Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তবুও মাতাল || Tarapada Roy

তবুও মাতাল || Tarapada Roy

তবুও মাতাল

পাঠক-পাঠিকা আমাকে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। আমার মদের নেশা ধরে গেছে। শুকনো রুলটানা কাগজে নীরস ডটপেনে মাত্র দু’-দশ অনুচ্ছেদ লিখে যদি এত নেশায় চুরচুর হয়ে যাই, তাহলে যাঁরা প্রকৃত নেশারস পিপাসু, তাঁদের গতি কী হবে।

আপাতত দুটো চরম দৃষ্টান্ত স্মরণ করা যেতে পারে। গভীর রাতে নেশা সাঙ্গ করে বাসে উঠেছেন এক মদ্যপ ভদ্রলোক। ফাঁকা বাস। উঠে একটা সিটে বসে পাশের সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা, আমি কি বাসে উঠেছি?’ মাতালের সঙ্গে কেউ কথা বাড়াতে চায় না, সহযাত্রীটি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘হুঁ।’ তখন মদ্যপ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা, আপনি কি আমাকে চেনেন?’ সহযাত্রী আবার সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘না।’ এবার মাতাল ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘যদি আপনি আমাকে নাই চেনেন, তাহলে কী করে বুঝলেন যে, আমিই বাসে উঠেছি?’

এ প্রশ্নের অবশ্য কোনও জবাব হয় না। কিন্তু মাতালদের আত্মপ্রবঞ্চনার শেষ নেই। এক পানশালায় এক ভদ্রলোক প্রতিবারে দু’-গেলাস করে পানীয় নিতেন। কৌতূহলী কেউ যদি জানতে চাইত, ‘এক সঙ্গে দু’-গেলাস কেন?’ ভদ্রলোক বলতেন, ‘এক গেলাস আমার নিজের জন্যে, আর, আরেক গেলাস আমার বন্ধুর জন্যে।’ এর পরে যদি প্রশ্ন করা হত, ‘কিন্তু আপনাকে যে একা দেখছি। আপনার বন্ধুকে তো দেখতে পাচ্ছি না।’ ভদ্রলোক জবাব দিতেন, ‘দেখবেন কী করে? সে তো বেঁচে নেই।’ এর পর আর কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না, তবুও যদি প্রশ্নকারী বলতেন, ‘তা হলে?’ ভদ্রলোক উত্তর দিতেন, ‘এক গেলাস আমার তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে, আর অন্য গেলাস আমার বন্ধুর আত্মার শান্তির জন্যে।’

এ রকম বেশ কিছুদিন চলেছিল। তারপরে একদিন দেখা গেল উক্ত ভদ্রলোক অন্য দশজনের মতোই এক গেলাস করে পানীয় নিচ্ছেন, আগের মতো দু’-গেলাস নয়। এবার সেই পুরনো প্রশ্নকারী স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল দু’-গেলাস থেকে এক গেলাসে নেমে এলেন কেন?’ ভদ্রলোক করুণ কন্ঠে জানালেন, ‘শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, ডাক্তার আমার মদ খাওয়া বারণ করে দিয়েছেন। আমি আর মদ খাচ্ছি না, শুধু বন্ধুর আত্মার শান্তির জন্য তার গেলাসটা খাচ্ছি।

নেশাতুর ব্যক্তিরা যে কতরকম ভুল করে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সেই ঘটনার কথা আগে আপনাদের আগে বলেছি। নেশায় চুরচুর এক মদ্যপ ভদ্রলোক মধ্যরাত অতিক্রম করে বাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছেন। এর পর পকেট থেকে একটা চাবি বার করে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে সেটা লাগাতে গেলেন। উলটো দিকের ফুটপাতে থানার পুরনো জমাদারসাহেব ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। এই নিরীহ মাতালকে তিনি বহুকাল চেনেন, কিন্তু আজ চাবি দিয়ে ল্যাম্পপোস্ট খোলার চেষ্টা করতে দেখে তিনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কী? করছেন কী?’ মাতাল ভদ্রলোক অমায়িক হাসি হেসে বললেন, ‘দেখছেন না জমাদারসাহেব, নিজের বাড়িতে তালা খুলে ঢোকার চেষ্টা করছি। শালা, এই চাবিটা কিছুতে লাগছে না।’ জমাদার সাহেব নিজেও সন্ধ্যার দিকে কিঞ্চিৎ গঞ্জিকা সেবন করেছিলেন। তিনি রঙিন চোখে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘এই আপনার বাড়ি!’ মত্ত ভদ্রলোক রীতিমতো আশ্বস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার নয় কি আপনার বাড়ি নাকি?’ তারপরে ল্যাম্পপোস্টের চূড়ায় যেখানে লাইট জ্বলছে, সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছেন না, দোতলায় আলো জ্বলছে। আমার বউ আমার জন্যে ভাত বেড়ে বসে আছে ওখানে।’

এ রকম একটা করুণ গল্পের পরে একটা মধুর গল্প অনায়াসেই বলা যায় প্রেক্ষাপট ওই একই। মধ্যরাত অতিক্রান্ত করে বাড়ি ফিরেছেন মত্ত ভদ্রলোক। শোয়ার ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠতে গিয়ে ভদ্রলোক থমকিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘এই যে আলুলায়িত কুন্তলা, স্খলিতবসনা সুন্দরী মহিলা, এত রাতে আমার বিছানায় শুয়ে আপনি কী করছেন বলতে পারেন।’

সদ্য নিদ্রোত্থিতা যুবতী রমণী আলগোছে পাশ ফিরে মুখোমুখি হয়ে টুলটুল নয়নে বললেন, ‘দেখুন এই বিছানাটা খুব নরম, আমার খুব পছন্দ হয়েছে, টেবিলের ফুলদানি থেকে কী মধুর সৌরভ আসছে রজনীগন্ধার, এই রজনীগন্ধাগুলি আমিই রেখেছি, তা ছাড়া এই ঘরটাও আমার খুব ভাল লাগে অবশ্য ভাল না লাগার কথা নয়, এই ঘরটা আমিই সাজিয়েছি। সামনের জানলার ওই দিকে নীল রঙের ফরফরে পর্দা আমিই কিনে এনেছি।’ মাতাল ভদ্রলোক এত কথা শোনার লোক নন, শোনার মতো অবস্থাও নয়। তিনি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা এত সব আপনি করতে গেলেন কেন?’

নয়ন ধনুকে শর সংযোজন করে যুবতী রমণী আধো-আধো গলায় বললেন, ‘কেন করলাম? এমনিই করলাম। আর তা ছাড়া কী বলব, জানেন কি আমি আপনারই বিবাহিত স্ত্রী?’

পুনশ্চ:

এবার আমরা শেষবার বারে যেতে পারি। না, আমরা কোনও টেবিলে বসব না। বরং একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধু কী আলোচনা করছে মন দিয়ে শুনি। আমরা মোক্ষম মুহূর্তে এসে গেছি। এখনই আসল আলোচনাটা হচ্ছে। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে মণিলাল, বেশি মদ খেলে তোর শরীরটা কি জ্বলে?’ মণিলাল বললেন, ‘আমি মদ খেয়ে কখনও এমন বেহুঁশ হই না যে, শরীরে আগুন লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখব যে, শরীরটা জ্বলে কি না।’

মাতালের হাত থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায় না। একবার মাতালের পাল্লায় পড়লে তাকে দ্রুত এড়ানো যে কত কঠিন ভুক্তভোগী মাত্রেই সেটা সম্যক জানেন। সুতরাং আমারও পরিত্রাণ নেই, আরেকবার মাতালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে সন্ধ্যাবেলা তাজ বেঙ্গলের লাউঞ্জে একজনের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। সহসা আশপাশের কোনও একটা বার থেকে এক বিখ্যাত মদ্যপ টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। সুখের বিষয় তিনি আমাকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু সামনেই পেলেন এক ইউনিফর্ম পরিহিত বায়ুসেনার অফিসারকে, যাঁকে তিনি হোটেলের উর্দিপরা দারোয়ান বলে ভ্রম করলেন এবং সেই ভ্রমবশত আদেশ করলেন, ‘ওহে, যাও তো তাড়াতাড়ি আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এসে তো।’

এবার আকাশপথের থেকে জলপথে যাই। ভবনাথবাবু আউটরাম ঘাটের দক্ষিণে গঙ্গার ধারে একটা চুল্লুর ঠেকে তরল অগ্নি পান করছিলেন সন্ধ্যা থেকে। নদীর ঘাটে ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, নদীর জলে পূর্ণ শশীর ছায়া, আবেগে চোখ বুজে ঘাটের ধারের রেলিংয়ে গা এলিয়ে দিলেন ভবনাথবাবু এবং সঙ্গে সঙ্গে নিচু রেলিং টপকিয়ে ঝপাৎ গঙ্গাজলে। ভাগ্যিস বর্ষার নদী, জল ঘাটের গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে তাই বেশিদূর পড়তে হয়নি। তা ছাড়া ভবনাথবাবু সাঁতার জানেন।

কিন্তু প্রথম ধাক্কায় জলে পড়ে যথেষ্টই হাবুডুবু খেলেন ভবনাথবাবু। তারপর বহু কষ্টে সিক্ত বস্ত্রে, সিক্ত শরীরে তদুপরি জলপূর্ণ উদর নিয়ে পাড়ে উঠে ভবনাথবাবুর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল সেই চুল্লুর ঠেকের মালিকের বিরুদ্ধে, তিনি ঘাটের ধাপ ধরে ধরে উঠে গেলেন সেই চুল্লুর দোকানে এবং গিয়ে সরাসরি চার্জ করলেন, ‘এত ভাল চুল্লুতে এতটা জল মিশিয়ে দিলে। চুল্লু মামা, তোমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই।’

মাতালের একটা বড় কাজ হল পড়ে যাওয়া। সে টলতে টলতে রাস্তায় পড়ে যায়, ঘরে বারান্দায়, পথে-ঘাটে সে কেবলই পড়ে যায়, কখনও বা দলবদ্ধভাবে পড়ে গড়াগড়ি খায়, গায়ে ধুলো-কাদা মাখে। হুঁশ ফিরতে ওইভাবেই বাড়ি ফেরে, ওটাই তার ট্রেড মার্ক। একদা এক মদ্যপ ব্যক্তি নেশা করে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন, ‘কেমন হল কবিতা লেখা?’ একথা তার কাছে জানতে চাওয়ায়, সে বলল, ‘মদ খেয়ে এত মাথা টলছিল, পারলাম না, দু’-চরণ না যেতে যেতেই একেবারে পপাত।’

তবে মাতালের খুব প্রিয় জায়গা হল রাস্তার ধারের ড্রেন, সেখানে পড়ে থাকতে সে খুব ভালবাসে। এ বিষয়ে অবশ্য তার একটা নিজস্ব বক্তব্য আছে, সেটা তার মুখেই শোনা যাক। ড্রেনে পতিত এক মাতাল ড্রেনের উদ্দেশে বলছে, ‘ও ভাই ড্রেন, এ তোমার কেমন ব্যবহার? দিনের বেলায় থাক রাস্তার ধারে আর রাতের বেলা চলে আস একেবারে রাস্তার মধ্যিখানে, এটা তো মোটেই ভাল নয়।’

কী যে ভাল, কী যে খারাপ, মাতালের অভিধান আর আমাদের অভিধানে সব শব্দের অর্থ এক নয়। এক ঢাকাই মাতালের কথা শুনেছিলাম, সে বাড়ি ফেরার জন্যে বেরিয়ে রাস্তায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, তার মাথা এত ঘুরত যে দাঁড়ানো অবস্থায় তার মনে হত ঢাকা শহরটা তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বলেছিল, ‘দাঁড়িয়ে থাকি এই আশায় যে আমার নিজের বাড়ির দরজাটা যখন সামনে চলে আসবে, ঝপ করে ঢুকে পড়ব। কিন্তু সে-বাড়িটা যে কোথা থেকে হুট করে পালিয়ে যায় বুঝতে পারি না।’ গোপাল ভাঁড়ের গল্প ছিল, ছেলে মধ্যরাতে মাতাল হয়ে বাড়িতে এসে বাবাকে ‘গোপালবাবু’ বলে চেঁচিয়ে ডাকছে। বাবা তো রেগে আগুন, ‘বদমায়েশ ছেলে, বাবাকে বাবা না বলে গোপালবাবু বলে ডাকছ?’ বুদ্ধিমান মদ্যপ ছেলে বলল, ‘আপনাকে যদি বাবা বলে ডেকে মাতলামি করি, পাড়ার লোকে ছিঃ ছিঃ করবে, বলবে গোপালবাবুর ছেলে মাতাল হয়ে এসেছে। আর আমি যদি আপনাকে ‘গোপালবাবু’ বলে ডাকি লোকে ভাববে আপনার কোনও ইয়ার-বক্সি-মাতাল হয়ে এসেছে, তাতে আপনার কী আসে যায়।’

গতবার ঢাকায় গিয়ে অনুরূপ একটি ঢাকাই গল্প শুনে এলাম। গভীর রাতে পাঁচ মাতাল আনোয়ার আলির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন আনোয়ার আলি স্বয়ং। কিন্তু তারা সকলেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ‘আনোয়ার আলি, আনোয়ার আলি’ বলে চেঁচাতে লাগল। ফলত আনোয়ার আলির স্ত্রী ঘুম জড়ানো চোখে বাড়ির সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এটাই আনোয়ার আলির বাড়ি কিন্তু আপনারা কী চাইছেন?’ বলা বাহুল্য বউটি মাতালদের দঙ্গলে বরকে লক্ষ করেনি। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, মাতালদের মুখপাত্র হাতজোড় করে বলল, ‘ভাবি, আমাদের মধ্যে কেউ আনোয়ার আলি, কিন্তু আমরা ঠিক ধরতে পারছি না। আপনি আসল আনোয়ার আলিকে বেছে নিন।’

আনোয়ার আলির স্ত্রী সেদিন স্বামীকে বেছে নিতে পেরেছিলেন কি না এবং তারপরে সেই স্বামী বেচারার কী পরিণতি হয়েছিল সেটা চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু একথাও তো সত্যি যে মাতাল হলে মানুষেরা চেহারা পালটিয়ে যায়, তাকে আর চেনাই যায় না। সাধে কি আর গল্পের সেই মাতাল তার সঙ্গীকে মদ খেতে নিষেধ করে বলেছিল, ‘ওরে তুই আর মদ খাসনে, তোর মুখ না কী রকম ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *