Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 2

ট্রেকার্স || Bani Basu

অনেকক্ষণ থেকে বেলটা বেজে যাচ্ছে। কী হল বিলুর? ধ্রুবজ্যোতি উঠে গিয়ে খুলে দিলেন। সংযুক্তা গলদঘর্ম। বলল, “একটা ট্যাক্সি নিলাম, যা ভিড়। বিলুটা কোথায় গেল?”

“কী জানি, ঢুকে তো পড়ো আগে।”

“আগে একটু চান করে আসি, বুঝলে? বিলুকে বলো একটু যদি উপ্‌মা করতে পারে। চা-টা আমি বেরোলে… জানো, ওই দিয়া মেয়েটা না আমাদের কলেজের।”

“তুমি চিনতে না?”

“হু, ওরা বলতে মনে পড়ল, স্যাড। মেয়েটার মা-বাবা বিচ্ছিন্ন, মা-র কাছে থাকে। তিনি তো বিশাল কাজ করেন, ম্যানেজেরিয়াল জব।” বলতে-বলতে সংযুক্তা চলে গেলেন। ধ্রুবজ্যোতি বিলুর খোঁজে গেলেন। ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠে বসল, “আগে ডাকোনি কেন বাবা?”

“দরকার হয়নি, ঘুমোচ্ছিলি খুব।”

উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে মেয়েটা। রেজাল্ট বেরোবার সময় হয়ে এল। দু’-তিনটি মেয়েকে ওঁরা আশ্রয় দেন। লেখাপড়া শেখান। যত্নে থাকে, যত্ন করতেও শেখে। বিলুর মর্নিং স্কুল, মিলুর ডে। সে-ও এখুনি এসে যাবে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল শীলু। সে ট্রেনিং নিয়ে কম্পিউটার শিখে এখন কলসেন্টারে কাজ করে। একঘরের ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে ওর অফিসের কাছাকাছি সল্ট লেকে। এখন বিলু কী করতে পারে দেখা যাক!

বিকেলে আজ একাই হন্টনে বেরোলেন ধ্রুবজ্যোতি। পায়ে স্নিকার্স, শর্টস, সাদা টি শার্ট। শরৎ ব্যানার্জি রোড থেকে বেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ পার হয়ে লেক। ত্রিপাঠী দম্পতি জোরে হাঁটছেন। মনু দীক্ষিত ওঁকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, “এক চক্কর হেঁটে আসুন, একটা কথা বলব দাদা,” তিনি স্পিড দিলেন।

দিয়ার বিষাদের কারণ তা হলে এই, ব্রোকেন হোম? যেন এক ফ্যাশন হয়েছে আজকাল। ডিভোর্স না করতে পারলে আর মডার্ন থাকা যাচ্ছে না। অত্যাচার, নির্যাতন, দুশ্চরিত্রতা, এসবের কথা আলাদা। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষ, বিয়ে করেছে, সন্তান হয়েছে, কোনওমতেই মানিয়ে থাকতে পারবে না—এ তিনি বিশ্বাস করেন না। এ সব এক ধরণের আঁতলামো।

“মা যেদিন প্রথম বলল, দিয়া, আমি আর তোর বাবা একসঙ্গে আর থাকব না। তোকে ঠিক করতে হবে তুই কার সঙ্গে থাকবি, সত্যি বলছি জেঠু, আমি একেবারে যাকে বলে অ-বাক হয়ে যাই। একদম বাকরোধ। কেননা এরকম কিছু ঘটতে চলেছে, আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি। একটা এইটুকুনি ফ্যামিলিতে মা আর বাবার মধ্যে কী চলছে, তাদের বছর চোদ্দোর একমাত্র সন্তানের বোঝার কথা। কিন্তু অন গড জেঠু আমি বুঝতে পারিনি। মা-বাবা দু’জনেই বড় পোস্টে কাজ করে, অনেক দায়িত্ব। আরও ছোটবেলায় আমার দিদাই ছিল, মলিনাদি ছিল, ছিল আমার নিজস্ব ঘর। এখনও রয়েছে আমার ক্লাব, খেলাধুলো, বন্ধুবান্ধবের বিরাট দল। কোনও জিনিসের অভাব কী আমি তো কোনওদিনই বুঝিনি। আমি জানতামই বাবা অর্ধেক দিনই অনেক রাত করে বাড়ি আসবে, মা তার চেয়ে আগে। তবুও রোববার ছাড়া আমাদের একসঙ্গে খাওয়ার কোনও ব্যাপারই ছিল না। আমি তো ঘুমিয়েই পড়তাম, রাতে বাবা আসার আগে। আমি তো জানতামই, বাবা-মা সকালে দু’জনে দুটো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবে। বাবার তখন খেয়ালই থাকবে না, আমি কোথায় কী করছি। ল্যাপটপ খুলে বসে ব্রেকফাস্ট খাবে, খেতে-খেতে অন্যমনস্ক ভাবে হুঁ হাঁ করে মা-র কথার, আমার কথার জবাব দেবে। মা বরং বলবে, দিউ, আমার সঙ্গেই খেয়ে নে। ডায়েরি হারাস না, টাস্কগুলো ঠিকঠাক টুকে আনিস। বড় হয়ে যাওয়ার পর বলত, আই ট্রাস্ট ইউ দিয়া। সব সময়ে মনে রাখবি। যে-স্বাধীনতা দিয়েছি বা দিতে বাধ্য হয়েছি, প্রুভ দ্যাট ইউ ডিজার্ভ ইট। কাগজ পড়িস তো? চারদিকে কত বিপদ, কত যে ফাঁদ। খুব বুঝে-সুজে চলিস। গাড়িটা ব্যবহার করিস না কেন? নিজের গাড়ি একটা সেফটি মেজার। বাবা রবিবারে গল্প করত। ছোটবেলার ছেলেমানুষি গল্প, বড়বেলায় অ্যামবিশনের গল্প। আমাকে কেম্ব্রিজে পাঠাবে, না হাভার্ডে। আমি এই করব, তাই করব। খবরদার, আই টি লাইনে আসিস না। লাইফ বলে আর কিছু থাকবে না। এর মধ্যে বাবা-মা’র যে দূরত্ব, সেটা পেশাগত কারণে অনৈচ্ছিক দূরত্ব। ভিতরে-ভিতরে সত্যিকারের দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল, বুঝিনি তো একবারও! এত হাঁদা আমি? তোকে বোধহয় আগে থেকেই প্রস্তুত করা উচিত ছিল আমাদের, আমার বাকরোধ দেখে মায়ের প্রতিক্রিয়া। মা বলল, আসলে আমিও তো, আমরাও তো, প্রস্তুত ছিলাম না।

দপ করে মাথার মধ্যে প্রশ্নটা লাফিয়ে উঠল, হোয়াট ওয়েন্ট রং, তৃতীয় ব্যক্তি? নিশ্চয়ই তৃতীয় ব্যক্তি। কার, মায়ের? বাবার? দু’জনেরই? চোখের মধ্যে প্রশ্নটা রেখে আমি সোজা মায়ের চোখের দিকে চাই, কথার পিঠে কথা থাকলে উত্তর দিতে সুবিধে হয়। আমার কোনও কথা ছিল না, তাই মায়ের অসুবিধে হচ্ছিল।

বলল, আসলে কোনও দিনই আমাদের মধ্যে ঠিক যাকে বলে, মানে… ছিল না।

কী যে ছিল না, মা পরিষ্কার করে বলতে পারল না। হঠাৎ কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠল, দিউ, মনে করিসনি আমরা তোকে ভালবাসি না। আমরা দু’জনে শুধু তোর ব্যাপারেই খুব কাছাকাছি, খুব। ওইজন্যেই… এবার আমায় বলতে হল, আমি তো এখনও আছি। আমার প্রশ্নটাও স্পষ্ট নয়, তবু একজন মায়ের বা বাবার বোঝা উচিত।

ভুল বুঝিসনি। তুই আমাদের আছিস, থাকবি চিরকাল। কিন্তু আমরা পরস্পরের সঙ্গে আর থাকতে পারছি না।

কেন?

বলা খুব শক্ত।

তুমি বা বাবা কি আবার আর একজনকে?

না না। আমি তো নই-ই। ডোন্ট মেক আ মিসটেক দিয়া। অন্য কাউকে, কোনও পুরুষকে বিয়ে-টিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোর বাবারও আপাতত তেমন কোনও ইচ্ছে আছে বলে জানি না।

কতক্ষণ তোমরা বাড়ি থাকো মা? আমার জন্য মাত্র এইটুকু সময়ও একসঙ্গে থাকতে পারবে না? আমার জন্য? আমার জন্য?

তখন মা এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমার চোখের গরম জল মায়ের গায়ের উপর, খোলা হাতের উপর পড়তে লাগল। সেইজন্যেই তো ছিলাম, এখনও থাকতে চাই। কিন্তু তোর বাবাই আর থাকতে চাইছে না।

অথচ বাবার আর কেউ নেই! এটা তুমি আমায় বিশ্বাস করতে বলছ?

যতদূর জানি কেউ নেই। যদি থাকেও, আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার দিয়া, আমার কাছে ওর আর কোনও ইম্পর্ট্যান্স নেই। কেন বুঝতে হলে, তোকে বড় হতে হবে।

আমাকে তোমরা কেউই চাও না। আমি আসলে তোমাদের কাছে একটা ভার।

ভুল, একদম ভুল। আমরা দু’জনেই তোকে চাই। একমাত্র তোর মধ্যে দিয়েই আমরা স্বাভাবিক পৃথিবীতে বাঁচি, দিয়া।

তা হলে বললে কেন, আমি যার কাছে ইচ্ছে থাকতে পারি?

কী করব বল, সেটাই যে আইন। তোকে ঠিক করতে হবে।

মা, কোনও ছেলে-মেয়ে এটা ঠিক করতে পারে, তুমিই বলো?

একটু চুপ করে রইল মা। তারপর বলল, তবে তোকে সরাসরি বলছি, তুই কোর্টে বলিস মায়ের কাছে থাকবি। তুই মেয়ে দিয়া, বাবার কাছে থাকলে তোর খুব অসুবিধে হবে। জেঠু, তুমি কিছু বুঝলে?”

ধ্রুবজ্যোতি চমকে উঠলেন। আনমনে বললেন, “নাঃ।”

দিয়া বলল, “রাতে বাবার সঙ্গে যা হল সে আরও দুর্বোধ্য নাটক। বাবা টাইটা খুলতে খুলতে বলল, দিয়া, তোর মায়ের কাছ থেকে সব শুনেছিস তো?

শুনেছি। কিন্তু বুঝিওনি, মানতেও পারছি না। বাবা, দিদাই আর দাদা কি তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল কেউ?

তা তো গিয়েছিলই। তোর দাদাই তো আমার চব্বিশ বছর বয়সে চলে গেলেন।

মৃত্যুর উপর কার হাত?

কিন্তু তোকে তো আমি ফেলে যাচ্ছি না, তুই তো অবশ্য আমার সঙ্গে যাচ্ছিস। বাড়ি নয়, বিশাল ফ্ল্যাট একখানা। কোনও কিছু ভাবতে হবে না, সব ইন-বিল্ট।

মা-ও, ওখানে মা-ও থাকবে? ইন-বিল্ট?

কী মুশকিল! এখন তো তুই বড় হয়ে গিয়েছিস, মায়ের আর দরকার কী?

মা-বাবা বুঝি দরকারের জিনিস? যেমন দুধের বোতল? যেমন ওয়াকার?

ওহ দিয়া, তুই তো খুব ইন্টেলিজেন্টলি কথা বলতে শিখেছিস। তুই আমার কাছে থাকবি, আমরা দু’জনে কত মজা করব।

বাজে কথা বোলো না বাবা, মজা করার সময় তোমাদের কারওই নেই। বাবা প্লিজ, তোমরা এক বাড়িতে আমাকে নিয়ে থাকো। কতটুকু সময় তোমাদের দেখা হয়! না হয় তোমার একটা ঘর, মায়ের একটা ঘর… আমার জন্যে। শুধু আমার জন্যে, লক্ষ্মী বাবা।

বাবা খুব গম্ভীর মুখে বলল, তাই তো ছিলাম, এখনও রাজি আছি। কিন্তু তোর মা-ই আর থাকতে চাইছে না।

এক মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলাম আমি। কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে? আমি ছুটে মা’র কাছে যাই, মা, মা, বাবা আমার জন্য এক বাড়িতে থাকতে রাজি হয়েছে।

মা প্লেট মুছতে-মুছতে ঠান্ডা গলায় বলল, বাবা মিথ্যে কথা বলছে। জিজ্ঞেস কর, সেক্টর ফাইভের কাছে বাবার ফ্ল্যাট কেনা, সাজানো স-ব হয়ে গিয়েছে। ও পারলে এখুনি চলে যায়।

মাকে টানতে টানতে বাবার ঘরে নিয়ে আসি আমি। তোমরা বলো, আমার জন্যে বাবা-মা হয়ে তোমরা এক বাড়িতে থাকবে। বলো, প্লিজ বলো। তোমাদের তো আর কেউ নেই, কেন তোমরা থাকতে পারছ না? আমি জানি না, যদি বলবার মতো কিছু থাকে তো বলো। আমি বুঝব, বোঝবার চেষ্টা করব, কথা দিচ্ছি।

বাবা-মা দুজনেই শূন্যের দিকে চেয়ে রইল। তখন আমি মায়ের হাত ছেড়ে দিলাম। বাবার হাত ছেড়ে দিলাম। আমার ঘরে চলে এলাম। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। কান্নাটা আটকাতে থাকল চকোলেটের মধ্যে লিকিওরের মতো। সারা জীবন এই কান্নাটা আমার মধ্যে টলটল করবে বুঝে গেলাম।”

মনু দীক্ষিতের সঙ্গে ধ্রুবজ্যোতির প্রায় ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।

“সমানে আপনাকে থামতে বলছি, শুনতে পাচ্ছিলেন না? কী এত ভাবছিলেন?”

মনুর মাথায় বয়কাট চুল, পাক ধরেছে। কান দুটো কুলোর মতো চিতিয়ে থাকে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড়। ঠোঁট দুটি আশ্চর্য সুন্দর। ছোট্ট নাক, এমন কিছু মোটা নয়। সুগার হয়েছে, ডাক্তার বলেছেন হাঁটতে।

ধ্রুব বললেন, “কিছুই ভাবিনি। কী ব্যাপার বলো।”

“আজকাল লেকে হাঁটা নুইস্যান্স হয়ে যাচ্ছে। আপনারা কিছু করুন।”

“কীরকম?”

“আশপাশে তাকান, তা হলেই বুঝতে পারবেন। প্রকাশ্যে এইরকম নেকিং, কিসিং আগে দেখেছেন? এদের তো ‘লভ’ সম্পর্কে কোনও পবিত্রতাবোধও নেই। দিস ইজ স্যাক্রিলিজ্যাস!”

ধ্রুব বললেন, “পাখি বা কুকুর, ছাগল এরা কি তোমাকে, আমাকে তোয়াক্কা করে মিস দীক্ষিত?”

“ওরা ওই স্তরে নেমে গিয়েছেন বলছেন?”

ধ্রুব মৃদু হেসে বললেন, “না। ওরাই আমাদের আর ওদের মতো ‘মানুষ’ বলে মনে করছে না। পশুপাখির সামনে আর মানুষের লজ্জা কী? দে থিঙ্ক, উই এজেড পিপল আর আ ডিফরেন্ট স্পিসিজ।”

মনু চোখ আরও বড় বড় করে বললেন, “ধ্রুবদা, হাউ ক্যান ইউ বি সো ক্রুয়েল, সো শকিং?”

“শকিং আমি হলাম মনু? যা সত্যি, তাই বললাম। দেখে শুনে এটাই আমার মনে হচ্ছে। স্যরি, ইফ আই হ্যাভ হার্ট ইউ।”

“বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজন হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে,” সুজিত বোস কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। “এরা সব আমাদের ছেলেমেয়ে নয়, বুঝলে মনু? আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্য কোনও সেফ ভেনু খুঁজে নিচ্ছে।”

“তবু ভাল,” বলে মনু আর দাঁড়ালেন না। জোর কদমে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন।

সুজিত বোস বললেন, “আসলে মনু চাইছে, আমাদের অ্যাসোসিয়েশন কিছু করে। এখন ধ্রুব বলো, এ নিয়ে কোনও মিটিংফিটিং করা যায় কি না।”

ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “ভাবুন আপনারা, আমি আছি।”

তিনি তাড়াতাড়ি পা চালালেন, কেননা ছেলেটি চাপা রাগে গজরাতে গজরাতে বলছে, “বাড়ি ইকোয়ালস টু জাহান্নম, পাড়া মানে নরকে ছয় ঋতু, কলেজ ইজ অনন্ত বোরডম, বন্ধু-বান্ধব আহাম্মক। হাতে রইল, যন্তর।”

ক্রুদ্ধ চোখে তাঁর দিকে চাইল, “কাল থেকে বলে রেখেছি দশটায় বেরোব। এখন মাই জেঠিমা দ্য গ্রেট বলছেন, ‘এই তো কলির সন্ধে, সবে জলখাবারের পাট চুকল। রোববারের বাজার, ভাতে জল দিয়েছি। একটু সবুর কর।’ হোয়াট দ্য হেল ডু দে ডু ফ্রম মর্নিং টিল নাইট? দিবারাত্র রান্নাঘরে ঘুসঘুস করছে। নো রেজাল্ট? নো প্রোডাক্ট?”

ওদিক থেকে মন্তব্য এল, “অত ইংরেজি বলছিস কেন? বলছি তো, একটু দেরি হবে। ধর, মিনিট কুড়ি, যাবি কোথায়?”

“বুন্দেলখণ্ড।”

বাপস। ফায়ার হয়ে আছে। এখনকার সব ইয়ংম্যানই কি এইরকম? অ্যাংরি এবং হাংরি? তবে এ ছেলেটি সেরকম বক্সার টাইপ চেহারার নয়। ন্যাদনেদেও নয় তাই বলে। একটা স্ট্রাকচার আছে, তারুণ্যের কমনীয়তার তলায় একটা ইস্পাতের আস্তর। ঠোঁট দুটো চেপে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বোধহয় ওর জেঠিমা ডাকছেন, “ও কী রে। চললি কেন? মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করতে পারিস না? কী এমন কাজ তোর?”

ছেলেটি ততক্ষণে বাসস্টপে। একটা ‘টু’তে উঠে পড়েছে। ভিড়ভাড়, জ্যামট্যাম ঠেলে বাসটা ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বালিগঞ্জ স্টেশনে ঢুকে যাবে। ক’টা লালবাতি খাবে, সেই যা ভাবনা। হিতেন সারকে আজ ধরতেই হবে। কোথাও একটা পাও-ভাজিটাজি মেরে দেব। চার ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত। খাওয়া-ফাওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে এরা এমন একটা করে না, যেন খেতেই এসেছে পৃথিবীতে। চব্বিশ ঘণ্টা দেখো, আশপাশে মানুষ গাঁউ গাঁউ করে গিলছে। গিলে যাচ্ছে। ডালপুরি, তেলেভাজা, ধোসা, চাউমিন, বিরিয়ানি গিলেই যাচ্ছে। কোনও নির্দিষ্ট টাইম নেই। অল টাইম ইজ গবলিং টাইম। আর যাই করো। যে-দেশি পদই পাতে দাও, ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে দেখতে না দেখতে। দা গ্রেট ইন্ডিয়ান ইটিং সার্কাস। মেডিক্যালের স্টপ থেকে আরিয়ান উঠল, “হাই রূপ্‌স।”

“হাই আরি!”

