দম্পতি, দম্পতী
দম্পতি বানানে হ্রস্ব ই-কার এবং দীর্ঘ ঈ-কার দুই-ই চলে। একবার এক বাংলার মাস্টারমশাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এর মধ্যে কোন বানানটা বেশি ঠিক বা বেশি শুদ্ধ। তিনি বলেছিলেন, দুটোই শুদ্ধ, দুটোই ঠিক আছে; যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা জমজমাট, প্রগাঢ় তখন অবশ্যি দম্পতি বানানের শেষে দীর্ঘ-ঈ দিতে হবে আর যখন ক্ষীণ হয়ে আসবে সেই ভালবাসা, প্রেম যখন সংকীর্ণ তখন নিতান্ত হ্রস্ব-ই-তেই চলবে। প্রথমে হ্রস্ব-ই-কারের একটি প্রান্তিক কাহিনী বলে নিই। কলকাতার উপকণ্ঠে তিলজলা উপনগরীর এক ভদ্রলোক ওই অঞ্চলেই অবস্থিত সরকারি মানসিক চিকিৎসালয় লুম্বিনি উদ্যানে একদিন সকালে জানতে গিয়েছিলেন যে উদ্যানের পাগলাগারদ থেকে দু’-একদিনের মধ্যে কোনও উন্মাদ পালিয়ে গেছে কি না। উন্মাদাগারের লোকদের প্রকৃত পাগলাদের কাছ থেকে নানা রকম উলটোপালটা প্রশ্ন, যুক্তি, বিশ্লেষণ শোনার নিয়মিত অভ্যাস থাকে, সে তাদের পরিচিত রোগীদের ব্যাপার। কিন্তু বাইরের কোনও ভদ্রলোক যাকে আপাত প্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে তাঁর কাছ থেকে এইরকম প্রশ্ন পেয়ে পাগলাগারদের কর্তৃপক্ষ একটু অবাক হলেন এবং জানতে চাইলেন, কেন এই ভদ্রলোক খোঁজ করছেন দু’-একদিনের মধ্যে কোনও পাগল পালিয়েছে কি না?
তখন সেই জিজ্ঞাসু ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখুন, আজ দু’দিন হল আমার স্ত্রীকে বাড়িতে দেখতে পাচ্ছি না। পাড়ায় কানাঘুষো শুনছি সে নাকি কার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তাই আপনাদের এখানে জানতে এসেছি, এখান থেকে কোনও পাগল পালিয়েছে কি না?’ উন্মাদাগার কর্তৃপক্ষ কিছু বুঝতে না পেরে বিব্রত বোধ করে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানে?’ ভদ্রলোক ম্লান হেসে বললেন, ‘মানে আর কী? পাগল ছাড়া কে আর আমার বউকে নিয়ে পালাবে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না?’
সংস্কৃতে একটা কী যেন কথা আছে, ‘গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’ কালিদাস নামে এক সরল প্রকৃতির কবি বোধ হয় অনন্তকাল আগে এ রকম কথা বলেছিলেন। কথাটার ব্যঞ্জনা একটু গভীর, গৃহিণী মানেই গৃহ, ঘরসংসার, স্বামীর চেয়ে সংসারে স্ত্রী কিছু কম নন, এই কথাটা বলারই অভিপ্রায় ছিল মহাকবির। সরল বাংলায় গৃহিণী গৃহমুচ্যতের অনুবাদ করেছিলেন এক বাঙালি গৃহস্থ, গৃহিণী গৃহ মুছছে অর্থাৎ বউ ঘর মুছছে, মুছবে।
অবশ্য এর চেয়ে অনেক বিপজ্জনক হলেন পুরনো দিনের ইংরেজি কবি জন ড্রাইডেন। ড্রাইডেন লিখেছিলেন তাঁর সহধর্মিণীর সম্ভাব্য এপিটাফ, স্ত্রীর কবরের উপরে মর্মর ফলকে লেখা থাকবে এই দুই পঙক্তি :
‘এইখানে শায়িত আমার স্ত্রী, থাকুন তিনি শান্তিতে,
আর আমিও থাকি, আমিও থাকি শান্তিতে।’
অবশ্য প্রথমা মৃত অবস্থায় শান্তিতে থাকছেন বলেই দ্বিতীয় জন অর্থাৎ স্বামী দেবতা জীবনে শান্তি পাচ্ছেন।
যা হোক, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার নিয়ে তুচ্ছ রসিকতা থেকে বৃহৎ বিশ্লেষণ—সমস্ত ভাষায়, সাহিত্যে, হাজার হাজার তার উদাহরণ। বর বড় না কনে বড়, বিয়েবাড়ির বাসরঘরে এ নিয়ে ঠানদিদিদের রসিকতা আজও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে একথা বলা যায় না।
ইতিপূর্বে স্বামী-স্ত্রীর কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে এই কলমে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার এক বন্ধুপত্নী তথা বান্ধবী অনুযোগ করেছেন সেটা নাকি ছিল বড়ই পরুষঘেঁষা, পক্ষপাতদুষ্ট। এবার আমার চেষ্টা হবে এই পক্ষপাতের অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়া।
সুতরাং আমি সেই গল্পটা কিছুতেই বলতে পারব না যেখানে ক্লান্ত ও অসুস্থ স্বামীর ডাক্তারি পরীক্ষার পর ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ‘বেশ কিছুদিনের জন্যে সম্পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন,’ এবং তারপরে একটি কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন স্ত্রীকে সেটা নিয়মিত খেতে কারণ স্ত্রীর স্নায়ুশান্তি না হলে স্বামীর বিশ্রাম হবে না। আরেকটা গল্প আছে ওই অসুস্থ স্বামীকে ডাক্তার দেখানো নিয়েই যেখানে ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ রোগীকে নানারকম প্রশ্ন-টশ্ন জিজ্ঞাসা করে অবশেষে বুঝতে পারেন যে স্বামী বেচারা বাকশক্তিরহিত, একেবারেই কথা বলতে পারে না। স্ত্রী তো একথা শুনে হতভম্ব, ‘সে কী?’ সে মহিলা দিনরাত নিজের কথার তোড়ে খেয়ালই রাখেননি পতিদেবতা কবে থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
এসব গল্প থাক। পথপ্রান্তে শোনা একটি নরম কথোপকথন উদ্ধৃত করছি :
‘কাল রাতে তোমাকে যে অতি সুন্দরী মহিলার সঙ্গে দেখলাম, মহিলাটি কে?’
‘বলতে পারি। কিন্তু প্রতিজ্ঞা কর, আমার স্ত্রীকে কখনও বলবে না।’
‘কী করে বলব, আমি তো তোমার স্ত্রীকে চিনিই না।’
‘যদি কখনও পরিচয় হয় তা হলেও বলবে না।’
‘না বলব না। নিশ্চিতভাবে তুমি আমাকে জানাতে পার ওই মহিলাটি কে?’
‘ওই মহিলাটিই আমার স্ত্রী।’
সকলের স্ত্রী অবশ্য এত সুন্দরী হয় না। সুন্দরী স্ত্রী নাকি জন্ম-জন্মান্তের ভাগ্যের ব্যাপার। সহস্র বর্ষের শুধু সাধনার ধন নয়, সহস্র বর্ষের ভাগ্যের ধনও সুন্দরী ভার্যা।
(এ বিষয়ে অধিক আলোচনায় যাওয়া আমার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, স্বগৃহে প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তার চেয়ে মানে মানে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া নিশ্চয় নিরাপদ।)
সেই এক বিরহতাড়িত স্বামী দূরপ্রবাসে এক সকালবেলায় চায়ের দোকানে গিয়েছিলেন, সেখানে চায়ের দোকানদারকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ভাই, বেশ ঠান্ডা এক কাপ চা দাও, চিনি বেশি, দুটো কালো পিঁপড়ে আর দুধের সর যেন পেয়ালায় ভাসে। সঙ্গে দাও দুটো মিয়ানো বিস্কুট। আর তোমার ওই উনুনের পেছনে যে মোটা মেয়েটি কয়লা ভাঙছে তাকে একটা ছেঁড়া বাজারের ব্যাগ আমার মুখে ছুড়ে দিতে বলো। আমার বড় বাড়ির কথা, বউ-এর কথা মনে পড়ছে। আমি হোম-সিক, মন হু হু করছে। এটুকু এই বিদেশি মেহমানের জন্যে দয়া করে করো।’
এই ভদ্রলোককে আমরা কি স্ত্রৈণ বলব? নাকি তাঁর স্ত্রীর প্রতি মমতাপরায়ণ হব? অথবা সত্যিই মমতাপরায়ণ হতে পারি সেই কৃপণ ও সাংঘাতিক হিসেবি যুবকের নববিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি, যে যুবক বিয়ের পর পয়সা সাশ্রয় করার জন্যে স্ত্রীকে ফেলে রেখে নিজে একাই মধুচন্দ্র অর্থাৎ হানিমুন যাপন করতে গিয়েছিলেন।
আর অবশ্যই মমতা দেখাব সেই মার্কিন সাহেবকে যাঁর স্ত্রী প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর স্বামী কাজ থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্বামীর কোটে জামায়, অন্য রমণীর কেশ সংগ্রহ করতেন। সোনালি পিঙ্গল বা কৃষ্ণবর্ণের দীর্ঘ কেশ যদি সেই মহিলা কোনওদিন আবিষ্কার করতে পারতেন স্বামীর পরিচ্ছদে তা হলে স্বভাবতই উত্তেজিত হতেন। তবে যেসব দিন অনেক খুঁজেও কোনও পররমণীর সন্দেহজনক কেশই উদ্ধার করতে পারতেন না, সেদিন অধিকতর উত্তেজিত হয়ে স্বামীকে গালাগাল করতেন, ‘ছিঃ, ছিঃ, তোমার এত অধঃপতন হয়েছে, তোমার রুচি এত নেমে গেছে! সারাদিন একটা টেকো ন্যাড়া মেয়েছেলের সঙ্গে কাটিয়ে এলে।’
অনেক স্ত্রী স্বামীর উপর রাগ করে পিত্রালয়ে বা অন্যত্র চলে যান। গিয়ে বুঝতে পারেন এর ফলে তাঁর বর অনেক শান্তিতে বসবাস করা আরম্ভ করেছে এবং তখন সেটা সহ্য করতে না পেরে আবার ফিরে আসেন। যারা ভাবে রাগ কমে গেছে, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে অথবা স্বামী- সংসারের প্রতি মায়াবশত ফিরে এসেছে তারা স্ত্রী-মনস্তত্ত্বের কিছুই জানে না।
ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, সহধর্মিণী হলেন যৌবনের প্রেমিকা, মধ্যজীবনের সঙ্গিনী আর বার্ধক্যের সেবিকা। এদিকে অস্কার ওয়াইল্ড স্ত্রীদের সমবেদনা জানিয়ে বলেছিলেন, যে কোনও মহিলার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল, তার অতীত হল তার প্রেমিকের আর তার ভবিষ্যৎ হল তার স্বামীর।
আমরা এত গোলমেলে কথার কচকচিতে নেই। দাম্পত্য প্রেম সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ ভাষণ শুনেছিলাম, আমাদেরই এই শহরের এক ক্লাবের ঝুল বারান্দায়। এক অশ্রুময়ী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বারান্দার এক কোণে অন্ধকারে, দাঁড়িয়ে স্বামীকে অভিযোগ করছিলেন, ‘তুমি এখনও বলছ আমাকে ভালবাস? যদি সত্যিসত্যিই আমাকে ভালবাস, তবে তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন?’
কিপলিং, ভারতরত্ন রুডইয়ার্ড কিপলিং, গদ্যে-পদ্যে অনেক উলটোপালটা গোলমেলে কথা বলেছেন, তবে বিয়ে করার বিষয়ে একদা একটা মারাত্মক কথা বলেছিলেন, ‘He travels the fastest who travels alone,’ অর্থাৎ ‘একলা চলো রে’, যে একলা যাবে সেই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যাবে।
এই একলা-দোকলার ব্যাপারে বেশ বড় সমস্যা সিনেমা-থিয়েটার-রেস্টুরেন্টগুলির। দম্পতির জন্য সেখানে পাশাপাশি জোড়া চেয়ার, জোড়া আসন চাই। প্যারিসের একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে দম্পতির জন্যে একটা অদ্ভুত বন্দোবস্ত আছে। না, কোনও আলাদা ছোট খুপচি অন্ধকার কেবিন বা ঘর নয়, যেমন এই শহরে বা যে কোনও শহরেই কোনও কোনও দোকানে আছে। প্যারিসের রেস্টুরেন্টটির আয়োজন খুব মজার এবং স্বামীর পক্ষে তৃপ্তিদায়ক ও সম্মানজনক। রেস্টুরেন্টে চেয়ারে বসার পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনের হাতে তারা দুটি একই রকম দেখতে মেনু ধরিয়ে দেয়। কিন্তু স্ত্রীর মেনুটিতে সব বাড়ানো, ফাঁপানো মারাত্মক দাম। আর যা আসল দাম, দোকানের যা প্রকৃত মেনু বা খাদ্যমূল্যতালিকা সেটা ধরিয়ে দেওয়া হয় স্বামীকে। মানে সহধর্মিণী যখন ভাবছেন তিনি আটাশ টাকা দামের চিলি চিকেন খাচ্ছেন স্বামীর মেনু ও দোকানের বিল অনুযায়ী তার প্রকৃত দাম সাড়ে বারো টাকা মাত্র।
স্বামীদের চিরদিনের চেষ্টা স্ত্রীকে ঠকানো। এইরকম রেস্টুরেন্টে দোকানদারের সহায়তায় বিনা চেষ্টায় স্ত্রীকে ঠকিয়ে তাঁরা নিশ্চয়ই আত্মসুখ বোধ করেন। তবে সুখের কথা পৃথিবীর সব স্বামী একরকম নয়।
অনেকদিন আগে উঠে যাওয়া ধর্মতলা স্ট্রিটের একদা বিখ্যাত ও জমজমাট কমলালয় স্টোর্সে একদিন শেষ রাতে এক চোর ধরা পড়েছিলেন। পুলিশের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায় তস্কর ব্যক্তিটি ওই রাতে চারবার পরপর কমলালয় স্টোর্সের পেছনের জানলার গরাদ ভেঙে ঢোকেন এবং তাঁর স্ত্রীর জন্যে একে একে চারবার পর পর চারটি ভাল শাড়ি চুরি করে আনেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তস্করপ্রিয়ার কোনওটাই পছন্দ হয় না। কোনওটার পাড় বড় বেশি চওড়া, সেকেলে, আবার কোনওটা বড়দির ননদের একটা শাড়ির মতো অবিকল; যে শাড়িটা কিছুটা পছন্দ হয়েছিল তার রং বড় বেশি পানসে, ট্যালটেলে। তস্কর বেচারা আর দশজন পুরুষমানুষের মতোই শাড়ির এত রকমসকম মোটেই বোঝে না। সুতরাং চতুর্থবারের পর পঞ্চমবার যখন তিনি শাড়ি পালটাতে ঢুকতে যাচ্ছেন, তখন কাক-ডাকা শুরু হয়ে গেছে; ফাস্ট ট্রাম ধর্মতলা স্ট্রিটে ঘটাং ঘটাং চলছে গঙ্গাযাত্রীদের নিয়ে, আর এই মহানগরীর অধুনা অবলুপ্ত ফরাসেরা হাইড্রান্ট থেকে পাইপ দিয়ে জল তুলে রাস্তা ধুচ্ছে। এই পঞ্চমবারে প্রবেশের মুখে প্রায় প্রকাশ্য দিবালোকে তস্কর স্বামী সদ্যনিদ্রোত্থিত ভোজপুরী দারোয়ানের হাতে ধরা পড়ে যান।
তবে এর চেয়েও মর্মান্তিক কাহিনী অন্য এক দম্পতির। এই দম্পতির স্বামী-স্ত্রীর উভয়েরই পূর্ব বিবাহ ছিল। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তাদের বর্তমান বিবাহ সংঘটিত হয়। এদিকে ভদ্রমহিলার আগের এক পুত্র, ভদ্রলোকের আগের স্ত্রীর এক পুত্র। এই দুই পুত্রই আলোচ্য দম্পতির সঙ্গে থাকে। ইতিমধ্যে বিধির বিধানে এই স্বামী-স্ত্রীরও একটি পুত্র হল। আগের দুই পক্ষের দুই পুত্র কিন্তু তাদের অর্ধভ্রাতা অর্থাৎ এই নবাগত তৃতীয়টিকে দু’চোখে দেখতে পারে না। এই পরিবার আমাদের পুরনো পাড়ার শেষপ্রান্তে একটা একতলা বাড়িতে থাকতেন। বিয়ের বছর পাঁচ-সাত পর থেকে এই বাড়ি থেকে অনবরত গৃহিণীর আর্ত আবেদন শোনা যেত স্বামীর উদ্দেশে, ‘ওগো তাড়াতাড়ি এসো। এদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল। তোমার ছেলে আর আমার ছেলে দু’জনে মিলে আমাদের ছেলেকে মেরে ফেললে।’
মজার কথা যথেষ্ট হল, এবার অন্তত একটা গুরুগম্ভীর কথা না বললে সুধী পাঠক কলকে দেবেন না। আর বলবই যদি সামান্য বলব কেন? ইউরোপীয় প্রবন্ধ সাহিত্যের জনক যাঁকে বলা হয়, সেই ফরাসি গদ্যকার যার ছায়ায় ইংরেজি গদ্য অনেকখানি লালিত, সেই মাইকেল ইকুয়েম দ্য মনটেইন (অথবা মিলেল মতে অথবা মনটে, অথবা মনটেগ, অথবা ইত্যাদি ইত্যাদি, ফরাসিবিদরা নিজগুণে মুখ কলমকারকে ক্ষমা করবেন) যা লিখেছিলেন আদর্শ দম্পতি সম্পর্কে সেকথাটা বলা যাক। কথাটা ভদ্রলোক কিন্তু আজকে বা গতকাল বলেননি, বলেছিলেন চারশো বছর আগে। এই সুপ্রাচীন ফরাসি সাহেবের মতে আদর্শ দম্পতি হল সেই পরিবার যেখানে স্ত্রী অন্ধ এবং স্বামী কালা। স্বামী যা করছে স্ত্রী দেখতে পাবে না, স্ত্রী যা বলছে স্বামী শুনতে পাবে না, তা হলেই সংসার সুখের হবে।
এককালে পানের দোকানে দোকানে কাচের মধ্যে লেখা থাকত, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।’ সেসব রোমান্টিক পানের দোকান, সেই সব রঙিন কাচ আর সেইসব সুখপ্রদ রমণীরা যাদের মুখচ্ছবি ফুটে থাকত প্রস্ফুটিত রক্তপদ্মের মাঝখানে; তারা কোথায় গেল, কবে গেল?
কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের এক গ্রাম সম্পর্কের আত্মীয় মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম সত্যিই শেষ নিশ্বাসের অপেক্ষায় রয়েছেন, তবে জ্ঞান রয়েছে টনটনে। বিছানার পাশেই বসে রয়েছেন তাঁর পঞ্চাশ বছরের সঙ্গিনী সতীসাধ্বী স্ত্রী। আমাকে দেখে আমার সেই গ্রামদাদার মুখ একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন, ‘তুমি এসে ভাল করেছ, মৃত্যুর আগে তোমাকে দু’-চারটে কথা জানিয়ে যেতে চাই। দ্যাখো পশ্চিমবাড়ির নগেনের কাছে আজ প্রায় চার বছর হল তিনশো টাকা পাই। কিছুতেই দেয়নি, আমার মৃত্যুর পর অন্তত যাতে তোমার বউদিকে টাকাটা দেয়, তুমি একটু দেখো। আর সামনের ঘরের ভাড়াটে দু’মাস ভাড়া দেয়নি।…’ এইভাবে তিনি বিশদভাবে বলে যেতে লাগলেন কোথায় তাঁর কী পাওনাগণ্ডা আছে তার কথা। মধ্যে মধ্যেই তাঁর স্ত্রী স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, ‘সত্যি দ্যাখো ভাই, তোমার দাদার কী বিচক্ষণ বুদ্ধি। সব কথা মনে রেখেছেন, শরীরের এই অবস্থাতেও খুঁটিনাটি কিছু ভোলেননি।’ কিন্তু ইতিমধ্যে আমার সেই গ্রামদাদা তাঁর মৌখিক হিসাবপত্রের ডান কলমে চলে গেছেন, সেখানে দায়দেনার কথা। তিনি সবে বলতে আরম্ভ করেছেন, ‘আর শোনো, আমার পিসতুতো ভাই গজেন আমার কাছে সাতশো টাকা পাবে, মাকালী ফার্নিচার পাবে বাইরের বারান্দার দুটো নতুন চেয়ারের দাম… ’ কিন্তু তিনি তাঁর বিবরণ সমাপ্ত করতে পারলেন না, আমার গ্রামবউদিদি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘ওগো কী আবোলতালোল বকছ গো, ও ভাই, তোমার দাদার বুঝি শেষ অবস্থা, এ যে প্রলাপ বকা শুরু করেছে!’
এই দাম্পত্য কাহিনীর শেষ মুহূর্তে অত্যন্ত বিনীতভাবে একটি ব্যক্তিগত কাহিনীও গোপনে, পাঠিকাদের নিবেদন করছি। কোনও একটি নিভৃত কারণে আমার প্রাণাধিকা গৃহিণীকে আমি একটি ভাল সেন্ট, যাকে অধুনা পারফিউম বলে, দেব বলে আজ কিছুদিন কথা দিয়েছি। গন্ধদ্রব্য বিষয়ে আমার অজ্ঞতা অপরিসীম। তা ছাড়া শিশি বা মোড়ক দেখে সেন্টের সুবাস অনুমান করা অসম্ভব। এর মধ্যে একদিন মিনিবাসে এক সুবেশা তরুণী যাচ্ছিলেন, ঠিক আমার পাশে বসে। তাঁর সর্বাঙ্গের বিদেশি কুসুমের মৃদু গন্ধ আমাকে সচেতন করে তুলল। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘দেখুন কিছু মনে করবেন না, আমার স্ত্রীর জন্যে একটা পারফিউম কিনতে হবে। আপনার পারফিউমের সৌরভটা বড় ভাল, দয়া করে ব্র্যান্ডটা যদি বলেন।’ তরুণীটি চাপা হেসে বললেন, ‘না, না, এ সেন্ট স্ত্রীকে কিনে দেবেন না। রাস্তাঘাটে যত আজেবাজে লোক তা হলে জানতে চাইবে কী সেন্ট, কত দাম? কোথায় পাওয়া যায়? মিছে হয়রানি করবে। গায়ে পড়ে কথা বলবে।’