কাশীবাবু সকালে তাঁর বাগানে
কাশীবাবু সকালে তাঁর বাগানে গাছপালার পরিচর্যা করছেন। সঙ্গে তাঁর বহুকালের পুরনো মালি নরহরি। নরহরি শুধু মালিই নয়, সে বলতে গেলে অনেক কাজের কাজি। তবে সে ভারী ভিতু লোক, দুনিয়ার সব কিছুতেই তার ভয়। দিনেদুপুরে একটা গোলাপ ডালের ন্যাড়া মাথায় গোবরের টুপি পরাতে পরাতে হঠাৎ সে বলে উঠল, “হয়ে গেল! ওই এসে পড়েছে। আর উপায় নেই কর্তামশাই, সব চেঁচেপুছে নিয়ে যাবে।”
নরহরির আগড়মবাগড়মকে তেমন গুরুত্ব দেন না কাশীবাবু। কুমড়োর ভাঙা মাচাটায় বাঁধন দিতে দিতে বললেন, “কার কথা কইছিস? কে এল?”
“ওই যে দেখুন না!মুশকো চেহারা, বাঘের মতো গুল্লু গুলু চোখ, ঝাঁকড়া চুল, কোমরে নির্ঘাত ছোরাছুরি আছে।”
কাশীবাবু দেখলেন, ফটকের বাইরে একটা উটকো লোক দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি মারছে বটে, তবে নেহাত হাঘরে চেহারা। রোগামতো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একখানা চেক লুঙ্গি, গায়ে সবুজ রঙের একখানা কামিজ, কাঁধে লাল গামছা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল আছে বটে, কিন্তু চেহারা মোটেই ভয়ংকর নয়। অনেক সময় সাহায্যটাহায্য চাইতে দু’-একজন গাঁয়ে ঢুকে পড়ে, এ তাদেরই কেউ হবে হয়তো।
কাশীবাবু হাতটাত ঝেড়ে ফটকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ”কে হে বাপু তুমি? কাকে খুঁজছ?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “বাগানখানা বড় সরেস বানিয়েছেন মশাই। কী ফলন, গাছপালার কী তেজ, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়!”
কাশীবাবু খুশি হয়ে বললেন, “তা আর হবে না। মেহনত বড় কম করতে হয় না। গাছপালার আদরযত্ন করি বলেই না তারা ফলন্ত ফুলন্ত হয়ে ওঠে।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “বড় খাঁটি কথা মশাই। আদরযত্নটাই তো আসল কথা। আদরযত্ন না পেলে সব জিনিসই কেমন দরকচা মেরে যায়। এই আমার অবস্থাই দেখুন না। কত কী হতে পারতুম, কিন্তু হলুম একটা লবডঙ্কা। যত্নই হল না আমার।”
কাশীবাবু দয়ালু মানুষ। নরম গলায় বললেন, “আহা, যত্ন করার কেউ নেই বুঝি?”
“কে আর থাকবে বলুন! মা-মরা ছেলের জীবন বড় দুঃখের। মা মরে যাওয়ায় বাবা বিবাগী হয়ে গেলেন, জ্ঞাতিরা এসে সব বিষয় সম্পত্তি দখল করে নিল। সেই ছেলেবেলা থেকে সাতঘাটের জল খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
কাশীবাবুর চোখ ছলছল করতে লাগল। দুঃখের কথা তিনি মোটেই সইতে পারেন না। ধুতির খুঁটে চোখের কোণ মুছে ধরা গলায় বললেন, “আহা, সত্যিই তো তুমি বেশ দুঃখী লোক হে!”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে। আমাকে দুঃখের তুবড়িও বলতে পারেন। নিদেন ফুলঝুরি তো বটেই।”
উদ্বিগ্ন হয়ে কাশীবাবু বললেন, “তা হলে তোমার উপায় কী হবে বাপু?”
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আজ্ঞে, উপায় তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুড়োমশাইকে খুঁজে না পেলে উপায় হওয়ার জো নেই কিনা।”
নরহরি এতক্ষণ কথা কয়নি। এবার কাশীবাবুর পিছন থেকে সে খিচিয়ে উঠে বলল, “তা বাপু, গাঁয়ে খুড়ো-জ্যাঠার অভাব কী? মেলাই পাবে। যাও না, খুঁজে দ্যাখো গিয়ে।”
কাশীবাবু একবার নরহরির দিকে ভৎসনার চোখে চেয়ে ফের লোকটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “তা বাপু, তোমার খুড়োমশাই কি এই গাঁয়েই থাকেন?”
লোকটা ঠোঁট উলটে বলল, “কে জানে মশাই। থাকতেই পারেন। বাপ বিবাগী হওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘ওরে খাঁদু, তোর যে কী হবে কে জানে! যদি পারিস, তবে তোর খুড়োকে খুঁজে দেখিস। তাকে পেলে তোর একটা হিল্লে হবে।’ তা মশাই সেই থেকে খুড়োকে কিছু কম খুঁজলুম না।”
“পেলে না বুঝি?”
“একেবারে পাইনি তা বললে ভুল হবে। কখনও অর্ধেকটা, কখনও সিকিটা পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু গোটাগুটি খুড়োমশাইকে নাগালে পেলুম কই?”
“তাজ্জব কথা! খুড়োর আবার সিকি-আধুলিও হয় নাকি হে? তোমার খুড়োমশাইয়ের তো একটা ঠিকানা আছে নাকি?”
মাথা নেড়ে খাঁদু বলে, “তা তো আছেই। থাকবারই কথা। ঠিকানা না থাকার জো নেই। কিন্তু মুশকিল হল সেটা আমার বাবা আমাকে বলেননি। তাই তো গোরুখখাঁজা খুঁজতে হচ্ছে মশাই। মেহনত বড় কম যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এত মেহনতে ভগবানকে পাওয়া যায়, তো খুড়োমশাই কোন ছার!”
“ঠিকানা না থাকলেও নাম তো একটা আছে রে বাপু?”
একগাল হেসে খাঁদু বলল, “তা আর নেই! খুব আছে। দিব্যি নাম মশাই। রাখালহরি গড়াই। নবগ্রামে রাখাল গড়াইকে পেলুম বটে খুঁজে, কিন্তু তিনি কালীর দিব্যি কেটে বললেন যে, তিনি নিকষ্যি রাখাল। রাখালের সঙ্গে হরি নেই মোটেই। তারপর ধরুন, শীতলাপুরের হরিপদ গড়াই, তাঁকে পাকড়াও করতেই তিনি ভারী রেগে গিয়ে বললেন, ‘কেন হে বাপু, হরিপদ হয়ে কি আমি খারাপ আছি? আমাকে আবার একটা রাখাল গছাতে চাইছ কেন, তোমার মতলবটা কী হে?’ তারপর ধরুন, মদনপুরে খুড়োমশাইকে প্রায় পেয়েই গিয়েছিলুম। রাখালহরি গড়গড়ি। যতই বলি গড়গড়ি নয়, ওটা আসলে গড়াই, ততই তিনি গরগর করে গর্জাতে থাকেন। ঘণ্টা দুই যুঝেও তাঁকে কিছুতেই মানতে পারলুম না যে, তিনি গড়গড়ি-ও হতে পারেন এবং গড়াই কিছু খারাপ কথাও নয়।”
“তা হলে তো মুশকিল হল হে। তা তোমার খুড়োমশাই কি বেশ পয়সাওলা লোক?”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে বলে, “তা তো বটেই। কুঠিবাড়ি লুট করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন যে! তারপর ডাকাত হিসেবে তাঁর আরও নামডাক হয়।”
“ডাকাত!” বলে কাশীবাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
“যে আজ্ঞে। তেমন চুনোপুটি ডাকাতও নন। তাঁর মাথার দাম এখন লাখ টাকা।”
“ওরে বাবা! শুনেই যে আমার হৃৎকম্প হচ্ছে! তুমি তো সাংঘাতিক লোক হে। ডাকাতের ভাইপো!”
“আজ্ঞে, ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল! ডাকাতের ভাইপো শুনে লোকে বড় ঘাবড়ে যায়। অনেকে সন্দেহ করে, ভয় পায়, ঘটিবাটি সামলে রাখে। অনেকে আবার পুলিশে খবর দেওয়ার উদ্যোগ করে। কী ফ্যাসাদ বলুন দিকি! আমি মশাই, নিতান্তই নিরীহ ধর্মভীরু লোক। খুড়োমশাই হাতে মাথা কাটেন বটে, কিন্তু আমার তো মশা মাছি মারতেও হাত সরে না!”
কাশীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তা হলে বাপু, তুমি বরং অন্য কারও ভাইপো হলেই ভাল করতে। এই ধরো উকিল-মোক্তার বা ডাক্তার। ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ভাল কথা নয়।”
“আজ্ঞে, সে কথাও খুব ভাবি। আমার যা স্বভাব, তাতে ওরকম একজন ডাকসাইটে ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। তিনি লাখো লাখো টাকা লুটছেন বটে, কিন্তু আমি মরছি বিবেক দংশনের জ্বালায়। এই তো দেখুন না, দিনদুই আগে নারানপুর গাঁয়ের হাটখোলায় একছড়া সোনার হার কুড়িয়ে পেলুম। তা ভরিটাক ওজন তো হবেই। কিন্তু যেই হাতে নিয়েছি অমনই যেন বিছুটি পাতার জ্বালা। সে কী জ্বলুনি মশাই, কী বলব! তারপর সারা গাঁ তোলপাড় করে যার হার হারিয়েছিল সেই খুকিটিকে খুঁজে বের করে তার হাতে হারছড়া তুলে দিয়ে তবে নিষ্কৃতি।”
“তা হলে তো বাপু, তুমি বেশ দোটানার মধ্যেই পড়েছ। একদিকে ডাকাতখুড়ো, অন্যদিকে বিবেকবুড়ো?”
“যথার্থই বলেছেন মশাই। দু’দিকের টানাহ্যাঁচড়ায় বড্ড জেরবার হচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কী, বিবেক দংশন যেমন আছে তেমনই খিদের জ্বালাও তো আছে। বাইরে থেকে দেখলে ঠিক বুঝবেন না, আমার ভিতরে বিবেক আর খিদের কেমন সাংঘাতিক লড়াই চলছে। ওফ, সে যেন সুন্দ-উপসুন্দের যুদ্ধ। কখনও বিবেককে ধরে খিদে এমন আছাড় মারে যে, বিবেকের অক্কা পাওয়ার দশা। কখনও আবার বিবেক তেড়েফুঁড়ে উঠে খিদেকে এমন চেপে ধরে যে, খিদের তখন দম আটকে মরার অবস্থা। তা এই খিদে যখন মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে ওঠে, তখন কখনও-সখনও চুরি-ডাকাতি করতে যে ইচ্ছে যায় না তা নয়। তখন যেন খুড়োমশাই আমার ঘাড়ে ভর করেন। এই তো গেল হপ্তায় গোলোকগঞ্জে দিনদুই উপপাসের পর দুর্বল শরীরে একটু ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ দেখি, একটা বাড়ির বাগানের বেড়ার ধারে একটা পেঁপে গাছে একেবারে হাতের নাগালে
একখানা হলুদ বরণ পাকা পেঁপে ঝুলে আছে। যেই না দেখা, অমনিই আমার খিদে লাফিয়ে উঠে বিবেককে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে পাঁইপাঁই করে ছুটল।”
কাশীবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, “বটে! তারপর কী হল!”
“আজ্ঞে, খিদে প্রায় জিতেই গিয়েছিল আর কী! আর-একটু হলেই মহাপাপটা করেই ফেলছিলুম প্রায়। কিন্তু হাত বাড়িয়ে পেঁপেটা যখন সাপটে ধরেছি, তখনই ভিতর থেকে বাঘের মতো বিবেক গর্জন করে উঠল, “খবরদার, খাঁদু! এখনও পৃথিবীতে চন্দ্র সূর্য উঠছে, এখনও গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা খেলছে, এখনও গোরুর দুধে সর পড়ে, এখনও দধিমন্থন করলে মাখন ওঠে, এখনও পাটালি গুড় দিয়ে পায়েস হয়। তাই বলছি, এ-পাপ তোর ধর্মে সইবে না। বুঝলেন মশাই, কী বলব, বিবেকের সেই বাঘা গর্জনে শরীরে যেন ভূমিকম্প হতে লাগল। মনস্তাপে মনটা ভরে গেল। হাত সরিয়ে নিলুম, পেঁপেটা যেমন ঝুলছিল তেমনই ঝুলে রইল।”
কাশীবাবু একটা খাস ছেড়ে বললেন, “যাক বাবা! পেঁপেটার জন্য ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার।”
“যে আজ্ঞে, হওয়ারই কথা। তবে পেঁপে বাঁচলেও এই খাঁদু গড়াইয়ের যে মরার দশা হয়েছিল মশাই! বিবেকের মার খেয়ে খিদে হার মানল বটে, কিন্তু আমার পেটে এমন কুঁইকুই করে ঘুরে বেড়াতে লাগল, কিছুতেই বাগ মানে না। ধর্ম রাখতে গিয়ে প্রাণ যায় আর কী? আচ্ছা মশাই, এটা কলিযুগ বলেই কি ধর্মভীরু মানুষরাই শুধু কষ্ট পায়, আর পাপীতাপী, খুনে-গুন্ডারা দিব্যি হেসে-খেলে বেড়ায়?”
“তা বাপু, কথাটা মন্দ বলেনি। আমিও শুনেছি, কলিযুগে সব উলটো নিয়ম।”
“আজ্ঞে, তাই হবে। আচ্ছা মশাই, আপনি কি ‘সধবার দীর্ঘশ্বাস বা ডাকাতের দয়া’ যাত্রাপালা দেখেছেন?”
“না বাপু, যাত্রাটাত্ৰা আমি বড় একটা দেখি না।”
পিছন থেকে নরহরি বলে, “আমি দেখেছি, বড্ড ভাল পালা, চোখের জল রাখা যায় না।”
খাঁদু একগাল হেসে বলল, “তবেই বুঝুন, এ কলিযুগ না হয়ে যায় না।”
কাশীবাবু অবাক হয়ে বলেন, “কেন বাপু, যাত্রাপালার সঙ্গে কলিযুগের সম্পর্ক কী?”
“বুঝলেন না! ও দুটো পালাই আমার খুড়োমশাইকে নিয়ে লেখা। আর শুধু কি পালা? তাঁকে নিয়ে কত গান বাঁধা হয়েছে জানেন? শোনেননি? সেই যে, মিছেই করো দৌড়াদৌড়ি, হাতে নিয়ে দড়াদড়ি, পরাবে যে হাতকড়ি হে কোথায় পাবে হাত, বাপের ব্যাটা রাখালহরি, তারই দয়ায় বাঁচি মরি, তার হাঁকেডাকে দাপে খাপে সবাই কুপোকাত…হবে সবাই কুপোকাত। শোনেননি?”
“না হে বাপু।”
নরহরি বলল, “আমি শুনেছি।”
খাঁদু দেঁতো হাসি হেসে বলে, “তবেই বুঝুন, কলিযুগে পাপীতাপীরা কেমন তোফা আছে। খুনখারাপি, লুটমার করে দোহাত্তা কামাচ্ছে, তার উপর তাদের নিয়ে পালা হচ্ছে, গান বাঁধা হচ্ছে। এসব কি অশৈলী কাণ্ড নয় মশাই?”
“তা তো বটেই।”
“আর এই আমাকে দেখুন, গোবেচারা, ধর্মভীরু মানুষ। কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। খুন-জখম, চুরি-ডাকাতির ছায়াও মাড়াই না। তা কে দাম দিচ্ছে বলুন! সেই সাতসকালে বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে হাঁটা দিয়ে তিন মাইল ঠেঙিয়ে আসছি, খিদের চোটে পেট খোঁদল হয়ে আছে, তেষ্টায় বুক অবধি ঝামা, তবু কোনও ভালমানুষ কি একবারও ডেকে বলল, “ওরে বাপু খাঁদু, আয় বাবা, এই ঠান্ডার সকালটাতে এক পাত্তর গরম চা আর দু’খানা বাসি রুটি খেয়ে আত্মারামটা একটু ঠান্ডা কর বাবা। কিন্তু মশাই, আজ যদি আমার শ্রদ্ধাস্পদ খুড়োমশাই রাখালহরি গড়াই হাতে একখানা রাম-দা বাগিয়ে এসে দাঁড়াতেন, তা হলে দেখতেন, খাতির কাকে বলে! এতক্ষণে গরম গরম ফুলকো লুচি আর মোহনভোগ, সঙ্গে রসগোল্লা-পান্তুয়ার গাদি লেগে যেত। গাঁ ঝেটিয়ে পিলপিল করে লোক ধেয়ে আসত একবার চোখের দেখা দেখতে।”
কাশীবাবু তটস্থ হয়ে লজ্জিত মুখে বললেন, “আহা, তুমি চা-রুটি খেতে চাও, সেকথা আগে বলতে হয়! খিদে-তেষ্টা কার নেই বলো!”
পিছন থেকে নরহরি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে চাপা স্বরে বলল, “কর্তা, খাল কেটে কুমির আনছেন কিন্তু। এ লোক মোটেই সুবিধের নয়। কেমন চোর-চোর চেহারা, দেখছেন না। তার উপর ডাকাতের ভাইপো ! ডাকাতের ভাইপোরা কিন্তু ভাল লোক হয় না।”
কাশীবাবু মুখ ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলেন, “তুই ক’টা ডাকাতের ভাইপো দেখেছিস?”
“কেন, আমাদের কেষ্টপুরের পটল দাস! আমার বুড়ি ঠাকুরমা সারা সকাল কত কষ্ট করে গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুটে দিতেন, আর বেবাক খুঁটে চুরি করে নিয়ে যেত ওই পটলা। মুদির দোকানে বাকি ফেলে জন্মে শোধ দিত না। আর নরেনবাবুর পোষা বিড়ালটা একখানা মাছের কাঁটা চুরি করেছিল বলে কী ঠ্যাঙার বাড়িটাই না মারল। এই পটলা হল কালু ডাকাতের সাক্ষাৎ ভাগনে।”
“তবে! ভাইপো আর ভাগনে কি এক হল? তুই যে মুড়ি আর মিছরির এক দর করে ফেললি? কালিয়া আর কোপ্তা কি আর এক জিনিস রে বাপু! ব্যাটবল আর বটব্যালে কি তফাত নেই? কিন্তু তোকে বলে কী লাভ, তুই তো সেদিনও সিন্নি খেয়ে বললি, ‘পায়েসটা বড় জম্পেশ হয়েছে!’ভাগনে আর ভাইপোর তফাত তুই কী বুঝবি?”
“আজ্ঞে, ভাগনে পছন্দ না হলে হাতের কাছে ভাইপোও মজুত রয়েছে। আমাদের গাঁয়ের গিরিধারীর কথাই ধরুন! গিরিধারী হচ্ছে। যেমন ষণ্ডা, তেমনই গুন্ডা, তার অত্যাচারে কত লোক যে গাঁ ছেড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একে ধাঁই করে ঘুসি মারছে, তাকে ঠাস করে চড় মারছে, রামহরি কবরেজের চুল ধরে এমন টান মারল যে, চুলের গোড়াসুন্ধু উঠে আসার কথা। তা ভাগ্যিস রামহরি কবরেজ পরচুলো পরত, তাই পরচুলার উপর দিয়েই গেল। রামহরির যে টাক ছিল, তা কেউ জানত না। পরচুলা খসে যাওয়ায় জানাজানি হতে রামহরিও লজ্জায় গাঁ ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেল। তা সেই গিরিধারী হল নবকেষ্ট চোরের সাক্ষাৎ ভাইপো।”
“চোর!” বলে নাক সিঁটকোলেন কাশীবাবু। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “তোর বড় ছোট নজর। কথা হচ্ছে ডাকাতের ভাইপো নিয়ে, তুই ফট করে চোরের ভাইপোকে এনে ফেললি। ওরে, আদার সঙ্গে কি কাঁচকলা মেলে! নাকি আমের দামে আমড়া বিকোয়!”
এই সময়ে হঠাৎ একটা বাজখাঁই গলা সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, “অ্যাই! কী নিয়ে এত কথা হচ্ছে রে! গন্ডগোল কীসের?”
কাশীরামবাবুর বাবা নসিরামের চেহারাখানা দেখবার মতোই। ছ’ফুট লম্বা, বিশাল কাঁধ, মুগুরের মতো দুখানা হাত, প্রকাণ্ড তাগড়াই গোঁফ, মাথায় সিংহের কেশরের মতো কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল। এখনও রোজ বৈঠক করেন, ডাম্বেল বারবেল করেন, মুগুর ভাঁজেন, প্রাতভ্রমণ সান্ধ্যভ্রমণ তো আছেই। এইমাত্র মাইল পাঁচেক প্রাতভ্রমণ করে ফিরলেন। গায়ে পুরোদস্তুর মিলিটারি পোশাক, পায়ে ভারী মিলিটারি বুট। একসময় যে মিলিটারিতে ছিলেন, সেটাই সবাইকে সব সময়ে সমঝে দেন আর কী?
কাশীবাবু তাঁর বাবাকে যমের মতো ভয় খান। এখনও চোখের দিকে চেয়ে কথা কন না। বাবার জেরার জবাবে মিনমিন করে বললেন, “না, এই ডাকাতের ভাইপো নিয়ে কথা হচ্ছিল।”
নসিরাম গর্জন করে উঠলেন, “ডাকাত! কোথায় ডাকাত?”
নরহরি তাড়াতাড়ি খাঁদুকে দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আজ্ঞে, এই যে, ইনিই!”
“বটে! যা তো, দৌড়ে গিয়ে কোদালটা নিয়ে আয়।”
নরহরি অবাক হয়ে বলে, “কোদাল! কোদাল দিয়ে কী হবে কর্তাবাবা?”
বাঘা চোখে চেয়ে নসিরাম বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “কোদাল দিয়ে বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা তিন হাত লম্বা দেড় হাত চওড়া গর্ত খুঁড়ে ফ্যাল শিগগির। এই ডাকাতটাকে আজ জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।”
কাশীরাম তটস্থ হয়ে বললেন, “বাবামশাই, এই প্রাতঃকালেই খুনখারাপি কি ভাল দেখাবে?”
নসিরাম গর্জে উঠলেন, “কেন, প্রাতঃকালে ডাকাতকে জ্যান্ত পুঁতলে দোষ হচ্ছে কোথায়?”
“আজ্ঞে, এ ঠিক ডাকাত নয়। ডাকাতের ভাইপো!”
“ওই একই হল। যা, যা, তাড়াতাড়ি কোদাল এনে গর্তটা করে ফ্যাল তো নরহরি!”
খাঁদু গড়াই কিন্তু মোটেই ঘাবড়াল না। হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মিঠে এবং মোলায়েম গলায় বলল, “পেন্নাম হই কর্তাবাবু। এই এতক্ষণ এঁদের সঙ্গে কথা কয়ে ঠিক সুবিধে হচ্ছিল না। এই
আপনার গলাটা শুনে পিলেটা এমন চমকাল যে, শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। পুরুষ-সিংহ বলে কথা! দেশে পুরুষ-সিংহের বড়ই অনটন কর্তাবাবা। ওঃ, যেমন গামা পালোয়ানের মতো চেহারা আপনার, তেমনই রাজাগজার মতো ভাবভঙ্গি। দেখে বুকটা ভরে গেল। তা আপনি মারতে চাইলে মরেও সুখ। শিয়াল কুকুরের হাতে মরার চেয়ে বাঘ-সিংহের হাতে মরাই ভাল, কী বলেন? বুক ফুলিয়ে পাঁচজনকে বলা যায়।”
নসিরাম প্রশস্তি শুনে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “তবে?”
খাঁদু গদগদ হয়ে বলে, “উচিত কথাই কইছি কর্তা। মরণকালে মিছে কথা কয়ে লাভ কী বলুন। পাপের বোঝা আরও ভারী হবে বই তোনয়। আমার খুড়ো রাখালহরি গড়াই ডাকাত বটে, কিন্তু আপনার কাছে নস্যি। আমাদের গাঁয়ের হরু পালোয়ান একসঙ্গে চার-চারজন পালোয়ানকে চিত করত বটে, কিন্তু তাকে দেখলেও এমন ভক্তিছেদ্ধা হয় না, কিংবা হরগোবিন্দপুরের বিশ্বেশ্বরের কথাই যদি ওঠে, পাগলা হাতির শুঁড় ধরে টেনে জিলিপির মতো শুড়টাকে পাকিয়ে এমন কাণ্ড করেছিল যে, হাতির ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! তা সেই হাতিবীর বিশ্বেশ্বরও আপনার ধারেকাছে আসতে পারে না। এই যে আপনার সামনে দাড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে, আসলে মানুষ তো নয়, যেন বরফ-মাখানো পাহাড়!”
নসিরাম সায় দিয়ে ঘনঘন মাথা নাড়লেন। তারপর ভ্রু কুঁচকে খাঁদুকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, “এঃ, এই চেহারা নিয়ে ডাকাতি করিস? ছ্যাঃ ছ্যাঃ। তোর তো বুকের ছাতি তেত্রিশ ইঞ্চির বেশি নয়, অমন প্যাকাটির মতো সরু হাত দিয়ে সড়কি-তলোয়ার চালাবি কী করে? আর অমন মিহিন গলায় হা-রে-রে-রে বলে হাড় ছাড়লে যে শিয়ালের ডাকের মতো শোনাবে! সব জিনিসেরই একটা প্রশিক্ষণ আছে, বুঝলি!”
খাঁদু ভারী কাচুমাচু হয়ে বলে, “দুনিয়ায় কত কী শেখার আছে কর্তাবাবা, কিন্তু শেখায় কে বলুন! অমন রাখালহরির ভাইপো হয়ে আজ অবধি হাতেখড়িটাও হয়ে উঠল না। তেমন শিক্ষকই বা দেশে কোথায় বলুন?”
“তার আর ভাবনা কী? আমার কাছে থাক, দু’মাসে তৈরি করে দেব।”
খাদু তাড়াতাড়ি নসিরামের পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে আর মাথায় ঠেকাল, ধরা গলায় বলল, “আজ্ঞে, আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম!”
নরহরি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “কর্তাবাবা, এই যে কোদাল এনেছি!”
নসিরাম ভারী অবাক হয়ে বললেন, “কোদাল! কোদাল দিয়ে কী হবে রে?”
“ডাকাতটাকে জ্যান্ত পুঁতকেন বলে গর্ত করতে বললেন যে!”
নসিরাম নাক কুঁচকে বললেন, “আরে দুর! এটাকে ডাকাত বললে ডাকাতের অপমান হয়। আগে এটাকে তাগড়াই একটা ডাকাত বানাই, তবে তো জ্যান্ত পুঁতবার কথা ওঠে। এরকম একটা হাড়জিরজিরে সিড়িঙ্গে চেহারার ডাকাতকে পুঁতে কি জুত হয় রে? লোকে যে ছ্যা-দ্যা করবে, তুই বরং এর জন্য একগোছা রুটি আর একবাটি গরম ডালের ব্যবস্থা কর। দুপুরে মুরগির সুরুয়া, রাতে পাঁঠার মাংস। লাঠি-সড়কি-বল্লমগুলো বের করে ঘষেমেজে সাফ কর তো! আজ থেকেই এর ট্রেনিং শুরু।”
এই বলে খাঁদুর নড়া ধরে টেনে হনহন করে বাড়িতে ঢুকে গেলেন নসিরাম। বাক্যহারা হয়ে কাশীবাবু আর নরহরি হাঁ করে চেয়ে রইলেন।