তামাক
গল্পটা অনেকদিনের পুরনো। পড়েছিলাম সেই ‘অচলপত্র’ কাগজে। সেও অনন্তকাল আগে, অন্তত তিরিশ বছর তো হবেই।
এ কালের মহাভারতের নবীন পাঠক, অচলপত্রের নামটা কি খুব অচেনা, খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে? কখনও দেখেননি অচলপত্র পত্রিকা? মনে পড়ে দীপ্তেন সান্যাল?
আমাদের নব যৌবনের দিনে অচলপত্র ছিল আমাদের রসিকতা শিক্ষার পাঠশালা আর তাঁর পণ্ডিতমশাই ছিলেন দীপ্তেন সান্যাল।
অচলপত্রের সাহিত্য ব্যাপারটা খুব জরুরি ছিল না, উচ্চমানের ছিল এমনও বলা যাবে না কিন্তু সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যালের রসবোধ ছিল তীক্ষ্ণ ও প্রখর, অনায়াস ও সহজাত হালকা চাল ছিল তাঁর কলমে এবং তার কোনও কোনও রসিকতা ছিল অনন্য সাধারণ ও স্মরণীয়।
হাতের কাছে পুরনো অচলপত্র পত্রিকার একটা সংখ্যাও নেই, কাছাকাছি কারও কাছে আছে বলেও জানি না। তা হলে অচলপত্র স্মৃতিচারণ অন্তত একবার করা যেত।
আপাতত সে ইচ্ছা মুলতুবি থাক, তামাকের গল্প চাই। একবারে হবে না, দু’বারে লিখব।
সিগারেট দিয়ে শুরু করি। অচলপত্রের গল্পটা সিগারেট নিয়ে।
খগেনবাবু নামে এক ভদ্রলোক ময়দানে খেলা দেখতে গেছেন। খুব উত্তেজনাপূর্ণ খেলা, ফুটবল লিগ মরশুমের একেবারে শেষ দিকের খেলা দুই মহারথীর মধ্যে। গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন খগেনবাবু।
তখনও ইডেন গার্ডেনের স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা চালু হয়নি। সল্ট লেক স্টেডিয়ামের কথাই আসে না, প্রকৃত অর্থেই সে তখন অগাধ জলে।
উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন খগেনবাবুর ইচ্ছে হল একটা সিগারেট ধরাতে। খেলা এখন সেকেন্ডে হাফের আধাআধি সময়ে এসে গেছে। এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে মাঠে ঢুকেছিলেন খগেনবাবু। প্রথমার্ধে এবং তারপরে হাফ টাইমের সময় প্রায় সব কয়টি সিগারেট তিনি খেয়ে ফেলেছেন। শেষবার যখন প্যাকেট পকেটে রাখেন তখন মাত্র একটা সিগারেট ছিল তাঁর প্যাকেটে। সেটা সযত্নে রক্ষা করেছেন এতক্ষণ, কিন্তু এবার আর পারলেন না।
গোলের মুখে বল প্রায় দেড় মিনিট ধরে ঘোরাঘুরি করছে। একটি গোলের ওপরেই খেলার চূড়ান্ত জয় পরাজয় নির্ভর করছে। খগেনবাবুর পাশের ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সেই সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ তাঁর নাকে ঢুকে চুলবুল করছে। শেষ সিগারেটটাকে আর রেখে লাভ নেই।
পকেটে হাত দিলেন খগেনবাবু। স্পষ্ট মনে আছে ডানদিকের প্যান্টের পকেটে প্যাকেটটা রেখেছিলেন কিন্তু প্যাকেটটা সেখানে নেই। বাঁদিকের প্যান্টের পকেটে, তারপরে শার্টের ওপর পকেটে—সব জায়গায় তন্নতন্ন করে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজলেন খগেনবাবু।
না, কোথাও নেই। সিটের পাশে, এমনকী গ্যালারির নীচে পর্যন্ত একবার উঁকি দিয়ে দেখলেন। সিগারেটের প্যাকেটটার কোনও চিহ্ন নেই কোথাও, একেবারে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল আশ্চর্য।
পাশের ভদ্রলোক এখনও সিগারেট টেনে চলেছেন। তাঁর সিগারেটের ধোঁয়ায় মন উশখুশ করতে লাগল খগেনবাবুর। অবশেষে খগেনবাবু সিগারেটের নেশার টান সামলাতে না পেরে একটা ছোট চাতুরির আশ্রয় নিলেন। পাশের ধূমপানরত সহদর্শককে বললেন, ‘দাদা, আপনার দেশলাইটা একটু দেবেন?’
ভদ্রলোক খেলা দেখতে দেখতে পকেট থেকে একটা দেশলাই বার করে খগেনবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। খগেনবাবু ভদ্রলোককে দেখিয়ে দেখিয়ে পকেটে সিগারেটের প্যাকেট খোঁজার একটা অভিনয় করলেন, তারপর মুখে একটা অস্ফুটপ্রায় ‘ধূৎ’ বলে দেশলাইয়ের বাক্সটা ফেরত দিয়ে দিলেন এই আশায় যে, ভদ্রলোক যখন দেখবেন যে তাঁর কাছে কোনও সিগারেট নেই, দেশলাই নিয়েও সিগারেট ধরাতে পারলেন না, তখন হয়তো দয়া করে একটা সিগারেট অফার করবেন।
দেশলাই বাক্সটা ফেরত দেওয়ার পর খগেনবাবু যা আশা করেছিলেন প্রায় তাই হল। পাশের ভদ্রলোক দেশলাই ফেরত পেয়ে এবং খগেনবাবুকে সিগারেট না ধরাতে দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন করলেন, ‘কী হল সিগারেট ধরালেন না?’
খগেনবাবু করুণ মুখে বলেন, ‘না। পকেটে একটা প্যাকেটে একটা মাত্র সিগারেট ছিল, কখন যে পড়ে গেছে প্যাকেটটা। আর তো সিগারেট নেই।’
ভদ্রলোক খগেনবাবুকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাঁচি সিগারেট? কঁচির প্যাকেটে একটাই সিগারেট ছিল আপনার?’ খগেনবাবু উৎসাহী হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক তাই। পেয়েছেন নাকি প্যাকেটটা?’ ভদ্রলোক লজ্জিত কণ্ঠে স্বীকার করলেন, ‘পেয়েছিলাম তো, কিন্তু আমার কাছেও যে কোনও সিগারেট ছিল না, আপনার সিগারেটটাই এতক্ষণ খেলাম।’ বলে শেষ একটা সুখটান দিয়ে তিনি সিগারেটের দগ্ধাবশেষটুকু গ্যালারির নীচে নিক্ষেপ করলেন।
তামাকের আলোচনার বদলে সিগারেটের গল্পটা একটু বড় হয়ে গেল।
তামাকের নানা রকমফের। সরাসরি মুখে দিয়ে খাওয়ার খইনি, সুরতি। গন্ধ মশলা মিশিয়ে জর্দা, দোকতা, গুণ্ডি। ওড়িয়া পানের দোকানে গুণ্ডি মোহিনীর খুব কদর, যেমন বিহারিদের কাছে খইনির। বাঙালির দুটোই বেশ চলে।
ধূমপান করার জন্যে আছে বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, চুট্টি। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর অপু বার্ডশাই খেয়েছিল, সেও এক জাতের সিগারেট।
আর তামাক খাওয়া বলতে যা বোঝায় সেই হুঁকো, গড়গড়া, অম্বুরী, বাদশাহী, রংপুরী তামাক; জরির নল, রুপোর খোল আজকের দ্রুতগতি জীবনে সে প্রায় সম্পূর্ণই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
হুঁকো সম্পর্কে শেষ গল্পটা লিখে রাখি। পরে লোকে গল্পটা বুঝতেও পারবে না।
একটা হুঁকোর চারটে প্রধান অংশ। প্রথম অংশ কলকে, যার মধ্যে তামাক থাকে। তারপর নলচে যার মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া নীচে নেমে আসে জলের পাত্রে, এই পাত্রই হল খোল। নারকোলের মালা দিয়ে ভাল খোল হয়, তবে সোনার, রুপোর, ব্রোঞ্জের পাত্রও হয়। চতুর্থ অংশটি আবশ্যিক নয়। সেটা হল নল। থেলো হুঁকো মানে নারকেলের মালার হুঁকোয় জরির কাজ করা অনেকরকম শৌখিন নল লাগানো থাকে।
ভবিষ্যৎ বংশীয়দের জন্য হুঁকোর এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকু লিখে রাখলাম। এবার গল্পটা বলি।
এক ভদ্রলোক দাবি করেছিলেন যে, তাঁদের বাড়িতে একটা হুঁকো আছে যেটা নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেবের আমলের। এত পুরনো শুনে অনেকে সেই হুঁকোটা দেখতে চাইত। তখন ভদ্রলোক যে হুঁকোটা বার করে দেখতেন, সেটাকে দেখে কিন্তু তত পুরনো মনে হত না। সবই কেমন, খুব নতুন নতুন না হলেও মোটেই পুরনো নয়।
ভদ্রলোক এর যা ব্যাখ্যা দিতেন সেটা চমৎকার। যদিও হুঁকোটা সেই প্রাচীন দিনের, এর মধ্যে পুরনো অংশ এখন আর কিছুই নেই। কখনও কলকে, কখনও নল, কখনও খোল, কখনও নলচে বদলাতে বদলাতে সেই হুঁকোটাই সম্পূর্ণ চেহারাটা পালটিয়ে ফেলেছে। বলা বাহুল্য, ‘খোল-নলচে সমেত বদলিয়ে যাওয়া’ প্রবাদটির উৎস এই গল্প।