ফ্লুরিসে ঠিক সময়ে
ফ্লুরিসে ঠিক সময়ে উপস্থিত হলো গৌরব। জয়তী নেই। সে ভেতরেও ওকে দেখতে পেল না। প্রায় মিনিট চল্লিশেক অপেক্ষা করার পর গৌরব চলে এলো হাসপাতালে। বারো বছর-আগে জয়তী কখনও কথা দিয়ে আসেনি এমন একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে না। সময় রাখার ব্যাপারে ও চিরকাল খুব তৎপর ছিল। বরং গৌরব কখনও কখনও দেরি করে বকুনি খেয়েছে। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যে কারণে আসতে পারল না জয়তী। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তা নাহলে টেলিফোনেও জানাতে পারত। মাথার ভেতরে নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে সে পিজি হাসপাতালে এলো। সেখানে সৌরভ দাঁড়িয়েছিল।
সৌরভ বলল, শুনলাম আজ দুপুরে পুলিশ লীনার স্টেটমেন্ট নিয়েছে।
ডাক্তার ওঁকে কথা বলতে দিয়েছে তাহলে?
হ্যাঁ। চল। আমি ব্যবস্থা করেছি দেখা করার।
লীনা চ্যাটার্জি শুয়েছিল চোখ বন্ধ করে। দাদার সঙ্গে গৌরব পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। কপালে এবং গালে এখনও প্লাস্টার আঁটা। গলা পর্যন্ত সাদা কাপড় টানা। সৌরভ মাথার পাশে গিয়ে ডাকল, লীনা।
লীনা চোখ খুলল। খুব দুর্বলভাবে সৌরভকে দেখল। সৌরভ প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটু ভালো লাগছে এখন? লীনার ঠোঁট কাঁপল। একটু।
তারপর সে মুখ নামাতেই পায়ের দিকে নজর গেল। গৌরবের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মৃদু হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। সে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে?
সৌরভ বলল, গোরা। ও তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে আবিষ্কার করে।
আবিষ্কার! নিঃশ্বাস ফেলল লীনা। সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, কে, কারা করেছে?
পুলিশকে বলেছি। সব মুখই তো একরকম। গৌরববাবু, আমার ফ্ল্যাটের চাবি কার কাছে?
থানায়। ওরা সব বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে।
আমি আর বাড়ি পাল্টাবো না। এর বেশি তো আর খারাপ হতে পারে না। কী বলেন? চোখ বন্ধ করল লীনা।
.
লীনার আততায়ীদের খুঁজে বের করা খুবই মুশকিল। তাদের চেহারার যে বর্ণনা সে পুলিশকে দিয়েছে তার সঙ্গে এই কলকাতার অন্তত তিনলক্ষ মানুষের মিল আছে। ভাঙা চোয়াল, রুক্ষ দৃষ্টি, রোগা লম্বা শরীর আর অমিতাভ বচ্চনের মতো ঘাড় ঢাকা চুল। এদের কারো সঙ্গে তার কখনও আলাপ ছিল না। কথা যা বলেছিল তাতে পড়াশোনার ছাপ বিন্দুমাত্র নেই। বোঝাই যাচ্ছিল এদের কেউ নিয়োগ করেছে এবং টাকার সঙ্গে অমন স্তরের এক নারী যা কিনা তাদের নাগালের বাইরে ছিল এতকাল পরে ভোগ করতে পেরে প্রচুর উল্লাস পেয়েছে।
পুলিশ তদন্ত করবে বলে কথা দিয়েছে। গৌরবকে কিছুটা হেনস্তা করতে হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছে কিন্তু কাজের কাজ কতটা হবে তাতে সন্দেহ থেকেই গেছে। পরদিন লীনার অবস্থা অনেক ভালো। বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল সে। গৌরব যেতেই হেসে বলল, বাঃ আপনি তো খুব ভালো।
ফুলগুলো রাখার জায়গা পাচ্ছিল না গৌরব। সকালে লীনাকে দেখতে আসার পথে ফুল কিনেছে সে। লীনার মনোমতো এই ফুলগুলোর জন্যে সে খুব খুশি হলো। একজন নার্সকে ডেকে অনুরোধ করতেই ভদ্রমহিলা বড় বোতল এনে সেটা লীনার মাথার পাশে রেখে তাতে ফুল সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বিছানার পাশে টুল নিয়ে বসল গৌরব। বসে জিজ্ঞাসা করল, দেখে মনে হচ্ছে একটু ভালো!
অনেক ভালো।
আপনাকে দেখতে বাড়িওয়ালা এসেছিল?
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
বাঃ ভাড়াটে হাসপাতালে গেলে বাড়িওয়ালার তো দেখতে আসা উচিত?
উচিত! ভারতবর্ষে এই শব্দটাকে অধিকাংশ মানুষই আর গুরুত্ব দেয় না।
আপনি-বললেন আর বাড়ি পাল্টাবেন না। মন স্থির করে ফেলেছেন?
হ্যাঁ।
কেন?
উত্তরটা দিতে পারব না। তবে এখন আর ও বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। লীনা হাসল, আজ সকালে ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যারা আমার শরীরটাকে ভোগ করে গেল তাদের কোনো স্মৃতি আমি বহন করছি কিনা। ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। প্রশ্নটার মানে বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না।
না বোঝার তো কারণ নেই। ঠিক আছে, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলব।
আচ্ছা গৌরবাবু, আপনি আমার জন্যে এত করছেন কেন বলুন তো?
গৌরব হেসে ফেলল, বিশ্বাস করুন, আমার কোনো বদ মতলব নেই।
বদ না হোক মতলব তো আছে।
তাও নয়। আসলে এটা আমার স্বভাব।
অথচ আমাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে সমস্যা তৈরি হয়েছিল।
অতীত অতীতই। যতক্ষণ কেউ অন্যায় করছে না বলে মনে করে ততক্ষণ তার একটা জোর থাকে। সেই জোর তাকে মাথা সোজা রাখতে সাহায্য করে। আপনার সেটা আছে।
আপনি চমৎকার বাংলা বলেন। আমেরিকায় এত বছর থেকেও দেখছি ভোলেন নি।
মনেপ্রাণে হয়তো ভেতো বাঙালি।
মোটেই নয়। আপনার সঙ্গে এখানকার বাঙালির মানসিকতার পার্থক্য অনেকে।
জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি যখন এদেশে ছিলাম তখন অনেক কিছুই চোখে পড়ত না। এখন সেগুলো অসহ্য মনে হয়। আজ উঠি। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন।
কী রকম ভালো বলছেন? ভালো হয়ে ওঠা কি যায়? লীনার মুখ শক্ত হলো।
উঠে দাঁড়াল গৌরব, না, আজ আর তর্ক নয়। এলাম। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পেছন থেকে ডাকল লীনা, শুনুন। গৌরব ফিরে তাকাল।
তারপর কাছে এসে হাসল, বলুন।
লীনা মুখ নিচু করল, কবে আসবেন?
আপনাকে রিলিজ করার আগে একবার আসব। গৌরব আর দাঁড়াল না।
.
জয়তীদের বাড়িতে গিয়ে মাসীমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল গৌরব। জয়তী নেই। সকালে বেরিয়ে গিয়েছে। ওর স্কুলে নাকি ঝামেলা হয়েছে। ঘণ্টা দেড়েক বসেও দেখা পেল না সে। আজ সারা বাংলা টিচার-স্ট্রাইক। জয়তী নাকি তাই নিয়ে ব্যস্ত। গৌরবের খুব ইচ্ছে করছিল মাসীমাকে প্রশ্ন করে যে তিনি সেদিন জয়তীর ফ্লুরিসে না যাওয়ার ব্যাপারটা জানেন কি না। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তিটা জয়তীর কারণেই। সে যদি মাকে কিছু না বলে থাকে তবে মাসীমার ধন্দ লাগবে। এটা ভারতবর্ষেই ঘটে থাকে। মা বা বাপ বন্ধুর মতো। ওদেশে ছেলেমেয়েরা নিজেদের কথা অসংকোচে আলোচনা করে। কিন্তু এখানে বয়ঃসন্ধি পার হতে না হতেই দূরত্ব বেড়ে যায়।
জয়তী না থাকায় মাসীমারও খারাপ লাগছিল। বললেন, তুমি এসে অপেক্ষা করেছ শুনলে ও মন খারাপ করবে। প্রণতি চলে যাওয়ার পর তো ও ভীষণ একা হয়ে গিয়েছে। আমার আর ভালো লাগে না বাপু। কোথাও যদি কোনো ভালো ওল্ড-এজ হোম পেতাম সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।
গৌরব জিজ্ঞাসা করল, জয়তী সেটা মানবে?
মানতে চায় না। কিন্তু তাতে তো ও নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করছে, হঠাৎ থমকে গেলেন প্রৌঢ়া, গৌরব কিছু যদি মনে না কর একটা প্রশ্ন করব?
মনে করার কিছু নেই মাসীমা, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।
বারো বছর ধরে তোমরা পরস্পরের জন্যে অপেক্ষা করলে, এবার আর একা ফিরে যেও না।
মাসীমা আমি তৈরি হয়ে এসেছিলাম। এদেশের অনেক মেয়ে আমেরিকায় বিয়ের পর গিয়ে ঠিক একটা না একটা কাজ পেয়ে যায়। জয়তীরও কাজ পেতে অসুবিধে হবে না। সেক্ষেত্রে আপনি ওখানে গিয়ে থাকতে পারেন। অথচ ও সেটাই বুঝতে চায় না।
না গৌরব। এদেশের মানুষকে আমি চিনি। আমাকে তোমরা নিয়ে গেলে কথা উঠবে। নিজের মা ভাইকে না নিয়ে গিয়ে শাশুড়িকে। সেটা আমার কাছে মোটেই ভালো লাগবে না। আমার ব্যাপারটা আমাকেই বুঝতে দাও। তুমি ওকে বোঝাও।
.
একমাত্র সে যদি কলকাতায় থেকে যায় তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। জয়তীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গৌরব ভাবছিল। একই শহরে মা আছেন, ইচ্ছে করলেই পৌঁছনো যায়, চাই কি দুচারদিন থাকাও যায় গিয়ে, এমন হলে জয়তী আপত্তি করবে না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে গৌরবকে অনেক কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে আর যাই হোক এ দেশে কাজের পরিবেশ নেই। কাজের চেয়ে মানুষের নিত্য চাহিদার মুখ বন্ধ করতে আন্দোলনের নামে এক ধরনের উত্তেজনা পোয়াতে উৎসুক সবাই।
এই সময় মিছিলটাকে দেখতে পেল গৌরব। সারা বাংলা টিচার ইউনিয়নের ফেস্টুন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকারা। জয়তী কি এই দলে আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত আন্দোলিত করে একজন স্লোগান দিচ্ছে আর অন্যেরা সেটিকে মন্ত্রের মতো আবৃত্তি করছেন। পুরুষদের পর কিছু মহিলা। মহিলাদের মধ্যে জয়তী নেই। স্লোগানগুলো মন দিয়ে শুনল গৌরব। এখন বোধহয় শ্রমিক কৃষক ছাত্র শিক্ষক যে যার নিজের আন্দোলনে একই স্লোগান ব্যবহার করে। তাদের বলার ভঙ্গিও এক। দুই-একটি বিশেষ দাবী ছাড়া সব একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, যে নতুন শুনবে তার কাছে। তার মনে হলো এই ভাবে মিছিল করতে হচ্ছে বলে একটু সংকোচে আছেন তারা, যেন বাধ্য হয়েই পথে নেমেছেন। হাঁটা চলা চাহনিতে আড়ষ্টতা আছে।
মিছিলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল গৌরব। পথে আরও মিছিল যাচ্ছে। ক্রমশ এটির চেহারা বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। সব মিছিলের লক্ষ্য এসপ্ল্যানেড ইস্ট। প্রায় জেদের বশেই সোজা এসপ্ল্যানেডে চলে এল গৌরব। রাস্তা জ্যাম, ট্রামবাস, ট্যাক্সি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মিছিলে মিছিলে ধর্মতলা উত্তাল। সাধারণ মানুষ যাদের সব কাজ থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা মেনে নিয়েছে নির্বিকার হয়ে। একটা বাসভর্তি লোক ঠাসাঠাসি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে।
কে সি দাসের মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে রাজভবনের খানিকটা এগিয়ে গৌরব দেখল রাস্তায় শিক্ষকরা বসে গেছেন। অনেক দূরে একটা মঞ্চ তৈরি করে নেতারা বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। এবং তখনই গৌরব জয়তীকে দেখতে পেল। কয়েকজন মহিলার সঙ্গে জয়তী বসে বক্তৃতা শুনছে। গৌরবের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল চেঁচিয়ে ওকে ডাকে। তারপরই মতটা পাল্টালো। জয়তী যখন উঠবে তখনই চমকটা দেওয়া যাবে। মেয়েটাকে এখন খুব কাহিল দেখাচ্ছে। চুল এলোমেলো, মুখে ঘাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধৈর্য ধরতে হলো গৌরবকে। এই সময় আর একজন মহিলার সঙ্গে জয়তী উঠে দাঁড়াল। ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে এ পাশের ফুটপাতে চলে এল ওরা। গৌরবের দিকে নজর নেই জয়তীর। দূরত্ব এবং মানুষের ভিড় এর একটা কারণ। একজন ভদ্রলোক জয়তীর সঙ্গে কথা বলছে। কোনো ব্যাপারে ওরা দ্বিমত বলে মনে হলো গৌরবের। শেষ পর্যন্ত ওরা এগোতে লাগল। সরে দাঁড়াল গৌরব ইচ্ছে করেই। তিনজনকে ও একটা রেস্টুরেন্টের ভেতর পা বাড়াতে দেখল। ভদ্রলোক কে, জয়তীর সঙ্গে কি সম্পর্ক ঠাওর করতে পারছিল না সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গৌরব রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ ভিড়। মিছিলের ক্লান্ত মানুষেরাই টেবিল দখল করে রেখেছে। আর তখনই জয়তী তার সামনে এসে দাঁড়াল।
জয়তী কিছু বলার আগেই গৌরব বলল, অনুসরণ করে চলে এলাম।
মানে? জয়তীর কপালে ভাঁজ পড়ল।
তোমাদের এই রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখলাম। ভালো আছ?
চা খাবে?
না।
তুমি একটু দাঁড়াও, আমি আসছি। জয়তী ফিরে গেলে গৌরব বাইরে এসে দাঁড়াল। মিছিলগুলো এখনও আসছে। মানতে হবে দিতে হবের ডাক চলছে। এই ভাবে যদি জীবনের সব ইচ্ছা চেঁচিয়ে জানান দেওয়া যেত! জয়তী এল মিনিট পাঁচেক বাদে। এসে বলল, তুমি এদিকে কী মনে করে?
তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। হাঁটতে আরম্ভ করল গৌরব।
ও। কিন্তু মা তো জানে না যে আমি এখানে এসেছি।
আমি অনুমান করলাম।
এই ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পেলে কী করে?
ভাগ্যবান বলতে পার, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে।
ওরা ক্রমশ নির্জন জায়গায় চলে এল। জয়তী এবার দাঁড়িয়ে পড়ল, আমি কিন্তু আর হাঁটতে পারব না। অভ্যেস নেই তো, অনেক হেঁটেছি।
গৌরব বলল, এখানে বসা নিয়ে আমরা একসময় রসিকতা করতাম। তুমি ফিরবে না অন্য কোথাও যাবে?
বাড়ি। খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছি।
ভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। সিটে বসে রুমালে মুখ মুছল জয়তী, দেখছ তো কী ভাবে বেঁচে আছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে প্রাণধারণ।
গৌরব কিছু বলল না। সে লক্ষ্য করছিল জয়তীর একবারও ফ্লুরিস না যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছে না। সেই প্রসঙ্গই তুলছে না ও। অতএব গৌরব নিজেই কথা টানল, তোমার সঙ্গে আমার এর মধ্যে দেখা হওয়ার কথা ছিল।
কবে? জয়তী মুখ ফেরাল।
তুমি ভুলে গিয়েছ?
বিশ্বাস করো–ও, হ্যাঁ, ফ্লরিস না? ইস, একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তুমি গিয়েছিলে, না? আমার এরকম কখনও হয় না। আসলে আমি এতরকম ঝামেলা নিয়ে আছি যে- কোনটা সামলাব বুঝে উঠতে পারছি না।
গৌরব কোনো কথা বলল না। সেটা লক্ষ্য করে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, এই রাগ করেছ?
হাসবার চেষ্টা করল, কী হবে করে?
তুমি আমাকে বুঝতে চাইছ না।
না আগে তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো আমার জন্যে তোমার ভালবাসা অবশিষ্ট আছে কিনা, টানবোধ কর কিনা। আমার জীবনটার সঙ্গে জড়িয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় কি না। তোমার উত্তরের ওপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি সরাসরি জানতে চাইছ আমি সম্পর্ক রাখতে চাই কিনা?
সম্পর্ক? কিসের সম্পর্ক? তার ধরনটাই বা কী?
তুমি জানো না?
না, দুটো মানুষ পরস্পরকে আকাঙ্ক্ষা করল। তারা নিজেদের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পেয়ে রোমাঞ্চিত হলো। বারো বছর ধরে দুজন রইলো পৃথিবীর দুই মহাদেশে। দুজনেই অন্য কোনো মানুষকে জীবনের ধারে কাছে আসলে দিল না। আবার একজন যত অনুরোধই করুক অন্যজন তার কাছে পৌঁছতে চাইল না ব্যবধান ঘুচিয়ে। সম্পর্কের কথা বলছ তুমি, আমি এবার এদেশে এসেছি তোমার জন্যে আর তুমি আমাকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কয়েক মাইল হেঁটে পিচের রাস্তায় ঘামমুখে বসে থাকতে তোমার খারাপ লাগে না অথচ আমার সঙ্গে দেখা করার সময় হয় না এটা কী ধরনের সম্পর্ক। ঠিক আছে। যেটা চোখে দেখা যায় না স্পর্শ করা যায় না অথচ আছে বলে মনে হয় সেই রকম সম্পর্ক আমি সারাজীবন চালিয়ে যেতে পারি। তোমাকে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না।
জয়তী জবাব দিল না। ট্যাক্সি বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে। খুব অবসন্ন লাগছিল তার। গৌরব কোনো কথাই মিথ্যে বলেনি। কিন্তু কেন সে নিজেকে এখন আড়ালে রাখছে তা বুঝতে পারেনি গৌরব। বারো বছর আগের গৌরব তার খুব কাছের মানুষ ছিল, বড় চেনাজানা। দীর্ঘকাল আমেরিকায় থেকে গৌরবের মানসিকতা এবং জীবনযাত্রায় কি ছাপ পড়েছে তা তো তার জানা নেই। কেমন একটা আড়ষ্টতা এসে গেছে মনের খাঁজে খাঁজে। একে কি কমপ্লেক্স বলে? হয়তো। তাছাড়া, মাকে ফেলে রেখে সে কোথায় যাবে। প্রণতিরা যা পারে তা সে পারে না। ট্যাক্সি থেকে নেমে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি নামবে না?
না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমি তো আজ অনেকক্ষণ এখানে কাটিয়ে গিয়েছি। আচ্ছা চলি।
কবে দেখা হচ্ছে?
তোমার কি দেখা করার ইন্টারেস্ট আছে?
নইলে জিজ্ঞাসা করব কেন?
বলে কী লাভ? হয়তো সময় পাবে না কিংবা ভুলে যাবে।
জয়তী ঠোঁট কামড়ালো। তারপর বলল, এক মিনিট দাঁড়াও। বলে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেল গৌরব দেখল মাসীমা দরজা খুললেন আর জয়তী ভেতরে ঢুকে গেল। কেন অপেক্ষা করতে বলল এই নিয়ে গৌরব যখন নানারকম ভাবছে তখন ফিরে এল জয়তী। মুখে ঘাম নেই চুলে সম্ভবত চিরুনি পড়েছে কিন্তু আর কোনো পরিবর্তন হয়নি বেশ বাসে। এসে দরজা খুলে উঠে বসলো সে, তুমি কোথায় যাচ্ছ চলো, আজ সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
তুমি সঙ্গে থাকতে চাইলেই যে আমি রাখতে পারব তা কী করে ভাবলে?
সেটা তোমার সমস্যা।
এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কাউকে নিয়ে যাওয়া শোভন নয়।
সেইরকম জায়গায় না গেলেই হলো।
কী ব্যাপার বলো! হঠাৎ এমন উৎসাহ?
জয়তী মুখ ঘুরিয়ে নিল কোনো জবাব দিল না। অগত্যা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল গৌরব। এই মুহূর্তে তার এমন কোনো জায়গার কথা মনে পড়ছিল না যেখানে যাওয়া যায়। সে চলন্ত ট্যাক্সিতে বসে জয়তীর দিকে একবার তাকিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো।
এখন প্রায় অপরাহ্ন। বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে জয়তী প্রথম কথা বলল,
আমরা কোথায় এলাম?
চিনে নাও। গৌরব ট্যাক্সিওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিলো।
তোমাদের বাড়ি? জয়তী রাস্তায় নেমে চাপা গলায় বলল।
গেট খুলতে খুলতে গৌরব হাসল, হুঁ।
ইসস্। তুমি এভাবে এখানে আমাকে আনলে?
কী ভাবে?
এরকম বিশ্রী– ওঃ ভালো।
আরে তুমি তো ঠিকই আছ। তাছাড়া যে চেহারা নিয়ে তুমি আমার সঙ্গে বেরুতে পার সেই চেহারায় পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যাওয়া সম্ভব। এসো।
টনি দাঁড়িয়েছিল বাগানে। সেই প্রথম দেখল। গৌরব তাকে ডাকল,
টনি। জলদি। এঁর সঙ্গে আলাপ কর। ইনি জয়তী।
টনি এগিয়ে এসে জয়তীকে দেখল, তোমাকে আগে কখনও দেখিনি।
জয়তী কী বলবে বুঝতে পারছিল না। গৌরব জবাব দিলো, দেখবি কী করে? ইনি চিরকাল মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে যুদ্ধ করেন।
ইন্দ্রজিত! টনি শব্দটা বলেই মাথা নাড়ল, মেয়ে হলে কী বলব?
এই সময় মলি বেরিয়ে এল বারান্দায়, ও গৌরব, তুমি সারাদিন না খেয়ে–। বোঝা গেল জয়তীকে দেখেই মলি কথা শেষ করতে পারল না।
গৌরব বলল, একদিন না খেলে মানুষের শরীর ঠিকই থাকে। তুমি নেমে এসো। বাড়িতে অতিথি এসেছে। মলি দোতলা থেকে অদৃশ্য হলো। গৌরব জয়তীকে বলল, এসো, আমাদের ঘরে এসো।
বাইরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জয়তী বলল, কি লজ্জায় ফেললে! এই সময় মলি ও সরলা নেমে এলেন। পরিচয় করিয়ে দেবার পর জয়তী সরলাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সরলা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন মা? এইভাবে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলতে হয়?
জয়তী কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারল না। গৌরব আর সেখানে দাঁড়াল না। তার এবার স্নান করা দরকার। খিদেও কম পায়নি। খুব ভালো বলেছে টনি। মেয়ে ইন্দ্রজিত। সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে শুধু নিজেকে আড়াল করে যাচ্ছে জয়তী, দেখা যাক, আজ ওঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়।
জলই যদি মাছের জীবন তবে নদীর মাছ কি সমুদ্রের গিয়ে স্বস্তি পায়? কিন্তু অনেক সামুদ্রিক মাছ স্বচ্ছন্দে উজান বেয়ে ঢুকে যায় নদীর ভেতরে। তাদের জীবনের অন্যতম কর্তব্য ডিম উৎপাদন করে ফিরে যায় সমুদ্রে। কোনো কোনো মাছ যারা নুনে মানুষ, তাদের মিঠে জলে অসুবিধে হয় না কিন্তু মিঠে জলের মাছেরা নুনজল সহ্য করতে পারে না। সেই বিকেলে বাড়ি ফিরে একথা মনে হয়েছিল জয়তীর। সে নিজে কি নুনজলের মাছ? নইলে অতক্ষণ একটা পরিবার সবার আদরের মধ্যে থেকে একটু অস্বস্তি হলো না তো তার? এ তো তার অভ্যেস ছিল না। গৌরবের মা যে ভাবে কথা বলেছেন সেইভাবে কেউ কখনও কোনোদিন কথা বলেনি। বস্তুত লজ্জাই করছিল তার। তিনি যে ধরেই নিয়েছেন জয়তী তার ছোটবউ। এবং সে যেন ইচ্ছে করেই তাকে এবং তার ছেলেকে কষ্টের মধ্যে রেখেছে। গৌরবের বউদি বলেছেন তিনি একা আর কতদিন সংসারের ভার বইবেন? জয়তী এলে সেটা ভাগ করে নেওয়া যেত। এমন কি টনি বনি পর্যন্ত তার সঙ্গে আঠার মতো লেগেছিল। চলে আসার আগে সবাই বলেছিল, ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। গৌরবের মা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন তিনি আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে পারবেন না। এইসব কথা শুনতে এমন আন্তরিক ব্যবহার পেতে কোন্ মেয়ের না আনন্দ হয়? কিন্তু জয়তীর যে একই সঙ্গে অস্বস্তি হচ্ছে সেকথা ওখানে বলার উপায় ছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল যোগ্যতা ছাড়াই তাকে সম্মান দেখানো হচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে আর একটা ভাবনা মাথায় এল। গৌরব ইচ্ছে করেই তাকে এই পরিবেশে এনে ফেলেছে। নিজে কয়েকবার বলে যখন জয়তীর কাছ থেকে ঠিকঠাক সাড়া পায়নি তখন বাড়ির লোকের মধ্যে তাকে এনে কথা বের করার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা গরম হয়েছিল জয়তীর। কিন্তু পরিবেশটা এমন কিছু সে সব কিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফেরার সময় ট্যাক্সিতে বসে গৌরব চুপচাপ ছিল। জয়তী জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা কী হলো? নির্বিকার মুখে গৌরব জানতে চাইল, কোনটা?
বাড়িতে নিয়ে এসে তুমি আলাদা সরে রইলে। আর এঁরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলেন যেন এ বাড়ির বউ হয়ে আসাটা আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে এবং সেই ইচ্ছেটা করছি না বলেই এরা অসুখে রয়েছেন। জয়তী সোজাসুজি তাকাল।
তোমার কী মনে হলো? এ বাড়ির লোক চাইলেই তুমি আসতে পার না?
দ্যাখো গৌরব। এঁরা খুব ভালো। আমি কিন্তু এঁদের বিয়ে করছি না।
মানে?
বিয়ে হবে তোমার সঙ্গে আমার। এঁরা সম্পর্কে সম্পর্কিত।
নিশ্চয়ই।
তোমার আমার সমস্যাটাকে সমাধান না করে আমাকে এঁদের মধ্যে এনে খুব অন্যায় করেছ। এখন নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।
তুমি কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বলেছিলে আমি যেখানে যাব তুমি সেখানেই যাবে। অতএব তোমাকে জোর করে বা ভুলিয়ে আমি এই বাড়িতে আনিনি।
জয়তী মুখ ফেরাল। হ্যাঁ, এই কথাটাও মিথ্যে নয়।
গৌরব গলা নামাল, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? আমি কি তোমার উপযুক্ত নই?
না। আমার মধ্যে একটা ধারণা কাজ করছে, আমিই তোমার উপযুক্ত নই।
অদ্ভুত।
না গৌরব, মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব অচেনা মনে হয়।
কেন?
তা বলতে পারব না।
তাহলে আর আমি জোর করব না। জোর করার জন্যে অধিকার বোধ থাকা দরকার তা তুমি আমাকে দিতে চাও না অথবা আমিই অর্জন করিনি। কিন্তু তোমার মা আমাদের বাড়িতে আসবেন।
কেন?
আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।
আমি নিষেধ করে দেবো।
কী বলবে?
বলব প্রয়োজন নেই।
না।
মিছিমিছি ওদের মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ?
স্বপ্ন তো মিথ্যেই। স্বপ্ন কি বাস্তব? ওটা মনের কল্পনা। জয়তী হাসতে চাইল, যদি কিছু বলার হয় আমিই বলব। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বল তো, বারো বছর আগে তুমি আমাকে যেমন দেখে গিয়েছিলে আমি কি তেমন আছি? আমাকে কি তোমার একটুও পাল্টানো বলে মনে হয় না?
তুমি একটু ভারী হয়েছ। বারো বছর সময় তোমাকে গম্ভীর করেছে। নদীর চেহারা পাহাড়ে যেমন থাকে সমতলে পড়লে তেমন থাকে না। এখন তুমি অনেক শান্ত। মনে রেখ আমার বয়স বারো বছর বেড়েছে। গৌরব জয়তীর দিকে তাকাল, তোমার গাল ভরাট হয়েছে, চোখের চাহনিতে সেই চটপটে ভাব নেই, চুলের সংখ্যা একটু কমলেও কমতে পারে। শরীর।
থাক, আর বলতে হবে না। গৌরবের এসব কথা কেড়ে নিয়ে জয়তী বলল, পাল্টানো বলতে আমি শুধু শরীরের কথাই বলছি না। আমার মন
তোমার মন? তার তলই পেলাম না যে চিনতে পারব। গৌরব হেসে উঠল।
জয়তী আর কথা বাড়াল না। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, মাকে তুমি কীভাবে নেবে?
ওঁর যা ইচ্ছে তাই করতে দিলে ভালো হয়।
কিন্তু আমি আমেরিকায় যেতে চাই না।
বেশ তো, তুমি এখানেই থাক। বিয়ে করলে যে একসঙ্গে আমাদের থাকতে হবে এমন কোনো বাঁধাধরা শর্ত নেই। গৌরব ট্যাক্সি ড্রাইভারকে থামাতে বলল। জয়তীর বাড়ি এসে গেছে।
দরজা খুলে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল জয়তী। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, আমি যখন যেটা করি সেটা পুরোপুরিই করি। আধাখেঁচড়ায় বিশ্বাস নেই আমার। এই বয়সে যদি বিয়ে করি তাহলে বিবাহিতার মতনই থাকব। জয়তী যতক্ষণ বাড়িতে ঢুকে না গেল ততক্ষণ চুপচাপ বসে রইল গৌরব। তারপর ড্রাইভারকে বলল গাড়ি ঘোরাতে। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। কলকাতায় এসে অনেকগুলো মোটাদাগের সমস্যা দেখেছে বলেই কি জয়তীকে সে ঠিক বুঝতে পারছে না, এমনও হতে পারে!
.
টনি বনির স্কুল পর পর তিনদিন ছুটি। সৌরভ অফিসের কাজে যথারীতি বাইরে, সরলা বাগান পরিষ্কার করছিলেন গৌরবকে দেখে বললেন, ছেলেমেয়েদুটো ইস্কুল আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যেতে পায় না। তুই যা, ওদের নিয়ে তোর জেঠিমাকে দেখে আয়।
জেঠিমা? প্রশ্ন করেই গৌরব লজ্জিত হলো।
বারে ছেলে! জেঠিমাকে এর মধ্যে ভুলে গেলি! সরলা অবাক।
না, না, ভুলব কেন? আসলে অনেকদিন সম্পর্ক না থাকায় সম্পর্কগুলোর ওপর ধুলো পড়ে যায়। জেঠিমা কেমন আছেন এখন?
দুবছর আগে সতু এসেছিল একবার। তখন বলেছিল চোখে একদম দেখতে পান না। তাই নিয়েই সংসারে সব কাজ করে যাচ্ছেন।
সতুদা এর মধ্যে আসেনি কেন?
হয়তো সময় পায় না। তবুও তো ও এসেছিল, তোর দাদা একবারও যায়নি।
সতুদা কী করছে?
যা করত গ্রামের স্কুলে মাস্টারি।
গৌরব মানুষটিকে মনে করতে পারল। কালো রোগা, বড় বড় চোখ মুখে হাসি লেগে থাকত সবসময়। অভাব ব্যাপারটাকে যেন গ্রাহ্যই করত না। সতুদা গৌরবের বাবা সম্পর্কিত ভাই-এর ছেলে। ওর মাকে জেঠিমা বলত গৌরবেরা। একদম বাল্যকালে সেই গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমেরিকায় যাওয়ার আগে সে ঘুরে এসেছিল জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে। চমৎকার আচার করতেন ভদ্রমহিলা। গৌরবের মন যাওয়ার প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলো। সে বলল, শুধু টনি বনি কেন? তুমি আর বউদিও চলো আমাদের সঙ্গে।
সরলা মাথা নাড়লেন, নারে রাস্তা থেকে অনেকটা হাঁটতে হয়। আমি পারব না, তোর বউদি যদি যেতে চায় নিয়ে যা ওকে।
মলি কথাটা শুনেই চোখ তুলল কপালে, ইম্পসিবল। একদিনের জন্যে অত খাটুনি আমার পোষাবে না ঠাকুরপো।
গৌরব বোঝাতে চাইল, আহা ওদের তো তিনদিন ছুটি আছে, তোমার ইচ্ছে হলে আমরা একটা রাত ওখানে কাটিয়ে আসতে পারি।
না বাবা। গ্রামের ওই বাড়িতে রাত কাটানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তোমার মায়ের কাছে শুনেছি বাথরুম করতে নাকি মাঠে যেতে হয়।
দূর। সেসব অনেক আগের কথা। এখন নিশ্চয়ই বাথরুম হয়ে গিয়েছে।
হলেও তার ধরন কতটা ভালো হবে বোঝাই যাচ্ছে। কলকাতায় বাস করে মিনিমাম যে কর্মকাণ্ডগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তা থেকে বেরুতে তো পারব না। ছেলেমেয়েরা যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারো। তবে রাত কাটিও না। গ্রামে শুনেছি চড়ুই পাখির সাইজে মশা ওড়ে।
টনি বনি কিন্তু লাফিয়ে উঠল প্রস্তাব শুনে। ওরা এখন পর্যন্ত গ্রাম দ্যাখেনি।
বনি বলল, এই গ্রামটা কি নিশ্চিন্দিপুরের মতো কাকা?
নিশ্চিন্দিপুর?
আঃ, অপুদের গ্রাম।
গৌরব হেসে ফেলল, তোরা বুঝি গ্রাম বলতে পথের পাঁচালির গ্রাম বুঝিস। সিনেমা দেখে না বই পড়ে ধারণাটা হয়েছে?
টনি বলল, সিনেমা দেখে।
বনি বলল, আমি বইটাও পড়েছি। ফ্যান্টাস্টিক।
গৌরব বনির মুখের দিকে তাকাল। পথের পাঁচালি সম্পর্কে ফ্যান্টাস্টিক শব্দটা কখনও ব্যবহৃত হয়েছে? ওই শব্দটির মানে যাই হোক না কেন একটু হাল্কাভাব যেন লেগে থাকে। সে আর এ ব্যাপারে কথা বাড়াতে চাইল না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশের ভাষা হয়তো এরকমই। পথের পাঁচালি যে ভালো লেগেছে, অ্যাকশন নেই, স্লো, গেঁয়ো বলে নি তাই ঢের।
একটা ঝুলিতে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে পরদিন সকালে ওরা বাড়ি থেকে বের হলো। সরলা চেয়েছিলেন একপ্রস্থ কাপড়জামা সঙ্গে দিয়ে দিতে। কিন্তু মলি আপত্তি করেছিল। ওগুলো নিয়ে গেলেই এরা রাত কাটিয়ে আসবে। বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েরা হাতির পাঁচ পা দেখবে!
ধর্মতলায় এসে বাস ধরল গৌরব। আগে সরাসরি বাস ছিল দিনে তিন-চারটে। এখন আধঘণ্টা অন্তর আর তাদের নম্বরও অনেক, জিজ্ঞাসা করে করে তবে বাস বাছতে হলো। টনি বনি পাশাপাশি বসার জায়গা পেয়েছিল, গৌরব ওদের পেছনে। বাস ছাড়া মাত্র ওটা প্রায় ভরে গিয়েছিল। বনি মুখ ফিরিয়ে বলল, দারুণ থ্রিলিং ব্যাপার কাকু।
কেন রে? গৌরব জানতে চাইল।
এই ভাবে কোনোদিন যাইনি আমরা।
টনি জানলায়। সে জিজ্ঞাসা করল, কলকাতাটা কখন শেষ হবে কাকু?
সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক এদের কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার শব্দ করে হেসে বললেন, কলকাতা কোথায় শেষ হবে বলা শক্ত। যেভাবে চার পাশের গ্রাম শহর কেড়ে নিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত পেছনে ফেলে বাস যে পথে ছুটতে লাগল তার দুপাশে চাষের মাঠ জলা আর পরিষ্কার আকাশ। মাঝ বাসের ভেতরটা মানুষের চাপে হাঁসফাস করছিল। এখন প্রায় প্রতিটি স্টপেই কিছু কিছু যাত্রী নেমে যাচ্ছেন। গৌরবের মনে পড়েছে রাস্তাটা আগে এমন ছিল না। কে বলে পশ্চিমবঙ্গে কাজকর্ম বা উন্নতি তেমন হয়নি। এদিকে পিচের রাস্তার কথা পনের বছর আগে কেউ ভাবতেও পারত না। রাস্তার ধার দিয়ে ইলেকট্রিকের লাইন চলে গিয়েছে। অর্থাৎ এখন গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।
ওরা যেখানে বাস থেকে নামল সেখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই, বাসস্টপ বলেই একটা ভাঙাচোরা চায়ের দোকান রয়েছে। এই রকম চায়ের দোকান পশ্চিমবাংলায় সর্বত্র এবং ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় পথ চলতেই দেখা যায়। অথচ সমস্ত আমেরিকার অথবা য়ুরোপে এর সন্ধান পাওয়া যাবে না। গৌরবের মনে পড়ল একবার এক ছুটির দিনে নিউইয়র্কের থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে সে পরিকল্পনাহীন বেড়াতে গিয়েছিল। যে বাসে যাওয়া তাতেই ফিরে আসা। ঘণ্টাখানেক জিরোবে বাস, আর সেই ফাঁকে একটু গ্রাম ঘুরে নেওয়া। দুশো কিলোমিটার যেতে বাসটা সময় নিয়েছিল আড়াই ঘণ্টা। যা হোক, বাস থেকে নেমে সে সুন্দর সাজানো গ্রামের বাড়ি, মাঠের শস্য, বাচ্চাদের খেলা দেখতে দেখতে ভেবেছিল এক কাপ চা অথবা কফি পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু পুরো গ্রাম খুঁজেও চায়ের দোকান চোখে পড়েনি। ডিপার্টমেন্টাল শপে যাবতীয় জিনিস বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের মানুষ সেখান থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে গিয়ে রান্না করে খায়। অথচ শ পাঁচেক টাকায় এখানে চমৎকার চায়ের দোকান খোলা যায় আর এই সব চায়ের দোকানদাররা দিনে পঞ্চাশ টাকার বিক্রি সহজেই করে যা বিদেশে কেউ ভাবতেই পারে না। টনি জিজ্ঞেসা করল, কী ভাবছ কাকু?
গৌরব বাস্তবে ফিরে এল, কিছু না।
বাস চলে যাওয়ার পর জায়গাটা একদম ফাঁকা। চায়ের দোকানদার ওদের জিজ্ঞাসা করল, কোন্ গাঁয়ে যাবেন?
গৌরব বলল, হলদিয়ানি।
কার বাড়িতে?
সত্যদা।
অ, মাস্টার, তা অনেকখানি হাঁটতে হবে। ডানদিকের রাস্তা ধরে চলে যান। মিনিট পাঁচেক বাদেই গঙ্গা পাবেন। গঙ্গার ধার দিয়ে গেলেই হলদিয়ানি।
গায়ে পড়ে উপকার বোধহয় এশিয়ার মানুষ ছাড়া কেউ করে না। মাটির চওড়া রাস্তায় নেমে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁরে হাঁটতে পারবি তো তোরা? নইলে চল, এখান থেকেই ফিরে যাব।
বনি চিৎকার করল, না কক্ষনো না।
বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এই গ্রামের পথ বালিতে ভরা। হাঁটতে সুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু চমৎকার বাতাস বইছে। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়েছে, বোঝা যাচ্ছে ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছে। টনি তো চেঁচিয়ে উঠল, দ্যাখো কাকু, আকাশটা কী নীল!
গৌরব হেসে বলল, আকাশ তো নীলই হয়।
মোটেই না। প্রতিবাদ করল টনি, কলকাতার আকাশ কক্ষনো নীল নয়।
এই সময় একটা সাইকেল রিকশাকে এগিয়ে আসতে দেখল। বনি বলল, কাকু রিকশা।
গৌরব মাথা নাড়ল, না। ভালো করে দ্যাখ এটা কিন্তু সাইকেল রিকশা নয়। পেছনে সিট নেই। বসার, ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। এতে করে জিনিসপত্র নিয়ে যায়।
ততক্ষণে রিকশাটা এসে গিয়েছে। রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে জিজাসা করল, কোন্ গাঁয়ে যাবেন বাবু?
গৌরব উত্তর দেওয়ার আগেই টনি বলল, হলদিয়ানি।
পাঁচ টাকা দিন পৌঁছে দিয়ে আসি। রিকশাওয়ালা নেমে দাঁড়াল।
বনি বলল, আরে, এই রিক্সায় মানুষ যাতায়াত করে?
হ্যাঁ দিদি। গ্রামের ব্যাপার তো, মাল মানুষ যখন যেটা পাই তুলে নিই। সিটওয়ালা রিকশা হলে মাল নিতে অসুবিধে হতো, মাল তো নয়, এক একজন যেন পাহাড় তুলে নিয়ে যায়। উঠুন আপনারা।
গৌরব ইশারা করতেই টনি বনি সন্তর্পণে উঠে মাঝখানে বসল পাশাপাশি।
গৌরব পেছনে দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। রিকশার দিক বদল হলো। দেখা গেল পা মুড়ে বসতে হলেও খুব খারাপ লাগছে না। ঝাঁকুনি হচ্ছে কিন্তু সেটা কিছু নয়। বনি জিজ্ঞাসা করল, গঙ্গা কতদূর?
ওইতো বাঁক ঘুরলেই, হাওয়ায় জলের গন্ধ ভাসছে, বুঝতে পারছেন না? টনি নাক টানল। যেন গন্ধটা নিতে চাইছে সে। তারপর হেসে ফেলল। বাঁকা ঘুরতেই চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার। গঙ্গা যেন আচমকা গায়ের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু এ কোন গঙ্গা? বনি বলল, ও কাকু এ তো সমুদ্র!
টনি বলল, হ্যাঁ কাকু ওপার দেখা যাচ্ছে না। কলকাতায় তো দেখা যায়।
গৌরব দেখল বড় বড় ঢেউ আসছে, ভেঙে পড়ছে পাড়ের ওপর। এত বছরেও নদীটার চেহারাটা পাল্টায়নি। হ্যাঁ এখানে গঙ্গাকে আর নদী বলে মনে না। আর কয়েক কিলোমিটার পরেই তো সমুদ্র। তাই দেখলে মনে হয় সমুদ্র যেন নিজেই উঁচিয়ে গঙ্গায় ঢুকে পড়ে বিশাল করে তুলেছে চেহারাটা।
বনি আদুরে গলায় বলল, ও কাকু, এখানে একটু বসবে?
টনি ধমকে উঠল, রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকবে?
অগত্যা আর বসা হলো না। গঙ্গার গা ঘেঁষে কিছুটা যাওয়ার পর রিকশা আবার পথ পাল্টালো। এবার গাছ চেনার খেলা। আম, কাঁঠাল চেনা গেল, লিচু চিনতে হিমশিম খেয়ে গেল দুজনে, কটা কালচে পাতার ঝোঁপ দেখিয়ে গৌরব জিজ্ঞেস করল, ওটা কি বল তো। রিকশাওয়ালাও মজা পেয়েই দাঁড়িয়ে গেল। টনি বনি অনেক ভাবল। শেষ পর্যন্ত বনি বলল, কোনো ডেকোরেটিভ পাতা।
হো হো করে হেসে উঠল গৌরব। রিকশাওয়ালা এগিয়ে গিয়ে দুটো পাতা ছিঁড়ে এনে দুজনের হাতে দিয়ে বলল, লক্ষ্মণকে যখন প্রায় মেরে ফেলেছিল তখন হনুমান গিয়েছিল গন্ধমাদন পর্বতে বিশল্যকরণী পাতা খুঁজতে। ওই পাতার রস যদি লক্ষ্মণকে খেতে দেওয়া যায় তো তিনি সেরে উঠবেন। পাতা চিনতে না পেরে পুরো পাহাড়টাকেই উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল হনুমান। তাই এখানে ওখানে ওই পাতার গাছ ছড়িয়ে গিয়েছে। এটা হলো বিশল্যকরণী পাতা।
দুজনেই প্রবল বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, সত্যি?
গৌরব বলল, আমি তো সেই সময় ছিলাম না যে বলতে পারব এই পাতাই লক্ষ্মণকে বাঁচিয়ে ছিল কি না। তবে কেটে গেলে এই পাতার রস লাগালে খুব তাড়াতাড়ি জুড়ে যায়, এটা দেখেছি।
বনি বলল, উঃ ফ্যান্টাস্টিক। এটা নিয়ে যাব, আমার বন্ধুদের দেখাতে হবে।
গৌরব বলল, ঠিক আছে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, যাওয়ার সময় একটা ডাল নিয়ে গেলেই হবে। আচ্ছা, আমরা তো গ্রামের মুখে এসেই গেছি, এখান থেকে হেঁটে গেলে খারাপ লাগবে না। নাও, ভাই তোমাকে আর যেতে হবে না। পাঁচটা টাকা রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দিলো সে।
দুপাশে ছোট শাকের খেত, মাঝে মাঝে গ্রাম্যবাড়ি, ওরা হাঁটছিল। এরই মধ্যে গৌরব নাজেহাল হয়ে পড়েছে ওদের প্রশ্নে। এটা কী গাছ ওটা কোন ফুল যেন একদিনেই সব জেনে নিতে চায় টনি বনি। এই সময় এক বৃদ্ধকে আসতে দেখা গেল বিপরীত দিক থেকে। তাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল গৌরবের কিন্তু সঠিক ধরতে পারছিল না। মুখোমুখি হতেই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলেন।
কেমন আছ? অনেকদিন পরে তোমায় দেখলাম। বৃদ্ধ বললেন।
ভালো। হ্যাঁ, আসা হয় না বড় একটা। গৌরব বিব্রত গলায় জবাব দিলো।
আমেরিকা থেকে কবে ফিরলে?
এই তো কিছুদিন হলো।
বিয়ে থা করেছ?
আজ্ঞে না। উত্তর দিতেই গৌরবের সন্দেহ তীব্র হলো।
এরা তোমার দাদার ছেলে মেয়ে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন মাস্টারমশাই?
এতক্ষণে চিনতে পারলে? আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি গুলিয়ে ফেলছ। দেখছিলাম শেষ পর্যন্ত চিনতে পার কিনা। না, সাকসেসফুল মানুষের গুণ তোমার মধ্যে আছে। তোমার নিজেরই মনে নেই আমিই তোমার হাতে খড়ি দিয়েছিলাম!
গৌরব ভদ্রলোককে প্রণাম করল। আপনি আমাকে লজ্জা দেবেন না।
মাস্টামশাইকে গর্বিত বলে মনে হলো। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ছুটিতে এসেছ?
হ্যাঁ।
গৌরব। বিদেশে অনেকদিন আছ নিশ্চয় এমন কিছু শিখেছ যা এখানকার মানুষ জানে না। যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই বিদ্যেটা দেশের মানুষকে শেখাও। মাস্টারমশাই সামান্য হাতটা তুললেন, আচ্ছা চলি। যদি বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে।
শ্লথগতিতে ভদ্রলোক হাঁটা শুরু করলেন। গৌরব চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। এই রকম ভুল তার হলো কী করে? মাস্টারমশাইকে ভুলে যেতে পারল সে? যদিও এই ভদ্রলোকের কাছে সে ছমাসের বেশি পড়েনি এবং সেটা পাঁচ বছর বয়সে তবু! হঠাৎ টনি জিজ্ঞাসা করল, কাকু হাতেখড়ি মানে কী?
গৌরব হেসে ফেলল, তোর হাতেখড়ি হয়নি?
না তো। টনি ঘাড় নাড়ল।
গৌরব বনির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তুই বুঝিয়ে দে।
না, আমি তোমার মুখে শুনব। টনি জেদ ধরল।
হাঁটা শুরু করল গৌরব, আগে পাঁচ বছর বয়স পার না হলে লেখাপড়া করতে হতো না, পাঁচ বছর পূর্ণ হলে সরস্বতী পূজোর দিন সকালে কোনো বয়স্ক মানুষ শ্লেটে খড়ি দিয়ে, খড়ি মানে চক, অক্ষর লেখাতেন। অ আ ই ঈ। ব্যস তখন থেকে তার লেখাপড়ার পালা শুরু হয়ে গেল। কোনো অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে যেমন ফিতে কাটতে হয় তেমনি ছাত্রজীবনের উদ্বোধনের নাম হাতেখড়ি।
আমার হাতেখড়ি হয়নি কেন?
কী করে বলব? আমি তো তখন বিদেশে ছিলাম।
বনি বলল, তুই তিন বছর বয়স থেকে নার্সারিতে পড়ছিলি। আর তোকে কখনও শ্লেটপেন্সিলে লেখানো হয় নি, তোর হাতেখড়ি হবে কী করে?
টনির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছিল হাতেখড়ি না হওয়ায় তার একদম ভালো লাগছে না।
বাঁ দিকে একটা খেলার মাঠ। মাঠের প্রান্তে টিনের চালওয়ালা একতলা কয়েকটা ঘর। দেখলে ব্যারাক বাড়ি বলে মনে হয়। সেখান থেকে গান ভেসে আসছিল। গৌরব বলল, ওই তো স্কুল। চল দেখি, সতুদাকে বোধহয় স্কুলেই পেয়ে যাব।
মাঠের মাঝ বরাবর আসতেই গানের লাইনগুলো স্পষ্ট হলো, ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী। ওরা বারান্দার সামনে দাঁড়াল যতক্ষণ গান শেষ না হয়। মাঝখানের ঘরে ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে ছাত্ররা গান গাইল। তাদের সামনে চারজন শিক্ষক গলা মেলাচ্ছিলেন। গান শেষ হতেই ছাত্ররা চারটে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় এবং বনিকে দেখে ওদের চোখে কৌতূহল স্পষ্ট। এই সময় শিক্ষকদের একজনের নজর পড়ল এদিকে। গৌরব দেখল সতুদা এগিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে। মানুষটাকে আরও রোগা আরও বয়স্ক মনে হচ্ছে। কিন্তু হাসি আর চেহারা পাল্টায় নি।
প্রায় চিৎকার করে সতুদা জিজ্ঞাসা করল, আরে গোরা তুই?
চলে এলাম। গৌরব হাসল।
কোত্থেকে? কবে এসেছিস আমেরিকা থেকে? সতুদা খুব উত্তেজিত।
কিছুদিন হলো।
আমি ভাবতেই পারছি না তুই এসেছিস!
কিন্তু অসময়ে তোমাকে বিব্রত করলাম। এখন তোমার কাজের সময়।
তোর অনারে এক ঘন্টা ছুটি করে নিতে পারব। ওঃ, মা চমকে যাবে।
জেঠিমা কেমন আছেন?
মা মায়ের মতনই। চোখে দেখতে পান না একদম।
ছানি কাটাওনি?
ছানির ব্যাপার নয়। মায়ের আইবল দুটোই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তার জন্যে তিনি বিন্দুমাত্র বিব্রত নন। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবি। একটু দাঁড়া।
সতুদা ভেতরে চলে গেল। গৌরব বনিকে জিজ্ঞেস করা, তোরা ওকে চিনিস না? দুবছর আগে আমাদের বাড়িতে তো গিয়েছিল।
বনি জবাব দিলো, আমরা তখন স্কুলে ছিলাম। তার অনেক আগে একবার এসেছিলেন ঝাপসা মনে আছে।
প্রণাম করবি।
ফস্ করে টনি বলে বসল, পায়ে ভীষণ ধুলো।
গ্রামে বাস করলে পায়ে ধুলো লাগবেই।
সতুদা বেরিয়ে এল, চল।
এই সময় টনি আর বনি প্রণাম করল। দুহাতে দুজনকে জড়িয়ে ধরে সতুদা হাঁটতে লাগল, বাপরে, সৌরভদার ছেলেমেয়ে কত বড় হয়েছে। সৌরভদা বউদি তো ভুল করেও গ্রামে আসেন না। তোমরা বড় হচ্ছ, তোমরা তো আসতে পার। দ্যাখো শহরের কোনো আরাম গ্রামে নেই। কিন্তু খুব সামান্য জিনিসের মধ্যেও গ্রামে অনেক স্বস্তি পাওয়া যায়। ধর, তুমি স্কুল যাচ্ছ য়ুনিফর্ম পরে, বেড়াতে যাচ্ছ খুব সাজগোজ করে কিন্তু রাত্রে যখন নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাও তখন কি সেই পোশাক থাকে? থাকে না। তখন তুমি আটপৌরে পোশাকেই শুয়ে পড়। কারণ বিয়েবাড়ি যাওয়ার সাজে ঘুম আসবে না। গ্রামে মাঝে মাঝে আসবে ওই আটপৌরে হবার জন্যে বুঝলে।
গৌরব হাসল, তুমি এখনও ঠিক আগের মতো সুন্দর কথা বলো।
এক ভদ্রলোক সাইকেলে চেপে যাচ্ছিল। সতুদা হাত তুলে চিৎকার করলেন, ও অজয়দা একটু দাঁড়াবে।
ভদ্রলোক প্যাডেল থেকে পা নামালেন। সতুদা এগিয়ে যেতে চিৎকার করলেন, একে চিনতে পারছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না।
গৌরব বলল, আমি কিন্তু আপনাকে চিনেছি। আপনি খুব ভালো সাঁতার কাটতেন। একবার গঙ্গা পার হয়েছিলেন বাজি ধরে।
অজয়বাবু মাথা নাড়লেন, যাচ্চলে! আমি তো একে চিনতে পারছি না সতুমাস্টার।
সতুদা বলল, আমার ভাই গোরা। গৌরব।
গোরা? যে শুনেছি আমেরিকা গিয়ে মেম বিয়ে করেছে?
সেটা আমি বলতে পারব না। সতুদা হাসল।
হো হো করে হেসে উঠল গৌরব, এরকম গল্প চালু হয়েছে বুঝি? আমেরিকায় গেলেই বিয়ে করতে হবে মেমসাহেবকে?
করোনি? যাচ্চলে!
মেম বিয়ে করা খুব সহজ নয়।
সেকি শুনেছি বাঙালি ছেলেরা সে দেশে গিয়ে বাড়ির ঝি কিংবা রেস্টুরেন্টের চাকরানিকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।
আমেরিকায় বাড়িতে কাজ করার জন্যে ঝি পাওয়া যায় না। যদি রাখতে হয় তবে তাদের মাইনে আমাদের টাকায় মাসে পনের হাজার।
অজয়বাবু অবিশ্বাসী চোখে তাকালেন, অত দিতে হবে না, ওর দশ ভাগের এক ভাগ দিলেই আমাদের দেশের মঙ্গলার মা, বাবুর মা, পাঁচির মা ছুটে যাবে আমেরিকায় কাজ করতে। যাক, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগল। আমরা তো কিছুই হতে পারলাম না, তুমি অন্তত তোমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ।
গৌরব এই ধরনের কথাবার্তার সামনে কিঞ্চিত অসহায় বোধ করল। তাকে ইনি প্রশংসা করছেন না নিজের জন্যে আফসোস করছেন তা ধরা মুশকিল। বাঙালির একটা নিজস্ব ধরন আছে আফসোস করার। অন্যকে প্রশংসা করার ছলে নিজের জন্যে হা-হুতাশ ছিটকে বের করে তারা। সেই প্রশংসাকে প্রশংসা বলে ধরা নিতান্তই বোকামি। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম। আমার কিছু হয় নি তোমার হয়েছে মানে আমি সুযোগসুবিধা পাইনি বলে বঞ্চিত হয়েছি আর তুমি সেগুলো পেয়েছ বলে এগিয়ে গিয়েছ। এই এগিয়ে যাওয়াটা আমার দ্বারাও সম্ভব ছিল। অতএব তোমার আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই তোমার ডাঁট দেখাবারও কিছু নেই।
সতুদা বলল, অজয়দা, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। গোরা এক মিনিট। সতুদা ভদ্রলোকের সঙ্গে এগিয়ে গেলেন কিছুটা। কথাবার্তা কী হলো গোরার পক্ষে শোনা সম্ভব ছিল না কিন্তু সতুদাকে পকেট থেকে টাকা বের করে অজয়বাবুর হাতে দিতে দেখল সে। সেখান থেকেই হাত নেড়ে অজয়বাবু চলে গেলে সতুদা হাসিমুখে ফিরে এল, চল।
কিছু দরকার ছিল না আমাদের জন্যে অত টাকা খরচ করার। গৌরব বলল।
তোর জন্যে কে বলল। ভাইপো ভাইঝি এসেছে না? সতুদা হাসল। এখন তোর আমেরিকা জীবন সম্পর্কে কিছু বল।
গৌরব বলল, একই রকম। দিল্লি বম্বেতে আমি থাকলে যেমন হতো। শুধু আরও কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধে পাওয়া যায়, কাজের জায়গায় মন দিয়ে কাজ করা যায় এই আর কি!
শুনেছি ওখানে প্রচুর বাঙালি আছে!
তা আছে। ছেড়ে দাও ওসব কথা। তুমি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলে না সতুদা?
দূর! বিয়ে করে খাওয়াবো কী?
এর পরে সতুদা টনি বনির সঙ্গে জমে গেল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে ওরা। কোন জিনিসটা কী তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চলছে সমানে। বনি টনি সেগুলো মন দিয়ে শুনছে। সেই বিশাল বট গাছটা চোখে পড়ল। ছেলেবেলায় শুনত ওই গাছে নাকি এক ব্রাহ্মণ দম্পতি মারা যাওয়ার পর বাস করেন। কি যেন বলে, ব্রহ্মদৈত্য। তারা নাকি কারো কোনো ক্ষতি করেন না। গাছটাকে দেখল গৌরব। একই রকম রয়েছে। শুধু সেই ব্রহ্মদৈত্য দম্পতি এখনও আছেন কিনা কে জানে। সতুদাকে ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল না সে। সতুদা তখন দুজনকে বোঝাতে আরম্ভ করেছে কত রকমের ধান হয় আর তাদের কী কী নাম।
ইটের পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলা পড়েছে। কোথাও একটু আধটু ভাঙনের চিহ্ন। এই পাঁচিলটাকে এক সময় ভালো চেহারায় দেখেছিল গৌরব। টিনের দরজা ভেতর থেকে একটা তারের হুকে আটকানো। সতুদা ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে সেটা খুলে বলল, এসো। ভেতরে অনেকখানি জায়গা, গাছপালা, বাগান। বাগানে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। লতানো ডালে কুমড়ো হয়েছে। টনি সেদিকে ছুটে গেল। কুমড়োর গায়ে হাত রেখে বলল, আমি এই প্রথম কুমড়োকে গাছে ঝুলতে দেখলাম।
গৌরব এগিয়ে গেল। বড় বাড়ি বলে যেটাকে এক সময় চিহ্নিত করা হতো তার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। সম্ভবত কাজের একটি মহিলা অবাক হয়ে বেরিয়ে এসেছিল দরজা খুলে। সতুদা তাকে ডাকতে সে নেমে এল। গৌরব খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল। তিন পাশে ইউ-সেপে ঘরগুলো আর মাঝখানে উঠোন। উঠোনটি বেশ বড়। ওপাশে রান্নাঘর আর কোণের দিকে বাথরুম টয়লেট। একটুও চেহারা বদল হয়নি। ভেতরের বারান্দায় নেমে গৌরব চুপচাপ দাঁড়াল। শূন্য বাড়ি। রান্নাঘরের দাওয়ায় সিঁড়ি পেতে বসে আছে জেঠিমা। সম্ভবত সতুদার গলা তার কানে গিয়েছিল। দুচোখ বন্ধ কিন্তু মুখ তুলে কানে শোনবার চেষ্টা করছেন।
গৌরব প্রায় নিঃশব্দে উঠোন পেরিয়ে পাশে দাঁড়াল। কেউ যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেলেন জেঠিমা। চোখের পাতা খুলল। গৌরব দেখল মণি দুটো সাদা হয়ে রয়েছে। জেঠিমা সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে, কে এসেছে?
গৌরব ধীরে ধীরে নিজের হাত রাখল তার পায়ে। প্রণাম করে উঠে দাঁড়াবার সময় খপ করে হাত ধরে ফেললেন জেঠিমা, কে, কে তুমি?
এই সময় পেছন থেকে সতুদা বলে উঠল, বলো দেখি মা, কে এসেছে?
গৌরব দেখল ওপাশের বারান্দায় সতুদার পাশে টনি বনি দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। বৃদ্ধার খুব অসুবিধা হচ্ছে, গৌরবের হাতে হাত বোলাচ্ছেন। গৌরবের ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের পরিচয় দিতে। তার আগেই জেঠিমার হাত ওর কনুই-এর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে একটা কাটা দাগ ছিল। ওঁর আঙুল কয়েকবার সেই দাগের ওপর স্পর্শ করল। তারপর দুটো হাত শূন্যে তুলে মুখ ধরতে চাইলেন বৃদ্ধা। গৌরব নিচু হতেই মুখের স্পর্শ নিলেন। কান ছুঁলেন। তারপরেই অস্ফুটে বলে উঠলেন, গোরা! গোরা তুই শেষ পর্যন্ত এলি!
আচমকা শরীরে ঝড় উঠল যেন, দেহের সমস্ত জল হু হু করে উঠে এল বুকে, বুক ছাপিয়ে গলায় চোখে। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কৃত হলো শব্দ আটকে যাচ্ছে। পাশে বসে গৌরব জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরল। জেঠিমা আজ উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছেন, বল, কথা বল, তুই গোরা না?
গৌরব কোনো মতে বলতে পারল, হ্যাঁ।
কেমন আছিস তুই? কত বড় হয়েছিস? ওঃ তোকে কতদিন দেখি না। আমি আর দুচোখে দেখতে পাই না রে! জেঠিমার গলায় কান্না ছিটকে উঠল। গৌরব কথা বলতে পারছিল না। আমরা দুটো দেখার চোখ থাকতেও জীবনের অনেক কিছু দেখতে পাই না। আর এই বৃদ্ধা অন্ধ হয়েও শুধু স্পর্শ দিয়ে কত বছর আগে শেষ এক কিশোরকে যৌবনের মধ্য স্তরেও ঠিক দেখে নিলেন।
সতুদা এগিয়ে এলেন, মা তুমি গোরাকে নিয়েই আছ, এখানে আরও দুজন বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভের ছেলেমেয়ে।
জেঠিমা হাত বাড়ালেন, কই কোথায় ওরা। এসো দাদু-দিদা কাছে এসো। তোমাদের তো কোনোদিন চোখে দেখি নি। তোমার বাবা-মা সাহেব মেম হয়ে গিয়ে আর তো এখানে আসে না। তোমরা নিশ্চয়ই খুব ভালো নইলে এত কষ্ট করে এই গ্রামে আসতে না।
বনি টনির দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে জেঠিমাকে প্রণাম করল। একটু বাদেই জেঠিমার দুদিকে, তাদের কাঁধে হাত রেখে তিনি সানন্দে বসে আছেন। ওপাশের বারান্দা থেকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে জেঠিমার সামনে বসে গৌরব জিজ্ঞাসা করল তুমি আমাকে চিনলে কী করে বলো তো?
জেঠিমার চোখে জল কিন্তু মুখে হাসি ফুটল, গন্ধ শুঁকে।
যাঃ।
হ্যাঁরে তোর শরীরে হাত রাখা মাত্র মনে হলো খুব জানি। নাকে যেন ভক্ করে একটা চেনা গন্ধ লাগল। প্রথমে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেবেলায় প্রত্যেক মানুষের শরীরে একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। বড় হতে হতে সেই গন্ধটা চাপা পড়ে যায়। ছেলেবেলায় খুব ভালবাসলে সেই গন্ধটা নাকে থেকে যায়। চাপা পড়ে গেলেও সেটা ঠিক টের পাওয়া অসম্ভব নয়। তাছাড়া তোর কনুইতে হাত দিতেই গন্ধটা পরিষ্কার হলো। কাটা দাগটা আমগাছ থেকে পড়ে তোর এই বাড়িতেই হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কান পরীক্ষা করলাম তোর কানের লতি জোড়া। ব্যস, দুই দুইয়ে চার।
তুমি সত্যি অদ্ভুত একই রকম আছ।
হ্যাঁ আমরা মা জেঠিমা একই রকম থাকি, তোমাদের ডানা গজালে আর পাত্তা পাওয়া যায় না। অসতু, তুই কি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবি? বাচ্চারা রোদে তেতে পুড়ে এলো অন্নদাকে বল কিছু খেতে দিতে। বলেই টনির হাতে চাপ দিলেন, অ্যাই তোরা মুড়কি খাবি?
মুড়কি?
খাসনি কখনও? তোদের শহুরে খাবার কোথায় পাব দাদু।
তিন বাটি মুড়কি এলো। দেখা গেল বনির সেটা খুব পছন্দ না হলেও টনি সোৎসাহে খাচ্ছে। এই সময় একটা নীল রঙের পাখি লেজ ঝুলিয়ে কাঁঠালগাছে এসে বসল। টনি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, দিদি দ্যাখ।
সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই ছুটল গাছটার দিকে। গৌরব কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সতুদা আপত্তি করল, ওদের বাধা দিস না। কলকাতায় তো এই জীবন পায় না।
এই সময় জেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে তোর মা কেমন আছে?
ভালো।
কতদিন দেখি না ওকে। আমার পক্ষে তো কোথাও যাওয়া সম্ভব না। ওকে তো নিয়ে আসতে পারতিস। অনুযোগ গলায়।
মা এতটা হাঁটাহাঁটি পারত না। পায়ে বাত আছে। হাঁটাহাঁটি কিসের। বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠত। জেঠিমা বললেন, এতদিন তুই মাকে ছেড়ে বিদেশে পড়ে রইলি কিসের টানে বুঝি না বাবা। মাকেও তো নিয়ে যেতে পারিস।
মা যাবে না। দেশের মাটির মায়া বড় বেশি।
হওয়াই তো উচিত। তুই আর ফিরে যাস না, এখানেই থেকে যা।
দেখি!
বিয়ে থা করবি না? নাকি দাদার মতো সিড়িঙ্গে হয়ে থাকবি?
ভাই তো দাদাকেই অনুসরণ করে।
না তোকে বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে পছন্দ আছে?
গৌরব জবাব দিলো না। সতুদা বলল, তুমি ও আসামাত্র প্রশ্ন করে নাজেহাল করছ। ওদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না?
হবে বাবা হবে। আমি অন্নদাকে বলছি, পোস্ত, কলাই-এর ডাল, কাঁকরোল ভাজা দুধ কলা ওকে খাওয়াতে। পোস্তটা আমি রাঁধব।
মাছ আসছে। আমি অজয়দাকে বলেছি, চিংড়ি আনতে। গলদা না পাওয়া গেলে বাগদা। ওটা তুমি রান্না করো। সতুদা বলল।
আপত্তি করল গৌরব, কি আশ্চর্য তুমি এই অবস্থায় রান্না করবে কি?
করি তো। অভ্যেস, কোনো অসুবিধে হয় না। তাছাড়া এত বছর পরে তুই খাবি আর আমি রাঁধব না, এ কখনও হয়। হয়তো এই জীবনে আর সুযোগই পাব না। তুই কলাই ডাল ভালবাসতিস, কাঁকরোল ভাজা পেলে খুশি হতিস আর আমার হাতের পোস্ত পেলে মাছ দরকার হতো না, মনে আছে? জেঠিমা উঠে দাঁড়ালেন, অন্নদা ও অন্নদা।
সতুদা বলল, তোরা কথা বল। আমি স্কুল থেকে একটা পাক দিয়ে আসি।
জেঠিমা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্নদার সঙ্গে। উঠোনের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল গৌরব। পৃথিবীটা সত্যি অদ্ভুত। জীবন আরও বেশি। এখন সভ্যযুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা অনেক কিছু পাই। অনেক সুখ অনেক আরাম সেই জীবনে আহরণ করা যায়। শুধু তার জন্যে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। যোগ্যতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় মানুষেরা এখন মরিয়া। কিন্তু এসবের বাইরে আর এক ধরনের জীবন আছে। যে জীবন স্বার্থহীন এক অপার্থিব আনন্দ চুপচাপ বহন করে যায়। সভ্যতার বর্ণাঢ্য জমকে আমরা অন্ধ হয়ে থাকি বলে সেই জীবনের রূপ রস গন্ধ হারিয়ে ফেলি। হয়তো এই প্রজন্মের মানুষই শেষ ভাগ্যবান যাদের জন্যে এমন জেঠিমা অথবা মা পিসিমারা বেঁচে আছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরের মানুষ বইতে পড়বে কিন্তু তাদের জন্যে কোনো জেঠিমা অপেক্ষা করবেন না যিনি গন্ধ নিয়ে স্পর্শ দিয়ে দীর্ঘ অদর্শনের পরেও বলতে পারেন তার আত্মার আত্মীয় এসেছে সামনে।
বাঙালির বুকে যত সুখ যত আনন্দ তার চেয়ে কষ্ট এবং আক্ষেপ অনেক বেশি। যে কোনো বয়স্ক অথবা বয়স্কা বাঙালির সঙ্গে, যিনি আত্মীয়তা সূত্রে জড়িত, একা বসলেই সেইসব আক্ষেপ আর কষ্টের কথা শোনা যায়। পৃথিবীর অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরাও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয় কিন্তু বাঙালি দীর্ঘকাল কষ্ট লালন করতে ভালবাসে। এক বৃদ্ধা বা বৃদ্ধ মনের কথা বলার মতো মানুষ পেলে যে আক্ষেপের কথা বলেন তাতে স্পষ্ট অভিযোগ মিশে থাকে। ছেলে দেখছে না, অমুক সময়ে তমুক পান নি, নিজেকে অত্যন্ত বঞ্চিত বলে মনে হয়, নেহাৎ প্রাণ শরীর ছেড়ে যাচ্ছে না তাই বেঁচে থাকা ইত্যাদি আক্ষেপের পাঁচালি পাঠ করে মনে মলম দিতে চান তারা। কিন্তু একবার মলম বুলিয়ে শান্তি পান না তারা। যখনই উপযুক্ত শ্রোতা পান তখনই এই কান্নার গল্প শুনিয়ে দিতে সময় নষ্ট করেন না। পৃথিবীর অন্য মানব সম্প্রদায়ের সঙ্গে এখানেই কিছুটা পার্থক্য তৈরি হলো। একজন ব্রিটিশ অথবা আমেরিকান বৃদ্ধ যত অসহায় অবস্থায় থাকুন না কেন কষ্ট বা আক্ষেপ দীর্ঘকাল ধরে চলে বলে আবার গ্রহণ করেন না। বঙ্গীয় বৃদ্ধ বৃদ্ধা যার বিরুদ্ধে পাঁচজনকে বলে এক ধরনের আরাম পান সেই মানুষটি যদি বর্ণনা করার সময় সামনে এসে পড়েন তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতে অতিশয় পারদর্শী। সেই ব্যক্তির সঙ্গে এই সময় যে কথা বলেন তাতে বোঝাই যায় না এতক্ষণ তার বিরুদ্ধেই বিষোদগার করছিলেন। হয়তো পরবর্তীকাল আরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনায় মনের জ্বালা চেপে রেখে তাকে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু যারা এমন অভিনয় করতে জানেন তারা নিজের দুঃখকে বারোয়ারি ভাবে প্রকাশ না করার শক্তি কেন আয়ত্ত করতে পারবেন না এটাই বোধগম্য নয়।
গৌরব ভেবেছিল আজকের দুপুরটা জেঠিমার কাছে বসে তার দুঃখের পাঁচালি শুনে কাটাতে হবে। একজন অন্ধ মহিলা একা একা গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছেন, ছেলে যত ভালোই হোক, তার নিশ্চয় বুকের ভেতরে অনেক হা-হুঁতাশ জমা আছে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।
অনেকদিন বাদে পুকুরে স্নান করল সবাই। গৌরব সাঁতার জানে কিন্তু টনির কাছে ব্যাপারটা দারুণ চমকপ্রদ। পোশাক আনা হয়নি বলে বনি জলে নামেনি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দেখল টনি প্রথম জলে নেমে ভয়ে চিৎকার করছে। গৌরব তাকে সাহসী করার চেষ্টা চালিয়েও কোমর জলের বেশি নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু সেখানেই পা ছুঁড়ে টনি প্রতিজ্ঞা করল ফিরে গিয়েই সে সুইমিং ক্লাবে ভর্তি হবে। এত মজা এত আনন্দ সে কখনও পায়নি।
খেতে বসে গৌরবের নাকে শৈশবের ঘ্রাণ লাগল। এমন তরকারি সে অনেক বছর খায়নি। জেঠিমার হাতের রান্নার স্বাদ তার কাছে অপূর্ব বলে মনে হলেও সে লক্ষ্য করল টনি বনি খুব আরাম পাচ্ছে না। জন্মাবধি মলি তাদের যে রেস্ট্রিক্টেড ডায়েটের মধ্যে রেখেছে তার অভ্যাসের বাইরে যেতে ওদের অসুবিধা হবেই। জেঠিমা বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন তারা খেতে পারছে কিনা। টনি বলেই ফেলল, মা না এরকম রাঁধে না।
জেঠিমা বললেন, সে তো শহরের মেয়ে, কত নতুন রান্না জানে, আমরা সেই ছেলেবেলায় যা শিখেছিলাম তাই করে চলেছি। এর উপর চোখে দেখি না কি রাঁধতে কি রেঁধেছি। ও সতু ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে রে।
বনি একটু বড় বলেই ঢাকতে জানে, বলল, না ঠাকুমা, একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। ডালটা খুব ভালো হয়েছে।
তাহলে তোরা ডাল দিয়ে খেয়ে নে। খুব কষ্ট হলো।
সতুদা বলল, মা তুমি, গোরাকে জিজ্ঞাসা করছ না?
জেঠিমার মুখ উজ্জ্বল হলো, সব কথা কি জিজ্ঞাসা করে জানতে হয়?
খাওয়া থামিয়ে গৌরব জানতে চাইল, কী জেনেছ?
খেতে ভালো লাগলে ছেলেবেলায় তুই এইরকম শব্দ করে খেতিস।
সঙ্গে সঙ্গে বনি বলে উঠল, হ্যাঁ কাকু, তুমি আজকে শব্দ করে খাচ্ছ।
জেঠিমা বললেন, তোর খেতে শব্দ হতো বলে সরলা খুব বকত তখন।
টনি জিজ্ঞাসা করল, কলকাতায় খাওয়ার সময় তো এমন শব্দ করো না কাকু, তুমি আমেরিকায় কি শব্দ করে খেতে?
গৌরব হেসে ফেলল, কলকাতা কিংবা আমেরিকায় যে এমন খাবার পাওয়া যায় না রে, পয়সা দিলেও না। তারপর সতুদার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে কি জানো, কোনো কোনো অভ্যেস মনের অজান্তে মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। আমরা যতই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করি না কেন নিজের জায়গা পেয়ে গেলেই অভ্যেসটা টুক করে বেরিয়ে পড়ে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা।
খাওয়া দাওয়ার পর টনি বাগানে ছুটল। সতুদার সঙ্গে দাওয়ায় বসে আড্ডা মারছিল গৌরব। জেঠিমা রান্নাঘরে। সতুদাকে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তারপর, তুমি এখানে কেমন আছ, বলো?
যেমন দেখছিস। একমাত্র শরীর ছাড়া আমার কোনো সমস্যা নেই।
তুমি একইরকম রয়ে গেলে।
দুতিন রকম হতে পারার ক্ষমতা নেই বলে একরকম থাকতে হলো।
কিন্তু এই গ্রামের জীবনে তোমার একঘেয়েমি লাগে না!
একটুও না। স্কুল আর গান-বাজনা নিয়ে চমৎকার সময় কেটে যায়। কলকাতায় গেলে হাঁপিয়ে উঠি, কতক্ষণে গ্রামে ফিরব। আসলে এখানে যে জীবন তাতে জটিলতা খুব কম। গ্রাম্য রাজনীতির কথা ছেড়ে দে, সবাই জানে আমি সাতে পাঁচে নেই তাই আমাকে কেউ জড়াতে চায় না।
এই মাইনেতে, মানে তোমার স্কুলের চেহারা দেখে যা মনে হলো, তাতে তো খুব বেশি কিছু পাওয়ার কথা নয়। তোমার অসুবিধা হয় না?
নারে। দুবেলা ভাত ডাল আর জামাকাপড় হয়ে যাচ্ছে। কিছু জমি আছে তা থেকেই কিছুটা আসছে। আচমকা যদি বড় খরচের ধাক্কা না আসে তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবনার দরকার পড়ে না। আসলে আমার কোনো চাহিদা নেই তাই বেঁচে গেছি। চাহিদা থাকলে তো তারও শেষ নেই। সতুদা হাসল, যেমন ধর, বাড়িতে একটা ক্লাইভের আমলের রেডিও আছে। এখনও চমৎকার বাজে। কেউ যদি বলে মডেলটা খুব পুরনো এখন নতুন নতুন মডেল বেরিয়েছে তাহলে আমি বলি শব্দ শোনার জন্যে যতক্ষণ এটি উপযুক্ত ততক্ষণ পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন গ্রামের অনেক বাড়িতে টিভি এসেছে। আমি কিনব কার জন্যে? মা তো টিভির সামনে বসলে সেটা রেডিওর মতো কাজ করবে। কোনো ভালো প্রোগ্রাম থাকলে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসি। সতুদা হাসল। খুব অকপট হাসি। গৌরবের বড় ভালো লাগল। আজকের মানুষ শুধু টেনশন আর সমস্যায় পিষ্ট হচ্ছে অনবরত। একটু আরাম একটু সুখের জন্যে যে ইঁদুর দৌড় হয়েছে তাতে যোগ না দিয়ে উপায় নেই কারণ আধুনিকতা নামক একটি বেড়াল ক্রমাগত তাড়া করে যাচ্ছে পেছন থেকে। অথচ সবাই শান্তি চায়, শান্ত জীবনের প্রত্যাশী কিন্তু চাহিদার তীব্রতা যখন আকাশচুম্বী তখন শান্তি মরীচিকার মতো শুধুই পিছু হঠে। এখন আর হবে না। মনের গঠন যেভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে তার পক্ষে আর সতুদার মতো জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তার জীবনের সমস্যাগুলো যেমন, জয়তীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া, আমেরিকার জীবন ছেড়ে এসে কলকাতায় চাকরি নেওয়া, দাদা-বউদির ব্যক্তি জীবনের গোলমাল সামলানো, এখানকার মানুষের ব্যবহারের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এসব তো সতুদার নেই। সে বলেই ফেলল, সতুদা তোমাকে এই মুহূর্তে আমি ঈর্ষা করছি।
সতুদা বলল, শ্মশান বৈরাগ্য রে। শ্মশানে এলে সংসার সম্পর্কে যে অনাসক্তি মনে আসে তা শ্মশান থেকে বেরিয়ে গেলেই উধাও হয়ে যায়। আমি আর একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসি, তুই মায়ের সঙ্গে গল্প কর, আমি এলাম বলে। জেঠিমা খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে বসেছেন। সতুদা বেরিয়ে গেলে গৌরব যেই জেঠিমার পাশে গিয়ে বসেছে অমনি ছাদে চিৎকার হলো। কিছু একটা ভাঙলো। জেঠিমা বললেন, দ্যাখ দেখি, ওদের বোধহয় কিছু হলো! গৌরব উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, টনি, এই টনি।
একটু বাদে বনি ছাদের আলসেতে অপরাধীর ভঙ্গীতে এসে দাঁড়াল। গৌরব মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে ওপরে?
বনির ঠোঁট নড়ল। একবার পেছন দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, হঠাৎ হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছে।
কি ভাঙলো?
শিশি।
জেঠিমা হেসে ফেললেন, দ্যাখ, হাত পা কাটল কিনা!
কিসের শিশি?
আচারের।
কিরে, তোরা বেড়াতে এসে আচারের শিশি ভাঙলি?
জেঠিমা বললেন, আঃ ভাঙুক না। এ বাড়িতে তো কেউ কিছু ভাঙে না আজকাল।
এই সময় আড়াল থেকে টনির গলা পাওয়া গেল, কাকু, দিদি চুরি করে আচার খাচ্ছিল। আমি দেখতে পেয়েছি।
গম্ভীর গলায় গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কারও হাত পা কেটেছে?
বনি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
গৌরব হুকুম করল, চটপট নিচে নেমে আয়।
চোরের মতো নিচে নামল বনি। হাতে আচারের রস মাখামাখি ঠোঁটের কোণেও রয়েছে। বাঁ হাতের আঙুলে রক্ত ছড়িয়ে আছে। ভালো করে জল দিয়ে ধুইয়ে হাত পরিষ্কার করার পর দেখা গেল কেটেছে আধইঞ্চির বেশি নয় কিন্তু রক্ত বেরিয়ে আসছে সমানে। জেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, রক্ত বেরুচ্ছে?
গৌরব আঙুলটা চেপে ধরে বলল, হ্যাঁ।
উঠোনের ওই কোণে বিশল্যকরণী গাছ আছে, দুতিনটি পাতা ছিঁড়ে এনে ধুয়ে টিপে রসালো করে কাটাটার ওপর চেপে দে। ঠিক হয়ে যাবে।
গৌরব একটু অস্বস্তি নিয়েই কাজটা করল। এই অবস্থায় একটা অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়া দরকার। ডেটল আছে কি না জানতে ইচ্ছে করলেও সে করল না। ইঞ্জেকশন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দেওয়া যায়। এখন পাতার রসের কি প্রতিক্রিয়া হয় তাই দেখা যাক। টনিও নেমে এসেছিল। রসালো পাতা দেখে সে বলল, আসবার সময় তুমি গল্প বলছিলে আর দিদির আঙুলে ওটা লেগে গেল। গৌরব নকল গলায় বলল, হ্যাঁ তোমার দিদি হলেন লক্ষ্মণচন্দ্র আর আমি হলাম গিয়ে হনুমান। সবাই হেসে উঠল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। গৌরব পাতার রস এবং পাতা ক্ষতের ওপর চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে লাগছে?
বনি মাথা নেড়ে বলল, না। রসটাও রঙিন কিন্তু বোঝা গেল রক্ত বের হওয়া বন্ধ হয়েছে। কাজের মেয়েটির কাছ থেকে একটা পরিষ্কার কাপড় চেয়ে আঙুলে জড়িয়ে দিলো গৌরব। এই সময় বনি বলল, কাকু!
কী হলো?
এই কথাটা মাকে বলবে না। মা খুব রেগে যাবে।
ঠিক আছে। টনি যদি না বলে তাহলে আমিও কিছু বলব না।
এই সময় সতুদা একটি লোককে নিয়ে ফিরে এল। লোকটার হাতে ক্যামেরার স্ট্যান্ড, একটা বড় ব্যাগ। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার সতুদা?
ছবি তোলাবো। আবার কবে আসবি তোরা তার তো ঠিক নেই। তোদের এই আসাটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মায়ের সঙ্গে সবার একটা ছবি চাই।
জেঠিমা আপত্তি করলেন, না, না। চেহারার কি ছিরি হয়েছে জানি না। আমাকে আর ছবি তোলাতে বলিস না।
গৌরব হাসল, রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণ হয় না।
জেঠিমা বললেন, রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ হয়ে গিয়েছে।
আঃ বড্ড তর্ক করো। তোমার সঙ্গে আমরা ছবি তুলব। কোনো আপত্তি শুনছি না। তবে তোমার শাড়িটা পাল্টে নেওয়া দরকার।
শাড়ি নয়, ছোঁড়া, এটা ধুতি।
সেই কথাই বলছি। ধুতিটা পাল্টে একটা পরিষ্কার শাড়ি পরে নাও।
লোকে বলবে ভীমরতি হয়েছে। চিতায় ওঠার আগে ভোল পাল্টাচ্ছে।
সেই লোকগুলোকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। কি সতুদা, তুমি কিছু বলছ না যে?
আমি অনেক চেষ্টা করেছি মাকে সাদা শাড়ি পরাতে, পারি না। দ্যাখ, তুই যদি পারিস!
জেঠিমা বললেন, শোন গোরা, সতু অনেক বলেছিল কিন্তু আমি তখন রাজি হইনি। এখন যদি তোর কথায় মত দিই ও কষ্ট পাবে না?
সতুদা বলে উঠল, মোটেই না। আমি সত্যি খুব খুশি হব।
কিন্তু আমার বোধহয় একটাও শাড়ি নেই।
সতুদা ঘরের ভেতরে চলে গেল। তারপর একটা মাঝারি পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি আর জামা এনে কাজের মেয়েটির হাতে দিলো। সে জেঠিমার হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর পোশাক পাল্টাতে।
এদিকে ক্যামেরাম্যান ততক্ষণে যন্ত্রপাতি ফিট করে ফেলেছে। যে দিকে রোদ্দুর পড়ছে সেদিকে ক্যামেরা লাগিয়ে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে অ্যাঙ্গেল ঠিক করতে করতে তাড়া দিলো, বড্ড দেরি হচ্ছে। চটপট করুন।
সতুদা বলল, আমরা সবাই বসে যাই, আপনি ক্যামেরা ঠিক করুন, মাঝখানে মায়ের জন্যে জায়গা ছেড়ে রাখছি।
কিন্তু জেঠিমার আসতে দেরি হলো না। ছোট চুল আঁচড়ে দিয়েছে কাজের মেয়েটি। সুন্দর দেখাচ্ছে। সতুদা বলেই ফেলল, আমার মা কেমন সুন্দর গোরা?
জেঠিমা ধমক দিলেন, গুরুজনদের নিয়ে রসিকতা হচ্ছে?
বনি বলে উঠলেন, না ঠাকুমা, সাজলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়।
জেঠিমা রঙ্গ করে বললেন, তবু তো পমেটম মাখিনি।
গৌরব দুহাতে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে মাঝখানে বসাল। টনি বনি ওদের সামনে। ক্যামেরাম্যান কালো কাপড় মুখে ঢেকে ফোকাস ঠিক করতে লাগল। এক দুই করে অনেকগুলো মুহূর্ত বলে যাচ্ছে, স্মাইল প্লিজ, একটু হাসুন, হাসতে থাকুন।
গৌরব বলল, কতক্ষণ ধরে হাসা যায়?
এই আর একটু। হ্যাঁ, আপনি বাঁ দিকে চাপুন, খুকি তুমি ডানদিকে। হঠাৎ মাথা কাপড় থেকে বের করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আঃ সানটা খুব শিফট করছে। একটু দাঁড়ান।
ক্যামেরা সরিয়ে নিল সে আর একটু আবার অ্যাডজাস্টমেন্ট শুরু হলো। গৌরব বলল, আপনার কোথায় যেন যাওয়ার তাড়া ছিল না?
হ্যাঁ। কেন? লোকটা সেই অবস্থায় প্রশ্ন করল।
না অনেক সময় লাগছে তো!
লাগবেই। এটা একটা আর্ট। আর্টের জন্যে সময় লাগবেই।
জেঠিমা বললেন, আমি তো বাবা আর সোজা হয়ে বসতে পারছি না। বাবা মাজা ধরে গেছে যে।
ক্যামেরাম্যান বলল, আপনি একটু ডান দিকে ঝুঁকে বসুন।
জেঠিমার আরাম হলো যেন। গোরা দেখল জেঠিমা সতুদার দিকে শরীর ছেড়ে দিয়ে পাদুটো সামনে ছড়িয়ে দিলেন। আর তখন ক্যামেরায় সাটার টেপার শব্দ হলো। সতুদা বলে উঠল, আরে মা তুমি তো প্রায় শুয়ে পড়েছ। এই আর একবার ছবি তুলুন।
জেঠিমা বললেন, না বাবা, অনেক হয়েছে। আমি উঠলাম। বাচ্চাদুটোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে। দেখি কি আছে ঘরে।
কারও কথা না শুনে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ক্যামেরাম্যান তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগল। সতুদা হতাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কবে ছবি পাওয়া যাবে?
পাঁচ দিন। এখনও কয়েকটা বাকি আছে। শেষ হলেই ধুয়ে ফেলব।
লোকটা চলে গেল। গৌরব বলল, সতুদা, তুমি কিন্তু আমাকে দুটো ছবি পাঠাবে।
নিশ্চয়। তবে একবার শাটার টিপেছে, ছবি উঠলে হয়।
টনি বনি আবিষ্কার করল, নারকেলের নাড়ু আর চিড়ের মোয়ার মতো উপাদেয় খাবার কেক প্যাস্ট্রিও নয়। জেঠিমার খুব ইচ্ছে ছিল ওরা আজকের রাতটা থেকে যাক। কিন্তু গৌরব বলল, ওদের মাকে কথা দিয়েছি আজই ফিরিয়ে নিয়ে যাব জেঠিমা। আবার একবার এসে রাত্রে থাকব।
তাহলে সেই সময় সরলাকে নিয়ে আসিস। কতদিন দেখিনি ওকে। আমি তো যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে আছি, হঠাৎ খবর পাবি নেই, কিন্তু যাওয়ার আগে তোর মায়ের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।
কী কথা? গৌরবের কৌতূহল হলো।
তোকে বলব কেন? জেঠিমা হাসলেন, আমরা দুই জা, তোরা তো পরে এসেছিস। এক সময় আমরা তো বন্ধুর মতো ছিলাম।
বিদায় দৃশ্যটা সত্যি বেদনাদায়ক হয়ে পড়ল। জেঠিমা কাঁদলেন। কিন্তু শুধুই কান্না, কোনো আক্ষেপ নেই। টনির চোখে জল, বনির মুখ গম্ভীর। সতুদা বলল, কলকাতায় গিয়ে বনির আঙুলটা কোনো ডাক্তারকে দেখাস।
বনি মাথা নাড়ল, আমার আর ব্যথা নেই।
জেঠিমা চোখ মুছে বললেন, ওই পাতা ধন্বন্তরি, ঠিক জুড়ে যাবে। ফেরার পথে যখন সূর্যদেব পাটে যেতে চলেছেন তখন মালবাহী রিকশায় বসে টনি আচমকা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা কাকু, আমরা কেন মাঝে মাঝে এখানে আসি না? কি সুন্দর আকাশ, নদী, মাঠ, মানুষ।
কী করে বুঝলি মানুষ সুন্দর?
বোঝা যায়। টনি নিশ্বাস ফেলল।
বনি বলল, মা আসবে না তাই বাবা আসে না।
টনি বলল, বাবা সময়ই পায় না।
বনি মাথা নাড়ল, বাবা সারা ভারতবর্ষ ঘোরার সময় কী করে পায়?
গৌরব কোনো কথা বলল না। অনেকদিন বাদে নিজেকে সমস্ত টেনশন চিন্তা ভাবনার বাইরে আসা একটি মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। ঈশ্বর যদি এক-আধদিন মানুষকে এমন সময় উপহার দেন তাহলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তার ভালো লাগছিল টনি বনির কথা ভেবে। এই বয়স পর্যন্ত ওরা ইট কাঠ সিমেন্টের বাইরের জীবন দ্যাখেনি। কে বলে জেনারেশন গ্যাপ দূরত্ব বাড়ায়। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হয়েও ওদের যদি গ্রাম থেকে ফিরে যেতে মুখ ভার হয়, মাঝে মাঝে আসার জন্যে মনে ইচ্ছে আসে তাহলে তার নিজের সঙ্গে ওদের কোনো পার্থক্য নেই। আসলে প্রয়োজন মেটাতে দ্রুতলয়ে বয়ে যাওয়া গা ভাসিয়ে আধুনিকতার সব কটি সুবিধে ভোগ করতে করতে যারা রঙিন চশমা পরে ফেলে তাদের কথা আলাদা, কিন্তু দেখার চোখ যদি ফুটিয়ে দেওয়া যায় তাহলে এক পা আগামীকালে রেখেও গতকালের গল্প শুনতে আগ্রহ না করে এদের উপায় নেই। আর তা হলেই মানুষের মতো বেঁচে থাকব।
দিন আটেক বাদে কলকাতার ঠিকানায় ছবি এল। সঙ্গে সতুদার চিরকুট। হতভাগা ফটোগ্রাফারের কান্ডটা দ্যাখ। ভাগ্যিস মা চোখে দেখতে পান না। প্রথমে ভেবেছিলাম এই ছবি তোকে পাঠাবো না। পরে মনে হলো মা যখন চলে যাবেন তখন তো তুই কাছেপিঠে থাকবি না। এই ছবিটাই সেই সময়টাকে মনে করিয়ে দিতে পারে।
ঠোঁট কামড়ালো গৌরব। ছবিতে জেঠিমা সতুদার ওপর এমন ভঙ্গীতে শরীর রেখে তার সামনে পা ছড়িয়েছেন যে দেখে হঠাৎ মনে হয় কোনো মৃতদেহকে নিয়ে ছবিটি তোলা হয়েছে। গৌরব স্থির করল, ছবিটা মাকে দেখাবে না।