একটি স্মরণীয় দিন
পরদিন আমাদের আখ্যায়িকার একটি স্মরণীয় দিন; যদিও ইতিহাস উহা স্মরণ করিয়া রাখে নাই।
পূর্বাহে সুজা আলিবর্দি খাঁকে সঙ্গে লইয়া ঘোড়ার পিঠে পীর পাহাড় পরিদর্শনে বাহির হইলেন। পরিদর্শন কার্যে সুজা সাধারণ বেশবাস পরিয়াই বাহির হইতেন, সঙ্গে রক্ষী থাকিত না। কেবল খান্ ভাই আলিবর্দি খাঁ এই সকল অভিযানে তাঁহার নিত্যসঙ্গী ছিলেন।
আলিবর্দি খাঁ একজন অতি মিষ্টভাষী চাটুকার ছিলেন; তাঁহার চাটুকথার বিশেষ গুণ এই ছিল যে উহা সহসা চাটুকথা বলিয়া চেনা যাইত না। সুজা আখেরে দিল্লীর সম্রাট হইবেন এই আশায় তিনি সুজার সহিত যোগ দিয়াছিলেন। কিন্তু পরে যখন সে আশা আর রহিল না তখন তিনি সুজার সৈন্য ভাঙাইয়া লইয়া পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুজা তাঁহাকে ধৃত করিয়া প্রকাশ্যে তাঁহার মুণ্ডচ্ছেদ করাইয়াছিলেন। কিন্তু ইহা আরও কিছুদিন পরের কথা।
দ্বিপ্রহরে পীর পাহাড়ে পৌঁছিয়া সুজা কার্যাদি তদারক করিলেন। পীর পাহাড় শহরের পূর্বদিকে গঙ্গার সন্নিকটে গম্বুজাকৃতি একটি টিলা; স্বভাবতই সুরক্ষিত। তাহার শীর্ষদেশ সমতল করিয়া তাহার উপর আর একটি গম্বুজের মতো মহল উঠিতেছে। ইহা সুজার আতিখানা হইবে—গোলাবারুদ প্রভৃতি এখানে সঞ্চিত থাকিবে। টিলার চূড়া হইতে একটি কূপও খনিত হইতেছে; গঙ্গার স্রোতের সহিত তাহার যোগ থাকিবে।
আত্মরক্ষার বিপুল আয়োজন। শত শত মজুর রাজমিস্ত্রি ছুতার কাজ করিতেছে।
পরিদর্শন শেষ করিতে অপরাহু হইয়া গেল। সুজা ও আলিবর্দি খাঁ ফিরিয়া চলিলেন। ভাগ্যক্রমে আজ বালি উড়িতেছে না, খর রৌদ্রতাপে বাতাস স্তব্ধ হইয়া আছে।
অর্ধেক পথ অতিক্রম করিতে সুজা ঘর্মাক্ত কলেবর হইলেন, সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়াছে, মুখের উপর রৌদ্র পড়িয়া মুখ রক্তবর্ণ হইল। শহরের উপকণ্ঠে যখন পৌঁছিলেন তখন তৃষ্ণায় তাঁহার গলা শুকাইয়া গিয়াছে।
একটি নিম্নশ্রেণীর লোক অপর্যাপ্ত তাড়ি সেবন করিয়া মনের আনন্দে পথের এধার হইতে ওধার পরিভ্রমণ করিতে করিতে চলিয়াছিল। সুজা ঘোড়া থামাইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানে কোথায় পানীয় পাওয়া যায় বলতে পার?
পথিক হাস্যবিম্বিত মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ঐ যে পূরব সরাই, ঐখানে ঢুকে পড়ন, দেদার তাড়ি পাবেন। বলিয়া প্রসন্ন একটি হিক্কা তুলিয়া প্রস্থান করিল।
আলিবর্দি খাঁ ও সুজা দৃষ্টি বিনিময় করিলেন। সুজা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, আসুন খান্ ভাই, এদেশের খাঁটি জিনিস চেখে দেখা যাক।
পূরব সরাই নেহাৎ নিম্নশ্রেণীর পানশালা নয়; তবে গ্রীষ্মকালে এখানে তাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। স্বত্বাধিকারী একজন মুসলমান; দুইজন ফৌজী সওয়ারকে পাইয়া সে সাদরে তাহাদের অভ্যর্থনা করিল। সুজা পুদিনার আরক-সুরভিত তাড়ি ফরমাস দিলেন।
নূতন মাটির ভাঁড়ে শুভ্রবর্ণ পানীয় আসিল। উভয়ে পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিলেন। শুষ্ককণ্ঠে নূতনতর পানীয় মন্দ লাগিল না। তারপর সরাইওয়ালা যখন এক রেকাবি ঝাল-মটর আনিয়া উপস্থিত করিল, তখন সুজা আবার পানীয় ফরমাস করিলেন।
ঝাল-মটর সুজার বড়ই মুখরোচক লাগিল। এরূপ প্রাকৃতজনোচিত আহার্য পানীয়ের আস্বাদ সুজা পূর্বে কখনও গ্রহণ করেন নাই, তিনি খুব আমোদ অনুভব করিলেন। পানীয়ের দ্বিতীয় পাত্রও ঝাল-মটর সহযোগে শীঘ্রই নিঃশেষিত হইল।
কোমরবন্ধের তরবারি আম্মা করিয়া দিয়া সুজা তৃতীয় কিস্তি পানীয় হুকুম করিলেন। আলিবর্দি খাঁর দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, কী খান্ ভাই, কেমন লাগছে?
খান্ ভাই মাথা নাড়িয়া মোলায়েম ভসনার সুরে বলিলেন, হজরৎ, আপনি গরিবের ফুর্তির দাম বাড়িয়ে দিলেন।
এক ঘড়ি সময় কাটিবার পর সুজা ও আলিবর্দি যখন সরাইখানা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন তখন তাঁহাদের মনের বেশ আনন্দঘন অবস্থা। উভয়ে আবার ঘোড়ার উপরে উঠিয়া যাত্রা করিলেন।
কিন্তু বেশি দূর যাইবার আগেই তাঁহাদের গতি ভিন্নমুখী হইল। আরোহীদ্বয়ের তৃষ্ণা নিবারণ হইয়াছিল বটে কিন্তু ঘোড়া দুটি তৃষ্ণার্তই ছিল; তাই চলিতে চলিতে পথের অনতিদূরে একটি জলাশয় দেখিতে পাইয়া তাহারা হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল এবং বৰ্গর শাসন উপেক্ষা করিয়া সেই দিকে চলিল। সুজা ঘোড়ার মুখ ফিরাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ঘোড়া বাগ মানিল না। তখন তিনি আর চেষ্টা না করিয়া লাগাম আগা করিয়া ধরিলেন।
কিন্তু দীঘির তীরে পৌঁছিয়া আবার তাঁহাকে দৃঢ়ভাবে রাশ টানিতে হইল। দীঘির পাড় বড় বেশি ঢালু, ঘোড়া নামিবার সুবিধা নাই; একটি সঙ্কীর্ণ ঘাট আছে বটে কিন্তু তাহার ধাপগুলি এতই সরু এবং উঁচু যে ঘোড়া সেপথে অতিকষ্টে নামিতে পারিলেও উঠিতে পারিবে না। সুজা ও আলিবর্দি খাঁ দ্বিধায় পড়িলেন। ঘোড়া দুটি জলের সান্নিধ্যে আসিয়া আরও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।
একটি লোক জলের কিনারায় বসিয়া নিবিষ্টমনে ছিপ দিয়া মাছ ধরিতেছিল; ঘাটে বা দীঘির আশেপাশে আর কেহ ছিল না। তাহার পিছনে পাড়ের উপর সুজা ও আলিবর্দি খাঁ উপস্থিত হইলে সে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিয়া আবার মাছ ধরায় মন দিয়াছিল; ফৌজী সওয়ার সম্বন্ধে তাহার মনে কৌতূহল ছিল না।
এদিকে সুজার মনের প্রসন্নতাও আর ছিল না। ঘোড়ার ব্যবহারে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন; পুকুর পাড়ে ঘোড়ার জলপানের কোনও সুবিধাই নাই দেখিয়া তাঁহার বিরক্তি ক্রমে ক্রোধে পরিণত হইতেছিল। তার উপর ঐ লোকটা নির্বিকারচিত্তে বসিয়া মাছ ধরিতেছে, তাঁহাকে সাহায্য করিবার কোনও চেষ্টাই করিতেছে না। দিল্লীর ভবিষ্যৎ বাদশাহ শাহজাদা আলমের ধৈর্য আর কতক্ষণ থাকে? তিনি কর্কশকণ্ঠে মৎস্যশিকাররত লোকটিকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, এই বান্দা, পুকুরে ঘোড়াকে জল খাওয়াবার কোনও রাস্তা আছে?
মৎস্যশিকারী মোবারক। সম্বােধন শুনিয়া তাহার রক্ত গরম হইয়া উঠিল। কিন্তু এই অশিষ্ট দায়িত্বহীন সিপাহীগুলার সহিত কলহ করিয়া লাভ নাই, তাহাতে নিগ্রহ বাড়িবে বৈ কমিবে না। বিশেষত মোবারক নিরস্ত্র। সে আর-একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিয়া আবার ফানার উপর চোখ রাখিল।
সুজা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। অবহেলায় তিনি অভ্যস্ত নন; তাই তিনি যে ছদ্মবেশে আছেন সেকথা ভুলিয়া গিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, আরে বাঁদীর বাচ্চা! তুই কানে শুনতে পাস না? বমিজ, এদিকে আয়।
ইহার পর আর চুপ করিয়া থাকা যায় না। মোবারক আরক্ত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল, ছিপটা হাতে তুলিয়া পাড় বাহিয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ঘোড়ার সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সুজার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর অধাবরুদ্ধ ক্রোধের স্বরে বলিল, বাঁদীর বাচ্চা তুমি। তোমার শরীরে ভদ্র রক্ত থাকলে ভদ্রভাবে কথা বলতে।
আলিবর্দি একেবারে হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, বেয়াদব যুবক! তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ জানো? উনি সুলতান সুজা।
নাম শুনিয়া মোবারকের বুকে মুগুরের ঘা পড়িল। সে বুঝিল তাহার জীবনে এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু তবু এখন ভয়ে পিছাইয়া যাইতে সে ঘৃণাবোধ করিল। অকারণ লাঞ্ছনার গ্লানি তাহার আরও বাড়িয়া গেল; নীচ শ্রেণীর লোকের মুখে ইতর ভাষা বরং সহ্য হয় কিন্তু বড়র মুখে ছোট কথা দ্বিগুণ পীড়াদায়ক। মোবারকের মুখে একটা ব্যঙ্গ বঙ্কিম বিকৃতি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, সুলতান সুজা ছোট ভাইয়ের কাছে যুদ্ধে মার খেয়ে এখন নিরস্ত্রের ওপর বাহাদুরী দেখাচ্ছেন!
সুজার অন্তরে যে-গ্লানি প্রচ্ছন্ন ছিল, যাহার ইঙ্গিত পর্যন্ত করিতে ওমরাহেরা সাহস করিতেন না, তাহাই যেন শ্লেষের চাবুক হইয়া তাঁহার মুখে পড়িল। আর তাঁহার দিগবিদিক জ্ঞান রহিল না, উন্মত্ত রোষে তরবারি বাহির করিয়া তিনি মোবারকের পানে ঘোড়া চালাইলেন।
গোস্তাক। বদ্বখ্ত—।
ইতিমধ্যে ভোজবাজির মতো কোথা হইতে অনেকগুলি লোক আসিয়া জুটিয়াছিল, তাহারা সমস্বরে হৈ হৈ করিয়া উঠিল। কেহ বা মোবারককে পলায়ন করিবার উপদেশ দিল; মোবারক কিন্তু এক পা পিছু হটিল না। ঘোড়া যখন প্রায় তাহার বুকের উপর আসিয়া পড়িয়াছে তখন সে একবার সজোরে ছিপ চালাইল। ছিপের আঘাত শপাৎ করিয়া সুজার গালে লাগিল।
সুজাও বেগে তরবারি চালাইলেন। মোবারকের গলদেশে তরবারির ফলা বসিয়া গেল। সে বাঙনিষ্পত্তি না করিয়া মাটিতে পড়িল।
কয়েক মুহূর্ত পূর্বে যাহা চিন্তার অতীত ছিল, অতি তুচ্ছ কারণে অকস্মাৎ তাহাই ঘটিয়া গেল।