Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 5

তিমির বিদার || Bani Basu

চাকরি শুরু হয়ে গেছে। চাকলাদার ঘুরে ঘুরে আমাদের মাল দেখাচ্ছে। চেনাচ্ছে। মিস্তিরিগুলো কত চোর বোঝাচ্ছে। কোথা থেকে কী মাল আসে, কত আছে, কত আসবে, সম-স্ত।

দিনতিনেক পরে বিকেলবেলায় বাড়ি ফিরে দেখি হরসুন্দরী স্কুলের ফার্স্ট গার্ল বেরিয়ে যাচ্ছে। মণি আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাড়ি? ওর বাড়িতে সায়েন্স ম্যাথস-এর লোক মজুত থাকা সত্ত্বেও ও অনেক কিছুই আমাকে দেখাতে আসে। স্পষ্টই বোঝা যায় ও বাড়িতে কোনও সাহায্য পায় না, কোনও মানে দীপুর। আর কারও তো সাহায্য করার ক্ষমতাই নেই। মণি কি জানে না ওর দাদা আর আমি কাজে লেগেছি? ওদের বাড়িতে কি কারও সঙ্গে কারও কমিউনিকেশন নেই!

—কী রে চলে যাচ্ছিস? কী এনেছিস আজকে? বসে যা।

ঘষা কাচের মতো গ্রীষ্মের শেষবেলার আকাশ। দীপু এখনও সাইটে আছে। হেড মিস্ত্রির সঙ্গে কী সব জানি কথা বলছে। তা ছাড়া এটা আমরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিয়েছি যেদিন আমি আগে যাব সেদিন আমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়িও ফিরব। ওর বেলাও একই নিয়ম। সারাদিনের মধ্যে কিছুটা সময় সাইটে আমি বা ও একলা। আমার টুইশানিগুলো সন্ধেবেলায় বলে বেশির ভাগ দিনই আমি আর্লি টু গো অ্যান্ড আর্লি টু বি ব্যাকটাই পছন্দ করি।

মণি বলল—তোমার কাছে আসিনি।

—তবে?

—বউদির সঙ্গে দরকার ছিল। একটু ফর্মাল হেসে মণি চলে গেল।

পিকিউলিয়ার ফ্যামিলি তো? মণিটা অন্তত স্বাভাবিক ছিল আচার-ব্যবহারে, বুদ্ধিসুদ্ধিতে। এও যে দেখছি মুক্তার পথ ধরেছে! বউদিকে জিজ্ঞেস করতেই পারতাম কী বিশেষ দরকারে মণি এসেছিল তার কাছে। কিন্তু কেমন বাধল। কে জানে হয়তো নিতান্তই কোনও মেয়েলি দরকার।

সত্যি কথা, চাকলাদারের কাজটা আমার ভাল লাগছে। হিসেবপত্তর রাখা এ আর এমন কী! কিন্তু একনম্বর সিমেন্ট কাদের, বালি ম্যাক্সিমাম আজকাল ইলমবাজার থেকে আসছে, স্টোন চিপসের ঠিকানা পাকুড়। টিলা ব্লাস্ট করে করে চিপস হয়। ইট আসছে নীলগঞ্জ থেকে। কত সিমেন্টের সঙ্গে কত বালি মেশালে পলেস্তারা, কত সিমেন্টের সঙ্গে কত বালি, কত স্টোন চিপস মেশালে কাস্টিং… বিচিত্র রকমের সব তথ্য, তারপর এই মিস্তিরি আর কামিনদের একটা আলাদা ওয়ার্ল্ড, ভাবভঙ্গি, সবচেয়ে মজার— শূন্য অকুপাই করে একটা পেল্লাই স্ট্রাকচার উঠে যাওয়ার ম্যাজিক। প্রথমে খাঁচাটা পুরো করে নিয়েছে। এখন টপ ফ্লোর অর্থাৎ সাততলায় ইটের কাজ জানলা দরজার ফ্রেম বসানো এ সব শেষ করে ছ’তলার ইটের কাজ হচ্ছে। সাততলায় সিমেন্টের কাজ। ধাপে ধাপে নামছে।

রসিক ঘোষ লেন দু’ তিন বার পাক খেয়ে যেখানে এস এস আলি রোডের একপ্রান্তে পড়েছে, রাস্তাটা হয়ে গেছে পঁচিশ ফুট চওড়া, সেই কোনায় গুহমজুমদারদের বাড়িটার অবস্থান। ওরিজিন্যাল নাম ছিল গুহ-প্যালেস। সেই প্যালেস দু’তিন পুরুষের পর পলেস্তারা খসে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছিল। অনেকটা জায়গা ফাঁকা ছিল সামনে। তাতে গাছপালা। বাড়িটা ছিল চৌকোমতো বেশ বড় দোতলা। এখন ওদের পাঁচ শরিকে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় গুহর নাতি দেবল মাঝে মাঝে এসে আমাদের সঙ্গে গালগল্প করে যায়। কতটা উঠল সেটাও দেখে যায়। মেজ এখানে থাকে না, সিঙ্গাপুর, থার্ড হল মেয়ে, দেরাদুনের কোন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, সেখানেই ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। ফোর্থ একটি মাল। হেন কুচুটেমি, বদমায়েশি নেই যা না কি সে করতে অরাজি। আমরা অত জানতাম না। দেবলের কাছেই শুনেছি এই সেজদাদুর জন্যেই তাদের বাড়ি শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে হল। সেজ এবং তার সঙ্গে তালে তাল দিয়ে যাওয়া ছোট। গুহমজুমদারদের সঙ্গে আমাদের কোনওদিনই ভাবসাব ছিল না। ওরা বিরাট বাড়ির মালিক, আমরা জবরদখল কলোনির বাসিন্দা। এই তফাতটা আমাদের অল্পবয়সে খুবই ছিল। কিন্তু দেবল আর ওর বাবা যেদিন প্রথম সাইটে এলেন দেবলের বাবা রমেন গুহ বললেন—আরে তোমরা? চেনা-চেনা লাগছে! কী যেন নাম?

দেবল বলল—চিনতে পারছ না? এটা দীপু আর ওটা রুণু। আমার এমন অবাক লেগেছিল! রমেনকাকা বললেন—তবে তো ভালই হল। আমাদের বাড়িটা এমন পিছিয়ে যাচ্ছে! জানো রুণু এই চাকলাদার কিন্তু আমাদের থার্ড প্রোমোটার।

আমি বললাম—তাই তো! আমাদের ধারণা ছিল উনি কন্ট্যাক্টর।

—হ্যাঁ তাই। প্রথম জনের নাম আমি করব না, আমাকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। দ্বিতীয় জন এক এক ইউ পিআইট, সে-ই চাকলাদারকে আনে। তা আমাদের পুরনো পাঁচিল ধসা নিয়ে সেই কেসের সময়ে তো সে চাকলাদারের ঘাড়ে সব চাপিয়ে কেটে পড়ল। কেস ফয়সালা হয়ে যাবার পর চাকলাদার বলল—আমিই আপনাদের এ বাড়ি করে দিচ্ছি। …তো এইসব গল্পগাছা উনি আমাদের সঙ্গে এমন করে করলেন যে মনেই হল না, আমরা কাছাকাছি থাকলেও কোনও জানাশোনা কথাবার্তা আমাদের মধ্যে ছিল না।

দেবল বলল—তোমরা আছ খুব ভাল হয়েছে। আমরা আরও ভাল করে এদের কাজকর্মের বিষয় জানতে পারব। কতটা এগোচ্ছে, কোথাও গাফিলতি হচ্ছে কি না।

সেই থেকে দেবল প্রায়ই আসে। আমাদের হিসেব-পত্র দেখে, বাড়িটা ঘোরে।

দীপু এ সবের মধ্যে থাকে না। হয় তো দুটো কথা বলল, তারপর বিনা নোটিসে উঠে চলে গেল। এক এক সময়ে জিনিসটা খুব বিশ্রী দেখায়।

একদিন বলি—কী রে দীপু, রমেনকাকা দেবল ওরা এলে তুই ওরকম অদ্ভুত ব্যবহার করিস কেন রে?

দীপু একেবারে ব্ল্যাংক চেয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর আমি বললাম—কী রে জবাব দিচ্ছিস না?

—ওদের অত কী রে? দীপু ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল।

—কীসের অত?

—কোনওদিন আমাদের দিকে ফিরেও চায়নি। আমরা গরিব, আমাদের ওদের মতো পয়সা নেই। ঠিক আছে, তোর রিকোয়েস্টে চাকরি নিয়েছি, তো কী?

আমি হেসে বলি—দ্যাখ দীপু চিরদিন কারও সমান যায় না। ওরা এখন আর আগের মতো বড়লোক নেই। এই বাড়ি মেনটেন করতে পারত না বলেই তো এইভাবে ভিটে বিক্রি করে দিচ্ছে। তা ছাড়া আগেকার মেন্টালিটিও লোকের থাকছে না। দেবল-টেবল আমাদের জেনারেশন, আমরা এ সব মানি না। তা ছাড়া বাড়িটা তো ওদের, খোঁজ নেবে না?

দীপু চোখ পাকিয়ে বলল—কিন্তু আমি যে ভয়েস শুনি। তুই যেদিন চাকরিটা প্লেটে নিয়ে হাজির হলি সেদিনও শুনেছিলুম। এরা এলেও শুনছি।

—তোর ভয়েস টয়েসগুলো রাখবি? বাজে যত। চল তোকে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

—চল, দীপু কেমন একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়া গলায় বলল।

—রাজি?

—রাজি।

—তা হলে খোঁজ নিচ্ছি কিন্তু।

সঙ্গে সঙ্গে দীপু কেমন মিইয়ে যায়—ডাক্তারটা যদি আমাকে পাগল বানায়?

—দ্যাখ দীপু পাগল কাউকে বানাতে হয় না, পাগল মানুষ হয়। তোর হাবভাব আমার সুবিধের ঠেকছে না। সময়মতো চিকিৎসা হলে এফেক্টটা হবে।

পাগলদের পাগল বললে খেপে যায় সবাই জানে, দীপু কিন্তু খেপল না। এটা ভাল লক্ষণ। আরেকটু সাহস করে বলি সুতরাং—এ সব ভয়েস-টয়েস, কোথাও কেউ নেই, অথচ তুই শুনছিস এর মানে কী? সত্যযুগ তো আর নয় যে দৈববাণী হবে।

দীপু চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল। আমি বললাম—নেচারটা কী তোর ভয়েসের? কী শুনিস? বলবি তো?

—দ্যাখ রুণু, তুই আমার বন্ধু মানছি। ক’টা টিউশনি জুটিয়ে দিয়েছিস, এখন আবার এই তিন হাজার। সব ঠিক। কিন্তু তুই আমার প্রাইভেট ব্যাপারে নাক গলাবি না।

যা বাব্বা।

ঠিক আছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটুকু যখন রাজি হয়েছে, তখন আর কিছু না বলাই ভাল। বেগড়বাঁই করলে মুশকিল আছে।

চুপচাপ কাজ করে যাই। দীপু একবার মিস্তিরিদের সঙ্গে কথা বলতে উঠে গেল। আমি দেখেছি ডেস্ক-ওয়র্কে দীপুর মন নেই। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারলেই ভাল। মিক্সচারের কড়া উঠছে নামছে। উঠে গেল, আবার নতুন করে বালি-সিমেন্ট মিশেল হচ্ছে। তবে এখন ও আর চটি ফতাস ফতাস করছে না। আমি নিজে সঙ্গে করে ওকে নিয়ে গিয়ে একসেট জামা-কাপড় কিনিয়ে দিয়েছি। এক জোড়া পেছনে স্ট্র্যাপ দেওয়া চপ্পল। পরতে নানা বাহানা শুরু করেছিল। এই দ্যাখ গোড়ালিতে লাল দাগ হয়েছে, ফোস্কা পড়বে। বিনা বাক্যব্যয়ে কয়েকটা স্টিকিং প্লাস্টার এনে গোড়ালিতে লাগিয়ে দিয়েছি। এখন মুখে আর কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু মুখটা অকারণ গোমড়া করে থাকে। —এরপর বোধহয় টাই পরাবি? —একদিন বলল।

আমি কোনও জবাব দিইনি।

একদিন হেড-মিস্ত্রি কলোরস বলল—কালোবাবু পাগলা হলেও শেয়ানা আছে।

কামিনগুলো হেসে অস্থির। গালে গুণ্ডি পুরে বলল একজন—তোমার থেকে ও শেয়ানা নাকি মিস্তিরি?

হেড মিস্ত্রি গম্ভীরভাবে বলল—যা যা কাজ কর। নয় তো ভেগে যা। কী বলেন গো রুণুবাবু?

আমি বলি—তোমার আন্ডারে যারা কাজ করছে, তারা তোমার দায়িত্ব। আমি ওর মধ্যে নেই। তবে তোমার দায়িত্ব পুরোই আমাদের দু’জনের—সে কালোবাবুই বলো আর ফর্সাবাবুই বলো।

লাল দাঁত বার করে কলোরস বলল—ফর্সাবাবু নয়, গোরাবাবু।

—ভাল। কিন্তু মিক্সচারগুলো ঠিকঠাক করো। প্রত্যেকবার নতুন মিশেল তৈরি করবে, আমাদের ডাকবে, এসে দেখে যাব। যে কেউ একজন।

খইনি মুখে নিয়ে কলোরস মিচকে হেসে বলল—এই যে বিল্ডিং ওপর থেকে নীচে নামছে, এরকম হয় না, নীচ থেকে ওপরে ওঠে, বাবু কি জানেন? মাপের কম বেশি করলে বাবু আপনি ধরতে পারবেন?

—মেপে মেপে তুলব, তোলাব—এই বাড়ির পাঁচিল চাপা পড়ে দু’জন মারা যায়। বাড়িটার বদনাম আছে।

—ভিখিরি তো, না কী বাবু?

—ভিখিরি তো কী?

—আজ্ঞে, ওদের পাঁচিল-চাপাই ভাল।

—বাঃ চমৎকার।

এদেরই যদি এই অ্যাটিচুড হয়, তা হলে বিত্তবান ক্ষমতাশালীদের কী হবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress