মেসোমশাই
মেসোমশাই, মেসোমশাই।
চিৎকার করে হাতছানি দিচ্ছে তুলসী। বলরাম থমকে দাঁড়ালেন। গোপালের কাগজের দোকানে উবু হয়ে বসে সেই মেয়েটি। মেঝেয় দড়ি দিয়ে দিস্তা করে বাঁধা ঠোঙার স্তূপ।
অফিসে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
তুলসী বেরিয়ে এল দোকান থেকে। মনে আছে, আমি যা বলেছিলাম?
বলরাম ভাবতে শুরু করলেন।
চাকরির কোনও সন্ধান পেলে আমাকে জানাবেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে আমার। বলরাম অপ্রতিভতা কাটাতে একটু জোর দিয়েই বললেন, নিশ্চয়ই খবর দেব তোমায়, কিন্তু তোমার নামটা তো জানা হয়নি এখনও! কুলডাঙায় থাকো, শুধু এটাই জানি।
আমার নাম তুলসী রায়। কুলডাঙায় রমেন স্যারের বাড়ি বললে যে কেউই দেখিয়ে দেবে। তা ছাড়া আপনি গোপালদাকেও বলতে পারেন, আমি রোজই তো এখান দিয়ে যাই।
ঠিক আছে, আমি এখানেই বলব। বলরাম স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন এবং তাঁর আগের গতিতে নয়। তুলসীও তাঁর সঙ্গে চলেছে।
তোমার সাইকেলটা কই?
সেটাই তো আনতে যাচ্ছি। আর বলবেন না, সেদিন রাতে বাড়ি ফিরেই আবার আসতে হয়েছিল স্টেশনের ওপারে আমার এক দূরসম্পর্কের কাকার বাড়িতে, ওই চাকরির খোঁজেই। কথা বলে বুঝলাম, হবে না। ওরা খেলোয়াড় মেয়ে চায়।
কী খেলার?
আর্চারি, রাইফেল শুটিং, শটপাট…এইসব। আমি তো এর কোনওটাই জানি না। সাইকেল চালাতে পারি, দৌড়তে পারি, আমাদের গ্রামের সরকারি ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের বিরাট একটা দিঘি আছে, রানিসায়ের নাম, সেখানে প্রায়ই যাই। ঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটি। কিন্তু সেই সাঁতারের কথা বলে চাকরি তো আর চাওয়া যায় না!
আমিও সাঁতার কাটতাম। কলকাতায় আমাদের বাড়ির কাছেই গঙ্গা। স্কুলের গরমের ছুটি পড়লে, গঙ্গাতেই ঘণ্টা দুয়েক রোজ পড়ে থাকতাম। গঙ্গায় একটা কম্পিটিশনে একবার কাপও জিতেছি, সেকেন্ড হয়েছিলাম। বলরাম বাধো বাধো স্বরে খবরটা জানালেন।
তুলসী মুখ ফিরিয়ে চোখ কুঁচকে তাঁকে দেখল। বলরামের মনে হল, মেয়েটি বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছে না। তিনি মুখ গম্ভীর করে বললেন, তোমাদের রানিসায়রে গিয়ে সাঁতার কাটা যাবে?
কেন কাটা যাবে না! আসুন না আপনি।
ভাবছি ভোরবেলায় একটু ব্যায়াম করা দরকার, তাতে ব্লাডপ্রেশারটা কমবে। সাঁতারের থেকে ভাল ব্যায়াম আর কী আছে!
কথা বলতে বলতে ওরা স্টেশনের কাছে এসে পড়েছে। তুলসী দাঁড়িয়ে পড়ল সাইকেল সারাইয়ের দোকানের সামনে।
সেদিন রাতে সাইকেলের টিউব পাংচার হয়ে কী বিপদে যে পড়েছিলাম কী বলব! সারাব বলে এই দোকানে দিতে এসে দেখি দোকান বন্ধ। তখন ওটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরি। পরদিন আবার হাঁটিয়ে এনে জটধারীবাবুর দোকানে দিলাম। শুধু কি পাংচার? শরীরে ওরও অজস্র ব্যামো। ব্রেক, বেয়ারিং, চেন সবকিছুই ঝরঝরে হয়ে গেছে। এ কি আজকের সাইকেল! আমার জন্মেরও আগে বাবা কিনেছিলেন।
শুনতে শুনতে বলরাম স্টেশনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। প্ল্যাটফর্মে অফিসযাত্রী ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের ভিড়টা যেন একটু বেশিই। নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল হয়ে ট্রেন বন্ধ রয়েছে।
খবরের কাগজের ওপর হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে দুটি ছেলে দেয়ালে সাঁটার জন্য জায়গা খুঁজছে। বলরাম তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলেন, ওভারহেড তারে বিদ্যুৎ নেই। তাই সকাল আটটা থেকে ট্রেন বন্ধ। এমন ব্যাপার প্রায়ই ঘটে। মনে মনে তিনি ঠিক করলেন, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখবেন, তার মধ্যে ট্রেন না এলে বাড়ি ফিরে যাবেন।
ব্যাঙ্ক বাড়ির দেয়ালে, নানা দাবি জানানো পুরনো ছেঁড়া পোস্টারের ওপর ছেলে। দুটি তাদেরটি মেরে দিল। বলরাম একবার তাকিয়ে পোস্টারটা দেখে নিলেন। সূর্য সঙ্ঘের পরিচালনায় একটা কী যেন দৌড় প্রতিযোগিতা। তিনি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোলেন।
দিদি, সাইকেলটা এবার ছাড়ুন। এর আর কিছু নেই। তুলসীকে উপদেশ এবং পরামর্শ দুটোই দিলেন প্রৌঢ় জটাধারী। একটি বালককে সহকারী নিয়ে তিনি নিজেই সাইকেল মেরামতির কাজ করেন।
ব্রেকের যা অবস্থা, কোনদিন অ্যাকসিডেন্ট করে বসবেন। সামনের চাকার হাব-এর ওপর এই যে রডটা বসানো রয়েছে, এটা তো জং ধরে ঝরঝর করছে। পেছনেরটারও একই অবস্থা। ভেঙে পড়লে আর দেখতে হবে না!
এখনও তো অ্যাকসিডেন্ট করিনি। এই বলে তুলসী সাইকেল নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বলল, সারাতে গেলে টাকা লাগে। পাব কোথায়?
সাইকেলে চড়তে গিয়ে তার নজর পড়ল পোস্টারটা। সে পড়ার জন্য এগিয়ে গেল।
বিরাট দৌড় প্রতিযোগিতা
পরিচালনায় সূর্য সঙ্ঘ
মেয়েদের ১০ কিলোমিটার ও পুরুষদের ২০ কিলোমিটার। নাম দিবার শেষ দিন ৭ অক্টোবর। প্রবেশ মূল্য ১০ ও ১৫ টাকা।
চিত্তাকর্ষক পুরস্কার।
পাঁচ মাইল রোড রেসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছি—তুলসীর মাথার মধ্যে বাক্যটি বিদ্যুৎ চমকের মতো চড়াত করে উঠল। মিথ্যেটাকে যদি সত্যি করতে হয় তা হলে এই সুযোগ। সত্যি সত্যিই দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে মিথ্যাটা খণ্ডাবার এই সুযোগ তার ছাড়া উচিত নয়। সূর্য সঙ্ঘ স্টেশনের পশ্চিমে, জগন্নাথকাকার বাড়ির কাছেই। ক্লাব ঘরটা সে চেনে। ঠোঙা বিক্রির টাকা থেকে এনট্রি ফি দশ টাকা সে আজই সন্ধ্যায় দিয়ে আসবে। দৌড়টা পাঁচ মাইল না হয়ে ১০ কিলোমিটার, তাতে কিছু যায় আসে না। ১০ কিলোমিটার মানে তো ছ মাইল। পাঁচের থেকেও বেশি। এটা তাকে জিততেই হবে। তুলসী সাইকেলে উঠে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল।
বলরাম আধঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করে ট্রেনের আর দেখা পেলেন না। ফিরে আসতে আসতে পোস্টারটার দিকে আর একবার তাকিয়ে থেমে পড়লেন। খুঁটিয়ে পড়লেন। শুনেছিলেন বটে এখানে একটা বড় দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, সেটা তা হলে এটাই বোধ হয়। তাঁর মনে ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠল তুলসীর কোঁচকানো চোখ। দুটো। সাঁতার কম্পিটিশনের কোনও সুযোগ থাকলে মেয়েটার কোঁচকানো চোখকে ছানাবড়া করে দিতে পারেন এখনও।
বলরামের বুকের মধ্যে একটা চনমনে উচ্ছাস কেঁপে উঠল। নিজেকে তাঁর খুব শক্ত বলিষ্ঠ মনে হল। হ্যাঁ, এই বয়সেও তিনি গঙ্গায় চার-পাঁচ মাইল সাঁতরাতে পারবেন, শুধু একটু প্র্যাকটিস করে নিতে হবে, এই যা! পঁয়ত্রিশ বছর আগে সেই কাপটা জিতেছিলেন। এত বছর পর আর-একবার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? তুলসী বলল, ওদের গ্রামের পাশে রানিসায়র নামে বিরাট দিঘি আছে। ওখানে তো প্রাকটিস করা যায় ভোরবেলায়, সেইসঙ্গে ব্যায়ামটাও হয়ে যাবে।
কিন্তু চার মাইল যাওয়া আর চার মাইল আসা, সেটা কী করে হবে? অসম্ভব! মাথা নাড়তে নাড়তে বলরাম রামপ্রসাদ হস্টেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আড়চোখে দোতলার বারান্দার দিকে তাকালেন। সেদিনের পর থেকে ওদের গান। গাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কেন বন্ধ হল কে জানে! তবে এখনও তিনি হস্টেলের কাছাকাছি হলে কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বাড়ির সামনেই তাঁর সঙ্গে দেখা হল সাইকেল হাতে ধরা পান্নালালের। স্টেশনের ওপারে মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে কেরানির কাজ করে। সাইকেলে যায়-আসে। বলরাম বললেন, পানু, তুমি আছ ভাল। ট্রেনে চড়ে চাকরিতে যেতে হয় না, সাইকেলের দুবার প্যাডেল মেরেই অফিস! আর আমাকে কিনা আজও কামাই করতে হল, ট্রেনের তারে বিদ্যুৎ নেই! তোমার মতো একটা সাইকেল যদি থাকত তা হলে অফিসে চলে যেতাম। লেট হবে নিশ্চয়ই, তবু কামাইটা তো হবে না, তা ছাড়া এটা ভাল ব্যায়ামও।
পানুর হেসে ওঠা উচিত ছিল বলরামের সঙ্গে। কিন্তু হাসল না। একটু অবাক হয়ে বলল, বলুদা, আপনি সাইকেল চালাতে পারেন?
কেন পারব না? তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই কলকাতায় শিখেছি। সাইকেল চড়ে দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় মঠ, এমন কী, ব্যান্ডেল চার্চ পর্যন্ত গেছি। একবার দল বেঁধে ডায়মন্ড হারবার যেতে গিয়ে আমতলার কাছে একটা ষাঁড় শিং নেড়ে এমন তাড়া করল যে, পালাতে গিয়ে ডোবায় পড়লাম, মাথা ভাঙল। ব্যস, বাবা বললেন আর সাইকেল না, সেই আমার শেষ চড়া।
পানু শুনতে শুনতে বলরামের আপাদমস্তক দুবার দেখে নিয়ে বলল, বড়দের, না বাচ্চাদের সাইকেল চালাতেন?
প্রশ্নটা অবশ্যই তাঁর উচ্চতাকে কটাক্ষ করে। বলরামের রেগে ওঠা উচিত। রাগের বদলে হেসে উঠলেন তিনি।
বলেছ ভাল। হাসি চাপতে চাপতে বললেন, সত্যিই আমার পা প্যাডেল পর্যন্ত পুরো পৌঁছত না। সাইকেলের সিটটা নিচু করার জন্য যে রডের ওপর সেটা বসানো থাকে, সেটা কেটে ছোট করে নিয়েছিলাম।
আমাদের চেয়ারম্যান একটা রেসিং সাইকেল বিক্রি করছেন, আপনি কিনবেন?
তোমাদের চেয়ারম্যান সাইকেল চড়েন নাকি?
উনি নন, ওঁর স্কুলে পড়া ছোট ছেলে চড়ত। একজন সাইক্লিস্ট সকালে প্র্যাকটিস করার সময় গত বছর ট্রাকের ধাক্কায় মারা গেল জি টি রোডে। চেয়ারম্যানের বউ কাগজে সেটা পড়েই ছেলের সাইকেলটা নিজের শোবার ঘরে তুলে এনে এক বছর হল চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছেন।
ছেলে চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করেনি?
করেছিল। বাবা একটা স্কুটার কিনে দেবে বলায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু সাইকেলটা উনি এখন বিক্রি করে দেবেন। কিনে নিন না!
দাম কত নেবে?
কিনেছিলেন দুহাজারে, নিশ্চয়ই একটু কমই চাইবেন। মাস তিনেক মাত্র চালিয়েছে, খুব ভাল কন্ডিশনে আছে।
বলরামের মনে হল, একটা সাইকেল থাকলে রানিসায়র যাওয়া আর আসার। সুরাহা হয়ে যায়। কিন্তু দুহাজার থেকে একটু কম মানে কত টাকা? দেড় হাজার? অত টাকা দিয়ে কেনা তাঁর দ্বারা হবে না। তবু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, শ পাঁচেকে যদি হয় তো নিতে পারি, এর বেশি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
চেয়ারম্যানকে বলে দেখি, যদি রাজি হয়ে যান—তা হলে নেবেন তো?
আজই নেব।
পান্নালাল সাইকেলে উঠে অফিস চলে গেল। বলরাম বাড়ি ঢুকলেন।
এ কী, বাড়ি ফিরে এলে যে! তাঁকে দেখেই বিমলা বললেন।
ট্রেন বন্ধ।
বলরাম ঘরে ঢুকলেন। পেছনে বিমলা। পাঞ্জাবির বোতাম খুলছেন, তখন বিমলা বললেন, তোমার সঙ্গে ওই হস্টেলের ছেলেদের নাকি হাঙ্গামা হয়েছে? পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটা কোথা থেকে শুনে এসেছে।
হাঙ্গামা? আমার সঙ্গে! বলরাম অবাক হওয়ার ভান করলেন। অসভ্যতা করছিল তাই বকে দিয়েছি, একে কি হাঙ্গামা বলে? রাস্তা দিয়ে লোক যায় ওরা পেছনে টিপ্পনী কাটে, ছড়া বলে। আমার বকুনির পর এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে।
বিকেলে পান্নালাল এসে জানাল, চেয়ারম্যান পাঁচশশাতেই রাজি, আজই। আপনাকে টাকা দিয়ে দিতে হবে।
সন্ধ্যাবেলায় তুলসী যখন নির্য সঙ্ঘের ক্লাবঘরে দশ কিলোমিটার দৌড়ের এন্ট্রি ফি বাবদ দশ টাকা দিয়ে রসিদ নিল, তখন বলরাম পাঁচশো টাকা গুনে দিচ্ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে।
তুলসী যার হাতে এন্ট্রি ফি-র টাকা দিল তাকে সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দাদা, প্রাইজ কী দেবেন আপনারা?
একগাল হেসে এবং ভারিক্কি চালে লোকটি বলল, অনেক প্রাইজ আছে। আমরা তিনজন স্পনসরার অলরেডি পেয়ে গেছি। সফট ড্রিঙ্কসের, পেইন্টসের আর গুঁড়ো মশলার কোম্পানি দিচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা করে। এখানকার আহার ক্যাটারিং আর গৃহলক্ষ্মী টিভি-র দোকান কথা দিয়েছে তিন হাজার করে দেবে। পিকু হোসিয়ারি ওদের নাম-ছাপা গেঞ্জি দেবে সবাইকে, তাই পরে দৌড়তে হবে। আমরা আরও স্পনসরার জোগাড় করার চেষ্টা করছি, যাতে প্রত্যেককেই কিছু না-কিছু প্রাইজ দেওয়া যায়। এ বছর মিনিমাম আমরা দেড় হাজার টাকার ফাস্ট প্রাইজই দেব ছেলে আর মেয়ে-বিভাগে।
ফাস্ট প্রাইজ কী দেবেন?
এখনও আমরা ঠিক করিনি, কাল-পরশু মিটিংয়ে বসে কমিটি ঠিক করবে। কেউ বলছে রিস্ট ওয়াচ, কেউ বলছে টেপ রেকর্ডার, কেউ বলছে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি, কেউ বলছে সাইকেল…।
সাইকেল! তুলসী উচ্ছ্বসিত হতে গিয়ে ঢোঁক গিলল। ওটা ছেলেদের, না মেয়েদের জন্য?
লোকটি একটু তির্যক চোখে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে যেন ফার্স্ট হয়েই গেছেন! ঠাকুরপাড়ার যুব সম্মিলনীর অনেক ছেলেমেয়ে নাম দেবে, ওরা রেগুলার ট্রেনিং করে।
দমে গেল তুলসী। দৌড় কেন, কোনও খেলার নিয়মিত কোনওরকম ট্রেনিং-ই সে করেনি। রানিসায়রে সাঁতার আর সাইকেলে আট মাইল, একে ট্রেনিং বলে না। তবে তার দম আছে, শরীর কষ্ট নিতে পারে, হাতে-পায়ে জোর আছে। সে বইতে পারে, সইতে পারে, কোনও কিছুতে লেগে থাকতে পারে। এটাই তার পুঁজি, সে হাল ছাড়ে না।
কিন্তু এই দৌড়ে তাকে যদি প্রথম হতে হয়, তা হলে ট্রেনিং তাকে করতেই হবে। বাড়ি ফেরার সময় সে ঠিক করল, প্রতিযোগিতার তো এখনও দু সপ্তাহ বাকি। সকালে, ছটায়, যে সময় দৌড়টা শুরু হবে ঠিক সেই সময়ে সেও রোজ দৌড়বে, ছ মাইল।
.
চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেলটা হাতে ধরে বলরাম ঝকঝকে চোখে সেটার ওপর দিয়ে বারবার দৃষ্টি বোলালেন। পান্নালাল বলল, খুব দাঁওয়ে পেয়ে গেলেন কিন্তু। বলুদা, খাওয়াতে হবে।
নিশ্চয় নিশ্চয়, ওপারে চলো, তৃপ্তি মহল-এর জিভেগজা খাওয়াব।
জিভেগজা! এমন একটা সাইকেল পেয়ে তো লোকে নেমন্তন্ন করে মাংস-ভাত খাওয়ায়।
খাওয়াব, খাওয়াব। বলরাম পরিতৃপ্ত স্বরে বললেন।
এবার সাইকেলটায় চেপে একবার চালিয়ে দেখুন। মনে তো হয়, প্যাডেল করতে অসুবিধা হবে না।
বহু বছর বলরাম সাইকেল চড়েননি। এখন সাইকেলে উঠতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে যদি পড়ে যান, তাও আবার পানুর সামনে!
কিছু অসুবিধে হবে না, ও আমি দেখে নিয়েছি, সিটটা নিচুই আছে। বুঝলে পানু, সাঁতার আর সাইকেল একবার শিখলে জীবনে কেউ আর ভোলে না। চলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই।
আপনি এগোন, এখানে আমার একটা কাজ আছে। দুপা এগিয়েই পান্নালাল ফিরে এল। বলুদা, শুনলুম হস্টেলের ছেলেদের সঙ্গে নাকি আপনার গোলমাল হয়েছে ওই প্যারডি গান গাওয়া নিয়ে?
গোলমাল? আমার সঙ্গে? বলরাম আকাশ থেকে পড়লেন এবং মনে মনে সিটিয়ে গেলেন। গুজব, গুজব। আচ্ছা আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি গোলমেলে লোক? আমি শুধু ওদের রিকোয়েস্ট করেছি, নজরুলের গানের এভাবে বিকৃতি করা ঠিক নয়। তোমরা পারলে নিজেরাই গান বাঁধে। ওরা আমার কথা মেনে নিল।
ওহ, তাই এখন গান বন্ধ রয়েছে! বোধ হয় ভাবনাচিন্তা করছে নতুন গান বাঁধার জন্য।
পান্নালাল চলে গেল। বলরাম সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে রেল লাইনগুলো পেরিয়ে স্টেশন রোড ধরে এগোলেন। তাঁর একটু আগেই তুলসী কুলডাঙা রওনা হয়ে গেছে সাইকেলে।
বাড়িতে পৌঁছে বলরাম সাইকেলটা দরজার বাইরে রেখে চেঁচিয়ে বিমলাকে ডাকলেন, দেখে যাও, কী একটা জিনিস কিনে এনেছি। দেখে চমকে যাবে।
ব্যস্ত হয়ে বিমলা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন এবং না চমকালেও, অবাক হলেন। ওমমা, এটা আবার কী!
রেসিং সাইকেল।
বলাই আবার রেসে নামবে নাকি পড়াশুনো ফেলে? না না। এখন ওকে এটা দিতে হবে না।
বলাইকে দেব কেন? আমি তো নিজের জন্য কিনেছি। খুব সস্তায় পেয়ে গেলাম।
তুমি চালাবে সাইকেল! বিমলা হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন।
হ্যাঁ চালাব, দেখবে?
বলরাম হ্যান্ডেল দু-হাতে ধরে ডান পা তুলে লাফ দিলেন চড়ার জন্য। যতদূর তোলা দরকার, পা ততটা উঠল না, ফলে সাইকেল নিয়ে তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
কাণ্ড দেখেছ! বিরক্ত হয়ে বিমলা এগিয়ে এসে স্বামীকে টেনে তুললেন এবং বলরাম তুললেন সাইকেল। স্বামীর হাত থেকে প্রায় ছোঁ মেরে সাইকেলটা কেড়ে নিয়ে বিমলা আর কথা না বলে সেটাকে হিচড়ে টানতে টানতে বাড়িতে ঢুকলেন।
কলঘরের মধ্যে সাইকেলটা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে রেখে বিমলা জানিয়ে দিলেন, কাল চেন আর তালা কিনে এনে এটাকে বেঁধে রেখে দেব, এই বয়সে হাড়গোড় ভাঙলে আর জোড়া লাগবে না।
এই বয়স মানে? বলরাম যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রকাশের চেষ্টা করলেন। তুমি কি আমায় বুড়ো বলছ?
হ্যাঁ বলছি। বয়স তো পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে কবে?
তা হলেই কি লোকে বুড়ো হয়ে যায়? বার্ধক্য কি শুধু বয়স দিয়ে ঠিক হয়? বলরামকে অবাক দেখাল।
তবে না তো কী।
রাত্রে ঘুম এল না বলরামের। ভোরের দিকে বিমলা যখন কাঁথা জড়িয়ে গাঢ় ঘুমে, তখন তিনি নিঃসাড়ে বিছানা থেকে উঠলেন। ট্রাউজার্স, বুশশার্ট আর জুতো পরে, কলঘর থেকে সাইকেলটা নিয়ে সদর দরজা খুলে বেরোলেন।
দরজার বাইরে রক। তার কিনারে সাইকেল রেখে, যেভাবে সেদিন তুলসীকে সাইকেলে উঠতে দেখেছিলেন, সেই ভাবে রক থেকে সোজা সিটে বসলেন। প্যাডেলটা উলটো দিকে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করলেন পা কতটা পর্যন্ত যায়। মোটামুটি পৌঁছচ্ছে। এবার তিনি প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগোতে গিয়েই পড়ে গেলেন। কাছেই একটা কুকুর ডেকে উঠল। বলরাম সিটিয়ে গিয়ে রকে বসে পড়লেন। এখনও অন্ধকার কাটেনি। কুকুরের ডাকে লোকজন জেগে উঠে তাঁকে চোর বলে যদি ধরে!
মিনিট পনেরো পরে আবার তিনি চেষ্টা শুরু করলেন এবং চতুর্থবারে সফল হলেন, অর্থাৎ পড়লেন না। কিশোর বয়সে প্রথম শিখে সাইকেল চালানোর আনন্দের মতো প্রচণ্ড খুশিতে ভরে গিয়ে তারপর সাইকেল চালিয়ে দিলেন স্টেশনের দিকে।
ফাঁকা রাস্তা। দু-পাশের দোকানগুলি বন্ধ। বহু দোকানের সামনে খাটিয়ায় বা মাটিতে লোকে ঘুমোচ্ছে। লেভেল ক্রশিং পর্যন্ত পৌঁছে তিনি সাইকেল ঘোরালেন। ব্যায়ামের জন্য সাঁতার কাটতে হলে কাটা দরকার ভোরবেলাতেই, আর সেটা রানিসায়রেই। রানিসায়রটা কেমন, সেটা এখন একবার দেখা দরকার। বলরাম কুলডাঙার উদ্দেশে রওনা হলেন। সর্বাগ্রে তাঁকে রমেন স্যারের বাড়িটা খুঁজে বের করে তুলসীকে সঙ্গে নিতে হবে।
বলরাম কোনওদিন এইদিকে আসেননি। তুলসীকে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন যে রাস্তা দিয়ে, তিনি সেটা ধরেই চললেন। ভোর হতে শুরু করেছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু আলোর আভায় রাতের চিহ্নটুকু আকাশ থেকে মুছে গেছে। লোক চলাচল শুরু হয়েছে। তাঁর বাড়ির এত কাছে এমন ধানক্ষেত আর কার্তিক মাসের পাকা ধান তিনি দেখতে পাবেন, স্বপ্নেও কখনও ভাবতে পারেননি। পায়েসের মতো একটা গন্ধ মাটি থেকে উঠে আসছে। তাঁর মনে হচ্ছে, আজন্ম কলকাতায় আর বিদ্যানগরের মতো শহরতলিতে বাস করে, তিনি এখনও জানেনই না সেই কথাগুলোর মানে—বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল… বলরাম বেসুরো হেঁড়ে গলায় গানটা গাইতে গাইতে জোরে প্যাডেল শুরু করলেন।
শুধু দুটি লোককে জিজ্ঞেস করেই বলরাম পৌঁছে গেলেন তুলসীদের বাড়ি।
তুলসী আছ নাকি, তুলসী? বলরাম ডাকলেন বাঁশের বেড়ার বাইরে থেকে। বাবু বেরিয়ে এল। তার পেছনে ওর মা।
তুলসী আছে নাকি? মাকে উদ্দেশ করে বলরাম জিজ্ঞেস করলেন, অবশ্য আগে একটা নমস্কার করে নিয়েছেন।
তুলসী তো ভোরেই বেরিয়েছে, ছোটার জন্য। ঘণ্টা দেড়েক পর ফিরবে। তুলসীর মা প্রতিনমস্কার করে বললেন।
না, না, দিদি তার আগেই ফিরবে। বাবু শুধরে দিল তার মাকে।
ওকে কি কিছু বলতে হবে? মা জিজ্ঞেস করলেন।
বলবেন মেসোমশাই এসেছিল। আমার নাম বলরাম গড়গড়ি। বিদ্যানগরে থাকি। স্টেশনেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওকে বলেছিলাম সকালে রানিসায়রে আমি সাঁতার কাটব, সেইজন্যই এসেছি। সায়রটা তো আমি চিনি না।
তুলসী না থাক, বাবু তো আছে। বাবু তুই ওনাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দে না।
মার কথায় বাবু বেরিয়ে পড়ল। মিনিট সাতেক গ্রামের ভেতরের পথ দিয়ে হেঁটে ওরা দুজন রানিসায়রে পৌঁছল। প্রায় দেড়শো বিঘার এক জলাশয়। পাড়ের কাছে জলজ লতাপাতা, গুল্ম থাকলেও মাঝখানটা পরিষ্কার টলটলে। বাঁধানো ঘাট নেই। গ্রামের লোকেরা একটা জায়গা দিয়ে জলে নেমে নেমে সেইখানটায় ঘাট তৈরি হয়ে গেছে।
বলরাম মুগ্ধ হলেন। গা জুড়োনো বাতাস আর জলের সোঁদা গন্ধ তাঁর ফুসফুসকে যেন হাতছানি দিয়ে বলল, এই হচ্ছে নির্মল তাজা অক্সিজেন টেনে নেওয়ার সময়। ফুসফুস তুমি কাজে নামো, সারা শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দাও বিশুদ্ধ বাতাস। মাথার ক্লান্তি, দেহের ক্লান্তি সব মুছে ফেলে দেওয়ার এই তো সুযোগ!
সাইকেলটা ঘাসের ওপর শুইয়ে, বলরাম জুতো এবং জামা খুলে ফেললেন। বাবু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। ট্রাউজার্স খুলে জাঙ্গিয়া-পরা বলরাম ছুটে গিয়ে দু-হাত তুলে জলে ঝাঁপালেন।
আহহ। একবার তাঁর মুখ থেকে শব্দটা বেরোল। কত বছর পর আবার জলের সঙ্গে তাঁর নতুন করে আলাপ হচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে রানিসায়রের পাড় থেকে প্রায় চারশো মিটার ভেতরে গিয়ে ফিরে এলেন। বারবার ডুব দিলেন, জল ছিটোলেন, মড়ার মতো ভাসলেন এবং বাংলার মাটি, বাংলার জলবলে চিৎকার করলেন।
প্রায় আধঘণ্টা জলে থেকে মুখে হাসি নিয়ে বলরাম রানিসায়র থেকে উঠলেন। বাবু বলল, গামছা আনেননি? গা মুছবেন কী করে? দাঁড়ান, আমি ছুট্টে বাড়ি থেকে নিয়ে আসি!
আরে না, না, না। গায়ের জল এখনিই বাতাসে শুকিয়ে যাবে। আজ প্রথম দিন তো, কতটা সাঁতরালাম বলো তো?
বাবু সায়রের দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে বলল, যাতায়াতে আধ মাইল হবে। দিদি এর থেকেও বেশি যায়।
তা তো যাবেই, ওর অভ্যেস আছে। আর আমি তো বলতে গেলে নতুন জলে নামলাম।
দিদি, আপনার থেকেও জোরে সাঁতরায়।
তা তো সাঁতরাবেই, আমার থেকে বয়স অনেক কম।
ভিজে জাঙ্গিয়ার ওপর ট্রাউজারটা পরে, জুতো পায়ে গলিয়ে বলরাম সাইকেলটা তুলে বললেন, চলো, আজ এই পর্যন্ত।
জামাটা পরুন।
নাহ। সকালের এই নরম রোদে আলট্রা ভায়োলেট আছে। চামড়ায় লাগানো দরকার।
বাড়ির কাছাকাছি এসে বাবু বলল, দিদি, একটু পরেই তো আসবে, আপনি বসবেন আমাদের বাড়িতে?
বলরাম মাথা নাড়লেন। বাজার যেতে হবে, রান্না হবে, খেয়েদেয়ে অফিস যেতে হবে। দিদিকে বোলো, আমি কাল আসব। একটু ভেবে যোগ করলেন, রোজই। আসব।
বলরাম যখন তুলসীদের বাড়ি থেকে সাইকেলে উঠলেন তখন তুলসী রেলওয়ে ট্র্যাকের মাঝের স্লিপারের ওপর দিয়ে ছুটছে। হাতঘড়ি দেখে সে ছোেটার বেগ বাড়াল। দশ কিলোমিটার দূরত্বের মাপটা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সে জানে পরের রেল স্টেশন ঠাকুরপাড়ার দূরত্ব বিদ্যানগর থেকে ছয় কিলোমিটার। যাতায়াতে বারো কিলোমিটার। এটাকেই সে মাপ ধরে নিয়ে আপ লাইনে এক নম্বর ট্রাকের স্লিপারের ওপর দিয়ে দৌড়েছে।
ছোটার মধ্যে দুটি আপ ট্রেনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। পেছন ফিরে তাকিয়ে কোনও ট্রেন আসছে কি না দেখে নিয়ে সে দুনম্বর ট্র্যাকে সরে যায়। স্লিপারগুলো কংক্রিটের এবং তাদের মধ্যেকার ব্যবধান প্রায় সমান মাপের নয়, ফলে তার অসুবিধে হচ্ছিল দৌড়ের ছন্দ রাখতে। কিন্তু এটাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। সে জানে যে-রাস্তা দিয়ে তাকে দৌড়তে হবে, সেটা এর চেয়েও খারাপ।
বিদ্যানগর-ঠাকুরপাড়া প্ল্যাটফর্ম থেকে প্ল্যাটফর্ম সে যাতায়াত করল, ঘড়ি ধরে পঁয়ষট্টি মিনিটে। শেষের দিকে কষ্ট হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল দাঁড়িয়ে পড়তে। কোমর, উরু ভারী হয়ে পা যেন আর উঠতে চাইছিল না। তবে সে জানে, প্রথম কয়েকটা দিন এইরকমই হবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
.
বলরাম বাড়ি পৌঁছতেই বিমলা জানতে চাইলেন, এই সাত সকালে খালি গায়ে কোথায় বেরিয়েছিলে?
সাঁতার কাটতে।
সাঁতার! সাইকেলে চেপে?
সাইকেলে চেপে সাঁতার কাটা যায় না। সাইকেলে চেপে জলের ধারে যাওয়া যায়, আর সেইজন্যেই এটা কিনেছি। চার মাইল দূরে কুলডাঙায় রানিসায়র, সেখানে গিয়ে সাঁতার কেটে এলাম। দাও, থলে দাও, বাজার যাব। আর বলে রাখছি এবার থেকে রোজ ভোরবেলায় যাব। আমার দারুণ ভাল লাগছে নিজেকে।
বিমলা হতবাক! তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন, প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠবেন।
বলরাম যখন অফিসে পৌঁছলেন, তুলসী তখন ঘরের মেছেয় চিত হয়ে শুয়ে। বাড়ি ফিরেই সে শুনেছে, বলরাম এসে রানিসায়রে সাঁতার কেটে গেছেন। সে অবাক। হয়েছে রেসিং সাইকেলে চড়ে বলরামের আসার কথা শুনে। মেসোমশাইয়ের সাইকেল আছে এটা তো জানতাম না! তুলসীর দুটো পা মালিশ করে দিতে দিতে মা বললেন, প্রথম দিনেই কি এত পরিশ্রম করতে হয়… অভ্যাস নেই, ব্যথা তো করবেই। এখন চান করে দুটো ভাত খেয়ে নে, তারপর ঘুমো।
.
যা কখনওই হয় না, আজ বলরামের তাই হল। অফিসে কাজ করতে করতে তিনি। ঘুমে ঢুলতে শুরু করলেন।
ও গড়গড়িদা, আজ হল কী আপনার, ঘুমোচ্ছেন যে? মনোজ সামন্ত সত্যিই অবাক!
চমকে সিধে হয়ে বসে বলরাম বোকার মতো হাসলেন। বহু বছর পর আজ খুব সাঁতার কেটেছি।
সাঁতার? এই বয়সে? ডুবে যাবেন মশাই!
তা হলে তো হাফ ছুটি পাবেন।
তা পাব। কিন্তু ব্যাপারটা কী, ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ানশিপে নামবেন টামবেন নাকি?
বলরাম গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ।
.
সূর্য সঙ্ঘের প্রতিযোগিতার দিন সকাল ছটার আগে সাইকেলে বেরিয়ে পড়লেন বলরাম। সঙ্ঘের সামনে থেকে শুরু হয়ে, পুরুষ ও মেয়েদের প্রতিযোগিতা শেষ হবে ওখানেই। তার মধ্যে বিদ্যানগর লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে মেয়ে প্রতিযোগিরা ছুটবে মাজাভাঙা, হোতর পার হয়ে ডানদিকে বেঁকে জোড়াশোল। সেখান থেকে আবার ফিরে আসবে আগের রাস্তা ধরে। অতঃপর বিদ্যানগর লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে এসে প্রথম হওয়া মেয়েটি সূর্য সঙ্ঘের ক্লাবঘরের সামনে সুতো ছিড়বে। ছেলেদের দৌড়ের দূরত্ব যেহেতু দীর্ঘ, তাই তাদের পথ জোড়াশোল থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সখিবাড়ি পর্যন্ত গিয়ে তারপর তারা ফিরে আসবে।
ছেলেরা এবং মেয়েরা মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে যাতে দৌড় শেষ করে, সেজন্য তাদের শুরুর সময়টাকে আগে-পিছে করা হয়েছে। ছেলেদের কুড়ি কিলোমিটার দৌড় শুরু হবে ছটায়। তার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শুরু হবে মেয়েদের। ভোর ছটাতেই ক্লাবঘরের সামনে মাঠে লোক জমে গেছে। লাউডস্পিকারে অবিরাম নির্দেশ দেওয়া চলেছে। স্বেচ্ছাসেবকরা পিকু লেখা হলুদ গেঞ্জি আর সাদা কাপড়ের টুপি পরে। রানারদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও পাশে পাশে থাকার জন্য সাইকেল নিয়ে তারা তৈরি হয়ে রয়েছে। প্রতি সাইকেলের হ্যান্ডেলে ক্লাবের পতাকার রঙের কাপড় কাঠি দিয়ে আঁটা।
প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করার জন্য প্রথমে ঠিক হয়েছিল জেলার মন্ত্রী। কিন্তু সুন্দরবন সফরে যাওয়ায় তাঁর বদলে মনোনীত হন স্থানীয় এম এল এ। কিন্তু তিনি গতকাল একটি জন্মদিনের নিমন্ত্রণে আহারের পরিমাণ ঠিক রাখতে না পেরে ঔদরিক গোলমালে পড়ে গেছেন। সকালে খবর পাঠিয়েছেন, তিনি আসছেন না। অবশেষে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে প্রায় বিছানা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। আসার আগে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত দাঁত মাজার সুযোগটা তাঁকে দেওয়া হোক। কিন্তু দেওয়া হয়নি।
কাঁটায় কাঁটায় ছটায় নলের ডগায় ছিপি আটা একটা এয়ারগান আকাশের দিকে তুলে চেয়ারম্যান এগিয়ে এলেন। ছত্রিশজন প্রতিযোগী চুনের দাগ দেওয়া লাইনে হলুদ গেঞ্জি আর সাদা টুপি পরে ঠেলাঠেলি শুরু করল। তাদের অর্ধেকেরই খালি পা। বাকিদের পায়ে কে।
কী বলতে হবে যেন বললে? চেয়ারম্যান তাঁর পাশে দাঁড়ানো ক্লাব সচিবকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমরা স্যার, বাংলা ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ গণ্য করি। তাই আপনি বাংলাতেই বলুন—নিজের জায়গায় দাঁড়াও… তৈরি হও… এই বলার পর ফায়ার করবেন।
গুড, ভেরি গুড। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে, খেলার মধ্যেও। কিন্তু সকলের আগে একটা স্বাগত বা উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়া উচিত নয় কি?
স্যার। এখনও আপনার দাঁতমাজা হয়নি!
তা বটে। আচ্ছা, প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের সময় আমাকে ডেকো।
চেয়ারম্যান এয়ারগান তুললেন, সচিব যা বলতে বলেছিলেন বললেন, ট্রিগার টিপলেন, কিন্তু ছিপিটা বেরোল না। দ্বিতীয়বার টিপলেন, এবং ফুট করল।
তাই যথেষ্ট। হইহই করে প্রতিযোগিরা ছোটা শুরু করে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে লাউডস্পিকারে বেজে উঠল রেকর্ড: চল চল চল। ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল, চল, চল, চল।
বলরাম স্টেশনের লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গানটা শুনতে শুনতে পায়ে তাল দিচ্ছিলেন। গানটা এখন তাঁর সত্যিই ভাল লাগছে। তিনি অপেক্ষা করছেন মেয়েদের দৌড় শুরু হওয়ার জন্য। লেভেল ক্রসিং খোলা, এখন কোনও ট্রেন আসছে না, বলরামের সামনে দিয়ে ছত্রিশজন দৌড়ে চলে গেল। তাদের পেছনে একটি জিপ। তাতে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে একজন ডাক্তার। স্টেশন রোড এখনও জমে ওঠেনি ভিড়ে। তবে বাড়ির বারান্দায়, জানলায়, ছাদে লোক।
মেয়েদের দৌড় শুরুর দেরি আছে। বলরাম ঠিক করলেন, এই ফাঁকে বাজারটা সেরে নেবেন। থলি নিয়েই বেরিয়েছেন। তাঁর হাঁটার মতো বাজার করাটাও দ্রুত হয়ে থাকে। এখন হাঁটার বেগ সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় তিনি মন্থর হয়েছেন। কিন্তু বাজার করার জন্য সময় তিনি বাড়াননি। ঠিক পনেরো মিনিটে কাজ সেরে, একটা খবরের কাগজ কিনে আবার লেভেল ক্রসিংয়ে ফিরে এসে সেটা পড়তে শুরু করলেন।
তুলসীকে বলা হয়েছিল, দৌড় শুরুর একঘণ্টা আগে হাজির হতে। পৌনে ছটায় সাইকেল চালিয়ে এসে পৌঁছে, সে ক্লাবঘরে একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে পড়ে। একে একে পুরুষ ও মেয়ে প্রতিযোগীরা আসতে থাকে।
তার চোখ ছিল মেয়েদের ওপর। অধিকাংশই তারই বয়সি, স্থানীয় মেয়েই সংখ্যায় বেশি। তবে তিনটি অচেনাকে তার মনে হল ঠাকুরপাড়া যুব সম্মিলনীর। ভাল স্বাস্থ্য, পায়ের পেশি সবল। ওদের একই আকাশি রঙের শর্টস, লাল ও নীল পাড় দেওয়া একই মোজা ও কেডস।
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। এক সময় ওরা নানারকম ব্যায়াম শুরু করল। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তুলসীও সমীহ ও কৌতূহলভরে তাই দেখতে দেখতে কিছুটা দমে গেল।
এরা রীতিমতো দুবেলা ট্রেনিং করে। এরা অ্যাথলিট। কী ভাবে পা ফেলে দৌড়তে হয়, সেটা একটা শেখার ব্যাপার। সে শেখেনি। দৌড়ের আগে শরীর গরম করা যে দরকার, এটাও সে জানত না। একবার সে ভাবল, ওদের মতো শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে, লাফিয়ে, দুলিয়ে, বাঁকিয়ে নেবে নাকি। কিন্তু অদ্ভুত একটা লজ্জাবোধ তাকে বাধা দিল। ওরা তা হলে নিশ্চয়ই মুখ টিপে হাসবে। তবে চার মাইল সাইকেল চালিয়ে আসার পর এখন তার শরীরে চনমনে একটা সজীবতা পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওঠানামা করছে।
ছটা চল্লিশে মেয়েদের ডাকা হল স্টার্টিং লাইনে আসার জন্য। নাম দেওয়া আঠারোজনের মধ্যে চারজন অনুপস্থিত। মেয়েদের দৌড়ের উদ্বোধক স্থানীয় থানার অফিসার ইনচার্জ। ইনি বক্তৃতা দেওয়ার বিরোধী এবং এয়ারগান হাতে নিয়ে ক্লাব সচিবকে জানিয়ে দিলেন, জানি মশাই জানি, স্টার্ট দেওয়ার জন্য কী বলতে হবে।
আমরা কিন্তু মাতৃভাষায় স্টার্ট…
অবশ্যই, অবশ্যই…তুলনা হয় নাকি মাতৃভাষার! এই বলেই দারোগাবাবু বিশেষ এক পুলিশি কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন, অন ইওর মার্ক…গেট, সেট.. এবং তার পর ফুট। সঙ্গে-সঙ্গে লাউড স্পিকারে বেজে উঠল, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…।
প্রবল উৎসাহে কিছু মেয়ে ছোটা শুরু করল এমনভাবে, যেন বিদ্যানগর স্টেশনে হুটার শুনেছে, তাদের এখন ট্রেন ধরতে হবে। তুলসী চোখ রেখেছে তিনটি মেয়ের ওপর। ওরা কী করে সেটা তাকে দেখে যেতে হবে।
লেভেল ক্রসিংয়ের ধারে ভিড় জমেছে, তার মধ্যে আছেন বলরামও। মেয়েদের আসতে দেখে ভিড়টা এগিয়ে গেল। হ্রস্বাকৃতি এবং হাতে ধরা সাইকেল এই দুইয়ের কারণে বলরাম সামনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। দুটি লোকের কাঁধের পাশ দিয়ে কোনওক্রমে মুখটুকু বের করে দেখলেন সাত-আটটি মেয়ে তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে গেল। তাদের মধ্যে তুলসী নেই। ওদের দশ-বারো মিটার পেছনে ছ সাতজন মেয়ের একটি দল। সবার পেছনে একটি জিপ। বলরাম তুলসীকে দেখতে পেলেন। সাদা টুপি, হলুদ গেঞ্জি, কালো শর্টস, নীল কেস, পায়ে মোজা নেই। চোখের নজর ডান দিকে—বাকি মেয়েদের ওপর।
গুডলাক তুলসী…গুডলাক। বলরাম চেঁচিয়ে উঠলেন। তাঁর মনে হল, তুলসী যেন মুখ ফিরিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করল।
পেছনের মেয়েগুলোই ঠিক ছুটছে, সামনের মেয়েগুলো ভুল করছে। ভিড় ভেঙে যাওয়ার পর স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক প্রবীণ বয়স্ক তাঁর পাশের লোককে কথাটা বললেন।
পেছন থেকে সেটা শুনে একজন তরুণ সন্দিগ্ধ গলায় বলল, সামনের মেয়েরা ভুল করছে বললেন কেন?
দশ কিলোমিটার দৌড়তে হবে, সাতটা প্রায় বাজে, রোদ এবার চড়চড় করবে। দুদিন হল আবার গরম পড়েছে। শুরুতেই অত জোর দিলে পারবে শেষ করতে? তার ওপর এই জঘন্য ভাঙাচোরা রাস্তা।
বলরামের কানেও কথাগুলো গেল। লোকটির যুক্তিতে সায় দিয়ে তিনি যোগ করলেন, ভাল মাঠে দৌড়তে যে পরিশ্রম হবে, তার ডবল লাগবে এই রাস্তায় দৌড়তে। এগুলো হিসেবের মধ্যে রেখে দৌড়ের স্পিড ঠিক করতে হবে।
শুনতে শুনতে তরুণটির মুখ বোকার মতো হয়ে গেল। আমার বোেনকে তো প্রথমেই একটা চার-পাঁচশো মিটারের বড় লিড নিয়ে দৌড়তে বলেছি!
ভুল করেছেন। বলরাম বললেন।
তা হলে কী হবে? তরুণটি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে যেন পরামর্শ চাইল। বারণ করে দিয়ে আসব?
কথা না বলে বলরাম সাইকেলে উঠলেন। বাজারটা তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। একটু পরেই তিনি দেখলেন, সেই তরুণটি ঊর্ধ্বশ্বাসে তাঁর পাশ দিয়ে ছুটে গেল।