পারে একসঙ্গে ট্রেনিংয়ের জন্য। আবার লিগে খেলার জন্য ছেড়েও দিতে পারে। সবই ওর ইচ্ছের ওপর।
তোকে তো সারথি কন্ট্রাক্ট করতে বলবে। হিমাদ্রি জানতে চাইল না, একটা স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা যেন বিবৃত করল। যাত্রীও তোকে চাইছে, বেশি টাকা দেবে বলছে। দুপক্ষের দরটা আগে শুনে নে।
দরটর শুনে কাজ নেই। নাকু, তুই আগে ভাল করে খেলাটা তৈরি কর। ওই চেক সাহেবের কাছ থেকে যত্ন করে সব শিখে নে। সম্মান বাড়া দেশের, দেখবি তাতে তোরও সম্মান বাড়বে। পিসির কথাগুলো দৃঢ়স্বরে বলা এবং তাইতে বাকি তিনজন অস্বস্তিতে পড়ল।
পিসি, দাদা তো দেশের সম্মান নিয়ে ভাবছেই, কিন্তু টাকাটাই ছাড়বে কেন? শ্যামলা বাস্তবের কাছাকাছি পিসিকে ধরে রাখার চেষ্টা করল। এই তো একটু আগে বললে, রক্তজল করে খেলে সেজন্য টাকাকড়ি নিশ্চয় নেবে, যারাই বেশি টাকা দেবে…
মলা তুই ভুল করছিস। হিমাদ্রি থামিয়ে দিল। পিসি বলতে চায় টাকা তো নেবেই কিন্তু দেশের মর্যাদাও বাড়াতে হবে, তাই তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই-ই পিসি সমাধানটা পেয়ে গিয়ে হাঁপ ছাড়লেন। আর ঠিক তখনই বাড়ির সামনে মোটরগাড়ির দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো শব্দ ভেসে এল।
এখন আবার কে! সমীরণ ওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এই সাড়ে দশটায়!
হিমাদ্রি জানলার কাছে উঠে গেল। শ্যামলা ফটকের আলোটা জ্বেলে দিল।
সবুজ মারুতির দরজা খুলে নামছে ঘুনু মিত্তির। রাস্তায় পা রেখেই বাড়ির জানলার দিকে ইশারা করে আলো নিভিয়ে দিতে বলল।
ঘুনুটা আবার এসেছে, মলা আলো নিভিয়ে দে। হিমাদ্রি রিলে করল জানলা থেকে। দরজা খুলতে খুলতে সে বলল, এত রাতে যে, কী ব্যাপার?
এত রাত আর কোথায়, মাত্র তো সাড়ে দশ। কলকাতায় এখনও ট্রামবাস চলছে, খাবারের দোকান খোলা রয়েছে। তোমাদের অবশ্য একটু বেশি রাতই। যারা ফুটবলার ক্যাচ করে বেড়ায় তাদের কাছে দুপুর একটা আর রাত একটা সমানই। ব্যাপার। ঘুনু সমীরণকে দেখে খুবই হৃষ্টমনে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে পড়ল। হু হুঁ বাবা, একটু রাত না করলে কি বাড়িতে যাওয়া যায়?
আর একটু দেরি করলে দাদাকে আর পেতেন না। হিমাদ্রি গম্ভীর গলায় বলল।
ঘুনু চমকে উঠলেন, কেন, কেন?
সারথির লোক দুবার এসে খোঁজ করে গেছে। হয়তো রাতেও আসবে। তাই দাদা রাতে বাড়িতে থাকবে না। হিমাদ্রির থেকেও শ্যামলা আর একটু গম্ভীর গলায় বলল।
সারথির লোক! ঘুনু বিরক্তি, ভয়, উদ্বেগ মিশিয়ে তাকালেন। বন্ধু? নির্মল? নাম বলেছে?
বলেনি। এইভাবে যখন-তখন ঘনঘন ডিস্টার্বেন্স হলে…আমার পার্টওয়ান পরীক্ষার আর দু মাসও বাকি নেই— শ্যামলা ঈষৎ অনুযোগ কষ্ঠে এবং চাহনিতে ফুটিয়ে তুলল।
ঠিক, ঠিক, ডিস্টার্বড় মাইন্ডে পড়াশোনা, পরীক্ষার প্রিপারেশন হয় না, ফুটবল তো খেলাই যায় না। নাকু, গুছিয়ে নে। দুটো শার্ট, একটা প্যান্ট, একটা পাজামা হলেই হবে।
দুটো শার্ট, দুটো প্যান্ট গুছিয়ে নে, তার মানে?
সমীরণের আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। এমনটি তার আজই হয়েছিল যখন বাসবের গলিতে ওরা তিনজন আচমকা ছুটে এসে তাকে ধরেছিল।
মানে হল, পতুর বাড়িতে এখনই তোকে নিয়ে যাব।
নিয়ে যাবে মানে?
ওখানে থাকবি, ওখান থেকে সই করতে যাবি, সই করেই সোজা দমদমে গিয়ে প্লেনে উঠবি। কোথাকার টিকিট কাটব বল? মাদ্রাজ, বাঙ্গালোর, না হায়দরাবাদের? মাদ্রাজেরই কেটে রাখি, ওখান থেকে সাউথের সব ফ্লাইটগুলোই পাবি।
থামুন, থামুন। সমীরণ দু হাত তুলল। পতুদার বাড়িতে আমি যাব কেন?
কথাটা শুনে ঘুনু অবাক হয়ে পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, কেন কী রে? দুবার যে ঘুরে গেছে। এরপর কি তোকে আর ছেড়ে রাখা যায়!
নাকুকে ধরে রাখবেন? পিসির নির্বিকারত্ব এতক্ষণে ঘুচল। কথার মধ্যে প্রবেশ করলেন সন্দেহ কুটিল চোখ নিয়ে।
নিশ্চয়।
আমি বেঁচে থাকতে! চাপা গর্জন আর পিসির উঠে দাঁড়ানো দেখে ঘুনু চেয়ারে তাঁর অবস্থান পালটে ইঞ্চিখানেক পিছোলেন। বাঁ হাতটা আপনা থেকেই বুশ শার্টের কলারের কাছে উঠে গেল।
কেন? কী করেছে ও? যেখানে খুশি ও খেলবে, যার সঙ্গে খুশি ও যাবে। ও কি গাধা-গোরু যে, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবেন?
আহাহা আপনি এত চটছেন কেন, নাকুর তো দুটোই পা, ও কেন গাধা-গোর হতে যাবে? আমরা ওই পা দুটোই চাইছি। অন্য কেউ এসে ওর পা ধরে যাতে টান না মারে সেজন্যই ওকে পতুর বাড়িতে সরাতে চাচ্ছি। আপনি অল্পেই রণচণ্ডী মূর্তি ধরেন। আজ সকালে আমার… ঘুনু গলায় হাত বোলাতে শুরু করলেন। রেখা গুপ্ত অপ্রতিভ হয়ে আড়চোখে তিনজনের মুখ লক্ষ করে বুঝলেন সকালের কাজটা নিয়ে এরা বহুদিন তাঁর পেছনে লাগবে।
ঘুনুদা, আপনি কি আমায় বাচ্চা ছেলে ভেবেছেন? কেউ ধরে নিয়ে যাবে বললেই কি অমনই ধরা দিয়ে দেব। তা ছাড়া, আমি যাত্রীতে খেলব এ ধারণাটাই বা আপনাদের হল কী করে? সমীরণ বিরক্তি লুকোবার চেষ্টা করল না।
তোর জায়গায় তিনটে প্লেয়ার আনছে, সেটা তো জানিস? আমাদের বুকুকেও। টোপ দিয়েছে। সারথি এখন ডেসপ্যারেট একটা-দুটো স্ট্রাইকার পাওয়ার জন্য। নইলে গত তিন বছর একটা বড় ম্যাচে গোল করতে না পারা বুকুকে কিনা দুলাখ অফার দেয়? ঘুনু তাজ্জব বনেছেন বোঝাতে চোখ পিটপিট করলেন।
তা হলে বুকু চলে যাক সারথিতে। সমীরণ আলস্য ভাঙার জন্য দুহাত তুলে দেহে মোচড় দিল। দুলাখ পেলে যাওয়া উচিত।
পাগল হয়েছিস। সারথিতে গিয়েই যাত্রীকে গোল দেবে। ওকে যেতে দেওয়া চলবে না, দুই-পঁচিশে ও রাজি হয়েছে। আজকেই ওকে পতুর বাড়িতে জিম্মে করে। দিয়ে এলাম। তুইও এবার চল।
বুকু অর্থাৎ কিশলয় দত্তকে দুই-পঁচিশ, যে গত তিন বছর ধরে বড় ম্যাচে গোল করতে পারেনি। আর সমীরণ গুপ্তকে এক লাখ ষাট হাজার! বাহ্। হিমাদ্রি দাদার হয়ে দরাদরির প্রথম ধাপে পা রাখল। আর দুলাল চক্রবর্তীর মতো বানপ্রস্থের সময় হওয়াকে কত অফার দিয়েছেন?
ঘুমু মেজাজ হারালেন না। খোঁচাটাকে সরল হাসি দিয়ে ভোঁতা করে বললেন, মানছি দুলালের বানপ্রস্থের সময় হয়ে গেছে, এখন ও পয়ত্রিশ মিনিটের প্লেয়ার। কিন্তু বড় ম্যাচে এখনও ওর জায়গায় খেলবার মতো লোক এদেশে নেই। এজন্যই ওকে নিতে হবে। বলেছি তো, ঘেঁকে তুলে নেব এবার, টাকাপয়সা নিয়ে কোনও কার্পণ্য যাত্রী করবে না। তা হলে নাকু? ঘুনু চেয়ার থেকে ওঠার মতো ভাব দেখালেন।
তা হলে কী? সমীরণ পা দুটো ছড়িয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে জানিয়ে দিল, সে ব্যস্ত নয়।
মামণির পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, সামনেই পার্ট ওয়ান। পতুর গাড়ি নিয়েই এসেছি। ব্যাগে শার্ট-প্যান্টটা ভরে এবার বেরিয়ে পড়, পাজামা নিতে ভুলিসনি। অত্যন্ত নিশ্চিন্তে কথাটা বলে, কী যেন ভাবতে ভাবতে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘুনু, নস্যির নতুন ডিবেটা বের করে ঢাকনায় কয়েকটা চাঁটি দিলেন। রেখা গুপ্তর চোখ নিবদ্ধ হল ডিবেটায়। শ্যামলা হাত দিয়ে মুখ চাপল। হিমাদ্রি হঠাৎ বিষম খেয়ে বেসিনের দিকে ছুটে গেল।
সমীরণ এসব লক্ষ করেনি। কারণ চোখ বন্ধ করে সে তখন ভাবছিল। ঘুনুদা, আমি যাত্রীতে যাব না।
নীল আকাশ থেকে ঘুনুর মাথায় বাজ পড়লেও এত অবাক তাঁকে দেখাত না। যাবি না! আমি যে পতুকে দিব্যি গেলে বলে এসেছি, তোকে নিয়ে যাবই! আমার মাথাকাটা যাবে, লজ্জা রাখবার জায়গা থাকবে না…
থাক ঘুনুদা, এসব কথা বলে লাভ নেই। আমার সঙ্গে কথা না বলেই দিব্যি গেলে ফেলেছেন? সমীরণ কঠিন গলায় ইঙ্গিত দিল বাজে কথা সে শুনতে চায় না।
দাদাকে কি গা-গো ভেবেছেন? শ্যামলা ফুট কাটল।
গা-গো! ঘুনু ঘাবড়ে গেলেন, তার মানে?
ও কিছু নয়। সমীরণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল। মলার মাথায় পোকা আছে, সেগুলো মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে।
আহহ। নিশ্চিত বোধ করে ঘুনু নস্যির ডিবের ঢাকনাটা খুলে আঙুল ঢোকালেন। তাই দেখে রেখা গুপ্ত কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, শ্যামলা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাঁকে চুপ থাকতে ইশারা করল।
দ্যাখ নাকু এক-ষাটটা হল চুক্তি, আর গুঁড়ো পঞ্চাশ হাজার। তা হলে দুলাখ দশ হাজার। গত দুবছর ধরে তোর পেছনে লেগে রয়েছি, এবার আর.. টেবিলে হুমড়ি খেয়ে ঘুনু আঙুলের টিপে নস্যি সহ সমীরণের দিকে দুহাত বাড়ালেন। সীতেশের গ্রুপের ছেলে বুকু। ওকে প্রোটেক্ট করার জন্য সীতেশই দুবছর ধরে তোকে যাত্রীতে আনার ব্যাগড়া দিয়ে গেছে। এ বছর পতু এসে ওকে কোণঠাসা করে দিয়েছে, তবে বুকুকেও পত্ন রাখতে চায়। তুই প্রথম দুটো ম্যাচে গোল কর, বুকু ফুকু ফুটে যাবে, সীতেশরাও ভেসে যাবে।
যাকে ফোটাতে চান, তার থেকে দাদা পনেরো হাজার কম নেবে কেন? হিমাদ্রি জেরা করার ভঙ্গিতে বলল। সাতটা গোল তিন বছরে, এক-একটার দাম কত হবে বলে মনে হয়!
ঘুনু তাকালেন সমীরণের দিকে। ভাইয়ের প্রশ্নটা দাদার চোখেও। হতাশভাবে ঘাড় নেড়ে ঘুনু নস্যিটা নাকে ঢুকিয়ে হাত ঝাড়তে গিয়েই মুখ ফ্যাকাশে করে ফেললেন। পর্যায়ক্রমে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসে বললেন, দ্যাখো, কী ভুলো মন যে আমার। আবার আমি নস্যি নিতে শুরু করেছি। এটা যে আজই ত্যাগ করেছি সেটা আর মনেই নেই!
এই ডিবেটাও কি জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবেন? খুব সাধারণ স্বরে শ্যামলা জানতে চাইল।
নাহ। ঘুনু মাথা নাড়ালেন। ফেলব না। থাক। বেইজ্জত হতে আর বাকি রইল না। তোমরা সবাই আমাকে ধাপ্পাবাজ, ভণ্ড, অ্যাক্টর বলে নিশ্চয় ধরে নিয়েছ। বোধ হয় আমি তাই। ক্লাব করে করে সোজাভাবে চলাটাই ভুলে গেছি।
করুণ হয়ে উঠেছে ঘুনুর মুখ, কিন্তু ঝট করে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে সরল হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলেন, যাকগে এসব, বরং তুই পতুর সঙ্গে একবার নিজেই মুখোমুখি কথা বল। এক একটা গোলের দাম কত সেটা ওই ধার্য করবেখন। মনে হচ্ছে আজ আর তোকে নিয়ে যেতে পারব না, তা হলে কালকে চল।
আপনি আমাকে পতুদার ফোন নাম্বারটা দিন, কবে যাব সেটা ফোন করে জানিয়ে দেব। সমীরণ আন্তরিকভাবে বলল।
ঘুনুদাকে এগিয়ে দিতে ওরা সবাই বাইরের বারান্দায় এল। হঠাৎ তিনি রেখা গুপ্তর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, মুন্নার বাড়িতে গেছলেন কি?
অ্যাঁ! মুন–না! কে–? রেখা গুপ্ত থতমত হয়ে আমতা আমতা করছেন, ততক্ষণে ঘুনু মিত্তির মারুতির দরজায় হাত রেখেছেন।
আহ, পিসি, তুমি মাটি করলে। মুন্না কে তা ভুলে গেলে এর মধ্যে? চাপা ঝাঁঝ শ্যামলার গলায় এবং সেটা অপ্রতিভতার লজ্জা সহ।
লাস্ট সেকেন্ডে পেছন থেকে এসে গোল করে দিয়ে গেল। নিশ্চয় সারাদিন ওত পেতে ধারেকাছে ছিল। হিমাদ্রি ঠোঁট কামড়াল।
নাকু, ভদ্দরলোকের কাছে যে আমি মিথ্যাবাদী হয়ে রইলাম। রেখা গুপ্ত কাঁদো কাঁদো হয়ে সমীরণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী ভাবছেন উনি আমার সম্পর্কে, মলার সম্পর্কে!
কিচ্ছু ভাবছে না, এসব ধড়িবাজ লোককে আমি চিনি। এরা সত্যি মিথ্যের ধার ধারে না। সমীরণ আশ্বস্ত করার জন্য বলল।
কিন্তু আমি তো ধরি। আমিও তো ধড়িবাজ হলাম। উহহহ, এবার নরক যন্ত্রণা শুরু হবে। নাকু তুই আমায় উদ্ধার কর,…তুই বরং ওর ক্লাবেই এবার যা, তা হলে আমি খানিকটা শান্তি পাব। বলেই রেখা গুপ্ত দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে খাটে বসে কান ধরে বিড়বিড় শুরু করলেন, মিথ্যা বলা মহাপাপ, নরকে গমন…মিথ্যা বলা মহাপাপ…।
ডাইনিংয়ে তখন হিমাদ্রি বলছে, গ্রেট লেডির অর্ডার, অমান্য করলে কিন্তু ভি আই পি রোডে নিশ্চিত নিলডাউন!
.
০৫.
কে, সমীরণ নাকি, আমি ধাড়াদা, সুবোধ ধাড়া বলছি।
টেলিফোন বাজার শব্দে সমীরণের ঘুম ভেঙে গেছল। খাবার দালান থেকে রেখা গুপ্তর ঘরে যাওয়ার সরু গলিটার মধ্যে দেয়ালে আঁটা র্যাকে টেলিফোন। সে ভেবেছিল মলা বা কানু ফোন ধরবে। ক্রমাগত বেজে যাওয়ায় বিছানা থেকে তাকে উঠতেই হল। আজ রবিবার বেগিং বন্ধ। পিসি আর মলা তা হলে বাজারে গেছে। কানুও বাড়িতে নেই।
বলুন। সমীরণ এক চোখ বুজে ঘড়ি দেখল। সওয়া ছটা।
ঘুম ভাঙালাম নাকি?
সারারাত লোডশেডিং, এই সকালের দিকে ঘুমটা এসেছিল। হাই তোলার শব্দ সে ফোন মারফত পাঠিয়ে দিল।
এহেহেহে, তা হলে তো অন্যায় হয়ে গেল। তুই তা হলে এখন ঘুমো, আমি বরং পরে ফোন করব।
ঘুম আর আসবে না, বলুন, কী বলবেন। বিরক্তি চেপে অমায়িক গলায় সে বলল।
বলব আর কী, ক্লাবে যা চলছে। এরা, মানে ঘুনুরা, আর কোচ খুঁজে পেল না, শেষে কিনা অজয় তালুকদারকে! কী যোগ্যতা আছে ওর? কোনওদিন কোনও বড় টিমকে কোচ করল না, দুটো ছোট টিমকে কোচ করে বি গ্রুপে তাদের নামিয়ে দেওয়া ছাড়া যার আর কোনও সাকসেস নেই, কোচিংয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা নেই, ফুটবল সেন্স নেই, ঝালচচ্চড়ি অম্বল রাঁধার বাইরে আর কিছু যে রাঁধতে জানে না তাকে কিনা ফাইভ স্টার হোটেলের চিফ শেফ করে দিল!…হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস?
পাচ্ছি। আপনি বলে যান। কিন্তু এই সক্কালবেলায় এসব কথা আমায় শোনাচ্ছেন। কেন? আমি তো যাত্রীর প্লেয়ার নই।
ঘুনু তোর বাড়িতে কাল গেছল তোকে তুলে আনতে। পারেনি। আমি জানতুম পারবে না। তোর মতো প্লেয়ারের মানমর্যাদা, ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হতে যাচ্ছিস, এখন। যারা কমিটিতে এসেছে তারা কি দিতে পারবে? ভেবেছে টাকা ছড়ালেই সমীরণ গুপ্ত ছুটে আসবে, তা কি কখনও হয়! হাঘরে ছেলেদের মতো টাকার জন্য আজ এ-ক্লাব। কাল সে-ক্লাব, এসব তো তোর পক্ষে সম্ভব নয়। কী ফ্যামিলির ছেলে তুই, আমি তো তা জানি।…হ্যালো, কদিন ধরে লাইনটা খারাপ, হ্যালো…
আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছি, বলুন।
ঘুনু কেমন লোক তা তো তুই ভালই জানিস। ক্লাস এইট পর্যন্ত তো বিদ্যে, আগে নারান সেনের গাড়ির দরজা খুলে দিত, এখন পতুর গাড়িতে চেপে প্লেয়ার ক্যাচ করে বেড়াচ্ছে। নারানদার আমলে সেক্রেটারির ঘরে না ডাকলে ঘুনু ঢুকতে পারত না। আর এখন ও পতুর চেয়ারেও মাঝে মাঝে বসে। ক্লাবের ডিগনিটি বোধটাই নষ্ট হয়ে গেল এদের জন্য। তোর দশ হাজার টাকা তো আজও পেলি না।
সমীরণ শুনতে শুনতেই বুঝে গেল সুবোধ ধাড়া তাকে ভাংচি দিতে এইসব বলছে। তার মাথায় দুষ্টুমি খেলল। এইসব লোককে নিয়ে মজা করার সুযোগ চট করে তো পাওয়া যায় না।
ধাড়াদা, কে যেন বলল, টাকাটা নাকি আপনিই…
কী বললি, কী বললি, আমি তোর টাকা মেরেছি? জীবনে আজ পর্যন্ত একটা পাই-পয়সাও কাউকে ঠকাইনি। নিশ্চয় ঘুনু বলেছে। আসলে তোর টাকাটা ঘুনুই সই করে তুলে নিয়েছিল। আমি নিজে ভাউচারে ওর সই দেখেছি।
তখন আমায় সেটা, এইরকম একটা ফোন করে জানাননি কেন? না ধাড়াদা, আমাকে এত ভালবাসেন অথচ এই খবরটা আমায় দেননি। যদি দিতেন তা হলে আমি হ্যাঁ বলতাম না।
হ্যাঁ মানে! হ্যাঁ ব্যাপারটা কী? ঘুনুকে হ্যাঁ বলেছিস নাকি?
বলব না? পৌনে তিন লাখ টাকার অফার পেলে কি না বলব?
পউউনে তিন!
সমীরণ দশ সেকেন্ড কোনও শব্দ পেল না ওধার থেকে। হাসল সে। ওষুধ ধরেছে।
ধাড়াদা হ্যালো, লাইন ঠিকই আছে, হ্যালো, ঘুনুদা বললেন, গত বছর বুকু যা ধেড়িয়েছে তাতে নাকি আমাকেই এখন সবাই চাইছে। মেম্বার নাকি বলছে হিরো থেকে হিরোইন হয়ে গেছে বুকু দত্ত। এখন যাত্রায় নামুক। পতুদা নাকি বলেছেন ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই করে দিচ্ছি, সমীরণকে এনে দাও। আচ্ছা দেখুন তো কী মুশকিলে পড়লাম। আমি যাত্রীতে গেলে এদিকে বটাদা বলেছেন আমাদের বাড়ির সামনে অনশন শুরু করবেন—আমরণ। কী করি বলুন তো?
ঘুনুকে হ্যাঁ বলেছিস মানে ফাইনাল কথা, নাকি ল্যাজে খেলাচ্ছিস?
ওহো ধাড়াদা, এখন কি ফাইনাল কথা বলে কোনও কথা আছে? সই করার আধঘণ্টা আগেও তো ডিগবাজি খেয়েছে কত তারকা!
এখন কিন্তু ওসব খাওয়ার পথ বন্ধ। অলরেডি বটা আর পতু তাদের খোঁয়াড়ে মাল ভরে ফেলেছে। বুকুও ঢুকে গেছে পতুর বাড়িতে। বাকি যারা রয়েছে তাদের। একজন তুই, আশ্চর্য হচ্ছি, বটা এখনও কী বলে তোকে ছেড়ে রেখেছে! তোকে কি সারথির দরকার নেই? বিনু জন তো কাল এসে গেছে, কানাইল আজ আসছে, তা হলে কি তোকে আর সারথি রাখবে না?
সমীরণ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাঠ হয়ে রইল বিনু আর কানাইলের খবরটা পেয়ে। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল, বিনু যতদূর জানি আসবে না আর কানাইলকে পঞ্জাব পুলিশ ছাড়বে না। তবে ইলেকশনে জেতার জন্য বটাদা রটাবে ওদের আনিয়ে ফেলেছে।
একটা হালকা খিকখিক হাসি সমীরণের কানে ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দিল তার কথা নস্যাৎ হয়ে গেছে।
তুই বড় ছেলেমানুষ সমীরণ। বিনুকে কাল আমিই আমার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলে রেখেছি চন্দননগরে। বটাকে ইলেকশনটা জেতাতে হবে যাত্রীর স্বার্থেই তো। আলবুকার্ক সারথিতে আসছে আসছে এমন একটা রব তুলতে হবে। আরে খবরের কাগজ আমার মুঠোয়, রব তুলিয়ে দেব। কানাইলের জন্য বটার হয়ে আমি অনেক হেপ ওকে করেছি।
কেন করেছেন? পতুদাকে ডোবাবার জন্য?
হ্যাঁ। দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ ফোনের মধ্য দিয়ে সমীরণের কানে সুড়সুড়ি দিল। সুবোেধ ধাড়া হঠাৎ যেন খেপে উঠল বলে মনে হচ্ছে। আর শুনে রাখ, যাত্রীতে তুই যদি আসিস তা হলে তোকেও ডুবতে হবে।
সমীরণের ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠল কথাটা শুনে। সতর্ক হয়ে সে বলল, পতুদাকে ডোবাতে আপনি কিন্তু যাত্রীরই ক্ষতি করবেন।
করব, ক্লাবের জন্য করব। একটা প্ল্যান নেই, পরিকল্পনা নেই, দুহাতে টাকা ছড়িয়ে শুধু প্লেয়ার ধরছে। এসব ঘুনুর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। যত টাকা খরচ হবে ততই ওর হিস্যের টাকাও বাড়বে। এত প্লেয়ার নিয়ে শেষে বিপদে পড়তে হবে। ভাব তুই, লেট ব্যাকই চারজন, মিডফিল্ড নজন। এইভাবেই রিক্রুট হচ্ছে, অ্যাডভান্স দেওয়া হচ্ছে। পাগল না হলে এমন কাজ কেউ করে? অজয় বলেছে সমীরণকে আননা। ওর ফাস্ট চয়েস তুই। যদি তুই ফেল করিস তা হলেই বুকু টিমে জায়গা পাবে। এইভাবে কি টিম তৈরি হয়? তুই ফেল করলে তবেই বুকু টিমে আসবে! যাত্রী কি অজয়ের বাপের ক্লাব?
ধাড়াদা আপনি তো ক্লাবের শুভাকাঙ্ক্ষী, বুকুরও গডফাদার। শুনেছি ক্লাব লিগ না পেলে একমাস হবিষ্যি করেন, জুতো পরেন না। তা হলে গত বছর সারথির সঙ্গে লিগ ম্যাচের মাঝখানে বুকুর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে টেলিফোন করে হঠাৎ ওকে মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? বুকু তখন তো বেশ ভালই খেলছিল। হয়তো বহুদিন পর গোলও পেয়ে যেত। নিজের ওপর কনফিডেন্সটা ফিরে পাওয়ার জন্য গোল পাওয়া ওর খুবই দরকার ছিল। সেদিন আপনি একই সঙ্গে বুকুর আর ক্লাবের ক্ষতি করেছেন।
সমীরণ ধীরস্বরে, মেপে মেপে কথাগুলো বলল মাথা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে। একজন ভাল ফুটবলারের সর্বনাশ হওয়া দেখতে তার কষ্ট হয়। ফুটবলার হিসাবে বুকুকে সে সমীহ করত। কিন্তু এখন আর করে না। ক্লাবের রাজনীতিতে ধাড়া গ্রুপের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বুকু নিজের ক্ষতি নিজেই করেছে। এইসব দেখে আর শুনে সারথিতে গোষ্ঠী ঝগড়া থেকে সমীরণ শত হাত দূরে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।
সমীরণ তুই বুদ্ধিমান, শিক্ষিত। নোংরামিতে থাকিস না বলে ময়দানে তোর সুনাম আছে। একটা গরিব ঘরের ছেলে, তিন পুরুষ যা পেত না তাই পেয়ে গেছে সাত-আট বছরে। কম করে লাখ দশেক যাত্রী থেকে আর হাজার তিনেক মাসে মাসে। ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে। দুবছর আগেই লক্ষ করেছি বুকুর ভেতর থেকে খেলার ইচ্ছেটা ফুরিয়ে গেছে। ও আর কোনওদিনই খেলায় ফিরতে পারবে না এটা আমি জেনে গেছি বলেই মাঠ থেকে বের করে নেওয়ার জন্য মায়ের হার্ট অ্যাটাকের টেলিফোনটা করিয়েছিলুম। ওর এজন্য কোনও ক্ষতিই হয়নি। কিন্তু আমি যা ঘটাতে চেয়েছিলুম সেটা হয়েছিল। ম্যাচ হেরে গ্যালারিতে আগুন জ্বলেছিল। হয়তো সেদিন বুকু একটা গোল করে ফেলত কিন্তু সেলফ কনফিডেন্স ও ফিরে পেত না। তা পেতে হলে খেলাকেই ধ্যানজ্ঞান করতে হয়। বুকু আর তা পারবে না বলেই ওকে আমি নিজের কাজে লাগাচ্ছি। আর ও এটা জানে, এখন ওভারটাইম খেটে উপরি আয় করার কাজ যতদিন পারে ওকে করে যেতে হবে। কিন্তু তুই অ্যামবিশাস, ফুটবলে বড় হতে চাস, তুই ডেঞ্জারাস।
এটা প্রশংসা, না নিলে?
কথাটায় কান দিল না বাড়া। শুধু বলল, যেজন্য ফোন করা, তুই সারথিতেই থেকে যা, তোর দর আমি বাড়িয়ে দেব। যাত্রীতে আড়াই লাখ টাকার অফার পেয়েছিস বলে খবরের কাগজে রটিয়ে দেব। সারথি দুলাখ অফার দিয়েছে শুনে তো বুকুকে তুলে নিয়ে গেছে পতু। তোকেও বটা তুলবে।
সমীরণ আবার খিকখিক করে হাসি শুনল। সে দ্বিধাভরে বলল, দুলাখ, আড়াই লাখ, এসব কি লোকে বিশ্বাস করবে?
করবে কেন, করেছে। আবার বলছি, যাত্রীতে এলে ঝামেলায় পড়বি, খেলতে পারবি না…খেলতে দেব না।
ওধারে টেলিফোন রাখার আর ডোরবেল বাজার শব্দ প্রায় একই সঙ্গে হল। বাজার নিয়ে রেখা গুপ্ত আর শ্যামলা ফিরল।
দাদা তোর কী অসম্ভব লাক, কতদিন পর আজই কিনা বাজারে শুড় থেকে টেইল প্রায় ছইঞ্চি লম্বা বাগদা উঠেছে!এ ব্লকের সেই মেমসাহেব, হাউসকোট পরে যিনি বাজার করেন, তিনি মাছওলার সামনে ঝুঁকে আঙুল দিয়ে বাগদার নাড়ি টিপে টিপে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন। আর পিসি, চল্লিশ হাত দূর থেকে ভিড়ের মধ্য দিয়ে…এককালে যে বাসকেট খেলত সেটা এবার বিশ্বাস হল।
মলা। রান্নাঘর থেকে গম্ভীর স্বরে ডাক পড়ল।
না পিসি সবটা আমি বলব না। শ্যমলা চেঁচিয়ে আশ্বাস দিয়েই সমীরণের দিকে বড় বড় চোখ করে বলল, অসম্ভব একটা ড্রিবল করে ছুটল। তিন-চারজন ভদ্রলোক ধাক্কা খেয়ে কোনওক্রমে টাল সামলালেন বটে, কিন্তু মেমসাহেবকে নির্ঘাত রেড কার্ড দেখানোর মতো ফাউল পিসি করেছে। সোজা গিয়ে একটা সাইডপুশ, মেমসাহেব দড়াম, এক থাবায় চিংড়িগুলো ধরে পাল্লায় চাপিয়ে দিয়েই পিসি বলল, ওজন করো, সবগুলো নেব। এক অ্যাকশনে সব ঘটে গেল। মাছওলা পিসিকে জানে। সে বিনা বাক্যবায়ে বাটখারা চাপিয়ে ডিক্লেয়ার করল, এক কিলো পঞ্চাশ গ্রাম, আশি টাকা আর চার টাকা, চুরাশি টাকা…দুটাকা কম দেবেন, সমীরণদা কাল ফিরেছেন জানি। মেমসাহেব যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন মাছগুলো আমার থলিতে এসে গেছে।
মলা। আবার রান্নাঘর থেকে।
এই যাই, আর একটু বাকি আছে পিসি। তারপরই বুঝলি দাদা, মেমসাহেব তো চিৎকার শুরু করলেন। মাছওলা তখন প্রায় ধমকেই তাকে বলল, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল পেয়ে কী করতে হয় সমীরণ গুপ্তর পিসিমা সেটা জানেন, আপনি অত লেট করলেন কেন? টাটকা বাগদা আর আপনি কিনা টেপাটেপি করছেন! ফাস্টাইম শট নেবেন তো! মেমসাহেব তো মাছওলার কথা কিছুই বুঝলেন না। আর পিসি তো হাতজোড় করে প্রচুর মাফটাপ চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিল জীবনে আর কখনও মেমসাহেবকে ধাক্কা মারবে না, এমনকী জীবনে আর কখনও চিংড়ি মাছও কিনবে না বলতে যাচ্ছিল…
মলা, মিথ্যে কথা বোলো না। রান্নাঘর থেকে প্রায় করুণ স্বর ভেসে এল।
আহা, আমি তো বলেছি বলতে প্রায় যাচ্ছিলে, সত্যিই কি আর বলেছ? আমি যদি তখন পিসি ওই দ্যাখো এঁচোড় না বলতাম তা হলে তো তুমি নির্ঘাত বলেই ফেলতে।
এই সময় রান্নাঘরের দরজায় এসে রেখা গুপ্ত একটা চিংড়ি তুলে গদগদ স্বরে বললেন, কী রকম টাটকা বল, আর কত শস্তা, আশি টাকা মাত্র!
সর্ষে, বাটা আর কষে ঝাল দিয়ে… সমীরণ টাকরায় জিভ লাগিয়ে একটা শব্দ করল। বহু…বহুদিন বাগদা খাইনি।
না, পিসি, নারকোল আর কিসমিস দিয়ে টক-মিষ্টি মালাইকারি। শ্যামলা নাকিসুরে আবদার জানাল।
দাঁড়া, দাঁড়া, এঁচোড় দিয়ে একখানা যা ডালনা… রেখা গুপ্ত রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।
মলা শিগগিরি গিয়ে ধরে পড়, এঁচোড় ফেচোড় বন্ধ কর।
তুই গিয়ে বল।
ভাইবোনের মধ্যে কথা নিয়ে যখন ঠেলাঠেলি চলছে তখন স্কুটার ফটফটিয়ে হিমাদ্রি বাড়ির সামনে থামল। জিলিপির ঠোঙাটা টেবিলে রেখে, তিরিশটা আছে, সবার ছটা ছটা, ইনক্লডিং বাবা। তারপরেই একটু উত্তেজিত স্বরে বলল, ট্যাক্সিটা থামিয়ে দুটো লোক, তারা-মার সামনে আমায় জিজ্ঞেস করল, সমীরণ গুপ্তর বাড়িটা কোথায়? দেখে মনে হল যাত্রী কি সারথির দলবদলের পার্টি, বললাম জানি না, ভেতরে গিয়ে খোঁজ করুন। ওরা সুশোভনেই ঢুকল, এক্ষুনি এসে পড়বে। বাইরে গিয়ে কথা বলবি।
হিমাদ্রির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেই ডোরবেল বাজল। সমীরণ বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এল।
দুজনেই সারথির। বটা বিশ্বাসের বিশ্বস্ত দিলীপ আর বাপি। প্রথমজন তার ব্যক্তিগত কাজগুলো করে, অন্যজন তার দেহরক্ষীর মতো সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। সমীরণের সঙ্গে মৌখিক আলাপ ছাড়া ঘনিষ্ঠতা নেই।
কী ব্যাপার, আপনারা?
বটাদা তোমায় একবার ডেকেছে। দিলীপ জরুরি ভাব দেখিয়ে বলল, ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
কিন্তু আমি তো এখন যেতে পারব না। পিসিমা বাগদা চিংড়ি এনেছেন। সমীরণের সহজ হালকা গলা।
মানে! দিলীপ বুঝতে পারল না।
পিসিমা বাজার থেকে আমার জন্য বাগদা কিনে এনেছেন। এখন তার খোলা ছাড়াচ্ছেন তারপর রাঁধবেন। সেটা না খাওয়া পর্যন্ত আমি তো বাড়ি ছাড়তে পারব না। সমীরণ হাসিমুখে বলল কিন্তু অন্য দুজনের মুখে হাসি ফুটল না।
বটাদা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। দিলীপের গলায় ব্যস্ততা একটু বেশিই ফুটে উঠল।
মাছফাছ এসে খাবেখন, আগে বটাদার সঙ্গে কথা সেরে আসবে চলো। বাপি কেউকেটা ভাব দেখিয়ে দুপা এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।
সমীরণের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। স্থির দৃষ্টিতে দিলীপের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটাকাটা স্বরে বলল, পিসিমার রান্না না খেয়ে, কোথাও আমি যাব না। এটা আমার কাছে আপাতত সবথেকে জরুরি ব্যাপার। বিকেলের দিকে বটাদার সঙ্গে দেখা করব, উনি তখন কোথায় থাকবেন?
ওরা দুজন একটু অবাক ও কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে সমীরণের কথা শুনল। বটাদা ডাকছে শুনে আঁকপাক করে দেখা করার জন্য ছুটল না, এমন অদ্ভুত ব্যাপার তারা দেখেনি। কিন্তু সমীরণকে ওরা চেনে। কঠিন গলা ও চাহনি থেকে ওরা বুঝে গেছে। এখন একে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
যাত্রী থেকে কেউ এসেছিল? দিলীপ নরম স্বরে জানতে চাইল।
হ্যাঁ। ঘুনু মিত্তির। সমীরণ জানে সব খবরই এরা পায়।
অফার দিয়েছে? দিলীপের নিচু গলা।
হ্যাঁ, তবে আমি কোনও কথা দিইনি।
দুজনেই যেন আশ্বস্ত হল। ওরা জানে সমীরণ ছলচাতুরি করে কথা বলে না।
বিকেলে বটাদা শশাভাবাজারে অভয় কুণ্ডুর বাড়িতে থাকবে, তুমি বাড়িটা চেনো?
অভয় কুণ্ডু একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিন বছর আগে অনেকের সঙ্গে সে অভয় কুণ্ডুর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। বাড়িটা যে ঠিক কোথায়, তার মনে নেই। তবে মাঝারি একটা রাস্তা থেকে গলির মধ্যে, খুব পুরনো বাড়ি, মোটা দেয়াল, উঁচু সিলিং, শ্বেত পাথরের মেঝের হলঘর, সদর দরজার পাল্লা দুটো খুব ভারী, এইটুকুই মনে আছে।
জায়গাটা জানি, বাড়িটা মনে নেই।
তা হলে ঠিক ছটায় শোভাবাজার মোড়ে বাপি অপেক্ষা করবে। তুমি ট্যাক্সি ওখানে থামাবে, ও নিয়ে যাবে অভয়দার বাড়িতে। ঠিক ছটায়, পাক্কা?
হ্যাঁ যাব। সমীরণ মাথা হেলাল।
.
০৬.
সমীরণ পৌঁছেছিল দশ মিনিট দেরিতে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিয়ম মানলেও, সর্ষে কাঁচালঙ্কা মাখানো বাগদাকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং মালাইকারিকে অবজ্ঞা করে রুচিহীনতার কবলে না পড়তে চাওয়ায় সে তার খাওয়ার বিধিনিষেধকে আজ শিকেয় তুলে দেয়। অবশ্য শুধু আজকের জন্যই। মনে মনে শুধু বলেছিল, হাজার হোক আমি তো বাঙালিই রে বাবা! মাছের সঙ্গে ভাতও আনুপাতিক হারে বেশি খেয়ে ফেলায় সমীরণকে একটি ভাতঘুমের সাহায্যও নিতে হয় হাঁসফাঁসানিকে সুস্থির করতে। অতঃপর দশ মিনিট বিলম্বকে সে দেরি মানতে চাইল না। অবশ্য ট্যাক্সিতে উঠে বাপি শুধু একবারই বলেছিল। আমি সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে দাঁড়িয়ে।
ট্যাক্সিটা শোভাবাজার মোড় থেকে পশ্চিমে গঙ্গার দিকের রাস্তা ধরে এগোল। সমীরণ হাটখোলা পোস্ট অফিসটা দেখে মনে করতে পারল এই পথেই সে গিয়েছিল নেমন্তন্ন খেতে। আর একটু এগিয়ে বাপির নির্দেশমতো ট্যাক্সি ডান দিয়ে একটা রাস্তায় ঢুকল। তারপর বাঁ দিকে একটা কানাগলির মুখে দাঁড়াল।
সামনেই চায়ের দোকান। সাত-আটটি যুবক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর বোর্ড রেখে ক্যারম খেলছিল। ট্যাক্সি থামতেই তিনজন এগিয়ে এল। বিগলিত সম্রম মুখে মাখানো।
সমীরণদা এসে গেছে রে..আসুন সমীরণদা। একজন দরজা খুলে ধরল।
একজন ঝুকে হাত বাড়াল নামায় সাহায্য করতে। সমীরণ নামার সময় একমুখ হাসল কিন্তু হাতটা ধরল না।
সমীরণদা, লিগটাই হল আসল জিনিস, এবার কিন্তু ওটা চাই। শিল্ড, কাপফাপ হোক বা না-হোক, আপনাকে কিন্তু…
আরে, একা কি কেউ লিগ জেতাতে পারে! এগারোজনের খেলা, এতদিন ধরে এতগুলো ম্যাচ, টিম কি সবদিন সমানভাবে খেলতে পারে? বিব্রতভাবে কিন্তু হাসিমুখে সমীরণ বলল। এই ধরনের কথার সামনে বহুবার তাকে পড়তে হয়েছে। বেশি কথাবার্তায় যেতে নেই। মুখে হাসি মাখিয়ে, অবশ্যই চেষ্টা করব, এবং এবার নিশ্চয় লিগ জিতব ধরনের কথা বলে সে পাগল-সমর্থকদের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে।
না, সমীরণদা, এ-কথা বললে হবে না, টিম আমাদের এবার খুব ভাল, বিনু জন তো… আচমকা বাপির ধমক খেয়ে ছেলেটি থতমত হয়ে কথা শেষ করতে পারল না।
কোথায় কী তার ঠিক নেই, বিনু জন নিয়ে হেদিয়ে মরছে। সমীরণ গুপ্ত থাকতে। আর কাকে দরকার? বাপি উত্তেজিত চোখে কটমটিয়ে তাকাতেই ছেলেটি গুটিয়ে। গেল। সমীরণের পিঠে মৃদু ঠেলা দিয়ে বাপি বলল, চলো চলো, এইসব কিসসু যারা বোঝে না জানে না, এদের সঙ্গে…।
সেই পুরনো বড় বাড়িটাই। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে বিরাট একটা অ্যালসেশিয়ান দেয়ালের কড়ার সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা। উপুড় হয়ে, চোখ বোজানো। পায়ের শব্দে একটা চোখ খুলে শুধু তাকাল। ওঠার সময় সমীরণের মনে পড়ল সুবোধ ধাড়ার কথাটা, বিনুকে কাল আমিই আমার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলে রেখেছি চন্দননগরে। আর এই ছেলেটা সবে যখন বলছিল, বিনু জন তো, ঠিক তখনই বাপি খিচিয়ে উঠে ওর মুখ বন্ধ করে দিল।
বিনুকে আনিয়ে বটা বিশ্বাস তার ওপর চাপ তৈরি করে রাখতে চায়। তারপর আলবুকার্ক, তারপর কার্নাইলও আসবে। একটা বিষাক্ত আবহাওয়া তৈরি করে বটা বিশ্বাস তার দমবন্ধ করে দেবে। পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হবে, খবরের কাগজে বেরোবে কে কার বিরুদ্ধে কী বলল আর তার জবাবে আর-একজন কী বলল। মেজাজ নষ্ট হবে, খেলায় ঘূর্তি আসবে না। সার্পোটাররা অকথ্য ভাষায় গাল দেবে।
হলঘরে দুটো সোফায় চারজন লোক বসে। সমীরণ চারজনকেই চেনে। ক্লাবটা এখন এরাই চালায়। বটা বিশ্বাস হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে একটা টাইপ করা কাগজ পড়ছিলেন। বয়স দেখে মনে হয় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, আসলে পঞ্চান্ন। গোলাকার মুখ, পাঞ্জাবির নীচে পেটের কাছে ফুলে রয়েছে চর্বি, গায়ের রং খুবই ফরসা, ডান হাতের আঙুলে পলা ও পোখরাজ বসানো দুটি আংটি। লোকটি সৌম্যদর্শন, কথা বলেন ধীরে। হাতের কাগজটা রেখে চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে সমীরণের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে মুখ ভরে গেল অনাবিল হাসিতে।
কাল এসেছিস অথচ খবর দিসনি। ফোনেও তো জানাতে পারতিস। সস্নেহ অনুযোগ করলেন বটা বিশ্বাস। নিজের পাশে বসানোর জন্য সোফায় চাপড় দিতে দিতে বললেন, বোস, বোস।
কাল বাড়ি ফিরলামই তো রাত্রে। খুব টায়ার্ড ছিলাম। সমীরণ বসার আগেই সতর্কভাবে বলল। বটা বিশ্বাস সব খবরই রাখে সুতরাং আড়াল দিয়ে কথা না বলাই ভাল।
টায়ার্ড তো হওয়ারই কথা। স্টেশন থেকে দুলালের ব্যাঙ্ক, তারপর দমদমে প্রধান অতিথি, ধকল তো কম নয়। বটা বিশ্বাস মিটিমিটি হাসছেন।
লোকটার কাছে এইসব খবরও পৌঁছে গেছে! আশ্চর্য বোধ করছে, এটা কোনওভাবেই যাতে মুখে ফুটে না ওঠে সমীরণ সেই চেষ্টায় সফল হল। মুখটা ব্যাজার করে বলল, তার ওপর রাতে আবার ঘুনুদার ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হল।
বটা বিশ্বাস বিস্ময় প্রকাশ করলেন না ঘুনু নামটা শুনে। ঘুনু প্রসঙ্গ না তুলে খুবই স্বাভাবিক গলায় বললেন, এ-বছর সারথিতেই তো থাকবি?
