Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 19

তিমির বিদার || Bani Basu

দিন তিনেক পর আমার জ্বরটা ছেড়েছে, সন্ধেবেলা একটা বই নিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়ছি। একটা প্রবল গুনগুন আওয়াজ শুনি। যেন অনেক মৌমাছি একসঙ্গে উড়ছে। কী ব্যাপার?— পুবের জানলা দিয়ে দেখি —বেশ দূরে রসিক ঘোষের মোড়ের থেকে একটা ভাল সাইজের জনতা আসছে। উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে আসছে। মোড়টা পেরিয়ে গেছে, কিছুক্ষণ আর দেখা যায় না। কী ব্যাপার? এ কী? রসিক ঘোষ পেরিয়ে গেছে, আড়াআড়ি রাস্তা রহিম শেখ ক্রস করে গেল, ক্রমশ গুনগুনটা বেশ ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো শোনাচ্ছে, জনতাটা আমাদেরই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। একেবারে সামনে রমজান আলি, কোমরে চেক লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় লেসের কাজ করা টুপি। দাড়িটা ছোট করে ছাঁটা, মেহেদি ছোপানো, গোঁফ কামানো, টুপির আশপাশ থেকে যে চুলগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো আগে কাঁচাপাকা ছিল, এখন তরমুজের বিচির মতো কালো।

আমাদের বাড়ির বেল বাজছে। চ্যাঁ-অ্যা করে বাজছে। কে খুলে দেবে? কে আছে এখন? আমিই টলতে টলতে যাই। হঠাৎ কোথা থেকে বউদি ছুটে নেমে যায়। দরজা খুলছে। দেড়তলা থেকে স্পষ্ট শুনতে পাই রমজান আলির ভারী ঘড়ঘড়ে গলা—হাসিনা কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? রুণুবাবু কোথায়?

—রুণুর ক্যালকাটা ফিভার হয়েছে। নিজের ঘরে শুয়ে আছে।

—বাড়ি খুঁজে দেখতে দিন, আমরা খুঁজে দেখব হাসিনাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে রুণু সরকার।

—আপনারা কি পুলিশ? সার্চ ওয়ারেন্ট আছে যে ভদ্রলোকের বাড়ি সন্ধেবেলা চড়াও হয়েছেন?

—পুলিশের বাপ আমরা, এই কে আছিস এই মেয়েছেলেটাকে সরিয়ে দে তো! আমি উত্তরের জানলা দিয়ে একটা হাঁক দিই—সত্য…

তারপরে ঝাপ খেতে খেতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই।

রমজানের পাশেই সামসুল। একটা কাগজ মেলে ধরে রাগি গলায় বলল—রুণুদা, এই চিঠি হাসি তোমাকে লিখেছিল?

—হ্যাঁ। —আমি বউদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দাঁড়াই।

—কোথায় রেখেছ তাকে? —সামসুলের এত চড়া গলা আমি আগে কখনও শুনিনি। —চিঠিটা পড়ে কি মনে হচ্ছে আমি তাকে লুকিয়েছি! পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের জানিয়েছি। আমার গলাও সমান চড়াতে চেষ্টা করি।

—ততার সঙ্গেই আশনাই ছুঁড়িটার! তোরই কীর্তি। —খিঁচিয়ে ওঠে রমজান।

—খবরদার। আমি গর্জে উঠি। আশনাই যদি হয়ই তা হলে কি তোর সঙ্গে হবে? কবরে পা তিনবারের বার নিকাহ করতে যাচ্ছিস একটা মেয়ের বয়সি মেয়েকে! লজ্জা নেই? তোর ভয়েই দিশেহারা হয়ে সে পালিয়ে গেছে। সাবধান সামসুল বেশি নকশালি মারিস না। তোদের কেস সব আমি বিলা করে দেব। এই মুহূর্তে যা এখান থেকে। ফোট।

ততক্ষণে ভিড় জমতে শুরু করেছে। পাড়ায় যে যেখানে ছিল ছুটে এসেছে। সত্য, সত্যর দুই শালা অমল আর কমল সাহা, রহিম শেখ লেন থেকে সেলিম বিশ্বাস আর তার তিনটে ভাই খলিল, মুস্তাফা, সঞ্জু। তা ছাড়া রবিনবাবু, দুলাল মিস্ত্রি, সোমেশ্বর, জিতেন রাহা, ভানু কানু, আরও অনেক, অনেক, অন্ধকারে প্রভূত চেনা মুখের আদল।

দাদা আপিস থেকে ফিরছে। এত লোক দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। রমজান দাদার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতদুটো ধরে বলল—তোমাকে আমি ভদ্দরলোক বলে জানি তপুবাবু। তোমার এই ভাই আমার হবু-বিবিটাকে লুকিয়ে রেখেছে। পালাবার মতলব করছে এখন জ্বরের ভান করে।

—কী বলছেন আপনি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! রুণু। এ সব কী?

—আমি জানি না। জানি না দাদা।

—জানিস না, মাজাকি মারছিস আমার সঙ্গে, জেলের ঘানি তোকে না টানাই তো আমার নাম…

দাদা তীব্র স্বরে বলল—চাচা, আপনি আমার ভাইকে গালাগাল দিচ্ছেন? গত দিন দশেক ধরে ও ক্যালকাটা ফিভারে ভুগছে। রুণু, তুমি কাঁপছ। ভেতরে যাও!

বউদিকে অপমান করেছে, ও শালাকে আমি দেখে নেব—আমি চ্যাঁচাই। ওর লুঙ্গি আমি খুলে নেব। মাফ চাক বউদির কাছে। দাদা এগিয়ে এসে আমার গালে একটা ঠাস করে চড় কষাল। বলল—বলছি তো ঘরে যাও। শুনছ না কেন? টুকু চলে যাও বলছি। যা-ও।

বউদি আমাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। দু’জনেই কাঁপছি, ভেতরের উত্তেজনায়, রাগে, ভয়ে। বউদি কাঁপতে কাঁপতে বলল— ওকে যদি কিছু করে।

আমি কাঁপতে কাঁপতে বলি, সত্যরা আছে।

নীচে অনেকক্ষণ উত্তেজিত চেঁচামেচি চলল। দাদা বলছে শুনছি— আচ্ছা আচ্ছা অনেক চেঁচামেচি হয়েছে। রমজান চাচা আপনার কেসটা কী? সামসুল— তোমরা এত লোক মিলে সন্ধেবেলায় আমাদের বাড়ি, ঝগড়া-ঝাঁটি, গালাগালি—এসব কী? কেসটা কী? কেসটা? সবাই চুপ করো। বলুন বলুন তো চাচা। এ-ই গোলমাল থামাও।

—আরে তপুবাবু—এই সামসুলের বোন হাসিকে বিয়ে করব, ওদের কথা দিয়েছিলাম। তা সেই মতো রেডি হচ্ছি। হাসিটাকে ওই আপনাদের দীপু-পাগলার বোন আর আপনার ভাই মিলে পড়াল। পাশ করাল। কলেজ যেতেই বাস আর তার মাটিতে পা পড়ে না।

—ছি ছি—আপনি বলছেন কী? সামসুলের বোন আমাদের বাড়ি? হ্যাঁ মণিমালার সঙ্গে টুকুর কাছে পড়তে আসত মাঝে মাঝে। তাতে হয়েছে কী?

—আপনার বিবিও এ সব্বোনাশের মধ্যে আছেন, বলতে বাধ্য হচ্ছি।

—লেখাপড়াটা সব্বোনাশ! আপনি বলছেন কি চাচা? শুনলে লোকে কী বলবে?

—সব্বোনাশ ওই আশনাইয়ের আস্পদ্দা—বুঝলেন? সে পালিয়েছে। সমাজ, ফ্যামিলি কিছু আর মানে না। আমি তখনই সাবধান করেছিলুম শামুকে…

—সামসুল! তোমার বোন…

—হ্যাঁ তপুদা ক’দিন আগে বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন যাবে বলে ব্যাগে জামাকাপড় ভরে কলেজ চলে গেল। আর আসেনি।

—তারপর? তোমরা থানায় খবর দিয়েছ?

—না। এখন সামসুলের সুর অনেক স্বাভাবিক—বদনামি হবে, হাসপাতাল-টাল খোঁজ করেছি। কোথাও নেই। পরদিন টুকুভাবি আর মণিমালা গিয়ে আমার দাদাকে এই চিঠি দিয়ে আসেন। চিঠিটা রুণুদার নামে এসেছিল।

কিছুক্ষণ চুপ। দাদা বোধহয় চিঠিটা পড়ছে। একবার, দু’বার…

কিছুক্ষণ পর আবার দাদার গলা—এর থেকে তো একটুও মনে হয় না তোমার বোনের নিরুদ্দেশের সঙ্গে আমার ভাইয়ের কোনও সম্পর্ক আছে সামসুল! চাচা, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের প্রাইভেট ব্যাপারে আমরা কেন কথা বলব। কিন্তু এই মেয়েটি কীসব প্রতিরোধটোধ লিখেছে। ফ্যামিলি ক্রীতদাস লিখেছে—এসব তো ভাল কথা নয়! ও আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়, বোঝাই যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আপনি কি গায়ের জোরে বিয়েটা করবেন? ইস্‌স, কত ভয় পেয়েছে তবে একটা সদ্য কলেজে পড়া কনজারভেটিড পরিবারের মেয়ে পালাতে পেরেছে! ও যদি কোনও হঠকারিতা করে বসে, তা হলে কিন্তু চাচা প্রধান দোষটা হবে আপনারই। আপনারা এখন যান। আমি রুণুকে-টুকুকে জিজ্ঞেস করছি। যদ্দূর পারি আপনাদের হেল্‌প্‌ করব কথা দিচ্ছি।

আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করল নীচেটা। সত্য, অমল, কমল ধাঁই ধাঁই করে ওপরে উঠে এল। কী ব্যাপার রে রুণু?— তুই তো এত বোকা ছিলি না।

—উফফ। আমি একটু হতাশ। কাতর প্রতিবাদ করি। বউদি বুঝিয়ে বলে— রুণু ওকে ভাল করে চেনে না পর্যন্ত। রমজানকে কী করে ওই মেয়ে বিয়ে করবে তোমরাই বলো।

—চেনে না, তো এরকম ডায়ালগ লিখল কী করে?

—ও আমার কাছে সাহায্য চাইত, আমিই রুণুকে একদিন বলি— তোমরা পাড়ার ছেলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এমন একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে, তাইতে রুণুই বলে— ওকে, ওদের নিজেদেরই এবারে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা ইনটেরফিয়ার করতে গেলে পুরো কমিউনিটি তো ভুল বুঝবে! সেটা আমি ওকে বলি। তাই হয়তো অভিমানে এ চিঠি রুণুকে দিয়েছে।

—আপনি তো ঠিকই করেছেন, রুণু তো ঠিকই বলেছে। কিছু করেনি তাইতেই পুরো শনিতালাও হাজির হয়ে গেল, কিছু করলে না জানি কী হত? সাবধানে থাকিস রুণু—অমল-কমল-সত্য চলে গেল। তারপর দাদা আমাকে ধরল।

—রুণু, সত্যি কথা বলো, মেয়েটার সঙ্গে তোমার…

—অনগড দাদা, আমি তাকে ভাল করে দেখিনি পর্যন্ত।

—আমি কিছু মনে করব না, তুমি নির্ভয়ে বলো। ভালবেসে ফেলেছ, কী করা যাবে! বলো!

বউদি বলল—সত্যি, ও হাসিকে চেনেই না।

—তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, কথাটা জিজ্ঞেস করেছি যাকে উত্তরটা তাকেই দিতে দাও।

—দাদা, কতবার বলব আমি হাসিকে মণির সঙ্গে দু’ চারবার আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি, তখন হয়তো আমি টুইশন সেরে হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরছি।

—তাহলে মেয়েটিই তোমার প্রেমে পড়েছে। এখন কথা হচ্ছে, গেল কোথায়? এরা থানায় খবর না দিয়ে খুব ভুল করেছে। পাতাল রেল-টেল— আজকাল কতরকমের সুযোগ-সুবিধে হয়েছে!

পরের কয়েকদিন দাদা শামু সামসুলকে নিয়ে থানা-পুলিশ করল। এখন অনুসন্ধানের জাল আরও নিয়মমাফিক বিছোনো হচ্ছে। শুনলাম নাকি ওসি শামুকে বলেছেন— আরে সমশেরভাই, তোমারই বাড়ি থেকে তোমার বোন চুরি? এ যে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!

শামু নাকি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলেছিল— চুরি নয়, ফেরার।— যাক যাক। চুরির থিয়োরিটা শামু অন্তত মানে না। কিন্তু কে যে এই ডামাডোলে কতকগুলো বোমা টপকে দিল শনিতলার বস্তিতে তা এক ঈশ্বরই জানেন। শনিতলায় বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া, হিন্দু এবং মুসলমান নিম্নবিত্তদের বাস। অবশ্য কিছু সম্পন্ন মুসলমানও আছে।

শুনলাম কতকগুলো ঘর উড়ে গেছে। মাঝরাত্তিরে ফেটেছে বোমাগুলো। নারী শিশু বেশ কিছু মরেছে। সত্যদের বাড়ির কাজের লোক এসে বলল— নিমকি শিমকির মা শেষ। দুই বোন হাসপাতালে, কী হবে বলা যাচ্ছে না। আরও কয়েকজন গেছে। বেঁটেদার হাত উড়ে গেছে একটা।

অসম্ভব মন খারাপ। একটা ঘটনা, যাতে আমার অজান্তে আমি জড়িয়ে আছি, সেইটা নিয়ে আমাদের এলাকা আবার ফিরে গেছে সেই শামু-গদা সমঝোতার আগের দিনগুলোয়। কিন্তু শামু, গদা বা রমজানের গায়ে পুলিশ হাত দেয়নি। ধরেছে আরও কিছু ছুটকো গুণ্ডাকে।

গায়ে জামাটা গলিয়ে বেরিয়ে যাই। মা এখন ছাদে। তুলসীতলায় পিদিম দিচ্ছে। রিন্টি আর বউদি বোধহয় ঘরের মধ্যে কোনও গেম খেলছে। রিন্টিকে আটকে রাখবার জন্যে বউদি আজকাল এই কৌশল ধরেছে। লুডো সাপলুডো। যতক্ষণ না জিতছে রিন্টির শান্তি নেই। সুতরাং খেলা অনেকক্ষণ চলে, বেস্ট অব থ্রি, বেস্ট অব ফাইভ, বেস্ট অব সেভ্‌ন। আমি নিঃসাড়ে বেরিয়ে পড়ি।

সাঁঝবাতি জ্বলছে গলিতে গলিতে। রসিক ঘোষ পেরিয়ে এস এস আলির মোড়ে আসি। আমি যাব বড় রাস্তায়। গাড়ির হর্ন, অনেক মানুষের চলাফেরার স্বাভাবিক আওয়াজ হই-হট্টগোল আমি শুনতে চাই। ‘গুহ প্যালেসে’র কাছে এসে দেখি—দীপু বেরোচ্ছে। দীপুর পরনে সেই পুরনো রদ্দি শার্ট আর পাজামা। পায়ে থ্যাপাস থ্যাপাস হাওয়াই চপ্পল।

লজ্জা হল ভাবতে এই ডামাডোলে দীপুর কথা, দীপুদের কথা আমি একবারও ভাবিনি। অথচ ওরা থাকে শনিতলার বস্তির মুখেই।

—কী রে কেমন আছিস?—আমার গলায় উদ্বেগ বোধহয় ভালই ধরা পড়েছিল।

দীপু হেসে বলল—তুই যেমন রেখেছিস!

—মানে?

—মানে কি আর তুই জানিস না? তুই শালা প্রেম করবি আর বোম পড়বে আমাদের ঘরে। মজা মন্দ নয়।

—ভাল হবে না দীপু। আমার বন্ধু হয়ে এরকম আলটপকা মন্তব্য যদি তোর মুখ থেকেই বেরোয় তা হলে বোমটা এবার আমাকে টিপ করেই ছোড়া হবে। আমি নিশ্চিত ডেড অ্যান্ড গন। খুশি হবি? খুশি হবি তাতে?

—তোর তা হলে বোম-টোমের ভয় আছে?

—আলবাত আছে। আমি তোর মতো ভবঘুরে খ্যাপা-পাগল নই।

—ভবের আর কট্টুকুনি ঘুরলুম রে রুণু, এতেই ভবঘুরে বলছিস! পাগলাই বা তেমন করে হতে পারলুম কই? বলে দীপে ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে গান ধরল—

তেমন একজন পাগল পেলাম না

ভোলামন, তাইতে পাগল হলাম না…

আমি পাশ কাটাতে যাই। দীপু আমাকে বজ্রআঁটুনিতে ধরে, রুণু বেঁটেদাকে দেখতে যাবি না?

—তাই তো যাচ্ছি!

—আর নিমকি-শিমকি?

—গেলে তো ওদের সঙ্গেও দেখা হবে।

—তোর সঙ্গে দেখা হলেই দু’ বোন ভাল হয়ে যাবে। শালা সব মেয়ে তোকে দেখে মুচ্ছো যাবে? কতক চাট্টি আমার দিকেও তো পাঠাতে পারিস!

—এসব চ্যাংড়ামি আমার ভাল্লাগছে না দীপু। বললি না তো মাসিমা, মণি, মুক্তা সব কেমন আছে?

—ফর্চুনেটলি অর আনফর্চুনেটলি আমাদের কিছু হয়নি। যারা বোম মেরেছে তারা দেখে দেখে একেবারে গরিব নিঃসহায়, মেয়েমানুষ আর বাচ্চার সংসারে মেরেছে।

—সত্যি বলছিস?

—বলব না? দ্যাখ রমজানের কিছু হয়নি, শামুদের কিছু হয়নি। আমরা গরিব, তবু বোধহয় ভদ্দরলোক বলে মানে, আমাদেরও তেমন কিছু হয়নি।

—‘তেমন কিছু’ মানে?

—না, ওই!

—কী বল না।

—মুক্তাটাকে আওয়াজ দিচ্ছে, আশে-পাশে, এই আর কী!

—দীপু এটাকে লাইটলি নিস না। সাবধান হ৷ এতদিন দিচ্ছিল না, এখন দিচ্ছে। এর মানে কী?

—কীভাবে হব? তুই-ই বল। মেয়েটাকে তো কাজে বেরোতে হবে? ন’টায় বেরোয়, সাড়ে সাতটায় ফেরে। মণিটা অবশ্য বেলা থাকতে থাকতেই ফেরে।

—তুই এক কাজ কর, মুক্তার ‘লা-বেল’-এ গিয়ে ওকে তিনটে সাড়ে তিনটেয় অফ করে দিতে বল কিছুদিনের জন্যে। বিপদের কথাটা বল।

—সাড়ে তিনটে তো আরও বেটার সময় রে, রাস্তা থেকে মুখ বেঁধে মেয়ে তুলে নেওয়ার উৎকৃষ্ট সময়।

আমার ভেতরটা আবার থরথর করতে থাকে। কথা বলতে পারি না।

—ব্যবস্থা একটা করেছি। একটা সাহারা।

—কী ব্যবস্থা?

—গদাকে বলেছি। গদা বলেছে ও দেখছে।

গদার নাম শুনে আমার রাগ হয়ে যায়। মাফিয়া, গুণ্ডার সর্দার একটা, চুরি-জোচ্চুরি করে ম্যানশন বানিয়েছে। সে হবে কারুর সাহারা! যদি-বা হয় কড়ায় গণ্ডায় দাম বুঝে নেবে।

একটাও কথা না বলে পা বাড়াই। হলই-বা দুঃখের দিনে গদাইরা ওর মাকে রাঁধুনির কাজ দিয়েছে, মান বাঁচিয়েছে, তাই বলে এতটা পক্ষপাত?

—এই রুণু, একটু দাঁড়িয়ে যা।

—কেন? আমি থেমে গিয়ে বলি।

—মন খারাপ করিসনি। ও বোমবাজি তোর জন্যে হয়নি। মানে তুই রিমোটলিও এর সঙ্গে যুক্ত নয়।

—তা হলে?

—শনিতলাওটা যারা বুজে ফেলছিল, কাজটা তারাই করেছে। দাঙ্গা বাধবে। পুলিশ এলে লাঠালাঠি হবে। কিছু নিকেশ হবে। কিছু জেল। ওরা যুক্তভাবে একটা রেজিস্ট্যান্স দিয়েছিল মনে আছে। এটা তারই প্রতিশোধ। এই ডামাডোলে ঐক্য নষ্ট হবে, অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যাবে… তখন আবার জমি ভরাট, বিশাল কমপ্লেক্স… ওয়েস্ট টাওয়ার সুইমিং পুল-নেচারের কোলের ওপর যদি বাস করতে চান। এটা একটা বহুতল কমপ্লেক্স নয় শুধু… এটা একটা লাইফ-স্টাইল…

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষে শুধু বলতে পারি, তুই কী করে জানলি? কে বলল তোকে?

দীপু বলল—ভয়েস।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress