গুঁফো গনশা বলিয়ে কইয়ে মানুষ
গুঁফো গনশা বলিয়ে কইয়ে মানুষ। বক্তৃতার শেষ দিকটায় সে আক্ষেপ করে বলল, “ভাল কোচিংয়ের অভাবেই আমরা এইসব অনুপ্রবেশকারী লুঠেরাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছি না। আমাদের প্রতিভা কিছু কম নেই, সাহস বা সংযমেরও অভাব নেই। ভাল ফরেন কোচ পেলে আমরা এলাকায় এখনও আধিপত্য করতে পারি। হ্যাঁ, আর দরকার হল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, আর ভাল নেটওয়ার্ক।”
মারকুটে মহেশ ঝাঁকি মেরে উঠে দাড়িয়ে বলল, “ফরেন কোচের কোনও দরকার নেই, আমার গুরু জটাবাবা কি খারাপ কোচ ছিল ? এমন মুষ্টিযোগ, এত প্যাচপয়জার জানত যে, লোকে নামই দিয়েছিল ‘জাদুকর জটাই’, ভারতীয় যোগবিদ্যাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
এই কথায় চাকু চপল আপত্তি করে বলল, “ওসব পুরনো যোগবিদ্যা এযুগে চলে না মশাই। এ হল কম্পিউটার, লেজার, স্ট্রেসারের যুগ, এ কে ফর্টি সেভেনের সামনে তো আর প্রাণায়াম দিয়ে লড়া যায় না। গোবিন্দদা ঠিকই বলেছে, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না হলে ওই রাখালহরির কাছে মুচলেকা দিয়ে এই এলাকায় বসবাস করতে হবে। যাকে বলে সেকেন্ড গ্রেড সিটিজেন।”
হাড়ভাঙা হারাধনের ডেরায় কাল রাতেই হানা দিয়ে রাখালহরি, তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, বুকে এ কে ফর্টি সেভেনের নল ঠেকিয়ে কান ধরে ওঠবস করিয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় এখনও তার চোখ ছলছল করছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলল, “আমি যদিও সনাতন পন্থাতেই বিশ্বাস করি, এবং জানি, আমাদের শিক্ষক ও ওস্তাদরা নানা গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তবু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, রাখালহরির বিদেশের ট্রেনিং থাকায় তার সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, প্রথম জীবনে কুঠিবাড়ি লুট করে সে চিনে চলে গিয়েছিল। সেখানে কয়েক বছর চিনা কোচের কাছে প্রশিক্ষণ পায়। এই যে কাল রাতে সে আমার ছাউনিতে চড়াও হল, তার মোডাস অপারেন্ডি আমরা ধরতেই পারলাম না। ছাউনির চারদিকে শক্ত পাহারা ছিল, তবু সে কী করে যে ব্লিৎস ক্রিগ করে অত লোককে বোকা বানিয়ে অস্ত্র কেড়ে নিল, তা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। একথা ঠিক যে, আমি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছেই পরাজিত হয়েছি, কিন্তু ভাববার বিষয় হল, আমাদের মান উন্নত না করলেও আর চলছে না।”
জঙ্গলের পাশেই নদী, নদীর ধারের বালির চরে বড় বড় উনুনে বিরিয়ানি আর মাংস রান্না হচ্ছে। সঙ্গে স্যালাড, পাঁপড় ভাজা, দই আর মিষ্টি। ভোজ দিচ্ছে প্রহ্লাদ। লেঠেল ললিত রান্নার তদারকি সেরে এসে কোমরের গামছায় হাত মুছে বলল, “মিটিঙে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটাই আমরা মেনে নেব বটে, তবু আমার নিজের দুটো কথা আছে, এই হাইটেক অপারেশনের যুগে কাজ করতে গেলে যে ফিটনেস এবং স্কিল দরকার, সেটা আমরা কোথায় পাব। ফরেন কোচ আমাদের স্কিল আর ছক শেখাতে পারে, কিন্তু ফিটনেস তো আলাদা ব্যাপার। তাই ফট করে বিদেশি কোচিং অ্যাডপ্ট করা ঠিক হবে না।”
কয়েকটি তরুণ কষ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ শোনা গেল। তাদের মুখপাত্র বাঘা বগলা উঠে সদর্পে বলল, “ললিতদা এখনও লাঠির মহিমা ভুলতে পারেননি। ঠিক কথা, ভূভারতে ললিতদার মতো লাঠিয়াল নেই, কিন্তু ওঁকে এখন বুঝতে হবে যে, লাঠির যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এমনকী সনাতন বন্দুক-বোমার যুগও আর নেই। আমরা যদি এখনও খোলনলচে না পালটাই, তা হলে বারবার বিদেশি টিমের কাছে হার অনিবার্য। ফিটনেস আর স্কিল আমাদের নেই কে বলল? আসল হল প্র্যাকটিস এবং উপযুক্ত কোচিং। ঐতিহ্য আঁকড়ে পড়ে থাকার দিন শেষ। যুগের সংকেত যদি আপনারা ধরতে না পারেন, তা হলে আমাদের আরও পিছিয়ে পড়তে হবে। এই যে রাখালহরির দাপট এবং আধিপত্যকে আমরা এত ভয় পাচ্ছি, তার কারণ, রাখালহরির দলের সবাই অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণে শিক্ষিত, তাদের হাতে একেবারে হাল আমলের অটোমেটিক অস্ত্র এবং তাদের স্পিড অভাবনীয়। তাদের অ্যাটাকিং এবিলিটি যেমন সাংঘাতিক, ডিফেন্সও তেমনই মজবুত। এসব তো জাদুবিদ্যা নয়, কোচিং এবং প্রাকটিসই এর কারণ।”
সভাপতি মোটকা মল্লিক শান্তশিষ্ট মানুষ, স্বল্পভাষীও বটে, সব শুনে সে এবার বলল, “আমরা প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি, এখন যেটা আশু প্রয়োজন, সেটা হল, রাখালহরিকে নিয়ন্ত্রণ করা। সে বিষয়ে প্রহ্লাদা কিছু বলুন।”
প্রহ্লাদ নিমীলিত নয়নে বসে এতক্ষণ একটার পর একটা সুগন্ধি জরদা দেওয়া পান চিবিয়ে যাচ্ছিল। এবার পিক ফেলে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “দেখা যাচ্ছে, আমাদের ভিতরে সবাই স্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত। অল্পবয়সিরা আধুনিক প্রশিক্ষণে বিশ্বাসী, বয়স্করা সনাতন কর্মপদ্ধতি বদলাতে অনিচ্ছুক। যাই হোক, আমরা কোন পন্থা নেব তা সভার শেষে ভোট নিলেই বোঝা যাবে। কিন্তু ফরেন কোচ বা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বা প্রশিক্ষণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিন তো আর রাখালহরি বসে থাকবে না। তাই আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে রাখালহরিকে আপাতত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমার প্রস্তাব আমি আগেই তোমাদের কাছে দিয়ে রেখেছি। রাখালহরির এখন তিপান্ন বছর বয়স, সে বিয়ে করেনি। সুতরাং তার ওয়ারিশন নেই। একমাত্র ওয়ারিশ তার ভাইপো ক্ষুদিরাম বা খাঁদু গড়াই। আমাদের আড়কাঠিরা খবর এনেছে, সে খয়েরগড়ের কাশীরাম রায়ের বাড়িতে এসে থানা গেড়েছে। ভাইসব, এই খাঁদু গড়াই হল রাখালহরির দুর্বল জায়গা, তার অ্যাকিলিস ছিল। কারণ, রাখালহরি তার দলের হাল ধরার জন্য খাঁদুকেই হন্যে হয়ে খুঁজছে। সে খাঁদুর হদিশ পাওয়ার আগেই খাঁদুকে আমাদের হস্তগত করা চাই। তারপর আমরা রাখালহরির উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পাব। হিংসাত্মক পদ্ধতির বদলে কূটনৈতিক চালেই আমরা রাখালহরিকে বাগে আনতে চাই। তার ফলে তার সঙ্গে নেগোশিয়েট করার সুবিধে হবে। ভাইপোকে ফেরত পাওয়ার জন্য আমাদের শর্ত না মেনে তার উপায় থাকবে না। এ-প্রস্তাবে তোমরা রাজি থাকলে হাত ভোলো।”
প্রায় সবাই হাত তুলল। দু-একজন ঘুমোচ্ছিল বলে হাত তোলেনি।
মোটকা মল্লিক গম্ভীর গলায় বলল, “এখন জিরো আওয়ার। কারও কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। তারপর মধ্যাহ্নভোজনের জন্য সভা মুলতুবি ঘোষণা করা হবে।”
সড়কি সতীশ ছোকরা মানুষ। ইসকুলে জ্যাভেলিন থ্রো-তে খুব নাম ছিল তার। পরবর্তীকালে সে বল্লম ছোড়ায় ওস্তাদ হয়ে ওঠে। সে উঠে বলল, “আমার প্রশ্ন হল, রাখালহরির ল্যাপটপে আমাদের সব স্ট্র্যাটেজিই অ্যানালিসিস করা আছে। তার পি আর-ও দুর্দান্ত, সেক্ষেত্রে তার ভাইপোকে পণবন্দি করা কি সহজ হবে? আমার তো সন্দেহ হয়, আমাদের এই টপ সিক্রেট মিটিঙেও রাখালহরির এজেন্ট মজুত আছে। এমনও হতে পারে, সেই এজেন্ট তার মোবাইল হ্যান্ডসেটে এই মিটিঙের সব খবরই তাকে জানিয়ে দিচ্ছে।”
একথায় সভায় একটা প্রবল হইচই উঠল। বাঘা বগলা বজ্রকণ্ঠে বলল, “মিটিঙের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছিল সবাইকে মোবাইল সুইচ অফ করে রাখতে হবে। কার মোবাইল অন আছে হাত তোলো।”
কেউ অবশ্য হাত তুলল না।
মোটকা মল্লিক মোটা গলায় বলল, “এই সাইবার পাইরেসির যুগে সবই সম্ভব। কিন্তু রিস্ক আমাদের নিতেই হবে। কারণ, রাখালহরির সঙ্গে টক্কর দিতে হলে সম্মুখসমরে পেরে ওঠা যাবে না। সে ধূর্ত এবং টেকনিক্যালি অনেক অ্যাডভান্সড। সুতরাং তার ভাইপোকে পণবন্দি করার প্রস্তাবটি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। লাঞ্চের আগেই আমাদের কম্যান্ডো বাহিনীর নামের লিস্টি করে ফেলা দরকার। লাঞ্চের পর সভা সাইনে ডাই মুলতুবি করে দেওয়া হবে।”
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে উঠে প্রহ্লাদ বলল, “ভাইসব, আজ এক সংকটের মুখে আমরা যে সংহতির পরিচয় দিয়েছি, সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের মূলধন। বহিরাগত শত্রু, হানাদার এবং অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে হলে এই সংহতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতা বজায় রাখতে হবে। আপনারা সকলেই যে আজ এই প্রাতঃকালীন সভায় মতানৈক্য সরিয়ে এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব উপেক্ষা করে যোগ দিতে এসেছেন, তার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি … ইত্যাদি।”
সভায় প্রবল হাততালি পড়ল। আর ঠিক এই সময়ে বিরিয়ানিতে গোলাপজল আর কেশর পড়ায় ভারী সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
সভাস্থল থেকে মাইলসাতেক দুরে নীলপুরের গভীর জঙ্গলের মধ্যে গোলপাতার একটা বড় ছাউনির ভিতরে হেডফোনটা কান থেকে খুলে রাখল রাখালহরি। তিপ্পান্ন বছর বয়সেও তার চেহারায় বিন্দুমাত্র মেদ নেই। ছিপছিপে চাবুকের মতো শরীর, রীতিমতো মাসকুলার হাত-পা।
ঘরের এক কোণে বসে একজন বেঁটেখাটো লোক কম্পিউটারে একটা মুখের ছবি আঁকার চেষ্টা করছিল। তার দিকে চেয়ে রাখালহরি বলল, “তোর হল রে কালীকেষ্ট?”
কালীকেষ্ট মৃদু স্বরে বলল, “আজ্ঞে, হয়ে এল। মুশকিল হল, আপনি যখন আপনার ভাইপোকে শেষবার দেখেন, তখন তার বয়স সাত-আট বছর, সে বয়সের চেহারার বিবরণ ধরে তার এখনকার মুখের আদল আন্দাজ করে যা দাঁড়াচ্ছে, তা কি আপনার পছন্দ হবে?”
রাখালহরি গম্ভীর গলায় বলে, “দেখি, একটা প্রিন্ট বের করে দেখা তো।”
কালীকেষ্ট একটা প্রিন্ট নিয়ে এলে রাখালহরি সেটা দেখে মমাটেই পছন্দ করল না। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল, “না, আমার মতো হয়নি ব্যাটা। মুখে সেই হারমাদের ভাবটাই নেই, চোখের চাউনিও তো মরা মাছের মতো। ব্যাটা ওর বাপের মতোই হয়েছে তা হলে। দাদা চিরকালই ভেডুয়া টাইপের ছিল।”
“যদি বলেন তা হলে একটা জম্পেশ গোঁফ লাগিয়ে দিতে পারি।”
“তাতে লাভ কী! লোকটা তো তাতে বদলাবে না। যাক গে, কী আর করা যাবে। শত হলেও রক্তের সম্পর্ক। একেই গড়েপিটে নিতে হবে।”
“আজ্ঞে, সে আর বেশি কথা কী? আপনি কিলিয়ে কত কাঁঠাল পাকালেন, চোখের সামনেই তো দেখলাম। দেখবেন একদিন, এই গোলগাপ্পা ভাইপোও একদিন গুন্ডাপ্পা হয়ে উঠবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাখালহরি বলল, “আর সময় নেই, মহিষবাথানের জঙ্গলে ওদের মিটিঙের রিলে শুনছিলাম নয়ন দাসের সেলফোন থেকে। ওরা আজই খাঁদুকে তুলে আনবে। কম্যান্ডো লিস্ট তৈরি হচ্ছে। তার আগেই যদি খাঁদুকে সরিয়ে ফেলা না যায়, তা হলে মুশকিল। তুই এক্ষুনি হাবু, সনাতন, গদাই আর গাব্বকে ডেকে আন।”
“যে আজ্ঞে,” বলে কালীকেষ্ট তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ছাউনির মধ্যে সিংহের মতো পদচারণা করতে করতে রাখালহরি একা-একাই বলতে লাগল, “কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি, শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। কোটি কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট, বিশাল নেটওয়ার্ক, ম্যান ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স, পাবলিক রিলেশন, অ্যাকাউন্টস, নিউ ভেঞ্চার, অপারেশন, একটিও কি ব্যাটা পারবে সামাল দিতে!”
নিঃশব্দে ছাউনিতে ঢুকে হাবু, সনাতন, গদাই আর গাব্ব ভারী বশংবদ ভঙ্গিতে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে রাখালহরি তাদের সামনে স্থির হয়ে দাড়িয়ে বলল, “অপারেশন খাঁদু। প্ল্যান সিক্স। গাঁয়ের নাম মামুনগড়। কাশীরাম রায়ের বাড়ি। সন্ধে ছ’টার মধ্যে কাজ হাসিল করা চাই। প্রিন্ট আউটের ছবিটা দেখে নে ভাল করে। ছবির সঙ্গে চেহারা না-ও মিলতে পারে। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ধরতে গিয়ে একবার মাঞ্জা সুতোয় খাঁদুর কান কেটে যায়। কানের পিছনে কাটা দাগ দেখবি। সাবধান, ভুল লোককে তুলে আনিস না। আইডেন্টিফিকেশন মার্কটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।”
“যে আজ্ঞে !”
“আর কোনও প্রশ্ন আছে?”
সনাতন বলল, “যে আজ্ঞে, কোন কান? বা না ডান?”
রাখালহরি ফের কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল, “যত দূর মনে আছে, বাঁ কান। তবে ডান কান হওয়াও বিচিত্র নয়। এবার বেরিয়ে পড়ো।”
চারজন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
রাখালহরি তার ল্যাপটপ খুলে নিবিষ্ট মনে কাজ করতে লাগল।
মাত্র মাইল পনেরো দূরে মামুনগড় গায়ে শশীরাম রায়ের বাড়িতে কাশীরাম রায় খুবই বিপন্ন বোধ করছেন। উঁকিঝুঁকি ব্যাপারটা তার একদম পছন্দ নয়। কেউ আড়াল থেকে লুকিয়ে উঁকি মেরে তাঁকে লক্ষ করছে, এ কথা ভাবলেই তার গা শিরশির করে। এইজন্য ছেলেবেলায় চোর-চোর খেলার সময় তিনি টেনশন সহ্য করতে না পেরে এই যে আমি’ বলে লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে সদর্পে ঘোষণা করে দিতেন। এই উনত্রিশ-ত্রিশ বছর বয়সে ফের সেই ছেলেবেলার টেনশনটা টের পাচ্ছেন তিনি।
দুনিয়াসুদ্ধ লোক যে কেন বীর বা সাহসীদের ভক্ত তা তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলা কি ভাল? সেটা কি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ নয়? ভূত-প্রেত, গুন্ডা বদমাশ, মারকুটে বা রাগী লোক, বাঘ ভালুক এসব তো ভয় পাওয়ার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে, নাকি? সুতরাং ভয় পাওয়াটাও তো নিয়মের মধ্যেই পড়ে! কিন্তু তার দাদু শশীরাম বা বাবা নসিরাম তা বোঝেন কই? দাদু শশীরাম প্রায়ই বলেন, ‘কেশোটা চোর-ডাকাত হলেও ভাল ছিল। তা হলেও বুঝতাম, একটা তালেবর হয়েছে। কিন্তু এ তো বংশের নাম ডোবাল! এমন ভিতু, কাপুরুষ, এমন ব্যক্তিত্বহীন ছেলেকে যে নিজের নাতি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে! কাশীবাবুর বাবা নসিরাম তো আরও এক ডিগ্রি সরেস। তিনি তাঁর পুত্রের উপর এতই বিরক্ত যে, প্রাতঃকালে তার মুখদর্শন অবধি করেন না। সারাদিন কুলাঙ্গার’ বলে গালি দেন। কাশীরামের ভরসা হল, মা আর ঠাকুরমা। তাঁরা তাঁর পক্ষ নেন বটে, কিন্তু বাবা বা দাদু তাঁকে মানুষ বলেই গ্রাহ্য করেন না।
ঠাকুরমা প্রায়ই বলেন, “ভয়-ভীতি থাকাই তো ভাল। তোর বাপু, বাপ-দাদার মতো আহাম্মক হওয়ার দরকার কী? তোর দাদু বীরত্ব ফলাতে গিয়ে তো কতবার মরতে বসেছে। সেবার হিরু গুন্ডার দায়ের কোপে গলা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল। বাঁচার কথাই নয়। শশধর ডাক্তার আর পাঁচকড়ি কবরেজের মতো ধন্বন্তরি ছিল বলে, গলা জোড়া লাগল। তোর বাপেরই কি বুদ্ধিসুদ্ধি আছে? গোলা বারুদের সামনে বুক চিতিয়ে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে কতবার মরতে বসেছে। এখনও নাকি একটা গুলি পাঁজরে সেঁধিয়ে আছে, বের করা যায়নি।”
মা বলেন, “তুই যেমন আছিস তেমনই থাক বাবা, অন্যরকম হয়ে কাজ নেই তোর। তোর বাপ-দাদার হল ষণ্ডা-গুন্ডার ধাত, ভদ্দরলোকদের ওরকম হওয়ার তো কথাই নয়।”
কিন্তু সমস্যা হল বিজয়বাবু। দুর্ভাগ্যবশত তিনি একজন বীরপূজারি। বীর জামাই না হলে মেয়ের বিয়েই দেবেন না। তাই শশীরামের নাতি আর নসিরামের ছেলে এই কাশীরামকে মেয়ে বঁচির জন্য দেগে রেখেছেন।
সম্বন্ধটা এনেছে দ্বিজপদ। শশীরাম একদিন দ্বিজপদকে ডেকে বলেছিলেন, “তুই তো ঘটকালিও করিস। দ্যাখ তো বাবা, ডাকাবুকো, ডানপিটে হান্টারওয়ালি গোছের একটা মেয়ে পাস কিনা। আমার অপোগণ্ড, ভিতুর ডিম, কাপুরুষ নাতিকে ওই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দেব। ডাকাবুকো একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে যদি ওর একটু উন্নতি হয়।”
তা বুচিকে সকলেরই খুব পছন্দ। সে নাকি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। বন্দুক-পিস্তলে অব্যর্থ হাত, যুযুৎসু জানে, স্কুলের স্পোর্টসে গাদা গাদা প্রাইজ পায়। কুঁচির বিবরণ শুনে কাশীবাবু খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বিয়েটা ভেঙে দেওয়ারও ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু সে-কথা ধানাইপানাই করে ব্যক্ত করার পরই মা হুমকি দিলেন, বাপের বাড়ি চলে যাবেন, ঠাকুরমা কাশীবাসী হওয়ার সতর্কবার্তা জারি করলেন, বাবা আর দাদু সন্ন্যাস নেওয়ার কথা আগাম ঘোষণা করে দিলেন। অগত্যা কাশীরামকে প্রস্তাবটা মেনে নিতে হয়েছে।
গত কাল থেকে খাঁদু গড়াই তাদের বাড়িতে বহাল তবিয়তে রয়েছে। কাশীরামের মাথায় আসছে না, তার বাবামশাই নসিরাম কেন খাঁদুকে একজন ডাকসাইটে ডাকাত বানানোর জন্য মেহনত করছেন। ডাকাত কি সমাজবিরোধী নয়? ইন্ডিয়ান পেনাল কোড কি ডাকাতিকে বিধিসম্মত পেশা হিসেবে স্বীকার করে ? কিন্তু নসিরামকে কার সাধ্য সেকথা বোঝায়? ওঁর গোঁ, খাঁদুকে এমন ডাকাত বানাবেন যে, পরগনার অন্য সব ডাকাত জব্দ হয়ে যাবে।
খাঁদু দিব্যি ডেঁড়েমুশে খাচ্ছোচ্ছে, দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে বাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর করছে। আর যতই খাদু গেড়ে বসছে ততই কাশীবাবু নার্ভাস বোধ করছেন। খাঁদুর জন্য যে এ বাড়িতে যে কোনও সময়ে রাখালহরি বা রাখালহরির প্রতিপক্ষ হামলা করতে পারে, এটা জেনে ইস্তক কাশীবাবুর খাওয়া অর্ধেক এবং ঘুম সিকিভাগ হয়ে গিয়েছে। তার উপর নজর রাখার মোটেই ইচ্ছে ছিল
কাশীরামের। কিন্তু দ্বিজপদ বিপদের ভয় দেখিয়ে রেখেছে, বিজয়বাবুকে বলে দেবে।
ঘনঘন জল খেয়ে, বারকয়েক বাথরুম ঘুরে এবং গোপনে একটু ডনবৈঠক দেওয়ার পর কাশীবাবু খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে নীচের তলার একটেরে ঘরটার শিয়রের জানালার কাছে গিয়ে আড়াল হয়ে দাড়ালেন। তারপর অতি সাবধানে একটা চোখ দিয়ে ভিতরে দৃষ্টিক্ষেপ করলেন না, ভয়ের কিছু নেই। দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে খাঁদু দিব্যি মাদুরে হাতে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। নজর রাখতে কোনও ভয় নেই।
সবে বুকে একটু সাহস ফিরে আসছিল, ঠিক এই সময়ে খাদু তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল, “কাশীবাবু যে! কী সৌভাগ্য! আসুন! আসুন!”
কাশীবাবু ভারী অপ্রস্তুত। খাঁদু গড়াইয়ের মাথার তালুতে কি তৃতীয় নয়ন আছে? নইলে তাকে দেখল কী করে?
খাঁদু উঠে বসে তার দিকে চেয়ে লাজুক হেসে বলে, “আজ্ঞে, আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক।”
কুষ্ঠিত পায়ে এবং উৎকণ্ঠিত মুখে কাশীবাবু ঘরে ঢুকে আমতা আমতা করে বললেন, “তা ইয়ে, বলছিলাম কী, তোমার কোনও অসুবিধে টসুবিধে হচ্ছে না তো!”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে বলে, “বলেন কী মশাই, অসুবিধে কীসের? তোফা আছি। দোবেলা ফাঁসির খাওয়া খাচ্ছি, ঘুমও হচ্ছে মড়ার মতো, না মশাই, আপনাদের অতিথি-সকারের নিন্দে কেউ করতে পারবে না। তা কাশীবাবু, মাতব্বরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এসেছেন তো!”
কাশীবাবু অবাক হয়ে বললেন, “কীসের শলাপরামর্শ? কে মাতব্বর?”
খাঁদু ডবল অবাক হয়ে বলে, “করেননি? সে কী মশাই? এই যে আমি একটা উটকো লোক হুট করে আপনাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লুম, এটা কি ভাল হল? তার উপর লোকটা এক সাংঘাতিক ডাকাতের ভাইপো। না মশাই, এরকম ঘটনা ঘটলে মুরুব্বি মাতব্বরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করাই তো উচিত। কী থেকে কী হয় তা তো বলা যায় না। দিনকাল মোটেই ভাল নয়। ভালমানুষ বলে মনে হলেও আসলে আমি কেমন মানুষ, কোন মতলব আঁটছি, এসব খতিয়ে না দেখাটা আপনার উচিত হচ্ছে না।”
কাশীবাবু ফাঁপরে পড়ে বললেন, “তা ইয়ে, তা কাল সকালে যে তুমি বলেছিলে, তুমি ধর্মভীরু লোক!”
খাঁদু গম্ভীর হয়ে গলা নামিয়ে বলল, “আহা, আমি বললেই আপনি সেকথা বিশ্বাস করবেন কেন? আজকাল কি কাউকে বিশ্বাস করতে আছে মশাই? ধরুন কেন, আপনার মা ঠাকরুনের গলার বিছোরখানার না হোক দশ বারো ভরি ওজন, আপনার ঠাকুরমা ঠাকরুনের বালাজোড়াও, তা ধরুন, পনেরো ভরির নীচে হবে না। তারপর ধরুন আলমারির লকারে, সিন্দুকে, পাটাতনের উপর পুরনো ন্যাকড়ার পুঁটলিতে, আরও ধরুন, এক-দেড়শো ভরি গয়না তো আছেই। আর নগদ টাকাই কিছু ফ্যালনা হল! বুড়ো কর্তার হাতবাক্সে সবসময় দশ-বিশ হাজার টাকা মজুত। কর্তাবাবার লোশকের তলায় তো টাকার হরির লুট। তাই বলছি, বাইরের অজানা-অচেনা লোককে ঠাঁই দিয়ে যে আতান্তরে পড়বেন মশাই!”
কাশীবাবুর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, এবাড়িতে যে এত গয়না আর টাকা আছে, এ-খবর তাঁরও জানা ছিল না। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “তু-তুমি এ-এসব জা-জানলে কী কী করে?”
“সে আর শক্ত কী? চোখ আর মগজ থাকলেই জানা যায়। কর্তাবাবারই কী আক্কেল বলুন, দুটো মন-রাখা কথা কইতেই উনি একেবারে গলে গিয়ে আমাকে খাতির করে প্রায় অন্দরমহলে ঢুকিয়ে ফেলেছেন।”
কাশীবাবু কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, “তা হলে উপায়?”
“আমি বলি কী কাশীবাবু, আপনি খুব হুঁশিয়ার হয়ে আমার উপর নজর রাখুন। এই ধরুন, আমি সারাদিন কী করি, বাইরের কেউ আমার কাছে যাতায়াত করে কিনা, ঠারেঠোরে বা ইশারা ইঙ্গিতে কাউকে খবরাখবর পাঠাচ্ছি কিনা, তারপর ধরুন, আমি লোকটা কেমন, হাঁ করে ঘুমোই কিনা, নাক ডাকে কিনা…”
কাশীবাবু সোৎসাহে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিজপদ তো এসব কথাই বলেছিল!”
বলেই কাশীবাবু জিভ কাটলেন। এঃ হেঃ, দ্বিজপদর কথাটা বেফাঁস বেরিয়ে গিয়েছে। সামাল দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, “না, না তোমার কথা হচ্ছিল না হে, এই চোর-ছ্যাঁচোড়দের কথাই হচ্ছিল আর কী!”
খাঁদু মাথা নেড়ে বলে, “আহা, আমার কথা হলেই বা দোষ কী? ভাল লোক তো কারও গায়ে লেখা থাকে না মশাই। চোখে চোখে রাখাই বিচক্ষণতার কাজ। উঁকিঝুকি মারারও কোনও দরকার নেই। সোজা এসে আমার নাকের ডগায় গেড়ে বসে বলবেন, তোমার উপর নজর রাখছি হে।”
কাশীবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সেটা কি ভাল দেখাবে? তুমি তো কিছু মনে করতেও পারো!”
“না, মশাই না। আনাড়ি লোকদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে আমি বড় ভালবাসি। গোলমেলে লোকদের উপর কী করে নজর রাখতে হয়, কী করে তাদের পেটের কথা টেনে বের করতে হয়, তার দু চারটে কায়দা আপনাকে শিখিয়ে দেব’খন।”
কাশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিজপদও এরকমই কী যেন বলছিল।”
“পাকা মাথার লোক তো বলবেই। তবে কিনা নজর রাখাও বড় চাট্টিখানি কথা নয়। আপনি হয়তো উকি দিয়ে দেখলেন, আমি বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছি। ভাবলেন, আহা, খাঁদু ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোক, আমিও গিয়ে তা হলে একটু গড়িয়ে নিই। ব্যস, ওইখানে মস্ত ভুল করে ফেললেন। ওই যে বাঁ দিকে কাত হয়ে শোওয়া, হাঁ করে থাকা, ও-সবই হচ্ছে নানারকম সংকেত, ওর ভিতর দিয়েই কথা চালাচালি হয়ে যাচ্ছে, আপনি ধরতেও পারলেন না।”
“অ্যাঁ!” বলে মস্ত হাঁ করলেন কাশীবাবু।
“হ্যাঁ মশাই, শুধু কি তাই, যদি নাক ডাকে তা হলে জানবেন ওই সঙ্গে আরও মেসেজ চলে গেল। নাক ডাকারও আলাদা অর্থ আছে, যা আপনার জানা নেই। তারপর ধরুন, আমি হয়তো বসে বসে হাই তুলছি বা আঙুল মটকাচ্ছি বা আড়মোড়া ভাঙছি, ভুলেও ভাববেন না যে, আলসেমি করছি। ও সবই হল নানারকম ইশারা ইঙ্গিত। আপনি যেমন আমার উপর নজর রাখছেন, তেমনই বাইরে ওই পাঁচিলের উপর বা ঝুপসি আমগাছের ডালপালার ভিতর থেকে দুরবিন কষে আর কেউও আমার দিকে নজর রাখছে। আর সব টুকে নিচ্ছে।”
কাশীবাবু এত অবাক আর বিহ্বল হয়ে গেলেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে প্রথমটায় কোনও কথাই বেরোল না। কী সাংঘাতিক লোকের পাল্লায় পড়েছেন তা ভেবে তাঁর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। অনেকক্ষণ পরে শুধু বলতে পারলেন, “ওরে বাবা!”
“তাই বলছি আমি থাকতে থাকতে সব শিখে নিন। দিনকাল যা পড়েছে, চারদিকে চোখ না রাখলে যে বিপদ!”