দিন শেষ হইয়া আসিতেছে
দিন শেষ হইয়া আসিতেছে।
খ্বাজা নজর বোখারী তাঁহার কারখানা ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দুনীচ বেনিয়ার সহিত হাসিমুখে কথা বলিতেছিলেন। দুনীচন্দের পুত্র আরোগ্যলাভ করিয়াছে, তাই সে মিঞা সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছে।
সহসা রাজপথের উপর অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। খ্বাজা নজর চোখ তুলিয়া দেখিলেন একদল লোক একটি মৃতদেহ বহন করিয়া আনিতেছে, তাহাদের পশ্চাতে দুইজন সওয়ার। খ্বাজা নজর শঙ্কিত হইয়া ঈশ্বরের নাম স্মরণ করিলেন।
মৃতদেহ বাহকগণ খ্বাজা নজরের অঙ্গনে প্রবেশ করিল। খ্বাজা নজর নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। বাহকেরা মোবারকের রক্তাক্ত মৃতদেহ আনিয়া খ্বাজা নজরের সম্মুখে একটি পাথরের পাটার উপর শোয়াইয়া দিল। কেহ কথা কহিল না। খ্বাজা নজর নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন; তাঁহার রক্তহীন অধর একটু নড়িল, মোবারক—
যাহারা বহন করিয়া আনিয়াছিল তাহারা নিঃশব্দে অশুমোচন করিয়া সরিয়া গেল। কেবল অশ্বারোহী দুইজন গেল না। সুজার মুখে ক্রোধের অন্ধকার এখনও দূর হয় নাই, চোখে জিঘাংসা ধিকিধিকি জ্বলিতেছিল। তাঁহার গালে ছিপের আঘাত চিহ্নটা ক্রমে বেগুনী বর্ণ ধারণ করিতেছে। তিনি মাঝে মাঝে তাহাতে হাত বুলাইতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু হিংস্রভাবে জ্বলিয়া উঠিতেছে।
সহসা সুজা খ্বাজা নজরকে উদ্দেশ করিয়া কঠোর কণ্ঠে বলিলেন, তুমি এর বাপ?
খ্বাজা নজর সুজার দিকে শূন্য দৃষ্টি তুলিলেন, কথা কহিলেন না। মোবারক তো বক্সী তালাওয়ে মাছ ধরিতে গিয়াছিল…!
উত্তর না পাইয়া আলিবর্দি খাঁ বলিলেন, ইনি মালিক উলমুল্ক সুলতান সুজা। তোমার ছেলে এর অমর্যাদা করেছিল তাই তার এই দশা হয়েছে।
খ্বাজা নজর এবারও উত্তর দিলেন না, ভাবহীন নিস্তেজ চক্ষু অশ্বারোহীদের উপর হইতে সরাইয়া মোবারকের উপর ন্যস্ত করিলেন। দেখিলেন পাথরের পাটা মোবারকের কণ্ঠ-ক্ষরিত রক্তে ভিজিয়া উঠিয়াছে। মোবারক বাঁচিয়া নাই….ইহারা তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে—
সুজা মুখের একটা বিকৃত ভঙ্গি করিলেন। এই সামান্য প্রস্তর-শিল্পীর পুত্রকে হত্যা করিবার পর ইহার অধিক কৈফিয়ৎ বা দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন নাই। সুজা আলিবর্দিকে ইঙ্গিত করিলেন; উভয়ে ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া প্রস্থাননাদ্যত হইলেন।
এই সময় বাড়ির ভিতর হইতে তীব্র আতোক্তি আসিল, সঙ্গে সঙ্গে পরীবানু ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। তাহার কেশ বিস্রস্ত, বোধকরি ভয়ঙ্কর সংবাদ শুনিবার সময় সে কেশ প্রসাধন করিতেছিল; অঙ্গে ওড়নি নাই, কেবল চোলি ও ঘাঘরি। সে ছুটিয়া আসিয়া মোবারকের মৃতদেহের পাশে ক্ষণেক দাঁড়াইল, ব্যাকুল বিস্ফারিত নেত্রে মোবারকের মৃত্যুস্থির মুখের পানে চাহিল, তারপর ছিন্নলতার মতো তাহার বুকের উপর আছড়াইয়া পড়িল। খ্বাজা নজর মোহগ্রস্ত মূকের মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন।
সুজা ঘোড়ার পৃষ্ঠ হইতে ঘাড় ফিরাইয়া এই দৃশ্য দেখিলেন; কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে পরীবানুর পানে চাহিয়া রহিলেন। সামান্য মানুষের গৃহেও এমন স্ত্রীলোক পাওয়া যায়? পানাপুকুরে মরালী বাস করে?
সুজার সমসাময়িক ইতিকার লিখিয়াছেন, চামেলির মতো ক্ষুদ্র বস্তু সুজার চোখে পড়িত না। আজ কিন্তু এই শিশির-সিক্ত চামেলি ফুলটি ভাল করিয়াই তাঁহার চোখে পড়িল। সন্ধ্যার ছায়ালোকে তিনি যখন দুর্গের দিকে ফিরিয়া চলিলেন, তখনও ঐ শোক-নিপীড়িতার যৌবনোচ্ছল লাবণ্য তাঁহার চিত্তপটে ফুটিয়া রহিল।
দুর্গের সিংহদ্বারে প্রবেশ করিতে সুজা বলিলেন, বুড়ো বান্দাটা পাথরের কারিগর মনে হল।
আলিবর্দি বলিলেন, হাঁ হজরৎ, আমারও তাই মনে হল। বলিয়া সুজার পানে অপাঙ্গে চাহিলেন।
সুজা চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া গণ্ডের স্ফীত কৃষ্ণবর্ণ আঘাত চিহ্নটার উপর অঙ্গুলি বুলাইলেন।
তাঁহার দৃষ্টি ছুরির নখাগ্রের মতো ঝিলিক দিয়া উঠিল।
পরদিন সন্ধ্যাকালে খ্বাজা নজরের গৃহে অনৈসর্গিক নীরবতা বিরাজ করিতেছিল। অন্তঃপুরে শব্দমাত্র নাই, যেন সেখানে মানুষ বাস করে না; পরীবানু শশাকের কোন্ নিগূঢ় গর্ভগৃহে আশ্রয় লইয়াছে। বাহিরের অঙ্গনও শূন্য নিস্তব্ধ; কেবল মোবারকের রক্তচর্চিত প্রস্তরপট্টের পানে চাহিয়া খ্বাজা নজর একাকী বসিয়া আছেন।
মোবারকের কফন দফন আজ প্রভাতেই হইয়া গিয়াছে। খ্বাজা নজর ভাবিতেছেন মোবারক নাই…কাল যে সুস্থ প্রাণপূর্ণ ছিল আজ সে নাই। বর্ষ কাটিবে, যুগ কাটিবে, পৃথিবী জীর্ণ হইয়া যাইবে, সূর্য ম্লান হইবে, চন্দ্র ধূলা হইয়া খসিয়া পড়িবে তবু মোবারক ফিরিয়া আসিবে না। এমন নিশ্চিহ্ন হইয়া কোথায় গেল সে? না, একেবারে নিশ্চিহ্ন নয়, ঐ যে পাথরের উপর তাহার শেষ মোহর-ছেপৎ রাখিয়া গিয়াছে…শুষ্ক রক্ত…পাথরে রক্তের দাগ কতদিন থাকে? ঘোড়ার খুরের শব্দে চোখ তুলিয়া খ্বাজা নজর দেখিলেন, কল্যকার একজন অশ্বারোহী আসিতেছে। তিনি ভাবিলেন, এ কে? সুলতান সুজা? মোবারক তাঁহার সহিত ধৃষ্টতা করিয়াছিল, সে ধৃষ্টতার ঋণ এখনও শোধ হয় নাই? তবে তিনি আবার কেন আসিলেন?
অশ্বারোহী কিন্তু সুজা নয়, আলিবর্দি খাঁ। আলিবর্দি অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া খ্বাজা নজরের পাশে আসিয়া বসিলেন এবং এমনভাবে তাহার সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিলেন যেন তিনি খ্বাজা নজরকে নিজের সমকক্ষ মনে করেন। সহানুভূতিতে বিগলিত হইয়া তিনি জানাইলেন, সুলতান সুজা কল্যকার ঘটনায় বড়ই মর্মাহত হইয়াছেন। অবশ্য তিনি যেভাবে অপমানিত হইয়াছিলেন। তাহাতে অপরাধীকে সবংশে বধ করিয়া তাহাদের দেহ কুকুর দিয়া খাওয়াইলেও অন্যায় হইত না; কিন্তু সুজার হৃদয় বড় কোমল, তিনি অন্যায় করেন নাই জানিয়াও কিছুতেই মনে শান্তি পাইতেছেন না। শোক-তপ্ত পরিবারের দুঃখ মোচন না হওয়া পর্যন্ত তাঁহার বুকের দরদও দূর হইবে না। সুলতান সুজা খবর পাইয়াছেন যে খ্বাজা নজর একজন প্রসিদ্ধ শিল্পী। সুজার ইচ্ছা সম্রাট হইবার পর নূতন সিংহাসনে বসেন; তাই তিনি অনুরোধ জানাইয়াছেন, খ্বাজা নজর যদি একটি মঙ্গলময় সিংহাসন তৈয়ারের ভার গ্রহণ করেন তাহা হইলে সুজা নিরতিশয় প্রীত হইবেন। পরম পরিমার্জিত ভাষায় এই কথাগুলি বলিয়া আলিবর্দি খাঁ এক মুঠি মোহর খ্বাজা নজরের পাশে রাখিলেন।
খ্বাজা নজরের মন তিক্ত হইয়া উঠিল; তিনি ভাবিলেন, ইহারা কি মানুষ! মোবারকের অভাব একমুঠি সোনা দিয়া পূর্ণ করিতে চায়! মুখে বলিলেন, শাহজাদার ইচ্ছাই আদেশ, সিংহাসন তৈরি করে দেব।
অতঃপর আরও কিছুক্ষণ মিষ্টালাপ করিয়া, তখত যত শীঘ্র তৈয়ারি হয় ততই ভাল, এই অনুজ্ঞা জানাইয়া আলিবর্দি খাঁ প্রস্থান করিলেন।
আসন্ন রাত্রির ঘনায়মান অন্ধকারে খ্বাজা নজর একাকী বসিয়া রহিলেন। কী নিষ্ঠুর ইহারা। অথচ ইহারাই শক্তিমান, ইহারাই সিংহাসনে বসে। ঈশ্বর ইহাদের এত শক্তি দিয়াছেন কেন? মোবারকের রক্তে যাহার হাত রাঙ্গা হইয়াছে আমি তাহারই জন্য মঙ্গলময় সিংহাসন তৈয়ার করিব! মঙ্গলময় সিংহাসন—তক্ত মোবারক!
ভাবিতে ভাবিতে খ্বাজা নজর রক্তলিপ্ত পাথরের দিকে চাহিলেন। মনে হইল, শ্বেত পাথরের উপর গাঢ় রক্তের দাগ যেন প্রায়ান্ধকারে জ্বলিতেছে। খ্বাজা নজরের দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, সূক্ষ্ম নাসাপুট ঘন ঘন ফুরিত হইতে লাগিল। তিনি অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করিলেন, তক্ত মোবারক—তক্ত মোবারক—তক্ত মোবারক–
ইহাই তক্ত মোবারকের ইতিহাস। কিন্তু আর একটু আছে। শুধুই রক্তমাখা পাথর এবং পিতার অভিশাপ লইয়া তক্ত মোবারক জন্মগ্রহণ করে নাই, তাহার উপর আরও গাঢ় পাপের প্রলেপ পড়িয়াছিল।
০৭.
তিন দিন পরে আলিবর্দি খাঁ আবার আসিলেন। খ্বাজা নজর অপরাহ্রে কারখানায় চালার নীচে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন; সিংহাসন প্রায় তৈয়ার হইয়াছে দেখিয়া আলিবর্দি খুশি হইলেন। কিন্তু আজ তিনি অন্য কাজে আসিয়াছিলেন, দুই চারিটি অবান্তর কথার পর কাজের কথা আরম্ভ করিলেন।
সুজার মনস্তাপ এখনও নিবৃত্ত হয় নাই। বস্তুত মোবারকের বিধবা কবিলার কথা স্মরণ করিয়া। তিনি মনে বড় কষ্ট পাইতেছেন; বিধবার মনে সুখ শান্তি ফিরাইয়া আনা তিনি অবশ্য কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেছেন। জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্রজাকে সুখী করাই রাজার ধর্ম। সুজা সদয় মনে ইচ্ছা করিয়াছেন যে মোবারকের কবিলা তাঁহার হারেমে আসিয়া বাস করুক; আরাম ও ঐশ্বর্যের মধ্যে থাকিয়া সে শীঘ্রই শোক ভুলিতে পারিবে। ইহাতে খ্বাজা নজরের আনন্দ হওয়া উচিত, এরূপ সম্মান অল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে। ইত্যাদি।
খ্বাজা নজরের বুকে বিষের প্রদাহ জ্বলিতে লাগিল। রাক্ষস-রাক্ষস এরা! মোবারককে লইয়াছে, এখন আমার ইজ্জত লইতে চায়। আমি কি করিতে পারি? না বলিলে জোর করিয়া লইয়া যাইবে। যাক—পরীকে লইয়া যাক। পরী আমার ঘরে কতদিনই বা থাকিবে? সে যুবতী, দুমাসে হোক ছমাসে হোক আর কাহাকেও নিকা করিয়া চলিয়া যাইবে। তার চেয়ে এখনই যাক—
মুখে বলিলেন, আমি দাসানুদাসরাজার যা ইচ্ছা তাই হোক।
আলিবর্দি অশ্বারোহণে ফিরিয়া গেলেন। সন্ধ্যার পর তিনটি ড়ুলি আসিয়া খ্বাজা নজরের বাড়ির সদরে থামিল। সঙ্গে কয়েকজন বরকন্দাজ। দুইটি ড়ুলি হইতে চারিজন বাঁদী নামিয়া খ্বাজা নজরের অন্দরে প্রবেশ করিল। কিছুক্ষণ পরে পরীবানু কাঁদিতে কাঁদিতে, চোখ মুছিতে মুছিতে বাঁদীদের সহিত বাহির হইয়া আসিল এবং ড়ুলিতে গিয়া বসিল। কানাৎ-ঢাকা তিনটি ড়ুলি বরকন্দাজ পরিবেষ্টিত হইয়া চলিয়া গেল।
রাত্রি হইল। খ্বাজা নজর কারখানা ঘরে আলো জ্বালিয়া কাজ করিতেছেন। তাঁহার দেহ নুইয়া পড়িয়াছে। বাটালি দিয়া সিংহাসনের গায়ে নাম খোদাই করিতেছেন আর মনে মনে চিন্তার অবশ ক্রিয়া চলিয়াছে—
মোবারকের বিবাহ…কতদিনের কথা? এইতো সেদিন…মুঙ্গের শহরে ১০৫২ সালের ২৭ শাবান তারিখে…দাসানুদাস খ্বাজা নজর বোখারী কর্তৃক…
ঠক্ ঠক্ করিয়া বাটালির উপর হাতুড়ির ঘা পড়িতেছে; খ্বাজা নজরের মন কখনও অতীতের স্মৃতিতে ড়ুবিয়া যাইতেছে, কখনও কঠিন নির্মম বর্তমানে ফিরিয়া আসিতেছে—মোবারকের বিবাহের তারিখের সহিত তাহার মৃত্যুর তারিখ মিশিয়া যাইতেছে—
মধ্যরাত্রি পর্যন্ত খ্বাজা নজর এইভাবে কাজ করিয়া চলিয়াছেন। যেমন করিয়া হোক আজই এই অভিশপ্ত সিংহাসন শেষ করিয়া দিতে হইবে। আর সহ্য হয় না—আর শক্তি নাই—
সিংহাসন দেখিয়া সুজা প্রীত হইলেন। দেখিতে খুব সুশ্রী নয়, কিন্তু কি যেন একটা অনৈসর্গিক আকর্ষণ উহাতে আছে। সুজা সিংহাসন লইয়া গিয়া দরবার কক্ষে বসাইলেন।
সন্ধ্যার সময় সভা বসিল। সুজা সিংহাসনের উপর মসলন্দ বিছাইয়া দুইপাশে মখমলের তাকিয়া লইয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন। সভাসদেরা সহর্ষে কেরামৎ করিলেন। বাঁদীদের হাতে হাতে শরাবের পেয়ালা চলিতে লাগিল।
হাস্য পরিহাস রসালাপ চলিতেছে এমন সময় গুরুতর সংবাদ আসিল। পাটনা হইতে জলপথে দূত আসিয়াছে; সে সংবাদ দিল, মীরজুমলা ত্রিশ হাজার সৈন্য লইয়া স্থলপথে আসিতেছেন, শীঘ্রই মুঙ্গের অবরোধ করিবেন।
শরাবের পাত্র হাতে লইয়া সুজা দীর্ঘকাল নীরব হইয়া রহিলেন। তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, আমি রাজমহলে ফিরে যাব। এখানে যুদ্ধ দেব না।
সকলে বিস্ময়াহত হইয়া চাহিয়া রহিলেন। এত আয়োজন এত পরিশ্রম করিয়া এ দুর্গ অজেয় করিয়া তোলা হইয়াছে, তাহা ছাড়িয়া পলায়ন করিতে হইবে?
সুজা কহিলেন, আমার মন বলছে বাংলা দেশে ফিরে যেতে। আপনারা বাড়ি যান, আজ রাত্রিটা বিশ্রাম করুন। কাল সকাল থেকেই রাজমহল যাত্রার আয়োজন শুরু করতে হবে।
সকলে অন্তরে ধিক্কার বহন করিয়া নীরবে প্রস্থান করিলেন। যাঁহারা সুজার বুলন্দ ইকবালের উপর এখনও আস্থাবান ছিলেন তাঁহারাও বুঝিলেন সুজার পুরুষকার মহত্তর পুরুষকারের নিকট পরাস্ত হইয়াছে।
সুজাও অবসাদগ্রস্ত মনে আবার সিংহাসনে বসিলেন। কক্ষে বাঁদীর দল ছাড়া আর কেহ ছিল না; তাহারা কেহ তাঁহার সম্মুখে পানপাত্র ধরিল, কেহ ময়ূরপঙ্খী পাখা দিয়া ব্যজন করিল, কেহ বা পদমূলে বসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতে লাগিল।
সুজা ভাবিতে লাগিলেন, ঔরংজেব আর মীরজুমলা! এই দুটা মানুষ তাঁহার জীবনের দুগ্ৰহ। ইহাদের নাম শুনিলেই তাঁহার মন সঙ্কুচিত হয়, নিজেকে ক্ষুদ্র বলিয়া মনে হয়, শক্তি অবসন্ন হয়। মীরজুল্লার বিশ মণ হীরা আছে, সে যুদ্ধ করিতে আসে কেন? ঔরংজেব তাঁহার ছোট ভাই হইয়াও তাঁহার মনে ভয়ের সঞ্চার করে কেন?
সুজার মনের আত্মগ্লানি ক্রমে জিঘাংসায় পরিণত হইতে লাগিল। কাহাকেও আঘাত হানিতে পারিলে গ্লানি কতকটা দূর হয়। চিন্তা কুঞ্চিত মুখে বসিয়া তিনি নিজ গণ্ডস্থল অঙ্গুলি দিয়া স্পর্শ করিলেন। গণ্ডের আঘাত চিহ্নটা প্রায় মিলাইয়া গিয়াছে, তবু একটু কালো দাগ এখনও আছে। মোবারকের ছিপের দাগ। বাঁদীর বাচ্চা! বদজাৎ কুত্তা! তাহার প্রতি সুজার আক্রোশ এখনও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয় নাই—প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ণাহুতি পড়ে নাই।
সুজা জিজ্ঞাসা করিলেন, কাল যে নূতন বাঁদীটা এসেছে তার কান্না থেমেছে?
একটি বাঁদী বলিল, এখনও থামেনি হজরৎ, তেমনি কেঁদে চলেছে।
নিরানন্দ হাস্যে সুজার দন্তপংক্তি প্রকট হইল। তিনি বলিলেন, তার কান্না আমি থামিয়ে দিচ্চি। তোরা যা, তাকে এখানে পাঠিয়ে দে।
বাঁদীরা চলিয়া গেল। তক্ত মোবারকের উপর অঙ্গ এলাইয়া দিয়া সুজা অর্ধশয়ান হইলেন, গালের চিহ্নটার উপর অঙ্গুলি বুলাইতে বুলাইতে নূতন বাঁদী পরীবানুর প্রতীক্ষ্ণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার চোখে কুটিল আনন্দ নৃত্য করিতে লাগিল।
পরীবানু সামান্যা নারী, খ্বাজা নজর বোখারী সাধারণ মানুষ, মোবারক হতভাগ্য স্বল্পায়ু যুবক; তাহাদের জীবন-মৃত্যু নিগ্রহ-নিপীড়ন হাসি-অশুর মূল্য কতটুকু? কেহ কি তাহা মনে করিয়া রাখে?
হে অতীত, তুমি মনে করিয়া রাখিয়াছ। যাহাদের কথা সকলে ভুলিয়াছে তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই, তোমার ভাণ্ডারে মানুষের সব কথা সঞ্চিত হইয়া আছে। তাই বুঝি বর্তমানের ললাটে তোমার অভিশাপের ভস্মটিকা দেখিতে পাইতেছি।
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪।