Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 14

তিমির বিদার || Bani Basu

মহালক্ষ্মী মহাজন মারাই গেলেন। হার্টের ট্রাবল ছিল। ছোট ছেলের সন্ধান পাওয়া না যাওয়ায় বেচারির করোনারি অ্যাটাক হয়। সেই যে নার্সিং হোমে গেলেন, আই সি ইউ থেকে আর বেরোতে পারেননি। একদিন দেখলাম একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল, তার ভেতর থেকে স্ট্রেচারে করে এক রুপোলি রঙের বৃদ্ধার মরদেহ বেরোচ্ছে। জগদিন্দ্র এসে নার্সিং হোমের লোকেদের সঙ্গে হাত লাগালেন। হঠাৎ দেখি সত্য, পানু আর আমিও জুটে গেছি। বৃদ্ধ এ এস বিরাট সিটিংরুমটার মধ্যে একটা একানে চেয়ারে চুপ করে বসে আছেন। বাড়িটার দেয়াল, দরজা, জানলা, আসবাবপত্র, সাজসজ্জা সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা কবরের তলার নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে। কেউ কাঁদছে না। অন্তঃপুর থেকে নাতি-নাতনিরা এসে দাঁড়াল প্রথমে। চমৎকার একটা সোনালি জরিপাড় সিলকের শাড়ি, বোধহয় পরিয়ে দিয়েছে নার্সিংহোম থেকেই, রুপোলি চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। কাঁধ অবধি। কপালে চন্দনের তিলক। নাতি-নাতনিরা কেউ ফুল, কেউ মালা দিল। সব আট থেকে সতেরোর মধ্যে বয়স। একটি বছর দশ-এগারোর মেয়ে হঠাৎ ‘দাদি’ বলে একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠল। এ বোধহয় মহেন্দ্রর। সবচেয়ে বড় ছেলেটি তাকে কাছে টেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দুই বউ এলেন, সব শোকের সাদা শাড়ি পরা। আরও তিন-চার জন বউকে দেখলাম। খুব ক্লোজ মনে হল। হয়তো মেয়ে, আমরা জানি না। প্রত্যেকে ফুল বা মালা দিয়ে প্রণাম করলেন তারপর মুখের ওপর কাপড় চেপে নিঃশব্দে ভেতরে চলে গেলেন।

অ্যাম্বুলেন্সটা আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গুরুদ্বার থেকে সৎকার-এর গাড়ি এসে দাঁড়াল। এবার স্ট্রেচারের চার কোণ ধরে বৃদ্ধাকে তুললাম জগদিন্দ্র, সত্য, পানু আর আমি।

কাগজে বেরোল খবরটা—মহেন্দ্র মহাজনের কোনও সন্ধান মেলেনি। কোনও খবর নেই! তাঁর মা মিসেস মহাজন হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু পুলিশ কী-ই বা করতে পারে? মহাজন ফ্যামিলি পুলিশের সঙ্গে একেবারেই সহযোগিতা করছে না। তবে ড্রাইভার মদনলালের পোস্ট-অপারেশন শারীরিক অবস্থা এখন অনেক ভাল। মদনলালকে হাসপাতালেই জেরা করছে পুলিশ। যেটুকু জানা গেছে, তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তা প্রকাশ করতে চাইছে না।

শব-সৎকারের পর যখন মিছরি শরবত কোনও মতে গলাধঃকরণ করে চলে আসছি, বৃদ্ধ এ এস আস্তে আস্তে উঠে এলেন, আমার মাথায় হাত রাখলেন, সত্য আর পানুর হাত ছুঁলেন, বললেন—থ্যাংকিউ বয়েজ। গলাটা ঈষৎ ভাঙা।

আমার এই তৃতীয় শবযাত্রা। প্রথমটা ছিল আমার নিজের বাবার। বাজার করে এসে বসলেন, এক গ্লাস জল চাইলেন, বউদি জলটা এনে হাতে দিচ্ছে বাবা ঘুরে পড়ে গেলেন, সেরিব্র্যাল স্ট্রোক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা বাড়িতে দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কি বাক্‌শক্তিহীন দুরারোগ্য রোগীকে তিলে-তিলে মরতে দেখার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়নি। বিধাতাপুরুষ বোধহয় মনে মনে একটু বিচার করেছিলেন—তিন প্রজন্ম ধরে এরা ভুগছে। কোথায় ফরিদপুরের একশো বিঘে জমির জমিদারি, স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টারগিরির মর্যাদা, বিশ-পঁচিশটা মুনিষ মাইন্দার খাটছে আর কোথায় কলকাতার প্রান্তিক ড্রেনহীন, কোনও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাহীন জবরদখল কলোনি। দিবা-রাত্র দূর-দূর। কী সংগ্রামের মধ্যে টিউকল, দখলীকৃত জমির পাট্টা পাওয়া। প্রথমে কর্পোরেশন স্কুল। তারপরে বড় স্কুল। লণ্ঠনের আলোয় আপ্রাণ পড়া মুখস্ত করে সেকেন্ড ডিভিশন পাওয়া। কোথাও কোনও কাজের লোকজন নেই। আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে পরের জমিতে ভিটে তোলবার দুঃসহ মানসিক পীড়ন। হয়তো বিধাতৃশক্তির মধ্যে বিবেকের উদয় হল। তাই। দ্বিতীয় যাত্রা—দীপুর বাবা। ওরে বাবা, সে প্রথমে বাঙ্গুর হাসপাতাল, তারপরে লাম্বার পাংচার-টার ফেল মারলে লাশকাটা ঘর। সেখান থেকে ডোমেদের সঙ্গে কুৎসিত ঝগড়া করে শব ফিরে পাওয়া, শবদাহ করে প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফেরা, কীরকম পাথর চোখে চেয়ে মাসিমা বললেন —ভালই হয়েছে। একটা মুখ একটা পেট কমে গেল, কী বলো রুণু! কিন্তু ওই মুখটাই যে আর সব পেটের জোগাড় করত, তার কী করছি! একবার আলোচনা করলে পারত, সে-কালে আমরা ওষুধটা খেতাম, ও বাঁচত! একটা নিঃসম্পর্ক ব্যাটাছেলের আর কী লাগে? একটা গামছা আর এক বান্ডিল বিড়ি! —এমন নিস্তাপ গলায় চাহনিতে কথাগুলো বললেন যে মনে হল—আলোচনাটা যে হল না আজও, চমৎকার, কিন্তু অলটারনেটিভটা আরও চমৎকার হত, আলোচনার অভাবে যে হতে পেল না এটাই মাসিমার আফসোসের কারণ। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন হিমবাহ নামছিল, চার পাশে ওরা পাঁচ ভাই বোন কেমন ছিটোনো ধুলোবালির মতো বসেছিল, এঃ একটা ভুল হয়ে গেল এরকম একটা ভাব। সত্যিই দেখুন মেয়েদের কত কী লাগে! অতি বৃদ্ধা হবার আগে পর্যন্ত পর্যাপ্ত লজ্জাবস্ত্র চাই। এখন সে যদি স্বেচ্ছায় করিনা কপূর-ফপুর হতে চায় তো আলাদা কথা, নইলে বস্ত্র চাই-ই, ছেলেদের, বাড়ন্ত ছেলেদের, মেয়েদেরও দুরন্ত খিদে। এটুকুতে হবে না আরও চাই। বাবা-মা তোমাদের ভাগগুলো দাও, পেট ভরছে না। তা ছাড়া চাই কিছু না কিছু লেখাপড়া, কোনও বৃত্তির প্রশিক্ষণ, মেয়েদের বিয়ে চাই। নইলে পাবলিকের ভোগে যাবে। কিন্তু আত্মীয়স্বজনহীন একজন বয়স্ক ব্যাটাছেলের কীই-বা লাগে! মাসিমা খুব চমৎকার সাম-আপ করেছিলেন, বেঁটেদাও যেটা পরে পরিষ্কার বুঝেছিল—চেড়ি আর বিড়ি।

—আর এই মৃত্যু? এ শোক শুধু শোক নয়। কেমন দুরন্ত অভিমানে ঠোঁট ফোলানো শোক। কাঁদব না। না, ফুঁপিয়েও না, যেচে মান আর কেঁদে সোহাগ নয়, যে-কষ্ট দিয়েছ তার কোনও তল নেই। কী ক্ষতি করেছিলাম কার? কিচ্ছু না। জন্মসূত্রে ব্যবসার পেশা পেয়েছি, লাভ-লোকসানের হিসেব, কোনটা কীভাবে করতে হয় এসব বহু জন্মের শিক্ষা ও অভ্যাসের উত্তরাধিকার। আমরা বড়বাজারি কারবারি নই যে ঘিয়ে সাপের চর্বি, তেলে শেয়ালকাঁটা বা ইনজেকশনের অ্যাম্পুলে জল ভরে বিক্রি করেছি। বিদেশি ইলেকট্রনিক গুডস্‌-এ বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। আমাদের কয়লাখনিগুলো শেষ হয়ে যাবার পর বাজারের চাহিদা বুঝে তৈরি করছিলাম, আরও বড়, আরও ভাল সব জিনিস, একটা কমপিটিশন দেবার চেষ্টা করছিলাম। মাথা খাটিয়ে ভাল উপার্জন করেছি, সুখে থেকেছি। আরও সুখের বিষয়, ফ্যামিলিটাতে কোনও ক্ল্যাশ অফ ইনটারেস্ট ছিল না, ফাটল ধরেনি। কী ক্ষতি করেছিলাম কার যে আমাদের বাড়ির ছোট ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেলে? আমাদের মাকে মারলে? —আমি যেমন কোনও বিধাতৃপুরুষের করুণা বা বিবেকবোধ দেখতে পাই আমাদের বাবার যন্ত্রণাহীন তাৎক্ষণিক মৃত্যুতে, ওরা হয়তো তেমনি বিধাতৃপুরুষের ঈর্ষা, বিদ্বেষ দেখে। পাড়ার সবাইকার চোখ-টাটানোও দেখে। এই শবযাত্রার পর আমি প্রথম সত্যি করে বুঝতে পারলাম— ধনী লোকেরাও আমাদেরই মতো মানুষ। তাদের শান্ত থাকা, তাদের অশ্রুহীনতা, চূড়ান্ত শোকের সময়েও ধীর থাকা এক ধরনের শিক্ষার ফল। ভেতরে-ভেতরে সেই একই আকুলতা, আর্তনাদ, হাহাকার, সেই ছোট মেয়েটির ‘দাদি’—বলে কেঁদে ওঠা! সংযম, কিন্তু সারাদিন একই চেয়ারে স্থবির বসে থাকা। ভাঙা গলা ‘থ্যাংকিউ বয়েজ।’

এবারে ঘন-ঘন মহাজনদের খবর বেরোতে লাগল। এখনও যখন মুক্তিপণ চেয়ে ফোন টোন আসেনি, তখন মনে হয় এ বিজনেস রাইভ্যাল্‌রি। কোন কোন হাউজের সঙ্গে মহাজনদের কারবার ছিল, ক্লোজ কম্পিটিশন ছিল তার লিস্টি বেরোতে লাগল। তদন্ত চলছে। মদনলালের সাক্ষ্য থেকে নাকি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রাদি পাওয়া গেছে। একটা কাগজের স্কুপ-নিউজ-মদনলালের সাক্ষ্যে অনেক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। ডি. সি. ডি ডি-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নো কমেন্ট। মহেন্দ্র কি বেঁচে আছেন? এ নিয়েও নানারকম কাগুজে জল্পনা চলে। এক কাগজ বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মহেন্দ্রর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। পরদিনই লালবাজার থেকে প্রতিবাদ বেরোয়। এমন কথা তাঁরা কখনও বলেননি।

মহেন্দ্র তো একা নন। মাঝে-মাঝেই কোনও ধনী ব্যবসাদার কি টপ এগজিকিউটিভ এভাবে হাপিস হয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চয় এটা একটা চক্র। আর সেই চক্র ভেদ করতে পারছে না পুলিশ? হয় তারা পুরো অপদার্থ। আর নয় গদ্দার। শুধু আমি কেন, আমাদের পাড়া কেন, সমস্ত জনসাধারণের এই ধারণা। তবে হ্যাঁ, যাচ্ছে ধনী লোকেরা, হাঙর-কুমিরে কি আর পুঁটি মাছ ধরে! এই বিশ্বাসে, আশ্বাসে জনসাধারণ চুপচাপ আছে। ধনী লোকেরা নিজেদের খরচে নিরাপত্তারক্ষী রাখছেন। পুলিশকে কিছু বলছেন না। ভরসা নেই।

কিন্তু আমাদের মতো জনসাধারণেরও হাজারো দুঃখের মধ্যে আরও দুঃখ মানে বিপদের দিন আসে। একদিন রমজান আলি আমাকে রাস্তায় ধরলেন।

—কী খবর রুণু ভাইজান?

হঠাৎ কেন কাকার বয়সি লোকটার ভাইজান হয়ে গেলাম জানি না।

—খুব তো পড়াচ্ছ। টিউটর বলে নাম বেরিয়েছে বাজারে।

আমি কিছু বলি না।

—সমশেরের বোন হাসিনাটাকে তো মাধ্যমিক পাশ করিয়ে ছাড়লে? ভাল ভাল, কথাটা কী জানো? তোমাদের মধ্যে যেমন-যেমন মেয়েলোকের লেখাপড়ার চল হয়েছে, তেমন তেমন সংসারের শান্তি ঘুচেছে। মুখে মুখে কথা, অভব্য পোশাক, ব্যভিচার, ডাইভোর্স।

আমার রাগ হয়ে যায়, বলি—হাসিনা মাধ্যমিক পাশ করেছে, আবার আমার কাছে পড়ে—এ খবরটা খুবই আনন্দের। শুধু আমিই ব্যাপারটা জানি না। আর লেখাপড়ার বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মেয়েদের লেখাপড়ার বিরুদ্ধে তিন শতক আগের ভোঁদা কথাগুলো বন্ধ করুন। আপনার মতো লোকেদের জন্যেই আপনাদের মেয়েগুলোর এত কষ্ট। পুরো সমাজটা আপনাদের পিছিয়ে আছে।

—তুমি তা হলে আমাদের মেয়েদের কষ্ট ঘোচাবার, সমাজটাকে এগোবার ঠিকে নিয়েছ?

—নিতে পারলে তো ভালই হত। কিন্তু সে সাধ্য কোথায়!

—কেন! ঘাবড়াবার কী আছে? ছোট করে শুরু করো। প্রথমে হাসিনা, তারপর সাকিনা, তারপর আমিনা টামিনা…

আমার এবার হাসি পেল। মনে পড়ে গেল এই লোকটা হাসিনাকে বিয়ে করতে চাইছে। প্রথম বউকে তালাক দিয়েছে। দ্বিতীয় বউ এখন শয্যাশায়ী।

—রোজগারপাতি কী করছ আজকাল!

—যাই করি, দেশের দামি জিনিস তো পাচার করছি না।

—এত্ত তেল! বেকার-বেগানার আবার জবান!

রাগে মুখ লাল সাদা হচ্ছে লোকটার।

আমি পেছন ফিরি। যথেষ্ট হয়েছে। ডেঞ্জারাস লোক।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবি—সমশেরের বোন মাধ্যমিক পাশ করেছে? একদিন শামু বলেছিল বটে ও রবীন্দ্রনাথ পড়ে। বাঃ! কিন্তু আমি ওকে পড়িয়ে পাশ করিয়েছি এমন গুজব কী করে রটল! গুজবটা সত্যিই রটেছে না আলিচাচা জাস্ট অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছে?

বাড়ি এসে বউদিকে বললাম কথাটা। বউদির মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

—কী ব্যাপার বলো তো বউদি, তুমি চেনো হাসিনাকে? জানো খবরটা? বউদি খুব ভয়ে ভয়ে মাথা হেলাল।

—জানো? আশ্চর্য? কী জানো? আমাকে বলোনি তো!

তখন বউদি যা বলল তাতে আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম।

দীপুর বোন মণিমালা নাকি হাসির খুব বন্ধু। সে-ই হাসিকে বই ধার দিত। পড়াত বরাবর, হাসির ভীষণ আগ্রহ, মাথায় কিছু বস্তুও আছে। মণিই এসে বউদিকে ধরে হরসুন্দরীতে হাসিকে ভর্তি করে নিতে। ক্লাস নাইনে। ভর্তি হবে কিন্তু স্কুলে যাবে না, মাধ্যমিকটা যদি অন্তত এইভাবে পাশ করতে পারে। বউদি না কি সেই মর্মেই হরসুন্দরীর বড়দির কাছে দিনের পর দিন দরবার করে। মেয়েটি আসবে না। কিন্তু সে অ্যাটেনড্যান্সের পার্সেন্টেজ পাবে, অনগ্রসর এলাকার মেয়ে। এত আগ্রহ, বাড়ি এবং পাড়া বড়ই রক্ষণশীল, সে কি এইটুকু সুযোগ পেতে পারে না? বড়দির বাসায় রাত্তিরে মণির সঙ্গে অনেক বার গেছে হাসি। বড়দি নিজে হাসিকে ইংরেজি পড়িয়েছেন। বউদি তাকে হিসট্রি জোগ্রাফি পড়িয়েছে। মণি বাকি সব দেখিয়ে দিয়েছে। আমার কাছ থেকে মণি মাধ্যমিকের সময়ে যে সাহায্য পেয়েছে, স্বভাবতই সে সবই হাসিও পেয়েছে। যে-দিন মণি নিজেদের পাসের খবর জানাতে এসেছিল সে-দিনও নাকি হাসি ওর সঙ্গে ছিল। মা আর বউদি ওদের লুচি বেগুনভাজা রসগোল্লা খাইয়েছিলেন।

বলতে বলতে আমার অমন সাহসিকা ফাজিল বউদি কেঁদে ফেলল। আমি বললাম, ও কি? কাঁদছ কেন? একটা কাজের মতো কাজ করেছ তো!

—মেয়েদুটো এসে অত করে ধরল, কী করি বলো!

—কী আশ্চর্য, বেশ করেছ, এর মধ্যে কৈফিয়তের কান্নাকাটির কী আছে?

—কিন্তু রমজান লোকটা যে ভাল নয়! তোমার সঙ্গে হাসির নামটা যে জড়িয়ে দিয়েছে।

—আমি তো ওকে বলেছি—আমি কাজটা করতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু করিনি, বিন্দুবিসর্গও জানি না ব্যাপারটার।

—তুমি বড্ড সরল রুণু। তুমি বললে আর ও অমনি বিশ্বাস করে নিল! এ রকম হয় না কি? এসব ডেঞ্জারাস লোক। তা ছাড়া কিছু প্রমাণ তো রয়েই গেছে।

—প্রমাণ? কীসের প্রমাণ?

—তোমার নাম লেখা বই যা তুমি মণিকে দিয়েছিলে। তোমার হাতে লেখা নোটস যা তুমি মণিকে দিয়েছিলে সে-সব তো এখন ওর কাছে। ওর বাকসো খুঁজলেই মিলবে।

—যা বাব্বা, একজনের বই, নোটস আরেকজনের কাছে যেতে পারে না? যে নিয়মে আমার কাছ থেকে মণির কাছে গেছে, সেই একই নিয়মে …

—এসব তো স্ট্রেট ফরোয়ার্ড সহজ সরল লোকের ভাবনা। রমজান লোকটা হাসিকে বিয়ে করবার জন্যে মরিয়া হয়ে গেছে, সে এখন নানারকম সন্দেহ করবে।

—একজন লোক মিথ্যে সন্দেহ করবে বলে আমাদের ভয় পেতে হবে! আচ্ছা তো! ওর হাসিকে বিয়ে করতে ইচ্ছে তো করুক গে না বিয়ে, আমি কি কিছু বলতে যাচ্ছি?

বউদি এইবার খুব করুণ গলায় বলল—কথাটা তুই বললি রুণু? আমি ঠিক শুনেছি তো!

—হ্যাঁ বললামই তো! তাতে কী হয়েছে?

—আজ যদি কেশবকাকা মণিকে বিয়ে করতে চায়, তোরা পাড়ার ছেলেরা চুপ করে থাকবি?

আমি হেসে ফেলি—কেশবকাকা?

—কেন? বউদি বলে, কেশবকাকা কি রমজান আলির থেকেও খারাপ পাত্র?

—তা অবশ্য বলা যায় না! কিন্তু কেশবকাকার তো কেশব কাকি রয়েছেন? কী করে তিনি ইচ্ছে করবেন? ছুঁকছুঁক করছে না কি বুড়ো ভাম? মারেগা এইসা ঝাঁপড়!

—দ্যাখ দ্যাখ রুণু, নিজেই দ্যাখ মণির বেলায় তোর রি-অ্যাকশনটা কীরকম হল। একেবারে স্পনটেনিয়াস! রমজানও তো একটা বুড়ো ভাম-ই। কোন না চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বয়স হবে। তারও তো ঘরে বিবি রয়েছে! একটা আঠারো বছরের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাইছে। ওর বড় ছেলে আর মেয়ে দুটোই হাসির থেকে বড়।

—আমরা কী বলব! বলতে গেলে ওই রমজান চাচার চাচি-ই হয়তো এসে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে যাবে। ওরা এতেই অভ্যস্ত।

—এতে কোনও মেয়ে অভ্যস্ত হতে পারে না রুণু, বাজে কথা বলিস না।

—তা সে তুমি যা-ই বলো। রেজিস্ট করতে হবে হাসিকে। তার পরিবারকে। আমাদের কিছু করবার নেই।

—এই কথাই তা হলে বলব তাকে?

—কাকে? হাসিকে?

—আর কাকে!

—সে আমার পরামর্শ নিয়ে চলে তা তো জানতাম না! আর একটা না-জানা জিনিস!

বউদি পায়ের আওয়াজ করে চলে গেল। দুম দুম করে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মানুষটা এতই হালকা যে সে চেষ্টা ফলবতী হল না।

আমার ভেতরটা কেমন একটা উল্লাসে ফেটে পড়ছে! মণি, আমার বন্ধুর বোন, মণিমালা আমার ছাত্রী নিজে পারাবার পার হতে চাইছে, আরেকটি মেয়েরও মুক্তি সে সম্ভব করেছে। দু’জনেরই প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশ। মণি তার সমাজ থেকে কিছুটা হলেও সাহায্য পেয়েছে, হাসি পায়নি। পায়নি কী? কীসের সমাজ? মণি হাসি দু’জনেই নির্ভেজাল বাঙালি। এক ভাষায় কথা বলে। চেহারার ধরন একরকম। অর্থের দিক থেকে দেখতে গেলে দু’জনেই নিম্ন মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্ত বলাটাই ঠিক ছিল। কিন্তু মণি আর দীপু দু’জনে মিলে ওদের নিম্নবিত্ততাকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে লাফিয়ে পার হয়ে গেছে। শামুকে পয়সাকড়ির দিক দিয়ে হয়তো উচ্চমধ্যবিত্ত বলা যেত, কেন না স্থানীয় ব্যবসাদারদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে অর্ডারমতো লোক চমকিয়ে, জায়গায় জায়গায় নাইট ওয়াচের টেম্পোরারি কাজ করে সে ভালই কামায়। কিন্তু ওর দুই মা। প্রথমার দ্বিতীয় সন্তান সে। প্রথম জন মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। শামুর পরে ওর নিজের মায়ের আরও একটি ছেলে সামসুল, মেয়ে হাসি। সৎমার পাঁচটি সন্তান বেশ ছোট ছোট। সবচেয়ে ছোটটির বয়স বোধহয় বছর আষ্টেক। ঠিক যতদিন ওর আব্বা মারা গেছেন। এদের সবাইকার ভার একা শামুর কাঁধে যার নাকি মাধ্যমিকটাও পাশ করার সুযোগ হয়নি। কোনও কারখানার শ্রমিক-ট্রমিক হবার ট্রেনিংও নেই। একটু সময় করে যে ট্রেনিং নেবে, ন’জন পরিজনকে নিয়ে সে ফুরসতটুকু পর্যন্ত ওর নেই। তারপর বাড়িতে দুই মায়ের ঝগড়া, বাচ্চা ভাইবোনগুলোর ক্যাঁচাকেঁচি লেগেই আছে। ওর মোক্ষ ছিল ফুটবলে। পাটা জখম হয়ে সে-দিকটাও বরবাদ হয়ে গেল। কাজেই সাংস্কৃতিকই হোক আর আর্থিকই হোক মধ্যমান এখনও ওর নাগালের বাইরে। কিন্তু হাসির মুক্তির ইচ্ছে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার বুদ্ধি প্রমাণ করে আরোহণের ক্ষমতা ওদেরও আছে। মণি, আমার ছাত্রী এটা সম্ভব করল। মণি যে স্টার পেয়ে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করেছে, তার চেয়েও বড় কৃতিত্ব এইটা। কথাটা কি মণি বুঝতে পারছে? যদি না পারে তো ওকে আমি বুঝিয়ে দেব। সুযোগ পেলে।

আমার আরও আনন্দ আমার ছুঁচ-হয়ে-ঢুকে-ফাল-হয়ে-বেরোনো ঘটি বউদি এই মুক্তি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছে। আর পাঁচজন চাকুরে স্ত্রী বা মায়ের মতো নিজের টাকা পয়সা, বুদ্ধিবৃত্তি সব নিজের লোকেদের সুখ-স্বার্থের জন্যেই খরচ করেনি। সে একটি অনগ্রসর সমাজের মুসলিম মেয়ের জন্য তার বসকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে অদ্ভুত শর্তে, মেয়েটির নিজস্ব পরিবেশের শর্তেই স্কুলে ভর্তি করিয়েছে, পড়িয়েছে, এবং করেছে নিশ্চয় নিজের খরচে। কেন না, বেতন মাফ হলেও, সেশন ফি ইত্যাদি বাবদ কিছু খরচ তো আছেই।

প্রথম যখন দাদা বাড়িতে ঘোষণা করল সে ঘটি মেয়ে আনতে যাচ্ছে, বাবা আপত্তি করেছিলেন। ওরা মিলেমিশে থাকতে পারে না। দু’জনেই চাকুরে, খুবই মুশকিলের কথা হবে তপু যদি আলাদা হয়ে যায়। মা বলেছিল —আমি ঘটি না হলেও বাটি তো বটে! আমি কোনওদিন আমার বাঙাল শ্বশুর-শাশুড়িকে অযত্ন করেছি! অমন বলো না।

আমি তখনও এত লায়েক হইনি। কিন্তু বলেছিলাম—বাবা, এ কথাটা তুমি ঠিক বললে না। আমরা এই জেনারেশন কি আর প্রকৃত অর্থে বাঙাল আছি? বাঙাল ভাষার টোন আমার চেয়ে কোনও পশ্চিমবঙ্গীয় অভিনেতা হয়তো বেশি ভাল আনতে পারবেন। আমাদের এখানেই জন্ম-কর্ম, এখানেই মিশে গেছি। বাবা নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—জাতিগত চরিত্র চট করে যায় না রে রুণু। তা বাবার আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে টুকু-বউদি আমাদের পরিবারের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পূর্ণ মানিয়ে নিয়েছে। আমার মা-বাবা দাদার চেয়েও বউদিরই কৃতিত্ব এতে বেশি আমি বলব। বউদিও খুব স্ট্রাগলিং পরিবারের মেয়ে। অল্প বয়সে বাবা গত, ছোট বোনটির বিয়ে দিয়েছে, মায়ের দেখাশুনো করেছে, যখন বিয়ে হয় তখন দাদাকে কথা দিতে হয়েছিল, মায়ের দেখাশোনা করতে যা টাকা খরচ করতে হয় সে তার রোজগার থেকে করবে। ওদেরও বাপের বাড়ির একটাই ভরসা ছিল। তিন শরিকের একখানা বাড়ি। তা হোক নিজের বাড়ি তো! দু’খানা ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা কলঘর, আর একটা দালানঘর। মাঝখান থেকে দেয়াল উঠেছে পার্টিশনের। বউদির মা এক ভদ্রমহিলাকে পেয়িং গেস্ট রেখেছিলেন। মহিলা কোনও বেসরকারি অফিসে ভাল কাজ করতেন। এ থেকে ওঁদের খরচের টাকাটা অনেকটাই উঠে আসত। বউদির মাস-মাইনে দাদা কখনও চায়নি, বউদিও কখনও দেয়নি। সে বাড়ির জন্য খরচ করে নিজের মতে, নিজের রুচি অনুযায়ী। এই খাবার-টেবিল চারটে চেয়ার এবং রান্নাঘরের গ্যাস উনুন তার কীর্তি, নিজের বাচ্চার সমস্ত খরচ সে-ই সামলায়। বাবা থাকতে বাবার, এবং এখন মায়ের ওষুধপত্র বউদিই কেনে। আমার ঘরের স্ট্যান্ডিং ফ্যানটা বউদির উপহার। তা সেই বউদি মায়ের সংসার, এখন অবশ্য মা আর নেই, ওদের অংশটুকু ওরা কোনও সরকারি চাকুরেকে ভাড়া দিয়েছে, সেটা বউদি আর তার বোনের মধ্যে ভাগ হয়। যাই হোক মায়ের সংসার, আমাদের সংসার চালিয়েও আর একটি মেয়ের লেখাপড়ার আংশিক খরচ ও দায়িত্ব নিয়েছে সম্পূর্ণ নিজের তাগিদে—ভাবতে আমার বুকখানা দশহাত হয়ে যেতে লাগল।

ছাতের মধ্যে সিগারেট খেতে খেতে জোরে জোরে পায়চারি করতে থাকলাম। যেন লটারি জিতেছি। অনেক, অনেকক্ষণ পর, প্রায় দেড় ঘণ্টা কাবার হয়ে যাবার পর হঠাৎ আমার খেয়াল হল—এ কী রে বাবা! এত উল্লাস কেন? কীসের? সারা জীবনটাই তো আমার ডিস্যাপয়েন্টমেন্টে ভরা। খুব খারাপ বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না, কিন্তু তেমন ভাল কিছু কোনওদিনই করতে পারিনি। এক একটা রেজাল্ট বার হত আর আমার মনের মধ্যেটা অন্ধকার হয়ে যেত। আবার আলোর দিকে উঠতাম বন্দি গাছের মতো, এবার আরও চেষ্টা করব। নিশ্চয় ভাল হবে। নিশ্চয়। আবার হল না। এই ভাবেই চলেছে। কোথাও কোনও চাকরি পাইনি আর পাব বলেও আশা নেই। ট্যুইশানিগুলোর জন্যে পড়াশোনার অভ্যেসটা আছে, বরং বেড়েছে, আর হাতে পয়সার খুব অকুলান হয়নি, কিন্তু একটা মেয়ে পাশ করেছে বলে, আর অন্য দুটো মেয়ে তাকে সাহায্য করেছে বলে, এবং সাহায্যকারী দুটি মেয়েই আমার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এ কী উল্লাস! যে মেয়েটি পাশ করল, আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাইনি কিন্তু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে পেয়েছে সে-ও তো আমার বন্ধুরই বোন। যেমন মণি, তেমনই হাসি। তফাত তো কিছু নেই! তা হলে তিনজনেই সামহাউ রিলেটেড টু মি। কিন্তু এত উল্লাস, এত আনন্দ! সেই গুপি বাঘার ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’, যেন মনের মধ্যে ঘুরছে ফিরছে! তবে কি আমি সোশ্যাল রিফর্মার-ফিফর্মার হয়ে যাচ্ছি? হায় ভগবান, আমি সামান্য মানুষ তুমি আমার এ কী করলে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress