Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তূণের তির ফিরে আসে || Anish Deb

তূণের তির ফিরে আসে || Anish Deb

সদর দরজার হাতলে খুব সাবধানে হাত রাখলাম। ধীরে-ধীরে হাতল ঘুরিয়ে চাপ দিলাম। সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে দরজা খুলতে শুরু করল। সেইসঙ্গে চোখে পড়ল অন্ধকারের হাতছানি। রুণা সবসময় বাড়িটাকে কেন যে অন্ধকার করে রাখে আজও বুঝিনি। সেই বিয়ের পর থেকে এই তিনবছর ধরে রোজই দেখছি। প্রতিদিন রাত এগারোটা নাগাদ যখন বাড়ি ফিরি, তখনই আমাকে অভ্যর্থনা জানায় অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার-ঠাসা বাড়িতে রুণার রাজত্ব চলে। কোনও নিশাচর প্রাণীর মতোই ও অন্ধকারে দেখতে পায়। আশ্চর্য!

ভেতরে ঢুকে সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে থেকে ছিটকে আসা আলোর টুকরো বাইরেই থেকে গেল। সামনে ঘোরানো সিঁড়ির ধাপ। আর সিঁড়ির মাথায় টিকটিক করে বেজে চলেছে বিশাল এক গ্র্যান্ডফাদার ক্লক।

পা টিপে-টিপে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। আলো জ্বালতে সাহস পেলাম না। মাঝামাঝি উঠেছি, হঠাৎ কানে এল রুণার চাবুকের মতো তীক্ষ্ন ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, ‘অয়ন!’

থমকে দাঁড়ালাম। পা দুটো কেউ যেন গেঁথে দিল সিঁড়ির ধাপে। তা হলে আজও রুণা আমাকে দেখতে পেয়েছে। এত সতর্কতা, এত সাবধানতায় কোনও কাজই হয়নি। আমার নার্ভের ওপর ও যেন জেঁকে বসছে। আর ওকে সহ্য করতে পারছি না।

‘অয়ন, ফিরতে এত রাত হল কেন?’

রুণার আবছা শরীরটা কি দেওয়াল-ঘড়ির ডায়ালের সাদা পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে? রোজ ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই একই প্রশ্ন ও দিনের-পর-দিন (প্রকৃতপক্ষে রাতের-পর-রাত) করে এসেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই আমিও দিতে পারিনি কোনও জুতসই উত্তর। আমার এই নেশাগ্রস্ত টলমল অবস্থায় রাত করে বাড়ি ফেরার যে একটাই মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, তা কি রুণা বুঝতে পারে না? ওর সঙ্গে থাকাটা আমার কাছে দিনকেদিন যে অসহ্য হয়ে উঠছে সেটা কি ওর মাথায় ঢোকে না? ও বোঝে না, এই বিবাহিত জীবন আমার কাছে দুর্বিষহ?

সব বুঝেও অবুঝের মতো এই অর্থহীন প্রশ্ন করে যাবে রুণা? একটুও রেহাই দেবে না আমাকে?

অন্ধকার সিঁড়ির আওতা পার হয়ে রুণার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম। ওকে স্পষ্ট করে দেখতে না পেলেও ওকে বেশ টের পাচ্ছি। কাপড়ে খসখস শব্দ তুলে ও বলে উঠল, ‘অয়ন, যদি এই মুহূর্তে তোমাকে এ-বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই তা হলে তোমার অবস্থাটা কী হবে জানো? তোমাকে জাস্ট না খেতে পেয়ে মরতে হবে।

ইচ্ছে হল, দু-হাতে রুণার নরম গলাটা চেপে ধরি। শেষ করে দিই ওর টাকার গুমোর।

কপর্দকহীনের প্রেম-ভালোবাসা মানায় না। একমাত্র রুণার প্ররোচনায় ও উৎসাহে কপর্দকহীন হলেও ওকে বিয়ে করেছিলাম। ওর বারবার বলেছিল, ওর টাকায় আমার নাকি সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আর আমিও এমন মহামূর্খ, সে-কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম।

রুণার সঙ্গে যেভাবেই হোক আমার একদিন আলাপ হয়েছিল এবং তারই পরিণতি এই বিয়ে। রুণার তুলনায় আমি সত্যিই পথের ভিখিরি। এই বিশাল জবচার্ণকী প্রাসাদ ছাড়াও রুণার প্রায় দশলাখ টাকা ব্যাঙ্কে পড়ে পচছে। আত্মীয়স্বজনের ঝামেলা আমার নেই। তবে রুণার কোন এক বুড়ি পিসি নাকি এখনও যমরাজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। অবশ্য এখানে নয়, শিলিগুড়িতে। তাঁর সঙ্গে রুণার কখনও-সখনও ফোনাফুনি বা চিঠি চালাচালি হয়।

বিয়ের পর থেকেই কীভাবে যেন আমাদের প্রেম-ভালোবাসা শুকিয়ে গেছে। তারপর কোন এক অজানা কারণে শুরু হয়ে গেছে টাকার খোঁটা। উঠতে, বসতে, খেতে—সবসময় খালি ওই একই কথা। আমি যে নিষ্কর্মার ঢেঁকি, অপোগণ্ড, অপদার্থ—ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ও রোজই আমাকে বিশদভাবে বোঝায়। তাই মধুচন্দ্রিমার মধু খুব বেশিদিন আর মিষ্টি থাকেনি। আমি সোজা পথ থেকে ক্রমেই পিছলে গেছি। আর রুণা ধীরে-ধীরে অন্ধকারকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমাদের দুজনের মাঝের ফাঁকটা ভীষণ চওড়া হয়ে গেছে।

‘কী হল আমার কথার জবাব দিলে না যে? বউয়ের টাকায় খাও-পরো, এতটুকু লজ্জা করে না? যাও, যেখানে এতক্ষণ ছিলে সেখানেই ফিরে—।’

রুণা হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু বলতে পারল না। কারণ অন্ধকারেই ওর গলার অবস্থান আন্দাজ করে বাড়িয়ে দিয়েছি আমার পেশিবহুল দুটো হাত। নির্ভুলভাবে আমার দু-হাতের দশ আঙুল কেটে বসেছে ওর গলার কোমল মাংসে। অন্ধ আক্রোশে আমি সবকিছু ভুলে গেলাম। হাতের আঙুলের চাপ বাড়াতে লাগলাম। জোরে। আরও জোরে…।

রুণার গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ হতে লাগল। ক্রমশ অবশ হয়ে ও লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। সেইসঙ্গে ওর গলা আঁকড়ে আমিও ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

একসময় গলা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাতে আঠালো অনুভূতি। রুণার মুখ দিয়ে কি রক্ত বেরিয়েছে? চারপাশের নিস্তব্ধতার পরতে কেটে বসছে দেওয়াল-ঘড়ির টিকটিক শব্দের ছুরি। এতটুকু ক্লান্তি নেই।

রুণার খুনের জন্যে নিজেকে মোটেই অপরাধী মনে হল না। কারণ, আমার চোখে ও বহুদিন ধরেই মৃত। সম্ভবত সেইজন্যেই আমার মনে কোনও দাগ পড়ল না। বেশ ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করলাম: এখন কী করব? কোন পবিত্র জায়গায় লুকোলে রুণার ডেডবডি কেউ খুঁজে পাবে না?

আশ্চর্য ব্যাপার, ওই অন্ধকারে রুণার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার এতটুকুও অস্বস্তি হল না। এমনকী সিঁড়ির আলোটা পর্যন্ত জ্বালার চেষ্টা করলাম না।

ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল এডগার অ্যালান পো-র লেখা দুটো গল্পের কথা। একটাতে ছিল কীভাবে একজন লোক তার স্ত্রীকে দেওয়ালের পেছনে সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে ফেলেছিল। আর দ্বিতীয় গল্পটাও অনেকটা সেইরকম। তবে দুটোই গল্পেই অপরাধী ধরা পড়েছে তার নির্বুদ্ধিতায়, মানসিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে।

এই গল্প দুটোর কথা মনে পড়ার কারণ, আমার প্ল্যানের সঙ্গে এই গল্প দুটোর সাংঘাতিক মিল আছে। রুণা বাড়ির নীচের তলাটা সারানোর জন্যে অনেক সিমেন্ট আর বালি এনে রেখেছিল। এখন সেগুলোকেই আমি কাজে লাগাব।

সুতরাং, আর দেরি না করে রুণার দেহটা কাঁধে তুলে সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। পেছন থেকে ভেসে আসতে লাগল দেওয়াল-ঘড়ির টিক-টিক: যেন আমাকে ব্যঙ্গ করছে।

আমি আর রুণা দুজনে দোতলাতেই থাকতাম। যার ফলে নীচতলার ঘরগুলো ব্যবহারই করা হত না। তাই একতলায় বসবার ঘরে রুণাকে রেখে গাঁইতি আর কোদাল আনতে ছুটলাম।

বসবার ঘরের মেঝেটা সারানো হবে বলে ভাঙাই ছিল। খুব সাবধানে গাঁইতির চাড় দিয়ে সিমেন্ট বালি খুঁড়ে একটা গর্ত তৈরি করতে লাগলাম। মৃত রুণা শূন্য ফ্যাকাসে দৃষ্টি মেলে ওর স্বামীদেবতার ক্রিয়াকলাপ দেখতে লাগল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। জানলা দিয়ে সূর্যের আলো সরাসরি মুখে এসে পড়তেই চোখ খুললাম। তাড়াতাড়ি উঠে হাতঘড়িতে নজর দিলাম: সাড়ে ন’টা। রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল বসিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, এরপর কী করব? পাড়াপড়শিরা জানতে চাইবে রুণা কোথায় গেছে। কী বলব ওদের? তার ওপর রয়েছে সেই হতচ্ছাড়া বুড়ি পিসি!

বাড়িতে এসে কেউ যদি একতলার বসার ঘরের মেঝেটা দ্যাখে, তবে কিছু বুঝতে পারবে এমন সম্ভাবনা কম। আর, যদিও বা কিছু সন্দেহ করে, তা হলেও ভয়ের কোনও কারণ নেই! কেউ তো আর খুঁড়ে দেখতে যাচ্ছে না, রুণার বডি ওর নীচে রয়েছে কি না?

রুণার বেড়াতে যাওয়ার কোনও জায়গা ছিল না। দিনরাত শুধু বাড়িতেই পড়ে থাকত। অতএব রুণা বাইরে কোথাও বেড়াতে গেছে এ-কথা বলাটা ঠিক হবে না। বরং রুণার অসুখ করেছে বললে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে। এবং খুব তাড়াতাড়ি এই কাল্পনিক অসুখেই ও মারা যাবে। তারপর ওর মৃতদেহ (মানে, ডামি) রাতবিরেতে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ভান করা যাবে।

এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে ঠিক করলাম রুণার অসুখের কথাটা আজই একটু-আধটু রটিয়ে দেব।

জামাকাপড় পরে যখন অফিসে বেরোচ্ছি, দেখা হয়ে গেল পাশের বাড়ির রত্মাকর সেনের সঙ্গে।

‘কোথায় চললেন? অফিসে বুঝি?’ একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।

‘হ্যাঁ। না গিয়ে আর উপায় কী! যাওয়ার তো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু বড়সাহেবের অর্ডার, এখন কাজের চাপ—বেশি কামাই চলবে না।’

‘কেন, যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কেন?’ উৎসুক হলেন রত্নাকর সেন।

যা ভেবেছিলাম, ঠিক সেইভাবেই কাজ হচ্ছে। নিজের অভিনয়ের প্রশংসায় মনে-মনে পঞ্চমুখ হয়ে বললাম, ‘না,—এই…রুণার শরীরটা আজ খুব ভালো নেই।’

‘কেন, কী হয়েছে আপনার ওয়াইফের?’

‘না, সেইরকম কিছু নয়…শুধু গা ম্যাজম্যাজ—মাথাধরা—এই আর কী!’

আমার বিষণ্ণ স্বরে ভদ্রলোক মুখে একটা বিষণ্ণভাব ফুটিয়ে তুললেন। তারপর সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘এইসব জ্বর-জারি আজকাল লেগেই আছে। বলেন তো আমার ওয়াইফ গিয়ে একটু—।’

‘না, না, তার কোনও দরকার নেই। রুণা এখন একা বিশ্রাম করছে। কেউ ওর বিশ্রামে ডিস্টার্ব করুক, ও চায় না। দরকার হলে ও নিজেই ডাকবে আপনাদের। আচ্ছা চলি—।’

হনহন করে হেঁটে এগিয়ে চললাম। আমার যেটুকু দরকার ছিল সেটুকু কাজ হয়ে গেছে। এখন এই রত্নাকর সেনের মুখ থেকেই সারা পাড়া জেনে যাবে রুণা অসুস্থ। তারপর এক-একটাদিন পেরোবে, রুণার অসুখ আরও কঠিন হবে। অবশেষে…ধীরে-ধীরে…মৃত্যু!

সন্ধেবেলা (রুণা তো আর নেই! সুতরাং, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে ক্ষতি কী?) বাড়ির ফেরার পথে রুণার পিসিকে ফোন করে বললাম, রুণার সামান্য জ্বর মতন হয়েছে—সঙ্গে প্রবল মাথা ঘোরা। তবে চিন্তা করার কোনও কারণ নেই—দু-একদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। আপনি ভালো আছেন তো? রুণা সেরে উঠেই আপনাকে চিঠি লিখবে, ফোন করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাড়িতে ফিরে একা সময় কাটাতে আমার মোটেই খারাপ লাগছে না। কয়েকটা ম্যাগাজিন উলটেপালটে সময় কাটিয়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম।

রোজকার মতো আমি যেন রাত বারোটায় বাড়ি ফিরেছি। তারপর বসবার ঘরের মেঝেটা কেমন আছে দেখার জন্যে গিয়ে দেখি, মেঝের সারানো জায়গাটা ফেটে চৌচির। তার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে রুণার ফ্যাকাসে মুখ। ও সেই একইভাবে শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে। আমাকে দেখেই ওর ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। ও যেন বলে উঠল, ‘অয়ন, ফিরতে এত রাত হল কেন?’

চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। আতঙ্কে সারা শরীর ঘেমে উঠেছে। মাথাটা যেন লোহার মতো ভারী। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে অন্ধকার সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলাম। বসবার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। মেঝের বাঁধানো জায়গাটা সেই একইরকম আছে। এতটুকু বদলায়নি। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ফিরে গেলাম শোওয়ার ঘরে। সকাল সাতটার আগে আর ঘুম ভাঙল না।

এইভাবে দিন যায়। আর সেইসঙ্গে রুণার অবস্থাও খারাপের দিকে যেতে থাকে। পাড়ার প্রতিবেশীদের বলেছি, ডাক্তারের নির্দেশ, রুণার বিশ্রাম প্রয়োজন। এই কথা বলে অতি কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি।

একদিন বাড়ি থেকে বেরোতেই পাশের বাড়ির দরজা থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল, ‘এই যে অয়নবাবু, শুনছেন?’

ইন্দিরা সেন। রত্নাকর সেনের স্ত্রী।

‘আমায় কিছু বলছেন?’ যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম।

‘হ্যাঁ, বলছিলাম, দু-সপ্তাহ হয়ে গেল রুণাকে দেখছি না। কী ব্যাপার?’ ভদ্রমহিলার গলায় সন্দেহের সুরটা চাপা নেই। আর আশ্চর্য, মাত্র আটদিন হতে না হতেই বলে দু-সপ্তাহ। তা হলে তো আর ক’দিন পরেই বলে বসবে, ‘আপনি রুণাকে খুন করেছেন।’

‘না, ওর শরীরটা খুব একটা ভালো নেই কিনা, তাই—।’

ইন্দিরা সেনের মুখে সহানুভূতির ছায়া পড়ল।

যত্ত সব! আমার বউয়ের জন্যে তোমার দরদ দেখছি উথলে উঠছে। সবার ব্যাপারে খালি নাকগলানোর স্বভাব! এর পরেই হয়তো জানতে চাইবে…।

‘আপনি তো বেরিয়ে যাচ্ছেন। বলেন তো, আমি রুণার কাছে গিয়ে বসি—?’

সর্বনাশ করেছে! এ কী গায়ে পড়া আদিখ্যেতা!

তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘না, না—তার কোনও দরকার নেই।’

‘ওর কি খুব শরীর খারাপ?’

‘ঠিকমতো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’

মেয়েটা হয়তো ভাবছে, অয়ন রায় ওর স্ত্রীকে মারধোর করে বিছানায় ফেলে রেখেছে, তাই ডাক্তার ডাকতে ভয় পাচ্ছে। আশ্চর্য মানুষের মন!

‘হ্যাঁ দেখিয়েছিলাম। তিনি বলছেন, রুণার হান্ড্রেড পারসেন্ট বিশ্রাম প্রয়োজন। চুপচাপ শুধু আরাম করবে—আর কিছু নয়।’

‘আমি বরং একটু পরে একবার রুণার কাছে যাব। যদি ওর কোনও ওষুধ-টষুধের দরকার পড়ে।’

‘না, না, না—আপনি কেন কষ্ট করতে যাবেন—?’ আপত্তিটা একটু বেশি জোরালো হয়ে গেল না?’ ওঃ, কী যে হল আমার! একটু ঠান্ডা মাথায় জবাব দিতে পারছি না কেন?

‘আপনার ব্যস্ত হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি রুণাকে দেখাশোনা করছি। ওকে ওষুধ খাইয়েই আমি অফিসে যাচ্ছি। ও এখন শুধু ঘুমোবে। অপেক্ষাকৃত ভদ্রস্বরে ইন্দিরা সেনকে নিরাশ করলাম।

‘কিন্তু আপনি অফিসে চলে যাচ্ছেন। ও একা অত বড় বাড়িটায় থাকবে…তাই—।’

‘না, ভাবছি একজন নার্স রাখব।’ ঝটিতি বলে উঠলাম। কিন্তু না বলেও তো কোনও উপায় ছিল না!

এইবার একগাল হাসি হাসলেন ইন্দিরা সেন। সন্দেহের হাসি নয়, কোনও প্রতিবেশীর অন্তরঙ্গ হাসি। কারণ, সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কথাটাই আমি ওঁকে বলেছি: একজন নার্স রাখব। বলে যখন ফেলেছি, একজন নার্স আমাকে রাখতেই হবে। না হলে কোনদিন দেখব ইন্দিরা সেন আমার বাড়িতে ঢুকে রুণাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

ভেবে দেখলাম, একজন নার্স রাখলে মন্দ হয় না। তাকে বলে দেব রুণার ঘরে যেন কক্ষনও না ঢোকে, ডাক্তারের বারণ—তা হলেই হবে। আর, নার্স রাখার পর রুণার ব্যাপারটা নিয়ে একটু ধীরেসুস্থে চিন্তা করতে পারব।

বহু চিন্তা-ভাবনার পর কাগজে নার্স চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম। সেইসঙ্গে বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না এসবও যে করতে হবে, তাও লিখলাম।

পরদিনই সন্ধেবেলা একটি মেয়ে দেখা করতে এল। তার একহাতে সুদৃশ্য ভ্যানিটি ব্যাগ, অন্যহাতে ভাঁজ করা একটি খবরের কাগজ। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে মেয়েটি বলল, ‘এই বিজ্ঞাপনটা কি আপনিই দিয়েছেন, স্যার?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার নাম সীতা দাশগুপ্ত। এই চাকরিটার জন্যেই আমি দেখা করতে এসেছি।’

এইবার মেয়েটিকে ভালো করে দেখলাম: যুবতী, অবিবাহিতা এবং সুন্দরী। দেখে বেশ পছন্দই হল। তা ছাড়া, কথাবার্তাও বেশ স্মার্ট এবং মার্জিত।

একটা মোটামুটি ইন্টারভিউ নিয়ে মেয়েটিকে ভালো মাইনেতে চাকরিতে বহাল করলাম।

সীতা রোজ রান্না করে। আর আমি খাবার সাজানো থালা দুটো নিয়ে রুণার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই। একা-একাই কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাই। যাতে সীতা মনে করে ঘরে আমি ছাড়াও রুণা রয়েছে। অবশেষে দুটো থালা চেটেপুটে শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসি। এঁটো থালা দুটো নিয়ে যাই রান্নাঘরে।

সীতাকে বলে দিয়েছি, কখনও যেন ও রুণার ঘরে না ঢোকে। কারণ, তাতে রুণা বিরক্ত হয়। আমার কথাগুলো ও বেশ সরল মনে মেনে নিল। কারণ, ঠিকঠাক মাইনে পেলে বসের কথার অবাধ্য কেউ হয় না।

রুণার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল (?)। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে বড় ভাবিয়ে তুলল। বেশ বুঝলাম, এ ক’দিনে সীতাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এবং আমার প্রতি সীতার ব্যবহারও যেন স্নেহ-মমতা মাখানো। প্রথম-প্রথম ও আমাকে করুণার চোখে দেখত। অসহায় নিঃসঙ্গ স্বামী বলে আমাকে মাঝে-মাঝে সমবেদনা জানাত।

একদিন ঝোঁকের মাথায় ওকে বলেই ফেললাম, ‘সীতা, আজ আমরা একটা সিনেমা দেখতে গেলে কেমন হয়?’

খুব রূঢ় একটা জবাব আশা করেছিলাম, কিন্তু ওর উত্তর আমাকে অবাক করল, ‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মিসেস রায় একলা থাকবেন—।’

‘সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি পাশের বাড়ির মিসেস সেনকে বলে দেব, তিনি রুণার কাছে থাকবেন।’ মনের আনন্দ গোপন করার চেষ্টা করলাম না। সীতাও উৎফুল্ল মনে রাজি হল।

সেই যে ‘মিসেস সেন’ রুণাকে ‘দেখাশোনা’ করতে লাগলেন তার জের আজও চলছে।

একদিন সীতা হঠাৎ বলেই ফেলল, ‘অয়ন, তোমার ওয়াইফ আজ কেমন আছে?’

‘সেই একই। জাস্ট বেঁচে বিছানায় পড়ে আছে। কবে মরবে কে জানে?’

আমাদের বিরক্তি বেড়েই চলল। কিন্তু সীতাকে সব খুলে বলতে সাহস পেলাম না। এখনও সেই দু-থালা খাবার নিয়ে দু-বেলা রুণার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসি। খাওয়া শেষ হলে দুটোই থালাই দিয়ে আসি রান্নাঘরে। সীতা রোজ বলে, ‘আমি আর ওয়েট করতে পারছি না, সোনা। যা হোক কিছু একটা তাড়াতাড়ি করো।’

পরদিন সকালে বন্ধ ঘরে বসে দু-থালা খাবার শেষ করছি আর ভাবছি সত্যিই তো, আর কতদিন পুরো ব্যাপারটাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা যায়! যা হোক কিছু একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।

যদি সীতাকে নিয়ে এখান থেকে পালাই, তা হলে কেমন হয়? রুণার ডেডবডি কারও পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। তিরিশ কী পঞ্চাশ বছর পর এই বাড়ি ভেঙে কেউ যদি নতুন বাড়ি তৈরি করতে যায়, তবেই একমাত্র রুণার মৃতদেহ—কিংবা ওর কঙ্কাল—বেরিয়ে পড়তে পারে। নয়তো নয়।

এতে হয়তো রুণার খুনের দায় থেকে রেহাই পাব, কিন্তু পেছনে ফেলে যেতে হবে এই বাড়ি আর ব্যাঙ্কের দশ লক্ষ টাকা। কারণ রুণা যে মারা গেছে, সে-কথা প্রমাণ না হলে, আমি কিছুই পাব না। এতগুলো টাকা ছেড়ে দেব?

রুণাকে মৃত প্রমাণ করতে গেলেও ঝামেলা আছে। আগে ভেবেছিলাম ‘ডামি’ দিয়ে কাজ চালাব। কিন্তু তা হলে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ পাব কোত্থেকে? এইসব নানান কথা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা মতলব আমার মাথায় এল। যদি রুণার বদলে সীতাকে শ্মশানে নিয়ে যাই, তা হলে? কোনও সৎকার সমিতিকে দিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করাব। আর অচেনা এক ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে সীতাকে দেখিয়ে ‘রুণা রায়’ নামে ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নেব। তা হলে কেউ জানতেই পারবে না রুণার বদলে সীতাকে সৎকার করা হয়েছে। তখন ওই বাড়ি, দশ লাখ টাকা, সব হবে আমার—শুধু আমার।

এখন তা হলে আসল কাজ হল সীতাকে খুন করা। এঁটো থালা দুটো রান্নাঘরে গিয়ে ফেরত দেওয়ার পর আচমকা ওর গলা টিপে ধরলেই হবে। রান্নাঘরের শব্দ বাড়ির বাইরে একেবারেই শোনা যাবে না। এইসব ভাবতে-ভাবতে খাওয়া শেষ করে থালা নিয়ে বাইরে এলাম।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সীতা অপেক্ষা করছে। আমি যেতেই কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ও বলল, ‘মিসেস রায় ঠিকমতো খেয়েছেন?’

কোনওদিন তো সীতা এ-প্রশ্ন করে না! আজ হঠাৎ?

‘হ্যাঁ। এই দ্যাখো—’ খালি থালা দুটো ওর মুখের সামনে নামিয়ে হেসে উঠলাম।

‘অয়ন, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’

একটু অবাক হলাম: ‘হঠাৎ এ-প্রশ্ন কেন, সীতা। তুমি তো জানো আমি প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। এই তো, খেতে-খেতেই তোমার কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, তোমার আর আমার ফিউচারের কথা।’

‘রুণা মারা গেলে, তুমি কি এখনকার মতোই আমাকে ভালোবাসবে?’

‘তার চেয়েও বেশি ভালোবাসব।’

‘তা হলে, সেসময় আসতে আর বেশি দেরি নেই, সোনা।’ সীতা আমার কাছে ঘন হয়ে এল।

‘তার মানে? চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।

সীতা একবার খালি থালা দুটোর দিকে দেখল। তারপর আমার চোখে চোখ রাখল: আজ রুণার খাবারে আমি বিষ মিশিয়ে দিয়েছি। ওকে আর বেশিক্ষণ কষ্ট পেতে হবে না।’ কথা শেষ করে হাতঘড়ি দেখল সীতা।

হঠাৎ এক প্রবল ঝাঁকুনিতে আমার সারা শরীর খিঁচিয়ে উঠল। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠতে লাগল। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। মুখের ভেতরটা বড় বিস্বাদ ঠেকছে। জিব জড়িয়ে এলেও কোনওরকমে উচ্চারণ করলাম, ‘সীতা—সীতা—!’ তারপরই যেন হাঁটুর জোড় খুলে গিয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়লাম। বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে! ওঃ…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress