Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

-“লাগছে। “
-“লাগে নাই! লাগে নাই! “
-“আমি নিজের চক্ষে দেখছি, কইতাছি লাগছে! “
-“কইলাম যে লাগে নাই , শালা কানা! “
-“তুই কানা! তোর বাপ কানা! “
-“বাপ তুইলা কথা কবি না, এক্কেরে পুঁইতা ফেলামু! “
-“আমারে পুঁতবি! দেখবি শালা ! “
নন্দু আর ভোটকা, গায়ের জোরে কেউ কম যায় না। কেউ কাউকে ছাড়বে না। পাশে দাঁড়িয়ে আরো চারজন ছেলে সকলেরই উদোম গা, শিকোই দিয়ে বাঁধা হাফপ্যান্ট । ওরা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ষাঁড়ের লড়াই দেখার মত আনন্দ !

ভোটকাকে মাটিতে ফেলে ওর বুকের উপরে চড়ে বসলো নন্দু। চলছে ইচ্ছে মত ঘুসি। ভোটকা নিজেকে প্রাণপণে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। দুজন  মহিলা   জ্বালানি কুড়িয়ে আঁটি মাথায় নিয়ে দায়সারা বকাঝকা করে চলে গেল ।

ভোটকার অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় হয়ে উঠছে। যারা এতক্ষণ ষাঁড়ের লড়াই দেখছিল, ওরাই এগিয়ে গিয়ে ছাড়িয়ে দিল।

নন্দুর গায়ে অসুরের মত শক্তি!  কোথা থেকে যে আসে এত শক্তি ! ঐ তো হাড়জিরজিরে শরীর! দুবেলা ঠিকঠাক খাবার জোটে না। নন্দুর মা বাতাসী ক্ষেত খামারে কাজ করে। বাপটা সেই যে কবে বিদেশ গেল। লোকেরা নন্দুকে বলেছে – “তর বাপে আবার বিয়া করছে রে । “

নন্দুর বাপের কথা তেমন মনে পড়ে না। শুধু টুকরো কতগুলো ছায়া চোখে ভাসে।

নন্দুর বাপের একখানা ভাঙাচোরা সাইকেল ছিল । এখন সেটার মালিক নন্দু নিজে। আরও ভালো করে বলতে হলে ওটা নন্দুর পঙ্খীরাজ ঘোড়া। ওটাকে বিভিন্ন কায়দায় চালাতে পারে নন্দু – কখনো দুহাত বুকের কাছে জড়ো করে শুধু প্যাডেল ঘোরায়। কখনো সামনের চাকাটাকে উপরের দিকে তুলে রেখে সাইকেলটাকে গোল গোল ঘোরায়, কখনোবা পাখির মত দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে রাখে । আরও আছে নানা রকম কসরত। ছোট ছেলেরা কসরত দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

তলপেটটা একটু ব্যাথাব্যাথা করছে। সাইকেল থামিয়ে রাস্তার ধারে একটু হাল্কা হয়ে নিল। গেল শ্রাবন থেকেই ঘরটা একদিকে হেলে গেছে । ঘরের উঁচু নিচু বারান্দায় পলিথিন দিয়ে ঘেরা রান্নার জায়গা।  আগে প্রায় তিন কাঠা জমি ছিল নন্দুদের। নন্দুর বাবা দেড় কাঠা জমি বিক্রি করছে। এখন দেড় কাঠা জমির উপর নন্দুদের ঘরটা ছাড়া আর একফালি উঠোন আছে।

ঘরে ঢুকে খাবার খুঁজছিল। কোণা ভাঙা  হাঁড়ির নিচে পড়ে আছে দুমুঠো ভাত। আর হাড়ির উপরই একটা বাসনে লাফা শাকের ঝোল। খুব খিদে পেয়ে গেছে।  বাজি ধরে গুলতি খেলার নেশায় দুপুরের ভাতটাও খাওয়া হয়নি। বাজি হেরে গিয়ে এখন খিদেয় পেট চড়বড় করছে। হাঁড়ি থেকে ভাত তুলতে গিয়ে কচকচ করে উঠলো । হাঁড়ির নিচের ভাতে কুচো পাথর।

দু গরাস ভাত মুখে তুলতেই মুখটা কেমন বিস্বাদে ভরে গেল। কেমন যেন তেতো তেতো! নুনের ডিবা থেকে কিছুটা নুন এঁটো হাতেই তুলে নিয়ে ভাতে  মেখে আরও দু গোরস ভাত মুখে ঢুকলো নন্দু । নাহ্, আর ঢুকছে না।  কলপাড়ের একচিলতে রোদে বসেছিল ম্যাঁও পুষি । ওর সামনে ভাতটা উপুর করে দিল। ও শুঁকে শুঁকে সরে এল। যেমন তেমন রোচে না!

আরে ওইটা প্যাঁচা না! কি নিয়া যায়!
—“ওই প্যাঁচা.আআ…….. কি রে ওইটা? “
খিলখিল করে হেসে উঠলো প্যাঁচা।
–“খাবি? “
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নন্দুর মুখ।
— “খামু। মা রে কইস না।”
প্যাঁচা একটা বনবিড়াল শিকার করে এনেছে। আজ ওটা দিয়ে মহাভোজ হবে।
হাতে হাতে পেঁয়াজ রসুন ছুলে দিচ্ছে নন্দু। বারবার চোখ মুছছে, নাক টানছে । প্যাঁচাদের বাড়ির পিছনে পেয়ারা গাছের নিচে তিনটে ইট পেতে উনুন তৈরি হয়েছে। একটা বস্তা এনে  বিছিয়ে দিয়েছে ।    কি যেন একটা এনে বস্তার নিচে লুকিয়ে রাখলো প্যাঁচা । নন্দু আড়চোখে দেখতে দেখতে একসময় হাতটা বাড়িয়ে দিল। দাঁত খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো প্যাঁচা । 
——–“ভাগ শালা! হাত দিলে হাত কাইটা ফেলামু !  “

নন্দু আবার আপন মনে রসুনের কোয়া ছাড়াতে লাগলো। কসানো মাংস কড়াই থেকে নিয়ে বেশ আয়েস করে বসেছে প্যাঁচা। লুকিয়ে রাখা বোতলটারও ছিপি খুলে নিয়েছে। নন্দু অবাক হয়ে দেখে। দু টুকরো কষানো মাংস নন্দুর কপালেও জুটলো। প্যাঁচা আজকে খুব খুশি, উদার মন। হাসতে হাসতে নন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল -” তুই ভাত খা “।

টলতে টলতে উঠে অনেকটা মাংস আর ভাত বেড়ে দিল নন্দুকে। নন্দু ভীষণ খুশি। জিভ থেকে পড়ে যেতে থাকা লালাটাকে কোনরকমে সামলে নিল।

নন্দু ভাত খেয়ে উঠতে না উঠতেই প্যাঁচা নন্দু কে বলল -” তুই থাক, আমি আসতাছি । “

নন্দুর মনে অনেক প্রশ্ন এলেও মুখে কিছু বলল না। সাইকেল নিয়ে হুস করে বেড়িয়ে গেল প্যাঁচা। নন্দু আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না। ও – ও পঙ্খিরাজকে উড়িয়ে দিল হাওয়ায়।

ঠিক টিনুদার বাড়ির সামনে গিয়ে সাইকেলটাকে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখে রমারম টিনুর পিসির ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লো প্যাঁচা, নিশাচর!

টিনুর পিসি পুইট্টাদি । ওটাই নাম। ছোট বড় সকলেই এক নামে চেনে। যার দিদি সেও দিদি বলে, যার মাসি সেও দিদি বলে। সাড়ে তিন ফুট মতন উচ্চতার কারনে ওর নাম পুইট্টা। বিয়ে থা হয়নি।

পাটকাঠির বেড়া ফাঁকা করে ঘরের ভিতরে চোখ রাখলো নন্দু। ভিতরে আলো নেই, শুধু ছায়ার ওঠানামা আর বিরক্তির কন্ঠ।
— ” ছাড় ছাড়! মুখে গন্ধ কয়!… “

সকাল বেলা রোদে বসে ঝিমােচ্ছে প্যাঁচা। চোখ দুটো লাল লাল। নন্দু পাশে গিয়ে বসল। প্যাঁচা নন্দুর থেকে বয়সে অনেকটা বড়। প্যাঁচার দুই দশ দুই   আর নন্দুর একদশ দুই । তবুও নন্দু কোনদিন প্যাঁচাকে দাদা বলে ডাকেনি। আজ নরম সুরে বলল – “প্যাঁচাদা কাইলকা কই গেছিলা?”
প্যাঁচা ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। নন্দু হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে, অস্ফুটে বলে —   “আমি দেখছি। “

প্যাঁচার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
— “কি দেখছস?”
নন্দু শুধু হাসে। রহস্যের হাসি। চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল প্যাঁচার।
”  কাউরে কিচ্ছু কবি না!কইলে….”
ঘাড় থেকে প্যাঁচার হাত সরিয়ে দিয়ে নন্দু অভয় দেয় — “না না, আমি কাউরে কিচ্ছু কমু না। তুমি কি ডেলি যাও? “
— – “হুসসস্, পঞ্চাশ টাকা দিতে লাগে। যেদিন যেদিন টাকা থাকে। “
— “মুটে পঞ্চাশ টাকা! “

—” ক্যান রে?  তর ও লাগবো নাকি? “
হিহিহি…………
প্যাঁচা অসুরের মত হেসেই চলেছে। কত আমোদ! দাঁতের কালো কালো ছোপ গুলো খুব বেশি করে দেখা যাচ্ছে এখন।
নন্দুর মাথায় রক্ত উঠে গেল! এত হাসির কি আছে! কি ভেবেছে টা কি ও নন্দুকে! নন্দুর কি কোন ক্ষমতা নেই! না, এই অপমানের  প্রতিবাদ না করলেই নয়। প্যাঁচা ভাবে কি নিজেকে! পুরুষ কি সে একাই!

আবার ছুটলো পঙ্খিরাজ! জোরে , খুব জোরে। একেবারে রতনদার চা মিষ্টির দোকানের সামনে। আজ রবিবার। রতনদার দোকানের খুব নাম। দোকানটা ঝকঝকে তকতকে। খাওয়াটা হলো শান্তির ব্যাপার, তৃপ্তির ব্যাপার। প্রতি সপ্তাহে রতনদার দোকানের মিষ্টির কড়াই, পরোটা ভাজার তাওয়া আরও যা যাবতীয় রান্নার বাসন সব ঐ হাটখোলার পাশের পুকুরে ডুবিয়ে মেজে আনে নন্দু। বদলে ত্রিশ টাকা আর মিষ্টির সিরা দিয়ে পাউরুটি।

আজ দোকানের ঝুলটুলও ঝেড়ে দিল নন্দু। সব ঝকঝক তকতক করছে। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা।

হাত কাঁপছে। সাইকেলটাকে ঝোপের আড়ালে রেখে দরজায় তিনটে টোকা দিল নন্দু। প্যাঁচাও তো তিনটে টোকাই দিয়েছিল! দরজাটা একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। এবারে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না নন্দু। কিভাবে শুরু করতে হবে! হাত পা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। গলা  শুকিয়ে কাঠ!

হঠাৎ কুপিটা জ্বলে উঠলো।
নন্দুর চোখের সামনে কুপি এগিয়ে নিয়ে পুইট্টা চোখ দুটো বড় বড় করে -” কেড়া তুই?  নন্দু নাকি! তর মায়ে পাঠাইছে বুঝি?  “

— – “হু, হ হ, না টিনুদারে খুঁজতে আসছি “

— “হগগলে ঘুমায়া পড়ছে। তুমি ঘুমাও নাই ক্যান?  যাও যাও, বাড়ি যাও। তুমার মায়ে চিন্তা করবো নে। “

নন্দু ধীর পায়ে চলে আসতে আসতে ফিরে তাকালো আরেকবার । ঠিক মায়ের মত! মা যখন খুব গরম পড়ে তখন এমনি করে সায়া ব্লাউজ ছাড়া শুধু শাড়িটাকে পেঁচিয়ে রাখে গায়ে। মায়ের গায়ের সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কি সুন্দর গন্ধ!

নন্দুর খুব পেট ব্যাথা। কতবার যে যেতে আসতে হচ্ছে। টিউবওয়েলে জল থাকে না। তাই একটা বালতিতে জল তুলে রেখেছে বাতাসী। শ্যাওলা জমে সবুজ হয়ে যাওয়া ঘটিটাতে এবারে আর জল ভরে নিয়ে যাওয়ার সময়টাও নেই। বিছানায় শুতে গিয়ে আবার দৌড়াতে হয়। সকাল হতে না হতেই বাতাসী ছুটলো জলকষা আনতে। বাতাস লেগেছে। কচি ছেলে কোথায় কোথায় দৌড়ে বেড়ায়!

একটু বেলা বাড়তে এল চিত্তর দোকানের হোমিওপ্যাথি মিষ্টি গুলি। চিত্ত ডাক্তার পান চিবাতে চিবাতে বলল -” যদি সম্ভব হয় তাইলে একটু ডাবের জল খাওয়াবা। “

নন্দুর  চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এর মধ্যে যে দুটো প্যান্ট ছিল তাও নোংরা হয়ে গেছে। এবারে গামছা পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। গামছাটাও জোরে গিঁট দেওয়া যাচ্ছে না, তাতেও পেট ব্যথা বাড়ে। বাতাসী এরতার বাড়িতে ডাব চাইতে গেল। কেউ দিলে না। কারোর আবার গাছ এতো উঁচুতে যে ডাব পাড়ার লোক নেই। নন্দুই তো সারা পাড়ায় এরতার বাড়িতে সুপারি পাড়ে, নারকেল গাছ পরিস্কার করে । আজ আর কে দেবে পেড়ে?

গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগলো!

“বাতাসী…. ও বাতাসী……. পুলাডাল শৈল খারাপ শুনলাম! এই নে, ডাব নিয়া আইছি। খুব কষ্ট কইরা পাড়ছি রে, বড় কুটা নাই। পড়শু দিন ছেড়াডা গেছিল আমাগো বাড়ি। তহনই দেখছি মুখটা কেমন শুকনা শুকনা! “
নন্দুর খুব জ্বর জ্বর লাগছে। গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। নন্দু তাড়াতাড়ি কাঁথা দিয়ে মাথা ঢেকে নিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *