ডনের ভূত
সেদিন সকালে চোখ বুজে একটা রোমাঞ্চকর গল্পের প্লট ভাবছি এবং টেবিলে কাগজ-কলমও তৈরি, হঠাৎ পিঠে চিমটি কাটল কেউ। উঃ বলে আর্তনাদ করে পিছনে ঘুরে দেখি, ডন দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ধূর্ত এবং ক্রুর হাসির ছাপ। খাপ্পা হয়ে বললুম, হতভাগা ছেলে! দিলি তো মুডটা নষ্ট করে?
ডন আমার ভাগনে। মহা ধড়িবাজ বিচ্ছু ছেলে! তার মাথায় একটা কিছু খেয়াল চাপলেই হল। তাই নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে।
তা লাগুক আপত্তি নেই। কিন্তু প্রতিটি খেয়ালের সঙ্গে আমাকেও যে জড়াবে, এটাই হল সমস্যা। ওইরকম নিঃশব্দ হাসিটি হেসে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললুম,–বুঝেছি। টাকা চাই। কিন্তু এবার কী কিনবি? রামুর গাধা, না সোঁদরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার?
ডন ফিক করে হেসে অমায়িক ভদ্রলোক হল। বলল, না মামা! ভূত কিনব।
অবাক হয়ে বললুম, ভূত কিনবি? কোথায় পাবি ভূত? কে বেচবে?
ডন কাছে ঘেঁষে এল। টেবিলের কলমটা খপ করে তুলে নিয়ে বলল,–মোটে তিন টাকা দাম, মামা! যদি এক্ষুনি তিনটে টাকা না দাও, কী হবে বুঝতে পারছ?
বিপদ ঘনিয়েছে দেখে ঝটপট বললুম,–বুঝেছি, বুঝেছি। লক্ষ্মী ছেলের মতো আগে আমার কথার জবাব দে। ঠিক-ঠিক জবাব হলে তিনটে টাকাই পাবি।
–শিগগির বলে মামা! দেরি হলে গোগো ভূতটা কিনে ফেলবে।
–ভূত কার কাছে কিনবি?
–মোনাদার কাছে।
–মোনাদা মানে সেই মোনা-বুজরুক? মোনা ভূত কোথায় পেল?
–ঝিলের ধারে বাঁশের জঙ্গলে ফঁদ পেতে ধরেছে।
–তুই দেখে এলি?
–হুঁ। শিশির ভেতর ভরে রেখেছে। –মোনাদা বলল,–শিশির দাম পঞ্চাশ পয়সা আর ভূতটার দাম দু-টাকা পঞ্চাশ পয়সা। ইজ ইকোয়্যাল টু তিন টাকা।
হাসতে-হাসতে বললাম, বাঃ! অ্যাদ্দিনে অঙ্কে তোর মাথা খুলেছে দেখছি। তো ভূতটা দেখতে কী রকম?
ডন চটে গেল। –ভূত কি চোখে দেখা যায়? কই শিগগির টাকা দাও।–বলে সে কলমটা টেবিলে ঠোকার ভঙ্গি করল।
দামি কলম। তাই বেগতিক দেখে তিনটে টাকা দিলুম। টাকা পেয়ে কলমটা রেখে ডন গুলতির বেগে উধাও হয়ে গেল।
গল্পের মুডটা চটে গেল। মনে-মনে মোনার মুন্ডুপাত করতে থাকলুম। মোনা থাকে ঝিলের ধারে পুরোনো শিবমন্দিরের কাছে।
মোনার মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে একফালি গেরুয়া কাপড়, কপালে লাল তিলক আঁকা। সে নাকি তন্ত্রসাধনা করে। কারও কিছু চুরি গেলে মোনা নাকি মন্ত্রের জোরে চোর ধরিয়ে দেয়। অসুখ-বিসুখের চিকিৎসাও করে। তবে কথাটা হল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কাজেই যারা ওকে বিশ্বাস করে, তারা বলে মোনা-ওঝা এবং যারা করে না, তারা বলে মোনা বুজরুক। তবে লোকটাকে যত ভয়ঙ্কর দেখাক, ওপর পার্টির দুটো দাঁত নেই বলে যখনই হাসে, তাকে ভালোমানুষ মনে হয়। কিন্তু মোনা বুজরুক ডনকে ঠকাবে এবং ডন একটা ছোট ছেলে। এতেই মোনার ওপর খাপ্পা হয়েছিলুম। বড়রা বোকামি করে ঠকে। ছোটদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকানো ভারি অন্যায়। ভাবলুম, মোনাকে গিয়ে খুব বকে দিয়ে আসি।
কিন্তু ডন তক্ষুনি ফিরে এল। তার হাতে একটা ছোট্ট শিশি। শিশিটা দেখিয়ে সে খুশিখুশি মনে বলল,-গোগো টাকা নিয়ে গিছল মামা! মোনাদা ওকে দিল না। বলল, আগে আমি কিনব বলেছিলুম, তাই আমাকেই সে বেচবে।
সে টেবিলে শিশিটা রাখল। শিশিটার ভেতর কিছু নেই। বললাম,–হ্যাঁরে, এর ভেতর যে ভূত আছে, কী করে বুঝলি?
ডন বলল, আছে মামা! মোনাদা বলল, সন্ধ্যা হলেই দেখতে পাওয়া যাবে।
–ঠিক আছে। তা এই যে তুই ভূত পুষবি, ভূতকে কিছু খেতে দিতে হবে?
–হবে বইকী। ভূতেরা দুধ আর মাছ খায়। তাই খাওয়াব।
–কিন্তু খাওয়াতে গেলে যদি ভূতটা পালিয়ে যায়?
মোনাদা বলল, আবার ফাঁদ পেতে ধরে দেবে।
–ডন চাপা গলায় বলল, আমি একটু দুধ নিয়ে আসি মামা! তুমি যেন ছিপি খুলল না।
ডন দুধ আনতে গেল। আমি সেই সুযোগে শিশির ছিপি খুলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না। ছিপিটা খুলতেই বোটকা গন্ধ টের পেলুম। তারপর দেখি, জানলা গলিয়ে একটা বেড়াল লাফ দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
ব্যাপারটা এমন আকস্মিক যে, চমকে উঠেছিলুম। কালো বেড়াল তো এঘরে দেখিনি। বাড়িতেও কোনও কালো বেড়াল নেই। ওটা এল কোত্থেকে? কখন এ ঘরে ঢুকল? ছিপি খোলার পরই বা জানালা গলিয়ে পালাল কেন?
হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম একেবারে। সেই সময় ডনের আবির্ভাব হল। তার হাতে দুধের বাটি। সে দেখতে পেল আমি ছিপি খুলেছি। অমনি চিকুর ছাড়ল,–মামা! মামা! ছিপি খুললে কেন? তারপরই তার চোখ গেল জানালার ওধারে পাঁচিলের দিকে। পাঁচিলে কালো বেড়ালটা বসে কেমন জুলজুলে চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে।
ডন দুধের বাটি রেখে আমার হাত থেকে শিশি আর ছিপি ছিনিয়ে নিয়ে বেরুল। পাঁচিলের কাছে যেতেই বেড়ালটা লাফ দিয়ে ওধারে নামল। ডনকেও বেরিয়েও যেতে দেখলুম।
এবার জানি কী কী ঘটবে। আমার কাগজ ছিঁড়ে কুচিকুচি হবে। কলমটা গুঁড়ো হয়ে যাবে। আমিও প্রচুর চিমটি খাব। ডনের নখ যা ধারালো!
কাগজকমল সামলে রেখে আমিও পালানো ভূতটা ধরার ছল করে বেরিয়ে গেলুম। রাস্তার দাঁড়িয়ে ডন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সে কিছু বলার আগেই বললুম,–চল! আবার মোনা বুজরুকের কাছে যাই। সে কাঁদ পেতে পালিয়ে যাওয়া ভূতটাকে ধরুক। টাকা যা লাগে, দেব।
ডন কঁদো কাঁদো মুখে এগোল! খেলার মাঠ পেরিয়ে ঝিল। ঝিলের ধারে শিবমন্দিরের ওখানে ঘন জঙ্গল। সেখানে পৌঁছে ডাকলুম,–মোনা আছে নাকি! ও মোনা!
সাড়া এল জঙ্গলের দিক থেকে,–কে ডাকে গো?
মোনার গলার স্বর কেমন অদ্ভুতুড়ে। বললুম,–শিগগির একবার এসো তো এদিকে। একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে।
জঙ্গলের ভেতর থেকে মোনার জবাব এল। আমিও এক কেলেঙ্কারিতে পড়েছি। জায়গা ছেড়ে নড়ি কী করে?
অগত্যা মন্দিরের পেছনে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকলুম। বললুম,–তুমি আছোটা কোথায়?
–শ্যাওড়া গাছের ভেতরে।
শ্যাওড়া গাছটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলুম, মোনা গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে ডালপালার ভেতরে। আমাদের দেখে সে ফিক করে হাসল। ওপর পাটির দুটো দাঁত নেই। তাই তার হাসিটা বেশ অমায়িক দেখাল। বললুম,–ওখানে বসে তুমি কী করছ মোনা?
মোনা বলল,–ফাঁদে একটা পেতনি পড়েছে। শিশিতে ঢোকাতে পারছি না। বলেই সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,–এই যা! পালিয়ে গেল।
সে শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এল। হাতে একই সাইজের একটা শিশি। হাসি চেপে বললুম, ফঁদ থেকে পেতনি পালিয়ে গেল। আর ডনের শিশি থেকে ভূতটা পালিয়ে গেছে। শিগগির একটা জোগাড় করো।
মোনা বলে উঠল,–এঃ হে হে হে! সর্বনাশ! সর্বনাশ! খোকাবাবুকে অমন পইপই করে বলেছিলুম, সাবধান!
ডন কঁদো কাঁদো মুখে বলল,–মামা শিশির ছিপি খুলেছিল।
মোনা বলল,-ছোটবাবু! কাজটা ঠিক করেননি। খোকাবাবুকে যে ভূতটা বেচেছিলুম, সে খুব ঘোডড়ল ভূত। সে কে জানেন! পাঁচু। সেই পাঁচু-চোর।
পাঁচু নামে একটা চোর ছিল আমার ছেলেবেলায়। পাকা সিঁদেলচোর। কত বাঘা বাঘা দাবোগাবাবুকে সে নাকাল করে ছাড়ত। বুড়ো হয়ে সে মারা পড়েছিল অসুখ-বিসুখে। যাই হোক ডনের সামনে মোনার সঙ্গে ভূত নিয়ে তর্ক করা ঠিক নয়। বললুম,–যাই হোক, পাঁচুকে আবার ফাঁদ পেতে ধরে দাও।
ডন বলল,–মোনাদা! পাঁচু কালো বেড়াল সেজে পালিয়ে গেছে।
ভনের ভূত
কালো বেড়াল? –মোনা ভুরু কুঁচকে বলল,-। তাহলে তো বড় কেলেঙ্কারি হল। ঠিক আছে, দেখছি। ইঁদুর ধরে ফাঁদে আটকাতে হবে ওকে। এখন ইঁদুর পাই কোথা দেখি। কই, খোকাবাবু। শিশিটা দাও।
শিশিটা নিয়ে সে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল। গেল তো গেলই। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। একসময় হঠাৎ াও শব্দ শুনে দেখি, ঝোঁপের ভেতর থেকে সেই কালো বেড়ালটা মুখ বের করছে। দেখামাত্র ডন তাকে তাড়া করে গেল। তারপর আর তাকে দেখতে পেলুম না। কিছুক্ষণ তাকে ডাকাডাকি করে মন্দিরের পেছনে বটতলায় গিয়ে বসে পড়লুম।
সেই সময় দেখলুম, একটু দূরে বাঁশবনের ভেতর গুঁড়ি মেরে মোনা বাঘের মতো চুপিচুপি হাঁটছে। তারপর সে লাফ দিয়ে যেন কিছু ধরল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল,-এবার? এবার বাছাধন যাবে কোথায়? খোকাবাবু! ছোটবাবু! চলে আসুন।
সাড়া দিয়ে বললুম,–এই যে এখানে আছি।
মোনা আমাকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত শব্দে হাসতে-হাসতে চলে এল। ছিপি আঁটা শিশিটা আমাকে দিয়ে বলল,-এবার কিন্তু সাবধান। তা থোকাবাবু কোথায় গেল?
বললুম, কালো বেড়ালটা দেখতে পেয়ে ছুটে গেছে। তুমি খুঁজে দেখো তো ওকে।
মোনা বলল, সর্বনাশ! আপনি খোকাবাবুকে যেতে দিলেন? পেতনিটার পাল্লায় পড়লে বিপদ হবে যে!
সে হন্তদন্ত হয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। একটু পরে সে ডনকে নিয়ে ফিরে এল। বলল, আর একটু হলেই পেতনি খোকাবাবুকে ধরে ফেলত। পেতনিদের স্বভাব জানেন তো? ছেলেপুলে দেখলেই কুড়মুড় করে মুন্ডু চিবিয়ে খায়। আপনারা শিগগির চলে যান। আর একটা কথা, পাঁচুকে তেরাত্তির উপোস করিয়ে রাখবেন।
ডন এসেই আমার হাত থেকে শিশিটা ছিনিয়ে নিল।… ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু তা হল না।
রাত্তিরে ডন আমার কাছে শোয়! শিশিটা বালিশের পাশে রেখে সে ঘুমোচ্ছিল। আমি ঘুমুতে পারছিলুম না। সেই বেড়ালটার কথা ভাবছিলুম। আরও ভাবছিলুম পাঁচু চোরের কথা। পাঁচুকে একটু-একটু মনে পড়ে! লম্বা সিঁড়িঙে চেহারার লোক ছিল সে। মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কেউ যাতে চুল ধরে তাকে বেকায়দায় না ফেলে, সেইজন্য ওইরকম করে চুল ছাঁটত। শুনেছি, দুদে দারোগা বন্ধুবিহারী ধাড়া তাকে শায়েস্তা করেছিলেন। কিন্তু কথাটা হল, পাঁচু মরে কালো বেড়াল সেজে বেড়ায় কেন?
হুঁ, ওই যে কথায় বলে-স্বভাব যায় না মলে। মরার পরেও পাঁচু বেড়াল সেজে দুধ-মাছ-মাংস চুরি করে বেড়াচ্ছে না তো? তবে তার আগে দেখা দরকার, সত্যি ডনের শিশি থেকে কালো বেড়াল বেরোয় কি না। রাত্তিরটা ছিল জ্যোৎস্নার। জানলার বাইরে ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় চুপিচুপি বালিশের পাশ থেকে শিশিটা নিয়ে ছিপি খুলে দিলুম।
অমনি দেখলুম, ফের একটা কালো বেড়াল জানালা গলিয়ে পালিয়ে গেল। এবার আমার শরীর শিউরে উঠল। তক্ষুণি ছিপি এঁটে শিশিটা যথাস্থানে রেখে জানালায় উঁকি দিলুম। বেড়ালটা পাঁচিলে বসে নীল জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তক্ষুণি জানলা থেকে সরে এসে শুয়ে পড়লুম। নাহ! সত্যি তাহলে ভূত আছে।
সকালে উঠে শুনি, রান্নাঘরে চোর ঢুকেছিল। সকালের চায়ের দুধ রাখা ছিল। এক ফোঁটা নেই। নটার আগে গয়লা দুধ দিতে আসে না। জামাইবাবু–ডনের বাবা খুব বকাবকি করলেন দিদিকে। দিদি নাকি রান্নাঘরের দরজা-জানালা আটকাতে ভুলে গিয়েছিল। শুধু দুধ নয়, ফ্রিজ থেকে মাছ-মাংস সব নিপাত্ত হয়ে গেছে।
ডন ছোটছেলে। সে এ নিয়ে মাথা ঘামাল না। কারণ শিশির ভেতর বন্দি পাঁচুকে তেরাত্তির উপোস রাখতে হবে। কাজেই সে ছিপি খোলেনি। সে তো জানে না, আমি ছিপি খুলে এই কেলেঙ্কারিটি বাধিয়েছি। ডন ভেবেছে পাঁচু শিশির ভেতর রয়ে গেছে।
চুপিচুপি মোনার ডেরায় চলে গেলুম।
মোনা আজ তার ডেরাতে বসে চোখ বুজে তপজপ করছিল। ডেরা মানে মন্দিরের লাগোয়া একটা পুরোনো জরাজীর্ণ একতলা ঘর। জপ শেষ হলে সে চোখ খুলে আমাকে দেখে বলল,-পাঁচু পালায়নি তো ছোটবাবু?
হ্যাঁ। পালিয়েছে। আসলে আমারই বোকামি। মোনা, ডন এখনও জানে না আমি ফের ছিপি খুলেছিলুম।–বলে যা ঘটেছে, তার মোটামুটি একটা বিবরণ দিলুম।
মোনা গুম হয়ে গেল। একটু পরে বলল, ঠিক আছে। তিনটে টাকা ছাড়ুন ছোটবাবু। আমি পেতনিটাকে শিশিতে ভরেছি। আপনি বরং এই শিশিটা আপনার ভাগনেবাবাজির শিশির সঙ্গে পাল্টে ফেলুন। খালি শিশিটা আমাকে ফেরত দিন। আর হ্যাঁ, পেত্নি কিন্তু দুধ-মাছ-মাংস খায় না। একটু শুকনো গোবর আর হাড়গোড় এর খাদ্য।
তিনটে টাকা গচ্চা গেল। কী আর করা যাবে? বাড়ি ফিরে এক সুযোগে ডনের শিশিটা নিয়ে এই শিশিটা রেখে দিলুম ডনের পড়ার টেবিলে। ডন তখন স্কুলে।
মোনাকে খালি শিশিটা ফেরত দিয়ে এলুম। মোন আমাকে সাবধান করে দিল।
সে-রাত্তিরে আবার আমার মনে হল, সত্যি এই শিশির ভেতর পেতনি আছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার। ডন যথারীতি বালিশের পাশে শিশি রেখে ঘুমোচ্ছিল। শিশিটা চুপিচুপি তুলে নিয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁকে রেখে ছিপি খুলে দিলাম।
তারপর যা দেখলুম, ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল।
জ্যোৎস্নায় একটা সাদা কাপড়পরা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
সাহস করে টর্চ বের করলুম। টর্চ জ্বালাতেই মূর্তিটা আর দেখতে পেলুম না। চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, সাদা মূর্তিটা বাগানের একটা আম গাছে উঠে গেল। একটু পরে আম গাছের ডগায় তাকে দেখা গেল। সেখান থেকে উঁচু একটা বাজপড়া ন্যাড়া তাল গাছের মাথায় গিয়ে বসল। তারপর পাচার ডাক শুনলুম ক্রাঁও। ক্রাঁও!
টর্চের আলো ফেললুম। কিন্তু কিছু দেখতে পেলুম না। আমার চোখের ভুল নয় তো? টর্চ নেভালে সাদা কাপড়পরা পেতনিকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আলো জ্বালিয়ে পাচ্ছি না। ব্যাপারটা ভালোভাবে পরীক্ষা করা দরকার।
বাজপড়া তালগাছটার কাছে গিয়ে ফের টর্চ জ্বাললুম। কিন্তু জুলল না। সুইচ বিগড়ে গেল নাকি? টর্চ নাড়া দিয়ে এবং ব্যাটারি বের করে আবার ঢুকিয়ে অনেক চেষ্টা করলুম, টর্চ আর জুলল না। পেতনিটা বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে।
একটু পরে শুনি, গুনগুন করে মেয়েলিগলায় গান গাইছে সে।
‘এমন চাঁদের আলো
মরি যদি সে-ও ভালো
সে-মরণ স্বরগ সমান।‘
এবার আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হল না। চুপিচুপি ঘরের দিকে পা বাড়ালুম তারপর এক কাণ্ড ঘটল। ভীষণ ঠান্ডা কী একটা জিনিস আমার মাথার পেছনে চাটি মারল। মাথা যেন বরফ হয়ে গেল।
তারপর ঘরের দিকে যত এগোচ্ছি, বারবার তত চঁটি খাচ্ছি। টলতে-টলতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলুম। শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল মাথায় পেছনদিকে কী একটা আটকে যাচ্ছে। আঁতকে উঠে হাত দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিলুম। পেতনির হাত ভেবে সেটা মুঠোয় ধরে ঘরের আলো জ্বেলে দিলুম।
কী কাণ্ড! একটা চামচিকে।
চামচিকেটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এটা না হয় চামচিকে। সাদা কাপড়পড়া মূর্তিটা তো পেত্নি।
নাকি পেতনিটাই চামচিকেটাকে হুকুম দিয়েছে আমার মাথায় চাটি মারতে?
কে জানে বাবা! আর ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। ডন খালি শিশিতে পাঁচুর ভূত আছে ভেবে কিছুদিন শান্ত থাকবে। খামখেয়ালি ছেলে। তারপর এসব ভুলে যাবে। কাজেই আর এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।…..
যা ভেবেছিলুম হলও তাই। পরদিন বিকেলে ডন এসে আমার পিঠে চিমটি কাটল। বললুম,–আবার কী চাই?
ডন গম্ভীরমুখে বলল,-পাঁচুর ভূতটা গোগোকে বেচে দিলুম।
–ভালো করেছিস।
–মামা, দুটো টাকা দাও।
–আবার কী কিনবি?
ডন ফিক করে হেসে বলল,–ঘুড়ি প্লাস লাটাই প্লাস সুতো। তোমার দুই প্লাস গোগোর তিন। ইজ ইকোয়াল টু পাঁচ।
দুটো টাকা দিলুম। বললুম,–হ্যাঁ ঘুড়ি কেনো। সেটা ভালো। কিন্তু আর যেন ভূত কিনতে যেও না।
ডন গুলতির বেগে উধাও হয়ে গেল।