Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভবানী ভবনের অফিস

দ্বিতীয় পর্ব

২.১

ভবানী ভবনের অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন কবির সাহেব, একজন আর্দালি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, স্যার, আপনার একটা ফোন আছে।

বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন কবির সাহেব। এখন সোয়া ছটা বাজে। এই সময় ফোন এলেই বা তাকে ডাকতে হবে কেন? ছুটির পর বাড়ি যেতেও পারবেন না?

আর্দালিকে বকুনি দিলেন না কবির, তিনি জানেন, ইদ্রিশ নির্বোধ নয়, খুব জরুরি ফোন। না এলে সে এমন ভাবে ডাকতে আসবে না।

তিনি জিগ্যেস করলেন, কার ফোন?

ইদ্রিশ বলল, আই জি ক্রাইম স্যার। বর্ধন সাহেব স্যার।

এ পি বর্ধন কবিরের ওপরওয়ালা। তিনি যখনতখন ফোনে ডাকতেই পারেন। কিন্তু মোবাইলে কল না করে অফিসের ফোনে এই অবেলায় কেন?

বর্ধন ডাকলে আবার তিনতলায় উঠে ধরতেই হবে। উনি এতক্ষণ লাইন ধরে থাকবেন? এ পি বর্ধন কাজপাগল মানুষ। স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। ছেলে আর মেয়ে দুজনেই থাকে বিদেশে। তাই এখন আর সংসার বলে কিছু নেই, অফিসেই কাটান বারো-চোদ্দো ঘণ্টা।

কিন্তু কবির সাহেবের তো তা নয়। তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে। কবিরের গ্রামের বাড়ি মুর্শিদাবাদে। পৈত্রিক সম্পত্তি ও জমিজমা আছে। কাজের চাপে কবির সেখানে যাওয়ার সময়ই পান না। স্ত্রী নীলোফারই ঘুরে আসে মাসে অন্তত একবার। গত সপ্তাহেই গেছে নীলোফার, আজই বিকেলে ফেরার কথা। আজ সন্ধেবেলা অন্য কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখেননি, নিরিবিলিতে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটাবেন ঠিক করেছিলেন।

তিনতলায় এসে দেখলেন, তার টেবিলের ওপর ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা পড়ে আছে। কিন্তু লাইন কেটে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। বর্ধন সাহেব কি এতক্ষণ ফোন ধরে থাকবেন নাকি?

কন্ট্রোল রুমকে তিনি বললেন, আবার যোগাযোগ করতে।

ফোন বাজার পরই কবির কিছু বলার আগেই বর্ধন বললেন, কবির?

দু-পায়ের গোড়ালি ঠোকাঠুকি করে স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গিতে কবির বললেন, স্যার!

বর্ধন বললেন, শোনো কবির, আমার মোবাইল ফোনটা চুরি গেছে!

কবির কয়েক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেলেন। এইজন্য তাঁকে অফিসের বাইরে থেকে ডেকে আনা হল? এত তুচ্ছ কারণে?

বর্ধন আবার বলতে লাগলেন, দুপুরের পর থেকে আর সেটাকে পাচ্ছি না। আজকাল চোর-ডাকাতদের কত সাহস বেড়েছে বলো তো? পুলিশের জিনিস চুরি করে। ওই ফোনে আমার কত ফোন নাম্বার, কত জরুরি বিষয় লোড করা আছে, হারিয়ে ফেললে চলবে না। সেটা খুঁজে বার করতেই হবে।

এপাশে কবিরের বিস্ময় কাটছে না। বর্ধনের মোবাইল খুঁজে বার করার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে নাকি? এ তো অদ্ভুত কথা!

কবির আমতা-আমতা করে বললেন, কোথায়, কখন চুরি হল স্যার?

তা কে জানে! জানলে তো এতক্ষণ চোর ধরেই ফেলতাম।

স্যার, একটা কাজ করা যায়। কোম্পানিকে বলে সিমকার্ড যদি অচল করে দেওয়া যায়।

ওসব কি আমি জানি না ভাবছ? সবই করা হচ্ছে।

তা হলে আমাকে কী করতে হবে, স্যার?

কিচ্ছু না। ও হ্যাঁ, কাজ আছে তো বটেই। তুমি অফিসে আর কতক্ষণ আছ?

আমি তো কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়ছিলাম। তবে আপনি যদি থাকতে বলেন, আরও থাকব।

হ্যাঁ, বসে থাকো। ফাইলপত্তর দেখো। কাজের কি আর শেষ আছে? তোমার কাছে। একজনকে পাঠাচ্ছি একটু বাদে।

কে?

কে গেলেই বুঝতে পারবে। কবির, তোমার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে।

স্যার! আমার নামে?

ইয়েস। তুমি একজন আসামিকে কোনও শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিয়েছ? চার্জশিট দাওনি।

কোন আসামি স্যার? কবে?

নাম-টাম আমি জানি না। কবে-টবে তাও আমার মনে নেই। যে তোমার কাছে যাবে, সেই সব বলবে।

এরপরেই খলখল করে হেসে উঠলেন বর্ধন।

হাসতে হাসতে বললেন, কেমন সাসপেন্সে রাখলাম বলো? যে যাচ্ছে, তার নাম বলিনি। কোন আসামিকে ছেড়ে দিয়েছ, সে নামও জানালাম না। কিন্তু অভিযোগটা সত্যি। এখন বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবো।

বর্ধনের এই স্বভাবটা জানেন কবির। অনেক সময়ই পুরো ব্যাপারটা খুলে বলেন না, হেঁয়ালি করতে ভালোবাসেন। এমনিতে বুড়ো বেশ পছন্দই করেন কবিরকে।

বর্ধন আবার বললেন, বউমা, ছেলেমেয়েরা সব ভালো আছে তো?

জি, স্যার। নীলু ছেলেমেয়েদের নিয়ে বহরমপুরে গিয়েছিল। আজ সন্ধেবেলাই ফেরার কথা।

আজ সন্ধ্যাবেলা ফিরবে? তারপর কি বউ-বাচ্চাদের নিয়ে বাইরের কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলে নাকি?

না, মানে, ঠিক সেরকম কোনও প্ল্যান করিনি, তবে…

সে গুড়ে বালি। আজ আর তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। বউমাকে খবর দিয়ে দাও। নীলোফার যদি রাগারাগি করে, বলবে, পুলিশের কাজে কি সময়ের কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকে নাকি? চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি। আমার নামে একটা গালাগালি দিও, খুব খারাপ কিছু দিও না, হারামজাদা-টারামজাদা বলতে পারো। বলবে, হারামজাদা বর্ধনটা তোমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে, তার জন্যই তাড়াতাড়ি ফিরতে পারছ না।

স্যার, আপনার নামে এইরকম কিছু বললেই নীলু বেশি রাগ করবে। সে ভাববে, আমি বানিয়ে বলছি।

ঠিক আছে, গুড লাক। কাল সকালে আমায় খবর দিও।

ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর কবিরের ভুরুটা কুঁচকে রইল। কোনও আসামিকে ছেড়ে দিয়েছে? কে? এরকম অভিযোগ তাঁর নামে কেউ কখনও দেয়নি। এখন কতক্ষণ বসে থাকতে হবে, কে জানে।

বাড়িতে এক্ষুনি ফোন করার দরকার নেই। আগে দেখা যাক, কে আসে, সে কী বলে।

কবির অফিসে বসে থাকলে তার আর্দালি ইদ্রিশ আর পি এ সুবিমলেরও ছুটি নেই। এটাই রীতি।

ইদ্রিশকে ডেকে তিনি এক কাপ চা আনালেন। ফাইল তো জমে থাকেই সব সময়। এখন আর ফাইল দেখতে ইচ্ছে করছে না।

সুবিমল নোট বুক আর কলম নিয়ে এসে দাঁড়াল।

কবির বললেন, তোমাকে ডাকিনি তো?

সুবিমল বলল, আপনি বেরিয়েও ফিরে এলেন স্যার। তাই ভাবলাম, জরুরি কোনও কাজ আছে।

কবির বললেন, নাঃ! একজন দেখা করতে আসবে।

আপনার কোনও বন্ধু?

না, না। বর্ধন সাহেব পাঠাচ্ছেন। ইম্পর্টান্ট কেউ হবেন নিশ্চয়ই। তুমি ইচ্ছে করলে বাড়ি যেতে পারো।

না স্যার, আমি থাকছি।

চা খাওয়ার পর একটা সিগারেট টানার জন্য মনটা উসখুস করে। অফিস ঘরের মধ্যে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। পাশের একটা ছোট ছাদে গিয়ে খাওয়া যায়। ছুটি হয়ে গেছে, এখন নিয়ম না মানলেও চলে। কবির ঘরে বসেই একটা সিগারেট ধরালেন।

সুবিমল এখনও দাঁড়িয়ে, সে বলল, স্যার, ডাক্তারের মার্ডার কেসটা–

কবির বললেন, ওসব কথা এখন থাক। তুমি এখনই যদি বাড়ি যেতে না চাও, তুমি তো গল্পের বই পড়তে ভালোবাসো, নিজের জায়গায় গিয়ে বই-টই পড়ো।

কবিরের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তাঁর বন্ধু বিনায়কের নম্বর।

তিনি বললেন, আজ সন্ধেবেলা তুমি বাড়িতে থাকছ? তা হলে একবার যেতে পারি।

কবির জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনই তো সন্ধে হয়ে গেছে। অফিসে বসে আছি। কখন ফিরতে পারব ঠিক নেই।

বিনায়ক বললেন, এখনও এত কাজ? পুলিশের চাকরিটা এবার ছাড়ো। সারা দিন, রাত পর্যন্ত শুধু চাকরিই করবে, তা হলে জীবনের অনেক কিছুই উপভোগ করা যাবে না।

চাকরি ছাড়লে খাব কী? ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া…

মাস ছয়েক দু-হাতে ঘুষ নাও! এত বড় পুলিশ অফিসার অথচ গরিব, এ আবার হয় নাকি?

তোমাকে তো বলেইছি, আমাকে কেউ ঘুষ দিতেই চায় না। ঘুষ অফার করলে নেব কি নেব না তা ঠিক করতাম, কিন্তু কেউ তো অফারই করে না।

তোমার যারা নীচের কর্মচারি, তারা নিশ্চয়ই প্রচুর ঘুষ নেয়। পুলিশ সম্পর্কে এটা সবাই জানে। তারা তোমাকে ভাগ দেয় না?

কেউ ভাগ দিতে চাইলে যদি আমি তাকে সাসপেন্ড করি, সেই ভয়ে, সবাই আমার কাছে সাধু সেজে থাকে।

তা হলে থাকো তোমার কাজ নিয়ে। আমি এক বাড়িতে গান-বাজনা শুনতে যাচ্ছি।

বিনায়ক ছেড়ে দেওয়া মাত্রই আবার সেই ফোন বাজল।

এবার আবার বর্ধন সাহেব।

কবির, যাকে পাঠিয়েছি, সে পৌঁছেছে?

না স্যার, এখনও কেউ আসেনি।

আসবে, দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে।

আমি অপেক্ষা করব, স্যার।

শোনো, তোমায় এবার ফোন করছি মোবাইল ফোন থেকে। বুঝতে পেরেছ? তার মানে আমার মোবাইলটা পাওয়া গেছে।

আই অ্যাম গ্ল্যাড টু হিয়ার দ্যাট স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

এতক্ষণে কবিরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। চুরি না ছাই। একদিন অন্তর একদিন বর্ধন। সাহেব তার মোবাইল ফোন হারান, আবার খুঁজেও পাওয়া যায়। বউ মারা যাওয়ার পর উনি আরও বেশি ভুললামনা হয়ে গেছেন।

আরও দশ মিনিট পরে এল সেই আগন্তুক।

রহস্যময় কেউ না। দিল্লি পুলিশের ডিটেকটিভ বিভাগের এক ইনসপেক্টর, এঁর নাম দুর্লভ সিং। এঁর সঙ্গে আগেও একবার দেখা হয়েছে কবিরের।

পদাধিকারে দুর্লভ সিং ছোট, তাই সে প্রথামতন ঘরে ঢুকেই স্যালুট করল প্রথমে।

কবির ইংরেজিতে বললেন, আরে, কী ব্যাপার, দুর্লভ সিং, বসুন, বসুন।

প্রথমে একটুক্ষণ সাধারণ ভদ্রতার কথাবার্তা হয়। দিল্লির অন্যান্য পরিচিত অফিসাররা কে কেমন আছে। আজকাল সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ নিয়েই পুলিশ বিভাগ ব্যতিব্যস্ত। দুর্লভ সিং কি সেই ব্যাপারে কোনও নতুন তথ্য এনেছে?

দুর্লভ সিং বলল, না, স্যার। আমি এসেছি একটা খুনের কেসের তদন্ত উপলক্ষে। খুনটা দিল্লিতে হয়েছে ছমাস আগে। দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করা যায়নি। এমনকী, খুনটা যে সত্যি-সত্যি হয়েছিল, তারও কোনও প্রমাণ নেই।

কবির ভুরু তুলে বললেন, খুন হয়েছিল কি না তার কোনও প্রমাণ নেই, তা হলে আবার কীসের কেস?

দুর্লভ সিং বলল, ব্যাপারটা এইরকম। দুই বন্ধুতে মিলে দিল্লির রাজেন্দ্রনগর এলাকায় একটা বাড়িতে ঢুকেছিল এক সন্ধেবেলা। বাড়িটাতে নিয়মিত মধুচক্র বসত গোপনে। চারটি মেয়ে থাকত। সহদেব আচারিয়া আর শিউলাল ঝা নামে দুই বন্ধু যে সেই বাড়িতে ঢুকেছিল, তার সাক্ষী আছে। তারপর একটি মেয়ের ঘরে কিছু গোলমাল হয়। শিউলাল ঝা পালায় সেখান থেকে। দুদিন পরে সেই শিউলাল ঝা থানায় এসে অভিযোগ করে যে তার বন্ধুকে ওই বাড়িতে খুন করা হয়েছে। সে কথা শুনে পুলিশ সে বাড়ি রেইড করেছিল। কিন্তু সেখানে সহদেব আচারিয়ার ডেডবডি খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুনোখুনির কোনও চিহ্নও বোঝা যায়নি। বরং একটি মেয়ে অভিযোগ করেছিল যে ওই দুই বন্ধু একটা ঝগড়া বাধিয়ে টাকাপয়সা না দিয়েই পালিয়েছিল। কিন্তু সহদেব আচারিয়া গেল কোথায়? আর কিছুই যদি না হয়ে থাকে, তা হলে শিউলাল নিজে থেকে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাল কেন? পুলিশ প্রচুর খোঁজ করেও সহদেব আচারিয়ার কোনও ট্রেস পায়নি। তার বাড়ি থেকেও বলা হয়েছিল যে, সহদেব মিসিং।

একটু বাধা দিয়ে কবির জিগ্যেস করলেন, ওই সহদেবের বয়েস কত?

দুর্লভ বলল, বত্রিশ। খুব বড় একটা ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে।

তা হলে সহদেবের বাড়ির লোক থানায় ডায়েরি করেনি কেন? একজন বত্রিশ বছরের লোক বাড়ি ফেরেনি।

সহদেবের বাবা বলেছেন, সহদেব আগেও মাঝে-মাঝেই দু-তিন দিন বাড়ির বাইরে রাত কাটাত, কোনও খবর দিত না। সেইজন্যই সেবারেও তারা ব্যস্ত হননি। সহদেব অন্য কোনও রাজ্যে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে, বিদেশেও চলে যেতে পারে। টাকাপয়সার কোনও অভাব নেই।

দেন, হোয়াট?

ডেডবডি না পাওয়া গেলে মার্ডার যে কমিটেড হয়েছে, তা বোঝা যাবে কী করে? তাই কিছুদিন পর কেসটা চাপা পড়ে যায়।

এরকম অনেক কেসই তো চাপা পড়ে থাকে, আবার কোনও কোনও কেস কিছুদিন পরে মাথা তোলে। তাই তো হয়েছে?

ইয়েস স্যার। রাজেন্দ্রনগরের ওই যে বাড়িটা, পুলিশ সেখানকার মধুচক্র ভেঙে দেয়। মেয়েগুলো পালিয়ে যায়। বাড়িটা কিছুদিন খালি পড়ে ছিল, তারপর বিক্রি হয়ে যায়। এখন। ওই সব বাড়িই ভেঙে মালটি-স্টোরিড বিল্ডিং হয়। বাড়িটা বেশ সুন্দর, তিনতলা বাড়ি, সামনে একটু বাগান, গোটা তিনেক সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। প্রোমোটার এসে পুরো বাড়িটারই সব ইট খসিয়ে ফেলে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো ভাঙতে গিয়ে দেখা গেল, একটা ঘরের মেঝেতে একটা ডেডবডি পোঁতা আছে। খুব বেশি পুরোনো নয়।

পুলিশের চাকরিতে এরকম ঘটনা আরও শুনেছেন কবির, তাই খুব বেশি চমকিত না হয়ে বললেন, হু, এটাই সেই লোকটা, কী যেন নাম বললে?

দুর্লভ বলল, পচাগলা অবস্থা, দেখে চেনার কোনও উপায় নেই। তবে, সেই ডেডবডির দাঁত পরীক্ষা করে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেই লোকটিই সহদেব আচারিয়া। তার শরীরে কোনও পোশাক ছিল না, কিন্তু তার বাঁ হাতে একটা লোহার বালা ছিল, সেটা ওরা খুলতে পারেনি। ডেডবডির মাথায় ছিল বড়-বড় কাচের টুকরো, তাতেই বোঝা যায়, ওকে মারা হয়েছে মাথায় বোতল ভেঙে।

কেসটা আবার রি-ওপন করা হল?

জি স্যার। বড়লোকের বাড়ির ছেলের ব্যাপার, তারা এই নিয়ে হইচই করতে চায় না, খবরের কাগজকে জানাতে চায় না, তবে খুনির শাস্তি চায়। খুনের সময় ওই বাড়িতে যারা ছিল, তারা সব কে কোথায় গেছে, তার ঠিক নেই। খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। পুলিশ তবু একটা সোর্স থেকে খবর পেয়ে একটি মেয়েকে স্পট করল। তার আগে যা-ই নাম থাক, এখন নাম গীতা চাওলা। তাকে দেখে খুব ভদ্র বাড়ির মেয়ে ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। স্মার্ট, সফিসটিকেটেড চেহারা ও ব্যবহার, ফরফর করে ইংরিজি বলে। এখন সে একটা লন্ড্রি শপ চালায় বসন্তবিহারে। থানায় এনে তাকে জেরা করতেই প্রথকেই সে অবাক করে দিল। সে স্বীকার করল যে, হা সে এক সময় বেশ্যাবৃত্তি করত, কারণ তার খুব টাকার দরকার ছিল, রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়িতেও সে ছিল কিছুদিন। হাতে বেশ কিছু টাকাপয়সা জমার পর সে স্বেচ্ছায় ওই পেশা ছেড়ে দিয়েছে।

রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে দেড় বছর আগে। সহদেব আচারিয়া কিংবা শিউলালকে সে চেনে না, কোনওদিন দেখেনি। ওই খুনের ঘটনাও সে বিন্দুবিসর্গ জানে না। রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়ি যে সে আগেই ছেড়েছে, তার প্রমাণও দিল, বসন্তবিহারে এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে দেড় বছর আগে, তখন থেকে সে ওই দোকান চালাচ্ছে। আপনি জানেন স্যার, এই সব মেয়েদের, এরা আগে থেকে সব আটঘাট বেঁধে রাখে। পুলিশকে ভয় পায় না, বেশ্যাবৃত্তি করেছে বলে লজ্জা-শরমের কোনও ব্যাপার নেই, অনেক জেরা করেও তাকে মচকানো গেল না।

এরা কিছুটা সত্যি আর কিছুটা মিথ্যে বলে, সেটাই বেশি বিপজ্জনক। মেয়েটি ওই বাড়িতে ছিল, তা স্বীকার করে নিল। কিন্তু খুনের সময় ছিল কিনা, তা প্রমাণ করা যাবে না।

স্যার, একটা শুধু হিন্ট ওর কাছে থেকে পাওয়া গেল। ওই বাড়ির একটা ম্যাপ দেখিয়ে ওকে জিগ্যেস করা হল, কোন ঘরে কে থাকত। যে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের মেঝের তলায় ডেডবডিটা পাওয়া গেছে, সেই ঘরে যে থাকত তার নাম কী? গীতা বলেছিল, তার সময়ে ওই ঘরে থাকত সরিফন বিবি নামে একজন মেড সারভেন্ট। ঘটনার সময়ও সেই সরিফন বিবি ছিল কিনা তা সে জানে না।

আচ্ছা, দুর্লভ সিং, তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করি। খুনের অভিযোগ শোনার পরই পুলিশ যখন ওই বাড়ি সার্চ করে, তখন সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো দেখেনি?

দেখেছিল স্যার। প্রত্যেকটা ঘর ভালো করে দেখেছিল।

মেঝেটা খুঁড়ে যদি একটা বডি পুঁতে দেয়, তারপর গর্ত বুঝিয়ে সিমেন্ট করে দিলেও তো কিছুটা কঁচা থাকবে, নতুন সিমেন্ট বলে বোঝা যাবে। তোমাদের তাতে সন্দেহ হয়নি?

সার্চ পার্টিতে আমি ছিলাম না স্যার। নিখিল মিশ্র একটা টিম নিয়ে গিয়েছিল। তাকে আমি জিগ্যেস করেছি। সে বলেছে, ওই ঘরে ঢোকার পর দেখেছিল, একজন মেড সারভেন্ট খাঁটিয়া পেতে শুয়ে জুরে কোঁকাচ্ছে। কেউ একজন বলেছিল, মেয়েটির চিকেন পক্স হয়েছে। তাই শুনে নিখিল আর সেখানে বেশিক্ষণ থাকেনি। এজন্য অবশ্য তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।

তার মানে ওই মেড সারভন্টটি অভিনয় করেছে। এরা পারেও বটে। ওয়েল?

কবির এবার একটা সিগারেট ধরালেন। চেয়ে রইলেন দুর্লভের চোখের দিকে। দুর্লভও চেয়ে রইল সোজাসুজি।

কবিরই আবার জিগ্যেস করলেন, যা শুনলাম, এ তো তোমাদের দিল্লির ব্যাপার। তুমি কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে, এর সঙ্গে আমি কী ভাবে জড়িত?

দুর্লভ বলল, আমি একটা এনকোয়ারির জন্য এসেছি। হয়তো আমার ভুলও হতে পারে। সে জন্য আমি আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি। আমি অসময়ে এসে বিরক্ত করছি আপনাকে

না, না, ঠিক আছে। তুমি তোমার ডিউটি করছ। বলল, কী ব্যাপার?

ওই মেইড সারভেন্টটির নাম সরিফন বিবি। বাঙালি। আমাদের রেকর্ড বলছে। একটা মেয়ে পাচার চক্র দিল্লি পুলিশ ধরে ফেলে। সেই মেয়েদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাঙালিও ছিল। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়। আপনি তাদের জবানবন্দি নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ওই সরিফন বিবিও ছিল। আপনি স্যার তাকে কোর্টে প্রোডিউস করেননি। গভর্নমেন্টের কোনও পারমিশানও নেননি। তাকে বেকসুর ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ওই সরিফন বিবির হোয়ার অ্যাবাউটস আমাদের জানা দরকার।

কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। প্রায় পৌনে নটা বাজে। নীলু এখনও ফোন করল না, বাড়ি পৌঁছেছে? ভেতরে-ভেতরে অস্থির বোধ করলেন কবির।

সরিফন বিবি? একগুচ্ছ উদ্ধার পাওয়া মেয়ের জবানবন্দি তিনি নিয়েছিলেন পাঁচ-ছমাস আগে। তাদের মধ্যে সরিফন বিবি বলে কেউ ছিল? মনে নেই। মনে রাখা সম্ভবও নয়।

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে কবির বললেন, তুমি কী বলতে চাও দুর্লভ সিং? একটি মেয়ের নামে মার্ডার চার্জ আছে, তবু তাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি, কোনও রেকর্ড না রেখে, এটা তো আমার সার্ভিসের পক্ষে কলঙ্ক। ওকে আমি ছেড়ে দিয়েছি, সে মুসলমান বলে?

দুর্লভ প্রায় কেঁদে উঠে বলল, এ কী বলছেন স্যার? এরকম কথা আমার ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি। আপনি যখন তাকে ছেড়ে দেন, তখন তার নামে মার্ডার চার্জ ছিল না। কোনও চার্জই ছিল না। আপনি তাকে ছেড়ে দিয়ে হয়তো ঠিকই করেছেন। আমি শুধু বলতে এসেছি, ওই সরিফন বিবিকে খুঁজে বার করা আমাদের পক্ষে খুবই দরকার। সে জন্য আপনার সাহায্য চাই।

হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা কবিরের একটা বাজে স্বভাব। এ জন্য তিনি নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলেন এবার। তিনি বুঝতে পারলেন বর্ধন সাহেবের দুষ্টুমিটা। কবিরকে তিনি এইভাবে খেপাতেই চেয়েছিলেন।

নিজেকে সংযত করে কবির বললেন, অফকোর্স তোমাকে আমরা সব রকমভাবে সাহায্য করব। দাঁড়াও।

বেল টিপলেন কবির।

ইদ্রিশ এসে উঁকি মারতেই বললন, সুবিমলবাবুকে বোলাও।

সুবিমলও এসে গেল সঙ্গে-সঙ্গে।

কবির বললেন, সুবিমল, ইনি দুর্লভ সিং, দিল্লি থেকে এসেছেন। কিছু জরুরি কথা আছে। তুমি বোসো।

বড় অফিসারের সামনে সুবিমল কখনও বসে না। কবির প্রত্যেকবারই তাকে বসতে বলেন, তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে।

কবির জিগ্যেস করলেন, সুবিমল, তোমার মনে আছে, কয়েকমাস আগে মেয়ে পাচারকারিদের হাত থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি মেয়ের কেস হিস্ট্রি আমরা রেকর্ড করেছিলাম?

সুবিমল বলল, হ্যাঁ, মনে আছে স্যার।

ওদের মধ্যে সরিফন বিবি বলে কেউ ছিল? ফাইল দ্যাখো তো!

ফাইল দেখতে হবে না। আমার মনে আছে, ওই নামে কেউ ছিল না।

ছিল না?

না স্যার।

কবির এবার দুর্লভের দিকে ফিরে জ্বলন্ত চোখে বললেন, দেখলে? দেয়ার ওয়াজ নো সরিফন বিবি। তুমি ভুল ইনফরমেশান নিয়ে এসেছ। অ্যান্ড দেয়ার এনডস দ্যা ম্যাটার।

দুর্লভ কোনও কথা বলল না।

সুবিমল বলল, স্যার, আমি আর একটু বলতে পারি? সেইসময়, সরিফন বিবির নাম উঠেছিল কয়েকবার। লক্ষ্মীমণি পাড়ুই নামে আর একটি মেয়ের সঙ্গে তার নাম গুলিয়ে ফেলা হচ্ছিল কয়েকবার। লক্ষ্মীমণি আর সরিফন বিবি, এদের দুজনেরই বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে। ইট ওয়াজ আ কোয়েশ্চেন অফ মিসটেকেন আইডেনটিটি। আমাদের রেকর্ডে স্পষ্ট করা আছে যে সরিফন বিবি আগেই মারা গেছে, তবু লক্ষ্মীমণিকেই কয়েকবার সরিফন বিবি বলা হয়েছে।

দুর্লভ হতাশভাবে বলল, সরিফন বিবি মারা গেছে? আর ইউ শিওর?

সুবিমল বলল, রেকর্ডে তাই রয়েছে।

দুর্লভ বলল, যাঃ! তা হলে তো আবার গভীর গাড্ডায় পড়া গেল! আর তো কোনও লিড রইল না।

সুবিমল বলল, স্যার, এই লক্ষ্মীমণির কেসটা খুব পিকিউলিয়ার। তার সঙ্গে কথা বলার সময় দু-একবার সরিফন বিবির নাম এসেছে, তখনই সে বলেছে যে, না, না, আমি সরিফন নই। যদিও তার বয়ানে শেষের দিকে দিল্লির রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়ির খুনোখুনির উল্লেখ আছে। এমনও হতে পারে, ওই সময় লক্ষ্মীমণিকেই অনেকে মনে করত সরিফন, সে-ই থাকত ওই ঘরটায়।

অন্য দুজন একেবারে চুপ।

সুবিমল অন্যদিকে তাকাল।

সুবিমল কয়েক মুহূর্ত পরে কবিরের দিকে চেয়ে বলল, স্যার, আপনার মনে নেই, আপনার বন্ধু, ফেমাস রাইটার বিনায়কবাবুও তখন উপস্থিত ছিলেন। লক্ষ্মীমণির স্টেটমেন্ট আমি রেকর্ড করে রেখেছি।

কবিরের ইচ্ছে করল, সুবিমলের গালে ঠাস-ঠাস করে দুটো চড় মারতে। সুবিমল যা বলছে, তা মিথ্যে নয়। কিন্তু এই সব কথা দুর্লভের সামনে বলার কী দরকার ছিল?

কবিরের সব মনে পড়ে গেছে। লক্ষ্মীমণির মুখটাও তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ওই সরল গ্রাম্য মুখে কি কোনও মিথ্যে কথা মানায়! আবার নিজের অভিজ্ঞতাতেও তিনি বুঝেছেন, অনেক মেয়েই বেশ ভালো অভিনয় করতে পারে। শহরের মেয়েদের তুলনায় গ্রামের মেয়েরাও কম যায় না।

দুর্লভ এবার বলল, স্যার, ওই লক্ষ্মীমণিকেও কি ট্রেস করা যাবে? তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হত।

লক্ষ্মীমণি কোথায় আছে, তা কবির জানেন। সব নিয়ম কানুন না মেনেই তিনি একদিন লক্ষ্মীমণিকে পুলিশের হেফাজত থেকে বার করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এ নিয়ে কোনওদিন কোনও প্রশ্ন উঠবে না।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, দুর্লভ, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। এ নিয়ে কাল আবার কথা হবে। তুমি কাল সকালে আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো–

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *