Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তালিয়াৎ || Narayan Gangopadhyay

তালিয়াৎ || Narayan Gangopadhyay

বর্ধমান থেকে ফিরে আসছিলুম। আমি আর হাবুল সেন।

একে কনকনে শীতের রাত, তায় শেষ ট্রেন। ছোট কামরাটায় যাত্রী নেই বললেই চলে। শুধু লাঠি হাতে মোটাসোটা এক ভদ্রলোক উঠেছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বাঙ্কে চেপে কম্বল মুড়ি দিয়েছেন।

শক্তিগড় স্টেশনে আর-এক ভদ্রলোক উঠলেন। রোগা লম্বা চেহারা-গায়ে বেমানান ধুমসো ওভারকোট। কান-মাথা একটা খাকী রঙের মাফলারে জড়ানো। মুখে সরু গোঁফের রেখা–চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

আমি আর হাবুল তখন বর্ধমানের গল্প করছিলুম। মানে দুজনে বেড়াতে গিয়েছিলুম হাবুলের মাসিমার বাড়িতে। খাওয়াদাওয়া হয়েছিল ভালো, মেসো আর মাসিমাও খাসা লোক, কিন্তু মেসোমশাইয়ের এক বন্ধু এসে সব মাটি করে দিলেন। তিনি নাকি খুব বড় গাইয়ে। কোত্থেকে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসে তেলে না তেলে না তেলে না না দে–গাইতে লাগলেন। মেলোমশাই ভীষণ খুশি–মাসিমাও ঘন ঘন মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু আমরা দুজনে গরম তেলে পড়ে কইমাছের মতো ছটফট করতে লাগলুম।

হাবুল ঢাকাই ভাষায় বললে, তোরে সত্য কই প্যালা–গান শুইন্যা আমার মাথাটা বনবনাইয়া ঘুরতে আছিল।

আমি বললুম, যা বলেছিস, গান তো নয়–যেন মেশিন-গান।

–হঃ, কান ফুটা কইরা দিতাছে একেবারে। আরে বাপু, এত ভালো-ভালো রবীন্দ্রসংগীত থাকতে ক্লাসিকাল গান গাওনের দরকার কী! কিছু বোঝন যায় না ক্যাবল চিৎকার।

ওভারকোট-পরা ভদ্রলোক একটা বিড়ি ধরিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। এবার বেশ শব্দ করে গলা খাঁকারি দিলেন। আমরা চমকে তাঁর দিকে তাকালাম।

বললেন, ক্লাসিকেল গান বুঝি তোমাদের ভালো লাগে না?

আমি বললুম, আজ্ঞে ভালো লাগবে কী করে? কিছু তো বোঝা যায় না।

ওভারকোট বিড়িটায় একটা মস্ত টান দিয়ে বললেন, আসল কথা কী জানো, তাল বোঝা চাই। তাল বুঝলেই গান বোঝা যায়।

হাবুল সেন বললে, তাল বুঝুম না ক্যান? তালের বড়া তো খাইতে খুবই ভালো লাগে।

–আহা-হা, সে-তাল নয়। গানের তাল।

–অ।

বেশ কায়দা করে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে ভদ্রলোক বললেন, তালই হচ্ছে গানের প্রাণ। ভালো বুঝলেই ক্লাসিকেল গান তালের পাটালির মতো মধুর লাগবে।

–তালক্ষীরের মতো উপাদেয় মনে হবে–আমি জুড়ে দিলাম।

-ঠিক।–ভদ্রলোক খুশি হলেন : তোমার বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি আছে দেখছি। তালই হল গানের রস–মানে তালবড়া, তালপাটালি আর তালক্ষীরের কম্বিনেশন।

হাবুল ভেবে-চিন্তে জিগ্যেস করলে, কিন্তু সুর?

আমি বললুম, ওটা গানের শুঁড়। মানে, লোকের কান পাকড়ে আনে। শিব্রাম চক্রবর্তী লিখেছেন। তারপর বেশ গর্ব করে বললুম, জানেন শিব্রামদার সঙ্গে আমার আলাপ আছে।

ওভারকোট হাসলেন : তোমার শিব্রামদা তো বাচ্চাদের জন্যে হাসির গল্প লেখেন, শুনেছি। কিন্তু গানের তিনি কী জানেন? আমি একটা উপমা দিয়ে বোঝাই। ভোজপুরী লাঠি দেখেছ কখনও?

আমি বললুম, বিস্তর। হাজীপুরে মেজদা থাকে সেখানে আমি অনেকবার গেছি। গাঁটে-গাঁটে-বাঁধানো তেল চুকচুকে সব লাঠি–এক ঘা পিঠে পড়লেই আর দেখতে হবে না।

ওভারকোট হাঁটুতে থাবড়া দিলেন : ইয়া! একদম কারেক্ট! গাছকে যদি লাঠি বলে ধরা যায় তা হলে তাল হল তার গাঁট। ওই গাঁট না থাকলে লাঠির কোনও মানে হয় না।

হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, গানেরও না। তালে গাঁট দুমদুম পিঠে পড়তে থাকে।

ওভারকোট আবার হাসলেন : যে তাল বোঝে, তার কাছে ওই গাঁটই আখের গাঁট হয়। একবার চিবুতে শেখো, তারপরেই মন মজে যাবে। আচ্ছা–এখুনি তোমাদের একটু তালিয়ে দিই?

–এখুনি? প্রস্তাবটা আমার ভালো লাগল না।

–মন্দ কী?–ওভারকোট অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন :কলকাতায় পৌঁছুতে এখনও তো অনেকটা সময় লাগবে। দারুণ শীত পড়েছে, তাল শিখলে শরীরটাও একটু গরম হবে। আচ্ছা–এই দ্যাখো-হাবুলের ছোট চামড়ার সুটকেসটা নিয়ে টকাটক বাজাতে লাগলেন, এই যে দেখছ–এই ধা-ধিনা-ধিনা–এই হচ্ছে দাদরা।

অ!

–আর এই ধিনি কেটে ধা–এ হচ্ছে কার্ফা। বুঝেছ? একটু কান পেতে শোনো, খুব মিঠে লাগবে।

আমি বললুম, আজ্ঞে খুব মিঠে লাগছে না তো।

আহা, বাঁয়া-তবলা না থাকলে কখনও বোল ওঠে? চামড়ার সুটকেস কিনা–তাই কেবল ঢপঢপ করছে।

আমি বললুম, তা ছাড়া কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

হাবুল বললে, আহা, এইডা বোঝস না ক্যান? তাল তো গোলই হইব। চৌকা তাল কোনওদিন দ্যাখছস নাকি?

ভদ্রলোক নাক দিয়ে কেমন ঘোড়ার মতো আওয়াজ বের করে ইঁ-হিঁ-হিঁ শব্দে কিছুক্ষণ হাসলেন। বললেন, ছেলেমানুষ। তালের নামে তালগোল একটু হবেই। আর চৌকো তালের কথাই যদি বললে, তা থেকে আমার চৌতাল মনে পড়ল। খুব শক্ত জিনিস–ভদ্রলোক টকাটক করে আবার খানিকটা সুটকেস বাজালেন, একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, কী করে যে বোঝাই! আচ্ছা–ট্রেনের আওয়াজ পাচ্ছ?

–পাচ্ছি বই কি।

কী রকম শোনাচ্ছে? হাবুল বললে, যেন কইতে আছে : চাইলতা তলায় বইসা যা-পাকা-পাকা খাজুর খা!

ভদ্রলোক বললেন, কী? চালতে তলায় বসে যা-পাকা পাকা খাজুর খা? বাঃ-মন্দ বলোনি তো। হ্যাঁ, চৌতাল অনেকটা এই রকমই। এই ধিনি-গিধা ধিনি-গিধা–

আবার টকাটক তাল পড়তে লাগল সুটকেসে : এই চালতে তলায় ধা। পাকা খেজুর খা। ধিনি গিধা–ধা! এবার ঠিক বুঝতে পারছ তো?

হাবুল বললে, আইজ্ঞা না। তবে আপনার আগের দুইটা তাল বেশ বুঝতে আছিলাম। কার পা? না দাদার পা। আইচ্ছা মশাই, এত জিনিস থাকতে দাদার পা নিয়া টানাটানি ক্যান?

ওভারকোট একটু বিরক্ত হলেন : আঃ–তুমি তো বড্ড বেরসিক দেখছি! ও-দুটো কার পা-দাদার পা নয়। কার্ফা আর দাদরা।

অ-অ।

–শোনো, চৌতাল বোঝার আগে ত্রিতালটা একবার জানা দরকার।–ওভারকোট আর-একটা বিড়ি ধরালেন, কয়েকটা টান দিয়ে সেটাকে নিবিয়ে পকেটে পুরে বলতে লাগলেন : একটু বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই ধরো, এই গানটা বলে গুনগুন করে গাইতে লাগলেন তিনিঃ

পঞ্চু পিসে ছাতের পরে
ভূতের সাথে কুস্তি লড়ে!
রাত ঝমঝম অন্ধকার
হুতোম প্যাঁচা আম্পায়ার।
পঞ্চু পিসে মারল ল্যাং
মটকে গেল ভূতের ঠ্যাং।
ভূতটা তখন বললে কাঁদি
গোবর আনো–পট্টি বাঁধি!

এই য়ে করুণ পদটা–মানে, মটকে গেল ভূতের ঠ্যাং–এটাকে খাসা ত্ৰিতালে ফেলা যায়।–বলেই টকাটক সুটকেসে বাজাতে লাগলেন–না ধিনা ধিনা ধানা ধিনা–মানে, এই তালটা

ঠিক সেই সময় আচমকা গাড়ির ভেতরেও তাল পড়ল। মনে হল একটা নয়, এক কাঁদি এসে পড়ল!

বাঙ্কে যিনি ঘুমুচ্ছিলেন সেই মোটা ভদ্রলোক এক লাফে নেমে পড়েছেন। ইয়া তাগড়াই চেহারা, লাল টকটকে বড়-বড় চোখ রাগে দপদপ করে জ্বলছে।

ওভারকোটের তাল বাজানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মোটা ভদ্রলোক বাজখাঁই গলায় ওভারকোটকে বললেন বলি, কী হচ্ছে এসব? এর মানে কী? অনেকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সয়েছিলুম…সব কিছুর একটা সীমা আছে!

ওভারকোট কেমন সিঁটিয়ে গেলেন। চিঁ চিঁ করে বললেন–এদের একটু তাল শেখাচ্ছিলুম।

–তাল। ওর নাম তাল? আমি পুরুলিয়ার অরবিন্দ মাহাতো, মরিস কলেজে গান শিখেছি, কাশীর কণ্ঠে মহারাজার ছাত্র আমার সামনে তাল নিয়ে এয়ার্কি? এদের ছেলেমানুষ পেয়ে ওস্তাদি?

ধিনি কেটে ধা–কার্ফা? পাকা খেজুর খা–চৌতাল?

–আজ্ঞে

-শাট আপ!–মোটা ভদ্রলোক সিংহনাদ করলেন : তালের বিন্দুবিসর্গ জানেন আপনি? সাত বছর গুরুজীর পায়ের কাছে বসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাল শিখেছি–আর তাই নিয়ে নষ্টামো? মটকে গেল ভূতের ঠ্যাং ত্রিতাল? আর তাল হল লাঠির গাঁট? তবে লাঠির গাঁটই দেখুন…

বলেই মোটা লাঠিটা তুলে নিলেন বাঙ্ক থেকে।

–এইবার এই লাঠির এক-এক ঘায়ে এক-একটা তাল বোঝাচ্ছি, আপনাকে। দেখি, কোন তালে আপনি আছেন। প্রথমেই দাদরা

লাঠি তুললেন, কিন্তু দাদরা বাজানোর আর সময় পেলেন না। ওভারকোট তার মধ্যেই সুড়ৎ করে চলে গিয়েছেন দরজার কাছে। ট্রেন তখন একটা স্টেশনে থামতে যাচ্ছিল, এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্ল্যাটফর্মে।

আমরা এতক্ষণ থ হয়ে যেন ম্যাজিক দেখছিলুম! এইবার হাবুল চেঁচিয়ে উঠল।–বুঝছি, বুঝছি–এইটার নাম ঝাঁপতাল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *