রামরাম চৌধুরীর মৃতদেহ
তারানাথ বলল—রামরাম চৌধুরীর মৃতদেহ নিয়ে যখন গ্রাম থেকে বেরুলাম তখন দিনের আলো নিভে এসেছে। শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ। সেবার বৃষ্টি হয়েছিল খুব মাঠে-ঘাটে জল থৈ থৈ করছে। পথ পেছল, সারাদিন জল হয়ে সবে একটু ক্ষান্তি দিয়েছে। কিন্তু বিশেষ ভরসা পাওয়া গেল না, আকাশে মেঘের কোলে কোলে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ-ঠাণ্ড শিরশিরে বাতাস দিচ্ছে পুব দিক থেকে। গায়ের মাতব্বর যতীন ঘোষাল ডেকে বলল—তাড়াতাড়ি পা চালাও হে সব, জল তো আবার এল বলে!
যতীন ঘোষাল বললে কি হবে, তাড়াতাড়ি পা চালাবার উপায় নেই কোনো। আলের ওপর দিয়ে রাস্তা, তারপর কিছুদূর গিয়ে মাইলখানেক মাঠ ভাঙতে হবে। এটেল মাটি বৃষ্টিতে ভিজে বিউলির ডালের মত হড়হড়ে হয়ে আছে, তাতে কাধের ওপর চৌধুরীমশায়ের দুধ-ঘি-খাওয়া শরীরের ভার। অনেক বয়েসে মারা গেলে কি হয়, রামরাম চৌধুরী বিশাল পুরুষ ছিলেন। যদি পা হড়কায় এবং স্বগত চৌধুরীমশায় আমাদের কারও ওপরে পড়েন, তাহলে তাকেও এযাত্রা চৌধুরী মশাইয়ের সঙ্গী হতে হবে।
আমরা দলে রয়েছি পনেরো-ষোলো জন মানুষ। খাটিয়ার সামনের দিকে ডাইনে-বায়ে কাঁধ দিয়েছেন রামরাম চৌধুরীর দুই ছেলে–ঘনরাম আর কৃষ্ণরাম। তাদের দুজনেরই বয়েস হয়েছে পঞ্চাশের ওপরে। কয়েক পা গিয়ে হাপিয়ে যাচ্ছেন, গায়ের ব্রাহ্মণ ছোকরারা এগিয়ে পালা করে তাদের রেহাই দিচ্ছে।
চৌধুরীরা ঠিক জমিদার না হলেও আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী ভূস্বামী ছিলেন। ধনোপার্জনের ব্যাপারে রামরামের কোন নীতির বালাই ছিল না। সুদের ব্যবসাতেও প্রচুর টাকা করেছিলেন। রামরাম মারা গেলেও তার খাতকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার কোন কারণ ঘটল না। ঘনরাম এবং কৃষ্ণরাম বৈষয়িক ব্যাপারে উপযুক্ত ছেলে। পিতৃব্যবসায় সমান তেজে বজায় থাকবে।
রামরাম চৌধুরী হঠাৎ মারা গেলেন। চুয়াত্তর বছর বয়েস হয়েছিল বটে, কিন্তু দিব্যি স্বাস্থ্য, সপ্তাহে দু-দিন পাঠার মুড়ো খান। দেড়সের দুধ জুলি দিয়ে আধসের করে সকালের জলখাবার। একটা গোটা ইলিশ কিম্বা ভরপেট খাওয়ার পর কুড়িটা বড়মাপের ল্যাংড়া আম তো কোনো ব্যাপারই ছিল না। জীবনে একটা চোয়া ভেঁকুরও তোলেন নি। এইরকম মানুষ রামরাম তিনচারদিন আগে খেতে বসে কয়েক গ্রাস মুখে তুলে তারপর খাওয়া থামিয়ে কেমন ভাবে যেন ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড় পুত্রবধূ কমলা, ঘনরামের স্ত্রী, পাশে বসে পাখা নেড়ে হাওয়া করছিলেন। শ্বশুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল দেখে তিনি মনে মনে শঙ্কিত হলেন। ভোজনবিলাসী বদমেজাজী লোক, কি ক্রটি হল কে জানে! নিজের হাতে পাকা রুই মাছের কালিয়া, সরষে-বেগুন, পোস্তর বড়া—এসব করেছেন। রান্না খারাপ হলে সারাদিন এর জের চলবে।
মৃদু গলায় কমলা জিজ্ঞেস করলেন, রান্না কি ভাল হয়নি?
উত্তর না দিয়ে রামরাম গেলাসের জল দিয়ে পাতের ওপরেই হাত ধুয়ে ফেলে শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে কমলাকে বললেন, ঘনা আর কেষ্টকে আমার ঘরে আসতে বল—
এসব ঘটনা আজই সকাল থেকে ঘনরাম আর কৃষ্ণরামের মুখে শুনেছি। ঘনরাম খিড়কির পুকুরে ছিপ ফেলে বসেছিলেন, কৃষ্ণরাম বৈঠকখানায় বসে সামনের মোকদ্দমার সাক্ষীদের তালিম দিচ্ছিলেন। বাপের তলব আদালতের সমনের চেয়েও ভয়ানক—দুই ছেলে ধড়মড় করে উঠে ভেতরবাড়িতে হাজির হলেন।
শোবার ঘরে রাতের আগে আসেন না রামরাম। দু’ছেলে গিয়ে দেখলেন বাবা বিছানায় শুয়ে। ঘনরাম বললেন, কি হয়েছে বাবা?
—এখানে এসে বোস দুজনে।
–কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
একটু চুপ করে থেকে রামরাম বললেন, আমার যেখানে যা আছে তোরা বুঝে নে, আমার আর বেশি সময় বাকি নেই।
অবাক হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন—সে আবার কি? শরীর কি অসুখ বলে মনে হচ্ছে? বলো তো কালীগতি কবিরাজকে একটা খবর দিই?
-থাম্। এ কবিরাজ ডাকবার ব্যাপার নয়। আমি টের পেয়েছি আমার ডাক এসেছে। দুপুরবেলা খেতে বসে আমার মুখে ভাত তেতো লাগল।
–ভাত তেতো লাগল। তাতে কি? রান্না পুড়ে গিয়েছিল?
-না, এ সে-রকম তেতো না। এ অন্যরকম তেতোভাব। মানুষ মরবার আগে তার মুখে ধানের ভাত তেতো লাগে। তোরা সব বুঝে নে—নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবি না—আমি সব চুলচেরা ভাগ করে দিয়ে গেলাম। উইল রেজেষ্ট্রি করা আছে। ওই দেয়াল আলমারি খুলে মোটা লম্বা খামটা নিয়ে আয় দেখি—
মোটামুটি এই ঘটনা। ছেলেরা বিষয়টাকে আমল দেয়নি। তিনদিন পর আজ সকালে ঘুম কখন পরপারে রওনা হয়েছেন।
সত্যি বলতে কি, লোক-দেখানো শোক কিছুটা করতে হলেও রামনামের মৃত্যুতে কেউই খুব একটা ব্যথিত হয় নি। ছেলেরা পঞ্চাশ পার করেও সম্পত্তির পুরো কর্তৃত্ব হাতে পাচ্ছিলেন না—প্রৌঢ় বয়েসে বাপের অধীন থাকা বড় কষ্টের। পুত্রবধুরাও শ্বশুরের বিখ্যাত মেজাজ ও সময় অসময়ে নানান উদ্ভট ফরমায়েস খাটা থেকে রেহাই পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। রাত গেল। তখন খাওয়াদাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। রামরাম ইলিশ হাতে এসে বলল—কি বলছেন বাবা?
-এই দেখ, কানাই জেলে কত বড় মাছ দিয়ে গিয়েছে। রাত্তিরেই রান্না করে খেয়ে না ফেললে এই গরমে পচে যাবে। যাও, উনুনে আঁচ দাও দেখি। ছোটবউমা মশলা বেটে ফেল। মাছটা কিছুক্ষণ পড়ে থাক—একেবারে তাজা ইলিশ খেতে ভাল লাগে না। একটু সময় গেলে স্বাদ হয়। যাও, জালা থেকে পাটনাই বালাম চাল সের দুই বের করে নাও। খোকাদের এখন ডেকে কাজ নেই। রান্না হয়ে গেলে ওরা উঠে খাবে এখন।
সময় যায়। উনুন ধরে গেল। মশলা বাটা হয়ে গিয়েছে। দুই বৌ গালে হাত দিয়ে বসে মাছটার পেটে আঙুলের চাপ দিয়ে পরীক্ষা করছেন। দুই বৌ আশায় আশায় তাকাচ্ছেন শ্বশুরের দিকে। রামরাম মাথা নেড়ে বলেন, উহু, আরও এক টিপ বসবে।
আবার পায়চারি। আবার অপেক্ষা।
রাত তিনটেয় হয়ত হুকুম হল রান্না শুরু করবার।
কাজেই ঠিক সময়ে গেছেন রামরাম। আরও আগে গেলেও কেউ দুঃখ করত না। দুপুরের মধ্যে দেহ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারলে ভাল হত। কিন্তু বেলা নটা থেকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হল বিকেল অবধি। একটু করে থামে, সবাই মিলে বেরুবার উদ্যোগ করি, আবার ঝুপকুপ করে শুরু হয়।
যতীন ঘোষাল বলল, আকাশের গতিক তো ভাল না। চৌধুরীমশায়, আবার বৃষ্টি আরম্ভ হলে বিপদ
ঘনরাম উত্তর দিলেন, কি আর করা যাবে? গিয়ে তো পৌঁছোই—
কৃষ্ণরাম বললেন, সেখানে কোনো ছাউনি-টাউনি কিছু নেই? জল এলে মাথা বাঁচানো যাবে তো?
যতীন ঘোষাল বললেন, আহা, সে রয়েছে। কিন্তু সেটা তো বড় কথা নয়—আমরা–হয় বৃষ্টিতে না ভিজলাম, কিন্তু জল হলে তো আর দাহ করা যাবে না। সারারাত বসে থাকলে মৃতদেহ বাসী হয়ে যাবে। বিপদ হল—
কৃষ্ণরাম বললেন, একটু পা চালিয়ে এগোন—
গ্রামের ধার দিয়েই নদী। শ্মশান নদীর ধারে হলেও গ্রামের কাছে নয়। নদীর উজানে মাইল দেড়েক গিয়ে তবে। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল।
কেউ কোথাও নেই। কাছে দূরে অপার্থিব স্বরে শেয়াল ডাকছে। মেঘ থমকে আছে সারাটা আকাশ ভরে। আমার তখন যদিও সতেরো-আঠারো বছর বয়েস, কিন্তু শ্মশানে সেই নিয়ে বোধ হয় পনেরো-কুড়িবার যাতায়াত হয়ে গিয়েছে। বলতে কি, শ্মশান জায়গাটা আমার কোনদিনই খুব একটা ভীতিকর বলে মনে হয় নি–বরং বেশ পবিত্র বলে মনে হত। কিন্তু সেদিন আমার কেমন যেন গায়ে কাটা দিতে লাগল। আজ এখানে যেন একটা খারাপ কিছু ঘটবে, একটা অমঙ্গলজনক কিছু দেখতে পাব।
শ্মশানবন্ধুদের জন্য একটা চালাঘর বাধা আছে। তার নিচে মৃতদেহ নামানো হল। ওসব দেশে দাহ করার কাঠ কিনতে পাওয়া যায় না। চৌধুরীবাড়ির চারজন চাকর মাথায় করে কাঠের বোঝা বয়ে আনছিল। ঘনরাম আর কৃষ্ণরাম তামাক খেতে লাগলেন। যতীন ঘোষাল দায়িত্ব নিয়ে কাজে লাগলেন—এই ছেলেরা! আর বসে কেন বাবা? চটপট একটা লম্বা গর্ত খুঁড়ে কাঠ সাজিয়ে ফেলো—ভালোয় ভালোয় কাজটা হয়ে গেলে বাচি! আর বিশ্রাম করতে হবে না, দেখছ না আকাশের অবস্থা?
নিঃশব্দে কাজ হতে লাগল। কেবল পুরুত ভবেশ ভট্টচাযের গুনগুন করে গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের পাঠ শোনা যাচ্ছে। আর হুঁকোর সুরসুর শব্দ।
আমরা ক’জন ক্লান্ত হয়ে চালাঘরের আড়ালে তামাক খেতে গিয়েছি—আমাদেরই বন্ধু হরেন, সে তামাক খায় না, এক চিতা সাজাচ্ছে। চালা থেকে বেশ কিছুটা দূরে চিতা সাজানো হয়েছে—যাতে বর্ষার জোরালো হাওয়ায় আগুনের ফুলকি উড়ে এসে না পড়ে। আমরা তামাক খেতে খেতে হঠাৎ শুনলাম হরেনের ভীত গলা—কে? কে রে ওখানে?
আমরা দৌড়ে গেলাম, চালার তলা থেকে ঘনরাম, কৃষ্ণরাম, যতীন ঘোষাল এরা সব বেরিয়ে এলেন। ঘনরাম তার স্বভাবসিদ্ধ ভারী গলায় হেকে বললেন, কি হয়েছে হরেন?
কয়েকটা লণ্ঠন মাত্র সম্বল। বিরাট প্রান্তরের অন্ধকার তাতে আর কতটুকু দূর হয়? লণ্ঠন উঁচু করে তুলে দেখলাম হরেন ফ্যাকাশে মুখে পাশের ঝোপ-ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, কি হয়েছে রে?
পাংশু মুখে হরেন বলল, ওই ঝোপের মধ্যে কে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্ট নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনলাম। আমি চেঁচিয়ে উঠতেই জলা ভেঙে ওইদিকে পালিয়ে গেল।
শুনেই আমাদের গ্রামের সাহসী ছেলে বলে খ্যাত ঈশ্বর বাগচী হইহই করে একটা লাঠি হাতে ঝোপটার ওপর বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। একটা ব্যাঙও বেরুল না সেখান থেকে।
আমরা বললাম, কোথায় কি রে?
হরেন সাহসী বলে খ্যাত না হলেও নিতান্ত ভীতু নয়। দেখলাম সে ঠকঠক করে কপিছে। সে বলল, না ভাই, তোমরা বললে তো হবে না, পায়ের শব্দ আর নিঃশ্বাসের আওয়াজ আমি স্পষ্ট শুনেছি। একেবারে গা ঘেঁষে ওই জল-জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।
যতীন ঘোষাল বললেন, আচ্ছা থাক্ থাক, এখন কাজ শুরু করে দাও। আর তোমরাও বাপু বিদঘুটে। অসময়ে তোমাদের ইয়ে চাগিয়ে উঠল। বন্ধুকে একলা ফেলে যাবার কি দরকার ছিল?
এত গোলমালেও একমাত্র ভবেশ ভট্টচার্য গীতাপাঠ থামান নি। শান্ত হয়ে বসে একই ভাবে গুনগুন করে পড়ে চলেছেন—ন জায়তে মিয়তে বা কদাচিৎ–
ঘনরাম এবং কৃষ্ণরাম পিতার যা যা শেষকৃত্য সব করলেন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।
যতীন ঘোষাল রামরাম চৌধুরীর কাছে বেশ কিছু টাকা ধারতেন। ছেলেদের সুনজরে থাকলে সেটা মাপ হয়ে যেতে পারে এই আশায় ক্রমাগত বলে চলেছেন, সেই থেকে বৃষ্টি আটকে আছে। হবে না কেন? কতবড় একটা পুণ্যবান মানুষ! তার শেষ কাজে কি ভগবান বাধা দিতে পারেন? আহা, গ্রাম একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। অমন মানুষ আর হবে না—
আবার সব চুপচাপ। নলখাগড়ার বনে একটা শেয়াল ডেকে উঠল। জোলো হাওয়ায় শীতশীত করছে। চৌধুরী ভাইদের ভুড়ক ভুড়ুক ইকোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আচমকা আমাদের সকলের বুকের রক্ত হিম করে দিয়ে একটু দূরে জলার মধ্যে থেকে একটা বিকট অট্টহাসির আওয়াজ জেগে উঠল। সে হাসির মধ্যে স্বাভাবিক মানুষী উল্লাস নেই-যেন কোন বদ্ধ উন্মাদ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখটির সন্ধান পেয়ে হাসি আর চেপে রাখতে পারছে না। নির্জন শ্মশানের শ্রাবণরাত্রির একাকীত্বকে ওই অপার্থিব হাসি যেন আরো প্রেতায়িত করে তুলল।
ভয়ে সবার মুখ পাংশু হয়ে গিয়েছে, কারো মুখে কোন কথা নেই। চিতা থেকে। কাঠের গাট ফাটার ফটফট আওয়াজ ভেসে আসছে।
ঘনরাম স্থিরবুদ্ধি লোক, সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি বললেন, এগিয়ে দেখ না কি ব্যাপার—ভয় কি? না-হয় আমিও যাচ্ছি। লণ্ঠন নাও—
ঈশ্বর বাগচী লজ্জা পেয়ে বলল, না, ভয়ের কি আছে? তবে রাত্তিরে অমন আওয়াজ শুনে-বুঝলেন কি না?
লণ্ঠন নিয়ে আমরা সবাই যেদিক থেকে হাসির শব্দ এসেছিল সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিছু পাওয়ার আশা ছিল না। কিন্তু জীবনে মাঝে মাঝে বেশ অভাবনীয় ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা এগিয়ে কাছাকাছি ঝোপগুলো লাঠি দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখা শুরু করতেই দলের বিনোদ বলে একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলে উঠল, এ কি! তুমি কে?
সবাই ছুটে গিয়ে দেখি সেখানে হাঁটুসমান জলকাদায় ঝোপের মধ্যে একটা পাগলাটে চেহারার লোক দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে জুলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখের মণিতে প্রতিফলিত হচ্ছে আগুনের শিখা। লোকটার রঙ কালো, গাল তোবড়ানো—গালে অনেকদিনের না-কামানো খোচা খোচা দাড়ি, শীর্ণ দেহ। খালিগায়ে কেবলমাত্র একটা অপোবাস পরে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দাহকাজ দেখছে। কোন সন্দেহ নেই যে এই লোকটাই হেসে উঠেছিল।
ঈশ্বর বাগচী বলল, এই, তুমি এখানে কি করছ?
লোকটা কোন জবাব দিল না।
ওধার থেকে কৃষ্ণরাম বললেন, আঃ! ও জঙ্গলে দাঁড়িয়ে কিসের কথা হচ্ছে? কে ওটা? টেনে এদিকে বার করে আনো না—
লোকটাকে হাত ধরে টেনে খোলা জায়গায় নিয়ে আসা হল। সে কোন কথা বলছে না।
হরেন বলল, এই লোকটাই তখন ঝোপের মধ্যে ছিল নিশ্চয়। ব্যাটা মহা পাজী। অত করে ডাকাডাকি করা হল, তা কোনো সাড়াশব্দ নেই–
যতীন ঘোষাল বললেন—পাগল বোধ হয়, চোখের দৃষ্টি দেখছ না?
লোকটা এতক্ষণ আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার চোখ ফিরিয়ে প্রথমে ঘনরাম ও পরে কৃষ্ণরামের দিকে তাকাল।
হঠাৎ ঘনরাম বললেন, আরে! তুমি শ্রীপদ না?
কৃষ্ণরামেরও ভ্রূ কুঁচকে গেল। সম্ভবত তিনিও চিনতে পেরেছেন।
শ্রীপদ ঘনরামের দিকে তাকিয়ে তর্জনী নির্দেশ করে বলল, চিতার আগুন থেকে ফুলকি উড়ে গিয়ে তোমার বাড়ির চালে পড়বে—আমি বলে দিলাম। বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবে না। চিতার আলো ছড়িয়ে পড়বে তোমাদের বংশে–
সেই জনহীন শ্মশানে জুলন্ত শবের সামনে দাঁড়িয়ে বলা শ্রীপদর কথাগুলো ভয়ানক গুরুত্ব নন। তিনি বললেন, যা ভাগ, পাগল কোথাকার! যতীন, তোমরা এটাকে ভাগাতে পারছ না?
যতীন ঘোষাল ইতস্তত করতে লাগলেন। কালো, রোগা শ্রীপদ চকচকে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা দেহধারী প্রেতের মত—কোমড়ে কেবল একটা ন্যাকড়া জড়ানো। তার গায়ে আগুনের আভা চমকে চমকে উঠছে। নিতান্ত অকিঞ্চন একটা উন্মাদ। কিন্তু যতীন ঘোষাল বোধ হয় ভাবছিলেন যে গতবছরও এই মানুষটা গ্রামের সম্পন্ন চাষীগৃহস্থ ছিল। রামরাম চৌধুরীর সঙ্গে দেওয়ানী মামলা লড়তে গিয়ে জমিজমা টাকা পয়সা সব গিয়েছে। সর্বস্বান্ত হবার পরও শ্রীপদর তেজ কমল না। শুধু ভিটেটুকু আর বিঘে দুই খাস জমি সম্বল করে লোকটা সমান দন্তে মাখা উঁচু করে বেড়াতে লাগল। রামরাম চৌধুরীর এটা একেবারেই ভালো লাগল না। যার পেছনে লাগা হয়েছে তাকে একেবারে মাটির সঙ্গে না মিশিয়ে দিতে পারলে আর সুখ কি? যে সব বিষয়ে হেরে গিয়েছে সে পায়ে ধরে না কাদলে আর জেতবার আরাম কোথায়? এর মধ্যে পথে একদিন রামরাম এবং শ্রীপদের বেদম ঝগড়া হয়ে গেল। শেষের দিকে শ্রীপদ বলেছিল—যান যান চৌধুরীমশায়, আমরা চাষের কাজ জানি—আরো চার বিঘে রায়বাবুদের কাছ থেকে পত্তনি নিয়ে নিলে ভাতে মরব না। আপনার যা করবার করে নিয়েছেন, আর আপনাকে ভয় পাই না। আপনার চালের নিচেও থাকি না— নিজের বাড়িতে বসে শাক ভাত খাই। আমার নিজের ঘরে আমিই কর্তা
রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের চেয়ে পদে খাটো কারো সঙ্গে বাড়াবাড়ি করা রামনামের স্বভাব নয়। সেদিনের মত ঘটনাটা ওইখানেই মিটে গেল।
সপ্তাহখানেক বাদে শ্রীপদর বাড়িতে আগুন লাগল। শ্রীপদ সে সময় হাটে গিয়েছিল। সে ফেরার আগেই এক ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ। হাট থেকে ফিরে শ্রীপদ দেখল, তার বৌ আর একমাত্র ছেলে দুর্গাপদ উঠোনের জামরুল গাছটার নিচে চুপ। করে বসে আছে। ছেলে কাদছে—বৌ পাথর। যেখানে তার বাড়ি ছিল, সেখানে কেবল কয়েকটা আধপোড়া খুঁটি দাঁড়িয়ে তখনও ধোঁয়াচ্ছে।
শ্রী পদ বৌয়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বেঁচেছে?
—না।
–খাটের তলায় টিনের তোরঙ্গে সেই যা রেখেছিলাম?
-জানি না। বোধ হয় গলে গিয়েছে।
–তারপর শ্রীপদর বৌ কেমন যেন চমকে উঠে সম্বিৎ ফিরে পাবার মত করে চারদিকে তাকাল—যেন সে এতক্ষণে টের পেল তার স্বামী এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। কোনো বিশেষ একদিকে না তাকিয়ে তার বৌ বিহ্বল গলায় বলল, কি আগুন! উঃ! হুস হুস করে জ্বলছে একেবারে।
শ্রীপদর বৌ পাগল হয়ে গেল। টিনের তোরঙ্গে তার সাধের কিছু সামান্য গয়না। রাখা ছিল—তার মত অবস্থার মানুষের এতেই যথেষ্ট শোক হতে পরে। তার ওপর চোখের সামনে সে নিজেদের বসতবাড়ি পুরো জ্বলে যেতে দেখেছে, সে ধাক্কা সামলানো কঠিন। শ্রীপদও থাকলে তার কি হত বলা যায় না। এর পরের কিছুদিন শ্রীপদর বৌ একদম কথা না বলে চুপ করে বসে থাকত, কখনো কখনো বলত—উঃ! বড় আগুন। হুস হুস করে জ্বলছে। তার বাপের বাড়ির লোকেরা তাকে আর তার ছেলেকে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। বাপের বাড়ি থেকে আর ভালো হয়ে ফেরে নি শ্রীপদর বৌ। কিছুদিন পরে খবর পাওয়া গেল সে স্নান করতে গিয়ে নদীতে ডুবে মরেছে।
শ্রীবৎস-চিন্তার গল্পটা একেবারে অলীক নয়, মানুষের দুঃসময় পড়লে ভাগ্যদেবতা তাকে অবনতির শেষ ধাপ অবধি না নিয়ে গিয়ে স্বস্তি পান না। বিপদ একবার ঘটতে শুরু করলে পর পর ঘটতে থাকে। বৌ মারা যাবার মাস দুই পরে শ্রীপদ খবর পেল কলেরার মড়কে পুরো মামার বাড়ির পরিবারের সঙ্গে তার ছেলেও মারা গিয়েছে। যে শ্রীপদ কয়েক মাস আগে একজন হাসিখুশি ফুর্তিবাজ মানুষ ছিল, দিনে চাষ ও রাতে সখের যাত্রাদলে গান গাইত, যে লোকটার গোয়ালে গরু, ক্ষেতে ধান ও বাড়িতে নম্র বৌ আর ফুলের মত শিশু ছিল—সে মানুষটা ভাগ্যের আশ্চর্য বিপর্যয়ে একটা মরা গাছের মত একেবারে শুকিয়ে গেল। তার বৌ এবং ছেলের মারা যাবার ব্যাপারে অবশ্যই রামরামের কোনো হাত ছিল না, থাকলেও পরোক্ষ কিন্তু মনে মনে শ্রীপদ ঠিক করল রামরাম চৌধুরীই সমস্ত কিছুর জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। শ্রীপদ আর উঠলও না, মাঠেও গেল না। কেমন খ্যাপা মত হয়ে গেল। সারাদিন নদীর ধারে বসে বিড়বিড় করে কি বলে, এর-ওর বাড়ি খেতে চায়। পাড়াগায়ে তখন ভাত জিনিসটার অভাব ছিল না। শ্রীপদকে সবাই ভালবাসত—খেতে দিত। ক্রমে তার জমি হাতছাড়া হয়ে গেল, হাল-গরু অন্য লোকে নিয়ে গেল। এখন শ্রীপদ গ্রামের একজন চিহ্নিত পাগল। সবাই দয়া করে, খেতেও দেয়—কিন্তু সময় যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার সম্বন্ধে গ্রামের লোকের বেদনার বোধ কমে গিয়েছে। এটাই নিয়ম। মানুষ এইরকমই।
ভোলে নি শ্রীপদ। আজকের ব্যাপারে সেটা বোঝা গেল। তার অব্যবস্থিত মনের অসংলগ্নতার মধ্যেও কোথাও এই হাহাকারের সুরটুকু অনবরত বেজে চলেছে।
হঠাৎ ঘনরামের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রক্ত গরম হয়ে উঠল। ভারী গলায় তিনি হেকে বললেন, সঙের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন যতীন? আমার পিতার পারত্রিক ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, তার সামনে এই পাগলটা যা-তা কথা বলছে—ছেলেদের বলো না ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে।
যতীন ঘনরামের বিরূপতা কোনো কারণেই অর্জন করতে চান না। তাছাড়া তিনি বোধ হয় ভাবলেন—এ লোকটা এখন পাগল, এককালে আলাপ ছিল বটে কিন্তু এখন আর ওর কোন জ্ঞানগম্য নেই। এখন ওকে ধাক্কা দিলে চক্ষুলজ্জায় বাধে না। যতীন ঘোষাল মুখে এই হই হট গোছের একটা শব্দ করে শ্রীপদর দিকে তেড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীপদ খবরদার’ বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, হঠাৎই দপ করে লাফিয়ে উঠল আগুনের শিখা। যতীন ঘোষাল থতমত খেয়ে থেমে গেলেন। শ্রীপদ ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ওরে বড়লোকের পা-চাটা কুত্তা! আমাকে আর তোরা কেউ ধরতে পারবি নে। তারপর ঘনরামের দিকে তাকিয়ে বলল, বাপ মরেছে তাই কি, এই তো সবে শুরু! তোর বংশ লোপ পাবে—
যতীন ঘোষাল সাহস সংগ্রহ করে আবার এগুনোর আগেই শ্রীপদ ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা নদীর দিকে দৌড়ে গেল, পাড়ের কাছে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়েই লাফিয়ে পড়ল জলে। বর্ষার খরস্রোতা নদী—কোথায় ভেসে গেল শ্রীপদ কে জানে! এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল ব্যাপারটা যে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার আগে কেউ বুঝতেই পারল না কি হয়েছে। ঈশ্বর বাগচী বলল, আরে! শ্রীপদদা তো সাতার জানত না, মরে যাবে যে!
কেউই অবশ্য এগুলো না শ্রীপদর কি হল দেখতে। যা স্রোত। যে সাতার জানে সে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই কোথায় ভেসে গেছে তার ঠিক কি? এছাড়া শ্রীপদর মত হতভাগ্য আর বেঁচে কি করবে—এমন ভাবনাও হয়ত কারো কারো মনে কাজ করে থাকবে।
ঘনরাম কেবল একবার বললেন-ন্যাকামো! সাঁতার জানে নিশ্চয়! নইলে আর ঝাঁপ দিতে সাহস হত না।
আর কোন বিভ্রাটের সৃষ্টি না হয়েই কাজ মিটে গেল। বৃষ্টি পড়ি-পড়ি করেও আটকে রইল। নদী থেকে মাটির কলসী করে জল এনে আমরা চিতা ভালো করে নিভিয়ে দিলাম। ভবেশ ভট্টচার্য জল ঢালার সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগলেন, ঠাণ্ডা হোন চৌধুরীমশাই, ঠাণ্ডা হোন। পেছন ফিরে মাটির কলসীতে শাবলের বাড়ি মেরে ভেঙে দিলেন ঘনরাম। এবার ফেরা। কলসী ভাঙার পর আর পেছনে তাকাতে নেই।
গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করার সময়েই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। গ্রামের লোক, আমরা কেউই ভিজতে ভয় পাই না। ঘনরাম আর কৃষ্ণরামের জন্য দুটো ছাতা এসেছিল, ভবেশ পুরুতও তার তলায় ঢুকে গেলেন। আমরা ভিজতে ভিজতে চললাম। এবার আর লণ্ঠন জ্বলছে না জলের জন্য। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে পথ দেখে নিচ্ছি। জনপ্রাণী নেই কোথাও। শেয়ালগুলোও বোধ হয় ভেজবার ভয়ে গর্তে ঢুকে বসে আছে।
অনেকটা চলে এসেছি, প্রায় আধ মাইল, হঠাৎ যতীন ঘোষাল যেন কেমন ভয়ার্ত গলায় বললেন, ও কি? কি হল ওখানে?
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, এই ভয়ানক বৃষ্টির মধ্যেও রামরাম চৌধুরীর নিভিয়ে দেওয়া চিতা আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
আমাদের মাথার ওপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, আমরা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে হা করে দেখছি ওই অলৌকিক দৃশ্য। যেভাবে আমরা আগুন নিভিয়ে দিয়ে এসেছি তাতে তা আর জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। আর এই প্রবল বর্ষণের ভেতর আগুন জ্বলছেই বা কি উপায়ে?
আমাদের গা বেয়ে জল পড়ছে। এত ভিজে গিয়েছি যে শুকোতে এক হস্তা লাগবে মনে হচ্ছে। কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম জানি না, একসময় ভবেশ ভট্টচার্য বললেন—কৃষ্ণরাম, চল। এ সময় পথে দেরি করতে নেই। ঈশ্বরের নাম নাও—ঈশ্বর পরমকারুণিক।
চৌধুরীবাড়ি পৌঁছে সবাই নিমপাতা দাঁতে কেটে লোহা ছুঁয়ে শুদ্ধ হলাম। এতরাতে এই বৃষ্টিতে আর কেউ বাড়ি গেল না, চৌধুরীদের বৈঠকখানায় বসে নানা গল্প হতে লাগল। ভেতরবাড়ি থেকে শ্মশানবন্ধুদের জন্য গৃহিণীরা আলাদা আলাদা কাসার জামবাটিতে ঘন দুধ, মর্তমান কলা, আখের গুড় আর চিড়ে পাঠিয়ে দিলেন ফলার করবার জন্য। ঘনরাম কিছু পরে বৈঠকখানায় এসে বসলেন। তার মুখ গম্ভীর। যতীন ঘোষাল কয়েকবার সময়োচিত কি সব কথা বলতে গিয়ে তেমন সাড়া না পেয়ে দমে গিয়েছেন। ঘনরাম কেবল মাঝে মাঝে বলছেন, বাবার চিতা ফের জ্বলে উঠল কেন পণ্ডিতমশাই? কিছু বলতে পারেন? ভবেশ ভট্টাচার্য উত্তর দিচ্ছেন, ঈশ্বরকে ডাকো। কোনো প্রশ্ন করো না, তাকে বিশ্বাস করো—
কিছুদিন কেটে গেল। দুই ভাই বিষয়সম্পত্তির কাজ নিজেদের হাতে নিয়েছেন। দুজনে খুব ভাব, সম্পত্তি ভাগ করার প্রশ্ন ওঠে নি। তাছাড়া ঘনরাম অপুত্রক, তার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই তার অংশ কৃষ্ণরামের ওপর বর্তাবে। কৃষ্ণরামের একটিমাত্র ছেলে—শিবরাম। সে বর্তমানে কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ে। পিতার মৃত্যুদিনের ঘটনা আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যাচ্ছে।
এ কাহিনীর কিছু কিছু ঘটনা পরে আমি লোকের মুখে শুনেছি, কারণ চৌধুরী বাড়ির ভেতরে কি ঘটছে তা বাইরে থেকে আমার জানা সম্ভব নয়। তবে একটা কথা। ভুলে যাবার আগেই এখানে বলে রাখি, রামরামের মৃত্যুর দুদিন পরে গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে নদীর উজানে হবিবপুরের বাঁকে শ্রীপদর মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল।
একদিন সন্ধ্যেবেলায়, তখন কাছারির আমলাদের ছুটি হয়ে গিয়েছে—ঘনরাম নিচে রয়েছেন, কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে এখনই ওপরে আসবেন। কৃষ্ণরাম দোতলার বারান্দায় কুশাসন পেতে আহিকের উদ্যোগ করছেন, হঠাৎ নিচে থেকে দাদার ক্রুদ্ধ গলা শুনতে পেলেন। ঘনরাম যেন রেগে গিয়ে কাকে বলছে—না! না! যাও—
তখনো আহ্নিক শুরু করেন নি, একটু অবাক হয়ে পায়ে পায়ে নিচে নেমে এলেন কৃষ্ণরাম। দেখলেন একতলার টানা বারান্দায় একটা মোটা থামের পাশে অন্ধকারের মধ্যে ঘনরাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার মুখ পাংশু। আশেপাশে আর কেউ নেই। বিকেল পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটায় কাছারি শেষ হবার পর এই সা চারকবাকরদেরও একটু ছুটি থাকে। তারা বাগানের শেষে নিজেদের ঘরে বসে হয়ত তামাক খাচ্ছে। তাহলে কাকে বকছিলেন ঘনরাম?
—কি হয়েছে দাদা?
ঘনরাম প্রথমে কোনো উত্তর দিলেন না। কৃষ্ণরাম বললেন, চল, ওপরে চল–
দাদার হাত ধরে ওপরে আনবার সময় কৃষ্ণরাম লক্ষ্য করলেন দাদার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ঘরে এনে দাদাকে বসিয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, কি ব্যাপার? চেঁচালে কেন?
নিতান্ত সংকটেও ঘনরাম নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, শ্রীপদকে দেখলাম।
আশ্চর্য হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, শ্রীপদ সে কি কথা? কোথায়?
–-কাছারি শেষ করে ওপরে আসছি, একতলার বারান্দায় উঠতেই একটা থামের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। সেই চেহারা, বুঝলি? সেদিন যেমন দেখেছিলাম—
-কিন্তু তা কি করে হবে দাদা? আমাদের সামনেই তো—পরে দেহও ভেসে উঠেছিল, সে খবর তো জানো? তুমি আলো-আঁধারিতে ভুল দেখেছ—
ঘনরাম দৃঢ় গলায় বললেন, না, আমি ঠিকই দেখেছি। শ্রীপদ আমার সঙ্গে কথাও বলল।
—কথা বলল? কি রকম?
–সেদিনের মত আঙুল তুলে আমাকে বলল, চৌধুরমশাই, মনে আছে তো?
কৃষ্ণরামের গা ছমছম করে উঠল। ঘনরাম বললেন, কেষ্ট, তুই কলকাতা থেকে শিবুকে আনিয়ে নে কিছুদিন বাড়িতে রাখ। লোকের আশীর্বাদ ফলে না, কিন্তু অভিশাপ ফলে যায়। বাড়ির ছেলে বাড়িতে এসে থাকুক–
বাবার জরুরি তার পেয়ে শিবরাম বাড়ি এল। সে আধুনিক ছেলে, এসব কুসংস্কারে তার বিশ্বাস নেই। তবু বাবা-জ্যাঠার সঙ্গে তর্ক করে মাসখানেক দেশের বাড়িতে রয়ে গেল।
আঘাতটা এল অন্য দিক দিয়ে।
শিবরাম বাড়ি আসার সাত-আটদিন পর চৌধুরীবাড়িতে আগুন লাগল। মুল বাড়ি পাকা, আগুনের আঁচে কিছু ক্ষতি হলেও বড় রকমের বিপর্যয় কিছু হল না। কিন্তু উঠোনের দশ-বারোটা ধানের গোলা পুড়ে একদম ছাই হয়ে গেল। সব মিলিয়ে প্রায় চারশে মণ ধান। পাড়াগাঁয়ে দমকল থাকে না, আগুন দেখে আমরা দৌড়ে গেলাম, সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়ল। পেছনের দীঘি থেকে বালতি বালতি জল নিয়ে ছুড়ে দেওয়া হতে লাগল অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে কিন্তু আগুন ততক্ষণে বেশ ভালরকম ধরে উঠেছে, দু-এক বালতি জলে কিছু হবার নয়। লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়ে আমরা জলের বালতি হাতে হাতে আগুনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলাম। আমার পাশে ছিল হরেন, সে বলল—একটা ব্যাপার কিন্তু অদ্ভুত, বুঝলি?
বললাম, কি?
—সবগুলো গোলায় একসঙ্গে আগুন ধরলো কিভাবে? একেবারে গায়ে গায়ে তো দাঁড়িয়ে নেই। আশ্চর্য। এ যেন মনে হচ্ছে কেউ নুড়ো হাতে সবগুলোতে আগুন দিয়ে বেড়িয়েছে। হ্যারে তারানাথ, চাকরগুলোর ভেতর কেউ করেনি তো?
—যাঃ, তা কেন করবে?
—কোন কারণে হয়ত মালিকের ওপর রাগ আছে।
—না রে। এরা সবাই পুরনো আর বিশ্বাসী লোক। দেখছিস না মালিকের এতবড় ক্ষতি হয়ে গেল বলে সবাই সার দিয়ে বসে কাঁদছে। এরা কেউ নয়—
—তা হলে?
—জানি না।
ধন্য ঘনরামের স্থৈর্য চুপ করে দাঁড়িয়ে তিনি আগুনের বিধ্বংসী কাণ্ড দেখলেন। তার মুখ দেখে এমন কি যতীন ঘোষালও কোনো সমবেদনার কথা বলতে সাহস করল না।
আগুন যখন প্রায় নিভে এসেছে, ঘনরাম ভৃত্যদের মধ্যে কাউকে হাক দিয়ে। বললেন, এই, কে আছিস; বাড়ি থেকে গোটাকতক সুপুরি নিয়ে আয় তো—
যতীন ঘোষাল ভয়ে ভয়ে বললেন, সুপুরি কি হবে চৌধুরমশাই?
ঘনরাম উত্তর দিলেন না।
কে একজন কাগজের ঠোঙায় সুপুরি নিয়ে এল। ঠোঙা হাতে ঘনরাম ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক নিভে আসা অগ্নিকুণ্ডে দু-একখানা করে সুপুরি ছুড়ে দিতে লাগলেন। কৃষ্ণরাম এগিয়ে এসে ভীত গলায় বললেন, এসব কি হচ্ছে দাদা?
ঘনরাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসলেন। বললেন, আগুনকে দিচ্ছি। সবই তো খেলো, এবার একটু মুখশুদ্ধি করুক—
কৃষ্ণরাম হাত ধরে দাদাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এরপর ঘনরাম জেদ ধরলেন শিবরামের বিয়ে দেবেন। দাদার জেদ দেখে বিপন্ন হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, কিন্তু দাদা, শিবু এখনো পড়ছে। এ সময়ে বিয়ে দিলে ওর পড়াশুনো আর হবে না—
ঘনরাম ভাইয়ের আপত্তিতে কান দিলেন না। বললেন, বোকামি করিস না কেষ্ট। বুঝে দেখ, আমাদের বংশের বৃদ্ধি নেই একদম! ওই শিবুই যা কিছু তোর-আমার ভালোমন্দ কিছু হলে শিবু ভেসে যাবে। ওকে তাড়াতাড়ি সংসারী করে দেওয়াই ভাল।
শিবরামের বিয়ে হয়ে গেল।
এর বছরখানেক পরে এক জ্যোৎস্নারাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে পান মুখে দিয়ে শুতে এসে একবার জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন ঘনরাম। পিক ফেলবার জন্য জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘনরাম দেখলেন বাগানে নতুন লাগানো কলমের আমগাছটার নিচে চাদের আলোয় ক্ষুধিত দৃষ্টি নিয়ে শ্রীপদ দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে শ্রীপদ বলল, মনে আছে তো? তার ডাকে কমলা ছুটে এলেন।–কি হয়েছে গো?
–দেখ দেখি বাগানে আমগাছের তলায় ও কে দাঁড়িয়ে?
কমলা তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গেলেন–কই, কেউ নেই তো?
ঘনরাম বিহুল গলায় বললেন, নেই? তাহলে কোথায় গেল?
—কে?
—যে দাঁড়িয়েছিল ওইখানে?
ভীত কমলা স্বামীকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সেদিন ছিল শুক্লা ত্রয়োদশী। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে ঘনরাম মারা গেলেন। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়েস হয়েছিল তার।
কৃষ্ণরাম ভয় পেলেন কিনা জানি না, কিন্তু কেমন যেন উদাস মত হয়ে গেলেন।
সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। বছর দুই পরে একটি ছেলে হল শিবরামের। এই সময়টা আমি গ্রামে ছিলাম না, সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গ করে বেড়াচ্ছিলাম শ্মশানে-মশানে! এই সময়ে বীরভূমের এক শ্মশানে মাতু পাগলীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়—সে গল্প তো তোমরা জানো!
ঘনরাম মারা যাবার পর বছর দশেক আর কোনো ঘটনা ঘটল না চৌধুরী বাড়িতে। বাড়ির এবং গ্রামের লোকেরাও আগের সমস্ত ঘটনাকে নেহাত সমাপতন বলে মেনে নিল।
কৃষ্ণরামের বয়েস এখন ষাট। একদিন দুপুরে বসে তিনি কি সব কাগজপত্র দেখছেন, বেলা আড়াইটে-তিনটে, বা বা করছে চৈত্রমাসের দুপুর—তার আট বছরের নাতি বলরাম এসে বলল, দাদামশাই, একটা লোক আপনাকে খুঁজছিল—
কৃষ্ণরাম বললেন, কে রে? কোথায়?
–বাইরে। আপনার নাম করে বলছিল—
কৃষ্ণরাম একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, যা, এখানে নিয়ে আর তোর মামার বাড়ির কেউ না তো
—নাঃ, তাদের সবাইকে আমি চিনি। এ লোকটা ভিখিরিমতন, নোংরাপানা—
কৃষ্ণরাম রীতিমত অবাক হয়ে বললেন, ভিখিরি এসে নাম ধরে আমার খোজ করছিল?
—হ্যাঁ। কালোমত লোকটা, খালি গা। চোখদুটো দেখলে ভয় করে দাদামশাই! আমাকে দেখে একটা আঙুল তুলে লোকটা বলল—কৃষ্ণরামকে গিয়ে বোলো, তার মনে আছে তো? ও হ্যাঁ, লোকটা নিজের নাম বলল শ্রীপদ, শ্রীপদকে মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বলল। কে লোকটা দাদু?
বিবর্ণমুখে কাজ ফেলে নাতিকে কোলে নিয়ে ভেতরবাড়িতে উঠে গেলেন কৃষ্ণরাম।
এক মাসের মধ্যে সন্ন্যাসরোগে কৃষ্ণরাম গত হলেন।
দেশের জমিজমা ভাগচাষীদের দিয়ে ছেলে-বৌ আর মাকে নিয়ে শিবরাম কলকাতায় চলে গেল। সেখানে সে বড় চাকরি করে। আধুনিক ছেলে, চাষবাসে বা বিষয়কর্মে তার তেমন উৎসাহ নেই। কমলাও সঙ্গে গেলেন।
এ কাহিনী বলতে আমার ভালো লাগছে না। রামরামের মৃত্যুর পর থেকে সবটাই মরে যাবার, উড়ে-পুড়ে যাবার ইতিহাস। যতই দোষ থাক, কিছু মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে—এ দেখতে বা ভাবতে ভালো লাগে না। তবু শুরু যখন করেছি, শেষ অবধি বলি।
কৃষ্ণরাম সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করার পর বছরদশেক সব শান্ত। গল্প বলার সময় দশ বছর কথাটা এক নিঃশ্বাসে বলা গেলেও দশ বছর কাটতে ঠিক দশ বছরই লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে পারিবারিক অভিশাপের স্মৃতিটা আবছা হয়ে এল। মানুষ দুঃখের স্মৃতি ভোলবারই চেষ্টা করে, বা একটা অবচেতন প্রচেষ্টা সব সময়েই থাকে— তার সঙ্গে কালের ব্যবধান মিলে চৌধুরী পরিবার থেকে কালো ছায়াটা একেবারে মুছে গেল।
এখন বলরামের বয়েস ষোলো, শিবরামের বয়েস বছর চল্লিশ। কলকাতায় যে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে শিবরাম ছিল, তার তিনদিকে ঘর মাঝখানে উঠোন। উঠোনে চৌবাচ্চা। স্নান করা, বাসনমাজ বা কাপড়কাচা ইত্যাদি উঠোনেই সারা হয়। উঠোন থেকে রোয়াকে ওঠবার সিড়িতে বড় উঁচু উঁচু ধাপ। কমলা আর নিরুপমার (কৃষ্ণরামের স্ত্রী) বয়েস অনেক হল, অত উঁচু ধাপ ভেঙে বারান্দায় উঠতে কষ্ট হয়! শিবরাম জনাতিনেক মিস্ত্রি ডাকিয়ে পুরনো সিড়ির দু-দিক দিয়ে নতুন করে কয়েকটা ধাপ গাথাবার ব্যবস্থা করল। সেদিন তার অফিসে জরুরি কাজ আছে, না গেলেই নয়। অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে শিবরাম দেখল গাথনির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। বলরাম বলল, তোমার আজ ফিরতে দেরি হল বাবা?
-হ্যাঁ, কাজের চাপ ছিল। মিস্ত্রিরা গেল কোথায়?
–কাজ শেষ করে জলখাবার খেতে গিয়েছে। আমি বলে দিয়েছি তুমি এলে আসতে—
—বেশ করেছিস। তুই ওপরে গিয়ে একটা লণ্ঠন নিয়ে আয় দিকি, হাত-মুখটা একেবারে ধুয়েই নি–
বলরাম ওপরে যেতেই মিস্ত্রিদের একজন এসে দাঁড়াল উঠোনে। শিবরাম বারান্দা থেকে বলল, কত মজুরী দেব হে? একটা দর ঠিক করে দাও–
খালি-গা লোকটা, কোমরের কাছে যেমন-তেমন করে একটা কাপড় জড়ানো, জুলজুলে দুই চোখ তুলে বলল, আমাকে মনে আছে তো? মনে করিয়ে দিতে এলাম—
শিবরামের ভয়ার্ত চিৎকারে বলরাম দৌড়ে নেমে এল লণ্ঠন হাতে। কি হয়েছে বাবা? কি হয়েছে?
শিবরাম ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকিয়ে বলল, একেবারে চোখের সামনে উবে গেল লোকটা—এ কি!
—কে উবে গেল? কে এসেছিল?
কমলা আর নিরুপমাও পেছন পেছন নেমে এসেছিলেন, তারা এই পরিবারের এই লক্ষণ বহুদিন থেকে দেখছেন। নিরুপমা কেঁদে উঠে শিবরামকে জড়িয়ে ধরলেন, কমলা দুর্গানাম জপ করে সারাগায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সবাই ধরে বিহুল শিবরামকে দোতলায় নিয়ে গেল।
খানিক পরে মিস্ত্রিরা এলে বলরাম নিচে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মধ্যে কেউ কি একটু আগে এসেছিল?
তারা অবাক হয়ে বলল, না তো, আমরা তো এই চা-বিস্কুট খেয়ে এলাম! কেন। বাবু?
—না, কিছু না!
ভয়ে ভয়ে কিছুদিন যাবার পর বোঝা গেল শিবরামের প্রাণের আশঙ্কা বোধ হয় নেই। তার থেকেও বড় ক্ষতি এবার হয়ে গিয়েছে।
শিবরাম আজকাল চুপচাপ বসে থাকে, অফিস যেতে চায় না। মাঝে মাঝে কেবল বলে ওঠে, তাহলে আর বাকি রইল কি? জলজান্ত মানুষই যদি উবে যেতে পারে, তাহলে আর কি বাকি রইল?
অদ্ভুত এক বাতিক গড়ে উঠল তার—সবকিছু ঢাকা দেবার বাতিক। টাকা পয়সা, জুতো, খাবারদাবার—সব ঢাকা দিয়ে বেড়ায় সারাদিন। বলরাম গিয়ে বাবার হাত ধরে, ছিঃ, ওদিকে চল তো! কি হচ্ছে কি?
শিবরাম ব্যস্ত হয়ে বলে, আরে দাঁড়া দাঁড়া , এটুকু ঢেকে দিয়ে যাই-আজকাল সবকিছু কপূরের মত উবে যাচ্ছে।
মাঝরাত্রে স্ত্রীর গায়ে লেপ নামিয়ে এনে চাপা দেবার চেষ্টা করে। স্ত্রী ভয় পেয়ে বলে, করছ কি?
—লেপটা নিয়ে এলাম তাক থেকে নামিয়ে। যা দিনকাল পড়েছে, চাপা দিয়ে শোও–কে কখন উবে যায় ঠিক কি?
তারপর সস্নেহে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি না হলে আমার চলে না যে চাপাচুপি দিয়ে থাকো। আমি দেখে আসি খোকার গায়ে ঢাকা আছে কি না—
স্ত্রীর চোখে জল আসে। হাত ধরে স্বামীকে জোর করে বসায়, বোসো দেখি, এই গরমে আর বলুর গায়ে লেপ দিতে হবে না—
-গরম তাই কি, ছেলে যদি উপে যায়?
বাতিক বাড়তে লাগল। প্রথমে তবু কথা বলত শিবরাম, তারপর ক্রমে কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে এল। একদিন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু সবকিছু ঢাকা দিয়ে বেড়াবার বাতিক।
দেহ ফেলে রেখে শিবরামের চেতনা পূর্বপুরুষের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে কোথায় গেল কে জানে!
এ অবস্থায় আর কলকাতায় থাকা চলে না। শিবরাম আর উপার্জন করে না, কলকাতার খরচ চালাবে কে? দেশে যা জমি আছে তার আয়ে চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু মালিক অনুপস্থিত থাকলে কে আর তার প্রাপ্য দিতে ব্যস্ত হয়? কাজেই মায়েছেলেতে-ঠাকুমাতে মিলে পরামর্শ করে চৌধুরীপরিবার বেশ অনেক বছর পরে আবার গ্রামে ফিরে এল। বলরামের বি. এ. পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, এখন একটু বিষয়কৰ্ম দেখলে ক্ষতি কি?
এই সময়েই এই ঘটনার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। আমার বয়েস তখন বছর পয়তাল্লিশ। মাঝে মাঝে গ্রামে আসি, আবার উধাও হয়ে যাই। দাড়িগোফ রেখেছি—তন্ত্রমতের সাধক বলে বেশ একটু খাতিরও হয়েছে। একবার বলরাম আমাকে ডেকে বলল, কাকাবাবু, আমাদের পারিবারিক দুর্ভাগ্যের কথা তো সবই জানেন, এর কোনো বিহিত হয় না?
বললাম, কি বিহিতের কথা বলছ?
–-দেখুন, আমি কলকাতায় পিয়ার্সন সাহেবের ছাত্র ছিলাম, আজগুবী ব্যাপারে বিশ্বাস করতে মন চায় না। কিন্তু ঠাকুর্দা মারা যাবার সময় আমার নিজেরই অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আমিই ঠাকুর্দাকে বলেছিলাম শ্রীপদের কথা। তারপর বাবার এই অবস্থা—সবটাই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিতে পারছি কই? আমার মাঠাকুমা-জেঠমার কথা ভাবুন তো? এই অভিশাপ কি কাটানো যায় না?
একটু ভেবে বললাম, অলৌকিক উপদ্রব দূর করবার জন্য একটা বিশেষ হোম করা যায়। তুমি ইংরেজী-পড়া ছেলে, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, যদি ওই হোম আমি শেষ করতে পারি তাহলে হয়ত তোমাদের বিপদ চিরদিনের জন্য কেটে যাবে। বলরাম আমার কথার সুরে একটু অবাক হয়ে বলল, কেন, শেষ করতে পারার অসুবিধে কি?
—সে তোমাকে এখন বলব না। তুমি কি চাও আমি ওই হোম করি?
—নিশ্চয়। সবার মঙ্গল হবার যদি কিছুমাত্র সম্ভাবনাও থাকে তাহলে আমার বিশ্বাসের জন্য আমি তাতে বাধা দেব না—
–ঠিক আছে। এ মাসের শেষ অমাবস্যার রাত্তিরে আমি হোম করব। তুমি ব্যবস্থা কর। আমি ফর্দ দিয়ে দিচ্ছি, যোগাড় করে ফেল। কিছু জিনিস লাগবে যা তুমি যোগাড় করে উঠতে পারবে না। সেগুলো আমিই নিয়ে যাব এখন। রাত দশটায় পুজোয় বসব, বারোটা থেকে হোম শুরু হবে। কিন্তু আমার একজন সঙ্গী চাই যে—
বলরাম বলল, কাকে চাই বলুন?
–তোমাদের কুলপুরোহিত ছিলেন ভবেশ ভটচায, তাঁর ছেলে নরেশ তো পুজোআচ্চা করে। তাকে বলে রেখো–
—বেশ তাই হবে। নির্দিষ্ট দিনে চৌধুরীবাড়ি পৌঁছে দেখি আয়োজন সব সম্পূর্ণ। বাড়ির সামনে বিরাট উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে হোমের জায়গা করা হয়েছে। কুশাসন, সমিধ ও অন্যান্য জিনিস রাখা হয়েছে। তার একদিকে বিষণ্ণমুখে নরেশ ভট্টাচার্য বসে। আমি গিয়ে নরকপাল, হাড়ের মালা আর ফলসুদ্ধ কুচগাছের ডাল নামিয়ে রাখছি দেখে সে কাতর হয়ে বলল, চক্কত্তিমশাই, আমি কি পারব? আমি তো ইয়ে, মানে আপনাদের মতের হোম কিছু জানি নে—বললামও বলরামকে, তবু আমাকে জোর করে নিয়ে এল—
হেসে বললাম, কিছু ভয় নেই ভট্টচামশাই, আপনাকে কিছু করতে হবে না— কেবল মাঝে মাঝে এটা-ওটা একটু হাতে এগিয়ে দেবেন। বড় হোম আর পুজো একহাতে করা যায় না।
বলরামকে ডেকে বললাম, হোম আরম্ভ করার পরে বাড়িতে নানারকম উপদ্রব আর উৎপাত হতে পারে। ভয় পেয়ো না। স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে ঈশ্বরের নাম করবে। বিরুদ্ধশক্তি চেষ্টা করবে যাতে আমি হোম শেষ না করতে পারি।
পুজো শুরু করে সবে দেহবন্ধন আর আসনশুদ্ধি করেছি, বাড়ির ছাতে দড়াম করে বিকট এক আওয়াজ হল। বলরাম দৌড়ে দেখতে গেল কি ব্যাপার। ফিরে এসে বলল, কি আশ্চর্য। একটা থানইট এসে পড়েছে কোথা থেকে। বাড়ির ছাদে ছুড়ে থানইট পাঠানো কি সোজা কথা!
আমি ততক্ষণে ঘটস্থাপন করে মঙ্গলভৈরবের ধ্যান শুরু করেছি। ভৈরবকে সামান্যার্ঘ দেবার সময় বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বিরাট চটকাগাছ থেকে অসংখ্য কাক জেগে উঠে কা-কা শব্দে চারদিকে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। ব্যাপারটা শুনতে সামান্য লাগছে—কিন্তু যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝতে পারবে না রাত এগারোটার সময় হাজারখানেক কাক মাথার ওপরে উড়লে কেমন লাগে। সেই অমাবস্যার নিকষ-কালো অন্ধকার উড়ন্ত কাকেদের অপার্থিব ডাকে খান খান হয়ে যেতে লাগল। এসব অশুভ ইঙ্গিত দেখে বাড়ির মেয়েরা একতলার বারান্দায় বসে কাদছেন। আমার মন বারে বারে পুজো থেকে সরে যাচ্ছে, বীজমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে অভিনিবিষ্ট হবার চেষ্টা করছি।
পুজো শেষ হয়ে আসছে, এবার ভৈরবের আরতি করবো, তারপর হোম হবে। প্রথমে দীপ এবং পরে ধূপ-ধুনোর আরতি। নরকপালে শবের আচ্ছাদন থেকে আহত বস্ত্রের সলতে পাকিয়ে তেল দিয়ে দীপ জ্বালালাম। নরেশ ভট্টাচার্য গাব-ফলের মত চোখ করে পুজোর প্রক্রিয়া দেখছিল, তাকে বললাম, ধুনুচি জ্বালান, এবার ধুনোর আরতি করব।
দীপের আরতি চলছে, নারকেলের ছোবড়ার আগুন করে তাতে অনেকখানি ধুনো ছড়িয়ে দিতেই গলগল করে ধোঁয়া উঠতে লাগল।
এবং আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল নরেশ ভট্টাচার্য।
ধুনোর পবিত্র, মিষ্টি গন্ধের বদলে বিষম পূতিগন্ধে বাতাস ভরে গিয়েছে।
যারা নরেশ ভট্টচাযের আর্তনাদ শুনে ব্যাপার কি দেখবার জন্য এগিয়ে আসছিল তারা নাকে কাপড় দিয়ে পিছিয়ে গেল। বিদ্যুৎবেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল মড়াপচা দুর্গন্ধ!
মহিলারা চিৎকার করে কাঁদছেন, নরেশ আচ্ছন্নের মত এলিয়ে আছে একদিকে, দোতলার বারান্দা থেকে আকুল হয়ে চেচাচ্ছেন শিবরাম, ঢাকা দিয়ে দে। ঢাকা দিয়ে দে!
দীপ নামিয়ে ভৈরবের ধ্যান করে একটি রক্তজবা ছুড়ে দিলাম ধুনুচিতে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট গন্ধ মিলিয়ে গিয়ে ধুনোর নিজস্ব গন্ধ ফুটে উঠল বাতাসে। আস্তে আস্তে হল না, কেউ যেন জাদুবলে এক মুহূর্তে সব জায়গায় একই সঙ্গে গন্ধটাকে বদলে দিল।
বলরাম পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দেখে মনে হয় তার অবিশ্বাস কেটে এসেছে। আমার তখন কেবল এক চিন্তা—হোম শেষ হবে তো?
পুজো শেষ করে হোমের বেদীতে বালির ওপর যোগিনীমণ্ডল আঁকলাম। হাড়ের মালা গলায় দিয়ে বসে শুরু করলাম হোম।
বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে আহুতি দিয়ে চলেছি, নরেশ বসে সমিধ এগিয়ে দিচ্ছে— হঠাৎ দেখলাম আগুনের তেজ যেন কমে আসছে। শুকনো বেলকাঠ জ্বলছে, অনেকখানি করে ঘি একএকবারে আহুতি দিচ্ছি—আগুন নিভে আসার তো কোন। কারণ নেই!
নরেশ ভাল করে কি দেখবার ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, আরে। এ আবার কি? দেখুন দেখুন!
তাকিয়ে দেখি হোমের বেদীর শুকনো বালি ভিজে উঠেছে, যেন তাতে বেশ খানিকটা জল ঢেলে দিয়েছে কেউ কি করে তা হবে? বিঘৎপ্রমাণ উঁচু মাটির বেদী করে তার ওপর পুরু করে বালি বিছিয়ে হোমের জায়গা হয়েছে—কাজেই স্যাতসেতে জমি ভিজে গিয়ে জল উঠবে তাও সম্ভব নয়। এ যেন মনে হচ্ছে মাটির তলা থেকে জল উঠছে। কেউ যেন তলা থেকে পিচকিরি করে জল দিয়ে ভেজাচ্ছে বালি।
এই শুরু। আমি বুঝতে পেরেছিলাম হোম শেষ করতে পারব না। বলরামের জন্য মায়া হচ্ছিল। সে বেচারা এখনো আমার ওপর নির্ভর করে তাকিয়ে রয়েছে।
এর পর মাটির তলা থেকে যজ্ঞবেদীর নিচে হুড়হুড় করে জল উঠতে লাগল। যেন কোন ঝরনার উৎসমুখে পুজোয় বসেছি। আমার আসন ভিজে গিয়ে জল গড়াতে লাগল। শেষদিকে যেন হঠাৎ একটা জলের ঢেউ তলা থেকে উঠে বালি, সমিধ সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল—আগুন গেল নিভে।
তারানাথ থামল।
কিশোরী আর আমি একসঙ্গে বললাম, তারপর?
বিষণ্ণ হেসে তারানাথ বলল, তারপর আর কি? আমার জয়ের গল্প তো অনেক শুনেছ, এটা আমার ব্যর্থতার গল্প।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চৌধুরী পরিবারের কি হল?
তারানাথ খুব মৃদু গলায় বলল, এখন সত্যিই তাদের বংশে বাতি দিতে কেউ নেই।
আমরা দুজন চুপ মেরে রইলাম।
তারানাথ বলল, কি, শেষটা পছন্দ হল না, কেমন? ভাবে তো, জিতটা তো পীড়িতজনেরই হল। চৌধুরীপরিবার বেঁচে গেলে সেটা ঈশ্বরের ন্যায় বিচার হত কি? পৃথিবীর আদালতে এই মানুষগুলো বিচার পায় না, বড় আদালতে যে এখনো সুবিচার হয়, তা তো প্রমাণিত হল।
একটু থেমে বলল, অবশ্য অনেকগুলো মানুষ—যারা শ্রীপদর ভাগ্যবিপর্যয়ের ব্যাপারে সরাসরি জরিত ছিল না–তারাও কষ্ট পেল। তা সে আর কি করা যাবে, এসব নিয়তির অখণ্ড বিধান।
আমরা উঠে আসছি, তারানাথ বলল, হিন্দু বিধবা সহজে পরিত্রাণ পায় না। কমলা আর নিরুপমা অতিবৃদ্ধ হয়ে এখনও বেঁচে আছেন। থাকেন কাশীতে সম্বল খুব সামান্যই, কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।