Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই

তারানাথ বলল—ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। শুধু তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে পাওয়া ক্ষমতার কথা বলছি না, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সংযমের খুব প্রয়োজন। নইলে বিপদ ঘনিয়ে আসে। গিয়ে বড় বড় রাজা-রাজড়াদেরও কি অবস্থা হয়েছে?

তারানাথের চাইতে বয়েসে অনেক ছোট হলেও আমি বা কিশোরী আর ঠিক যাকে ছোকরা বলে সে দলে পড়ি না। তবু তারানাথ আমাদের মাঝে মধ্যে ছোকরা বলে সম্বােধন করে এবং আমরা মেনে নিয়ে থাকি।

কিশোর বলল—তত্ত্বকথা শুনতে ইচ্ছে করছে না, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ক কোনো জমাট গল্প বলেন তো শুনি।

তারানাথ হেসে বলল—কারো সর্বনাশে কারো পৌষ মাস হয় এ কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। একটা জমাট গল্প মানে কোনো একজনের ভয়ানক বিপদের গল্প তো? তোমাদের গল্পের যোগান দিতে হলে দেশে হাহাকার পড়ে যাবে।

বললাম—অনেকদিন ভাল গল্প হয়নি। আজ কোনো ফাকি চলবে না। আজ গল্প বলতেই হবে।

তারানাথ বলল—একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু কারো কষ্ট নিয়ে বা দুঃখের ইতিহাস নিয়ে গল্প ফেঁদে বসতে আমার সঙ্কোচ হয়। তবু বলছি এই কারণে যে, এর ভেতর দিয়ে একটা জনশিক্ষার কাজও হয়ে যাবে।

কিশোরী বলল—জনশিক্ষার ব্যাপারটা গল্পের শেষে মর্যালের মত জুড়ে দেবেন এখন। আপাতত গল্পে আসুন।

তারানাথ আমাদের দিকে ইঙ্গিতবহ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই কিশোর তার পকেট থেকে পাসিং শো-র প্যাকেট বের করে সামনে রাখল। মৌজ করে কয়েকটা টান দিয়ে বলতে শুরু করল—দেখ, আমি একজন সাধারণ মানুষ। যাকে সাধক বলে আমি তা নই। কারণ সত্যিকারের সাধনা করবার সুযোগও আমি কোনোদিন পাইনি, পেলেও করতাম কিনা সন্দেহ। আসল ব্যাপারের চেয়ে এই পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ানো, নানা বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়া—জীবনের এই দিকটাই আমাকে বেশি মুগ্ধ করত। নইলে সত্যিকারের সাধনা করলে আমি অনেকদূর উঠতে পারতাম। তোমাদের এতদিন বলিনি, আমার একবার প্রকৃত তান্ত্রিক দীক্ষাও হয়েছিল! গুরুর নাম বলব না, তার বারণ আছে। এবং আমার দীক্ষাও হয়েছিল শুভলগ্নে। তান্ত্রিক দীক্ষা অনেক বিচার করে লগ্ন দেখে দিতে হয়। শুক্লপক্ষে দীক্ষা হয় না। কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী, সপ্তমী—এসব তিথি খুব ভাল। অক্ষয় তৃতীয়া বা দশহরার দিন হতে পারে। কিন্তু তন্ত্রমতে এসবের চেয়েও প্রশস্ত দিনে আমার দীক্ষা হয়।

কিশোরী বলল—যেমন?

—আমার দীক্ষা হয়েছিল সূর্যগ্রহণের সময়। গুরু যজ্ঞ শেষ করে আমার কপালে তিলক একে যখন গলায় পদ্মবীজের মালা পরিয়ে দিলেন, তখন মাথার ঠিক ওপরে সূর্যে গ্রহণ লেগে রয়েছে। গুরু আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন—তোর উন্নতি হবে। এমন লগ্ন সবাই পায় না। উন্নতি অবশ্য কিছু হয়নি, তবে কয়েকটা ক্ষমতা পেয়েছিলাম সে তো তোমরা জানোই গুরু এ-ও বলে দিয়েছিলেন—বেটা, সাধনা করলে অসীম শক্তি পাবি। কিন্তু সেই শক্তি নিজের স্বার্থে অপরের ক্ষতি করবার জন্য কাজে লাগালে সর্বনাশ হবে। তন্ত্রের এই নিয়ম। সাবধান থাকিস্-পা যেন না ফসকায়।

গুরুর কথামত চলতে পারিনি। অপরের ক্ষতি করিনি বটে, কিন্তু লোভে পড়ে আধ্যাত্মিক উন্নতির বদলে বৈষয়িক উন্নতি চেয়েছিলাম। ফলে শক্তি কমে গিয়েছে। নেহাত মধুসুন্দরী দেবী বলেছিলেন, কোনোদিন ভাত-কাপড়ের জন্য ভাবতে হবে না— তাই চলে যায় একরকম করে।

যাক এসব কথা। একদিন বসে আছি এই বৈঠকখানা ঘরে। সময়টা সকাল। আগের দিন এক ব্যাটা মাড়োয়ারীকে কোন শেয়ার ধরে রাখলে লাভ হবে বলে দিয়ে বেশ কিছু নগদ লাভ করেছিলাম। পড়তির মুখেও আমার কথায় ভরসা করে সে শেয়ার ধরে রেখে দেয়। পরের দিন মাঝরাতে বম্বে থেকে ট্রাঙ্ককল পায়—ওই শেয়ারের দর হঠাৎ বাড়তির দিকে। সাত দিনে কয়েক লাখ টাকা মুনাফা করে গতদিন সে এসে বেশ মোটা প্রণামী দিয়ে গিয়েছে। মনটা বেশ ফুর্তিফুর্তি লাগছে। এমন সময় দরজার কাছে একজন লোক এসে দাঁড়াল। পরনে ধুতি আর টুইলের শার্ট, পায়ে পাম্পশু। বয়েস আমারই মত হবে। আমাকে দেখে লোকটা বলল—আচ্ছা, এটা কি বললাম—আজ হাত দেখা হবে না।

-–তারানাথ কার নাম?

লোকটা তারানাথবাবু’ বা ঠাকুরমশাই’ বলল না দেখে তার অভদ্রতায় নিতান্ত চটে গিয়ে বললাম—আমারই নাম। কেন, কি চাই?

লোকটা কাছে এসে একটু সামনে ঝুঁকে ভাল করে আমাকে দেখে বলল—হ্যাঁ, তাই বটে। তুই তো তারানাথ। আমাকে চিনতে পারছিস না?

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল—অবশ্য তোরই বা দোষ কি? সে কি আজকের কথা? চিনতে পারলি না? আমি বিরজাভূষণ—বিরজাভূষণ তালুকদার।

আরো কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবার পর আমার মনে পড়ে গেল। আমাদের ইস্কুল-জীবনের সেই ভূষণ! পেছনের বেঞ্চিতে বসত, আর অনর্গল পকেট থেকে ডাশা পেয়ারা বের করে চিবোতো। তার পুরো নাম বিরজাভূষণই তো ছিল। বটে।

আমি তক্তাপোশ থেকে উঠে তার হাত ধরে বললাম—মাপ কর ভাই, সত্যিই প্রথমটা চিনতে পারিনি। কবেকার কথা সব! চেহারাও একেবারে বদলে গিয়েছে। তারপর কি খবর বল? বোস—

বিরজা চৌকিতে বসে বলল—খবর ভালই। রাজাগজা কিছু হইনি, কিন্তু বেশ কেটে যাচ্ছে, বুঝলি? তুই কেমন আছিস বল—

সংক্ষেপে বললাম—ভালই। আমারও কেটে যাচ্ছে।

-–শুনলাম তুই নাকি নামকরা জ্যোতিষী হয়েছিস; লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে নাকি ভাগ্য বলে দিস? কলকাতায় এসে ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা না করে যাব না।

—বেশ করেছিস। থাক না আমার কাছে ক’দিন।

বিরজা মাথা নেড়ে বলল—থাকা হবে না। আজকের রাতটা হয়তো থাকব, কিন্তু কাল সকালেই রওনা দিতে হবে।

রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে দুই বন্ধু বাইরের ঘরের চৌকিতে এসে বসলাম। ঘুম আর হল না, গল্প করতেই রাত ফুরিয়ে গেল।

বিরজাভূষণ কলকাতায় এসেছিল একটা মামলার তদারক করতে। ওদের সমস্ত সম্পত্তি বাবা মারা যাবার পর দু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক ভাগ পেয়েছে বিরজা, অন্য ভাগ পেয়েছে তার আপন দাদা অম্বিকাভূষণ। দাদাকে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজে একটু দূরে আলাদা বাড়ি তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ভাগাভাগির ব্যাপারে কি একটা ক্রটি বের করে অম্বিকাভূষণ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছেন। যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা, তার মূল্য বিশ হাজার টাকার চেয়ে বেশি। কাজেই মামলা এসেছে হাইকোর্টে। এ নিয়ে অনেক দুঃখ করল বিরজা। দেখলাম ওর সেই পুরনো দিনের ভালমানুষী এখনো যায়নি। যে দাদা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তার জন্যই সে দুঃখ করছে।

পরের দিন যাবার সময় বিরজা বলল—একবার আমাদের গায়ে চল না, বেড়িয়ে আসতে পারবি। দেশের দিকে যাসও না অনেকদিন। যাবি?

কথাটা ঠিক। গ্রামে আমাদের বাড়িও প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়েছে। থাকার বা দেখাশুনো করবার কেউ নেই। কাজেই কিসের টানে আর সেখানে যাব? অবশ্য। বিরজার বাড়ি আমাদের গ্রামে নয়, মধ্যে আর একটা গ্রাম পেরিয়ে প্রায় মাইল তিনেক দূরের চড়ইটিপ নামের এক গ্রাম থেকে সে পড়তে আসতো। স্কুলে পড়ারসময় মাত্র একবারই তার গ্রামে গিয়েছিলাম। এখন আর ভালো মনে পড়ে না।

বললাম—আচ্ছা, যাব এখন। দেখি, একটু সময় করে উঠতে পারলেই–

বিরজা বলল—দেখ ওসব ছেঁদো কথায় আমাকে ভোলাতে পারবি না। সময় করে উঠতে পারলে মানে কি? তুই কি কারো চাকরি করিস? ওসব বললে চলবে না। সামনের মাসের প্রথম দিকে আমায় আবার কলকাতায় আসতে হবে। মামলার তারিখ পড়েছে। সেদিন তোর এখানেই এসে উঠব। তুই আগের থেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখিস, ফেরবার সময় তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

বললাম—বেশ, তাই হবে।

পরের মাসে বিরজার সঙ্গে আমাদের গ্রামের ষ্টেশনে গিয়ে নামলাম কত বছর পরে। সেই হারানো শৈশবের সোনালী দিনগুলো স্বপ্নের মত মনে আসে। হায়, যা যায় তা একেবারেই যায়।

স্টেশন থেকে আমাদের গ্রাম সাত মাইল, আর বিরজার গ্রাম মাইল দশেক। স্টেশনে নেমে দেখি আমাদের জন্য গরুর গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিরজা ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগে থেকে। গরুর গাড়ি চেপে অনেক বছর পরে আবার কাচা রাস্তা দিয়ে দুলতে দুলতে যাওয়া! এত ভালো লাগছিল যে, বিচার করে দেখে বুঝতে পারলাম শহরে বাস করলেও শহরকে আমি আদৌ ভালোবাসি না। গ্রাম আমার রক্তে মিশে রয়েছে।

চড়ুইটিপ গ্রামটা দেখতে ভালো। গ্রামের প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটি নদী। নদীর ধারে ঝোপঝাড়। সমস্ত গ্রামে কোথাও খুব ঘন জঙ্গল না থাকলেও ছাড়া ছাড়া গাছপালা প্রচুর। তিনচারটে পাকা বাড়ি চোখে পড়ল। এ ছাড়া সবই হয় চালাঘর, নয়তো করোগেট টিনের ছাদওয়ালা বাড়ি।

বিরজা আর তার দাদার বাড়ি পাশাপাশি, মধ্যে একটুকরো জমি। পাশাপাশি, কিন্তু মুখ দেখাদেখি নেই। যে বাড়িতে বিরজা আমাকে এনে তুলল, সে বাড়ি সে নতুন করেছে। ছোটবেলায় আমি এসেছিলাম পাশের ওই পুরনো বাড়িতে, যেখানে এখন অম্বিকাভূষণ থাকেন।

শৈশবের স্মৃতিমণ্ডিত কোনো জায়গায় অনেকদিন পরে গেলে যে আনন্দ অনুভব করা উচিত, সেরকম খুব একটা হল না। কারণ গ্রামে ঢুকতেই আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। তোমরা তো জান, দেবী আমাকে কিছু অতিমানবিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। গ্রামে ঢুকেই আমার মনে হল—এখানে একটা অমঙ্গলজনক কিছু ঘটছে। সেটা কি, তা তখনই বুঝতে পারলাম না বটে, কিন্তু মনের ভেতর কেমন অস্বস্তি পাক খেতে লাগল।

বিরজা জিজ্ঞাসা করল—কি হয়েছে? অমন মুখ করে রইলি কেন?

বললাম—কিছু না। এমনি।

বিরজার বৌটা ভারি ভালো, বেশ সাধবী মেয়ে। আমাকে আগে কখনো দেখেনি বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বুঝতে পারল আমি তার স্বামীর খুব বড় বন্ধু। চড়ুইটিপ গায়ে এখনো শহরে চালচলনের ঢেউ এসে দোলা দেয়নি। সেকালের মত একটা জলভর্তি গড়র ওপরে পাটকরা গামছা এনে রেখে গেল বিরজার বৌ। হাতমুখ ধুয়ে দুই বন্ধু বাইরের ঘরে তক্তাপপাশে বসে গল্প করতে লাগলাম। সবই আমাদের সেই রঙিন হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার গল্প।

গল্প করছি, কিন্তু পোকায় খাওয়া দাতের ব্যথা যেমন সর্বদা সব কাজের মধ্যে জানান দেয়, তেমনি মনের ভেতরকার অস্বস্তিটাকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারলাম না। বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমার এ অনুভূতি সচরাচর ভিত্তিহীন হয় না। এ গ্রামে কোথাও একটা খারাপ কিছু ঘটছে। কি সেটা?

আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি দেখে বিরজা ভাবল আমি বোধ হয় ক্লান্ত। সে গল্পে ক্ষান্ত দিয়ে উঠে খাওয়ার কতদূর দেখতে গেল।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে আমি আর বিরজা নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। ছোট গ্রাম্য নদী, কিন্তু কচুরিপানায় তার স্রোত বন্ধ হয়ে যায়নি। বেশ কাকচক্ষু জল ধীরগতিতে বয়ে চলেছে। সকালের স্নিগ্ধ হওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়। একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে দুজনে বসলাম। আমার বাঁ-পাশে একটা বড় বাবলা গাছ। তার ডালপালা অনেকখানি জলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গুঁড়ি থেকে কিছু ওপরে এক জায়গায় তিনটে মোটা ডাল তিন দিকে বেরিয়েছে। সেখানে একটা কাকের বাসা। কাকের বাচ্চা হয়েছে বোধ হয়। মা-কাক বসে বাচ্চা পাহারা দিচ্ছে, আর বাবা-কাক একটু বাদে-বাদেই কি মুখ করে এনে বাচ্চাদের খাইয়ে যাচ্ছে। ওপারে চাষীরা জমিতে লাঙল দেবার উদ্যোগ করছে। গ্রামে এত সকালেই দিন শুরু হয়ে যায়। শহরে অর্ধেক লোক বোধ হয় এখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেনি।

খোলা জায়গা, বেলা বেশি না হলেও রোদুর ওঠার পর আর বসা গেল না। বিরজা বলল—চল উঠি। মমতা খাবার করে বসে আছে এতক্ষণ–

ফেরবার সময় আগে পড়ে অম্বিকাভূষণের বাড়ি। দেখলাম একজন প্রৌঢ় মানুষ, পরনে খাটো ধুতি, বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, গলায় একছড়া মোটা রুদ্রাক্ষের মালা–বসে বসে তামাক খাচ্ছেন। সেদিকে না তাকিয়ে বিরজা চুপিচুপি বলল—ওই আমার দাদা।

অম্বিকাভূষণ আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। আমরা বাড়ির সামনে দিয়ে পার হয়ে যাবার আগেই ভেতরবাড়ি থেকে একজন লাল কাপড় পরা সন্ন্যাসী গোছের চেহারার লোক বেরিয়ে এসে অম্বিকাভূষণের পাশে বসে একবার আমাদের দিকে তাকাল। বিশ্রী দৃষ্টি লোকটার। মাথায় সামান্য জটাও আছে। নিম্নশ্রেণীর তন্ত্রসাধকের মত চেহারা। জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—ওই লোকটা কে রে? বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল? তোর দাদার গুরু নাকি?

পেছন ফিরে একবার দেখে বিরজা বলল—নাঃ, দাদা মন্ত্র নেয়নি। তবে সাধুসন্নিসি করার খুব বোক। মঝে-মাঝেই এমন দু’চারটেকে এনে পোষে। এ ব্যাটাকে দেখছি আজ কয়েকদিন যাবৎ। কিছুদিন শুষে চলে যাবে আর কি!

দুপুরে দুজনে বৈঠকখানায় বসে কথাবার্তা বলছিলাম। বহুদিন পরে শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে যেন হাপ ছেড়ে বেঁচেছি। কোলাহল নেই, লোকজনের ঝামেলা নেই, রোজ সকালে বাজার থেকে শুটকো তরকারি আর আধপচা মাছ কিনে আনবার তাড়া নেই। এখানে সকালবিকেল শুধু খাচ্ছি আর বৈঠকখানায় বসেই তামাক খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি। পরিবেশও বেশ শাস্ত। বেড়াতে বেরুলে মেঠো পথ, বাশঝাড়ের নুয়ে পড়া ডগার ওপরে বসে পাখির গান—মনে হয় এসব ছেড়ে এতদিন ছিলাম কি করে?

কথায় কথায় হঠাৎ বিরজা বলল—তারানাথ, তুই তো আজকাল শহরে থাকিস, আমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না?

বুঝতে না পেরে বললাম—কিসের ব্যবস্থা?

–ওসব দিকে আমার একটা চাকরি হয় না?

হেসে বললাম—তুই চাকরি করবি কি রে! তোর বংশে কেউ কোনোদিন পরের কাজ করেনি। আর তাছাড়া সেরকম কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নেই–

বিষণ্ণমুখে বিরজা বলল—মনে হচ্ছে দাদার সঙ্গে এই মামলায় আমি পেরে উঠব। যদি জিতি তাহলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। তখন তো চাকরি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ভাই।

এ কথার আর কি উত্তর দেব? চুপ করে বসে রইলাম।

রাত্তিরবেলা গরমে ঘুম আসছিল না। এই দুদিন বিরজার বাড়িতে থাকাকালীন মনের এই অস্বস্তির ভাবটা কিন্তু দূর হয়নি। রাত্তিরে শুয়ে এ ব্যাপারে ভাববার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারলাম না।

সকালে বিরজা আর আমি নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়া একটা অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। আসশেওড়ার ডাল ভেঙে দাঁতন করতে করতে আমরা ভোরবেলা রওনা দিলাম নদীর দিকে। একেবারে স্নান করে তবে ফিরবো।

সারারাত গুমোট গরমের পরে সকালে স্নিগ্ধ নদীজলে অবগাহন যে কি তৃপ্তির সে তোমরা শহরের মানুষেরা কি বুঝবে! জলে নেবে ডুব দিয়ে পরে মাথা তুলে দেখলাম যেখানে দাঁড়িয়ে ডুব দিয়েছিলাম, সেখান থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছি। বিরজা হেসে বলল—আমাদের ছোট নদী হলেও বেশ স্রোতের টান আছে, কি বল?

অবাক হয়ে বললাম কিন্তু পরশু সকালেও তো টান ছিল না হঠাৎ বাড়ল কেন?

-–ও হয়। এমনিতে জোয়ার-ভাটা বিশেষ খেলে না। কিন্তু অমাবস্যা আর পূণর্মার সময় স্রোত বাড়ে

—অমাবস্যা কবে?

—ঠিক জানি না। দিন চারেক বাকি আছে বোধ হয়।

স্নান সেরে পাড়ে দাঁড়িয়ে গাঁ মুছতে মুছতে নদীর ধারে ঝুঁকে পড়া বাবলা গাছটার দিকে চোখ পড়ল।

প্রথমটা খেয়াল করতে পারিনি, পরে হঠাৎ মনে হল গাছটায় কি যেন একটা নেই।

একটা জায়গা যেন কেমন ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখাচ্ছে। কি নেই ওখানে?

পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম। সেই কাকের বাসাটা!

বিরজা বলল—কি হয়েছে তোর? কি দেখছিস ওদিকে?

আঙুল দিয়ে গাছটার দিকে দেখিয়ে বললাম–দেখ কাকের বাসাটা আর নেই।

—কাকের বাসা!

—হ্যাঁ, কালকেও এখানে ওই ডালের তেকোনায় একটা কাকের বাসা দেখে গিয়েছি। আজ আর দেখছি না। কি হল? কাল তো ঝড়-টড় হয়নি যে পড়ে যাবে।

বিরজা শুকনো কাপড় পরতে পরতে বলল—যাঃ, ঝড়ে কখনো কাকের বাসা পড়ে! ওরা দারুণ শক্ত করে বাসা বাঁধে। অবশ্য খুব বড় ঝটুকা হলে পড়তে পারে—

বললাম—কিন্তু সেরকম তো হয়নি!

—ছাড় দেখি। একটা কাকের বাসা নিয়ে মাথা ঘামাবার কি আছে?

হায়! কি ঘটতে চলেছে জানলে কি বিরজা অত শাস্তভাবে কথা বলতে পারত।

এই ঘটনার পরেও কিন্তু আমি কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। পারা সম্ভবও ছিল। কিন্তু কখনো কখনো জীবনে আশ্চর্য অঘটনের ভিড় লেগে যায়। সকালে যার কথা খুব ভেবেছি বিকেলে দশ বছর পরে হয়ত সেই বন্ধু এসে হাজির হল। কিংবা হয়ত সকালে একটা তালা এবং বিকেলে সেই তালাটারই চাবি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এর পরের দিনই সে ধরনের একটা ব্যাপার ঘটায় আমি মনে মনে দুই আর দুই যোগ করে দিলাম।

চড়ুইটিপ থেকে মাইল আষ্টেক পশ্চিমে বসন্তপুর বলে একটা গ্রাম আছে। সে গ্রামের কল্যাণেশ্বর শিব খুব জাগ্রত। প্রতি বছর চড়কের সময় বড় মেলা বসে। মন্দিরও নাকি বহুদিনের পুরনো, গায়ে পোড়ামাটির কাজ রয়েছে শুনে বিরজাকে বলেছিলাম একবার দেখতে যাবার কথা। বিরজা গ্রামের আবিদ শেখকে বলে রেখেছিল, পরের দিন সকালে তার ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে আসতে। সমস্ত গ্রামে আবিদেরই একমাত্র গাড়ি। মাঝে মাঝে স্টেশনে গিয়ে ভাড়া খাটে, অবসর সময়ে পড়ে পড়ে ঘুমোয়।

সকালে তৈরি হয়ে বসে আছি, কিন্তু বেলা ক্রমে বেড়ে চলে, আবিদ শেখ আর গাড়ি নিয়ে আসে না। বিরজা বিরক্ত হয়ে বলল—দূর! যত সব কুঁড়ে লোক নিয়ে কারবার! এত বেলা হয়ে গেল, আজ আর যাওয়া হবে না। গেলে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। নে, জামা-কাপড় খুলে ভালো করে বোস।

এইসব বলা-কওয়া হচ্ছে, এমন সময় স্নানমুখে আবিদ শেখ এসে উপস্থিত।

বিরজা চটে বলল—কেমন তোমার কাণ্ডজ্ঞান আবিদ! সেই কখন থেকে বসে আছি, আজ আর যাওয়াই হল না! কি হয়েছিল তোমার? গাড়ি কই?

আবিদ শেখ বিষণ্ণ মুখে বলল—আর বলবেন না কর্তা, সকালে উঠেই ঘোড়া জুতে গাড়ি নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু ঘোড়া কিছুতেই গাড়ি টানবে না। কত গুতোগাতা দিলাম, তবু ঘোড়া ঠায় দাঁড়িয়ে অনেকদিনের পোষা জানোয়ার কর্তা, কথা বললে শোনে। পরে মনে হল ওর ঘাড়ে ব্যথা হয়েছে কোন কারণে, গাড়ি টানতে গেলে ব্যথা লাগছে। নেমে এসে দেখি ঠিক তাই। ঘাড়ের কাছে একটা বেশ বড় কাটার দাগ। ও ঘোড়া নিয়ে তো আজ আর বেরুনো যাবে না কর্তা! জোর করে চালাতে গেলে মাঝপথে ক্ষেপে গিয়ে গাড়ি উলটে দিতে পারে।

বিরজা বললে-ঘোড়া জখম হল কি করে? জোয়ালে পেরেক-টেরেক কিছু বেরিয়ে আছে নাকি?

—আজ্ঞে না, সে আমি দেখেছি।

—তাহলে?

মাথা চুলকে আবিদ শেখ বলল—আমিও তো তাই ভাবছি, কিসে ঘা খেল জানোয়ারটা?

-–যাক গে, যাও তুমি। তোমার ঘোড়া ভালো হয়ে ওঠা অবধি যদি আমার বন্ধু থাকে, তাহলে একদিন মন্দির দেখতে যাওয়া যাবে।

আবিদ শেখ চলে যেতে বিরজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল—লোকটা মিথ্যে কথা বলছে কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আবিদ এমনিতে ভালো কিন্তু বড় কুঁড়ে। হয়ত আজ আর মেহনত করতে ইচ্ছে নেই। ঘোড়া ফের আস্তাবলে তুলে দিয়ে সারাদিন পড়ে ঘুমোবে।

আমি তখন দুয়ে দুয়ে যোগ দিচ্ছি। বললাম—না হে, লোকটা বোধ হয় মিধ্যে কথা বলছে না।

বিরজা একটু অবাক হয়ে বলল—তার মানে? তুমি ওর ভালোমানুষের মত মুখ দেখে গলে গিয়েছ নাকি? আবিদ কিন্তু ভয়ানক মিথ্যেবাদী।

—তা হতে পারে। তবে এবার বোধ হয় সত্যি কথাই বলেছে।

কি বলতে গিয়ে বিরজা থেমে গেল। একটু ইতস্তত করে বলল—হবেও বা। তোর তো আবার কি সব ক্ষমতা আছে লোকের মুখ দেখে মনের কথা বলে দেবার!

আমি এ নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না, বিরজাও চুপ করে গেল।

সকালে বসন্তপুর যাবার জন্য তৈরি হয়ে বসেছিলাম, কাজেই নদীর ধারের দৈনন্দিন ভ্রমণ আজ আর হয়ে ওঠেনি। দুপুরে খাওয়ার পর নিটোল একটি দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে দেখলাম বেলা গড়িয়ে গিয়েছে! এখনই বেরিয়ে পড়লে কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসা যায়। মুখেচোখে জল দিয়ে রওনা দিলাম।

গ্রামের দিকে দিনশেষের একটা সুন্দর রূপ আছে, যা শহরে তোমরা টের পাও। আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে নদীর ওপরের চষা ক্ষেত আবছা অন্ধকারে স্নান হয়ে এল। পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে ফিরে যাচ্ছে বাসায়। সারাদিনের গরমের পর নদীর বুক থেকে জোলো হাওয়া ভেসে আসছে। বাংলার বাতাসে বৈরাগ্য আছে, বুঝলে? কিছুক্ষণ চুপ করে খোলা হাওয়ায় বসে থাকলে মনে হতে শুরু করে—কে কার? কি হবে অনর্থক উন্নতির চেষ্টা করে?

অন্ধকার বেশ চেপে আসছে দেখে বাড়ি ফেরবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে নজর পড়ল ওপাশের সেই বাবলা গাছটার দিকে। গাছের নিচে একটু ঝোপমত, তার মধ্যে কি যেন নড়ছে!

প্রথমে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। এদিককার গ্রামে সন্ধের দিকে এখনো বুনো শুয়োর বেরোয়। শখ করে হাওয়া খেতে এসে শেষে বুনো শুয়োরের হাতে পড়লাম নাকি? শুয়োর বড় পাজী জানোয়ার, অকারণেই তেড়ে এসে দাঁত দিয়ে পেট চিরে দেয়।

না, শুয়োর নয়।

আমার পায়ের আওয়াজ পেতেই বোধ হয় ঝোপের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়াল।

অম্বিকাভূষণের বাড়িতে দেখা সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। তার হাতে কতগুলো শেকড়বাকড়।

লোকটা তীব্র জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীতে সব আলো-হাসি-গান ফুরিয়ে গিয়েছে। যেন কাল সকালে আর সূর্য উঠবে না এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি মারা যাব। তোমরা হলে সেই চাউনিতেই তোমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসত। কিন্তু আমি তারানাথ, আমারও জীবন কেটেছে ভয়ানক সব সাধকদের সঙ্গে মেলামেশা করে। তারা সত্যিকারের সাধক। আর এ লোকটাকে দেখেই বুঝতে পারলাম এর কিছু ক্ষমতা আছে বটে, কিন্তু সে নিম্নশ্রেণীর ক্ষতি করার ক্ষমতা। সেটা বুঝেই মনে জোর পেলাম।

লোকটা আমার দিকে তাকিয়েই আছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে বললামকি, শ্বেতসরষে যোগাড় হল?

মুহূর্তের মধ্যে তার মুখে বিস্ময়, ক্রোধ ইত্যাদি কয়েকটা অভিব্যক্তি খেলে গেল। আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে অদ্ভুত কর্কশ গলায় বলল—তুমি কি করে জানলে?

আবার বললাম—কাকের বাসা তো আগেই সংগ্রহ হয়েছে, নিমপাতা কি কালকে। পাড়া হবে, না পরশু পরশুই তো অমাবস্যা, তাই না?

সে কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে, প্রত্যেকটি কথা গরম লোহার মত বিধিয়ে দিয়ে বলল—ওঃ, তুমি জেনেছ তাহলে? তাই তোমাকে দেখে সেদিন আমার—আমিই বোকা, আমার আগে বোঝা উচিত ছিল।

তারপরেই তার চোখ আবার দপ করে জ্বলে উঠল। মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে সে বলল—কিন্তু বিশেষ কিছু লাভ হবে না। এক সাধকের অভিচার ক্রিয়ায় বাধা দেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ, জানো তো? দিয়েও সুবিধে করতে পারবে না। আমার যা করবার তা করবই। বাধা দিলেও লাভ হবে না। আমার ক্রিয়ার ফল হবেই।

বললাম—দেখা যাক।

সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, ‘বেশ, দেখ তাহলে বলে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।

খুব মন খারাপ নিয়ে বিরজার কাছে ফিরলাম। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এসব সাধকদের ভালো করার ক্ষমতা না থাকুক, ক্ষতি করবার শক্তি খুবই থাকে।

কিশোরী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল—কিন্তু আমরা যে অন্ধকারে রয়ে গেলাম। আপনি কি ভাবে দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন, বললেন না?

তারানাথ হেসে বলল—তাও তো বটে। গল্প বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে তোমরা এসব ব্যাপার কিছুই জানো না। আচ্ছা, বলি শোন। প্রথমে নদীর ধারের বাবলা গাছ থেকে কাকের বাসাটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়াতে আমার মনের ভেতরে টনক নড়ে ওঠে। তোমাদের এ জিনিসটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। বহু অভিজ্ঞতায়, শ্মশানে-মশানে ঘুরে একটু একটু করে এটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কখনো মুণ্ডমালাতন্ত্র অথবা হংসপারমেশ্বর নামে কোনো বইয়ের নাম শুনেছ?

আমি আর কিশোরী বললাম—না।

তারানাথ বলল—সেই বইয়ে শ্বেতবগলা নামে এক দেবীর উল্লেখ রয়েছে। তার পুজো করে তারপর উচাটন ক্রিয়া করতে হয়। কারুর ক্ষতি করবার জন্য যে তান্ত্রিক ক্রিয়া, তার নাম উচাটন। অমাবস্যার দিন ছাড়া শ্বেতবগলার পুজো হয় না। ঘোড়া আর মোষের রক্ত মিশিয়ে কালি তৈরি করতে হয়। তারপর কাকের পালকের কলম দিয়ে যার সর্বনাশ করতে চাও তার নাম একটা নিম পাতার ওপর ওই রক্ত দিয়ে লিখতে হবে। লেখার সময় একটা মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়, সেটা তোমাদের বলব না। এরপর ষোড়শোপচারে শ্বেতবগলার পুজো করে হোম করতে হবে। যজ্ঞের সমিধ হচ্ছে সাধারণত বেলকাঠ বা জগডুমুরের কাঠ। কিন্তু এই যজ্ঞ করতে হয় কাকের বাসার সরু সরু কাঠি দিয়ে। প্রত্যেকটি কাঠি যজ্ঞের আগুনে দেবার আগে শ্বেতসরষের তেলে ভিজিয়ে নিতে হয়। পূর্ণাহুতি দেবার সময় ওই শত্রুর নাম লেখা নিমপাতাটি যজ্ঞের আগুনে দিলেই কাজ শেষ। এবার আগুন নিভে গেলে যজ্ঞকুণ্ড থেকে কিছুটা ভস্ম তুলে শত্রুর বাড়িতে নিক্ষেপ করলে কয়েকদিনের মধ্যেই তার ভয়ঙ্কর সর্বনাশ উপস্থিত হবে।

বললাম—কি ভয়ানক!

–ভয়ানকই বটে। সেই জন্যেই বিরজার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম!

রাত্তিরে বাইরের ঘরে বসে গল্প করতে করতে বিরজা বলল—তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন রে? শরীর খারাপ নাকি?

-নাঃ! শোন ভূষণ, কাল একটা পুজো করব ভাবছি। ফর্দ করে দেব, কতকগুলো জিনিস আনিয়ে দিস তো। রাত্তিরে পুজো হবে।

—পুজো! কিসের পুজো?

–এমনিই। তোর সময়টা ভালো যাচ্ছে না, ভাবছি একটা স্বস্ত্যয়ন গোছের করে দেব।

বিরজা বোকা নয়। সে উঠে এসে আমার হাত দুটো ধরে বলল—কি ব্যাপার বল। দেখি? আমায় ভোলাবার চেষ্টা করিস না। যদি কিছু বুঝে থাকিস আমাকে বল— আমার কি কোন বিপদ আসছে?

ভেবে দেখলাম বিরজার কাছে আসল ঘটনা লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং তৈরি থাকলে ও যাই আসুক না কেন, তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে।

আমি বিরজাকে সব খুলে বললাম।

বিরজা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর নিজের বিপদ সম্বন্ধে কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—আবিদ শেখ তাহলে সত্যি কথাই বলেছিল।

বললাম—তা বটে।

বিরজা বলল—আমি তাহলে এখন কি করবো?

–বললাম তো, যোগাড়যন্ত্র করে দে—কাল সকালেই স্বস্ত্যয়ন করে দিই।

—তাতে আমার বিপদ কেটে যাবে? ওদের পুজোর ফল ফলবে না?

বিরজার কথার কোনো উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলাম।

তার খুলে বিরজার চোখ মুখ কেমন হয়ে গেল। আমি আর জ্ঞানানন্দ একসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলাম—কি হয়েছে? কি খবর?

বিরজা আমার দিকে তারটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—দাদা করেছেন। পড়ে দেখ

পড়ে দেখলাম। অম্বিকাভূষণেরই করা তার বটে। বিশেষ কিছু লেখা নেই। শুধু বলা হয়েছে—অবিলম্বে ফিরে এস। বাড়িতে বিপদ।

বিরজার দিকে তাকিয়ে বললাম—কি বিপদ বলে মনে করিস?

–-তা কি করে বলব? কিছু তো বলা হয়নি। তাছাড়া দাদা হঠাৎ—যার জন্য এত কাণ্ড। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে—

জ্ঞানানন্দ বুদ্ধিমান মানুষ, বিরজার কথার ধাচে বুঝলেন কোথাও কোনো গোলমাল আছে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন—আচ্ছা, আমি তাহলে যাই—একটু কাজ আছে। কি ঠিক করেন জানাবেন আমাকে।

তিনি চলে যেতে বললাম—কি করবি?

বিরজা বলল—চল ফিরি। নিশ্চয় কিছু গুরুতর হয়েছে। নইলে দাদা তার করতেন না। ট্রেনে আসতে সমস্ত পথ বিরজা বলল-রক্তের টান, বুঝলি? দাদা ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আবার ডেকেছে।

আমি তার কথার উত্তর দিই নি তখন। কারণ হঠাৎ আমার মনের মধ্যে আবার সেই পুরনো অমঙ্গলের ধ্বনি বেজে উঠেছে। যেন অবিলম্বে একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। এর ওপর বিরজাকে আর কিছু বলে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিন্তু আমি জানি কিছু একটা ঘটবেই, বা ঘটছে। আমার এ অনুভূতি মিথ্যা হয় না।

হলও তাই।

গরুর গাড়ি নিয়ে স্টেশন থেকে একেবারে অম্বিকাভূষণের বাড়ির সামনে গিয়ে নামা হল। মালপত্র গাড়িতেই রেখে আমরা ঢুকলাম বাড়িতে।

চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব। বাইরের ঘরে কেউই নেই। বিরজা অন্দরের দিকে পা বাড়াবে, এমন সময় স্বয়ং অম্বিকাভূষণ এসে ঘরে ঢুকলেন। বিরজা নিচু হয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে বলল—কি হয়েছে দাদা? তার করেছ। কেন?

উত্তরে অম্বিকাভূষণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

-কি হয়েছে দাদা? আমন করছ কেন?

–সন্তুর খুব অসুখ বীরু, আর বুঝি রাখা যায় না—

সন্তু অম্বিকাভূষণের বড় ছেলে। বিরজা অবাক হয়ে বলল—কি হয়েছে সন্তুর?

অম্বিকাভূষণ কপালে আঘাত করে বললেন—সব আমার দোষ, আর কারো কোনো পাপ নেই ভাই। আমার নিজের দোষেই আমি পুত্রশোক পেতে চলেছি—

—আহা, শান্ত হও দাদা। সব ঠিক হয়ে যাবে। অস্থির হয়ো না—

বিরজার স্ত্রী তক্ষুনি অন্দরে চলে গিয়ে সন্তুর পায়ের কাছে বসল। আমার বুদ্ধিই বোধ হয় কিছু স্থির ছিল। আমি দুই ভাইকে ধরে বসালাম। বললাম—কি হয়েছে খুলে বলুন তো—

অম্বিকাভূষণ কাদছিলেন, বিরজা পাশে বসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বেশ দৃশ্যটা। দুই ভাইয়ের বিবাদ বিপদের স্রোতে ভেসে গিয়েছে।

আমার প্রশ্ন শুনে অম্বিকাভূষণ মুখ তুলে তাকালেন। বললেন—নিজের মুখে স্বীকার করলে পাপের বোঝা হালকা হয়। তাই কোনো কিছু না লুকিয়েই বলছি। বীরু, তোর সর্বনাশ করার জন্য আমি এক তান্ত্রিকের পরামর্শে শ্বেতবগলার পুজো করেছিলাম। সে পুজোয়–

আমি বললাম-এ অংশটা বাদ দিয়ে বলুন। এটা আমি আগেই টের পেয়ে বিরজাকে বলেছি।

অম্বিকাভূষণ একবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—ও, জানতেন তাহলে! যাই ব্যাটা তান্ত্রিক এ কাজটা আমাকেই করতে বলল। কি আর বলব, তখন শয়তান আমার বুদ্ধি কেড়ে নিয়েছিল। এই সময় বীরুও কাশীতে। বাড়ি ফাকা। কাজেই আমিও ভাবলাম সুবিধেই হল। অমাবস্যার দিন প্রায় সারারাত্তির পুজো হল। হোম শেষ হতে হতে শেষরাত্তির। কলাপাতায় মুড়ে খানিকটা ছাই আমার হাতে তুলে দিয়ে তান্ত্রিক বলল—যাও। সাবধান, অন্য কোথাও যেন না পড়ে। তাহলেই সর্বনাশ!

তখনো ভোর হতে দেরি আছে। বীরুর বাড়ির পাঁচিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতে আমার কলাপাতায় মোড়া হোমের ছাই। পাচিল ডিঙিয়ে সেটা সবসুদ্ধ ছুড়ে ফেলতে যাব ওর বাগানে, কি বলব মশাই, একটু মেঘ নেই বা ঝড়ের চিহ্ন নেই কোথাও—অথচ প্রচণ্ড একটা বাতাসের ঝাপটা এল কোথা থেকে! ততক্ষণ আমিও সেটা ছুড়ে দিয়েছি হাত থেকে। আমার চোখের সামনে বাতাসের মুখে উড়ে গিয়ে তা পড়ল আমারই বাড়ির উঠোনে! তখুনি দৌড়ে গিয়ে উঠোন থেকে সবটুকু ছাই নিকিয়ে তুলে নিলাম। কিন্তু তাতে কি আর পাপ যায়! গত পরশু থেকে সন্তু বাবা আমার কেবলই রক্তবমি করছে—

বিরজা ব্যস্ত হয়ে বলল—কোন ডাক্তার দেখছে?

—কোনো ডাক্তার কি বাকি আছে? বিকেলেই সদর থেকে বড় ডাক্তার এসেছিলেন। নিবারণ কলকাতা গিয়েছে মর্গান সাহেবকে আনতে। কাল সকাল নাগাদ। এসে পৌঁছবে মনে হয়।

বিরজা উঠে পড়ে বলল—চল দাদা ভেতরে, সন্তুকে দেখি গিয়ে।

বললাম-আমি একবার যেতে পারি কি?

অম্বিকাভূষণ বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না।

তারপর বিরজার হাত দুটো ধরে বললেন—ভাই, আমি যা করবার তো করেই ফেলেছি। তুই কোনো রাগ পুষে রাখিস না। তুই আমার সন্তুকে আশীর্বাদ কর—

বিরজা কেঁদে ফেলে বলল—অমন করে বলছ কেন দাদা? সন্তু আমার নিজের ছেলের মতন–

সকাল হবার আগেই নিবারণ রায় মর্গ্যানকে নিয়ে পৌঁছলেন। শেষরাতের ট্রেনে এসেছেন।

স্ট্যানলি মর্গান রোগী দেখে বললেন—বোধ হয় পেরিটোনাইটিস। যদি র্যাপচারড় হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ছেলে বাঁচবে না। নইলে একটু সুস্থ হলেই কলকাতা নিয়ে গিয়ে অস্ত্র করাতে হবে—

পরের কথা সংক্ষেপে বলি। সন্তু বেঁচে উঠেছিল। আমাদের সবার মিলিত প্রার্থনার জোরেই হোক, বা অম্বিকাভূষণের অনুতাপে ঈশ্বর দয়া করার জন্যই হোক—সন্তু তিনদিনের দিনে একটু ভাল হয়ে উঠল। ডাক্তার মর্গান নিজে তার অপারেশন করেন। সে ভাল হয়ে ওঠে। দুই ভাইয়ের ঝগড়াও চিরকালের জন্য মিটে যায়। কিন্তু তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অপরের ক্ষতি করতে গিয়ে মানুষ নিজের কি বিপদ ডেকে আনে দেখলে তো? বোধ হয় ভগবানই অম্বিকাভূষণকে একটু শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন। নইলে সামান্য বাতাসের চিহ্ন নেই কোথাও, অথচ অমন হবে কি করে!

কিশোরী বলল—সে তান্ত্রিকের কি হল?

—সে পরের দিনই লোটা-কম্বল নিয়ে কাউকে না বলে ভেগেছিল। প্রাণের ভয় সবারই আছে তো—

কিশোর বলল—সন্তুর অসুখের ব্যাপারটা কাকতালীয়ও তো হতে পারে?

তারানাথ কড়া চোখে তাকিয়ে বলল—পাষণ্ড কোথাকার! আর যদি কখনো তোমাদের গল্প বলেছি!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *