Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পূর্ণ সহযোগিতা

রোগী প্রচুর কথা বলছে। অর্থাৎ প্রায়ই পূর্ণ সহযোগিতা পাই। আমার বাঙালত্ব নিয়ে বিরক্তিটা দেখছি বেশ সামলাতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি যুক্তিবোধ বা যাকে বলে হুঁশজ্ঞান বা কমনসেন্স এখনও আসেনি। তাহলে আমার পরনে সাদা কোটটা (ধারে পাওয়া) এত সহজে মেনে নেওয়া যেত না। রোগী যখন নিজের অতীতের কথা বলে তখন হঠাৎ হঠাৎ তার স্মৃতি একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। শুনলে মনে হয় যেন চোখের সামনে যা ঘটছে তার ধারাবিবরণী। এবং ভাষ্যকার যেমন দৃশ্যটির অংশ, তেমন রোগীও যেন স্মৃতির মধ্যে দিয়ে আবার ঘটনাগুলিতে ফিরে যাচ্ছে। নতুন করে ঘটছে তার চেতনায়।

যে অধ্যায়গুলোর কথা শুনি সবই একটা বিশেষ পর্যায়ের যখন রোগীর কর্মও ব্যক্তিজীবন ছিল পরস্পর সংলগ্ন। দুটিই অদ্ভুতভাবে আবর্তিত হয়েছে একতা নামে একটি প্রবাসী বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ঘিরে। ভুবনেশ্বরে এই ক্লাবটিকে অবলম্বন করে তার জীবন পেয়েছে বহুমাত্রা। তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ। দায়িত্ব পালন করেছে সাবালক পুরুষের, পরিবারের কর্তার।

এত মানুষের ভালমন্দে যে মাথা ঘামায়, সক্রিয়ভাবে কিছু করে, তাকে তা কোনও মতেই আত্মকেন্দ্রিক বা বাস্তবজ্ঞানশূন্য বলা যায় না। তাহলে মানসিক ভারসাম্যটা নষ্ট হল কেনও কী করে?

.

গ্রিভস কটন-এর সুশান্ত ঘোষের স্ত্রী সংযুক্তা আর ইন্ডিয়ান মেটাল অ্যান্ড ফেরো অ্যালোয়েজ-এর অধীর দত্তর স্ত্রী সুপর্ণার ক্ষেত্রে কিন্তু অমলের অসম প্রতিযোগিতার সূত্রটি খাটেনি। সংযুক্তা আর সুপর্ণা কেউ ভুবনেশ্বরে চাকরি চায়নি, চেয়েছে পড়াশুনা করতে। সংযুক্তা কলকাতার শহরতলিতে কী একটা নতুন কলেজে পড়ায়। বেশ কবছরের চাকরি। এদিকে সুশান্ত বদলি হয়ে এসেছে ভুবনেশ্বরে। অন্তত বছর তিনেক থাকতে হবে। এপারে কেকা ওপারে কুহু। প্রথম বছর সব ছুটিছাটা উইকএন্ড ভেকেশানে সংযুক্তা কমুট করেছে। আ টেল অফ টু সিটিজ। কলেজের শুভ্যানুধ্যয়ীরা পরামর্শ দিল কলিঙ্গ ইউনিভার্সিটিতে এমফিল করে ফেলুক, বছর খানেক অডি লিভ নিয়ে স্বামীর কাছে থেকেও যেতে পারবে। সুপর্ণা ভূগোলে ফার্স্টক্লাস,ভাবল এখানে পিএইচডির চেষ্টা করা যাক। দুজনকেবগলদাবা করে সরস্বতী বিহারে যার যার বিভাগে নিয়ে গেল অমল। হেড-এর সঙ্গে আলাপ করালো।

প্রচুর উৎসাহ সহযোগিতার আশ্বাস, সুন্দর নিখুঁত ব্যবহার, ভদ্রতার ত্রুটি নেই। দুজনে পরে নিজেরা এসে সব বুঝেটুঝে হেড-এর উপদেশ অনুসরণ করে দরখাস্ত দিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস থেকে অবিলম্বে কাগজ দুটি ফেরত। এমফিল-এ সীমিত সংখ্যক আসন। সবই নিজেদের রাজ্যের ছাত্রছাত্রী অধ্যাপকদের জন্য রাখা। সুপর্ণার দরখাস্ত নাকচ কারণ তার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি এখানে স্বীকৃত নয়। অথচ অমলের পরিষ্কার মনে আছে এখানকার বিভাগীয় প্রধান গল্প করছিলেন কদিন আগে বর্ধমানের কোন্ অধ্যাপক পি এইচ ডি-র ভাইভা নিতে এসেছিলেন। থেকে থেকে অমলের কেমন সব গুলিয়ে যায়। ইংল্যান্ড আমেরিকায় নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কদর পায় না। ওখানে গবেষণা বা চাকরি করতে হলেওখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার ছাপ প্রয়োজন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ কি তেমনই একে অন্যের কাছে বিদেশ? হয়তো তাই।

বোধহয় অদ্ভুত লাগাই উচিত নয়। সেই কবে ছোটবেলায় বাবার চেম্বারে ঢুকে দেখত দরজার ওপরে দিদির হাতে ক্রসস্টিটে গেরুয়া-সাদা-সবুজে লতিয়ে লেখা এক জাতি এক প্রাণ একতা। স্কুলে গানের সঙ্গে ড্রিল, মাথার মধ্যেও ড্রিল হয়ে গেছে। ওটা এক বিশেষ সময়ে বিশেষ জনগোষ্ঠীর অনুভূতি। তার পিছনে ছিল বিশেষ কারণ, ইংরেজ বিতাড়ন। আজ সেই কারণ নেই, নেই সেই মানুষজন। সেই সময়টাই পাল্টে গেছে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা টাইমমেশিনে আটকা পড়ে আছি।

পরের পার্টিতে অর্থাৎ একতা ক্লাবে কার্যকরী কমিটির সদস্যদের মাসিক জমায়েতে সেই কথাই উঠল। অমলই মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলল,

–দেখ তোমরা ওই পড়া-ফড়া ছাড় তো। অনেক তো পড়েছ, সব এম-এ-টেমে পাশ, আর কত পড়বে। অন্য কাজকর্ম কর, এই তো মঞ্জু আর সুজাতা—সুজাতা হোটেল কলিঙ্গ অশোকের অ্যাসিস্ট্যিান্ট ম্যানেজার বিভূতি পালের বউ-কেমন দুজনে দিব্যি কোচিং খুলে ফেলল। রোজ ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। দেখ না দুচার বছরে কী হয়। একেবারে নিউ ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোম। সেখানে কই কিস্যু বাঙালি ওড়িয়া প্রবলেম নেই। ইংলিশ মিডিয়াম-এর মতো ইংরেজি পড়াও সঙ্গে ম্যাথমেটিক্স, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি যদি পার তো কথাই নেই। সবাই লুফে নিচ্ছে। আমাকেই দেখ না, বঙ্গালি বলে কখনও অসুবিধা হয়নি। নেভার, কত লোকে যা এক্সপেক্টেড তার চেয়ে বেশি করেছে। ইন্ডাস্ট্রিজ মিনিস্টারকেই দেখ। আমাকে রীতিমতো ভালবাসেন। একতা যখন শুরু হয়েছিল তখন ফিনান্সিয়াল কন্ডিশান কী ছিল মনে আছে? কোনওক্রমে টায়টায় চলা। আমাদের ফার্স্ট ব্রেক সেই কটকে ফাংশান। ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ম্যাজিসিয়ান এ সি সরকারকে আনা। উনি কি দারুণভাবে হেল্প করেছিলেন। ওঁর সাহায্য ছাড়া একতা আজকে এই জায়গায় পৌঁছতে পারত?

—একতার কথা, আপনার কথা দাদা আলাদা, আপনাদের বেশিরভাগ কলকাতায় কংগ্রেস সাপোর্টার। আপনার তো একটা ডেফিনিট কংগ্রেস ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। এখানে কংগ্রেস মিনিস্ট্রিতে তাই এত কোঅপারেশন পেট্রোনেজ পান। রণজিতটা একটু ঠোঁটকাটা, মামাবাড়ি বরিশাল তো। আধা বাঙাল। তার ওপর বেশি কোয়ালিফায়েড, টেলকোর আভিজাত্য। অমলকে অন্যদের মতো অতটা যেন খাতির করে না।

অবশ্য অমল কোনও উত্তর দেবার আগেই স্ত্রীরা হইহই করে উঠল।

-নো পলিটিক্স। নো পলিটিক্স। বলেছি না কংগ্রেস সি পি এম নামোচ্চারণ বারণ। রণজিতটাকে ফাঁইন দিতে হয়। চট করে বেরিয়ে এক বোতল ডিরেক্টরস স্পেশাল।

সুপর্ণা এতক্ষণ মুখ চুন করে বসেছিল। জিন অ্যান্ড লাইম পেটে থিতিয়ে বসতে চাঙ্গা হল।

–যাকগে ওসব কথা। যা হবে না তা হবে না। এ নিয়ে তর্ক করে লাভ কী। দাদাই ঠিক বলেছেন। স্বাধীন ব্যবসা ট্যাবসা করলে ঝামেলা নেই। আচ্ছা দাদা ইউনিসেফের গ্রিটিং কার্ড বেচলে কেমন হয়? সব বড় অফিসে গ্রিটিং কার্ড বিভিন্ন অকেশানে কেনা হয়। ক্রিসমাস নিউইয়ার ছাড়াও আজকাল দেওয়ালি-হোলি এসবে চলছে। মাড়োয়ারি-গুজরাটি ফার্মে। বেশ ভদ্র ব্যবসা। ওটা যদি করি?

এর আগে আরেকটি মেয়ে দেবারতি, ইন্ডিয়ান অয়েলের সঞ্জয় গুপ্তর স্ত্রী ইউনিসেফের এজেন্সি চালাতে চেষ্টা করেছিল, হয়নি। ওড়িশার এক প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারির স্ত্রী তাদের ডিভোর্সি কন্যার বকলমে ব্যবসাটিতে লেগেছেন। যেখানে কোনও ভূমিসূত বা ভূমিসূতাব দুপয়সা করার সম্ভাবনা, বিশেষ করে কোনও আইএএস, আইপিএস, আইআরএস, অর্থাৎ উচ্চপদস্থ আমলার স্ত্রী-পুত্রকন্যা-ভাইপো-ভাগ্নে, যদি কোনওরকমভাবে জড়িত, তাহলে সে ক্ষেত্রটিতে সর্বসাধারণের বিশেষ করে বহিরাগতের প্রবেশ নিষেধ। অমলকুমার দাস ব্যাঙ্কার মানুষ। টাকাপয়সা লেনদেন তার জীবিকা। উচিত অনুচিত এসব ভাববিলাসের ধার ধারেনা। বাস্তবকে মেনে চলে। সে বুঝে গেছে ওড়িশায় আইএএস মানে বাংলার রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ-হেমন্ত-অমর্ত। হ্যান্ডস অফ। আউট অফ বাউন্ডস ফর দ্য রেস্ট অফ ইন্ডিয়া।

অতএব বলল-ওটা সুপর্ণা ঠিক জমবে না। এখানে কটাই বা অফিস। বরং অন্য কিছু ভাবো।

—আপনি কিছু বাতলান না।

—কেন, সব জিনিসে আমি কেন। এই এখানে এতগুলো নামকরা ফার্মের বাঘা বাঘা প্রতিনিধি বসে, তাদের জিজ্ঞাসা কর না। তোমার কর্তাটি কী বলেন?

-না, না দাদা, ওদের গা-ই নেই। আপনি একটু আমাদের জন্য ভাবুন প্লিজ। কয়েকটি নারীগলার কোরাস।

অগত্যা অমলকে ভাবতে হয়। তার একজন ওড়িয়া ক্লায়েন্ট যে নিজে কটকে এক মাড়োয়ারি বনস্পতি কোম্পানির বেনামী অংশীদার সে আবার ভুবনেশ্বরে নিজের স্ত্রীর নামে একটা প্রিন্টিং প্রেস কিনেছে। স্ত্রীটি বহরমপুর গঞ্জামের কুমুঠি বাড়ির মেয়ে। পুরুষানুক্রমিক ব্যবসায়ী বুদ্ধি, এখন তিনি স্মার্ট হচ্ছেন, উপরে উঠবেন। তারও ইচ্ছে, স্বামীরও সুবিধে। অতএব, নেমন্তন্ন কার্ড ছাপানোর বাঙালি ওড়িয়া যৌথ যোজনা প্রস্তুত হল। কিন্তু তেলেজলে মিশ খায় না। দুদিন যেতে না যেতেই গণ্ডগোল। মেয়েদের একসঙ্গে হওয়া মানে কে কত পড়াশোনা করেছে, ইংরিজি কেমন, জামাকাপড় মেকআপ, সংসার চালনার স্টাইল, সব এসে যায়। অতএব উড়েনী বঙালুনী পার্টনারশিপের ইতি। প্রায় হাতাহাতিতে দাঁড়াত যদি না এর মধ্যে সুপর্ণার স্বামী অধীর ইমফা ছেড়ে আরও বড় কোম্পানিতে আরও ভাল চাকরি নিয়ে আমেদাবাদ না চলে যেত। ওদের ফেয়ারওয়েলে যথারীতি কটকি রূপোর ফিলিগ্রি কাজের মেমেন্টো দেওয়া হল। এখানে বলে তারকোষিকাম। অমলই পছন্দ করে কিনল।

ইন্ডিয়ান অয়েলের সঞ্জয়-দেবারতির বেলায় ফেয়ারওয়েল দেওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। ওরা এমন হঠাৎচলে গেল কেন জিজ্ঞাসা করেছিল অমল দুচারজনকে। একতার সেক্রেটারি সুজিত সকলের খবর রাখে। ও একমাত্র এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বাঙালি অর্থাৎ টেকনিক্যালি ক্যারা, যাকে একতা ক্লাবে নেওয়া হয়েছে। কারণ ও অতি চালু ছেলে। রাজ্যের কোথায় কী হচ্ছে ও কেন হচ্ছে সব খবর নখদর্পণে। একটি গেজেট বললেই হয়। কলকাতা থেকে গাংগুরামের ফ্রাঞ্চাইজ কিনে ওড়িশাতে বহু জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো গাংগুরামের দোকান গজিয়ে উঠেছে। তার একটি দোকানের মালিক। ব্যবসা রমরমা বাড়িটারি করে ফেলেছে। পুজোর সময় বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে কুলুমানালি বেড়াতে যায়। অমল অবশ্য কখনও ওর দোকানের মিষ্টি খায় না। সর্বদা বলে সে নর্থ ক্যালকাটার ঘটি, মিষ্টির ব্যাপারে নো কমপ্রোমাইজ। ওখানে একজাতি একপ্রাণ একতা নেহি চলেগা। একবার পেট খারাপের সময় ওর দোকান থেকে দুশো দই এনে দিয়েছিল বীর সিংহ। তা একটু খেয়ে-যাক সে কথা। অমল সুজিতকে মুখের ওপরেই বলে–

–উড়েদের ঠকাচ্ছো। খালি মাঠে গোল। এরা তো মিষ্টিফিষ্টি কিছু বোঝে না। তাই করে খাচ্ছ। হত আমাদের শ্যামপুকুর কি হাতিবাগান বা গড়পার, তখন তোমার ঐ মিষ্টি শুধু মাছিতে খেত। এমন বেহায়া গায়েই মাখে না, একমুখ হেসে বলে,

—আরে দাদা, আপনার মতো এখানে সমজদার কে? যা দিই তাই বাপের জন্মে দেখেনি। আগে কী ছিল তো জানেন না। সমস্ত ওড়িশার মধ্যে মিষ্টির দোকান বলতে হাতে গোনা, কটকে ক্যালকাটা সুইটস ঢেনকানলে প্যারাডাইস নিমাপাড়ার ছানার জিলিপি আর কটক-ভুবনেশ্বরের রাস্তায় পাহালের রসগোল্লা।

পাহাল শুনেই অমল আঁৎকে ওঠে। প্রথম প্রথম ভুবনেশ্বরে এসে ভাল মিষ্টির খোঁজ করলে অফিসের স্টাফ গদগদ ভঙ্গিতে বলত,

—আইজ্ঞা, দিনে পাহালের রসগোল্লা টিকিএ খাইবে। বঢ়িয়া করুছন্তি। একবার কটকে যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে এক হাঁড়ি কিনে এনেছিল। বাব্বা, এক একটি গোল থান ইট। কোথায় তার যুঁইফুল সাদা স্পঞ্জের রসগোল্লা, মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। আর এর এক একখানা চিব্বোচ্ছে তো চিবোচ্ছে, চিবোচ্ছে তো চিবোচ্ছে। চেহারাখানিই বা কি। ম্যাটমেটে, রসটা নোংরা জলের মতো। হ্যাঁ, সাইজ একখানা বটে। প্রায় রাজভোগ। অমল ক্রমে বুঝতে পারে এখানে সকলের মনে বদ্ধমূল বিশ্বাস বিগ ইজ বিউটিফুল। জিনিস আকারে বড় আর ওজনে ভারী হলেই তার কদর।

এটা একবারে চাক্ষুষ উপলব্ধি হল কটকে বালিযাত্রার মেলায়। ফি বছর শীতে মহানদীর তীরে এ মেলা বসে। সেই কোন্ সুদূর অতীতে বণিকের দল সাগরপাড়ি দিত দেশবিদেশে তাদের বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে, তার স্মৃতিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে সুন্দর খেলনা সাইজের শোলার নৌকো ময়ুরপঙ্খী ভাসানো। ওড়িয়াদের মুখে শুনে অমলের খুব ভাল লেগেছিল। বাঃ বেশ কাব্যটাব্য করার মতো ব্যাপার তো। কটক-ভুবনেশ্বর দৈনিক যাতায়াত করা একটা কর্মচারীর দল প্রত্যেক অফিসেই থাকে। অমলের অফিসেও ছিল। তারা সাগ্রহে সাহেবকে নিয়ে গেল মেলা দেখাতে। তখন সন্ধে। মেলা আলোয় আলো। লোকের ভিড়। অন্য পাঁচটা মফঃস্বলের মেলার মতো। শুধু একটি বৈশিষ্ট্য। চারিদিকে খালি খাবার আর খাবার। সব খুব বড় বড় মাপের। কোথাও বিশাল থালার সাইজের পাঁপড় ভাজা হচ্ছে। একখানাতে ছেলে-পুলে-বাপ-মা সকলের খাওয়া হয়ে যেতে পারে। কোথাও বা ছোট লাউয়ের মতো রাজভোগ, মুক্তকেশী বেগুমের মতো পান্তুয়া। সঙ্গী কর্মচারীদের সর্নিবন্ধ অনুবোধ ঠেলতে না পেরে চাখতে হল। সর্বনাশ সব যে এক একটি বোমা। সুজি ময়দায় ঠাসা। অখাদ্য। তারপর থেকে অমল লক্ষ্য করেছে এখানে বেশিরভাগ লোকের কাছে স্বাদ গন্ধের আকর্ষণ কম। চোখে দেখা আকার আর হাতে ধরা ভারের মর্যাদা বেশি। কোয়ান্টিটি কোয়ালিটির বিচারটা গোলমেলে। পরিমাণই উৎকর্ষ। প্রথম বছর পুজোয় মৈত্রেয়ীর জন্য ওড়িশার বিখ্যাত তাঁতের শাড়ি কিনতে গিয়ে দেখে যত দামই দিক না কেন পাতলা মিহি জমির শাড়ি নেই। সবচেয়ে দামি শাড়িও প্রচণ্ড ভারী এবং বাংলা তাঁতের সস্তা আশি কাউন্টের সুতোর মতো মোটা। দোকানি সমানে পাখি পড়ার মতো বলে যায় কত খাপি জমি কত বছর টিকবে। মহাষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতে পরেছিল মৈত্রেয়ী। ঘেমে নেয়ে ফিরে এসে বলে,

-ঠিক যেন বেডকভার পরে আছি। এ শাড়ি টিকবে না তো কি। শীতকাল ছাড়া তো পরাই যাবে না আর হাঁটা তো অসম্ভব, কুঁচি হয় না এদিকে গলা অবধি বহর। এরপরে আর ওড়িশার সুতী শাড়ি কেনেনি। একযুগ বাদে ভুবনেশ্বর ছাড়বার সময় উৎকলিকায় দেখল বেশ পাতলা জমির সব শাড়ি। দাম অবশ্য বাংলা তাতের দ্বিগুণ। তবু ভাল, বাইরের বাজারের সঙ্গে তাল মেলাবার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আগের মতো ঠাসজমি দশহাত বহরে পঞ্চাশ ইঞ্চি বেঢপ শাড়ি আর বোনে না। আর্থিক লেনদেনের নিয়ম সবার ওপরে। ব্যবসা করলে চোখ কান খুলতেই হবে। বাইরের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তবে জিনিস বিক্রি….

–আচ্ছা, আপনি আর পাঁচ জনের মতো একটা ছকে বাঁধা গল্প বলতে পারেন না? কোথা থেকে কোথায় চইল্যা যান। সঞ্জয় দেবারতির ভুবনেশ্বর ছাড়ার ব্যাপারটা কী হইল? ছায়া যেন মাস্টারনি। সব সময় ভুল ধরে।

—তুমি আমার জীবনকাহিনী চাও তো না কি? এসব আমার জীবনেরই অংশ। আমি কী দেখলাম কী ভাবলাম। নইলে ঘটনাগুলোর মূল্য কী? আচ্ছা ঠিক আছে। সঞ্জয় দেবারতির কথাটাই বলি।

অমল সুজিতকে জিজ্ঞাসা করে সঞ্জয়রা কেন কাউকে কিছুনা জানিয়ে ভুবনেশ্বর থেকে হঠাৎ প্রায় রাতারাতি চলে গেল। সুজিত একমুখ হেসে বলে ও সে কাহিনী শোনেননি বুঝি? ওর ছেলে পাপ্পকে মনে আছে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ। সব পার্টিতে নিয়ে আসত। একেবারে বাচ্চা তো, বছর দুই আড়াই বয়স? বেশ কথা বলত কিন্তু। কেন তার অসুখ-বিসুখ কিছু হল নাকি? হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে সুজিত।

-সে সব কিছু নয়। ছেলেটা সব সময় বুড়ো আঙুল চুষত। তা নিয়ে সঞ্জয় আর দেবারতি দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। নোংরা অভ্যেস, দাঁত খারাপ হবে, হাঁ মুখ উঁচু হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি। সব সময় ছেলেকে বারণ করে। কসপ্তাহ আগে সন্ধেবেলা সঞ্জয় ট্যুর থেকে ফিরেছে। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখে কাজের ওড়িয়া ছোঁকরাটা আর ছেলে পোর্টিকোর তলায় সিঁড়িতে বসে। ছেলের মুখে বুড়ো আঙুল। সঞ্জয় যেই না বলেছে পাপ্পু, তুমি আবার আঙুল চুষছ। বের করে ফ্যালো বলছি, ছেলে কী করল জানেন? গম্ভীরভাবে মুখ থেকে বুড়ো আঙুলটা বের করে বাপের দিকে তর্জনী দেখিয়ে বলল, শলা গণ্ডু অছি বলেই আবার বুড়ো আঙুল কপ করে মুখে চুষতে লাগল। আর সঞ্জয় জামাকাপড় না ছেড়ে সেই রাতে বিনা রিজার্ভেশানে ট্রেন ধরে সোজা পরদিন কলকাতা ডিভিশনাল অফিসে হত্যে। তার ছেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাকে এখনই কলকাতা বা আশেপাশে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে হোক নিয়ে আসতে হবে। অতঃপর পাহাড়পুর বদলি। অর্ডার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দে ছুট।

শুনতে শুনতে একতার সকলে হা হা হি হি। অতএব ভুবনেশ্বর ও একতা ক্লাব থেকে ফেয়ারওয়েল পার্টি এবং অবধারিত কটকি তারকোষিকাজের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় উপহার না নিয়ে সঞ্জয়দেবারতির বিদায়।

ছায়া দেবনাথ সন্তষ্ট হয় না। কলম থামিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে এটা একটা কী স্টেরি হইতাসে খালি রামশ্যাম খেদিপেঁচির কথা। আপনি না হিরো। হিরোর কাহিনী কই?

–আরে ওদের সকলের মধ্যেই তো আমি। সেটাই তো বোঝাতে চেষ্টা করছি। ভুবনেশ্বরে আমার বেস্ট পিরিয়ড অফ লাইফ, আমার স্বর্ণযুগ। কারণ তখন আমি নিজেকে কেন্দ্র করেই শুধু বাঁচতাম না। ছড়িয়ে গিয়েছিলাম অনেকের মধ্যে। ভাবলে আশ্চর্য লাগে না? সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, কদিনের চেনা, আলাদা শিক্ষা, হয়তো বা আলাদা পরিবেশে মানুষ। তবু শুধু বাংলাভাষী এই পরিচয়ের জোরে কাছাকাছি আসা। কিছু সময়ের জন্য। আবার যে যার নিজস্ব স্রোতে কোথায় আলাদা ভেসে চলে যাওয়া। কিন্তু যে সময়টুকু একসঙ্গে থাকা। তখন তাদের সবকিছুতে এই অমলদা। আমার কত ইম্পর্টেন্স বুঝতে পারছ না?

—মানলাম। আপনি অ্যাকটা কর্তাব্যক্তি হইসিলেন। কিন্তু আপনার নিজের কী হইতেছিল? আপনার নায়িকা গ্যালেন কই? আপনার আর তার ভাব-ভালাবাসা-বিরহ অভিমান এই সবই না স্টোরি। আপনি অ্যাকটা ক্যামন স্টোরি কন, নায়িকার যে দেখি পাত্তাই নাই।

—আছে আছে খুব আছে। তুমি তো ধৈর্য ধরে শুনছই না। এই যে এত পার্টিফার্টি মেলামেশা দাদাগিরি ফাংশান, সবই তো তার জন্য। তার ভুবনেশ্বরে আসা উপলক্ষে। এই যে সঞ্জয় দেবারতি হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে গেল তারপর প্রথম স্টেপ তো তার। খোঁজ করে দেখ কী হয়েছিল। আমার বাড়িতে প্রতি জমায়েতে তো সে-ই হোস্টেস। শুধু তাই নয়, মধ্যমণি। আমার প্রায় সমস্ত সাবালক জীবনটার ভিত্তিভূমি সে। তাকে ঘিরে আমি, আমাকে ঘিরে একতা।

একতা ক্লাব একটা গোষ্ঠী তার কার্যকরী কমিটির সদস্যরা একটা যেন যৌথ পরিবার। হিন্দু আনডিভাইডেড ফ্যামিলি এইচইউএফ, ইনক্যামট্যাক্সের পরিভাষায়। যে পরিবারের কর্তা গোষ্ঠীপতি এই অমলকুমার দাস। সকলের সবকিছুতে যেমন অমলদা তেমন অমলের সব কিছুতেই মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী। কবে প্রথম দেখা তার সঙ্গে? স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য যেন ফ্ল্যাশ ব্যাক। মফঃস্বল শহরের আধাচা ফাঁকা রাস্তা। নিচু নিচু বাড়ি। একটির সামনে দরজায় বেল বাজাচ্ছে সদ্যকৈশোর উত্তীর্ণ একটি তরুণ। সবে প্রতিদিন নিয়মিত দাড়ি কামাচ্ছে গলার স্বর ভারী হয়েছে। দরজা খোলে। একজন তরুণী, সতেজ ছিপছিপে মাজামাজা রঙ, পরনে কমলারঙের শাড়ি, কালো ব্লাউজ, মিশকালো কোকড়া চুল আধখানা পিঠ ছড়িয়ে আছে। স্মিত সপ্রতিভ মুখ।

—ডাঃ চক্রবর্তী বাড়ি আছেন?

—না। উনি তো এখনও হসপিটাল থেকে ফেরেন নি।

–কখন পাওয়া যাবে?

–সন্ধেবেলা।

—কিন্তু আমার যে জরুরি প্রয়োজন। আমিইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আসছি। আমার রুমমেট একজন ছাত্রের খুব জ্বর। চিকিৎসার দরকার। তাড়াতাড়ি কথা বলতে যেন ঠেকে ঠেকে যায়। প্রয়োজনের পয়ে র ফলা, চিকিৎসার স উচ্চারণটা ঠিক হল তো।

তরুণীর স্মিত মুখ এবারে সুন্দর উদ্ভাসিত।

—এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? আস্তে আস্তে কথা বলুন, তাহলে আর ঠেকবেন না। কী হয়েছে আপনার বন্ধুর?

রোগের লক্ষণ শুনে ভেতর থেকে দুটো প্যারাসেটামল ট্যাবলেট আর ভিটামিন সি এনে অমলের হাতে দিল।

-এখন এগুলো খাইয়ে দিন। কঘন্টা চলে যাবে। জ্বরও কমবে। সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন। কোন ইয়ার আপনার?

-ফাস্ট ইয়ার।

–ও তাহলে তো আপনি সবে এসেছেন। বাড়ি কোথায়?

–কলকাতা।

–কেমন লাগছে এখানে?

—ভালই। তবে হস্টেলে আগে কখনও থাকিনি তো তাই অসুবিধা হচ্ছে একটু।

—মার জন্য মন কেমন? মিসিং হোমফুড? হেসে ফেলে মেয়েটি।

অমলও। মামুলি আলাপ দিয়ে শুরু। ডাঃ কল্যাণ চক্রবর্তীর স্ত্রী মৈত্রেয়ী। বিয়ে হয়েছে বছর চারেক। একটি বাচ্চা, দু বছরের ছেলে। মৈত্রেয়ীর বাবা ছিলেন আর্মির রসদ যোগানোর কাজে। বদলির চাকরি। মৈত্রেয়ীর ছেলেবেলা কেটেছে বাংলার বাইরে। শিক্ষা ইংলিশ মিডিয়ামে। তাই ইংরেজি উচ্চারণ এত ভাল। তবে বাংলাও পরিষ্কার বলে। পড়ে অবশ্য সামান্য। কলকাতার মেয়ে নয় বলেই বোধ হয় অমলের ইংরিজি বাংলা ভুলভাল হলে হাসে না। আস্তে করে শেখায় শুদ্ধরূপ। শুদ্ধ উচ্চারণ। মফঃস্বল শহরে বিশেষ করে এই আঘাটায় তার কথা বলার লোক কোথায়। ডঃ চক্রবর্তীর হাসপাতাল ছাড়া আরও কত চিন্তা। ভাল জায়গায় পোস্টিং। স্পেশালাইজেশান কোন পথে ও কী ভাবে, চাকরিতে উন্নতির জন্য কী কী দরকার ইত্যাদি। অর্থাৎ তার প্রাণমন অধিকার করে আছে তার পেশা। বলাই বাহুল্য সবই পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য। মৈত্রেয়ীর সময় কাটানোর রীতি অতি সনাতনী—রেসিপে বই দেখে নিত্য নতুন রান্না। দুর্ভাগ্যবশত ডাঃ কল্যাণ কুমার চক্রবর্তী ভোজনরসিক নন। ভালমন্দ সবই নির্বিচারে খান। রান্না খারাপ হলে বিরক্তি প্রকার করেন না। ভাল লাগলে প্রশংসায় গদগদ হন না। মানুষটা নিতান্ত কেজো। বেশি জিজ্ঞাসা করলে বলেন বাঁচার জন্য খাওয়া, খাওয়ার জন্য বাঁচায়। সে তুলনায় হোস্টেলের মেসেঅপরিতৃপ্ত অমলের কাছে মৈত্রেয়ীর মাছের চপ চিকেন কাটলেট বেনারসি বা কাশ্মীরী আলুর দম স্বর্গীয়। কে না জানে পুরুষের উদর ও হৃদয়ের মধ্যে যোগসুত্রটা অতি ঘনিষ্ট। প্রথমে অবসরমত আসা। হোমকুজিন আস্বাদন ও স্তুতি। তারপর অন্যান্য পাঁচটা কথা। অমলের পরিবারের আত্মীয়স্বজনের গণ্ডির মধ্যে এমন সপ্রতিভ ঝকঝকে ভাল উচ্চারণে ইংরিজি বলা মেয়ে অমল দেখেনি। অথচ এত ভোলামেলা। কদিনই দেখা গেল দুজনের আরেক জায়গায় মিল, নাটকের শখ। কেউই গ্রুপ থিয়েটার মার্কা আঁতেল নাটকের ধার ধারে না। আসলে মৈত্রেয়ী প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে দেখেছে জমাটি নাটকই জনপ্রিয়। হাসির, মজাদার ব্যস। সামাজিক রাজনৈতিক মনস্তাত্বিক সমস্যাটমস্যার ধারে কাছে যায় না।

অমলেরও সেটাই পছন্দ। কলেজের অন্যান্য ছাত্রদের মতো তার রাজনীতিফিতি নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। বরং বিতৃষ্ণা আছে। জন্ম থেকে অমল দেখেছে বাড়িতে রাজনীতি। হরিচরণ দাস বি এ বি এল-এর সাঙ্গপাঙ্গোদের আসাযাওয়া হৈ চৈ, সভাসমিতি ফুলের মালা, নির্বাচনী সংগঠন প্রচার, এক কথায় অন্তহীন ঝুটঝামেলা। তেরঙা প্রত্যক্ষ রাজনীতি বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতির দেওয়াল ছাদ মেঝে ইটকাঠ কড়িবরগায়। হ্যাঁ চিত্তরঞ্জন সুভাষের দিন আর ছিল না। তখন দেবতা বিধানচন্দ্র রায় অতুল্য ঘোষ। অমলের সারা ছেলেবেলাটা জুড়ে এক স্লোগান একজাতি একপ্রাণ একতা, এক ইস্য, দেশের বাইরে কম্যুনিস্ট বন্ধু দেশের ভিতর শত্রু। এতটুকু উৎসাহ জাগেনি অমলের বরং মনে হয়েছে ভূতপ্রেতের দল নেত্য করছে। সেইঠাকুরদা যা বলেছিলেন। এমন কি চিনে আক্রমণের সময় দেশাত্মবোধের প্রবল বিকারে যখন কম্যুনিস্ট মার লেফটিস্ট মার চলছে তখনও অমলের মনে আঁচড়টি কাটেনি। তার কাছে ইংরিজি ভাষার অনেক ধাঁধার মধ্যে একটি হল লাইন অফ অ্যাকচুয়েল কন্ট্রোল আর অ্যাকচুয়েল লাইন অফ কন্ট্রোল এই দুটি উক্তির পার্থক্য। অর্থাৎ অমল শুধু আপলিটিকাল নয় রীতিমতো রাজনীতিবিমুখ। সেই কি না চার বছরের জন্য শিক্ষা নিতে গেল এমন জায়গায় যেখানে আকাশ জুড়ে ঘনিয়ে আসছে বিপ্লবের ঘনঘটা।

তার ভর্তি হওয়ার সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিকই লেগেছিল। নতুন কলেজ। সে রকম কঠোর নিয়ম অনুশাসন গড়ে ওঠেনি, একটু নরম কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাবসাব। হস্টেলে তার ঘরে আর দুজন সঙ্গী। একজন তাদের বছরের সেরা ছাত্র অনিরুদ্ধ সেন যে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই শেষ করে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, আর্ট, অর্থাৎ আরো পাঁচরকমের জিনিস পড়ে এমন কি নেরুদা-ব্রেস্ট, কী করে গেরিলা হব বা রেডবুক। আরেকজন শীতাংশু মিত্র, উত্তর কলকাতার বনেদি কায়স্থ পরিবারের সন্তান যার উর্ধত ক পুরুষ বিভিন্ন পেশায় বিশেষত ওকালতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাবার চেম্বারের ঠিকানা ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিট। এখন ইঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড এম বি এর যুগ, সাধারণ উকিল মাছি তাড়ায়। ব্যারিস্টার হতে এলেম ও অর্থ দুটোই এখন অত্যন্ত বেশি লাগে। তাই বংশের পড়ন্ত সময় পড়াশুনায় মাঝারি সন্তান শীতাংশুর স্থান হয়েছে এই সদ্যখোলা কলেজটিতে। সে যদিও অমলের মতোই উত্তর কলকাতার ফসল কিন্তু জাতে উচ্চবর্ণ এবং পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনেক আলাদা। ইংরিজিটা তার নির্ভুল এবং বাংলা পরিষ্কার। প্রথম প্রথম অমলের সঙ্গে বেশ মিশতটিশত শীতাংশু। শোওয়াবসা খাওয়া দাওয়া ক্লাস করা একসঙ্গে। তা ছাড়া দুজনেরই মেকানিক্যাল। বিকেলে পাঁচজনের মতো বেড়াতে যায় করলা নদীর ধারে। জুলজুল চোখে চেয়ে দেখে চৌখস সিনিয়র বিনয়-সুগত-কৌশিক-পার্থদের দল হেভি মাঞ্জা দিয়ে বেরিয়েছে, স্থানীয় গোপা-সুমিতা-সুজাতা-কেতকীর সঙ্গে জোর টুং চলছে। ওখানে তখন কলকাতার ছেলেরা হিরো। ভূমিপুত্র যুবকের দল বাপঠাকুরদার কেনা সোনাঝুড়ি পিয়ারাছড়া নাইটকুইন হিলপ্রিন্সেসের শেয়ারকটিতে সন্তুষ্ট। দার্জিলিং চা-এর মৃদু সুবাসে তাদের নিশ্চিন্ত গয়ংগচ্ছ জীবন। উদ্যম এবং উচ্চাশা তাদের আরাধ্য দেবদেবী নয়। বাঙালি জাতির প্রথম মহামন্ত্র লেখাপড়া করে যেই গাড়িঘোড়া চড়ে সেই তাদের ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করে নি কারণ তারা জন্ম থেকেই গ্রহণ করেছে বাঙালির দ্বিতীয় মহামন্ত্রটি, একপুরুষে করে খায় তিন পুরুষে বসে খায়। অতঃপর প্রকৃতির অবধারিত নিয়মেনারী পুরুষ জোড়বাঁধার খেলায় তারা আজ পরাজিত। উদ্যোগী পুরুষের লক্ষ্মীলাভ সর্বজনীন ও চিরন্তন। কিন্তু জীবমাত্রেই নিজস্ব এলাকার হকদার। বহিরাগতর ফোপরদাললি সহ্য হয় না বিশেষ করে মেয়ে পটানোর মতো আদিম ক্ষেত্রে। অতএব, প্রথমে অশালীন মন্তব্য, তারপর ভীতি প্রদর্শন, ফলে কথাকাটাকাটি প্রতিবাদ কখনও বা হাতাহাতি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র বনাম স্থানীয় যুবশক্তি। নিত্য নাটক—যেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে অমলও উৎসাহী দর্শক এবং প্রয়োজনমতো অংশগ্রহণকারী।

দেখতে দেখতে সব পাল্টাতে লাগল। অমল আর করলা নদীর ধারে যায় না। তার মনপ্রাণ মৈত্রেয়ী আর পরীক্ষার পড়ায়। শীতাংশুর সঙ্গে তেমন আর আজ্ঞা হয় না। খেয়ালই করে নি তার নিজের ঘরের বাসিন্দা কেমন বিগড়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন ক্লাস কামাই, দিনভর বাইরে বাইরে টো টো। বেশিরাতে কাণ্ডকেত্তন করে হস্টেলে ফেরা। জামাকাপড়ের যত্ন নেই, নাওয়াখাওয়া অনিয়মিত, রুক্ষ চুল। অমলকে যেন এড়িয়ে এড়িয়ে যায়। শেষে একদিন তাকে অমল প্রায় পাকড়াও করে,

—হ্যাঁরে শীতাংশু তোর ব্যাপারটা কী বলতো? কোথায় থাকিস সারাদিন? ক্লাসে আসিস না কেন?

-এডুকেশন মে ওয়েট বাট রেভেলিউশাল ক্যান নট। সবচেয়ে আগে চাই বিপ্লব, পড়াশুনা পরে হবে।

-সে কি। পরীক্ষা দিবি না।

-কী হবে পরীক্ষা দিয়ে? বিই ডিগ্রি লাভ, এই তো? একটা ভাল চাকরি, ফর্সাসুন্দরী কনভেন্ট শিক্ষিতা গ্র্যাজুয়েট বঙ্গললনার সঙ্গে বিয়ে। একটিদুটি বাচ্চা সাজানো ফ্ল্যাট। ব্যস হয়ে গেল লাইফটা। এর জন্য পরীক্ষা দেব।

-কেন ক্ষতি কী?

—কী যে বলিস। বাস্তব থেকে পালিয়ে আমাদের চোখের সামনে চারিদিকে যে অন্যায়, যে শোষণ চলছে তার থেকে গা বাঁচিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া। সেটাই তো তোদের এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য। সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি অস্বীকার করে একটা ছোট সংসারে পালিয়ে থাকা। তোদের কি কোনও পলিটিক্যাল কনশাসনেস বলে কিছু নেই? আমি তোদের মতো নই। শুধু নিজেকে নিয়ে থাকা আমার আইডিয়েল নয়।

ভয়ানক বিরক্ত লাগে অমলের। জন্ম থেকে বাড়িতে দেখেছে মা যখনই কোনও পারিবারিক সাংসারিক সমস্যার কথা তুললে বাবা ঠিক এমনই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলতেন, আমি তোমাদের মতো শুধু স্ত্রীপুত্র পরিবার নিয়ে বাঁচি না আমাকে দেশের কথা ভাবতে হয়। ওসব আলু পটলের হিসেব আমার কাছে দিতে এস না। ছেলেপুলের হ্যাপা তো বরাবর মায়েরাই পোহায়। আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান কর কেন।

তার অর্ধশিক্ষিত খবরেরকাগজ না পড়া মা শরণ নিতেন ভাসুরদের। সংসারের হাল বরাবর রয়ে গেল বড় জ্যাঠামশাইয়ের হাতে। মেজো জ্যাঠা দেখলেন অমলদের পাঁচভাইবোনের পড়াশুনা। প্রায়ই তার মনে হয়েছে বাবা তার একজন নয় তিনজন।

তেমনই শীতাংশু যেন একা নয় অনেকে। আস্তে আস্তে দিনে দিনে কলেজ ছেয়ে গেল শীতাংশুরা। তবু বছরান্তে আরেকবার শীতাংশুকে ধরে, হাজার হোক রুমমেট বলে কথা। একটা দায়িত্ব তো আছে।

—কী রে শীতাংশু, তুই কি সত্যিসত্যি পরীক্ষা দিবি না কি?

–না।

—দুর, পাগলামি করছিস কেন?

–তোকে তো আমি বলেইছি। আমি, মানে আমরা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে।

–কোন্ সিস্টেম?

-ন্যাকা সাজছিস। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টারে ছয়লাপ। অন্ধও দেখতে পায়। তুই পাসনা? সাম্য মানুষের জন্মগত অধিকারশোষক আর শোষিত দুটি শ্রেণী দুনিয়ার মজদুর এক শ্রেণী শত্রুকে খতম কর। গেটের পাশে ডানদিকে পুরো দেওয়াল জুড়ে আলকাতায় লেখাটা দেখিস নি? বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা নিপাত যাক। ওটা আমার হাতের লেখা। আর তুই কি না জিজ্ঞাসা করছিস আমি পরীক্ষা দেব কি না।

–পরীক্ষা দিবি না, বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বাস নেই তা হলে কলেজে আদৌ ভর্তি হলি কেন? মাসের পর মাস বছরের পর বছর কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আছিস কেন? বাপের পয়সা শ্রাদ্ধ করে বিপ্লব। লজ্জা করে না?

—না করে না। এই বাপই তো এক নম্বরের শ্রেণী শত্রু। তুই জানিস না হাউ মাচ আই হেট মাই ফ্যামিলি। জেনারেশান আফটার জেনারেশান বিধবা আর নাবালকদের সম্পত্তি মেরে বড়লোক। ব্রিটিশ আমলে খুব রাজভক্ত ছিল ফ্যামিলির সবাই। কে একটা যেন রায়বাহাদুর খেতাবও পুরস্কার পেয়েছিল। এরা হচ্ছে কোলাবরেটার সুবিধাভোগী ক্লাস। আর সেই সুবিধার ফায়দা উঠিয়েছে নিজেদের দেশের লোককে এক্সপ্লয়েট করে। না, এই ফ্যামিলির কিছু টাকা নষ্ট করছি বলে আমার কোনও অপরাধবোধ নেই। নো নো, আই ডোন্ট ফিল গিল্টি, নট অ্যাট অল।

—আসলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে খালি গুলতানি করে বেড়িয়েছিস। পড়বার লিখবার ডিসিপ্লিন নষ্ট হয়ে গেছে। একেবারে গেজিয়ে গেছিস। এখন নিজেকে জাস্টিফাই করার

জন্য বাতেল্লা দিচ্ছিস বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা নিপাত যাক। আঙুরফল টক।

—মুখ সামলে কথা বল অমল।

-কেন? আমি পরীক্ষা দিচ্ছি বলে তোদের কাছে নিচু হব? যা যা জানা আছে তোদের মতো দুধেভাতে বিপ্লবীদের।

-তুই শালা একটা আস্ত বুর্জোয়া। আই হেট ইউ হেট ইউ… ভাল ছাত্র অনিরুদ্ধ না এসে পড়লে হয়তো অমল আরশীতাংশুর হাতাহাতিইহয়ে যেত। তারপর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে আর কথাবার্তা হয়নি।

অথচ অনেক কথাই অমলের বলার ছিল। সেদিন শীতাংশু অত গরম না দেখালে অমল তাকে বলত, দেখ শীতাংশু তোরা সব উচ্চবর্ণ হিন্দু, হাজার বছর সমাজের মাথায় রয়েছিল। হিন্দু আমলে যে মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা ছিল সুলতানি জমানায় সেসব বেড়েছে বই কমেনি। বরাবর দেশের চালু শিক্ষাব্যবস্থার, সুবিধা পেয়েছিস। যুক্তাক্ষর ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারিস। তোদের জিভে শ আর স, হ তার অ দিব্যি আলাদা থাকে। আধুনিক ইংরিজি শিক্ষায় তোদের মেধা আরও পালিশ হয়েছে। ভাল উকিল ডাক্তার তো বটেই জ্ঞানীগুণীও তোদের মধ্যে অনেক। সে শ্রেণীর একজন হয়ে প্রলেতারিয়েট-সর্বহারা শোষিত নিপীড়িতদের দরদ দেখানো তোর পোষায়। তুই যদি ইঞ্জিনিয়ার না-ও হোস তৃতীয় বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণীর আর্থরাজনৈতিক কাঠামো তোকে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেবে না। যাদের জন্য তোর প্রাণ কাঁদে যাদের প্রতি তুই কমিটেড তুই কোনওদিন তাদের একজন হবি না কারণ তুই তাদের একজন হয়ে জন্মাসনি, তোর চোদ্দোপুরুষ তাদের একজন ছিলেন না। তুই বড়জোর তাদের নেতা হবি। বা তাদের নিয়ে লেখালেখি করে পুরস্কার পাবি। তোর জন্য তলায় হাজার বছরের সুরক্ষা, শক্ত মাটিতে পড়ে প্রাণ যাবার ভয় নেই। সার্কাসে ট্রাপিজ খেলা দেখেছিস, শীতাংশু? কেমন সুন্দর সাবলীল অপরূপ দেহ তরুণ তরুণী অনায়াসে চমৎকার ভয়ঙ্কর খেলা দেখায়? ক্লান্ত হলে ধপ করে পড়ে যায়-না, একদম নীচে পড়ে না। ওই ওপরে ট্রাপিজের দড়ি আর সেই তলায় কঠিন মাটি। মাঝখানে পাতা শক্তপোক্ত বিরাট জাল। সেখানে নিশ্চিন্তে ঝাঁপ খায় নিপুণ শিল্পীর দল। দর্শকেরহাততালির মধ্যে পরমুহূর্তে লাফিয়ে উঠে পড়ে। গায় আঁচড়টিও লাগে না। আর আমি? আমি যদি টেকনিক্যালি কোয়ালিফাইড না হই তা হলে আজকের পশ্চিমবাংলায় কনিষ্ঠ কেরানির কাজটিও আমার কপালে জুটবে না। হয়ে যাব নিম্নবিত্ত। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন তোদের ওই মেহনতি জনতা। ঠাকুরদা ইংরিজির মই বেয়ে ভদ্রলোক শ্রেণীতে উঠলেন। বাবার ওকালতি রাজনীতি সবই কাজে লেগেছে ভদ্র মধ্যবিত্ত হয়ে থাকাটা মজবুত করতে। ওই এক জায়গায় থাকতে হলে আজ আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া চাই। শীতাংশু তুই ঠিক বলেছিস আমি বুর্জোয়া কারণ আমি বুর্জোয়াই হতে চাই। বুর্জোয়া থাকাই আমার জীবনের স্বপ্ন। কারণ প্রলেতারিয়েট থেকে বুর্জোয়া হওয়াতেই উন্নতি। হ্যাঁ, আমার কাম্য ডিগ্রি ভাল চাকরি-সংসার-ফ্ল্যাট।

এরকম বাংলা টিভি সিরিয়ালের মতো ডায়লগ অমল কস্মিনকালেও দিতে পারে না। এটা তার নিছক স্বগতোক্তি। তবে তার জীবনে শ্রেণী আরোহণের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে জোরদার ভূমিকা যে মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর তা সে ভালভাবে জানে। না জেনে উপায় কি। কলেজের ছাত্র অমলকুমার দাস আর স্থানীয় সরকারি ডাক্তারের স্ত্রী মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর, দেখাসাক্ষাতের ভিত্তিভূমি শুধু উদরতৃপ্তিতে নয়। উচ্চকোটি জীবনযাত্রার প্রশিক্ষণ। বাবার আর্মি লাইফে দেখা বিলিতি আদবকায়দা ঘরগৃহস্থালির অভিজ্ঞতা মৈত্রেয়ী তার ডাক্তার স্বামীর ওপর বিশেষ ফলাতে পারেনি। বরিশালের বাঙাল। বুদ্ধিশুদ্ধি বাঙালের মতো অতি সরল দ্বিমাত্রিক। বেশি যোগ্যতা অর্জন করলে পরিশ্রমী হলে জীবনে উন্নতি, ব্যস। নিঃসঙ্গ অবসরে অমলকে হাতের কাছে পেয়ে মৈত্রেয়ী লেগে যায় তাকে ফ্যাশান দূরস্ত করে তুলতে। টেবিলে সভ্যভাবে খাওয়া কাটা-চামচন্যাপকিন ব্যবহার, মশলাছাড়া রান্না পদের উপযুক্ত তারিফ থেকে সুরু করে প্লিজ-থ্যাংক ইউ-গুডমর্নিং গুডনাইট ইত্যাদির প্রয়োগ। সর্বোপরি চলনসই বাংলা ও ইংরিজি বলা। না, ব্যাকরণ ঠিক করা মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর ক্ষমতায় কুলোয়নি কিন্তু উচ্চারণটা পদের করে ফেলেছে। তাই তো যখন বছর পনেরো বাদে পার্কস্ট্রিটে এক সন্ধ্যেয় শীতাংশু র সঙ্গে দেখা, হা সেই শীতাংশু যে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা বিলোপে জীবন যৌবন ধনমান উৎসর্গ করেছিল—তখন প্রাক্তন বিপ্লবীকে বিস্মিত করেছিল বুর্জোয়া অমলের চাকরিতে সাফল্য নয়, তার ইংরিজি বাংলা কথা বলায় উন্নতি।

মনেপড়ে। পিটার ক্যাট-এর দোতলা থেকে নামছে অমল ও মৈত্রেয়ী। দেখে একতলায় সামনের দুজনের ছোট টেবিল থেকে বিল চুকিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে এক ভদ্রলোক সঙ্গে ফর্সা সুসজ্জিতা এক আধুনিকা। কেমন চেনাচেনা মুখ। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজনে। তারপর প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে,

–শীতাংশু।

–অমল।

–হোয়াট আ সারপ্রাইজ।

—তুই এখানে!

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। কতদিন বাদে দেখা কী করছিলি এতদিন, বাকিরা কে কোথায় জানিস—ইত্যাদি। রেস্তেরাঁয় খদ্দের ওয়েটারের যাতায়াতের পথ আগলে এত কথা হয় না। অতএব, সবাই বেরিয়ে এসে ফুটপাতে দাঁড়ায়। সমাজে সাম্য আনার বৈপ্লবিক প্রয়াসে শীতাংশুর প্রচুর কর্মশক্তি, প্রথম যৌবনের স্বাস্থ্য ও কয়েকবছর সময় নষ্ট হয়ে যাবার পর বাবাকাকা জ্যাঠা-পিসে-মেসোদের সম্মিলিত চাপ তাকে চালান করে দেয় বিবাহিত বড় দিদির সংসার সুদুর ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে প্রথমে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা তারপর দক্ষিণের এক নতুন অজ্ঞাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রিলাভ করে কলকাতায় ফেরা। এ ধরনের ব্যাখ্যাহীন সময়ের ফাঁকওয়ালা বায়োটা থাকলে একজিকিউটিভ পোস্ট তো পাওয়া যায় না। কাজেই অগতির গতি স্কুলে পড়ানো। সুসজ্জিতা আধুনিকা উসখুস করছিলেন। এবারে স্বামীর বিনীত বিবরণে বাধা দিয়ে সগর্বে জানালেন শীতাংশু কলকাতার সবচেয়ে নামীদামি বনেদী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। তাও আবার সায়েন্স সাবজেক্টস এবং উঁচু ক্লাসে।

—ক্যালকাটার বেস্ট ফ্যামিলির ছেলেরা পড়ে ওর স্কুলে। জানেন এভরিইয়ার কত স্টুডেন্টস্ ওদের স্কুল থেকেই সোজা ইউ এস এ এতে চলে যায়? আর ওইতো কোচিং দেয় সবাইকে।

—তুই কোচিংও খুলেছিস না কি?

—না..মানে… ঠিক সেভাবে নয়। স্টুডেন্টরা ডিমান্ড করলে একটু গাইডেন্স তো দিতেই হয়।

—কোথায় করিস কোচিং? বাড়িতে?

-না, স্কুলেই। সাহেবি স্কুল তো, সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হয়ে দেড়টার মধ্যে ছুটি। তারপর ক্লাসরুমগুলো সব খালি। ওখানেই সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে বসি।

-–ম্যানেজমেন্ট আপত্তি করে না।

–পাগল!স্টুডেন্টরা নিজেদের খরচে এক্সট্রো পড়ে ভাল রেজাল্ট করলে ম্যানেজমেন্ট তো খুশি থাকে রে। তাদের তো লাগছে এক দেড় ঘণ্টার বাড়তি ইলেকট্রিক খরচ। ওটা আমরা অ্যাডজাস্ট করার ব্যবস্থা করি।

–তুই কি সব সায়ান্স সাবজেক্ট পড়াস না কি?

স্ত্রী সোৎসাহে জবাব দেন,

—ওতো পড়ায় মেইনলি ম্যাথ। তবে কোচিং-এ অন্য সাবজেক্টসও দেখে, ফিজিক্স, কেমিস্ট্র। জানেন আপনার বন্ধুর খুবনাম কোচিং-এ? ওতো শুধু স্কুলের বা বোর্ডের পরীক্ষায় জন্য পড়ায় না, জয়েন্ট এন্ট্রান্স, স্যাট, মানে ইউ এস এ-তে কলেজে পড়তে হলে যে স্কলাস্টিক অ্যাপ্টিচিউটি টেস্ট দিতে হয় তারও প্রিপারেশন করায়।

– তোর তো তাহলে হেভি ইনকাম রে। আমাদের সবাইকে টেক্কা মারছিস। তারপর ফ্যামিলির খবর কী? ছেলেমেয়ে?

—একটি ছেলে, সবে চার বছর। এখন পাড়ার হ্যাপি আওয়ার নার্সারিতে যায়। পরে আমার স্কুলে শিক্ট করবো।

—কোথায় থাকিস?

স্ত্রীর উত্তর-ভদ্রমহিলা চুপ করে থাকতে পারেন না।

–এখনও সেই কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের পুরনো বাড়িতেই আছি। তবে ফ্ল্যাট বুক করা হয়ে গেছে। ঠোঁট ফুলিয়ে যোগ করেন,

—তেমন ভাল লোকালিটিতে হল না, সন্তোষপুর। তবে সাউথ ওপেন। স মোজাইক, দুটো ডবলিউসি ওয়ালা বাথরুম আর কিচেনে বলেছে টাইলস লাগিয়ে দেবে। এই তো মাস ছয়েকের মধ্যেই পজেশান পেয়ে যাব।

এবারে শীতাংশু অমলকে প্রশ্ন করে,

—আমার কথা তো অনেক হল। এখন তোর খবর কী বল। একেবারে পাল্টে গেছিস তো। কলেজে প্রথম কথাবার্তায় চালচলনে একেবারে কলকাত্তাই ছিলি। জানিস তোকে নিয়ে আড়ালে কত হাসাহাসি করতাম সামবাজারের সসিবাবু এয়েছেন হা হা হা। এখন তো দিব্যি পরিষ্কার বুলি ফুটেছে। এত বদলে গেলি কী করে? বিয়ে থা করেছিস? (অপাঙ্গে মৈত্রেয়ীর দিকে দৃষ্টিপাত)।

কী পরিচয় অমল দিয়েছিল মৈত্রেয়ীর? সাধারণত বাইরের লোকের কাছে প্রথম সাক্ষাতে যা বলে থাকে অর্থাৎ আমার বোন? হবেও বা। আজ আর সে কথা মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে তার চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠক্রমের সমান্তরাল গতিতে ক্রমবর্ধমান তার সঙ্গে মৈত্রেয়ীর ঘনিষ্ঠতা। এবং শেষ পরিণতি চক্রবর্তী বনাম চক্রবর্তী মামলা ও বিবাহ বিচ্ছেদ। যথেষ্ট ঢাকঢোক পেটানো পরিণাম।

.

কীসের পরিণাম কী আমার সন্দেহ হয়। এই ধন্দের কথা কাকেই বা বলি। সত্যি কি মৈত্রেয়ী আমার প্রেমে এমনই হাবুডুবু ছিল যে পতিপুত্ৰ সংসার তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল? নরনারীর সম্পর্কে বিশেষ করে বিবাহবহির্ভূত তথাকথিত ব্যভিচারে দেহাশ্রিত দিকটাই প্রধান। এ একটা মজার ব্যাপার। কুমারী মেয়ের সঙ্গে প্রেমে দেহের ভূমিকা অস্পষ্ট। সে প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায় বিশ্বাস করা অসম্ভব নয়। কিন্তু পরস্ত্রীকে ভালবাসা মানেই চোখের সামনে একটি শয্যা। আরও মজা হল এইখানেই আমার ও মৈত্রেয়ীর মধ্যে বরাবরের ফাঁক, কোথায় যেন শীতল ঔদাসীন্য, নাকি কামনার অভাব। গোড়ার দিকে মনে হয়েছে হাজার বছরের হিন্দু পিতৃতান্ত্রিক মগজ ধোলাই। পতিকেন্দ্রিক সতীত্ব শিক্ষার ফল। মৈত্রেয়ী যখন আর ডাঃ কল্যাণ কুমার চক্রবর্তীর আইনত স্ত্রী থাকবে

তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন জীবনে তেমন করে এল কি।

না। ছায়াকে এসব বলা যায় না।

কী ভাবতাসেন? চুপ মাইরা গ্যালেন যে? আপনাদের বিয়াসাদি হইল তো?

—না। আমাদের বিয়ে হয়নি।

—ক্যান? তালাক, থুরি, ডাইভোর্স তো হইসিল। তা হইলে আর বাধা কোথায়?

সত্যি কথা বলতে কি বাধাটা যে ঠিক কোথায় কিসে তা আমি কোনওদিনও বুঝতে পারলাম না। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কবছর যেন সময়ের হিসেব থেকে বাইরে। বাবা মা আত্মীয় পরিজন অনেক দূরে। তারা আমার অতীত। প্রায় বিস্মৃত। আবার পড়া শেষ করে চাকরিবাকরি সংসারের যে অবশ্যম্ভাবী পাঁচাপাচি জীবন তাও তখন অতটা বাস্তব হয়ে ওঠেনি। অতীত ও ভবিষ্যৎ দুই-ই যেন বহুদূর আবছা। সত্য শুধু বর্তমান, মৈত্রেয়ী ও আমি। একটা ছোট্ট জগৎ। সবকিছুর বাইরে। এমন কি মৈত্রেয়ীর দুবছরের যে বাচ্চাটা পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করত, ঠিকে ঝি যে মাঝে মাঝে বেটাইমে হাজির হয়ে আমাকে আড়চোখে দেখত, সকলেই কেমন যেন থেকেও নেই। ডাঃ কল্যাণ কুমার চক্রবর্তীর দৈনিক অনুপস্থিতির মাপে আমার সব কাজকর্ম। এমন কি ক্লাস করা পর্যন্ত। বলাবাহুল্য কলেজের ছেলেদের কাছে আমার গতিবিধি অজানা ছিল না। তবে তাদের সকলেরই মনপ্রাণ অন্যত্র। মহানগরীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা মফঃস্বলে সদর্পে বিজয়ের পথে। লক্ষ্য শ্রেণীশত্রু বা কুমারী হৃদয়। শুধু মুষ্টিমেয় হাতেগোনা অনিরুদ্ধরা পড়া আর তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত। আমার প্রতি সকলেরই অনুকম্পামিশ্রিত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি….ম্যাদামারা অমলটা সেকেন্ড হ্যান্ড মালের সঙ্গে ফেঁসে গেছে। মজার ব্যাপার হল আমার আচরণের নৈতিকতার প্রশ্ন কেউ তোলেনি। হয়তো তারা অনেকে বিবাহ নামে প্রতিষ্ঠানটির বিরোধী। হয়ত আমার পড়াশুনাটা যাদবপুর শিবপুর খড়গপুরের মতো কলকাতার কাছাকাছিপরিচিত গণ্ডির মধ্যে হলে সমাজের অনুশাসন বা উচিত অনুচিতের প্রশ্নটা এমন অনুচ্চারিত থাকত না। আমাদের ন্যায় অন্যায় বোধটা কি এতই আপেক্ষিক, পরিবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের গড়া অলিখিত কিন্তু অবশ্য পালনীয় লক্ষণরেখা? যা অজানা পরিবেশে অচেনা মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদানে অনায়াসে অলীক হয়ে উঠতে পারে? প্রবাস আমাদের সব পেয়েছির দেশ যেখানে সব বন্ধন থেকে মুক্তি। তাই সকলের মধ্যে যেন এসে গিয়েছিল এক বাঁধনছাড়া ভাব। কেউ সমাজকে কলা দেখাল, কেউ বা সিস্টেম বা রাষ্ট্রকে।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে কলকাতায় ফিরলাম। প্রথম চাকরি টিটাগড়ে তারপর থেকে কেমন সব গোলমাল পাকিয়ে গেল। মৈত্রেয়ীর ডিভোর্সের ঝামেলা বিচ্ছেদের আইনসঙ্গত কারণ ঠিক কী দেখানো হবে তা ঠিক করতে আমাদের সমাজের আধুনিক মধ্যযুগীয় গোঁজামিল। পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম (আইনত একত্রে শয়ন, নিকষিত হেম টাইপ নয়) একটা গ্রাহ্য অভিযোগ। প্রমাণ করতে পারলে বিচ্ছেদের সঙ্গে স্বামীর খোরপোশ দেওয়ার দায় থেকে মুক্তি। কিন্তু ভদ্রলোকের মানে লাগে। তার চেয়ে বড় কথা সাক্ষীসাবুদ জোগাড় প্রায় অসম্ভব। অতএব, পারস্পরিক মানিয়ে নেওয়ার অক্ষমতা অভিযোগ সাব্যস্ত হল। তবু বিয়েতে পাওয়া জিনিসপত্র কোনটা কার ও কেন, ছেলের হেফাজৎ কে পাবে ইত্যাদি জরুরি প্রশ্নে আধুনিক বাঙালি রীতি অনুযায়ী প্রচুর তর্কবিতর্ক উত্তেজনা অশান্তি। সৌভাগ্যক্রমে ডাঃ কল্যাণ কুমার চক্রবর্তীর মতো প্রফেশনালি কোয়ালিফায়েড এবং উন্নতিতে তৎপর পাত্রের সুপাত্রী সুলভ হওয়ায় তিক্ততার তীব্রতা হ্রাস পেতে খুব একটা দেরি হল না। বছর তিনেকের মধ্যে পুরোপুরি শান্তি ঘোষণা মধ্যবিত্ত বাঙালি মানদণ্ডে খুবই তাড়াতাড়ি।

এমন কিছু বেশি নয় তিন বছর সময়। একটা মানুষের জীবনে কতটুকুই বা। কিন্তু সময়ের মাপ বড় অদ্ভুত। কেমন যেন মনে হয় আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়টা দীর্ঘ চার বছর নয়। কদিন মাত্র এবং আমাদের অনুরাগ পর্বটি নেহাতই সংক্ষিপ্ত। আর এই তিন বছর যেন একটা যুগ। সময়ের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। তবে ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। একেবারে যথেচ্ছাচারী। সেই হিটলার-মুসোলিনি-স্টালিন। যুক্তির ধার ধারেনা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমাদের ইয়ারের বেস্টবয় আমার রুমমেট অনিরুদ্ধ সেনের ছিল সাহিত্য-আর্ট-ফার্ট বাই, অন্যদের মতো অত বিপ্লব করত না। একবার কি দয়া হল। আমি পাশে বসেছিলাম লাইব্রেরিতে, ওর হাতে একটা মোটা রেফারেন্সের বই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম,

–কী পড়ছ অত?

–না, ঠিক পড়ছি না। অন্য একটা জিনিস দেখছি। ছবি। দেখবে?

ফার্স্ট বয় বলে কথা। এত ভদ্রতা হঠাৎ। আমি মুখ বাড়ালাম,

–দেখি।

একটা পুরনো মতন ছবি। কাস্তে হাতে ভীষণ দর্শন পুরুষ। অনিরুদ্ধ আমাকে বোঝালো।

–কাস্তেটা একটা রূপক। সারা বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসল যেই পেকে যায় অমনি চাষীর কাস্তের আঘাতে ঘচাঘচ কাটা পড়ে। ঠিক তেমনই জীবনভর আমরা যা কিছু কৰ্ষণ করি, প্রেমভালবাসা কর্মকীর্তি সব কিছুর শেষ সময়ের কোপে।

ছবিটির তলায় খুদে খুদে অক্ষরে লেখা অ্যান্ড নাথিং স্টান্ড বাট ফর হিজ স্কাইদ টু মো, তার কান্তের ফলায় কিছুই বাদ যায় না। অনিরুদ্ধ আবার বিদ্যে ফলিয়ে ব্যাখ্যা করেছিল–আইডিয়াটা শুধু পশ্চিমের নয়, ইউনিভার্সাল বুঝলে। আমাদের দেশেও আছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে। কাল হরতি সর্বম্‌।

কেন কে জানে ছবিটা আমার মনে গেঁথে আছে। চারিদিকে যখন লাল ঝাণ্ডায় কাস্তে দেখতাম তখন আমার কখনও মনে হত না ওটা শ্রমজীবী মানুষের অভিজ্ঞান। এখনও হয় না। বরং মনে হয় ওটা হচ্ছে সময়ের সর্বময় কর্তৃত্ব ঘোষণার প্রতীক—যে কর্তৃত্ব থেকে সাম্যবাদেরও নিষ্কৃতি নেই।

—কী ভাবতাসেন? ঘটনাটা কী হইল বলেন। অসহিষ্ণু ছায়া। বাঙালরা কি এমনই মাথামোটা। একটু চিন্তা ভাবনা করে না।

—তোমার তো ওই এক কথা। ঘটনা আর ঘটনা। আরে ঘটনার মাহাত্ম কী? অলৌকিক চমৎকার কিছু ঘটে না কি মানুষের জীবনে? সবই তো জানা কথা। সাধারণ হাসিকান্না। হাবু-গাবু-খেদি-পেঁচির ব্যাপার।

—তা আমি কি অসাধারণ কিছু চাই নাকি? কইলকাতায় আইস্যা হিরো হিরোয়িনের জীবনটা কী হইল সেইটা বলবেন তো।

কলকাতায় কমাস যেতে না যেতে অমল দেখল বিবাহবন্ধনে বন্দিনী মৈত্রেয়ীর যতটা সান্নিধ্য সে পরপুরুষ হিসেবে লুকিয়ে চুরিয়ে ভোগ করত এখন স্বামীত্যাগিনী স্বাধীন মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আদানপ্রদান তার চেয়ে অনেক কম। বিবাহিতা মৈত্রেয়ী সুদূর মফঃস্বল শহরে ছিল ছোট্ট নিউক্লিয়ার সংসারের গৃহবধূ মাত্র। হাতে অঢেল সময়, বাড়ির বাইরে কাজের সুযোগ সীমিত, সামাজিক চাহিদা মেটানোর দায় নেই বললেই চলে। কলকাতায় পিতৃগৃহে ফিরে এসে তার প্রথম কাজ চাকরি নেওয়া। বাবার পরিচয় সূত্রে একটি নামী কোম্পানি পরিচালিত নার্সারি স্কুলে। স্কুলটি বজবজে। কোম্পানির কারখানায় নিযুক্ত স্টাফেদের ছেলেমেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট। বন্ডেল রোড থেকে রোজ বজবজ যাতায়াত। অবশিষ্ট সময়টুকুতে ছেলে মানুষ ও বাবা মার মন যোগানোতে ব্যয়। তাদের জীবনসায়াহ্নে মেয়ের স্বামী ত্যাগে মনোকষ্ট ও অসন্তোষকে সামাল দিতে অনেক পিআতৃভক্তি প্রদর্শন প্রয়োজন। তাছাড়া তারা যেমন নাতিটির বিনে মাইনের সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য চব্বিশ ঘণ্টার বেবিসিটার তেমনই মৈত্রেয়ী তাদের বাইরের কাজে অপরিহার্য বিকল্প পুত্র। অর্থাৎকলকাতায় বাপের বাড়িতে স্বামীত্যাগিনী মৈত্রেয়ীর প্রতি সংসারের দাবি তার স্বামী সন্তানসহ বিবাহিত জীবনের চেয়ে ঢের ঢের বেশি। বিশেষ করে তার একমাত্র ভাই যখন বম্বেতে চাকরি করে। অতএব, এখন অমলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শুধু সপ্তাহ অন্তে। সাধারণত একটি সন্ধ্যায়, হোটেল রেস্তোরাঁয়। শীতকালে একটু বেশিক্ষণ। মাঝে মাঝে সারাদিনের প্রোগ্রাম। যে সময়টুকুরও বেশ খানিকটা অংশ যায় কার বাড়িতে কে কী বলল আলোচনায়। কারণ দুটি পরিবারেই এখন প্রবল ও সোচ্চার বিরোধিতা জারি। মৈত্রেয়ীর বাবা মার দুশ্চিন্তার মূলে আপাতদৃষ্টিতে নাতির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং তার আড়ালে নিজেদের আশু বার্ধক্যের সহায়হীনতা। জাতের প্রশ্নটাও কি ছিল না? ছিল না আমাদের দেশে নারীপুরুষের সম্পর্কে বয়সের সাবেকি বড় ছোট হিসেব? পুরুষকে যে বয়সে বড় হতেই হয়। তাই অমলের বাড়িতে প্রথম দিকে দেওর বৌদি গোছের আশনাই অল্প বয়সের ঝোঁকইত্যাদি আখ্যায় সম্পর্কটা মুখে অবহেলিত হত কারণ আশা ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং বা উপযুক্ত পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে হলে আপনিই এ রোগ সেরে যাবে। যখন দেখা গেল উপযুক্ত পাত্রীতে অমলের মন নেই এবং ঝোঁকটা অল্পবয়স পেরিয়ে চালু আছে তখন সকলে উঠে বসল। ঠেস দিয়ে কথা বিদ্রূপ শ্লেষ ইত্যাদি অমোঘ পারিবারিক অস্ত্রপ্রয়োগ শুরু। বাপের মুখে প্রায়ই মায়ের উদ্দেশ্যে কিন্তু সবাইকে শুনিয়ে উঁচু গলায় মন্তব্য তোমার ছোট ছেলে তো সবৎসা গাভী ঘরে এনে পিতৃমাতৃ দুই কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে, শুনে শুনে একদিন অমল বলে ফেলে,

-ক্ষতি কী। গাইবাছুর তো আপনার কংগ্রেসেরই প্রতীক ছিল। কতদিন ইলেকশানে নিজের নামের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। এখন নয় পরিবারে দেখবেন। হরিচরণ দাস বি.এ.বি.এল সমুচিত জবাব দেন।

—আমার সে দিন থাকলে তোমাকে জুতোপেটা করে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। বংশের কুলাঙ্গার কোথাকার। পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লজ্জা পর্যন্ত নেই। একেবারে ছোটলোক হয়ে গেছে।

-সে দিন ম্যানে কী সেই ইউনিয়ন জ্যাক ওড়ানো সময় না আপনার তেরঙা স্বদেশি আমল,না কি সেই একেবারে খাঁটি সত্যযুগ যখন ঠাকুরদার বাপঠাকুরদারা লাঙ্গল ঠেলতেন তখনকার কথা বলছেন? অমল আজ মরিয়া।

হরিচরণ দাস বি. এ. বি. এল পা থেকে চটি খোলেন, তবে মারতে পারেন না। অমলের মা মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে দিন থেকে বহুকাল বাপের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ। দাদারা গম্ভীর। বাড়িতে বাক্যালাপ শুধু মা বউদি ও বেড়াতে আসা বিবাহিতা দিদির সঙ্গে। পুরুষদের জেদ না রক্ষণশীলতা কোনটা বেশি বলা শক্ত।

তবে অমলও পুরুষ অতএব সমান জেদী এবং একদিক দিয়ে রক্ষণশীল। অর্থাৎ নিজের জেদে অপরিবর্তিত। তারই ফলে বোধ হয় মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে গেল স্থায়ী। মানুষের জীবনে কার্যকারণ সত্যি অদ্ভুত। অমলের বাড়ির তুলনায় মৈত্রেয়ীর পরিবারে বিরূপ আবহাওয়া কিন্তু অনেক তাড়াতাড়ি বদলে গেল। বার্ধক্যের বন্ধ্যা নীরস গতানুগতিকতায় একটি শিশুর আগমন, বুদ্ধিমতী কর্মপটিয়সী কন্যার সাহচর্য বাবা মার মনোভাবকে অল্প দিনেইনরম করে ফেলল। সবচেয়ে বড় কথা মৈত্রেয়ীর চাকরিতে সাফল্য লাভ। তার জনপ্রিয়তা ও প্রতিষ্ঠা অর্জন। যেমন ভাল তার ইংরিজি, যেমন কড়া তার ডিসিপ্লিন তেমনই উৎসাহ এক্সট্রাকারিকুলারে। তার পরিচালনায় স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান প্রায় পেশাদার মান ভূঁইছুঁই। ছেলেমেয়েদের নাচ গান নাটকে তার আগ্রহের শেষ নেই। গভর্নিং বডি খুশি। চটপট উন্নতি। কয়েক বছরে হেড মিসট্রেস। সহকর্মিণী সীমা ঘোষ, অনিন্দিতা সেন, মধুমতী রায় বা গভর্নিং বডির পি মুখার্জি, এস বাসু, টি কৃষ্ণ, অভয় মিত্র তার জীবনে অমলের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে হয়তো থাকতেন না কিন্তু অনেক বেশি সময় দখল করে নিতেন। যেমন অভয় মিত্র, যাঁর বাড়ি ছিল বালিগঞ্জ প্লেসে। মৈত্রেয়ীর বাবার হার্ট অ্যাটাকে আই সি ইউ-র বন্দোবস্ত তিনি করলেন। মৈত্রেয়ীর ছেলে জয়েন্ট এন্ট্রান্সে কিছুই পেল না তখন কর্নাটকের এক কম খরচের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সন্ধান পাওয়া গেল তাঁর কাছ থেকে।

মানুষের সম্পর্কে পারস্পরিক যোগাযোগের সময় দৈর্ঘ্যের বদলে না কি তার গুণে বিচার করতে হয়। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করা যায় না যে মৈত্রেয়ী ও অমলের প্রাত্যহিক জীবনে বেশির ভাগ সময় তারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন, আলাদা। দে আর সিমপ্লি নট টুগেদার। দুজনে চাকরি করে এমন স্বামী স্ত্রীও কি তাই নয়? না। তারা রাতে একসঙ্গে। শয্যার অর্থ শুধু দেহের সম্পর্ক নয়, সান্নিধ্য। বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রী যত রাত একসঙ্গে শোয় তার মধ্যে সঙ্গমে লিপ্ত হয় করাত?শয্যা হচ্ছে প্রতীক, একসঙ্গে বসবাসের, সম্পর্কের।

অমলের বরাবরের ধারণা ছিল বিয়ে, সংসারটংসার মেয়েদেরই একচেটিয়া। বিবাহবিচ্ছেদে তাদেরই গায়ে আঁচ লাগে। সবার কাছে তাই শোনে, গল্প উপন্যাসে সেরকম লেখা হয়, সিনেমা টিভিতে তো দেখে বটেই। ফলে সে ধরেই নিয়েছিল বিয়ের জন্য মৈত্রেয়ীর আগ্রহই বেশি হবে। তথাকথিত অবৈধ সম্পর্কের গ্লানি সামাজিক বদনাম ইত্যাদি থেকে নিষ্কৃতি পেতে সেই হবে অগ্রণী। কার্যত দেখা গেল মৈত্রেয়ী আর বিয়েটিয়ে নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনাই করছে না। তার দিন কাটে রুদ্ধশ্বাসে, দৈনিক ব্রড স্ট্রিট-বজবজ যাতায়াত, একপাল বাচ্চার সার্বিক উন্নতির দায়িত্ব, বাড়ি ফিরে সংসারের নিত্য কর্মের সঙ্গে দুজন বয়স্ক ও একটি বাড়ন্ত শিশুর দেখাশোনা। তার কাছে অমলের সঙ্গে সপ্তাহান্তে দেখাটা অতি মূল্যবান অবসরযাপন। অক্সিজেনের বেলুন। শ্বাসরোধকারী ব্যস্ততায় একটু গা এলানো উপভোগ। সে দিন তার পরনে ভাল শাড়ি চুলে শ্যাম্পু। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো কাজ স্কুল সংসার বাবা মা ছেলে। ছুটির দিনের নাম অমল। সেই থেকেই কি অমল-মৈত্রেয়ী সম্পর্কের স্থায়ী ছক তৈরি হয়ে গেল? তাই কী ছক পাল্টে অমলকে ওই সারা সপ্তাহ কাজের রুটিনে আনতে চাইল না? কে জানে।

এখন মনে হয় অমলকুমার দাসের জন্য মৈত্রেয়ী ও কল্যাণকুমার চক্রবর্তীর সুখের সংসার ভেঙেছে, আদম ইভ-এর নিষ্পাপ সততসুখী বাগিচায় সেই বিষধর সর্পরূপী ঘর ভাঙানো শয়তান—অমলের নিজের এবং আর পাঁচ জনের এই বদ্ধমূল ধারণাটি একেবারেই ঠিকনয়। মফঃস্বল শহরে একটি ছোট সংসারের চার দেওয়ালের বেষ্টনে মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর মধ্যে নিহিত অফুরন্ত কর্মশক্তি আঁটছিল না। অমলকুমার দাস সেই ফাঁকফোঁকড় যার মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশের রাস্তা খুঁজে পেল। তার নিজস্ব সত্তা অর্জনের পথে অমল একটি অতি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মাত্র। হ্যাঁ অমল বলছে না যে মৈত্রেয়ী ভেবেচিন্তে ইচ্ছে করে অমলকে ব্যবহার করেছে বা তাদের ঘনিষ্ঠতার উৎস ছিল কোনও রকম স্বার্থবোধ। কিন্তু শেষমেষ পরিবেশ ও ব্যক্তিমানুষের মধ্যে টানাপোড়েনে ব্যাপারটা সে রকমই দাঁড়িয়ে গেল।

—সে কি। হিরোয়িন আর হিরোরে ভালবাসে না। ছি ছি। ক্যান? অন্য কারো প্রামে পড়ল? হবেই। যে নিজের পতিরে ছাইড়া আপনারে ধরছিল সে পরে আপনারে ছাইড়া আর একজনকে ধরবে এ তো জানা কথা।

ছায়া বিচলিত। সে এখনও বাস করেরূপকথার জগতে। যেখানে শুধু দুটি রঙ, সাদাকালো ভালমন্দ। প্রধান চরিত্র তরুণ তরুণী। বিষয়বস্তু প্রেম। সমস্যা ভিলেনের আবির্ভাব, সমাধান ঢিসুম ঢিসুম। অতঃপর নায়ক নায়িকার মিলন এবং তাহারা সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল। ব্যস কাহিনী সমাপ্ত। বায়োলজির একটি পর্যায়েইনারীপুরুষ সম্পর্ক স্থায়ী। পূর্বরাগ ও মিলন যার উদ্দেশ্য ও চরিত্র সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত। দুটি বিপরীত লিঙ্গ প্রাণীর জোড় বাঁধা। যে কারণে মানুষ কাঁচা সবজি মাংস মাছ খায় না; তেল মশলা সহযোগে আগুনে রান্নার পর গ্রহণ করে সেই কারণেই অর্থাৎ তথাকথিত মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনকে পিতৃতান্ত্রিক রোমান্সের মোড়কে দেখতে চায়। ভাল আদর্শবাদী বীর নায়ক, সুন্দরী দুর্ধর্ষ রকমের সতী নায়িকা। সবই রূপকথা যা বাস্তবে হয় না কিন্তু হলে কি ভালই না হত। এদিকে বাস্তবে ভালবাসা টক মিষ্টি ঝাল তেতো নোনতা—সব স্বাদের সমাহার। তাই কি অমল আর মৈত্রেয়ীর সম্পর্কে আকর্ষণ বিকর্ষণের বিচিত্র লীলা?

তবে মৈত্রেয়ীর একনিষ্ঠতা সম্বন্ধে অমলের কোনওদিন বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি। তার প্রতি মৈত্রেয়ীর টান যে শতকরা একশো ভাগ খাঁটি, একেবারে খাদশূন্য সে বিষয়ে অমল বরাবর নিঃসন্দেহ। অমলের চাকুরি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় তার সহানুভূতি সখ্য উপদেশ সর্বদা মজুত। অমলের পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনে সেভাগীদার—পুজোতেমা বউদিদের জন্য শাড়িবাছা, ভাইফোঁটায় উপস্থিত থাকলে দিদির জন্য কী,শীতে বাবাকে শাল, ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নিদের মুখেভাত জন্মদিন ইত্যাদিতে সুযোগ সুবিধামতো উপহার কেনা। অমলের সব পারিবারিক সামাজিক নিত্যদায় পালন তার কর্তব্য কর্মের মধ্যে বলে মৈত্রেয়ী ধরে নিয়েছিল। সুগৃহিণীর মতো অমলের বাজেট অনুযায়ী। অর্থাৎ মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর বিয়ে না হলেও বলতে গেলে অমলকুমার দাসের স্ত্রী এবং অধিকাংশ স্ত্রী যেমন নিছক নিষ্ক্রিয়তার অভ্যাসে স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকে মৈত্রেয়ীও তেমনই অমলের প্রতি বরাবর বিশ্বস্ত ছিল। যদিও অমল ছিল না।

—আপনি তা হইলে আর পাঁচটা মরদেরই মতো অ্যা? সে মাইয়াটা আপনার লাইগ্যা স্বামী সংসার ছাড়ল আপনি কিনা তারে পথে ভাসাইয়া দিব্যি…

–আঃ। ছায়া দেবনাথকে নিয়ে আর পারা গেল না। সর্বদা সর্দির মতো সেন্টিমেন্টে ফ্যাসফ্যাস করছে। অমল বাধা দেয়,

—আরে রাখো তোমার বস্তাপচা কাঁদুনি। আমিই বা কিসের মরদ আর মৈত্রেয়ী বা কোন কুসুমকোমল অসহায় নায়িকা, প্রতারণার শিকার! সোল ম্যানস্ ওয়ার্লড়! হাঃ। আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনা কি কম! বাস্তব অনেক অন্যরকম বুঝেছ।

–বাস্তবটা আপনাদের ক্যামন খোলসা কইর‍্যা কন দেখি।

মাথামোটা বাঙালদের সব কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়। মৈত্রেয়ীর জীবনে পুরুষের ভূমিকা কতটুকু? সে নিজে তো পুরুষের বাবা। তার যৌবনের পাতলা ছিপছিপে চেহারাটি কবছরেই প্রধান শিক্ষয়িত্রী-সুলভ ভার ও মেদ অর্জন করেছে। হাত পায়ের লোম দিনকে দিন আরও ঘন আরও কালো। গলার স্বর পাল্লা দিয়ে কর্কশ। যেন আধাপুরুষ, পুংহরমোনের মাত্রাটা বেশ অধিক। স্কুলের সব অল্পবয়সি মেয়েলি-মেয়েলি পাতলা টিচারদের ভয় ও ভক্তি তার উদ্দেশে নিবেদিত। স্কুলের পুরুষ পিয়ন-জমাদার-কেরানিবড়বাবু তার কড়া শাসনে তটস্থ। যেন সনাতন একান্নবর্তী পরিবারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্তা। কর্মক্ষেত্রের বাইরে তার হাবভাবে নিঃসঙ্কোচ আত্মবিশ্বাস—সঞ্চয়িতায় মোটা টাকা লগ্নি করে লোকসান সত্ত্বেও দমে না। বাবা-মা ডিভভার্সি মেয়েকে বসতবাড়িটিতে জীবন স্বত্ব লিখে দিয়েছেন, সারা জীবনে জমানো টাকার সিংহভাগও। প্রাথমিক তিক্ততার পর ছেলের ভরণপোষণে প্রাক্তন স্বামী কার্পণ্য করেননি। তাঁর দ্বিতীয় সংসারে পুত্রকন্যা-লাভের দরুন এই ছেলের ওপর অকারণ দখলদারিও নেই। সব মিলিয়ে মৈত্রেয়ী অনেক পুরুষের চেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অমলের চেয়ে তো বটেই। বরং অমলেরই পৈত্রিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অনিশ্চিত। বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতির যে ঘরখানাতে তার কিছু স্বত্ব ছিল সেটিতে যে সবৎসা গাভীর স্থিতি হতে পারে না সে মোদ্দা কথাটি বহুবার শোনা। তার কর্মজীবনের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর হায়দ্রাবাদে ভূপালে নতুন চাকরি নিয়ে স্বস্তি পেয়েছিল বটে কিন্তু কোনওটাই পুষ্পশয্যা নয়। এখানেও অর্থাৎ পাবলিক সেক্টর ফিনানসিয়াল ইনস্টিটিউশানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর রাজনৈতিক চাপ বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপের স্বার্থ ও মর্জি অনুসারে তার কাজ পরিচালিত। আধুনিক ভারতে চাকরিতে ক্ষমতা আর উদ্বগ প্রায় সমান্তরাল। এদিকে সহকর্মিণীদের বশ্যতা বন্ধুত্ব এবং সন্তানের মা হিসেবে আপাতসন্তোষে মৈত্রেয়ী পুরুষহীন জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে বটে কিন্তু অমলের পক্ষে নারীসঙ্গহীনতা শাস্তি। অর্থাৎ তার স্বাধীনতা অতি সীমিত। স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রশ্ন হাস্যকর। মৈত্রেয়ীর তুলনায় অমলের জীবনে পরিপূর্ণতা বোধ কোথায়। অথচ সে একটা প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদাধিকারী পুরুষ। অতএব, তার একমাত্র উপায় অন্য নারী। সে যেই হোকনা কেন। কখনও শুধু একরাতের সঙ্গিনী, কখনও বা কয়েক সপ্তাহের।

ছিঃ ছিঃ, ছায়া দেবনাথ এতখানি জিভ কাটে। কানে আঙুল দেয়,

—এইটা একটা কী কন। আপনে মানুষটা এত দুশ্চরিত্র। এ সব কথা শোনাও পাপ। কাগজকলম গুছিয়ে নিয়ে ছায়া উঠে যায়।

—যাই, আমাকে আবার অন্য পেশেন্টের ঘরে যেতে হবে। হঠাৎ তার বাংলা ঠিক হয়ে যায়।

অমল আর কিছু বলে না। বাঙালদের নীতিজ্ঞান বড় বেশি। ঘটিরা এসব বিষয়ে অনেক প্র্যাগমাটিক, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। একটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের দেহের চাহিদা নেই! বাঙালদের ভাবভঙ্গিই অদ্ভুত। সেইনাইন্টিস্থ সেরিব্রাহ্ম। অমলের ভারি বয়েই গেল। তার জীবনকাহিনী ছায়া দেবনাথ শুনুক বা না শুনুক কী এসে যায়।

.

সতীত্ব একনিষ্ঠিতা যে কত অর্থহীন নিষ্ফল তা তো আমার জীবনেই উপলব্ধি করলাম। স্বামীত্যাগিনী মৈত্রেয়ী এতদিন আমাকে ছাড়া আর কোনও পুরুষকে জানতই না—কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা। এতে আমার কি স্বর্গ লাভ হয়েছে? বরং অন্য কোনও পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হলে একটু উত্তেজনা একটু মনোমালিন্য বুদবুদ জাগাত নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে। সম্পর্কটা ধরে নেওয়া নিশ্চিন্ততায় মরে হেজে যেত না। চিরন্তন সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দুজন অচেনা মানুষ কদিনের জন্য পরস্পরের কাছে আসে। কিন্তু সেই জায়গায় তো স্থির থাকতে পারে না। ফ্রেমে বাঁধাই দেওয়ালে টাঙানো, গলায় মালা অমর প্রেমে প্রাণের স্পন্দন কই। আমি যদিও কাব্য-টাব্যর ধার ধারিনা তবু কেন জানি না আমাদের সেরা ছাত্র সাহিতপ্রেমিক অনিরুদ্ধর আবৃত্তি করা পদ্যের একটা লাইন মনে গেঁথে আছে। দ্বিধাবিজড়িত লজ্জাজড়িত হে হৃদয় ঝাউবৃক্ষের পাতা। এমন হৃদয় কোথায় কেমন করে পাওয়া যায় তার হদিশ তত অনিরুদ্ধ দেয়নি। একনিষ্ঠতা, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ বা উত্তরাধিকারে প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তাতে কোনও যাদুর ছোঁওয়া নেই।

মাঝে মাঝে মনেহয় সতীত্ব একনিষ্ঠতা নিয়ে বাড়াবাড়ি পুরুষের বোকামি, তার দুর্বলতার সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রমাণ। নারীমাত্রেই প্রায় যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষকে দৈহিক তৃপ্তিদানে মোটামুটি সমর্থ। কিন্তু পুরুষমাত্রই যে কোনও নারীর সন্তোষবিধানে সক্ষম নয়। এইখানেই প্রকৃতি মেরে দিয়েছে পুরুষকে। অপরিতৃপ্ত নারীকে বড্ড ভয়। আদিম পুরুষ নারীকে বিকলাঙ্গ করে দেয় তার সুখানুভূতির উৎসকে উৎপাটিত করে। সভ্য জগৎ অতটা নির্মম হতে পারে না। তাই সর্বদা দখলদারির চেষ্টা। শাখাসিঁদুর-লোহায় স্বত্ব ঘোষণা। স্বামীত্ব প্রতিষ্ঠা। যেহেতু ঐ শাখাসিঁদুর-লোহায় সিলমোহর আমাদের সম্পর্কে লাগানো হল না তাই কি মৈত্রেয়ীর ওপর আমার এক্তিয়ার জারির চেষ্টা চলেছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে? তাকে কজা করার জন্য কী করেছি। জীবনের কত সময় কত উদ্যমের অপচয়। কখনও ঘুস দিয়ে কখনও বা ভয় দেখিয়ে। সপ্তাহান্ত কাটাতে ভাল ভাল হোটেলরেসর্ট। পুরী-চাঁদবালি-দীঘা-বকখালি। ছেলেকে কী বলবর একঘেয়ে বেসুরো স্বরকে সবলে দমন। কলকাতার পার্কস্ট্রিট-থিয়েটার রোডে ডিনার। জন্মদিন পুজো নববর্ষে বাংলাদেশি ঢাকাই মসলিন-বিষ্ণুপুরী। সর্বদা না হোক যখন যা নতুন ফ্যাশান তাই উপহার। সবেতেই শুধু এক ধুয়ো, তুমি যে আমার তুমি যে আমার।

ক্রমাগত তুষ্টিবিধান মন জোগানোর উৎস থেকেই প্রায় শেষ পর্যন্ত ভুবনেশ্বরে একতা ক্লাবের প্রেরণা। সর্বভারতীয় এই সাংস্কৃতিক সংস্থাটির প্রতিটি অনুষ্ঠান, তার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের প্রতিটি সামাজিক সমাবেশের তারিখ ঠিক হত বজবজের একটি নার্সারি স্কুলের হলিডে লিস্ট অনুযায়ী। অ্যানুয়েল মেগাফাংশনে, কোন্ আর্টিস্ট আনলে ভাল, ইন হাউস নাটক কী হবে, কারা কোন্ রোল করবে, রবীন্দ্রজয়ন্তী নববর্ষ বিজয়া সম্মিলনীতে শুধু গান আর আবৃত্তি নাকি সঙ্গে গীতিনাট্য, সদস্যদের ছেলেমেয়েরা কে কী করবে ইত্যাদি সর্ববিধ কার্যক্রমের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত একজনের, শ্রীমতী মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর। অথচ তিনি ক্লাবটির সদস্য পর্যন্ত নন। আ মেম্বার একস্ট্রাঅর্ডিনারী।

একতাক্লাবের অস্তিত্বের মূলে ছিলাম আমি। আর আমার সব কিছু আবর্তিত মৈত্রেয়ীকে কেন্দ্র করে। তার কাছে আমি বরাবর সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র এবং সে বয়সে বড় প্রায় অভিভাবিকা। নামকরা কোন এক লেখক নাকি নারীও রমণীর মধ্যে পার্থক্য দেখতে। তার কাছে প্রেয়সী বা রমণীর চেয়ে নারী শ্রেয়সী কারণ সে মা। আমার তো ধন্দ এখানে। প্রকৃতির নিয়মে জন্মদায়িনী মায়ের ভূমিকা অমূল্য কিন্তু সাময়িক, সন্তানের সাবালকত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার ইতি। আবার সে চায় জুড়ি। খুব কম প্রাণীর ক্ষেত্রেই সেই জুড়ি এক ও অদ্বিতীয়। মানুষের সবই গোলমেলে। কামের সঙ্গে প্রেম, আবার প্রেমের সঙ্গে বাৎসল্য, যে যত মেশাতে পারে সে তত ভারী।

আমার সম্বন্ধে মৈত্রেয়ীর অসীম ধৈর্য সহনশীলতা, আমার স্বভাবচরিত্রের গোপন অন্ধিসন্ধি বোঝার ভয়াবহ ক্ষমতা–সবই কেমন তাকে একটা ওপরের আসনে বসায়। আর আমাকে ঠেলে দেয় তলায়। তার মনের, তার দেহের চাহিদার কতটুকু আমি বুঝি। একান্ত নির্জনে স্বপ্নবিলাসে তার যে বাসনাকামনা তা কি আমার আয়ত্তে। এ ছাড়া ছেলে আর সে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃত্ত। সেখানে বায়োলজিক্যাল ফাদার কল্যাণ চক্রবর্তী ও বিকল্প পিতা আমি দুজনেই বাহিরি, বহিরাগত। মৈত্রেয়ী আমার এত কাছের হয়েও কেমন যেন নাগালের বাইরে। তাকে ঘিরে একটা রহস্যের বলয় যা আমি কিছুতেই ভেদ করতে পারি না।

কতবার চেষ্টা করেছি তাকে আঘাত দিতে। আভাসে ইঙ্গিতে কখনও বা স্পষ্ট কথায় তাকে একতার কতটুকু আজ ছেলে আমাদের সহবাসের অপ্রতুলতাকে প্রেমের বিশাল প্রতিবন্ধ করে তুলেছি। এবং সেই ছুতোয় তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কত হাফগেরস্ত অমুক কনসার্টের মিস পলি অমুক গ্রুপ-এর মিস জুলি-র সঙ্গে গা শোকাশুকি। কী ভাবত কে জানে। পরের গরমে বা পুজোর ছুটিতে সঙ্গে নিয়ে আসত স্কুলের কোনও অল্পবয়সি টিচার। বেশির ভাগ লিভ ভেকেন্সির সাময়িক চাকুরে। ইচ্ছে করে সুযোগ জোগাত ঘনিষ্ঠতার। পুরী কোণারক চিল্কা দর্শনের সঙ্গে তাদের জন্য বাড়তি টোপ গোপালপুরের নির্জন সৈকত, তপ্ত পানির হট স্প্রিং বা সিমলিপালের জঙ্গল।

আমার পদস্খলনও তারই হাত ধরে। বেয়াড়াপনাতেই কি তার সর্বময় কর্তৃত্বের বাইরে যেতে পেরেছি। পারিনি। সেই সব নিরীহ মেয়েলি-প্রায়শ-অতিগরিব মেয়েরা সম্পূর্ণভাবে মৈত্রেয়ীর অনুগামিনী একান্ত বাধ্য ভক্ত। শান্তা কুণ্ডু, স্মৃতি পাল বা মিত্রা মণ্ডল কখনওই মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর জায়গা নিতে পারেনি। আমি, মৈত্রেয়ী ও তৃতীয়জন–তা সে যেই হোক না কেন—সর্বদা এক সমদ্ববাহু ত্রিভুজ যে ছকে মৈত্রেয়ী সর্বদা আমার সঙ্গে সমান। এবং আমার অনুভূতিতে একটু বেশি বড়।

.

–কই, আপনি যে অন্য সব মাইয়াদের ভালবাসতেন তাদের কথা কিছু বলেন না ক্যান্? হাজার হোক উপনায়িকা তো।

আজ ছায়া দেবনাথ হঠাৎ ভারী উদার। অমল তার কাহিনীতে অন্য নারীদের উপস্থিতি প্রকাশ করার পর ছায়া দেবনাথ খুবই বিচলিত হয়েছিল। তার বিশ্বাসে ভদ্রঘরের নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই ভালবাসা। শুধু কাম বা দৈহিক সংস্পর্শ তার জগতে খারাপ মেয়েদের এলাকা। তার অভিধানে প্রেম একেবারে নিকষিত হেম না হলে রক্তমাংসের বাস্তব থেকে একটু দূর। বরং সিনেমা টিনেমায় নায়ক নায়িকার জোড়বেজোড়ের খেলায় সে প্রেমের চিরন্তর ছকটি পায়, বিশ্বস্ততা যার ভিত্তি। জেলের মেয়ে স্বপ্নার মাহাত্ম্যে সে মুগ্ধ। অমলের ছুটকো-ছাটকা উপরি পাওনা তার কাছে বিশ্বাসঘাতকতা পাপ। ব্যাড এনাফ। তারওপর যখন আভাস পেল মৈত্রেয়ীর নিজেরও অমলের যদৃচ্ছ গমনে কিঞ্চিৎ ভূমিকা আছে তখন সে একেবারে বিপর্যস্ত।

—ছি, ছি, এটা কী এ্যামের কাহিনী! আপনার নিজের ভালবাসার মানুষ কিনা আপনারে মাইয়া যোগায়। রাম রাম। আর আমি আপনার সাথে কথা কমু না।

তারপর কদিন ছায়া দেবনাথের পাত্তা নেই। আর অমলের ঘরে আসেনি। নার্সিং হোমটার ডিসিপ্লিন সম্বন্ধে অমলের ধারণা মোটেই উঁচুনয়—একজন নার্স খেয়ালখুশিমতো রোগীর ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। আবার মর্জি হলে একেবারে আসেই না। আশ্চর্য। ছায়ার বদলে যিনি এলেন তিনিও পূর্ববঙ্গজ, লম্বাচওড়া দশাসই চেহারা, একেবারে কথা বলেন না। মেশিনের মতো গায়ের তাপ রক্তচাপ মেপে ওষুধ বাড়িয়ে দিয়ে চলে যান। অমল জিজ্ঞাসা করে,

—ছায়া দেবনাথ ডিউটিতে আসেনি?

কোনও উত্তর নেই। আবার জিজ্ঞাসা করে,

—ছায়াকে দেখছি না তো কদিন। ছুটিফুটি নিয়েছে নাকি?

তখন একটি সংক্ষিপ্ত জবাব যার কোনও মানে হয় না,

—এলেই দেখতে পাবেন। অতঃপর মেশিনদিদির প্রস্থান।

এখন অমলে বড় একঘেয়ে লাগে। ঘরটার এ মাথা ও মাথা পায়চারি করে। বাইরে টানা করিডোরের ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত। একদিন মনে হল খবরের কাগজটা দেখলে হয়। খোলে। হিন্দি, ইংরেজি, আঞ্চলিক ভাষা। অজানা সব নাম, অচেনা মুখের ছবি। ভাজ করে রেখে দেয় খবরের কাগজ। খেতে ও ইচ্ছা করে না। তবে খোপখোপ স্টেনলেস স্টিলের থালায় দুবেলার খাবারটার কোনটায় ফিরিয়ে দেয় না। জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। আশ্চর্য, মেশিনদিদি ঠিক টের পান।

–কি, খাওয়া দাওয়া করছেন না কেন? খিদে নেই? কী খেতে ইচ্ছা করে? উত্তর শুনেই চলে যান।

ডাক্তার রাউন্ডে এসে একই প্রশ্ন করেন, একবারে এক ভাষায়। জবাব না পেয়ে আরেকটা জিজ্ঞাসা,

-আচ্ছা অমলবাবু,আপনার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না?

–বাড়ি। অমল যেন ঘুম থেকে ওঠে।

–হাঁ বাড়ি। এইতো আপনার ঠিকানা আছে, সিস্টার পড়ুন তো।

–বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি, উনিশের এক …

–থাক থাক। ঠিকানা দিয়ে কি হবে। নিজের বাড়ি কোথায় জানি না ভাবছেন। বিরক্ত হয় অমল।

-না না তা বলছি না। জানেন তো নিশ্চয়। পুরনো বাড়ি কতকালের, বলছিলেন না তিন-পুরুষের? আপনি ব্যাচেলর মানুষ, রিটায়ার্ড লাইফ। বাপঠাকুরদার বাড়িতে কাটাবেন এটা তো নরম্যাল। যাবেন?

অমল মাথা নাড়ে, না। বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি সে তো কতকাল ত্যাগ করেছে। চলে যেতে চেয়েছে তার ত্রিসীমানা থেকে। ইন্ডিয়া বিরাট দেশ। নিজেকে প্রমাণ করবার কত সুযোগ সেখানে। বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি তার কাছে মৃত।

হঠাৎ আবার ছায়া দেবনাথের আবির্ভাব। না, অমলের কাহিনী সম্পর্কে তার উৎসাহ শেষ হয়নি। যেন সে স্টেনোগ্রাফার, সেবাটেবা জ্বরমাপা রক্তচাপ পরীক্ষা তার কাজের অঙ্গ নয়, নেহাত ফালতু। প্রথমেই ব্যাগ থেকে কাগজের গোছা বেরয়।

–ন্যান, শুরু করেন। তবে একটা কথা কিন্তু জাইন্যা রাখেন। আপনি মানুষটা মোটেই হিরো নন। হিরোয়িনের উপর অ্যামন অত্যাচার হিরো কখনও করে না। আপনি নিজে বলছেন তাই বিশ্বাস করছি। নইলে সত্যি ভাবা যায় না। আপনার বিবেকবুদ্ধি নীতিজ্ঞান কিছুই ছিল না? সাহেব-ম্যামদের মতো যেখানে সেখানে ছি ছি।

—দেখ, বেশি জ্ঞানফ্যান দিতে এসোনা তো। সেদিনকার মেয়ে, কিছু তো জানোনা। তারওপর বাঙাল, বলি আমাদের হিন্দু সমাজে তোমার ওই নীতি-ফিতির বালাই কবে ছিল,অ্যাঁ? কুষ্ঠরোগগ্রস্ত স্বামীকে বেশ্যাবাড়ি নিয়ে যাওয়া যেখানে সতীত্বের আদর্শ সেখানে মৈত্রেয়ী সুস্থসবল অপরিতৃপ্ত এবং অবিবাহিত স্বামীকে দুচারটে মেয়ে এনে দিয়েছে তোত কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? তাছাড়া ওই কি একলা আমার জন্যে কিছু করেছে? আমি করিনি? তার মন পাবার জন্য দুহাতে খরচ, এত অনুষ্ঠান জমায়েত, বম্বে কলকাতা মাদ্রাজ থেকে আর্টিস্ট আনা, তাদের সঙ্গে দরদস্তুর খাওয়া-থাকা যাতায়াতের বন্দোবস্ত, ফাংশনের ফিনান্স, পুলিশের আয়োজন, টিকিট বিক্রি একটা পাবলিক ফাংশান নামানো কম কথা ভাবছ। আর প্রত্যেকবার স্টেজে কোনও না কোনও ছুতোয় মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর উপস্থিতি এবং তার উপর নিউজ পেপার টিভির ক্যামেরা ফোকাস, বিশেষ উপহার গ্রহণ বা প্রদান। তার জন্য তো লাইন আপ করতে হয়েছে পার্টিকে। কখনও রুরকেল্লা স্পঞ্জ আয়রণের বোস কখনও কলকাতার ফিয়ারলেসের গুপ্ত। এসব করতে এলেম লাগে না ভাবছ?

—মানলাম আপনিও না হয় বেশ কিছু করছেন। শোধবোধ। কিন্তু তা হইলে আজ আপনি অ্যাকলা ক্যান? মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী গ্যালেন কই?

অমল চুপ। উত্তর দেয় না।

–কী হল? বলবেন না? ছায়া মেয়েটা নাছোড়বান্দা। যেন জোঁক। একবার ধরলে পেটপুরে মালটি চুষে খেয়ে তবে খসবে।

অমল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

-দেখ সবসময় বকরবকর ভাল লাগে না। তুমি কে সবকিছুর কৈফিয়ত চাইবার? কী হবে তোমার এসব জেনে? তোমার তো অন্য পাঁচটা পেশেন্টও দেখবার কথা। তুমি মোটেই আমার স্পেশাল নার্সনও। সারাক্ষণ আমার ঘরেই বা বসে থাকো কেন? আর অত লেখাফেখার দরকার কি? এত যে পেশেন্ট আছে এখানে তাদের সকলের কাহিনী লেখা হচ্ছে?

–বাবা। আপনি দেখি একেবারে খেপচুরিয়াস? কাগজের তাড়া গোছাতে গোছাতে ছায়া উঠে দাঁড়ায়, এখন যাই। মেজাজ ঠাণ্ডা হলে আসব। ছায়াকে ধ্যাতানি দিলে দিব্যি শুদ্ধ বাংলা বেরোয়। এমন কি বাঙাল টানটাও বোঝা যায় না। আশ্চর্য। স্ত্রী জাতির চরিত্র থেকে ভাষা সবই রহস্য।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress