রবিদার গ্লানির কথা
১৬.
বড়দির জন্যে রবিদার গ্লানির কথাটি যে হঠাৎ এসেছে সুমিতার মনের অন্ধকার ছাপিয়ে, তাতে ও নিজে অবাক হয়নি একটুও।
স্পষ্ট মনে পড়ছে রবিদার প্রতিটি কথা, প্রতিটি চাহনি, নিয়ত হাসি, যাওয়া আসা আর বড় বিচিত্র করুণভাবে বাবার মুখোমুখি নীরবে বসে থাকা।
জীবনের কূলে কূলে যখন চোরা বান আসে, তখন জীবন নিজেও জানতে পারে না, কত দূর উঠেছে সে ছাপিয়ে। সুমিতাও জানে না, বড়দিকে নিয়ে ওর চিন্তা ছাপিয়ে উঠেছে কতখানি।
ছায়া আসতে লাগল ঘনিয়ে। বেলা পড়ো পড়ো হয়েছে। সুমিতা উপুড় হয়ে পড়ে রইল খাটে। ঘর থেকে ছুটে যাওয়ার নিজের পাগলামিটা আজ পেয়ে বসেনি। তাপসী আজ মনের আর একটা দরজা খুলে দিয়ে গেছে মুখের ওপর। শুধু সেই কথাগুলিই চারদিক থেকে ঘিরে রাখল ওকে। সোসাইটি, প্রেস্টিজ, পজিশন, সিকিউরিটি আর ভয়ংকর রকমের হ্যাপিনেস।
যত বড় অপমানই হোক, তবু সবটা যেন আজ ধরা পড়ে গেল সুমিতার চোখে। কোন পথে যে রেহাই আছে, সেই বোবা ভাবনায় কান্না পেতে লাগল ওর।
বিলাস বলল দরজার বাইরে থেকে, ছোট দিদিমণি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
চমকে উঠল সুমিতা। তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালিয়ে বড়দির ঘরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আলুথালু বেশ, চুল বাঁধাও হয়নি। মহীতোষ এসে দেখলে ভীষণ অবাক হবেন। জানে সুমিতা, শুধু অবাক নন, যে রকম ভীরু মানুষ, হঠাৎ চিন্তিত হয়ে পড়বেন।
ফিরতে গিয়ে দাঁড়াল আবার সুমিতা। যেন তীক্ষ্ণ চোখে, আয়নাতে তাকাল আর একজনের দিকে। তাপসীর ধামসানিতে জামাটি বিস্রস্ত হয়ে গেছে একেবারে। এই আলুথালু বেশে নিজেকে দেখে যত ওর লজ্জা করতে লাগল, ততই মনে হতে লাগল, ওর গা হাত পা, সমস্ত শরীরটি আশ্চর্য সুন্দর। বিচিত্র রূপ ওর চোখে মুখে। নিজেকে অনেকখানি বড় মনে হতে লাগল। তারপর মনে হল, সত্যি, ও যেন অবিকল বড়দির মতোই দেখতে।
ভ্রূ কাঁপিয়ে, কেমন একটু যেন ভীত হেসে, নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করল, আমার জীবনও কি বড়দির মতোই হবে?
কিন্তু সমস্ত আয়নাটা জুড়ে নিজের অবয়বটাই একটা নিষ্ঠুর বোবা মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল সুমিতার দিকে। পরমুহূর্তে নিজের প্রতিই যেন বিরক্ত হয়ে, তরতর করে চলে গেল বাথরুমে।
মহীতোষ যখন এলেন, তখন সুমিতা পুরো ফিটফাট। কিছুই বলাবলি হল না। শুধু মহীতোষ সপ্রশংস দৃষ্টিতে সুমিতার সাজটুকু বোধ হয় দেখলেন। তারপর তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে, খাবার টেবিলে এসে বসলেন। সুমিতা চা ঢেলে নিল কাপে।
মহীতোষ আজ এতক্ষণ পরে বললেন, রবি আসেনি আজও?
সহসা সুমিতার দৃষ্টি নত হল। বলল, না। আর বোধ হয় আসবেন না।
অবাক হয়ে বললেন মহীতোষ, কেমন করে জানলে?
মুখ নামিয়ে রেখেই জবাব দিল সুমিতা, আসেন না দেখে বলছি।
কিন্তু আশ্চর্য! বাবার প্রতি হঠাৎ অভিমানে কান্না পেতে লাগল সুমিতার। মনে হল, রবিদাকে বিমুখ শুধু বড়দি করেননি। বাবাও করেছেন। উনি কি কিছুই জানতেন না?
কিন্তু মহীতোষের মোটা ভ্রূ দুটি কুঁচকে উঠল বিস্ময়ে। বললেন কী হয়েছে রুমনো সাহেবা?
সেটা ঠিক সুমিতা নিজেও বোধ হয় জানত না। মনের তলে তলে, কথাগুলি যে শেষ পর্যন্ত এত সেজেগুজে, হেসে, চা খেতে বসে, হু হু করে ছুটে আসবে, ভাবতে পারেনি একেবারে। বলল, বড়দি নিশ্চয় রবিদাকে কিছু বলেছে, তাই আর আসেন না।
সে কথা জানতেন মহীতোষ। তাতে তিনি বিস্মিত হননি। কিন্তু বিস্ময় কাটল না ওঁর সুমিতাকে দেখে। তখনও তাকিয়ে রইলেন একইভাবে।
সুমিতা একটুখানি সময় সাহস সঞ্চয় করে আবার বলল, তুমি তো জান বাবা, বড়দি কিছু বললে, সবচেয়ে বেশি রবিদার বাজবে।
মুহূর্তে কী ঘটে গেল। মহীতোষ চায়ের কাপ নামিয়ে, খানিকক্ষণ অপলক অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে রইলেন সুমিতার দিকে। আজকাল রুমনো সাহেবার অনেক কথা শুনেই এমনি করে তাকাতে হয়। বললেন, তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে নাকি এ সম্পর্কে?
–কোন সম্পর্কে?
–রবি আর উমনোর?
–না।
তবে?
–আমি বুঝি বাবা।
বলে বাবার দিকে এক মুহূর্ত চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিল সুমিতা।
মহীতোষের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বললেন, কী বোঝ রুমনো সাহেবা?
বাবার গম্ভীর স্বরে একটু যে ভয় না হল তা নয়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি মুখ আরক্ত হল লজ্জায়। একটু চুপ করে থেকে বলল, রবিদার নিশ্চয় অনেক কষ্ট হয় বাবা।
কীসের কষ্ট, কেন কষ্ট, না বললেও মহীতোষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল সব। কয়েক মুহূর্ত কিছুতেই কথা বলতে পারলেন না। কেবলি মনে হতে লাগল, ছোট মেয়ে রুমনিও যেন ওঁরই পিতৃত্বের প্রতি রুষ্ট কটাক্ষ করছে। নইলে রবির কষ্টের কথা কেন সুমিতাকে বলতে হবে। বললেন, চলো রুমনো, আমরা বারান্দায় যাই।
দুজনে বারান্দায় এলেন। রাস্তায় আলো জ্বলছে। তোক চলাচল করছে। তবুসবই কেমন শান্ত, স্তব্ধ মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে, ভিতরের বারান্দার দিকে, সন্ধ্যাবেলায় কলকাতাকে অদ্ভুত নীরব বিষণ্ণ মনে হয়।
সুমিতা মহীতোষের কাছ ঘেঁষে বলল, বাবা তুমি রাগ করলে?
মহীতোষনা, রাগ করিনি। তুমি ঠিকই বলেছ।
মহীতোষ আবার বললেন, কিন্তু আমার কোনও দোষ নেই তাতে রুমনো সাহেবা। রবি অনেক বড়, মহৎ ছেলে। কিন্তু তোমার বেলাও যদি আজ এরকম কিছু ঘটে, তবু আমি কিছু বলতে পারব না। বলা যায় না।
মহীতোষের বুকে হাত দিয়ে বলল সুমিতা, থাক, এ সব কথা কেন বলছ বাবা? চোখে ওর জল এসে পড়ল। মহীতোষ সুমিতার মাথায় হাত রেখে বললেন, বলছি, পাছে তুমি আমাকে ভুল বোঝ।
তারপর অনেকক্ষণ পর বললেন, রুমনো, তোমার বড়দির ব্যাপার আমি আজও ঠিক বুঝিনে। তবে আমাদের চোখ দিয়ে দেখা সবকিছুই খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে যেন। হয়তো আরও বদলাবে, তখন তোমাদের আমি চিনতে পারব না একেবারেই। আমি ত্রিশ বছর আগে ভাবতুম একটা নতুন জীবনকে গ্রহণ করেছি। এর চেয়ে আগে বাড়ার ক্ষমতা যদি আমার না থাকে, তবে যেন আমাকে ভুল বুঝো না বাবা।
.
পাখার বাতাসও গরম লাগছিল সুমিতার। মেজদি আর বাবা বেরিয়ে গেছেন। পাশের ঘরে কী যেন লিখছে বড়দি।
কাল সুমিতার রেজাল্ট আউট হবে। থেকে থেকে সেই কথাটি মনে পড়ছে আর পাখার তলায় হাঁসফাঁস করছে গরমে। বসেছিল মেজদির চেয়ারে, টেবিলের সামনে। হঠাৎ ধাক্কা লেগে একটি ড্রয়ার একটু ভেতরে ঢুকে গেল। টানতে গিয়ে খুলে এল ড্রয়ারটি। অবাক হয়ে ভাবল সুমিতা, এটা তো কোনওদিন খোলা থাকে না। নিশ্চয় মেজদি ভুলে গেছে।
বন্ধ করতে গিয়ে কী ভেবে টেনে খুলল। কাগজ, খাম, পেনসিল, পাস। একটি রুপোর বাটিতে কানের দুল, গলার হার। যেগুলি মেজদি কিছুতেই পরবে না। একটি ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ। আর একটু খুলল। একটি ইংরেজি কবিতার বই। তার পাশে একটি খাম। ওপরে ইংরেজিতে লেখা, সুগতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা। কিন্তু পোস্টাল খাম নয়।
হাত দিয়ে খামটা খুলতেই কেমন ধক করে উঠল বুকের মধ্যে রেখে দিয়ে দরজার দিকে ফিরে তাকাল ভীত চোখে। দরজা জানালা নিজেই দিয়েছিল বন্ধ করে বাইরের হলকার ভয়ে, তবু হাত দুটি যেন কেঁপে উঠল, আর মনে পড়ল মেজদির সেই দৃপ্ত কঠিন মুখখানি। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার হেনে, বন্ধ করে দিল ড্রয়ার। ছি! হয়তো মেজদির পরীক্ষার নোট কিংবা ছাত্র সমিতির কিছু। নয়তো, যা খুশি তা-ই। ওর মনে এত কৌতূহল, বুকে দ্রুত তাল কেন।
উঠতে গিয়ে আবার বসল। ঘামে ভিজে উঠল জামা। মুখেও ঘাম দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য। অবিশ্বাসী সাপের মতো হাতটা আবার পিলপিল করে এগিয়ে যাচ্ছে ড্রয়ারের দিকে। মন যত বলছে, না, না, ছি ছি! ততই ওর নিজের হাত বশে থাকছে না। আবার হাত ফিরিয়ে নিয়ে এসে, সারা শরীর শক্ত করে রইল দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। তবুও যেন কী এক দারুণ শক্তিতে হাত উঠতে চাইছে। শেষ মুহূর্তে চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। না না, কখখনও না। যা-ই থাক, যা-কিছু, কিছুতেই হাত দেবে না।
কিন্তু ততক্ষণে, ড্রয়ার খুলে খামটি খুলে তুলে নিয়েছে হাতে তুলে নিয়ে খুলে ফেলেছে। একটি নীল আর একটি সাদা কাগজ। দুটিই লেখা কাগজ। দুটিই পত্র, দুজনের হাতের লেখা। একটি ছোট ছোট প্যাঁচানো লেখা, আর একটি বড় বড়, ধরে ধরে সুন্দর করে লেখা। যে ভয়ে সুমিতা খুলতে চায়নি, দেখতে চায়নি, সেই জিনিসই দুটি। দুটি পত্র, একসঙ্গে। আশ্চর্য! কেন?
কিন্তু একী অবোধ কৌতূহল ওর। কী ভয়ংকর দুঃসাহস! কেমন করে নিজের সঙ্গে এমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করছে সুমিতা। অসহ্য গরমে কাপড় ফেলে দিল থেকে। ততক্ষণে অবিশ্বস্ত দৃষ্টি দ্রুতগামী পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে বেয়ে চলেছে লেখার ওপর দিয়ে। বড় বড়, ধরে ধরে লেখা নীল-পত্রখানির লাইন ধরে ধরে।
সুগতা,
মুখে বলার সাহস নেই বলেই বোধহয় পত্রের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। সেজন্যে দোষ নিও না। যদিও প্রতিমুহূর্তেই ভয় পাচ্ছি, এরকম পত্র লিখে মনের কথা বলতে চাওয়াটাই তোমার নিজের চরিত্রানুযায়ী একেবারে বিপরীত ঠেকবে। যদি ঠেকে, তবে জানবে, আমার সমস্ত দিক থেকেই যে কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি কিছুদিন থেকে, যে কথা আমার দিক থেকে না বললে আর চলে না, সে কথা বলতেই পত্র লিখতে হচ্ছে। এ কথাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, পারলে মুখে বলতাম নিশ্চয়ই। বলবার
আশা নিয়ে অনেক দিন গিয়েছি তোমার সামনে। বিরক্ত হয়েছ, কিংবা রাগ করেছ নয়তো অবাক হয়েছ। মনে মনে আমাকে দেখে। হয়তো বা হেসেছ মনে মনে আমার অবস্থা দেখে। কিন্তু তোমার সতেজ মূর্তি নিয়ে, সহজ দৃপ্ত চোখে যেই তাকিয়েছ, আমার সবই এলোমেলো হয়ে গেছে মনের মধ্যে। তোমার হাসির ধারে এমন একটা গাম্ভীর্যের রেশ লেগে থাকে যে, সামনাসামনি গিয়ে আর আমার কিছু বলবার সাহস থাকে না। ভয়, পাছে হাসি ভেদ করে তোমার ওই গাম্ভীর্যটাই থমথমিয়ে ওঠে।
তবুও তোমাকে যে হাতে হাতে পত্র দিতে সাহস করছি, সে ভরসাটুকু দিয়েছ তুমিই। আমি জানি, তুমি অবাক হবে প্রথমে, কিন্তু যে ভাবান্তরটুকু ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছ আমার, তাতে নিশ্চয়ই ওইটুকু বুঝেছ, মুখে না বলি, যেমন করে হোক, এবার কিছু একটা বলতেই হবে আমাকে।
সেদিন ব্যুফেতে, জলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে তুমি কী ব্যাপার? আজকাল যে তুমি আস্তে আস্তে বোবা হয়ে যাচ্ছ একেবারে?
আমি বললাম, কিছু বলতে পারছিনে।
তুমি তাকিয়ে রইলে গঙ্গার দিকে। তোমার মুখে কিছুক্ষণ জলের ঝিকিমিকি দেখা গেল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠলে আস্তে আস্তে। বুঝলাম আর কিছু বোধ হয় শুনতে চাও না তুমি আমার কাছ থেকে।
আরও এরকম অনেক দিন, অনেক সময় গেছে। কত দিন তোমার অজান্তে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেছে। পরশুদিন তুমি কমিটি মিটিং-এর পর বাইরে এসে পরিষ্কার বলেই ফেললে আমাকে, তোমাকে এত অন্যমনস্ক দেখছিলুম যে।
আমি বললাম, নিশ্চয়ই কারণ আছে।
কিন্তু সে কারণ তুমি শুনতে চাইলে না। তোমার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। তুমি যেন ভয়ে ভয়ে শুধু পড়া আর ছাত্রসঙেঘর কথাই বললে। তার চেয়ে, তুমি নীরব থাকলেও ক্ষতি ছিল না। পড়া কিংবা সঙ্ঘকে আমি খাটো করছিনে, কিন্তু তখন বড় অবান্তর বোধ হচ্ছিল। সত্যি, ফ্যাশানের খুবই ভক্ত ছিলাম। তুমি যেদিন প্রথম হেসে বিদ্রূপ করলে, আর ফ্যাশানের দিকে এগুতে পারলুম না। যদিও পোশাকটাই মানুষের সব নয়, পরে তুমিই বলেছ। বাড়ির গাড়িতে করে উনিভার্সিটিতে আসতাম, কলেজেও আসতাম। যে কোনও কারণেই হোক, তোমার এবং অনেক বন্ধুর চোখে ওটা খারাপ ঠেকেছিল। সেদিন থেকে গাড়ি চড়াটা ছেড়ে দিয়েছি। যদিও আমাদের বাড়িতে আর গাড়ি চড়ার লোক কেউ নেই। গাড়িটা আমি আমার মায়ের সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছি। আমার দিদিমার আর কেউ নেই (হেসো না যেন, তোমাকে সব লেখা দরকার), একমাত্র দৌহিত্র হিসেবে তাঁর দু লক্ষ টাকা, বাড়ি, গাড়ি সবই বর্তেছে আমাতে।
আর আমার সম্পর্কে যা শুনেছ, তোমার চোখের স্পষ্ট ঘৃণায় যা দেখেছি আমি, তার অনেকখানিই সত্য। ছাত্র আন্দোলনে আসাটা আমার অনভিপ্রেত ছিল না। আমার উপর সবাই বিরূপ বলে আমি ঘেঁষতাম না। কিন্তু এখন ঘেঁষছি। মিশছি এবং মোটেই তো অসহজ বোধ করছি না। অবশ্য, তুমি এবং আরও কয়েকজন বন্ধুর কাছে জীবনের নতুন শিক্ষা পাঠ করেছি আমি। এখন তুমিও বলল মাঝে মাঝে, গাড়িটাকে সত্যি জং ধরিয়ে দিয়ো না। যথেষ্ট, ওইটুকুই আমার ভরসা। টাকা, গাড়ি, এ সব মানুষের জীবনে অনেকখানি প্রয়োজনীয়, বিশ্বাস কর নিশ্চয়ই। তবু বলব, পূর্বে যা শুনেছিলে তার অনেকখানিই সত্যি।
আমি মদ খেতাম। মদ খেয়ে শেষ পর্যন্ত আমার মা দিদিমার সামনেও গিয়েছি মাতাল হয়ে। পঙ্কের শেষ সীমা পর্যন্ত নেমেছি, অস্বীকার করিনে। (বড় ভয় হচ্ছে, এই মুহূর্তেই হয়তো চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলবে কুটিকুটি করে। তবুও) বহু দুর নেমেছিলাম, উঠতে পারতাম কিনা জানি না। যদি না, দেখা হত তোমার সঙ্গে।
এই মুহূর্তে আমার সত্যি কথা বলার সময় এসেছে। আমি ভাবতে পারিনে তোমার পাশে নিজেকে নিয়ে ফিরব কেমন করে। তোমার জীবনের উচ্চতার সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে গা মিলিয়ে চলতে পারব কি না জানিনে। সেই চেষ্টা করব। শুধু যদি এসো পাশে–আমি আমার জীবনের ঐশ্বর্যের দুর্দশা থেকে অনেকখানি রেহাই পাব তবে।
আর একটু লিখি। সেদিন আমার চুলের ঝুটি ধরে নাড়িয়ে যখন বললে মশাই, ছেলেমানুষের মতো অতক্ষণ ধরে কী দেখছিলে আমার দিকে, তোমার সেই মুহূর্তের মূর্তি স্মরণ করে পত্র না লিখে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারলাম না। পত্র পেয়ে যদি রাগ না কর, অপমান বোধ না কর, তবে নিশ্চয়ই আবার তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে। ইতি–
মৃণাল।
সুমিতার ভয়ার্ত অস্থিরতাটা কেটে এসেছে অনেকখানি। কিন্তু যেন জামা গায়ে জলে ডুব দিয়ে উঠেছে। ভয়েলের জামা লেপটে গেছে সারা গায়ে। চিঠির তারিখ দেখে বুঝল, ছ মাস আগের চিঠি।
তারপরে আর একটি চিঠি। আশ্চর্য। মেজদি এই দুটি চিঠি-ই রেখেছে পাশাপাশি। কেন? তখন ওর মনের ধিক্কার গেছে, বিশ্বাসের মর্যাদা গেছে। বৃশ্চিকের মতো কিলবিল করে চোখের নজর চলল খুদে অক্ষরের প্যাঁচানো লেখার চিঠিটার গা বেয়ে।
সুগতা,
অবাক হয়েছি তোমার চিঠি পেয়ে। হঠাৎ চিঠি দিতে গেলে কেন? সারাদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, বাড়ি এসে দেখছি, তোমার পত্র। আবার দেখছি, জবাব চেয়েছ পত্রে। ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু তোমার পত্র পড়ে পুরোপুরি হাসতে পারিনি।
ছাত্র আন্দোলনটাকে আমি তোমাদের কয়েকজনকে দেখে সংকীর্ণ বলিনি। কিন্তু জীবনের গভীরতর প্রদেশে যতই এগুব, আমার মনে হয়, ততই আমি ওদিক থেকে সরে আসব। সেটা হয়তো আমার মনের গঠন প্রকৃতি, আমি যে পরিবেশে, যে ঘরে মানুষ হয়েছি, সেই মন নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যাপকতাকে কেন যেন খুঁজে পাইনে এখানে। ছাত্রের শিক্ষা, মাইনে স্বাস্থ্য ইত্যাদি খুবই গুরুতর বিষয়, তার জন্যে এখনও প্রচণ্ড আন্দোলনের প্রয়োজন আছে, থাকবেও অনেক দিন। তা ছাড়া মধ্যবিত্ত যুবশক্তির বিরাট অংশ এখানেই।
তবু জীবনের গভীরতম, ব্যাপকতম প্রদেশটাকে আমি যতই অনুসন্ধান করতে গেছি, ততই দেখছি, আমার মন চলে যায় সম্পূর্ণ ভিন্নতর মানুষ ও জনপদের দিকে। সেখানে প্রতিমুহূর্তেই নিজের মনটাকে, অর্থাৎ চিন্তার পরিধিকে বড় সংকীর্ণ ছোট্ট একটুখানি মনে হয়। মনে হয়, আমি একটুখানি। জিজ্ঞেস করলে এদেশের কোনও কথাই আমি বলতে পারব না।
সে সব যাক, আমি তো এখুনি যাচ্ছিনে। তোমার চিঠি পেয়ে অবশ্য আমার লোভ হচ্ছে চিরকাল কলকাতার ছাত্র আন্দোলন নিয়েই না হয় কাটিয়ে দিই। কিন্তু, তারপর যে তোমরাই একদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না তা বুঝব কেমন করে। এখন তো আমাকে প্রায় গুরুদেব করে ফেলেছ, (যদিও গুরুবাদে আমি একেবারেই বিশ্বাসী নই) তারপর?
একে তো চটকলের কেরানির ছেলে। এম এ পাশ করেও একটা বড় চাকরি নয়, রাজনীতি। সেটা রাজনীতি কি না তাও বলতে পারিনে। বরং বলা যায়, মানুষ আমি যত ছোটই হইনা কেন, আমার কিছু বলার আছে। আমি বলতে চাই, এবং তারই সন্ধানে আছি। ভাগ্যি ভাল, আমার মায়ের কোনও বাধা নেই, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার ঘোরতর বিরোধ। তিনি আমাকে বলেন, প্রাণহীন নিষ্ঠুর। কেন জানিনে। তবু আমরা একসঙ্গে বাস তো করি। তোমরা নিষ্ঠুর বলেও তো একসঙ্গে থাকতে পারবে না।
যাক, ঠাট্টাটাকে কিছু মনে করো না। তুমি আমার চিরদিনের সাহচর্য চেয়েছ, এমন কী দেশান্তরে, পথে পথে ফিরবে শত দুঃখেও। আমি আছি, তুমি এলে তোমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। মানুষের নিজের মনের কাছে স্বীকৃতিটাই অনেকখানি। পত্র পড়ে মনে হল যেন, কীসের একটি অদৃশ্য ভয় তোমাকে তাড়া করছে। সেটাও মনের মধ্যে ছায়া ফেলেছে বাইরের কোথাও থেকে এসে। তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কেন না, ওটাও নিজের মনের। তুমি না চাইলে সে আপনি উবে যাবে।
কিন্তু আর যা-ই কর, আমাকে খুব বড় করো না। তাতে তুমি, পরে বন্ধুরাও অনেক দুঃখ পেতে পার। আমিও পারি। আমাকে বিশাল ও কঠিন ভেবে এড়িয়ে যাবার কিছু নেই তোমার, ভয় পাবারও কিছু নেই। আমার বন্ধুত্ব রইল তোমার জন্য চিরকাল, যে কোনও অবস্থাতে।
শেষবার, আবার একটু ঠাট্টা করছি বড় সেন্টিমেন্টাল মেয়ে বাপু তুমি।
ভালবাসা ও শুভেচ্ছাসহ,
রাজেন।
সমস্তটাই, স্টিম চালিত যন্ত্রের মতো করল সুমিতা। পত্র দুটি শেষ করেই, ঠিক যেমনটি ছিল, রাখল তেমনি করে। তারপর যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল শূন্য চোখে। স্খলিত জামার বুকের গহনে কলকল নিঝরিণী বইছে ঘামের। উঠে গিয়ে খুলে দিল একটি জানালা। তারপরেও যেন দূর বাড়িগুলি পেরিয়ে, তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। যা পড়েছে, সবটুকু আর এক বার পড়ে নিচ্ছে মনে মনে।
কিন্তু ভয়? কোন অদৃশ্য ভয় তাড়না করছে মেজদিকে? সেই ভয়ের নাম কী? বড়দিকেও কি ওই ভয় তাড়না করেছিল বিয়ের আগে? না, সুমিতার মেজদি কেন ভয় পাবে? মেজদি দুর্জয় সাহসিনী। সে ভয় পাবে না, কখনও না।
.
১৭.
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লে সুমিতা। কাল সারা রাত প্রায় ঘুমোতে পারেনি। উঠেই মনে হল, বাড়ির সবাই জেগে গেছে। বেলা হয়ে গেছে ওর। আসলে মহীতোষ ছাড়া তখনও বিছানা ছাড়েনি কেউ। পাশের বিছানায় এলোখোঁপায় মুখ গুঁজে মেজদি তখনও অচৈতন্য। সুমিতা ছুটে গেল বাইরের ঘরে। কিন্তু টেবিলটা ফাঁকা। সেখানে খবরের কাগজটি নেই। ছুটে গেল বাগানে। মহীতোষ ছিলেন সেখানে তাঁর নিত্যকর্মে। সুমিতা গিয়ে বলল, কাগজ আসেনি বাবা?
মহীতোষ বললেন, এখনও তো সময় হয়নি। দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হলে কি চলে। তোমাদের রেজাল্ট নিয়ে বেরুবে। আজ একটু বা দেরিও হতে পারে।
মহীতোষের ঠোঁটের কোণে লুকোনো স্নেহের হাসিটুকু ওর চোখে পড়ল না। বলল, কেন?
মহীতোষ হেসে উঠলেন। বললেন, অতগুলো ছেলেমেয়ের পাশের খবর ছাপতে হবে তো কাগজওয়ালাদের।
কী দুশ্চিন্তা সুমিতার। আবার কী একটা বলে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার সঙ্গে চোখোচোখি হতেই হেসে উঠল দুজনে।
হাসির মধ্যেও উৎকণ্ঠার সুরে বলল সুমিতা, বিলাসকে দিয়ে রাস্তা থেকে একটা কাগজ কিনতে পাঠিয়ে দেব বাবা?
মহীতোষ হেসে বললেন, কেন, আধ ঘণ্টার মধ্যেই কাগজ এসে পড়বে। এত উতলা হচ্ছ কেন তুমি? এদিকে এসো।
কাছে গেল সুমিতা। মহীতোষ কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হচ্ছে? পাশ করবে তো?
দুহাতে বাসি চুল সরাতে গিয়ে সলজ্জ হেসে মুখ ঢাকল সুমিতা। বলল, কেমন করে জানব।
পরীক্ষা তো তুমিই দিয়েছ।
সুমিতা নীরব। মহীতোষ বললেন, মনে হচ্ছে কাল সারা রাত ঘুমোওনি।
চমকে বলল সুমিতা, ঘুমিয়েছি তো।
মহীতোষ আর এক বার সুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে সূর্যমুখীর গোড়ায় প্যাকেটের মশলা মেশাতে লাগলেন।
সুমিতার হঠাৎ কেমন লজ্জা করতে লাগল। সত্যি, ও তো সারা রাত কাল ঘুমোতে পারেনি। কিন্তু সে তো পরীক্ষার জন্যে নয়। অন্য ভয়, অন্য চিন্তায়। | আবার ছুটে গেল ও বাইরের ঘরের বারান্দায়। গেল গেটে, রাস্তার ধারে। কেউ কেউ যাচ্ছে কাগজ হাতে। ইচ্ছে করছে, টেনে নিয়ে নিজের রেজাল্টটা দেখে নেয়। ইতিমধ্যে সুগতাও এসেছে বাইরে। তারও সেই একই কথা, কাগজ এসেছে, রুমনি?
-না।
কাগজ, কাগজ। কোনও খবরের দরকার নেই। শুধু সেই সাপ্লিমেন্টটা পেলেই হয়। অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরি করেই আজ কাগজ এল। খুলেই, ধকধকে বুকে আগে সেন্টারের নাম। তারপর রোল রেজেষ্ট্রি..পাশ। পাশ করেছে সুমিতা। ফার্স্ট ডিভিশনেই পাশ করেছে। কী করবে এবার সুমিতা। কী করবে!
মহীতোষ ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, পাশ?
সুমিতা আরক্ত মুখে হেসে চট করে একেবারে নুয়ে পড়ল বাবার পায়ে।
মহীতোষ অবাক হয়ে বললেন, আরে, করিস কী?
সবচেয়ে অবাক সুমিতা। এরকমভাবে প্রণামের ব্যাপারটা তো ছিল না কোনওদিন এ বাড়িতে। কোত্থেকে আমদানি করলে এ সব রুমনি।
তাতে কী লজ্জা সুমিতার। সত্যি, এ ও কী করে ফেললে। ইচ্ছে করে নয়, এ ছাড়া যে এ মুহূর্তে ও আর কিছু ভেবেই পেলে না। শুধু তাই নয়, মেজদিকেও একটা প্রণাম করে ফেললে।
সুগতা তো প্রায় সুড়সুড়ি লাগার মতো হেসে ধমকে উঠল, এই রুমনি।
মহীতোষ বললেন, পাগল।
সুমিতা ছুটে গেল বড়দির কাছে। তাকেও প্রণাম করলে।
সুজাতা বলল, আরে? কী হয়েছে?
–পাশ করেছি, বড়দি?।
অবাক হয়ে বললে সুজাতা, সেজন্যে নমস্কার করতে হয় বুঝি।
নিঃশব্দে হাসল সুমিতা। ভাবল, বড়দি নিশ্চয়ই ওকে শিবানীর পর্যায়ে ফেলে একেবারে আনকালচার্ড ভাবছে।
মহীতোষ এগিয়ে এসে দুটি দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন সুমিতার দিকে। বললেন, এটা তোমার পুরস্কারের ফাউ। আসলটা পরে পাবে। সেটা অবিশ্যি টাকা নয়।
সুমিতা নোট দুটো নিয়ে বললে, কী করব বাবা টাকা দিয়ে?
যা তোমার খুশি। বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে একটু বেড়াবে, খাবে আজ।
সেই মুহূর্তে বাকি দুই বোনেরও মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের কথা। তখন আরও জমজমাট ছিল। রিটায়ারের আগে মহীতোষের গাড়ি ছিল। খাওয়া বেড়ানো ছাড়াও বই, শাড়ি, সোনার গহনা পুরস্কার দিয়েছেন প্রত্যেকটি পাশের সময়ে। মেজদি তার কিছুটা পেয়েছে। সুমিতা সামান্য।
গুলতোনিটা একটু থামতেই সকলের নজরে পড়ল, সুজাতা আজ স্নান করতে চলেছে সকলের আগে। এতক্ষণে সকলের খেয়াল হল। সকলের পরে বিছানা ছাড়ে সুজাতা, প্রায় মহীতোষের বেরিয়ে যাবার সময়ে। আজ সাতসকালে স্নান। শুধু তাই নয়। জানা গেল, তাড়াতাড়ি খাবার কথাও বিলাসকে বলে রেখেছে সুজাতা।
মহীতোষ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আজ এত সকাল সকাল যে উমনো।
সুজাতা সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, একটু কাজ আছে।
এইটুকুই শুনলে সবাই। দেখলে, মহীতোষের মুখে একটু ছায়ার আভাস। বোঝা গেল, এর বেশি শোনা যাবে না আর কোনও পক্ষ থেকেই।
সুমিতার মনে হল, ওর পাশ করার আনন্দে যে আলোটুকু ছড়িয়েছিল বাড়িতে, কয়েক পোঁছ অন্ধকার নামল তাতে।
মহীতোষ আর বিশেষ কোনও কথা না বলে মন দিলেন নিজের কাজে। মেজদি কোনও কিছুই জিজ্ঞেস করবে না বড়দিকে। শুধু সুমিতাই এক ফাঁকে না জিজ্ঞেস করে পারলে না–কোথাও বেড়াতে যাবে নাকি বড়দি?
এখানে জবাব আরও সংক্ষিপ্ত, না।
মহীতোষের একটু পরেই বেরিয়ে গেল সুজাতা।
আস্তে আস্তে নানান কথার অলিগলি দিয়ে গতকাল রাত্রের কথা মনে পড়ল সুমিতার। বড়দির পাশ দিয়ে উঁকি দিল মেজদির প্রসঙ্গ।
সুমিতা কাল প্রায় সারাটি রাত্রি ঘুমোতে পারেনি। মেজদি বাড়ি আসার পর থেকে কী ওর অস্বস্তি। প্রতি মুহূর্তে ভয়, ড্রয়ার খুলেই মেজদি চমকে তাকাবে তীক্ষ্ণ চোখে। জিজ্ঞেস করবে, এ কী! আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছিল কে?
তখন যে সুমিতার কিছুই বলার থাকবে না। কেঁদে ক্ষমা চেয়েও মনের গ্লানি তো যাবে না। একটি অবিশ্বাসের অদৃশ্য চিহ্ন নিয়ত ঘুরবে ওর পিছনে পিছনে!
মেজদি যতক্ষণ ড্রয়ারে হাত দেয়নি, ততক্ষণ ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হয়েছে কাল। অনেকক্ষণ পর, অনেক পড়ার পর, শুতে যাবার আগে মেজদি ড্রয়ার খুলেছে। নাড়াচাড়া করেছে এটা সেটা। সুমিতার মনে হয়েছে, সুগতা নাড়াচাড়া করছে ওর হৃৎপিণ্ডটা নিয়েই। তারপর দেখেছে, খামটাও হাতে করতে। সেই সময়ে কালঘামে প্লাবিত হচ্ছিল সুমিতা।
মেজদি রেখে দিয়েছে খামখানি। আবার বই পড়েছে। কিংবা পড়ার বই পড়ছেনা, রাজনীতির বিষয় খুঁটছে অক্ষরে অক্ষরে।
সেই মুহূর্তে সুমিতার ভয় ও অপমানের গ্লানিটা গেছে ছেড়ে। এমনি মানুষের মন। অথচ কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিল, এ গ্লানি ওর কোনওদিন কাটবে না। তবুও ঘুমোতে পারেনি সারা রাত ধরে। তখন ওর অবসর এসেছে, চিঠি দুটির কথা ভাববার। রাজেনের চিঠিটা মৃণালের পরে। প্রায় তিন মাস বাদে। দুটি চিঠির দুই সুর। সেই ভিন্ন সুরের রূপ বিশ্লেষণ সম্ভব নয় সুমিতার পক্ষে। কিন্তু মানুষ দুটি পরিষ্কার ধরা পড়ে যায়। হয়তো, চিঠির নীচে নাম না দেখলেও, লেখককে চিনতে পারে সুমিতা।
কিন্তু অনেক গরমিলের মধ্যেও, একটি মিল আছে দুজনের। একজন চেয়েছে, আর একজন সাড়া দিয়েছে ডাকের। দুটি মিলিয়ে একটিই হয়, তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু, ভয়? ভয় কেন পাবে মেজদি?
তারপর মনে হল, রাজেনের তিনমাস আগের চিঠির সঙ্গে সেদিন ঝড়ের রাতের কোথায় একটি মস্ত অমিল দেখা দিয়েছে। যার কাছে মেজদি লিখে পাঠায় মনের ভয়, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে চায় জীবনের দুর্গম পথে পথে, ঝড়ের রাতে মেজদির ঠিক সেই রাজেনকে তো চোখে পড়েনি এক বারও।
বেলা তিনটে নাগাদ এল বিনয়। পাশ করার আনন্দটা আর এক বার ঝলকে উঠল সুমিতার। কিন্তু পরমুহূর্তে লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞেস করল বিনয়কে, পাশ করেছ?
বিনয় ভয়ংকর সেজে এসেছে আজ! কোঁচা পড়েছে লুটিয়ে। মাথার মাঝখানের সিঁথিটা অস্পষ্ট হয়ে সমস্ত চুলেই একটু ব্যাকব্রাশের লক্ষণ। ভারী নিরুৎসুক গলায় বলল, করেছি, কিন্তু তোমার মতো নয়।
–আমার মতো নয় মানে?
–তুমি ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছ। আমি থার্ড।
সুমিতা অবাক হয়ে বলল, কী করে জানলে। তুমি আমার রোল নাম্বার জানতে?
বিনয় ওর অভ্যস্ত সকরুণ লজ্জায় বলল, মনে করে রেখেছিলুম।
সুমিতা ঠোঁট টিপে হেসে এক বার দেখলে বিনয়ের আপাদমস্তক। তখুনি কী একটা বলবে বলবে করেও সামলে নিলে নিজেকে। বলল, তবে যে বলেছিলে, পাশ করতে পারবে না।
বিনয় বলল, তখন তা-ই মনে হয়েছিল। কিন্তু আর আমি কিছুতেই পড়ব না।
অনেকখানি গাম্ভীর্য দিয়ে বলার চেষ্টা করেও কথার মধ্যে ওর ছেলেমানুষের আবদারের সুরটিই পরিস্ফুট। সুমিতা বলল, কেন? সেই গান?
বিনয় চকিতে এক বার দেখে নিল সুমিতার মুখের দিকে। তারপর বলল, হ্যাঁ। হোলটাইমার না হলে কোনও বিষয়ে সিদ্ধিলাভ হয় না। অলরেডি একজন ওস্তাদের কাছে ভরতি হয়েছি। কিন্তু হলে কী হবে। বাড়িতে ভীষণ আপত্তি।
বিনয়ের এ করুণ অবস্থার মধ্যেও হয়তো হেসে ফেলত সুমিতা। সামলে নিয়ে বলল, চলো বেরুই।
বিনয় চকিত উচ্ছ্বাসে ঝলকে উঠল। বলল, আমি বলতে যাচ্ছিলুম। যাবে?
লাল টকটকে শাড়ি পরে, সারা ঘর আরক্ত করে এসে দাঁড়াল সুমিতা। ভয়েলের লাল শাড়ি যেন সারা গায়ে তরল আগুনের মতো গলে পড়ছে তার সর্বাঙ্গে। লাল লিনেনের জামাটা ওর এত দিনে কাঁধ থেকে নেমেছে একটা দুঃসাহসিক পর্বত-চূড়ার সংকীর্ণ কিনার ঘেঁষে। কিন্তু জামার সাহসের চেয়ে মনের সাহসটা কম বলে, হেলায় বাঁধা একটি বিনুনি ওকে লতিয়ে দিতে হয়েছে বুকের খোলা সীমানায়। বোঝেনি, আড়াল করতে গিয়ে আরও একটি চোখ-টানা-চিহ্ন ওতে আঁকা হয়ে গেছে।
শাড়ির এ তরল আগুন ঝলকে উঠল বিনয়ের চোখে। ওর যৌবনের নতুন খোলা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে রক্তে রক্তে অনুভব করল একটি বিচিত্র বোবা বিস্ময়-মুগ্ধ উত্তেজনা।
সুমিতা কিছুতেই লজ্জা চাপতে পারছিল না। তখনও মুখের স্নো ঘষার অছিলায় সারা মুখে হাত বুলিয়ে ঢেকে রাখতে চাইছিল। শেষ পর্যন্ত ওকেই বলতে হল, চলো।
প্রায় চমকে উঠে বললে বিনয়, হ্যাঁ, চলো। কাউকে বলে এলে না?
বলে এসেছি মেজদিকে।
মেজদি। ধক করে উঠল বিনয়ের বুকের মধ্যে। সুগতাদি। সুমিতা হেসে বলল, তোমার খুব ভয়, না?
বিনয় টেনে বলল, না–তবে…
সুমিতার দিকে চেয়ে সে প্রসঙ্গ আবার ভুলে গেল। বলল, কোথায় যাব?
কোথায়! সেটা একটা সমস্যা। কেননা, যেখানে খুশি সেখানেই যাওয়া যায়।
বিনয় আবার বলল, কিন্তু আজ একদম হাঁটব না। ট্রামে বাসেও নয়। স্রেফ ট্যাক্সি চেপে বেড়াব।
সুমিতা বলল, বেশ। সারা কলকাতাটা ঘুরব।
ওরা দুজনেই অনুভব করছিল সকলেই তাকিয়ে দেখছে ওদের দুজনাকে।
বড় রাস্তায় এসে ট্যাক্সি ডেকে উঠতে গিয়ে হঠাৎ সুমিতা যেন চমকে ডাক দিল, আচ্ছা, বিনয়–
বলো।
চোখ বড় করে বলল, এক জায়গায় যাবে?
—কোথায়?
–ছাত্রসঙ্ঘের অফিসে।
–কেন।
রাজেনদার সঙ্গে দেখা করতে।
বিনয়কে একটু বিমর্ষ দেখাল। কিন্তু সাহস পেল না আপত্তি করতে। বলল, কিন্তু সেখানে বেশি দেরি হয়ে যাবে।
–দেরি আবার কী? বেড়াতে বেরিয়েছি। দেখা করে চলে আসব। তোমাকেও তো রাজেনদা খুব ভালবাসেন। পাশ করে দেখা করবে না?
এবার বিনয়ই একটু লজ্জিত। বলল, না তা নয়, যাব না কেন? চলো।
গাড়িতে বসে বিনয় যত বার দেখল সুমিতাকে, তত বারই চোখে পড়ল, হাসি ও অভিমানে এক বিচিত্র আনোছায়ার খেলা ওর মুখে। একেবারে গায়ে গায়ে বসেনি। তবু বিনয়ের রক্তধারা এক নতুন প্লাবনে ছোলা হয়ে উঠছে। যেন এক পাগলা ঘূর্ণির আবর্তে দিশেহারার মত্ততা পেয়েছে প্রাণ।
বলল, কী ভাবছ সুমিতা?
সুমিতা বলল, রবিদার কথা। এক বারো এলেন না। আচ্ছা বিনয়, আজ এক বার রবিদাদের বাড়ি যাব, কেমন। তারপরে দুজনে বেরিয়ে পড়ব।
বিনয়ের উপায় ছিল না ঘাড় কাত করা ছাড়া। সুমিতার মুখের আলোছায়াটা ওইখানেই।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল এসে দুজনে ছাত্রসঙেঘর অফিসে।
সারা ঘরটি ধুলোর আর পুরনো পোস্টার লিফলেটের জঞ্জালে ভরা। টেবিল চেয়ারও নড়বড়ে, ধুলোমাখা। দেয়ালে পোস্টার। ছেচল্লিশের ছাত্র শহিদদের ফটো। দোমড়ানো দলা পাকানো ফেস্টুন। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে গান্ধীজির দন্তহীন স্নিগ্ধ হাসি মাখানো ফটোখানি। তবু সব মিলিয়ে কেমন একটা রুদ্ধশ্বাস কারখানার মতো মনে হল সুমিতার।
রাজেন ছাড়া আর এক জন বসেছিল পাশে। চেনা চেনা, কিন্তু অচেনা। শান্ত শিষ্ট, মোটা লেন্সের চশমা-চোখে একটি যুবক। ভাবের ঘরে ডুব দেওয়া চোখ। আশ্চর্য একটি তন্ময়তা দৃষ্টিতে বসে আছে কাঁধে নিয়ে মস্ত একটি ঝুলি।
ওদের দুজনকে দেখেই রাজেন অবাক, হেসে ডাক দিল, আরে, এসো এসো। কী ব্যাপার, একেবারে এখানে?
কাছে এল দুজনেই। সুমিতা বলল, দেখা করতে এলুম আপনার সঙ্গে।
রাজেন বলল, বটে। ভয় করেনি তো?
সুমিতা ঘাড় নাড়ল নিঃশব্দে। রাজেন আবার বসতে বলেই সহসা জিজ্ঞেস করল, আসল কথা বলো, তোমাদের পরীক্ষার খবর কী?
সুমিতা বলল, পাশ করেছি। তাই বলতে এলুম।
–বিনয়?
–পাশ করেছি।
–টেনে বুনে বুঝি?
তারপর পাশের যুবকটির দিকে ফিরে বলল রাজেন, বিনয়কে তো চেনই। এ হচ্ছে সুগতার ছোট বোন। সুমিতা হাত তুলে নমস্কার করবার আগেই রাজেন আবার বলল, আর এ আমাদের চিত্রশিল্পী বিভূতি।
সুমিতার মনে পড়ল। বিভূতির অনেক ছবি পত্র-পত্রিকায় দেখেছে ও। আরও মনে পড়ে, এক বার বোধ হয় মেজদির সঙ্গে গিয়েছিল বাড়িতে, অনেক দিন আগে। তখন বিভূতি ফোর্থ ইয়ারে পড়ত মেজদির সঙ্গে।
সে উঠবে উঠবে করছিল। এবার বিদায় নিল।
সুমিতা দেখছিল রাজেনকে। আর বারবার মনে পড়ছিল সেই চিঠিখানির কথা। এই আপাত বিদ্যুৎ-চকিত চোখের আড়ালে সুদূর গম্ভীর আকাশের মতো যেন রাজেন বিশাল। এই পোস্টার ফেস্টুন অফিসের চেয়ে যেন আরও বহু দুরের এক অজানিত লোকে বিস্তৃত।
পরীক্ষার সম্বন্ধে আরও দু-একটি কথার পর, বিনয়কে বলল রাজেন, তারপর? পড়বে তো?
বিনয় সলজ্জ নীরব। সুমিতা হাসল বিনয়ের দিকে চেয়ে। বলল, আমি জানি ও কী করবে।
ধুতি পাঞ্জাবিতে গুটিয়ে গেল প্রায় বিনয়। রাজেন বলল, জানি। গান তো? আর তুমি? সুমিতার দিকে ফিরে তাকাল।
সুমিতা বলল, পড়ব।
বি এ?
–হ্যাঁ।
–তারপর? এম এ?
–হ্যাঁ।
–তারপর?
তারপর। সুমিতা যেন চমকে উঠল। ছটফটিয়ে উঠল কথা খুঁজে না পেয়ে। এমন করে তারপরের কথা তো কোনওদিন ভাবেনি।
রাজেন হেসে উঠে বলল, আমি জানি।
কৌতুক উৎসুক চোখে তাকাল সুমিতা, কী বলুন তো?
–বিয়ে।
–অ্যাঁ?
রাজেন হেসে উঠল হো হো করে, সারা ঘর কাঁপিয়ে। বলল, খুব বড়লোক বরের সঙ্গে।
লাল হয়ে উঠল সুমিতা। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নতুন করে রাজেনের চোখে পড়ে গেল বিনয়। বিনয়েরও আরক্ত নত মুখ।
কী বলতে গিয়ে মুখ নামাল সুমিতা। রাজেন বলল, কী বলছিলে, বলো?
সুমিতা বলল, বড়লোকের সঙ্গে বললেন কেন?
রাজেনের মুখে চকিতে দেখা দিল এক বার গাঢ় মেঘের ছায়া। ঠোঁটের কোণে একটু বা শ্লেষের বিদ্যুৎ। হেসে বলল, তবে? তোমাদের বিয়ে বুঝি গরিবের সঙ্গে হবে।
কথাটি বাজল সুমিতার কষাঘাতের মতো। সংশয়াম্বিত চোখে তাকাল রাজেনের দিকে। কী বলতে চায় রাজেন।
রাজেনও যেন চকিত লজ্জায় বিব্রত হয়ে উঠল। হেসে বলল, রাগ করলে নাকি?
সুমিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না।
রাজেন বলল, তোমাকে ঠাট্টা করে বললুম। তা বলে কি ইনসেনসিবল ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। আমি যদি এখন মস্ত বড় মিলওয়ালার মেয়েকে বিয়ে করি, সে বেচারি কেঁদে পালাতে পথ পাবে না। খালি তো টাকা নয়, মনটা দেখতে হবে। মানুষ যেখানে মানিয়ে চলতে পারে, সেখানে বিয়ে করে।
থেমে একটু অদ্ভুত হেসে আবার বলল, তা তুমি অত সিরিয়স হয়ে উঠছ কেন? এর মধ্যেই সে সমস্যা এসে পড়েছে নাকি?
বিনুনি দিয়ে মুখ চেপে হাসল সুমিতা। ঘাড় নাড়ল নিঃশব্দে। তবু রাজেনের এই সত্যি কথাগুলির আড়ালে কোথায় যেন কী একটা বাজছে। যেটা ওর মনের সংশয়ের তারে দিয়েছে একটি নিশ্চিন্ত ঝংকার। সবচেয়ে নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ পরদাটা বাজছে গুরু গুরু করে।
রাজেন আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার মেজদির খবর কী?
সুমিতা বলল, কেন, ও আসেনি এখানে?
কই, সাতদিন তো তার দেখা পাইনি, খুব পড়ছে বুঝি?
না, রোজই বেরোয় তো।
আবার এক বার চোখোচোখি হল রাজেন সুমিতার। দুজনেই অনুভব করল, দুজনেই একটি সায়রে চলেছে ভেসে। সুমিতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, মৃণালদা আসেননি?
রাজেন সহসা ড্রয়ার খুলে, সেই দিকেই মুখ রেখে বলল, খেয়াল করিনি। বোধ হয় আসতে পারেনি কয়েকদিন।
তারপর হেসে বলল, তা হলে সুমিতা, অভিনন্দন দিয়ে শুধু কী হবে? অনেকে এসে পড়বে। চলো, তোমাদের দুজনকে একটু খাওয়াই।
সুমিতা দৃঢ়ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, না, এখন নয়। আপনার বাড়ি যাব।
-আরে বাপরে, সে ভাই অনেক দূর।
–তবে আপনি আমাদের বাড়ি আসুন।
–তাই যাব।
ইতিমধ্যে দুটি ছেলে এল। বিদায় নিল এরা দুজনে।
.
রবিদার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বিনয়কে পাঠালে সুমিতা খোঁজ করতে।
রবিদার বাড়ির ভাই-বোনদের কেমন যেন নকল মৌনীবাবা মনে হয়। অথচ, মেয়েরা রং মেখে, ছেলেরা প্যান্ট পরে পাশে পাশে ঘুর ঘুর করবে ঠিক, তাকাবে আড়ে আড়ে।
রবিদাকে পাওয়া গেল না বাড়িতে।
বেলা শেষের দগ্ধ আকাশে, শেষ অঙ্গারের দীপ্তি লেগেছে। তপ্ত বাতাস হয়েছে একটু ঠাণ্ডা। সারা কলকাতা নিশ্বাস নিতে বেরিয়েছে পথে, পার্কে, ময়দানে।
রক্তাম্বরী সুমিতার খর আগুনের শিখাও যেন কেমন ছাইচাপা হয়ে এসেছে এই ঝোঁকে। রাজেনের ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই কেমন একটু ছায়া ঘিরে এসেছে ওকে।
বিনয় বলল, চলো ব্যুফেতে যাই।
তাই গেল দুজনে। মেজদির চিঠির কথা মনে পড়ল। মৃণালের সঙ্গে ব্যুফের সেই কথা।
পঞ্চম জর্জের কালো মূর্তিটার বাঁ-পাশ দিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। ব্যুফের গাধাবোটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হঠাৎ সুমিতার মনটা আবার দীপ্ত হয়ে উঠল। জলে তখন আকাশের ধূসর লালিমা। আশেপাশে জাহাজ স্টিমার অনেক নৌকার ভিড়। আরও দূরে ভাসছে বয়া, অতিকায় কচ্ছপের মতো। পাখিরা ফিরে চলেছে দল বেঁধে জলের ঢেউ ঘেঁষে ঘেঁষে।
প্রায় ওর কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল বিনয়, কী খাবে সুমিতা।
সুমিতা বলল, যা খুশি।
বিনয় অর্ডার দিল যা খুশি। যা খুশি ওরা খেল আর রেখে দিল। বাতাসে বার বার আঁচল পড়েছে উড়ে বিনয়ের গায়ে। লাল লিনেনের সর্বনাশা বাঁকটা বাতাসে কাঁপছে থরথরিয়ে শাণিত অস্ত্রের মতো। নীচে তার রক্তশৃঙ্গ সুমিতাকে আজ যেন অনেকখানি করেছে বলিষ্ঠ উদ্ধত। কিন্তু সুডৌল বাঁকের ছায়ায় যেন কেমন একটু নম্র। বিনয়ের অপলক চোখের সামনে লজ্জার আগলটুকু বোধ হয় গোপন থাকছে না কিছুতেই। তাই হাসির আভাস লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে।
হঠাৎ সুমিতা ভ্রূ কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ?
বিনয় যেন ইচ্ছে করেই ধরা দিয়ে বলল, তোমাকে। সত্যি, কী সুন্দর।
সুমিতা মুখ ফিরিয়ে তাকাল দূর গঙ্গায়। বলল, সবই ভারী সুন্দর।
তারপর আর একটা কী বলতে গিয়ে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল সুমিতা।
বিনয়ের চোখে নিয়নআলোর ঘষা-চকচকে ধাঁধা। রক্তে ওর তোলপাড় লেগেছে। এখানে আশেপাশে প্রত্যেকটি টেবিলে অনেকের ভিড়।
বিনয় বলল, চলো, বাইরে যাই।
সুমিতা বলল, তাই চলো। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি।
দুজনে এসে বসল একটি গাছের ছায়ার কোল আঁধারে। সামনে সারি সারি নৌকা। লম্প আর হ্যারিকেন জ্বলছে সেখানে। রাস্তায় জ্বলছে আলো।
নৌকাগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হল, কিছুই জানে না সুমিতা। কত লোক আছে এদেশে, কত রকম, কত দূর দুরান্ত থেকে আসছে তারা। তাদের যে সংসার আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, ভাবতে পারে না। আবহমান কাল থেকে এরা যেন গঙ্গার বুকেই ঘুরছে নৌকা নিয়ে।
বিনয় বসেছে প্রায় ওর গা ঘেঁষে। ওর বুকের মধ্যে দুর মেঘের গুরু গুরু ডাক পড়েছে যেন। কিছুই যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। মনে পড়তে লাগল বারবার, তাপসীর প্রেমের কথা।
বিনয় গান ধরল গুন গুন করে। কিন্তু রক্তধারার তীব্রতা ভাল করে গান গাইতে দিল না ওকে। আঠারোর রক্তকণা গলিত তপ্ত লাভার মতো পোড়াচ্ছে ভিতরে ভিতরে। বলল, সুমিতা, কলেজে না পড়লেও তোমার দেখা পাব তো?
সুমিতার বুকের মধ্যেও তখন ধকধক করছে। মনে হচ্ছে, অবশ বিহ্বল হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। বার বার তাপসীর কথাগুলিই মনে পড়ছে। প্রেম, প্রেম, তবে এই কি প্রেম! যা যা সন্দেহ করেছিল তাপসী, ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মতো।
বিনয় একটি হাত তুলে নিল সুমিতার। বিনয়ের হাত ঠাণ্ডা, ঘামে ভেজা, একটু বা কাঁপা কাঁপা।
নিশ্বাস লাগছে ঘাড়ের কাছে। ডাকল, সুমিতা।
সুমিতা কোনও রকমে বলল, উ।
বিনয় ঠোঁট ছোঁয়ালে সুমিতার সুদীর্ঘ গ্রীবায়। একবার কেঁপে উঠে, সুমিতা যেন অবাক বিস্ময়ে পাথর হয়ে যেতে লাগল। রক্তধারাটা জোয়ার ঠেলে যেন নামতে লাগল ভাটার টানে।
বিনয় বলল, সুমিতা। আমি তোমার কাছ থেকে যেতে চাইনে।
বলতে বলতে সুমিতাকে টেনে আনল কাছে। আনতে গিয়ে বুঝল, সুমিতা পাষাণের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আবার ব্যাকুলভাবে আকর্ষণ করতে যেতেই হাত দিয়ে বাধা দিল সুমিতা। আশ্চর্য! এ কী হচ্ছে। কেন ওর তাপসীর মতো মনে হচ্ছে না। কেন সমস্ত ব্যাপারটা ওকে শুধু দুঃখিত করছে, কাঁদাতে চাইছে। বিনয়কে তো ওর একটুও খারাপ মনে হচ্ছে না। তবু ব্যাপারটাকে এত ছেলেমানুষের পাগলামি মনে হচ্ছে কেন। কতটুকুই বা ওর বয়স। তবু কেন এক আশ্চর্য বিষণ্ণ গাম্ভীর্যে ভরে উঠছে মন।
সুমিতা হাত ছাড়িয়ে নিল বিনয়ের হাত থেকে। কিন্তু সরে বসল না। বিনয় কাঁপছে। কাঁপছে ভয়ে ও লজ্জায়। এই নিঃশব্দ আচমকা বাধায় জ্বরতপ্ত করে তুলল ওকে। কী করবে। পালাবে, না নেমে যাবে গঙ্গায়।
কিন্তু কিছুই করতে পারল না। ঠিক সুমিতার মতোই বসে রইল আড়ষ্ট হয়ে।
সুমিতার মনে হল, কী একটি কঠিন বস্তু ঠেলে উঠছে থেকে থেকে। তাকেও ধরে রাখছে ঢোঁক গিলে গিলে।
কাছে দূরে মেয়ে পুরুষের নিচু গলার কথা ও হাসি শোনা যাচ্ছে। মোটরের হেডলাইট মাঝে মাঝে লেহন করে যাচ্ছে পলকে।
অনেকক্ষণ পর, বিনয় অনেক শক্তি সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল, রাগ করছ সুমিতা।
সুমিতা উঠে দাঁড়াল। রাস্তার আলোর একটি রেশ নিঃশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর মুখে। সেই মুখে একটি বিচিত্র বিষণ্ণ মিগ্ধ হাসি। বিনয়ের দিকে ফিরে তাকাল। হঠাৎ যেন ওর চোখে স্নেহের ধারা পড়ল গড়িয়ে বলল, রাগ করব কেন? রাগ করিনি, কিন্তু আমি তা পারিনে বিনয়।
আশ্চর্য। বিনয়ের মনে হল, ওর চেয়ে অনেক বড়, অনেক গম্ভীর স্নেহশীলা একটি একেবারে অন্য মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। এর সঙ্গে তো সে বেরোয়নি বাড়ি থেকে। এই হাসি, এই কথা, এই মূর্তির সঙ্গে তো কোনও পরিচয় নেই ওর কোনওকালে।
সুমিতা বলল, তুমিই হয়তো রাগ করলে?
বিনয়ের চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠল। ঢোঁক গিলে বলল, না।
তারপর দুজনে হেঁটে এল চৌরঙ্গিতে। সুমিতাই জিজ্ঞেস করল, আর কোথাও ঢুকবে?
বিনয় বলল, না। আজকে এবার বাড়ি যাই।
ট্যাক্সি ডেকে ওঠবার আগে সুমিতা বলল, বাড়িতে আসবে তো বিনয়?
বিনয় যেন একটি দিশেহারা করুণ শিশু। নীরবে শুধু ঘাড় কাত করল। ওকে পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটল দক্ষিণে।
গাড়ির মধ্যে ঢুকে বসতেই চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল সুমিতার দৃষ্টি। কেন এমন হল। কোনওটাই যে ওর ইচ্ছাধীন ছিল না। বড় বিচিত্রভাবে শুধু মনে হল, নানা, মনের সেখানে বিনয়ের কোনও ছায়া তো নেই। সেখানে বিনয় শুধু সঙ্গী, খেলার সঙ্গী।
বাড়ি ঢুকে দেখল বাইরের ঘরে বাবা, মেজদি আর মৃণাল বসে আছে। মৃণালের মুখ লজ্জিত, কিন্তু দীপ্ত। কী যেন আলোচনা চলছিল। ওকে দেখে মৃণাল বলে উঠল, কংগ্রেচুলেশন!
.
১৮.
কোনওরকমে মুখে হাসি টেনে, একটু দাঁড়িয়ে, সোজা ভিতরে চলে গেল সুমিতা। কাপড় ছাড়ার কুঠরিতে গিয়ে সুদীর্ঘ আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ বিস্মিত বিহ্বল হয়ে। তারপর আস্তে আস্তে হাত দিয়ে স্পর্শ করল ঘাড়ে, যেখানে বিনয়ের ঠোঁট স্পর্শ করেছিল। না, কোনও জ্বালা নেই সেখানে, অপমান নেই, শুধু এক দুর্বোধ্য বেদনা। সমস্তটাই একটি নিরানন্দ শৈথিল্যের মধ্যে যেন বার বার নিজের কানেই ফিসফিস করছে, না, না, এ সে নয়, এ সে নয়।
কুঠরির বাইরে এসে দেখল, মহীতোষ চলে গেছেন নিজের ঘরে। বড়দি ফেরেনি এখনও।
বাইরের ঘরে ঢুকে দেখল, সেখানে কেউ নেই। দাঁড়াল থমকে সুমিতা। বাইরের বারান্দায় শোনা যাচ্ছে গলার স্বর। মৃণাল আর মেজদির। কথার গুঞ্জনের ফাঁকে সুগতারচ্চাপা হাসির নিক্কণ উঠল বেজে।
পায়ে পায়ে ফিরে গেল সুমিতা শোবার ঘরে। সমস্ত ব্যাপারটাই শব্দহীন অথচ দৃঢ়স্বরে যেন ঘোষণা করছে একটি কথা। এক অনিবার্য, অপরিহার্য পরিণতি। সুগতা-মৃণাল, সুগতা-মৃণাল।
অনেকক্ষণ বসে রইল ও টেবিলে মাথা গুঁজে। তারপর গেল খাবার ঘরে। অনেকগুলি ফাইলপত্র নিয়ে বসেছেন মহীতোষ।
এক মুহূর্ত সুমিতার মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে হঠাৎ একটু হাসলেন মহীতোষ। বললেন, তুমি যাওনি বাইরের ঘরে?
সুমিতা বলল, ওরা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
মহীতোষ একটু অর্থপূর্ণ হেসে বললেন, ও।
তারপর ফাইলের দিকে চোখ রেখে বললেন, মৃণালকে তোমার কেমন লাগে রুমনো সাহেবা।
চকিতের জন্য মন বিস্ময়ে একটু মোচড় দিয়ে সহজ হয়ে গেল সুমিতার। এক মুহূর্তেই সমস্ত অস্পষ্টতাটুকু গেল উড়ে। বলল, ভাল।
মহীতোষ বললেন, ঝুমনো আর মৃণাল এনগেজড, তুমি জানতে?
ও জানত না। জানাজানির মাঝামাঝি ছিল। চোখে মুখে ওর কোনও বিস্ময় কিংবা আনন্দের চিহ্ন দেখা গেল না। বলল, জানতুম না। এক একবার মনে হত।
মহীতোষ একটু অবাক হলেন সুমিতার মুখের ছায়া ছায়া নির্বিকার ভাব দেখে।
মহীতোষ বললেন, ওরা দুটিতে সুখী হবে, নয় রুমনো সাহেবা?
মনের কোথায় যেন একটি আঘাত লেগেছে সুমিতার। মহীতোষের সামনে সেটুকু চাপবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারল না। বলল, নয় কেন?
মহীতোষ আর একবার সুমিতার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। রুমনির ব্যবহারে অবাক অস্বস্তিতে ভরে রইল মন। এই তাঁর প্রথম মনে হল, রুমনি অনেকখানি বড় হয়ে উঠেছে মনে মনে। সহসা ইচ্ছে করলেই আর ওর মনের কথা টের পাওয়া যায় না।
মৃণাল চলে গেছে। মেজদিকে দেখে বিস্ময়ের আর সীমা নেই সুমিতার। দুবার গুনগুন করে উঠেছে বোধ হয় নিজেরই অজান্তে। কানের পাশ দিয়ে কয়েক গুচ্ছ চুল এলিয়ে পড়েছে গালে কপালে। কেমন যেন একটু ভাব-বিভোর, বেসামাল। থেকে থেকে, আপনা আপনি চিকচিক করে উঠেছে ঠোঁটের বাঁকে।
খাওয়ার পর, শুতে এসে মেজদি জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছলি রুমনি।
সুমিতা কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপরে বলল, অনেক জায়গায়। রবিদাকে খুঁজেছিলুম আজ, দেখা পাইনি।
কিন্তু সুগতার আর সেদিকে খেয়াল নেই। গালে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়েছে টেবিলের উপর। ঠোঁটের উপর কলম চেপে যেন কিছু ভাবছে।
সুমিতা আবার বলল, রাজেনদার সঙ্গেও দেখা করেছিলুম।
সুগতা চমকে ফিরল একেবারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। যেন সভয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?
সুমিতা কেমন ঘাবড়ে গেল। হঠাৎ যেন অপরাধ করে ফেলেছে কথাটি বলে। পুনরাবৃত্তি করল কথাটি। দেখল, মেজদির দীপ্ত মুখখানি পাংশু হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল আড়ষ্ট হয়ে। একটি অস্পষ্ট অপরাধবোধ বাড়তে লাগল সুমিতার মধ্যে। বলার পূর্বমুহূর্তে কেন যেন ওর এক বার মনে হয়েছিল, রাজেনদার নামটি একটি অসঙ্গতির সৃষ্টি করবে হঠাৎ।
তারপর, একটি নিশ্বাস ফেলে সুগতা নিজেকে শান্ত করল অনেকখানি। বলল, ও! কোথায় দেখা করলি?
সঙ্ঘের অফিসে।
সুগতার মুখে শুধু গাঢ় ছায়া। বলল, হঠাৎ, কেন রে?
–পরীক্ষার সংবাদ দিতে।
–ও। কী বললে রাজেন?
–তোমার কথা বললেন, সাত দিন যাওনি।
সুগতার মুখ ক্রমেই একেবারে আড়াল হয়ে যাচ্ছে সুমিতার দিক থেকে। বলল, আর কী বললে?
সুমিতা বলল, বললে, তুমি বুঝি খুব পড়ছ, তাই আর যাবার সময় পাও না।
তারপর অনেকক্ষণ আর কোনও কথা নেই। কেবল পাখার ব্লেডগুলি শূন্যতাকে ফরফর করে কাটছে নিঃশব্দে।
সুমিতা আবার বলল, মেজদি, বাবা বললেন, তুমি আর মৃণালদা এনগেজড?
যেন অনেক দূর থেকে সুগতার স্বর ভেসে এল, হুঁ।
সুমিতার ঠোঁটের তটে ভীরু-সংকোচের হাসি। কী একটা কথা বলতে চাইছে, পারছে না। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য বেগে কলকল করে আসছে সেই কথা। দাঁত দিয়ে দংশাচ্ছে সুমিতা ঠোঁটের প্রান্ত। যেন দংশে দংশে ধরে রাখবে কথাগুলি।
শেষ পর্যন্ত বলতে হল ওকে, জানো মেজদি–
–অ্যাঁ?
–আমি, আমি ভাবতুম, তোমার বিয়ে হবে রাজেনদার সঙ্গে।
চকিত ভীরু বিস্ময়ে কুঁচকে উঠল সুগতার ভ্রূ। বলল, কেন?
ঢোঁক গিলল সুমিতা! ভাবল, মেজদি নিশ্চয় রেগেছে। বলল, এমনি।
এমনি! এমনি যে নয়, সেটুকু বুঝল ওরা দুজনেই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। সুমিতা আবার বলল, জানো মেজদি, আগে আমি সত্যি মনে করতাম, রাজেনদা রাগি আর গম্ভীর মানুষ। কিন্তু এখন মনে হয়, রাজেনদাকে আমরা বুঝতে পারি না। মনে হয়, রাজেনদা এক আশ্চর্য মানুষ। আমাদের কাছ থেকে অনেক, অনেক দুরে, কীসের এক ঘোরে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, না? গম্ভীর ঝুমনো, রুমনির মেজদি আজ যেন ছোট বোনের কাছে কেবলি বিব্রত হয়ে পড়ছে। সুমিতার এক বারও খেয়াল হল না এনগেজমেন্টের সংবাদের পর এমনি করে আর রাজেনের বিষয় বারে বারে উত্থাপন করা উচিত নয়। তবু না বলে পারল না, হ্যাঁ, রাজেন অনেক বড়, অনেক দূরের মানুষ। কাছাকাছি থেকেও ওরা চিরকাল দূরে। গরিব বড়লোক, ওগুলো কোনও প্রশ্ন নয় ওদের কাছে। সংসারের কোনও কিছুর কাছেই ওরা ধরা দিতে চায় না। আমরা ওদের কেউ নই।
বলতে বলতে সভয়ে থামল সুগতা। ধিক্কার দিয়ে উঠল নিজেকে। ছি ছি, এ সব কী বলছে ও রুমনিকে। এ যে সবই নিজের তৈরি কথা, সবই মিথ্যে, ভয়ংকর মিথ্যে। সুমিতাও বিস্ময়ে যেন কুঁচকে উঠেছে ভিতরে ভিতরে। অনেক দূরের, অনেক বড় রাজেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মেজদি যে তার কেউ নয়, এ কথা তো কোনওদিন টের পায়নি সুমিতা। মেজদিকে বিমুখ করে ফিরিয়েছে। রাজেন, এ যে অভাবিত। আজও রাজেনের কথার মধ্যে, এ সংসারের কোনও সৃষ্টিছাড়া উক্তি শুনতে পায়নি ও। নির্বাক বিস্ময়ে সুমিতা তাকিয়ে রইল মেজদির দিকে।
সুগতার মনে হচ্ছে, একদিকে যেন ওর সব কথাগুলিই মিথ্যে। আর একদিকে সুমিতার সামনে মুখ খুলতে গিয়ে চেপে ধরেছে অস্বস্তিকর লজ্জা। দুদিকের চাপে রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠছে সুগতার। ঘামতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু। কিন্তু আশ্চর্য। ওর যে দীপ্ত গম্ভীর ব্যক্তিত্বের কাছে আর সবকিছুই ম্লান হয়ে যায়, সেটা হারিয়ে গেছে রুদ্ধশ্বাস অসহায়তার মধ্যে। নিজের কাছেই আটকা পড়েছে হঠাৎ। নিজেকেই যেন জবাব দিতে হচ্ছে নিচু গলায়, সংসারে একদল লোক আছে, যারা নিজের লক্ষ্য ছাড়া কিছু দেখে না, কাউকে না। সঙ্গী চায় না, পেছনও ফেরে না। রাজেন হল সেই দলের লোক। আমাকে বিয়ে করে ও নিজেই হয়তো দুঃখ পেত।
আবার! আবার মনে হল, এও মিথ্যে। যতই বলতে গেল, ততই পুড়তে লাগল সুগতার বুকের মধ্যে।
বিস্ময় থাকলেও ভীরু অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে সুমিতার মন। কেবলি মনে হল, কী একটা কষ্ট হচ্ছে মেজদির। কী একটি কথা বলতে পারছে না কিছুতেই। কেন ও এমন করে কথা বলছে সুমিতার সঙ্গে। ওর সেই দীপ্তি কোথায়। যা দেখে, সব সংশয় পেরিয়ে শুধু মেজদিকেই মনে হয়, ধ্রুব সত্য।
সুগতা নিজের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লাগল। নিজের এই অস্থিরতা আরও বেশি প্রকাশ হয়ে পড়ার আগেই সুমিতাকে অবাক করে দিয়ে বলল, নে, রাত হয়েছে, এবার শুয়ে পড় রুমনি।
বলে, বাতি অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল সুগতা। অন্ধকারে, দু চোখের কোল ভরে উঠল জলে। মনে মনে বলল, কই, কোনও মিথ্যে তো ও বলেনি। রাজেন যে সত্যি অনেক দূরে, বহু দুরে। আসলে যে ভয়টাকে ও চাপছে ভিতরে ভিতরে সে ভয় হল রাজেনের সঙ্গিনী হওয়ার। দূরে যেতে আপত্তি নেই, কিন্তু কত দূরে। জীবনের কোন গহনে! সেই সুদূর পথের কোনও সীমারেখা তো সুগতা দেখতে পায়নি।
আবার মনে হল, মিথ্যে বলছে। আসলে নিরাপত্তার ভয়ে পালিয়ে এসেছে ও। নিরাপত্তা, সুখ, আনন্দ, সমাজের মান-সম্মানের কাছে পালিয়ে এসেছে ভয়ে। রুমনির সন্দেহটাই বুঝি সত্যি।
কিন্তু কই, রাজেনকে দেখে তো ওর অবস্থার কথা মনে হয়নি, কোনওদিন। শুধু মনে হয়েছে, সতেজ ডানাওয়ালা দুর্গম আকাশের পাখি রাজেন। শাণিত চঞ্চু সাহসী তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি বহু দূরে। অনেক বড়, সুদূর ব্যাপ্ত আর ভয়ংকর।
বুকে যত অস্থিরতা, ততই চোখ ভেসে গেল জলে। এ অঞ ওর দুঃখের নয়, ব্যথারও নয়। নিজের সঙ্গে বিবাদের এই চোখের জল।
একেবারে নিস্তব্ধ হয়েছে নগর, পাশের খাটে শোনা যাচ্ছে সুমিতার ঘুমন্ত নিশ্বাস। সুগতার চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃণালের মুখ। সেই মুহূর্তে মনের সমস্ত বিবাদের জোড়টা ছড় খেয়ে, একটি অবোধ ব্যাকুলতা দেখা দিল। মৃণালের প্রত্যাশা ব্যাকুল চোখ। সেই ছায়ার মতো ঘোরাফেরা সুগতার আশেপাশে।
সবকিছু ছাপিয়ে বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল মৃণালের জন্যে। অনেকক্ষণ চলে গেছে মৃণাল। অনেক রাত হয়েছে। কিন্তু মনের যোঝাযুঝির মধ্যে শুধুমৃণালের কথাই মনে হতে লাগল। কীসের এত দুশ্চিন্তা, বিচার বিশ্লেষণ। সুগতা তো মৃণালকে ভালবেসেছে। এর মধ্যে কোথায় যুক্তি নিরাপত্তার, ভয় কোথায় রাজেনের সঙ্গিনী না হতে পারার। ও ভালবেসেছে মৃণালকে। মৃণালকে, আর কিছুকে নয়। আর কাউকে নয়।
ভেজা চোখ বন্ধ করল সুগতা। ভোের হতেই বিছানা ছেড়ে উঠল। বেশবাস গুছিয়ে নিল যেমন তেমন করে। তারপর কাউকে কিছু না বলে, রাস্তায় গিয়ে চেপে বসল একটি উত্তরগামী বাসে। নামল এসে একটি বড় বাড়ির সামনে।
মৃণালের দিদিমার বাড়ি। এখানেই থাকে সে। তখনও নিঝুম বাড়ি ভাড়াটে নেই, শুধু দিদিমা-নাতি আর ঠাকুর চাকরের বাসস্থান। মৃণালের বাবা মা থাকেন অন্যখানে। চেনা বাড়ি, চেনা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে, চাকরের সঙ্গে দেখা। সে বেচারি চোখ ঘষে দেখে বলল, আপনি? দাদাবাবু তো ঘুমোচ্ছেন।
সুগতা ফিসফিস করে বলল, দিদিমা কোথায়?
চাকর বলল, উনিও ঘুমোচ্ছন।
সুগতা বলল, ঠিক আছে। তুমি যাও, আমি মৃণালের ঘরে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ নেই তো?
আজ্ঞে না।
করুক লজ্জা, হোক মুখ লাল। কিছুতেই নিজেকে চাপতে পারছে না সুগতা। মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব যেন তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে ওকে! রাত্রের সমস্ত কথাগুলি মিথ্যে। অকারণ ভয়ে ওকে খুঁজেছে, মেরেছে, চটকেছে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে। জীবনের পথ থেকে সুগতা বিচ্যুত হয়নি। ভালবেসেছে ও মৃণালকে, অসহায় পঙ্কিলাবর্তের জীবনকে তুলে এনেছে নিজের পাশে। এ-ই তো সত্য। রাজেন সাহসী শক্ত দৃঢ়। সে চলবে নির্ভয়ে একলা। সুগতাকে তার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ভীরু ভঙ্গুর মৃণালের।
ঢুকে দেখল, উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছ মৃণাল। স্প্রিং-এর গদিতে ঢুকে গেছে বুক চেপে। দামি আসবাবে ভরা ঘর, কিন্তু অগোছালো। অ্যাশট্রেটা ছাপিয়ে উঠেছে পোড়া সিগারেটের চাপে।
সুগতা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল অপলক চোখে। ভারী অসহায় মনে হচ্ছে মৃণালকে। পিছন দিকে এক বার তাকিয়ে, দুহাতে মৃণালের মাথাটা দিল ঝাঁকিয়ে।
মৃণাল ঘুমন্ত চোখ খুলে এক মুহূর্ত বিমূঢ় বিস্ময়ে রইল চেয়ে। তারপর চকিতে উঠে বসে বলল, তুমি? কী হয়েছে?
সুগতা হেসে বলল, কিছু না। শুয়ে পড়ো, আমি চলে যাচ্ছে। বলে সত্যি সত্যি পিছন ফিরল।
তখনও যেন অবাক ভয়ে দিশেহারা মৃণাল একেবারে পাথর হয়ে রয়েছে। চলে যায় দেখে লাফ দিয়ে উঠে পথরোধ করে দাঁড়াল। উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী হয়েছে, বলে যাও সুগতা।
যেন ভয়ংকর একটা কিছু শোনবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে মৃণাল। সুগতা হেসে ফেলল। বলল, কিছু নয় সত্যি।
কিন্তু মৃণালের কপাল সর্পিল হয়ে উঠল এক অজানা দুশ্চিন্তায়। বলল, তবে? হঠাৎ এসে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছ, যে?
মৃণালের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বলল সুগতা, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। একটু চুপ করে আবার বলল, এমন সব বাজে ভাবনায় পেয়ে বসেছিল রাত্রে, কিছুতেই না এসে পারলাম না। মাঝখান থেকে তোমার ঘুমটি গেল।
একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল মৃণাল, তাই ভাল। এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো।
–কেন, ভয় কীসের?
কী জানিভাবলুম, কিছু একটা অপরাধ করে ফেলেছি হয়তো।
মৃণালের মুখের দিকে কয়েক নিমেষ তাকিয়ে রইল সুগতা। বলল, তোমার দেখছি সব সময়েই কী এক অপরাধের ভয়। মনের মধ্যে এত অপরাধবোধ কেন?
–ও কিছু নয়। এটাও বোধ হয় তোমার কাল রাত্রের ও সব বাজে ভাবনার মতো। সে যাক, চলে যাবে কেন? বসো।
না বাড়িতে বলে আসিনি। তোমার দিদিমাও এখুনি দেখে আবার মুখ ভার করবেন।
সে কথা মিথ্যে নয়। মৃণালরা উত্তর কলকাতার সেকেলে পরিবার। দিদিমার বাড়িতে বরং সেকেলে আভিজাত্যেরই বাড়াবাড়ি। দিদিমাও তাই। মৃণালের বউ হিসেবে সুগতাকে ভাবতেই পারেন না। কাঁধে ব্যাগ, ছাত্র-নেত্রীকে নাতবউ বলে ভাবতে গিয়ে মন বেঁকে আছে প্রথম থেকেই। সুতরাং কথা পারতপক্ষে বলেন না। শুধু লোমহীন ভ্রূ দুটি বৃদ্ধার কুঁচকে ওঠে। কিন্তু মৃণাল বড় আদরের নাতি। যত আপত্তিই থাক, সেখানে কোনও কথা চলে না।
দিদিমা একদিন বিদ্রূপ করে বলেছিলেন সুগতাকে, ও! তোমারই ভয়ে খোকা গাড়ি চড়া ছেড়েছে?
লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেছল সুগতা। বলেছিল, না তো! গাড়ি থাকলে চাপবে না কেন? পরে শুনেছিল, আসলে মৃণাল নাকি বলেছিল, বিয়ে না করে আর গাড়ি চাপব না। কিন্তু দিদিমার আপত্তি না থাকার আর একটি গুঢ় কারণ ছিল। সেটাও উনি নিজেই বলেছিলেন, তোমার ভয়েই খোকা মদ খাওয়া ছেড়েছে শুনলুম। খুব ভাল।
কথাগুলি যেন কেমন মাপা মাপা, স্নেহহীন। তারপরে বলেছিলেন, তবে, মেয়েছেলেকে এত বেশি ভয় করে চলাটাও বাপু বড় ভয়ের কথা।
তবু বসতে হল সুগতাকে। মৃণাল বলল, আমি বরং তোমাদের পাশের ডেপুটি বাড়িতে একটা ফোন করে দিই।
সুগতা বলল, না না, ততক্ষণ বসব না। আর বাড়িতেই বা কী ভাববে।
নিরস্ত হতে হল মৃণালকে। বলল, কিন্তু রাত্রের বাজে ভাবনাগুলো কী তা তো বললে না।
সুগতা অন্যদিকে মুখ ফিরে বলল, সে সব কিছু নয়।
মৃণালের অপরাধ বোধ, সেটা ও কিছু নয়। সুগতার বাজে ভাবনাগুলিও সে কিছু নয়। কিন্তু দুটো কিছু নয় মিলে এমন একটি অদৃশ্য কিছুর মতো খচ খচ করতে লাগল দুজনের মাঝখানে।
মৃণাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুগতার দিকে। ওর পুষ্ট বলিষ্ঠ শরীরের প্রতি অঙ্গে এক আশ্চর্য দৃঢ়তা। এক একসময়ে, বাইরে থেকে দেখলে আকস্মিক ধাক্কা লাগে চোখে। যেন প্রতিটি রেখা ওই তীব্র রং-এর মাঝে বড় তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। কিন্তু, এই এলোমেলো বেশবাশে, রুক্ষ চুলে, বুকের আঁচল ছাপিয়ে ওঠা জামার ফিতের মধ্যেও একটি অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব রয়েছে ফুটে।
চোখাচোখি হতেই সুগতা বলল, কী হল? কথা বলছ না যে?
মৃণাল উঠে দরজাটা বন্ধ করতে গেল। সুগতা একেবারে লাল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বলল, না, না, ওকী? বাড়ির লোকেরা কী ভাববে। খুলে রাখো।
মৃণালও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তা বটে। তবে বসো, আমি চা দিতে বলি।
মৃণাল চলে গেল। সেইদিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে উঠল সুগতার মুখ। দেয়ালের দিকে ফিরে তাকাল ও বিভূতির আঁকা একটি ছবির দিকে। ক্রোকুইল নীবে, চায়নিজ কালির ছবি, একটি মেয়ে গালে হাত দিয়ে, রেলিং-এ ভর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে পথের এলোমেলো ভিড়ের দিকে।
.
১৯.
এ বাড়িতে এখন প্রতি দিন রাত পোহায় নতুন ঘটনা, নতুন বিস্ময় নিয়ে। বড় ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিত আর স্পষ্ট ফাটল-রেখাঁটি দিনে দিনে বাড়ছে সর্পিল হয়ে। অন্তরালে বসে কে যেন ভয়ংকর শক্তিতে, অন্ধ আক্রোশে চাড় দিচ্ছে দিবানিশি।
যত বিস্ময়, তত বেদনা এ সংসারে। সুমিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, সুখ নেই এ সংসারের কারুর। কোথাও নেই। আজ এই মুহূর্তে যা সুখ, পরের দিনে ফিরে আসে সে দুঃখের বেশে। শুধু অপরকে দিয়ে নয়, নিজেকে দিয়েও এখন বারংবার মনে হয় সে কথা। সেই যে স্বপ্ন দেখেছিল, নিজে যেন একটি চিত্রবিচিত্র পাতাবাহারের ঝাড়, নানান পাখির জটলা তার ডালে ডালে, সেটা হঠাৎ দাঁড়িয়েছে এখন রং ফিরিয়ে। একদিকে মরণ ধরেছে পাতাবাহারের স্বপ্নে, আর একদিকে পুরোপুরি অচেনা লাগছে জীবনের এই বিচিত্র ঝাড়টিকে।
সুগতা কাটিয়ে উঠেছে ওর সেই রাত্রের সংশয়াবস্থা। ফিরে এসেছে আবার দীপ্ত প্রখর্য, তার সঙ্গে এক সুগভীর ঘোর। শুধু ঠোঁটের কোণে কঠিন রেখাঁটি চিকটিক করে যেন অন্তরের কোনও গূঢ় রহস্যের মতো। সুগতার রক্তধারায় যে একটি নেশার আমেজ লেগেছে, সেটুকু পাঠ করা যায় ওর মুখে, শরীরের প্রতিটি রেখায় রেখায়, চলাফেরায় কথায়।
তবু সংশয় সুমিতার। সংশয়, মেজদিকে হয়তো বুঝতে পারছে না। যা দেখছে, সবই মিথ্যে।
সংশয় শুধু সংশয়। জীবনের এই শুরুতেই নিরন্তর সংশয় পায়ে পায়ে ফিরছে। ভয়, কখন হোঁচট খেয়ে পড়বে মুখ থুবড়ে।
কিন্তু এত কথা ভাববার অবকাশ ছিল না সুমিতার। সকালবেলা লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দিকে দেখে ভয়ে মরছে ও এখন। ভয় হচ্ছে, যদি চোখখাচোখি হয়ে যায় বড়দির সঙ্গে। দেখা হয়ে যায় সকলের সামনে। বাইরের ঘরেই রয়েছে মেজদি। জামাকাপড় পরছেন বাবা নিজের ঘরে। সকলের সামনে যখন দেখাদেখি হবে, তখন কী হবে।
এত দিন, সুজাতাকে সাদা শাড়ি পরতে দেখেছে সবাই। সবাই দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু কার্যকারণে অনুমানে অবাক হয়নি কেউ।
আজ বড়দির সর্বাঙ্গে রং। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তাই ফিরে এসেছে সুমিতা। আজ আলমারি উজাড় করে, বেছে পরেছে শাড়ি। ড্রেসিং টেবিল উজাড় করে মেখেছে রং। এত দিন তাকানো গেছে, আজ তাকাতে গিয়ে ভয়ে ধুকধুক করছে বুকের মধ্যে। আজ আর তাকানো যায় না। আনন্দে হেসে উঠতে গিয়েও মনে হল, কী এক সর্বনাশের আয়োজন করেছে বড়দি সর্বাঙ্গের সাজে।
ঈষৎ উন্মুক্ত দরজা দিয়ে আর এক বার ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে পালিয়ে গেল সুমিতা বাইরের ঘরে।
শেষ মুহূর্তে চোখে কাজল টানল সুজাতা। তারপর ফিরে তাকাল আয়নার দিকে। হাসল একটু। রং মাখা ঠোঁটের কোণ টিপে আছে যেন লুক্রেজিয়ার দীপ্তি নিয়ে। কেউ নেই, দেখেনি কেউ। তবু দ্রুত নিশ্বাসে কম্পিত নাসারন্ধ্র। লিপস্টিকের চাপা তীব্র গন্ধটাও কেমন যেন শ্বাসরোধ করতে চাইছে।
আবার তাকাল ঈষৎ ঘাড় ফিরিয়ে, হৃ তুলে। যেন সামনে রয়েছে আততায়ী, ধরাশায়ী করছে মর্মভেদী বাণে। ঘাড়ের উপরেই নিপুণ করে বাঁধা সুবিস্তৃত খোঁপা। তারপর এক ঝলক রোদের মতো নেমেছে উন্মুক্ত সুছাঁদ গ্রীবা ও পিঠ। অনেক নীচে গিয়ে ঠেকেছে জামরং জামার বোতামপটিতে। সামনেও নেমেছে তেমনি অসংকোচে, যেন সহসা উল্লাসে মত্ত নিরুদ্দিষ্ট গতিতে। ভয় ধরানো এক সীমারেখায় এসে থেমেছে, যেখানে এসে সুগভীর অন্ধকার রয়েছে থমকে এক বিচিত্র ইশারা নিয়ে। কী এক তীব্র বিদ্বেষ আর শ্লেষে অসংকোচ করছে সারা দেহ। পিঙ্ক সিল্কের অবাধ্য সজ্জা রেখায় রেখায় কিলবিল করছে সাপের মতো।
ড্রয়ার খুলে একটি ঝুটো মুক্তার হার পরল গলায়। চোখে গগলস পরতে গিয়ে আবার তাকাল থমকে। আপন মনেই বলল শ্লেষ চাপা সুরে, দেখবে! দেখুক। দেখুক দেখুক, তা-ই তো আমি চাই। দেখে ভাববে, অনেক দূর নেমেছি। ভাবুক। নেমেছিই তো। বলে হাসতে গিয়ে থেমে গেল। গম্ভীর হল মুখ। তারপর এক মুহূর্ত অবশ হয়ে রইল সারা শরীর। কণ্টকিত হল তীব্র ঘৃণায়।
আবার হাসল। মনে পড়ল অমলার কথা, এটুকু দরকার। সাজতে গিয়ে যদি কলঙ্ক হয়, তোক। মিথ্যে বৈরাগিনী হয়ে ফিরে লাভ কী!
তবু দরজার পরদাটা সরাতে গিয়ে হাত দুটি উঠছে না কিছুতেই। যেন কত ভার, কত ভারী এই সামান্য পরদা। তাড়াতাড়ি গগলস পরে, দু চোখ আড়াল করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মহীতোষ বেরিয়ে এলেন নিজের ঘর থেকে। দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন কয়েক লহমা। চিনতেই পারেননি যেন। সুজাতা ততক্ষণে হেঁটে এগিয়ে গেছে বাইরের ঘরে।
মহীতোষ যেন পাংশু হয়ে উঠলেন ভয়ে। দ্রুত পায়ে বাইরের ঘরে এসে ডাকলেন, উমনো, উমনো শোন।
এই আশঙ্কাই করেছিল সুমিতা। তাকানো যায় না, তাকানো যায় না সত্যি বড়দির দিকে। কী ভয়ংকর, সুন্দর দুর্বিনীত সাজ। যেন পথে পথে সমস্ত মানুষের বিবেককে পুড়িয়ে দিয়ে যাবে।
সুগতাও চমকে উঠেছিল। বিস্ময়-দীপ্ত চোখে দেখতে লাগল সুজাতাকে। গগলসটা খুলল না। ফিরে দাঁড়াল সুজাতা। বুকের মধ্যে কেমন যেন ধকধক করছে। ওর নিজের মনেও ছিল এই আশঙ্কা। এ বাড়ির ঘোর উৎসবের দিনেও যে এমন করে সাজেনি কোনওদিন সুজাতা। মহীতোষের ডাক শুনে ফিরতে গিয়ে সহসা ওর মুখের রং-এর পর রং উঠল ফুটে। তবু নিজেকে শক্ত করে বলল, কী বলব?
এই কয়েক মুহূর্তেই মহীতোষের মুখে কে অনেকখানি হিজিবিজি দাগ কেটে দিয়েছে। ঘাম দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু। হাত দিয়ে টেবিলটা ধরে এক বার দেখলেন সুজাতাকে। উৎকণ্ঠা চেপে, অকম্পিত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি উমনো, তিন দিন ধরে একই সময়ে?
সুজাতা কয়েক নিমেষ ঠোঁট টিপে নির্বাক রইল। ওর মুখের ভাব অনেকখানি চাপা পড়েছে চোখের আবরণে। সেটা নিজেও জানে সুজাতা। এক বার সুমিতা আর সুগতা, দুজনাকেই দেখল আড়চোখে। বলল, কাজে।
কাজে?
নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারেননি মহীতোষ। দু পা এগিয়ে এসে, ঘাড় কাত করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়।
সুজাতা দেখল, মহীতোষের লং প্যান্টটা যেন কাঁপছে। ফ্যান ঘুরছে, বাতাসে কাঁপছে। কিন্তু টাই-এর বন্ধনীর মুখে কলারটা ভিজে উঠছে ঘামে। চোখ থেকে গগলস খুলে নত চোখে জবাব দিল সুজাতা, কাজে যাই।
আবার একটুক্ষণ নীরবতা। মহীতোষের মুখের রেখায় একটি অদ্ভুত কাঠিন্য দেখা দিল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?
সুজাতা চকিতে দেখল এক বার মহীতোষের মুখের দিকে। বলল, কারদেজোয়।
মহীতোষের মুখের রেখা গভীরতর হল। বললেন, কারদেজোয়? অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি?
–হ্যাঁ।
কীসের কাজ?
ম্যানেজারের পার্সন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।
ম্যানেজার। বোধ হয় এক বার স্মরণ করবার চেষ্টা করলেন মহীতোষ কারদেজোর ম্যানেজারকে। কোথায় যেন শুনেছেন কিংবা দেখেছেন ভদ্রলোককে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। গিরীনদের অন্তরঙ্গ বন্ধু, ইওরোপ-ফেরতা শুভেন Cardezoর ম্যানেজার। সুজাতার বিয়ের সময় ভদ্রলোক এসেছিলেন তাঁর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পার্সন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে। সে মেয়েটিও নিমন্ত্রিতা ছিল।
হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা কেমন ঘুলিয়ে গেল মহীতোষের কাছে। কেবল একরাশ সংশয়, ভয় ও বেদনা তাঁকে গ্রাস করতে লাগল। সমস্ত ব্যাপারটিকে সর্বাঙ্গীণ চিন্তা করতে পারলেন না। দিশেহারা উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করলেন, কেন উমনো?
সুজাতা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বলল, কাজ করার আবার কেন, কী আছে? এভাবে বসে থেকে লাভ? তা ছাড়া
মহীতোষের হাত বোধ হয় সত্যি কাঁপছিল। বললেন, কী, বলো?
সুজাতা বলল, তোমাকে তো বলেছি, আমি কারুর গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাইনে।
মহীতোষের স্বর স্তিমিত চাপা হয়ে এসেছে, কার গলগ্রহ তুমি? আমার?
সুজাতা এক লহমা নির্বাক থেকে বলল,নয়? নইলে তুমি কেন মফস্বলের মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়ে চাকরি নিয়েছ, বলো?
সভয়ে কন্টকিত হয়ে সুমিতা ফিরে তাকাল মহীতোষের দিকে। ভাবল, ওকেই সন্দেহ করবেন বাবা, বড়দিকে বলেছে ভেবে। কিন্তু মহীতোষ ফিরে তাকালেন না ওর দিকে। কেবল সুগতা অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। মহীতোষের চাকরির কথাটা শুধু ওর কাছেই একেবারে আকস্মিক।
মহীতোষের দু চোখে যেন অশ্রুহীন কান্নার আভাস। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, ঢোঁক গিলে বললেন, উমনো, চাকরি নিয়েছি, সে কি তুমি আমার গলগ্রহ বলে। আর কিছু নয়?
–আর আমার জন্যে দুশ্চিন্তা। সেজন্য তুমি রবিকেও পাঠিয়েছিলে আমার কাছে। অকারণ তুমি আমার জন্যে দুর্ভাবনা করছ। শুধু দুর্ভাবনা নয়, হয়তো আমার ওপর রাগ করেই আবার এ বয়সে এরকম একটা চাকরি অ্যাকসেপ্ট করেছ। কিন্তু তার তো কোনও দরকার ছিল না।
মহীতোষ বললেন, রাগের কথাটা ঠিক নয় উমনো। আর দুশ্চিন্তার কথা বলছ। তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা, সেটা তো কেউ ঠেকাতে পারবে না। তুমি চাকরি নিলেও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব কি?
সুজাতা বলল, না হওয়ার তো কারণ দেখিনে।
বলতে বলতে হঠাৎ কঠিন হল সুজাতার মুখ। বলল, আমার জন্যে কাউকে আমি দায়ি করতে চাইনে। কোনওকিছুর জন্যই নয়। নিজের দায়িত্বটা আমার নিজেরই। তুমি শুধু নিজের মনের সান্ত্বনা খুঁজলে কী করে হবে। আমার নিজের সান্ত্বনারও দরকার আছে।
মহীতোষ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য! চাকরি করতে চাও করো, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এ যেন কেমন হয়ে গেল। যে জীবন আমি শুরু করেছিলাম, যেভাবে তোমাদের তিনজনকে নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ ভাবতুম, সে সমস্তই কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
সুজাতার গলার স্বরও নেমে এল এবার। বলল, সকলেরই যাচ্ছে বাবা। তোমার, আমার, সকলেরই। সেজন্য তুমি আমাকে দায়ি করতে পার না। আমিও তোমাকে দায়ি করতে পারিনে।
উমনো, কেউ আমরা কাউকে দায়ি করছিনে। হয়তো, ছোটকাল থেকে তোমাদের যেভাবে মানুষ করেছি, তার মধ্যেই কোনও গলদ থেকে গেছে। থেকে থাকলে সে গলদ আমার।
সমস্ত ঘরটি কেমন ব্যথিত বিহ্বল হয়ে উঠেছে। টনটন করছে সুজাতারও বুকের মধ্যে। এত নিপুণ সাজের মধ্যেও নিজেকে লাগছে যেন শ্রীহীনা অপরাধিনী। এক বছর আগে হলে হয়তো এখুনি গুটি গুটি পায়ে ফিরে যেত নিজের ঘরে। কিন্তু জীবনের, শুধু জীবনের নয়, মনের কোথায় একটি ভাঙন ধরে, তার টানা পথ বাঁক নিয়ে গেছে ঘুরে। সেখান থেকে আর উজানে ফেরা চলে না ওর। নিজের দেহ, মন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এক অনিশ্চিত সংশয়ের হাহাকার অনেকগুলি বাঁধা বিশ্বাসকে চুরমার করেছে। এখন, চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কেও বড় কষ্টদায়ক অস্পষ্টতা ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে শুধু রুদ্ধশ্বাস অসহায়তা গ্লানি, আত্মগোপন আর বিদ্রূপ নিজের প্রতি। বলল, আজ আর পুরনো কথা ভেবে লাভ কী?
বলে হাতের ঘড়ি দেখল সুজাতা।
মহীতোষ উৎকণ্ঠিত চাপা গলায় বললেন, কিন্তু আমার বড় ভয় করছে উমনো।
সুগতা উঠে মহীতোষের হাত ধরে বলল, তুমি বসো বাবা, ওরকম কোরোনা। ভয় পাচ্ছ কেন তুমি। চাকরি করুক না বড়দি। তুমি যেভাবে জীবন চেয়েছিলে, সেভাবে যখন হয়নি, তখন আমরা যে কেউ-ই চাকরি করি, সেটা তোমার মেনেই নিতে হবে। কিন্তু বড়দি
শক্ত মুখে ফিরে দাঁড়াল সুগতা, সুজাতার দিকে। তীব্র চোখে সুজাতার আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে কঠিন গলায় বলল, তোমার নিজের দায়িত্ব তুমি নিজে নেবে, তাতে কারুরই কিছু বলার নেই। কিন্তু নিজের সম্পর্কে স্ক্যান্ডালগুলো একটু কমাবার চেষ্টা করো।
সুজাতা মনের কাছে হার না মেনেও শেষ পর্যন্ত কেমন যেন অপরাধ বোধ করছিল মহীতোষের সামনে। তার ওপরে নিজেকে খুঁটিয়ে সাজানোটা কোথায় একটু পরাজয় বোধ জাগিয়েছে মনে। এক মুহূর্তে জীবনের সবটা মিলিয়ে ভিতরে ভিতরে একটি দুরাগত কান্নার নিঝর আসছিল ছুটে। সহসা সুগতার কথায় দপ করে জ্বলে উঠল মনের মধ্যে। রক্ত-ঠোঁট কুঁকড়ে বলল, কীসের স্ক্যান্ডাল?
সুগতারও সারা চোখে মুখে উত্তেজনার দপদপানি। রাগলে মনে হয়, ওই সকলের বড়, গম্ভীর, কত্রী। চাপা গলায় অদ্ভুত ব্যঙ্গ করে বলল, আমার চেয়ে তুমি সেটা ভাল জানো।
কিন্তু রাগ সুজাতারও কম নেই। ওর রাগ আজ আরও বেশি। কেননা ওর যে কোনও যুক্তি নেই ওই স্ক্যান্ডালের পিছনে, শুধু বিচ্যুত জীবনের দুঃখটাই আছে। রাগে রাগে আর কিছু নয়, বাঁধল শুধু বিপর্যয়। চাপা ছিল অনেক দিন, আজ ফেটে পড়ল চৌচির হয়ে। সুজাতা বলল ভাল জানি কি মন্দ জানি, সেটা আমিই বুঝব। তোর কাছে কোনও কৈফিয়ত দিতে পারব না।
মহীতোষের ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। এ বাড়িতে এমন অভাবনীয় ব্যাপারে, ভয়ে দুঃখে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছিল সুমিতার। কিন্তু, মন এমনি বিচিত্র কান্নাটা যতই থাক, কেমন একটি কৌতূহল ও উত্তেজনায় আড়ষ্ট নিশ্চল হয়ে বসেছিল ও। কান্নাটা আটকা পড়ে গেছে এক ভীরু বিস্ময়ের বাঁধে।
কথা বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল সুজাতা। কিন্তু এমনিভাবে চুপ করে যাওয়া সুগতার চরিত্র নয়। উদ্দীপ্ত গলায় বলে উঠল, ও সবের কৈফিয়ত শোনা-ও লজ্জার বিষয়। কিন্তু পারিবারিক সম্মানটা ভুলে যেয়ে না। তোমার মিসেস স্যামসনের আড্ডায় আর নাইট ক্লাবে যাওয়ার কৈফিয়ত তোমার বোনেরা লোকের কাছে দিতে পারবে না। ওগুলো ভদ্রমহিলাদের আস্তানা নয়।
বিন্দু বিন্দু ঘামে ধুয়ে যাচ্ছিল সুজাতার মুখের রং। ভয়ংকর ক্রোধে ওর বুকের অসংকোচ জামাটা দুলে দুলে উঠছে। একরাশ মকর-চোখের মতো ধকধক করে জ্বলছে ঝুটো পাথরের হার। চোখ রক্তবর্ণ। তীক্ষ্ণ গলায় যেন চাবুকের শিস দিয়ে উঠল, কাদের আস্তানা সেটা আমিই বুঝব, ভদ্রমহিলারা নিজেদের নিয়ে থাকুন।
চকিতে এক বার মহীতোষের ঘর্মাক্ত ভয়ার্ত ব্যথিত মুখের দিকে দেখে আবার বলল, পারিবারিক সম্মানে যদি আটকায়, পরিবার থাকুক। আমি কারুর সম্মানে আঘাত করতে চাইনে।
কী কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল সুগতা। নিমেষের জন্যে সুজাতার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
নিজেও জানে না সুমিতা, কান্না চাপবার জন্যে কখন আঁচল চাপা দিয়েছে মুখে। চোখের কূল ছাপিয়ে এসেছে জল।
যেতে গিয়েও দাঁড়াল সুজাতা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। চোখে ওরও জল এসে পড়ছে। ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মুছে নিতে লাগল।
মহীতোষ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু দাঁড়িয়েই আছেন।
কোনও শব্দ নেই। শুধু চারটি বুক বোধ হয় নিঃশব্দে ভাসছে অকূল পাথারে।
অনেকক্ষণ পর, সুজাতারই নিশ্বাসের শব্দে চমকে উঠলেন মহীতোষ। মুখে ফিরে এসেছে বিষণ্ণ শান্তভাব। সুজাতার কাছে গিয়ে বললেন, তোমার অ্যাটেনডেন্স কটায় উমনো?
সুজাতা ভেজা গলায় জবাব দিল, এগারোটায়।
শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন মহীতোষ, তা হলে তুমি বেরিয়ে পড়ো, লেট হয়ে গেছে। শুধু একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মা।
সুজাতা নিশুপ দাঁড়িয়ে রইল আরও একটু সময়। তারপর বলল, বাবা, তোমরা কত দূর ভেবেছ আমার বিষয়ে জানিনে। কত কথা শুনেছ তাও জানিনে। তোমাদের সবাইকেই বলছি, সমাজের আত্মীয় বন্ধুরা আমার দুরবস্থা দেখে শুধু করুণা করবে, সে আমি চাইনে। এ সমাজের কাছে কতটুকু আমার সম্মানের মূল্য বুঝিনে, সকলের করুণার চাইতে আমি যা করছি, তা-ই আমার ভাল।
মহীতোষ বললেন উমনো জীবনটা স্রোতের মতো। একদিকে বাধা পেলে সে আর একদিকে যাবেই। তুমি ঠিকই বলেছ, তোমার নিজের সান্ত্বনা তোমার কাছেই। বড় হলে, ছেলেমেয়েদের গোটা জীবনই চারদিকে বড় হয়ে পড়ে, তখন ছোটকালের কথা ভেবে আর তাকে আমার সান্ত্বনায় শান্তি দেওয়া কঠিন। তোমার কিছু হয়তো বুঝি, সব বুঝিনে। সেই সবটুকু নিয়ে তুমি নিজেকে যেন আঘাত করো না কখনও। তুমি বাড়ি ফিরে এসো কিন্তু তাড়াতাড়ি।
সুগতা সবচেয়ে অভিমানী মেয়ে। ওর সতেজ দীপ্তিতে সেইটাই থাকে ঢাকা পড়ে। মুখ ফিরিয়ে সুজাতাকে কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ছুটে চলে গেল ভিতরে।
সুমিতা বলল কান্না চেপে, তুমি বাড়ি ফিরে এসো কিন্তু বড়দি।
সুজাতা বেরিয়ে গেল। ওর বুকের মধ্যে এক অসহায় মেয়ে ব্যাকুল কান্নায় বারবার বলতে লাগল, ওরা আমার কিছু বোঝে না, কিছু না। নিজেরা ভয় পেয়ে আমাকে ভয় পাইয়ে আরও দুর্বল করে তুলছে।
ট্রামে কালিঘাটের মোড়ে এসে নামল সুজাতা। কথামতো, কাছেই অপেক্ষা করছিল অমলা গাড়ি নিয়ে। ক্ৰ কুঁচকে, রাঙানো ঠোঁটের ভঙ্গি করে বলল, খুব মেয়ে বাবা। তুই চাকরি করবি বটে।
সুজাতা ম্লানভাবে হাসতে চেষ্টা করল।
.
২০.
মরিস মাইনরের দরজা খুলে দিতে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে অপাঙ্গে তাকাল অমলা সুজাতার দিকে। পুঁইমেটুলি রং-এ রাঙানো ঠোঁট টিপে হাসল। মেয়ে বলেই বোধ হয় ওর প্রাণ এক বার বিস্মিতমাৎসর্যে উঠল কনকনিয়ে। কালিঘাটের ওই পথের মোড়ে অমলা, ওর নীল মরিস মাইনর, সব চাপা পড়ে গেছে যেন সুজাতার রূপ আর রং-এর ভারে। কিন্তু সে ক্ষণিক মাত্র। জ তুলে প্রায় রুদ্ধ গলায় বলল অমলা, টেরিবল! করেছিস কী?
সুজাতা বোধ হয় নিজেকেই ব্যঙ্গ করে হাসল ঠোঁট উলটে। বলল, যেমন বলেছিলি। নে, এখন উঠতে দিবি।
অমলা সরে গেল হুইলের পাশে। সুজাতা এসে পাশে বসতে অমলা বলল, সে যে অমন মারাত্মক হবে, তা ভেবে তো বলিনি। আজ তো কারদেজোর ম্যানেজার থেকে আর্টিস্ট, কেরানি, মায় লিফটম্যানটার পর্যন্ত অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে। বেচারিরা কাজ করবে কী করে!
সুজাতা ম্লান হেসে তাকাল সামনের দিকে। অমলার হাত উঠে গেল।
সুজাতার কাঁধে, রাঙানো নখ বিছের মতো পিল পিল করে কণ্ঠা বেয়ে, গাল টিপে ধরে ফেরাল নিজের দিকে। বলল ফিসফিস করে, আমারই প্রাণটা কেমন করছে।
বলে অসংকোচে একমুহূর্ত ঠায় সুজাতার মুখ ও বুকের দিকে তাকিয়ে বলল, আয়নায় দেখিছিলি তো এক বার নিজেকে?
সুজাতা তেমনি ম্লান গম্ভীর স্বরে বলল, নইলে সাজব কেমন করে? এবার স্টার্ট দে। অনেক লেট হয়ে গেছে। নতুন চাকরি!
অবকোর্স! নতুন চাকরি!
ট্যাঙ্ক কি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিয়ে হেসে উঠল অমলা খিলখিল করে। বলল, পার্সন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্যে এতক্ষণ কারদেজোর ম্যানেজারও বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছে। কিন্তু
গাড়ি চলেছে। অমলা আড়চোখে এক বার তাকাল সুজাতার দিকে। একটু পরে আবার বলল, কিন্তু সত্যি গিরীনটা একেবারে রাসকেল। মাইরি।
অমলা আবার তাকাল আড়চোখে। সুজাতা ফিরল না। দৃষ্টি ওর সামনের দিকে, সুদূরে। কেবল মুখটি কঠিন হল। আরও এক বার বোধ হয় কেঁপে উঠল ভ্রূর মাঝখানে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ কেন?
সুজাতার ভাবে ভঙ্গিতে অমলা ঘাবড়ে গেল। কিন্তু অস্বস্তিটুকু এত গভীরে, ওর রং করা মুখে তার কোনও আবর্ত নেই। সামনে পুলিশের হাত। নখ রাঙানো হাত বের করে, পেছনের গাড়িকে ইঙ্গিত করে থামাল গাড়ি। প্রায় সুজাতার মতোই একটু করুণ হাসি টেনে বলল, মনে হয়, তাই বললুম। দেখা হয় কিনা মাঝে মাঝে।
সুজাতার রক্তাভ ঠোঁটের কোণ সাপের জিহ্বার মতো চিকচিকিয়ে উঠল। কিন্তু সহসা কিছু বলল না। কেবল বুকের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও বিস্ময় নিয়ে নীরব হয়ে রইল।
অমলা গাড়ি বাঁয়ে ঘুরিয়ে ফাঁকা পথ ধরল। এখানে পথ অনেকখানি নিঃশব্দ। আকাশের নীল পুড়ে পুড়ে ধূসর হয়েছে এর মধ্যেই। মেঘের কোনও চিহ্ন নেই। বড় বড় বাড়ি আর গাছগুলি যেন কেমন প্রাণহীন নীরব। যত বড়, ঠিক ততখানি অসহায় বোবা যেন, দগ্ধ হচ্ছে রোদে। প্রতি অলিন্দ ফাঁকহীন বন্ধ অর্গলে সর্বত্র চাপা। তারপর সামনে মাঠ, মাঝে তার কালো সর্পিল পথ কাঁপছে মরীচিৎকার মতো।
সুজাতা জানে, গিরীনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হচ্ছে আজকাল অমলার। হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। কথাও হচ্ছে নানা রকমের। এতক্ষণে ওর জ কুঁচকে উঠল। বলল, আরও দুদিন এ কথা বলেছিস।
অমলা চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে, একটু হেসে বলল, আজকে নিয়ে তিন দিন বলছি। গিরীন নিজেও বলে। বলে, ব্যাপারটা এখনও পর্যন্ত তার বোধগম্যই হয়নি, অর্থাৎ এরকম একটা ব্যাপার যে ঘটেছে, তার বিস্ময়ের ঘোরটাই নাকি কাটেনি আজও। বলে, আমি বোকা হয়ে ফিরছি সর্বত্র। বেচারির অবস্থাটা দেখলেও দুঃখ হয়।
এক কথা, প্রায় একই কথা আজ তিন দিন বলল অমলা। উপরে উপরে যথেষ্ট নির্বিকার অন্যমনস্ক থেকেও, সুজাতার বুকের মধ্যে কতগুলি অদৃশ্য মতলব নখ আঁচড়াতে খামচাতে লাগল। ঠোঁটের কূলে কূলে আবর্তিত হতে লাগল ভয়ংকর বিদ্রূপ, বিষের মতো তীব্র অনেকগুলি কথা। কিন্তু নিজেকে ধরে রাখল অনেক কষ্টে। অমলাকে চটাতে পারবে না ও কিছুতেই, দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না। মনের মাঝে কোথায় এক ঘোরতর অমিল থাকা সত্ত্বেও নোঙর ছেঁড়া জীবন খুঁটি আঁকড়ে ধরেছে অমলাকেই। এ খুঁটি ওকে কোনও নিশানা ঠিক করে ধরতে হয়নি। পথের মাঝে আপনি এসে পড়েছে, নিয়তির মতো।
কিন্তু বড় ভয়ংকর অমলার ভাবান্তর। কেবলি গিরীনের কথা বলে। সব জেনেশুনেও কেন বার বার। গিরীনের রক্ষিতাদের কথাও বলে অমলা। ছি ছি ছি! যেটা আসলে লেগেছে, সেই নিজের মনের অহংকার, অভিমান আর অপমানবোধের পুরোপুরিটা নিজের কাছেও বোধ হয় ধরা পড়েনি। কিন্তু হিংসা করবে সে গিরীনের মেয়ে সঙ্গিনীদের? সুজাতা তো জানে, গিরীন প্রতি দিন কোথায় ঘোরে, রাত্রিবাস করে কোথায়। যে জীবন কাটাচ্ছে গিরীন, সেটা তো নতুন নয়। আগে পরে একই। তাইতেই গিরীন সতেজ সুস্থ স্বাভাবিক। এই সামাজিক পরিবেশ–তাতে ওর সম্মানের চুন এক ফোঁটাও খসেনি কোনওদিন পান থেকে, কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না ঘরে বাইরে। মাঝখানে সুজাতা গিয়ে নিস্তরঙ্গ জলে কিছু আলোড়ন জাগিয়ে ফেলেছে। ফিরেছেও ভয়ংকর আলোড়ন নিয়ে। শুধুই আলোড়ন, কিন্তু দুর্বোধ্য। কোনও পথে তার গতি নেই, পায়নি।
সেখানে আর যাই হোক, অমলার আঁকা গিরীন নেই। অসহায় ব্যথিত অমলার বেচারি শব্দটার মধ্যে চাপা চাপা উমেদারির গন্ধ। সেইটাই ওকে ক্রোধে আত্মহারা করছে, ভয় দেখাচ্ছে ভীষণ।
অমলা আর এক বার আড়চোখে তাকিয়ে, হেসে হঠাৎ একটু ঢুলু ঢুলু চোখে দৃষ্টি হানল। বলল, আর তুইও ভাই বড্ড ক্রুয়েল…আমারই ভয় করে এক এক সময়। গিরীনের সম্পর্কে এক সময় আমারও
হঠাৎ অসহ্য ঘৃণায় নাক সিটকে, ঠোঁট কুঁকড়ে চাপা গলায় বলে উঠল সুজাতা, এ সব কথা একদম ভাল লাগছে না ভাই, একেবারে না।
অমলা চমকে থতিয়ে গেল। ঢিপ ঢিপ করতে লাগল ওর বুকের মধ্যে। স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরল শক্ত করে। কয়েক মুহূর্ত পরে হেসে বলল, খুব রেগে গেছিস না?
সুজাতার ভয়ও করছিল। হয়তো গম্ভীর হয়ে যাবে অমলা। তাড়াতাড়ি বলল, না। কিন্তু ভাল লাগছে না, সত্যি।
অমলা এবার সোজাসুজি এক বার তাকিয়ে বলল, তোর আজ কী হয়েছে বল তো?
—কিছু হয়নি তো।
বাজে কথা বলছিস। চোখের কাজলে তেল থাকে, জানিস তো।
তাতে কী।
–তেলে জলে যতই অমিল থাক, তেলের গায়ে জল যেটুকু শেষ পর্যন্ত লেগে থাকে, তা সহজে মোছে না। এখনও তোর চোখে জল লেগে রয়েছে দেখছি।
সুজাতা ব্যস্ত হয়ে ব্যাগ খুলতে গেল। অমলা হেসে উঠে বলল, না না, আয়না দেখতে হবে না। বাব্বা! কী মেয়ে। জল থাকলে তো আগেই বলতুম। কিন্তু কেঁদেছিস, সেটা বোঝা যাচ্ছে।
সুজাতা বলল, ও কিছু নয়।
পথের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতভাবে অমলা ওর পুঁইমেটুলি-রং ঠোঁট কামড়ে ধরল সাদা দাঁতে। বলল, রবি এসেছিল বুঝি?
সুজাতা চমকে উঠে গাড়ি থেকেই চার পাশে তাকিয়ে বলল, কোথায়?
অমলা মনে মনে হেসে বলল, এখানে নয়, বাড়িতে?
অবাক হয়ে বলল সুজাতা, না তো।
পরমুহূর্তেই একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, কেন?
নইলে, কাঁদালে কে তোকে বাড়িতে?
–কেন, রবি আমাকে কাঁদায় নাকি?
বলেছিলি তো সেই রকম একদিন। কবে একদিন রবির কথা শুনে সারা রাত্রি কেঁদেছিলি। শুনেছি, অনেক পুরুষ নাকি শুধু কাঁদাতেই ভালবাসে। আর সেই মেয়েরা নাকি কেঁদেই সুখ পায়।
সুজাতা গম্ভীর হল আবার। কিন্তু একটু রং-এর ছিটা লেগে গেল মুখে। বলল, কেঁদে,কাঁদিয়ে কেমন সুখ, ও সব আমি জানিনে। তোকে যেটা বলেছিলুম, সেটা অপমানের কথা। রবির অপমানের কথাগুলি ভেবে কান্না পেয়েছিল।
–সে অপমানই হোক, আর যাই হোক, যারা কাঁদায়, তারা দুঃখ দিয়েই কাঁদায়। কেঁদে যখন সুখ, তখন দুঃখ পেয়েও সুখ নিশ্চয়ই।
ঠিক কথা নয়, একটু যেন বিরক্ত হয়ে বলল সুজাতা, কী যা তা বাজে বকছিস। অকারণে রবিকে টেনে এনে এ সব কেন। জানিস তো সবই, আমি একদম ওকে টলারেট করতে পারিনে।
স্ট্র্যান্ড রোডে পড়ে অমলা হেসে বলল, কথা শুনে অবিশ্যি সেরকমই মনে হয়। কিন্তু তারপর? আমার বাপু ঘোর সন্দেহ, ওই কূটকচালে কথার মানুষ প্রফেসারটিকে তুই সব সময় মনে রেখে চলিস।
তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে সুজাতার ভারমিলিয়ান ঠোঁট বেঁকে উঠল। বলল, কেন, সেরকম কিছু টের পেয়েছিস নাকি?
বিদ্রূপ না হলেও, একটা সুদূর কুহকী হাসির আভাস অমলার ঠোঁটে। বলল, না, টের পাইনি। ভয় নেই।
-কেন?
–আর যাই হোক, সবকিছুর চেয়ে তোদের ওই রবিদের মতো ওঁচা নির্জীব আর কিছু নেই।
সুজাতা নিশ্ৰুপে একটু সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সেই থেকে রবি তো আর আসেনি।
কারদেজোর সামনে ব্রেক কষে অমলা ঘাড় কাত করে একেবারে সুজাতার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল। অর্থপূর্ণ হেসে ফিসফিস করে বলল, তুই ডাকলে হয়তো আসবে।
সুজাতা দরজা খুলে নামতে নামতে হেসে বলল, সেইটা বাকি আছে। তোকে দিয়েই খবরটা পাঠাব রাক্ষুসী। এখন বল, বিকেলে আসছিস তো আমাকে তুলে নিতে।
অমলা হেসে বলল, হ্যাঁগো হ্যাঁ।
ততক্ষণে পিছন ফিরে লিফটের দিকে এগিয়ে গেছে সুজাতা। পিছন ফিরতেই ওর মুখের সমস্ত হাসিটুকু উবে গেল ভোজবাজির মতো। অনেকক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা খুঁচিয়ে মারছিল, তবু হেসেছে। যেন অবশ করে রেখেছিল। এখন অকস্মাৎ সুযোগ পেয়ে কাঁটাটি উঠল মাথা উঁচিয়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির করে তুলতে লাগল।
আর সুজাতার প্রাণের এই অবোধ অস্থিরতার মূলেই ঘা দিতে চায় সবাই। সবাই, অমলা, বাবা, বোন, বন্ধু, সবাই। যে অস্থির ওর মন গোটা জীবনটাকেই তছনছ করছে। ও যত বেসামাল, সবাই তত পণ করেছে যেন আরও বেসামাল করতে। এই কারদেজো, বাড়ি, মিসেস স্যামসনের ক্লাব, অমলা, যাদের কাছে যেতে ওর মন প্রতিনিয়ত বিদ্রোহী, আজ ঠিক সেই সব জায়গায়ই ওকে যেতে হবে সারাদিনের বাঁধা রুটিন মতো। তার উপরে অমলার আজকাল গিরীন-প্রসঙ্গ। সেটা ছাড়িয়ে, তারও উপরে রবির প্রসঙ্গ, যে তাকে সবচেয়ে হীন আর দুর্বল বলে জেনেছে, উপদেশ দিয়েছে গিরীনের কাছে ফিরে যাবার। মনে করেছে ওর ওই কপট বিষণ্ণ-গাম্ভীর্য ও সতোর ভিতরটা সুজাতা মোটেই দেখতে পায় না। জানে না, বোঝে না কিছু।
আবার সেই বোবা অস্থিরতাই আসছে ঘিরে চারদিক থেকে।
লিফট নেমে এসে তুলে নিল ওকে। তাড়াতাড়ি চোখে গগলসটা এঁটে দিলে সুজাতা। মিথ্যে নয়, এক বারের জায়গায় দুবার তাকাল লিফটম্যান। অফিসের গেস্টরুমের এক কোণ থেকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান টেলিফোনিস্ট মেয়েটি এক লহমা অবাক হয়ে হেসে বলল হ্যালো হাউ ডু ইউ ডু!
ভিন্ন সুরে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে ঘাড় হেলিয়ে হেসে সুজাতা মেইন অফিসের সীমানায় গেল। কিন্তু মেয়েটি তাকিয়ে রইল তেমনি ঠোঁট কুঁচকে।
মেইন অফিসেও চাক-ভাঙা মৌমাছির মতো গুঞ্জন উঠল একটা। একরাশ দৃষ্টি ছুটে এল চারদিক থেকে। আসে রোজই, একটু অন্যরকমভাবে। তারপর ম্যানেজারের পার্টিশনের দরজা।
শুভেন্দু, শুভেন চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে দাঁড়াল উঠে। কারদেজোর ম্যানেজার। বেঁটে মানুষ, ওলটানো কোঁকড়ানো চুল। ভীষণ ফরসা, অদেশীয়সুলভ। টাই-প্যান্টের নিটুট কেতা। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ ছোেট ছোট দুটি চোখ।
কথা বলতে গিয়ে থতিয়ে গেল একমুহূর্ত। সুজাতাকে দেখতে দেখতে আবার থিতিয়ে গিয়ে বলে উঠল, এসেছেন? আমি ভীষণ দুশ্চিন্তা করছিলুম, কেন আপনি আসছেন না। হঠাৎ কোনও অসুখ-বিসুখ
কথাগুলি মোটেই ম্যানেজারের মতো নয়। রক্তাভা দেখা দিল সুজাতার মুখে। ওর বিয়ের দিনই প্রথম দেখেছে শুভেনকে। গিরীনের বন্ধু লোকটি। পরিচয়টা ভাল করে হয়েছে আসলে মিসেস স্যামসনের ক্লাবে। অমলার অন্তরঙ্গদের মধ্যে শুভেন একজন। চাকরিটা হয়েছে সেইদিক থেকেই। শুভেনও খুশি হয়ে সম্মতি দিয়েছিল। মাঝখান থেকে, যে মেয়েটি চাকরি করছিল এখানে, শুভেনের অফিস ও বাইরের সঙ্গিনী, সে বেচারিকে চলে যেতে হয়েছে কারদেজোর মাদ্রাজের ব্রাঞ্চে। সে সব নিয়েও কম গুলতোনি হয়নি। অফিসের আলোচনার বিষয় সবই শুনেছে ও অমলার কাছ থেকে। অমলার কাছে বলেছে শুভেন। বলেছে, অনেকের আপত্তি ছিল সুজাতার জন্যে। কিন্তু টেকেনি। বলে অমলা মুচকে হেসে বলেছে অপাঙ্গকটাক্ষপাত করে, কেননা খোদ ম্যানেজারেরই ভাল লেগে গেছে তোকে।
সে-ই তো সুজাতার সবচেয়ে বড় ভয় ও বিঘ্ন। মিসেস স্যামসনের ক্লাবে, এত দিন আলাপের পরেও হাল ছাড়েনি শুভেন। ঠিক গিরীন-প্রসঙ্গের মতো তখন অমলা বলত শুভেনের কথা। শুভেনের জীবনের ব্যর্থতা, দুঃখ, অনেক কিছু। চাকরি দিয়ে, নতুন করে কোমর বাঁধছে শুভেন। যেন চাকরি নিয়ে ওকেই কৃতার্থ করেছে সুজাতা। ভাগ্য ভাল, লোকটা গিরীনের কথা তুলে কখনও সুজাতাকে সমবেদনা দেখায় না। শুধু নিজের কথা। সেও এত কথা যে, প্রতি মুহূর্তেই শুনতে বড় ভয় সুজাতার।
নিজের মনের কাছে অস্বীকার করতে পারে না সুজাতা, ঠোঁটের কোণে গর্বের একটু সূক্ষ্ম হাসি চমকাচ্ছে নিয়ত। কারদেজোর ম্যানেজার যদি কৃতার্থ মনে করে ওকে দেখে, তবে কেমন করে সুজাতা
এই সমাজের মেয়েলি মন থেকে দূর করবে অহংকার। তা ছাড়া, শুভেন বন্ধু গিরীনের।
কিন্তু, এ অহংকার সুজাতার বাইরের। ওর ভিতরের অস্থিরতার আবর্তে এ যে শুধু ভয়। সেখানে কোনও অহংকার নেই। কিন্তু জীবনের একদিকের ধাক্কায়, আর একদিকের এই অর্থের আশ্রয়কে ও কোনওরকমেই ভাঙতে চায় না। খুশি রাখতে চায় শুভেনকে।
সুজাতা বলল অপ্রতিভ লজ্জায়, অনেক দেরি হয়ে গেল মি.
–নো নো, একদিন আধদিন ওরকমে কিছু যায় আসে না। বসুন বসুন বসুন। রবার সিল্ক লং প্যান্টের রেখায় রেখায় যেন নেচে উঠল শুভেনের সুগঠিত উরু পেশি। আবার বলল, আমি ভাবলুম, আপনি আবার ডিসিশন করলেন নাকি নতুন কিছু।
হেসে মাথা নাড়ল সুজাতা। অসম্ভব শুভেনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা। ক্লাবে ও যখন পানমত্ত হয়ে ওঠে, তখনও চোখ দুটিকে এমন ভয়াবহ মনে হয় না। বরং তখন দেখায় ভীরু আর বোকা। ওই তীক্ষ্ণ চোখ দুটিই ভেসে ওঠে মরা মাছের চোখের মতো।
জায়গায় বসে সুজাতা ফাইলে হাত দিতে যাবে। মানুষের গলার একটি বিচিত্র শব্দ শুনে, চোখ তুলল। শব্দটা শুভেনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর। বলল, যদি কিছু মনে না করেন সুজাতা দেবী, অতুলনীয় মনে হচ্ছে আপনাকে। একটা ম্যানেজারের অফিসে, আপনাকে মানায় না। আর…জানত সুজাতা, শুভেন বলবে এই কথা। অমলা বলেছিল, আজকে নয়, আরও আগে, পোশাকে প্রসাধনেও একটু সোশ্যাল হওয়া দরকার। আর কিছু নয়, সবাই ভিরমি যাবে, তুই ঘুরবি রানির মতো।
রানির মতো! ঠিকই, একটা খুশি জ্বলছে মনের মধ্যে, কিন্তু একটি তীক্ষ্ণ গ্লানি বসছে কেটে কেটে। খুশিটুকু একরকমের জ্বলুনি।
সপ্রশ্ন সংকুচিত চোখে তাকাল সুজাতা।
শুভেন বলল, আর, কারদেজোর আর্টিস্টরা বলে, আমার বিউটি সেনস নেই। হয়তো তাই। যদি কিছু মনে না করেন, সাজসজ্জার বাইরে আপনাকে চোখ সয়, তাই সেইটেই যেন ভাল, মানে, এখন, এখন কী রকম জানেন, চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে, এ রুইনিং স্পার্ক।
অবাক হল সুজাতা। যেন, করুণভাবে অনুরোধ করছে শুভেন তাকে না-সাজতে। যেন সত্যি ওকে কেউ শ্বাসরুদ্ধ করছে ভিতরে ভিতরে। দুটো ফ্যানের হাওয়াতেও ঘামছে ওর থ্যাবড়া শক্ত কপালটা।
একথার কোনও জবাব নেই। জবাবের প্রত্যাশাও ছিল না শুভেনের। কথা শেষ করে ওর জায়গায় গিয়ে বসল ও।
সুজাতা ভাবল, এই ওর ম্যানেজার, ও পার্সন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, এই ওর চাকরি। সময় চলে গেল টিকটিক করে। কাজ কতখানি হয়েছে, সুজাতা নিজেও জানে না। একই পার্টিশনের মধ্যে, শুভেনের নিয়ত দৃষ্টির সামনে ও যেন এক বিচিত্র শিকারের মতো ছটফট করতে লাগল। আর চারপাশ থেকে সেই ভয়ংকর থাবাটাই আসতে লাগল ঘিরে। অপরের করুণা, ঘৃণা, সংশয় আর লোভের পাত্রী। এই রূপ, আর এই শরীর দেখে শুধু রক্তধারা নাচে পুরুষের। নিজের বিবাহিত স্বামীও শুধু এইজন্যেই আজ ওকালতি করে বান্ধবীর মারফত। শুধু এক জন মজা লোটে দূর থেকে বিদ্বেষের আনন্দে। উপভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে। সে রবি। ভীরু আর কাপুরুষ, বীরত্ব শুধু জেল খাটতে, আছে কিছু নির্বিষ মাস্টারিয়ানা। নীতিসর্বস্ব বাকচতুর। এ ছাড়া আর কী ভাববে সুজাতা।
নিজেই জানে না, শুধু জীবনের ভয় আর অবিশ্বাসগুলিকে কাটিয়ে উঠতে পারছে না বলেই যত ওর দুর্দশা। মেয়ে এবং মানুষ হয়ে গোটা সংসারের এ দুর্দশাকে সুজাতা কাটাবেই বা কেমন করে।
বেলা যায় পড়ে। আকাশটা পুড়ে পুড়ে এবার রং ধরে তামাটে। কারদেজো বিল্ডিং-এর পশ্চিম দিগন্ত রক্তাভ হয়ে উঠছে। রক্তাভ হয়েছে শুভেনের ঘর। রক্তাভ হয়েছে সুজাতার সমস্ত অন্তর। শুভেনের রক্তে রক্তে জমাটি নেশা।
এই সময়ে সুজাতার বার বার মনে হতে লাগল, কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে ও। যতই রাত আসবে, ততই ভীত বিহঙ্গের মতো সঁপে দেবে নিজেকে অমলার অতল অন্ধকারে। ঝুমনো, সুমিতার কথা মনে পড়ে, আর যেন কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না ওদিকে। আর, বাবার উমনোটির মতো জীবনের এত বছর কাটিয়ে আজ চূড়ান্ত বিমুখ হয়ে উঠেছে মন।
শুভেন পৌঁছে দিতে চাইল গাড়িতে করে, যেখানে যেতে চায় সুজাতা। অমলার কথা বলে বিদায় নিল।
তারপর গাড়ি চলল অমলার। পথ ঘুরে, মাঠ ঘুরে, বেড়িয়ে বেড়িয়ে, আড়চোখে দেখে দেখে, শেষপর্যন্ত অমলা সার্কুলার রোড ধরল।
গাড়ি এসে ঢুকল মিসেস স্যামসনের ক্লাব প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যা তখন উতরে গেছে। বারান্দার টালি-শেডে ঢাকা পড়ে গেছে লেখাটি, ক্লাব অ্যান্ড বার। অনেকগুলি গাড়ি এসে জুটেছে প্রাঙ্গণে। এ এক বিচিত্র মেয়েপুরুষের আড্ডা। রীতিমতো মেম্বারশিপ আছে নিয়ন্ত্রিত। স্টেজ এবং হলঘর ছাড়াও তিনতলা বাড়িটির নানান খাপে খাপে ফাঁদ আছে ছড়িয়ে। লোকে বলে, সোসাইটির যত অবৈধ কিংবা বৈধ প্রণয়ের জায়গা এইটি। মেম্বার বেশি মেয়েরাই। পুরুষেরা অধিকাংশ সভ্য হয় মেয়েদেরই সুপারিশে। সেদিক থেকে বুড়ি স্যামসন সচেতন নারীর অধিকারে।
চারদিকে ফিসফিস গুঞ্জন। সুজাতাকে নিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে ঢোকবার আগেই পুরুষেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গুঞ্জন শুরু করে দিল। সারা হলঘরেই আজ পুরুষের প্রশংসা আর মেয়েদের বিদ্বেষের গুঞ্জন উঠল যেন। অনেক দিন দেখা সত্ত্বেও অনেকে আজ চিনতেই পারল না সুজাতাকে।
–কে?
–ও! তাই নাকি!
–হেরিবল!
–সপ্লেন্ডিড।
চেম্বারে ঢুকে, অমলা গাল টিপে দিল সুজাতার। বলল, মরে গেল আজ সবাই। কিছু খাবি আজ?
সুজাতা ঘামছিল দরদর ধারে। বলল, খাব।
অমলার বিস্মিত হওয়ার পালা এবার। কিছু খাওয়া, মানে পান করা। এতদিনে বার তিনেক প্রায় স্পর্শ করার মতো খেয়েছে সুজাতা।
অমলা বলল, সত্যি?
হাসবার চেষ্টা করে বলল সুজাতা, তবে কি মিথ্যে? অমলার দু চোখে চকিত আলোর ঝলকানি। ছুটে গিয়ে অর্ডার দিয়ে এল অমলা। ফিরতে গিয়ে দেখল গিরীন তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে হলঘরে দাঁড়িয়ে।
অমলা বলল চোখ কুঁচকে, আমি ডাকলে আসবেন আমাদের চেম্বারে?
গিরীন স্থির নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল অমলার দিকে। বলল, যদি বলেন। অবশ্য, কোনওরকম মিসআন্ডারস্ট্যান্ড না হয়।
সুজাতা আজ খেল খানিকটা।
প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে, ওর সমস্ত মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। নতুন আরশোলার পাখনার মতো চকচক করছে আরক্ত চোখ। কিন্তু নীরব হয়ে গেছে একেবারে। কী যেন বলতে চেয়েছে বারবার, বলতে পারেনি মুখ ফুটে। যেন কী এক ভয়ংকর যন্ত্রণা কিলবিল করে উঠছে সারা মুখে।
অমলা কয়েকবার উঠে যেতে চেয়েছে, যেতে দেয়নি সুজাতা। অমলা ক্রমে বিস্মিত ভীত হয়ে উঠছিল সুজাতাকে দেখে। কেন যেন, কষ্টও হচ্ছিল। আশ্চর্য নিষ্পাপ দুঃখিনী মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল সুজাতাকে।
বলল, কোনওরকম অসুস্থ বোধ করছিস না তো সুজাতা।
সুজাতা খুব পরিষ্কার গলায় জবাব দিল, তো।
তবে? কিছু বলবি
সুজাতা হাসল একটু। বলল, কী বলব অমল! বলছি না, ভাবছি, আমার মুখে খুব গন্ধ হবে তো!
না, ততখানি খাসনি।
আর ভাবছি অমল, এ সংসারকে আমার কী দেওয়ার আছে, তা জানিনে, কী চায় সংসার, তাও জানিনে বলে আমার বড় কষ্ট হয়। বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
অমলা বলল, দ্যাখ শত হলেও তুই মেয়ে, মেয়েমানুষ, এ সময়ে কী চাই, সে কথা কি তুই বুঝিসনে?
সুজাতা বুঝি। সে-ই তো বড় যন্ত্রণা, নিজেকে নিয়ে। আমার তো কেউ নেই।
অনেকেই আছে, চায়ও।
জানি। সেইটে আরও কষ্টকর।
পরমুহূর্তেই চমকে উঠে ভীতস্বরে বলে উঠল, পালাব এবার। কী জানি ভাই এ সব আমি কী করছি, কিছু বুঝতে পারছিনে। বড় ঘেন্না করছে, আর ভয় করছে। বলতে বলতে সটান উঠে দাঁড়াল সুজাতা। চোখে জল এসে পড়েছে ওর।
–কোথায় যাচ্ছিস।
বাড়ি।
সামান্য কাত হয়ে দ্রুত পায়ে, না টলে টলে বেরিয়ে গেল সুজাতা। অমলা বলল, দাঁড়া, গাড়ি বার করি।
না ভাই, আজ হাঁটব বড় রাস্তা পর্যন্ত।
হল পার হয়ে, প্রাঙ্গণ পেরিয়ে বেরিয়ে গেল সুজাতা। গিরীন তখন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। অমলা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলে।
বাতাস বইছে। গিরীনের সিগারেটের স্ফুলিঙ্গ উড়ছে। ওর সারা মুখে একটা বোবা বিস্ময় ছাড়া আর কিছু নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে না অমলাকে, নড়ল না এক পা। এমন কী, অমলার বিদায়ের হাতের সংকেতও দেখতে পেল না।
সুজাতা পায়ে পায়ে, মোড় নিয়ে সার্কুলার রোডে এসে উঠল। রাস্তার আলোগুলি এখানে বড় বড় দেবদারু বট আর বাদামের ছায়া ও বিস্তারকে ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি। রাস্তা এসেছে ফাঁকা হয়ে। সামনে অনেকখানি জমি নিয়ে খ্রিস্টানদের পুরনো কবরস্থান। গাঢ় অন্ধকার ও নৈঃশব্দ এখানে বিচিত্র অশরীরী মায়া ছড়িয়েছে। সাদা পাথরের স্তম্ভ আর মূর্তিগুলি দূর অন্ধকারে গাছের আড়াল আবডাল থেকে যেন অদ্ভুত মূর্তিতে বেড়াচ্ছে নড়েচড়ে। কথা বলছে কোরাস গলায় ঝিঁঝি ডাকের আড়ালে। বাতাস বইছে শনশন করে। জোনাকির ঝিকিমিকি দেখা যায় কবরস্থানের অন্ধকারে।
অমলার গাড়ির লাইট এসে পড়ল সুজাতার গায়ে। ব্রেক কষে নেমে বলল অমলা, এ কী হচ্ছে সুজাতা, ওই রাস্তায় এত রাত্রে হেঁটে যাওয়া যায়?
বড় ভাল লাগছে ভাই হাঁটতে। একটু ভয় ভয়ও করছিল।
যেন সত্যি, ছোট একটি মেয়ে। অমলা হাত ধরে টানল ওকে। সুজাতা হঠাৎ বলল, দ্যাখ অমল আমি তো চেয়েছিলুম স্বাস্থ্যবান শিক্ষিত একনিষ্ঠ স্বামী আর স্বচ্ছন্দ জীবন। সংসারে কি এটা মেয়েদের খুব বেশি দাবি।
অমলা দেখল, চোখের জলে সুজাতার সারা মুখ ভেসে গেছে। বলল, হ্যাঁ। সব মেয়েই বোধ হয় এই চায়। ওই দুটির একটি সুখ, আর একটি স্বস্তি। কিন্তু সংসারেরই বোধ হয় এই নিয়ম, মেয়েরা কোনওদিন ও দুটি জিনিস একসঙ্গে পায় না। ও দুটি জিনিস কেউ একত্র পায় না ভাই, কেউ না।
সুজাতা ফিসফিস করে বলল, তাই, তাই বোধ হয়।
দুজনে উঠল গাড়িতে। মরিস মাইনরটাও যেন একটি অসহায় মেয়ে। দুজনকে নিয়ে চলল চাপা গুরুগুরু শব্দে।
বাইরের ঘর থেকে মহীতোষ দেখলেন নামতে সুজাতাকে। তাড়াতাড়ি চলে গেলেন নিজের ঘরে। শব্দ পেয়ে, বাতি নিভিয়ে পড়া সাঙ্গ করল সুগতা।
সুমিতা অন্ধকারে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল বালিশে মুখ গুঁজে।