ডাক্তার বাবু
“ডাক্তার বাবু ,আপনি আমার ছেলেটাকে বাঁচান” ।
ডাক্তারবাবুর হাত দুটো ধরে বলল শিশু সন্তানটির বাবা।
বাবার দুচোখে তখন জলের ধারা নেমে এসেছে।
ডাক্তারবাবু চোখ তখন তোর টেবিলের ওপরে ল্যাপটপে।
ওই শিশুটির জন্মগত হার্টের ত্রুটিগুলোর নানা বিষয় পর্যালোচনা করছেন তিনি।
জন্ম থেকেই হার্টের ভালবে ফুটো থাকায় অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণে শিশুটির প্রাণ সংশয় হয়েছিল আর মুখমন্ডল নীল হয়ে যাচ্ছিল। বুকটা অস্বাভাবিক রকম ফুলে ছিল,শ্বাস প্রশ্বাসের গুরুতর সমস্যায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল শিশুটি।
কলকাতায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, ওইটুকু ছোট শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। তবে অত ছোট শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং মারাত্মক, সার্ভাইভাল চান্স খুব কম, তাই বেশিরভাগ ডাক্তার বাবুই অত ছোট শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি করতে অসম্মত হয়েছিলেন।
অগত্যা শিশুটির বাবা মা তাকে নিয়ে এসেছেন দক্ষিণ ভারতের নামকরা হৃদরোগ চিকিৎসার হাসপাতালে। এখানকার ডাক্তারও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছেন যে শিশুটির হার্টের ওপেন সার্জারি করতে হবে এবং সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তার কারণ এই সার্জারিতে ওই শিশুটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে মাত্র কুড়ি শতাংশ আর না বাঁচার সম্ভাবনা আশি শতাংশ।
এরপরই ওই হাসপাতালের হৃদরোগের অন্যতম প্রধান শল্যচিকিৎসক ডাক্তার জগন্নাথনের চেম্বারে গিয়ে তার হাত ধরে শিশুটির বাবা কেঁদে পড়েছিলেন।
ডক্টর জগন্নাথন শিশুটির বাবার ওই অবস্থা দেখে শিশুটির বাবাকে স্থির থাকতে বললেন আর বললেন, ঠিক আছে , আপনি যখন এইরকম ভাবে অনুরোধ করছেন তখন,আমি একবার চেষ্টা করে দেখি ,তবে ফলাফল সম্বন্ধে এখন কিছু বলতে পারব না ,আমরা চেষ্টা করতে পারি, বাকিটা উপরওয়ালার হাত।
দুদিন পর সকাল বেলায় শিশুটিকে ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে আর ওই ঘরের বাইরে সিড়িতে বসে রইল ছেলেটির বাবা, মাথায় একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে।
দীর্ঘ আটঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের দরজা খোলা হল, ছেলেটিকে লাইভ সাপোর্ট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল আইসিইউ রুমে।
এরপর ডাক্তার জগন্নাথন ক্লান্ত দেহে অপারেশন থিয়েটার থেকে বার হলে ছেলেটির বাবা একরকম ছুটতে ছুটতে গিয়ে ডাক্তার বাবুর সামনে গিয়ে বললেন,’ ডাক্তারবাবু অপারেশন সফল হয়েছে তো?’
ছেলেটির বাবাকে আশ্বস্ত করে বললেন ডক্টর জগন্নাথন বললেন,’অপারেশন সাকসেসফুল, তবে এখনো অনেকটাই ঝুঁকি আছে। এখন শিশুটি আইসিইউতে থাকবে ,তারপর অবস্থার উন্নতি হলে সেমি আইসিউতে, এরপর অবস্থার উন্নতি হলে জেনারেল বেডে দেওয়া হবে।’
‘আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ,এখন বাকিটা উপরওয়ালার হাতে ,’ডঃ জগন্নাথন বললেন।
‘আপনিই আমার কাছে উপরওয়ালা ,আমার কাছে দেবতা, ঈশ্বর বা উপরওয়ালা বা জেসাস খ্রাইস্ট বা আল্লা যিনি হোন না কেন, আমি আপনার মধ্যেই তাঁকে দেখতে পাচ্ছি ,’শিশুটির বাবা বলে উঠল।
‘আরে না না,আমরা অত কিছু না, ডাক্তারবাবুরা চেষ্টা করেন, বাঁচা -মরার ভার উপরওয়ালার ওপর।’এই কথা বলে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন আই সি ইউর দিকে।
সেদিকে তাকিয়ে গভীর কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে রইল শিশুটির বাবা ।
হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে ভাড়া করা ঘরে এসে, শিশুটির বাবা দেখল তার স্ত্রী ঠাকুরের ছবির সামনে স্থির হয়ে হাতজোড় করে বসে আছে,দুচোখ দিয়ে জলের ধারা পড়ে গালের ওপর শুকিয়ে গেছে,দেখেই মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছুই মুখে দেয়নি।
শিশুটির বাবা তার স্ত্রীকে বলল,’ একজন ডাক্তার রূপে ভগবান আজ আমাদের ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, ওঠো, ভগবান আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন, এখনও নানা রূপে ভগবান আছেন, তার মধ্যে একটা রূপ হল ডাক্তার, যদিও অনেক ডাক্তারই আছেন যাদের কাছে অর্থ আরো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাটাই বড়, রোগীকে নানাভাবে হয়রান করেন , চিকিৎসার জন্য রোগীরা সর্বস্বান্ত হন। কিন্তু এখনও অনেক অনেক ডাক্তার বাবু আছেন, মানুষের সেবা, মানুষকে সুস্থ করে তোলা, মানুষকে বাঁচানো তাঁদের ব্রত বলে মনে করেন, আর রোগী আর তার পরিবারের সদস্যরা তো ডাক্তার বাবুর কাছ থেকে সেই রকমই আশা করেন।
আজ যে ডাক্তার বাবু, ডক্টর জগন্নাথন আমাদের ছেলের ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন, উনি সেই রকম ডাক্তার বাবু যার কাছে রোগীকে সুস্থ করে তোলাই প্রধান লক্ষ্য অন্য কিছুর থেকে, আর তিনি আমাদের কাছে ভগবান স্বরুপ। তাই স্বয়ং ভগবান যখন আমাদের সাথে আছেন, তখন আর চিন্তা কোরো না, সবকিছুই ঠিক হয়েছে । আমাদের ছেলের ওপেন হার্ট সার্জারি সফল হয়েছে ,ওকে এখন আইসিইউতে রাখা হয়েছে এরপর সেমি আইসি ইউ তারপর নরমাল বেড,তারপর হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেবে। ডক্টর জগন্নাথন নিজে আমাকে এই কথা বলেছেন। আমরা আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু ডক্টর জগন্নাথনের মতন অনেক ডাক্তারবাবু আছেন যাদের চিকিৎসায় আর উপরওয়ালার আশীর্বাদে মানুষ অনেক কঠিন আর দুরারোগ্য রোগ থেকে সুস্থ হয়ে যায়। ডক্টর জগন্নাথনের মতন ডাক্তারদের সেবামূলক মনোভাব আর রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য আন্তরিক চেষ্টা সত্যিই ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান অনেক বাড়িয়ে দেয়।
আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের ছেলের হার্টের অপারেশন এইরকম একজন ডাক্তার বাবু করেছেন আর সেই জন্যই আমাদের ছেলের আজ সফল অপারেশন হয়েছে।
তাই আজ আমাদের ছেলের সফল অপারেশনের জন্য এসো আমরা বলি, জয় ডাক্তারবাবুর জয়, জয় ভগবানের জয়।’