প্রশ্ন বা উৎকণ্ঠা নয়, বটা বিশ্বাসের বলার ভঙ্গিটা যেন একটা বিবৃতি শুরু করার মতো। প্রচুর দেনা রয়ে গেছে গত বছরের। এই দ্যাখ, ব্যাঙ্ক তাগিদ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। কী ভাবে যে এবার টিম করব ভেবে পাচ্ছি না।
সুদে-আসলে এগারো লাখ ব্যাঙ্ক এখন পাবে। শুকনো গলায় বটা বিশ্বাসের পাশে বসা সহসচিব অপূর্ব মজুমদার বললেন।
সমীরণ এই ধরনের কথা গত বছরও দলবদলের আগে শুনেছে। তখন ধারের অঙ্কটা ছিল আট লাখ। এখন যে কাগজটা দেখাল সেটা সত্যিই ব্যাঙ্কের চিঠি কি না তাতে সন্দেহ হলেও সে চুপ করে রইল।
তুই তো ঘরের ছেলে, যা দেব তাই নিবি সোনামুখ করে। কিন্তু সবাই তো তা নয়।
সবাই তো সমীরণ গুপ্ত নয়। অন্য সোফায় বসা অভয় কুণ্ডু নিজেকে তাড়াতাড়ি জুড়ে দিলেন বটা বিশ্বাসের সঙ্গে।
তুই ছিলিস না, কী অসুবিধেয় যে পড়েছিলাম। কাকে কাকে নেব, কাকে কাকে ছেড়ে দেব, এই নিয়ে কথা বলার লোকই পাচ্ছিলাম না। নির্মলকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বিপ্লব বোস, গৌতম চ্যাটার্জিকে যাত্রী থেকে নিতে বলল। বোেঝ, ও দুটো কি প্লেয়ার! একটার তো ডান পা বলে কিছু নেই, শুধু পারে লম্বা লম্বা দৌড়। আর অন্যটা ফুলবাবু, সাজিয়েগুজিয়ে পায়ে বল পৌঁছে দিলে তবেই তিনি নড়বেন। মডার্ন ফুটবল এইসব প্লেয়ার দিয়ে কি খেলা যায়?
বটা বিশ্বাসের মুখে মডার্ন ফুটবল কথাটা শুনে সমীরণ হাসি চাপল।
মডার্ন ফুটবলে সারাক্ষণই তো দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, অভয়ের সংযোজন।
সোফায় বসা চতুর্থজনের দিকে মাথা হেলিয়ে বটা বিশ্বাস বললেন, পুলকেশবাবু ছোট টিমের চারটে ছেলের নাম দিয়েছেন। ওদের অ্যাডভান্স করা হয়ে গেছে।
বাইরে থেকে কাকে পাচ্ছেন, কানাইলের ট্রান্সফার নিয়ে নাকি প্রব্লেম হচ্ছে? সমীরণ জানতে চাইল। দল গড়ার ব্যাপারে গত তিন বছরে কখনও তার মতামত বা পরামর্শ কেউ নেয়নি। এইবার তাকে খাতির দেখাবার এই ভানটায় তার ভেতরটা কাঠ হয়ে উঠল।
কার্নাইলের কেসটা একটু কমপ্লিকেটেড। এ আই এফ এফ জানিয়েছে, কানাইল ওর অফিস থেকে লোন নিয়েছে, টাকা শোধ না করা অবধি রিলিজ অর্ডার দেবে না। সরকারি অফিস তো, তাই ফ্যাচাং আছে। আলবুকার্কের এগেনস্টে রয়েছে সন্তোষ ট্রফির খেলায় রেফারির ম্যাচ রিপোর্ট। আর বিনু জন ইন্টার স্টেট ট্রান্সফার চেয়েছে বাংলা আর মহারাষ্ট্রে। এটা তো হয় না। দুটো স্টেটে খেলতে চাইলে পারমিশন দেবে কী করে? বটা বিশ্বাস অসহায়ভাবে সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। সবাই মাথা নেড়ে তাদের অসহায়তাও বুঝিয়ে দিল।
সমীরণ খটকায় পড়ে গেল। সুবোধ ধাড়া যে বললেন বিনু এসে গেছে? কিন্তু উনি তো বাজে কথা বলার লোক নন। ঠিক এই সময়ই বছর বারোর একটি ছেলে ভেতর। থেকে হলঘরের দরজায় এসে বলল, বাবা, চন্দননগর থেকে একজন ফোন। করেছে।
অভয় কুণ্ডু প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। হাত তুলে তাকে নিরস্ত করে বটা বিশ্বাস সোফা থেকে উঠলেন। ব্যস্ত হতে হবে না, আমিই ধরছি।
বটা বিশ্বাস ফোন ধরতে গেলেন। ঘরে সবাই চুপ করে বসে রইলেন। নীরবতা অস্বস্তিকর লাগায় সমীরণ অভয় কুণ্ডুকে বলল, সুখেনদা থাকছেন তো?
সুখেন কর সারথির কোচ। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, দরদি। কথা কম বলেন এবং ডিসিপ্লিন সম্পর্কে নোভাচেকের মতোই কঠোর। গত বছর মাঠে এসেও, শরীর ভাল নেই বলে ট্রেনিংয়ে না নামায় দুলাল চবর্তীকে সাতদিন ট্রেনিং করতে দেননি সুখেন কর। তাই নিয়ে জোট বেঁধে দুলালের নেতৃত্বে কয়েকজন বয়স্ক ফুটবলার ছোটখাটো একটা বিদ্রোহ করে ফেলেছিল। বটা বিশ্বাসের মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ প্রশমিত হয়।
নিশ্চয়। সুখেন কর ছাড়া আর কারও কথা আমরা ভাবছিই না। তবে নির্মাল্যরা। চাইছে হেমন্ত গাঙ্গুলিকে। আরে, যার কোনও কোচিং ডিগ্রি-ডিপ্লোমা নেই সে কিনা সারথির মতো ক্লাবে কোচ হবে! অভয় কুণ্ডু আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলেন।
সমীরণের মনে পড়ল, সুবোেধ ধাড়াও ঠিক একই ভাবে অজয় তালুকদারকে যাত্রীর কোচ করার বিপক্ষে এই যুক্তিটাই দিয়েছিলেন। একই মানসিকতা দুটো ক্লাবে। ডিগ্রি-ডিপ্লোমার প্রতি এত ভক্তি, মডার্ন ফুটবলের জন্য এত ব্যাকুলতা অথচ ক্লাব চালাতে লক্ষ-লক্ষ টাকা দেনা না করে এরা থাকতে পারে না।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কি হায়ার সেকেন্ডারি ফেল-মারা কোনও ছাত্রের পড়ার সুযোগ পাওয়া উচিত? যদি পায় বুঝে নিতে হবে, সে সুযোগ পাচ্ছে খুঁটির জোরে, নিয়মবহির্ভূতভাবে। হেমন্ত সম্পর্কে আমার কোনও অ্যালার্জি নেই। কিন্তু আমাদের তো সারথির স্বার্থের কথাটাই ভাবতে হবে। ও যখন যাত্রীতে খেলত তুই। তখন গড়ের মাঠ চোখে দেখিসনি। তখন সারথিকে একটা ম্যাচে দুগোল দিয়েছিল। আমাদের মেম্বার গ্যালারির দিকে কী অশ্লীল অসভ্য অঙ্গভঙ্গি যে হেমন্ত সেদিন করেছিল তা আজ পনেরো-ষােলো বছর পরও চোখে ভাসছে। ওর পরিচয় তো যাত্রীর ছেলে হিসাবেই, সারথির মেম্বাররা ওকে মোটেই মেনে নেবে না।
মেম্বার চায় ট্রফি। ট্রফি পাইয়ে দিলে কোচ কার ছেলে কার নাতি এসব নিয়ে। কেউ মাথা ঘামাবে না। সমীরণ বিরক্তি চেপে বলল।
এবার পুলকেশবাবু আসরে নামলেন। চাপা গলায়, খুবই গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, বাংলার কোচ হয়ে হেমন্ত সন্তোষ ট্রফি নিয়ে এল মাদ্রাজ থেকে, সে তো স্রেফ চুরি করেই, বাঁকা পথে। এখন এ আই এফ এফ সেক্রেটারি পদ্মনাভন তো মাদ্রাজেরই লোক। সে তো বলেইছে, বাংলাকে এর মাশুল গুনতে হবে। সেই হেমন্তকে সারথির কোচ করলে, তুমি কি ভেবেছ পদ্মনাভন খুব গদগদ হয়ে আমাদের সুনজরে দেখবে?
কার্নাইল, আলবু, বিনুর ক্লিয়ারেন্সে নো অবজেকশন লিখে দেবে? অভয় কুণ্ডুর সংযোজন।
ঘরে ফিরে এলেন বটা বিশ্বাস। ওরা দুজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সমীরণকে একপলক দেখে নিয়ে বটা বিশ্বাস বললেন, না, তেমন কিছু নয়। ওখানে থাকতে একটু অসুবিধে হচ্ছে…কলকাতায় আসতে চায়। হ্যাঁ, ভাল কথা সমীরণ, ঘুনু তোকে যে অফার দিয়েছে, জানি, আমি জানি কত টাকা বলেছে, কিন্তু অত টাকা সারথি তোকে দিতে পারবে না। বটা বিশ্বাস ব্যাঙ্কের চিঠিটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে হাতে রেখে বললেন, গতবারের থেকে বিশ হাজার বেশি দেব।
তার মানে পুরো দেড় লাখ। অভয় কুণ্ডুর সংযোজন।
সমীরণ তখন মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। তার মাথায় ঘুরছে চন্দননগরের ফোন। বিনু জনই করেছে। ধাড়াদা বাজে কথার লোক নন। ওখানে বন্ধুর বাড়িতে তিনিই বিনুকে তুলে রেখেছেন।
তোকে কবে ক্যাম্পে ফিরতে হবে? বটা বিশ্বাস জানতে চাইলেন।
বাইশের মধ্যে কোঝিকোড় ফিরতে হবে।
তা হলে তো আর মাত্র কটা দিন। পুলকেশবাবু ক্যালেন্ডার খুঁজতে লাগলেন। দেয়ালে।
বটাদা, যাত্রী কিন্তু আমায় অনেক বেশি অফার দিয়েছে।
দিক না, দেবী আর রণেনকেও তো দুলাখ আশি হাজার করে অফার দিয়েছে, ওরা তিন লাখ করে চেয়েছে। পতু ঘোষ ভাববার জন্য সময় নিয়েছে। আমি সময় টময় নিইনি। দুজনকেই বলেছি দুলাখ দশ হাজার, অ্যাডভান্স চল্লিশ হাজারের চেক এখুনি দেব। ওরা চেক নিয়ে গেছে।
চেক নিয়ে গেছে? সমীরণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
শুধুই কি নিয়ে গেছে, খবরের কাগজে স্টেটমেন্ট গিয়ে দেবী বলেছে, শত প্রলোভনেও দল ছাড়ছি না, ক্লাব এখন রক্তে মিশে গেছে। হ্যাঁ, ক্লাব যদি অবহেলা করত তা হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছি তাতে আমাদের ক্ষোভ থাকার কথা নয়। আমাদের অনুরোধেই সুখেনদাকে কোচ করা হয়, প্রতি ম্যাচে দল গড়ার সময় আমাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, এবারেও ক্লাব নির্বাচনের ডামাডোলে কর্তারা ব্যস্ত কিন্তু আমাদের অনুরোধ মেনে চল্লিশ হাজার করে ধার চাইতেই বটাদা ধার দিয়ে দিলেন…
মৃদুমন্থর কণ্ঠ পুলকেশবাবুর কথা কেড়ে নিয়ে অভয় কুণ্ডু উচ্চগ্রামে বেগসঞ্চার করে যোগ করলেন, এত গুরুত্ব, এত ভালবাসা আর কোথায় পাব, টাকাটাই তো জীবনের সব নয়, লক্ষ লক্ষ সারথি সমর্থকের ভালবাসার দাম কি টাকায় হয়? অভয় কুণ্ডু নিজেকেই প্রায় হাততালি দিয়ে ফেলছিলেন। সেটা না করে, বটা বিশ্বাসের দিকে আপ্লুত চোখে শুধু তাকালেন।
শুনতে শুনতে নিলু গড়গড়ির বক্তৃতা সমীরণের মনে পড়ছিল। কলকাতার ফুটবল মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গড়গড়ি বলেছিলেন, গত বছর কাগজে পড়ি একজন বড় প্লেয়ার ক্লাবে থেকে যাবে বলে অ্যাডভান্স নিয়ে বলেছিল এই ক্লাবের তাঁবু তার কাছে মন্দিরের মতো কিন্তু তিনদিন পরই সেই ফুটবলার আর এক ক্লাবের এক কর্তার ফ্ল্যাটে গিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে দরাদরি করছে। এটাই হল দুর্গন্ধ।
সমীরণের গা গুলিয়ে উঠল। গত বছরের ওই ফুটবলারটি আর কেউ নয়, দেবী। তার মনে হল, পুরনো এই বাড়ির হলঘরটা যেন একটা মর্গ,শবাগার। এই লোকগুলো এক একটা ডোম। এখান থেকে বেরিয়ে না গেলে সে বমি করে ফেলবে।
যাত্রীকে গিয়ে কিন্তু তুই খেলতে পারবি না। বিরাট ঝগড়া, গোলমাল, কামড়াকামড়ি চলছে, সারা বছরই চলবে। তোর খেলা ও-ক্লাবে গেলে শেষ হয়ে যাবে। টাকা কম দেবে সারথি, তোর দামের থেকে অনেক কম। এখানে কিন্তু নিজের খেলাটা খেলতে পারবি। বটা বিশ্বাস তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। সমীরণ মাথা নিচু করে দ্রুত ভেবে চলেছে। বটা বিশ্বাস ধরে নিলেন, এই নীরবতার অর্থ, সম্মতি।
ওপরের তিনটে ঘরে এখন রয়েছে প্রফুল্ল, মানিক, অরবিন্দ আর সতু। তুই। প্রফুলের ঘরে চলে যা। প্রথম দিন এখান থেকেই সই করতে যাবি। তোকেও অ্যাডভান্স দিচ্ছি চল্লিশ হাজার।
সমীরণ শুনতে শুনতে থ হয়ে গেল। এখানে বন্দি হয়ে থাকতে হবে! ব্যাপারটাই তো লজ্জার, অপমানেরও। সে কি গাধা না গোরু? তাকে বিশ্বাস করে এরা ছেড়ে রাখতে চায় না।
এখানে বাপির ছেলেরা রয়েছে। যাত্রী কোনওরকম হাঙ্গামা হুজুত করতে আসবে না, তা হলেই চেম্বার বেরোবে এটা ওরা জানে। তোফা খাবিদাবি, ঘুমোবি, ভিডিওর সিনেমা দেখবি, পঞ্চাশটা হিন্দি-ইংরেজি মারপিটের ফিল্মের ক্যাসেট রয়েছে, কত দেখবি দেখ না! একদমই বোর লাগবে না। গৃহকর্তা অভয় কুণ্ডু দরাজ স্বরে আতিথ্য গ্রহণের আহ্বান জানালেন।
বটাদা, পিসিমার সঙ্গে কথা না বলে এখন আমি কথা দিতে পারব না।
বটা বিশ্বাসের ভ্রূ কুঁচকে উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। এজন্য তোকে পিসিমার সঙ্গে কথা বলতে হবে?
পুলকেশবাবু বলে উঠলেন, তা কী করে হয়।
অভয় কুণ্ডু বললেন, টেলিফোনে কথা বলে নে।
না, এসব কথা টেলিফোনে হয় না। আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। সমীরণের দৃঢ়স্বর বুঝিয়ে দিল তার সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না।
তা হলে পিসিমার সঙ্গে কথা বলে আয়। অভয়বাবু, বাপিকে ডাকুন একবার, সমীরণকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার সঙ্গে করেই নিয়ে আসুক।বটা বিশ্বাসকে হঠাৎ ক্লান্ত দেখাল।
আজ রাতে আর আসা সম্ভব নয়, কাল সকালে এসে আপনাকে জানাব। সমীরণ উঠে দাঁড়াল।
তা হলে বাপির ছেলেরা সারারাত তোর বাড়ির সামনে পাহারা দেবে। না, না। অন্য কিছু নয়। ওরা সারথিকে যেমন ভালবাসে তেমনই তোকেও। তোর জন্য ওরা। প্রাণ দিতেও পিছপা হবে না, তেমনই প্রাণ নিতেও। তুই সারারাত নিশ্চিন্তে থাকবি! বটা বিশ্বাস সোজা সমীরণের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন শীতল দৃষ্টিতে। সমীরণ চোখ সরিয়ে নিল না। নিরুচ্চার একটা চ্যালেঞ্জ বিনিময় ঘটল।
অভয় কুণ্ডুর অ্যাম্বাসাডরের পেছনের সিটে সমীরণ আর বাপি, ড্রাইভারের পাশে নারান নামে একটি ছেলে। পেছনে একটা ট্যাক্সিতে আরও তিনজন।
সিগারেট বের করার ছলে বাপি বুশশার্ট তুলে প্যান্টে গোঁজা পিস্তলটা বের করে সিটে রাখল।
ওটা দেখাবার দরকার নেই, যথাস্থানে রেখে দাও।
না না, তোমাকে দেখাচ্ছি না। বাপি অপ্রতিভ হয়ে ওটা তুলে নেয়। তোমার জন্য তো নয়, নিজেদের সেফটির জন্য এটা রাখতে হয়।
এর পর সারা পথটাই সমীরণ সিটে হেলান দিয়ে বাঁ হাত কপালের ওপর রেখে চোখ বুজে রইল।
বাপি আর নারান মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছিল কিন্তু সমীরণের কানে তার একটা শব্দও ঢোকেনি।
.
০৭.
মোটর থেকে নেমেই সমীরণ ফটক খুলে ভেতরে এসে ডোর-বেলের বোতাম টিপল। সব জানলায় পরদা টানা, খাবার দালানে শুধু আলো। পেছনে তাকিয়ে দেখল ফটকের সামনে পাঁচজন দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে। সময় দেখার জন্য বারান্দার কিনারে এসে রাস্তার আলোয় বাঁ হাতটা তুলল। আটটা বেজে দুই।
রাস্তা নির্জন। এখন টিভি-তে সিনেমা দেখানো হচ্ছে তাই একেবারেই শুনশান। তাদের দুপাশের বাড়িগুলোর জানলা বন্ধ মশাদের ঢোকা আটকাতে।
আবার সে বেল বাজাল। বাড়িতে কি কেউ নেই? দরজার পাল্লায় কান লাগিয়ে সাড়াশব্দ পাওয়ার চেষ্টা করল। পিসির ঘরে বসে সবাই টিভি দেখতে থাকলে, অন্তত হিন্দি সিনেমার নাচগান কি মারপিটের আওয়াজ তো ভেসে আসবে। তাও আসছে না। টিভি বন্ধ।
হঠাৎ দরজার পাল্লা খুলে গেল। সুনীলবরণ। বাবাকে দেখে সমীরণ হতভম্ব।
কী ব্যাপার, আপনি? ওরা সব গেল কোথায়? একবার পেছনে তাকিয়ে, ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সমীরণ বলল। সব ঘর অন্ধকার, শুধু আলো জ্বলছে খাবার দালানে।
কানু, মলা আর রেখা গেছে অনিরুদ্ধ ভটচাজ মশায়ের বাড়িতে। ভদ্রলোক সাইকেলের ধাক্কায় পা ভেঙেছেন বিকেলে। ওরা দেখতে গেছে। সুনীলবরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন।
সমীরণ দ্রুত ভাবতে শুরু করল। এখন কী করা যায়। কার্যত সে এখন গৃহবন্দি। বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই ওরা তাকে জোর করে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। সকালে ওদের পাহারাতেই বটা বিশ্বাসের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে হবে।
অসম্ভব।
যদি বলি সারথিতে খেলব না, তা হলে জোর করে আটকে রাখতেও পারে। কিন্তু বাইশের মধ্যেই তাকে কোঝিকোড় পৌঁছতে হবে, যেভাবেই হোক। ইন্ডিয়া টিমের জন্য ক্যাম্প তো টানা সারা বছর ধরে চলবে না, প্লেয়ারদের ছেড়ে দেবে। তখন কলকাতায় এসে খেলতেই হবে। সমীরণ দোটানায় পড়ল। খেললে হয় সারথিতে, নয় যাত্রীতে। দুটো ক্লাবের যেটাতেই সে খেলুক, আই এফ এ-তে নাম রেজিস্টার্ড করতেই হবে। সে শুনেছে ক্যাম্পের প্লেয়ারদের অন্য নিয়ম হয়েছে নির্দিষ্ট দিনের পরেও এটা করা যাবে।
সে ঘরে গিয়ে সন্তর্পণে জানলার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। একজনকে দেখতে পেল, রাস্তার ওধারে রঙের ব্যবসায়ী অমিয় চাটুজ্যের ফটকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। বাকি চারজনকে সে দেখতে পেল না। বোধ হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একসঙ্গে সবাই জটলা করলে লোকে সন্দেহ করতে পারে ডাকাত বলে। তবে সমীরণ নিশ্চিত, এখানকার সব লোকই শিক্ষিত, অতএব ডাকাত ধরার চেষ্টা করবে না। সেজন্য একটু সাহস দরকার।
কিন্তু এভাবে কোনও ক্লাবে খেলার কথা এখন সে ভাবতে পারছে না। যদি সকালে ওদের সঙ্গে যেতে সে অস্বীকার করে? সমীরণ বুঝে উঠতে পারছে না, তা হলে কী ঘটনা তখন ঘটতে পারে। শুনেছে বছর ছয়েক আগে নাকি হেদায়েত আলিকে নিয়ে এইরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। যাত্রীতে যেতে চেয়েছিল হেদায়েত, জুপিটার তাকে সুবোধ ধাড়ার পটলডাঙার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছল বোমা ফাটিয়ে। রাস্তার একটা লোক তাইতে মারাও যায়। ধাড়ার একতলাটা তছনছ করে দিয়েছিল।
যদি এরাও তাই করে। সমীরণের মাথার মধ্যে অসাড় হয়ে আসছে। অন্ধকার ঘরে খাটে বসে সে দুহাতে মাথা চেপে ধরল। কেউ তাকে চাপা স্বরে এখন পরামর্শ দিল, পালিয়ে যা, এখান থেকে যেভাবেই হোক, পালিয়ে যা। আজ রাতেই। বটা বিশ্বাসের কথাটা এখন ভীষণভাবে তার মনে পড়ল। তোর জন্য ওরা প্রাণ দিতেও পিছপা হবে না। তেমনই প্রাণ নিতেও। কথাগুলোর মানে খুবই স্পষ্ট।
বাবা, পিসিমা, কানু, মলা এদের আহত রক্তাক্ত দেহ পলকের জন্য তার চোখে ভেসে উঠেই অদৃশ্য হল। সে ফিসফিসিয়ে নিজেকেই বলল, আমার জন্য এরা কেন বিপদে পড়বে? হতে পারে না, তা হয় না। এদের বাদ দিয়ে আমি কেউ নই, আমার কোনও অস্তিত্বই থাকবে না।
সমীরণ খাট থেকে উঠে আবার পরদা সরিয়ে দেখল। একজনও নেই। ব্যাপার কী! ওরা কি চলে গেল? দোতলার ছাদে গিয়ে কি একবার দেখবে? এইসব যখন সে। ভাবছে, তখন ধীর গতিতে কথা বলতে বলতে দুজন বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। একজনকে সে চিনল, নারান।
ওরা তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারারাতই কি ওরা ঘুরবে? সমীরণ ভেবে কূলকিনারা পেল না। সে পায়চারি শুরু করল।
হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। সমীরণ লাফ দিয়ে পরদা সরিয়ে তাকাল। রাস্তা ফাঁকা। টিভি-তে হিন্দি খবর পড়ার শব্দ আসছে। বারান্দায় একটা কোণ দেখা যায় কোনওক্রমে। তার মনে হল পিসিরা বোধ হয় ফিরল।
দ্বিতীয়বার বেল বাজার সঙ্গেই দরজা খুলল সমীরণ। পিসি, মলা আর কানু। দাঁড়িয়ে। প্রথমেই সে তিনজনের পেছনে ফটকের দিকে তাকাল। মনে হল রাস্তায় কেউ একজন সরে গেল।
আর বলিসনি, ভটচাযদার যা কাণ্ড! পায়ের ওপর দিয়ে সাইকেল রিকশার চাকা চলে গেছে! রেখা গুপ্ত হাসি চাপতে চাপতে বললেন।
এমন চেঁচাচ্ছেন যেন পাটা দুখণ্ড হয়ে গেছে। শ্যামলা বলল।
দাদা, তোর কথাবার্তার কতদূর? কত অফার দিল? হিমাদ্রি জানতে চাইল।
বোস সবাই। বিপদ হয়েছে। রাস্তায় কি কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখলে? সমীরণের চাপা স্বর আর উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে তিনজনের মুখের ভাবও বদলে গেল।
কেন, কী বিপদ হয়েছে? রেখা গুপ্তর গলা অজানা ভয়ে কেঁপে গেল।
রাস্তায় দুটো লোক দেখলাম আমাদের পেছন পেছন আসছিল। আর ওই মোড়ে কুকুরওলা বাড়ির কাছে একটা লোক ছিল। তা ছাড়া তো আর কাউকে দেখলাম না! শামলা মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল।
ওই লোকগুলো গুণ্ডা, পাঁচজন রয়েছে, বটা বিশ্বাসের লোক ওরা, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
অ্যাাঁ, কেন?
আস্তে কথা বলো, পিসি। শ্যামলা চাপা ধমক দিল।
ওরা সারারাত আমার ওপর নজরদারি করবে। কাল সকালে আমাকে সঙ্গে করে আবার বটা বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যাবে।
কেন? হিমাদ্রি জানতে চাইল।
আমাকে সারথিতেই খেলতে হবে। ওরা ছাড়বে না। পিসির সঙ্গে কথা বলে কাল সকালে জানাব এই কড়ারে বাড়ি এসেছি। ওরা সঙ্গে এসেছে। পাছে আমি পালিয়ে যাত্রীর ঘরে গিয়ে উঠি, তাই সেটা আটকাবার জন্য ওরা রয়েছে। একজনের কাছে পিস্তল আছে দেখেছি। সমীরণ ধীর নিচু গলায় কথাগুলো বলল। কেউ কোনও কথা বলল না। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং চমকে কথা বলার অবস্থা কারও নেই।
এটা কি মগের মুল্লুক? হিমাদ্রি গজরে উঠল। আমার ইচ্ছেমতো কি কোথাও খেলতে পারব না। ঘাড় ধরে খেলাবে আর আমায় খেলতে হবে?
সমীরণ ভাইয়ের মুখের দিকে শুধু নীরবে তাকিয়ে রইল। রেখা গুপ্ত ব্যাকুলভাবে। বললেন, পুলিশে খবর দিলে হয় না?
পুলিশ কী করবে? সমীরণ বলল।
ওদের অ্যারেস্ট করবে।
কোন অপরাধে?
তোকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে বলে।
প্রমাণ কই যে, ধরে নিয়ে যেতে এসেছে? পুলিশ শুধু তো অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারে না। সমীরণকে হতাশ দেখাল। তা ছাড়া ওরা তোমাদের ওপরও হামলা করতে পারে। আমি যদি এখন পালিয়ে যেতে পারতাম।
আচ্ছা পিসি, তোমাদের জি. সি. দত্ত তো পুলিশ অফিসার ছিলেন, ওঁকে বলে দেখলে হয় না? শ্যামলা বলল।
তিনি কী করবেন? হিমাদ্রি কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যভরে জানতে চাইল।
উনি তো বলেন খোকাগুণ্ডা না কাকে যেন পিস্তল সমেত ধরে ফেলেছিলেন। তা এখানেও তো পিস্তল নিয়ে একজন রয়েছে, তাকে এসে ধরুন না, আর দাদাও বাড়ি থেকে সেই ফাঁকে বেরিয়ে যাবে। শ্যামলা খুব সহজ একটা সমাধান পেশ করে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।
এই রাতে বেরিয়ে কোথায় যাবে? হিমাদ্রি বিশদ হতে চাইল।
কোথাও একটা.এখানেই কারও বাড়িতে। আমতা আমতা করে শ্যামলা বলল।
তারপর? সমীরণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
মলা ঠিকই বলেছে, দত্তবাবু ধরুন বা না-ধরুন, ওদের ভয় তো দেখাতে পারবেন। বলার সঙ্গে সঙ্গেই রেখা গুপ্ত ফোনের কাছে উঠে গেলেন।
পিসি তুমি এদের চেনো না। সমীরণ উঠে এল। এদের ভয় দেখানো দত্তবাবুর কর্ম নয়।
রেখা গুপ্ত ততক্ষণে ডায়ালে পঞ্চাশ সংখ্যাটি ঘুরিয়ে ফেলেছেন। সমীরণ হালছাড়া ভাবে ঘরে এসে পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওদের কাউকে দেখতে পেল না। তার বদলে স্বামী-স্ত্রী আর একটা বাচ্চা ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখল। ছাদে গিয়ে পাঁচিলের আড়াল থেকে কাউকে দেখা যায় যদি, এই ভেবে সে সিড়ির দিকে এগোল। পিসির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনল—তা হলে আর বলছি কী, দারুণ গুপ্তা, আপনি যেমনটি পছন্দ করেন ঠিক সেইরকম।
পিসি বলল পিস্তলও আছে। শ্যামলার ব্যগ্র স্বর।
না, ওসব বললে দত্তবাবু খেপে যেতে পারেন। রিসিভারে হাতচাপা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে পিসিকে বলতে শুনল সমীরণ, সিঁড়িতে ঘোরার সময়।
সুনীলবরণের ঘরের দরজায় পরদা ঝুলছে। সামান্য ফাঁক, তার মধ্যে দিয়ে একনজরে সমীরণ দেখতে পেল টেবিলে ঝুঁকে বাবা কিছু লিখছেন। মোটা দুখানা বই খোলা রয়েছে। সন্তর্পণে দরজা পার হয়ে গুঁড়ি মেরে সে চোখ দুটি শুধু পাঁচিলের কিনারে রাখল।
বাঁ দিক থেকে তিনজন বেড়াবার মতো শ্লথভঙ্গিতে আসছে। দূর থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল, অ্যাই, অ্যাই।
ওরা তিনজন ঘুরে দাঁড়াল। সমীরণ মুখটা একটু তুলে দেখতে পেল, লুঙ্গি আর গেঞ্জিপরা জি. সি. দত্তর দশাসই চেহারাটি বেগিং-এর গতিতে এগিয়ে আসছে।
কে তোমরা, এখানে এত রাতে কী করছ? দত্তর উচ্চ স্বরে দুটো বাড়ির বারান্দায় লোক টেনে আনল, একতলার জানলা খুলিয়ে দিল।
তিনজন কী জবাব দিল সমীরণ তা শুনতে পেল না। দত্ত যে জবাবে একদমই সন্তুষ্ট হননি, সেটা তাঁর আচরণে প্রকাশিত হল। খপ করে তিনি পুলিশি কায়দায় দুজনের জামার কলার ধরলেন।
আমাকে ধোঁকা দেবে? তোমাদের উদ্দেশ্য আমি বুঝিনি ভেবেছ? এত বছর পুলিশে— কথা অসমাপ্ত রেখে জি. সি. দত্ত হঠাৎই কণ্ঠস্বর বদলে, অ্যাই, অ্যাই কী হচ্ছে! বলতে বলতে দুহাতে লুঙ্গি চেপে ধরলেন। তারপরই য্যা-আ-আ ধরনের একটা শব্দ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত মাথার ওপর ওঠালেন। লুঙ্গিটি তখন তাঁর পায়ের গোছে নেমে এল।
জি. সি. দত্ত কাতরকণ্ঠে কী যেন বললেন। বাপির গলা শোনা গেল, তুলে বেঁধে দে।
একজন লুঙ্গিটা তুলে দত্তর কোমরে গ্রন্থিবদ্ধ করে দিল। সমীরণ এইবার দেখতে পেল বাপির হাতের পিস্তলটা। বাপি কিছু একটা বলল। দত্ত দুহাত তোলা অবস্থাতেই ঘুরলেন। এই সময় দোতলার বারান্দাগুলো নিমেষে নির্জন হয়ে গেল, জানলার পাল্লাগুলো ফট ফট শব্দে বন্ধ হল। বাপি ঝুঁকে দত্তর কানে কিছু বলেই পিস্তলের নলটা দিয়ে খোঁচা দিল।
সঙ্গে সঙ্গে জি. সি. দত্ত দুহাত তুলে বাড়িমুখো রওনা হলেন। একটা ব্যাপার সমীরণ বুঝতে পারছে, জি. সি. দত্ত পরোপকারী, আন্তরিক, দরাজ মানুষ, না হলে এইভাবে, ফোন পাওয়ামাত্রই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছুটে আসতেন না। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবের সঙ্গে ওঁর তেমন কোনও যোগ নেই। উনি এখনও খোকাগুণ্ডার আমলেই রয়ে গেছেন, বাপিগুণ্ডাদের সম্মুখীন কখনও হননি।
ডান দিক থেকে দুজন আসছে। সমীরণ মুখটা নামিয়ে নিল। তাদের বাড়ির সামনেই পাঁচজন দাঁড়াল। হাসাহাসি করল। একজন বলল, আরে, এখানে শিক্ষিত লোকেরা থাকে। কেউ ঝামেলা করবে না।
আর-একজন বলল, বাপিদা খিদে পেয়েছে।
বাইরে বড় রাস্তায় দেখেছি তারামা না ফারামা নামে একটা দোকান রয়েছে, তোরা খেয়ে আয়। আচ্ছা, চল, আমিও যাচ্ছি, গোরা তুই তা হলে এখানে থাক। আবার কেউ হুজ্জত করতে এলে কিছু বলবি না, কাটিয়ে বেরিয়ে চলে আসবি। বাপি গলা নামিয়ে কথা বলার দরকার আর বোধ করছে না। প্রতিটি কথা সমীরণ শুনতে পেল।
চারজন মন্থর গতিতে ভি আই পি রোডে মিষ্টির দোকানে খাওয়ার জন্য সুশোভন পল্লির প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেল। সমীরণ ছাদ থেকে নীচে নামার সময় শুনতে পেল টেলিফোনে পিসি কথা বলছে।
বলছেন কী দত্তবাবু?..আপনি দুজনের ঘাড় ধরে…তা হলে ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই?…তা তো হবেই, আপনাকে আর চিনবে না!…হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেন কী, খেলনা পিস্তল!…তাই বলুন, আচ্ছা আচ্ছা।
টেলিফোন রেখে উদ্ভাসিত মুখে রেখা গুপ্ত কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, সমীরণ তাঁকে থামিয়ে বলল, পিসি ঘুনু মিত্তির যে টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে গেল সেটা কোথায়? মলা, তুই টুকে রেখেছিস।
কেন, ঘুনু মিত্তির কী করবে? রেখা গুপ্ত বিভ্রান্ত।
এখন ওর বুদ্ধিটাই দরকার। বাপিদের মোকাবিলা ওকে ছাড়া সম্ভব নয়। সমীরণ টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল।
শ্যামলা ফোন নাম্বার লেখা কাগজটা দিতেই সমীরণ ডায়াল করল।
হ্যালো, এটা কি পতিতপাবন ঘোষের বাড়ি?
হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন? সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন এল।
আমার নাম সমীরণ গুপ্ত, আমি ঘুনুদার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ওধারে কিছুক্ষণ কথা বন্ধ। ফিসফিস করে কাকে তখন বলা হচ্ছে সমীরণ, সমীরণ গুপ্ত!
হ্যালো…।
ঘুনুদা তো এখানে নেই, বাড়িতে চলে গেছেন। আপনার কী দরকার বলুন।
ওঁর বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিন, দরকারটা ওঁকেই বলব।
নাম্বার লিখে নিয়ে ঘুনু মিত্তিরের বাড়িতে সমীরণ ফোন করল। হ্যালো শুনেই সে বুঝতে পারল ঘুনুদা রিসিভার তুলেছেন।
আমি নাকু বলছি।
বল। বটার ছেলেরা তো তোর বাড়িতে গেছে। নিশ্চিন্তে চিবিয়ে চিবিয়ে ঘুনু বললেন।
আমি সারথিতে থাকব না ঠিক করেছি। এখনই আমাকে বের করে নিয়ে যান। কথাকটি বলতে গিয়ে সমীরণের হাঁফ ধরল। টানটান হল হাতের পেশি। বুকের কাছে চিনচিন করে উঠল। তিন বছরের সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে কষ্ট তো হবেই। কিন্তু এখন দুঃখে মুহ্যমান হওয়ার সময় নেই।
ঘুনু কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন কথাগুলো মগজের ভেতর-দেশে চালানোর জন্য। চমকে উঠলেন না, উল্লসিত হলেন না, ধীর শান্ত গলায় বললেন, এখন তোর পজিশনটা কী?
বাড়িতে বন্দি। রাস্তায় পাঁচজন ঘোরাফেরা করছে। একজনের কাছে চেম্বার আছে।
অ। গোলমালের মধ্যে গিয়ে কোনও লাভ নেই। তুই যে-কোনওভাবেই হোক, আজ রাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবি? আমি গাড়ি নিয়ে থাকব কোথাও। এসব কাজে দেরি করতে নেই।
বেরোনো? সমীরণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, ছাদ থেকে বাড়ির পেছনদিকে নেমে একটা মাঠ, ইলেকট্রিকের মাঠ।
আলোটালো নেই তো? অন্ধকার তো?
একদম ঘুটঘুটে।
এখন আর বেশি কথা নয়। আমি ওই মাঠের ধারে, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব, ঠিক দুটোয়।
আপনি চিনে আসতে পারবেন মাঠে?
আরে, আমি ঘুনু মিত্তির। তারামা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গা দিয়ে শহিদ কলোনির দিকে যাওয়ার রাস্তা, মাঠটা তো তার ওপরই! বরেন মুখখাটি ওই মাঠেই ট্রেনিং করায় না?
হ্যাঁ।
হুঁ হুঁ বাবা, এ হল ঘুনু মিত্তিরের মেমারি। শোন, ঠিক দুটোয় নেমে আসবি। ছেলেগুলো তখন কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে আগে সেটা দেখে নিবি। ছাড়ছি। ঠিক দুটোয়।
তিনজন হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে। সমীরণ ব্যস্ত হয়ে বলল, ব্যাগটা কোথায়? শার্ট, প্যান্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, শেভিংকিট…পিসি হাজার তিনেক টাকা কাল কানুকে দিয়ে আমার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে রাখবে। কানু, একুশ তারিখের কোঝিকোড়ের টিকিট, ভায়া বোম্বে, একদিনেই তা হলে পৌঁছতে পারব। না পেলে বাঙ্গালোরের, ওখান থেকে ঘণ্টা দশেকের বাস-জার্নি। ঘুনুদা ঠিক দুটোয় ইলেকট্রিক মাঠের ঘরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। আমি ছাদ থেকে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠব।
উঠে কোথায় যাবি? উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন রেখা গুপ্তর।
জানি না।
সমীরণ ঘরে ঢুকে গেল। আলো জ্বালবে কি জ্বালবে না ভাবতে ভাবতে জ্বেলেই ফেলল। জানলার পরদা সরিয়ে দিয়ে কাঁধে ঝোলানোর পলিথিন ট্রাভেলিং ব্যাগটা আলনা থেকে নামাল। রাস্তা থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে। স্লিপিং সুট ব্যাগ থেকে বের করে নাড়াচাড়া করল। সে যে এখন ঘুমোতে যাচ্ছে, এটা যেন ওরা বুঝে যায়। আলো নিভিয়ে ডোরাকাটা পাজামা আর ঢিলে জামাটা পরে নিয়ে আবার আলো জ্বালাল। এইসব করার সময় সে একবারও বাইরের দিকে তাকাল না। শ্যামলাকে ডেকে এক গ্লাস জল চাইল। জল খেয়ে গ্লাসটা ওর হাতে দেওয়ার সময় সে বলল, তোরা খেতে বোস টেবিলে, আমারটা এখানে দিয়ে যা, ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাব, শোব, তুই মশারিটা ফেলে গুঁজে দিবি, আলো নেভাবি। সব যেন নর্মাল ভাবে হয়। আর শোন, ছাদ থেকে নামার জন্য একটা শাড়ি কি বেডকভার ঠিক করে রাখা ঠিক দেড়টায়, সারা বাড়ি যেন অন্ধকার থাকে।