“চললি কোথায়, ক্লাস নেই?”

চোখ নাচাল আরিয়ান। মেডিক্যালটা মেরে দিয়েছে গত বছর, ক্যালি আছে। প্রথম বছরটা মিস করল কেন, কে জানে! আসলে সবটাই সেই আননোন এক্স ফ্যাক্টর। বিশাল একটা জটিল ছক কাটা রয়েছে প্রত্যেকের জীবনে। ছকটা অন্যদের জীবন। ভূ-গোলক তার অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, তার অতীত, ভবিষ্যৎ, এই সমস্ত নিয়ে কাটাকুটি খেলতে-খেলতে চলেছে। কোথায় কেন কী হল না, আর কোথায় হঠাৎ কী হয়ে গেল, তা সেই ছকই জানে। কোনওটারই আপাতদৃষ্টিতে কোনও কার্যকারণ নেই। একটা পয়েন্টে যদি একশোটা গাড়ি ক্রস করে এক মুহূর্তে, কোনটা প্রথম যাবে, কোনটা কোনটার সঙ্গে ধাক্কা লাগাবে, কোনটার পেছনে পুলিশ লাগবে, তুমি বলতে পারবে? এ সেইরকম।

“কী রে আরি! এখন তো তোর অ্যানাটমি পড়ার কথা।”

আবার চোখ নাচাল আরিয়ান। নিচু গলায় বলল, “ট্যাটু ক্লাসে যাচ্ছি।”

“মিন্‌স?”

“রীতিমতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয় ইয়ার।”

“হঠাৎ ট্যাটু!”

“ইন-থিং!”

“তুই আবার কবে থেকে ইন-আউট করতে লেগেছিস?”

“আপকামিং ক্লাস চড়চড় করে মই বেয়ে উঠছে ইয়ার। শুদ্‌দু ডান হাতের ফোরআর্মে একখানা ড্র্যাগন। যখনই হাত তুলব, নজরে পড়বে। আর দেখতে হবে না। দাম চড়ে যাবে এক লাফে।”

“ফান্টু!”

“ওল্ড ভ্যালুজ নিয়ে থেকে যা মেছোবাজারে,” আরিয়ান ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

এইটা শুনলে তার ফাটাফাটি রাগ হয়ে যায়, ধ্রুব জানেন। এই সাউথের ছেলেগুলো উত্তর কলকাতা মানেই মেছোবাজার বুঝে চলেছে। কোথায় থাকিস? মেছোবাজারে। কোথায় যাচ্ছিস? মেছোবাজারে। সংযুক্তা গল্প করেছিলেন, “জানো লোরেটোতে পড়তে গিয়েছি, একটা মেয়েকে বেশ ভাল লাগল। জিজ্ঞেস করি, কোথায় থাকো, না বালিগঞ্জ প্লেস।”

আমি বললাম, “ও বালিগঞ্জ?”

মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলল কী জানো, “তা কি মেছোবাজারে থাকব?” বলতে বলতে সংযুক্তা হেসেছিল।

“তুমি তো বাবা সেই বালিগঞ্জের মক্কেল, অমনি আপস্টার্ট নাকি? আমি তো প্রথমে না-ই করে দিয়েছিলাম।”

রূপরাজ ছেলেটি বলল, “আমার নিজের যে নর্থ পছন্দ, তা মোটেই নয়। কিন্তু গোয়াবাগানের ছেলে অত সহজে কিল খেয়ে, কিল হজম করার পাত্র আমি নই। তুই যা গেছোবাজারে,” চেঁচিয়ে বলি। আশপাশের দু’-চারজন মিচকি হাসে। “আরে বাবা, এই নর্থ ক্যালকাটাই আসল কলকাতা। এখানেই রেনেশাঁস। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যেন বোস। কী সাহিত্য, কী বিজ্ঞান, এখানকারই কোণ-কানাচ থেকে বেরিয়েছে, তবে না দাঁড়িয়ে আছিস! নইলে কোথায় দাঁড়াতিস দাঁড়কাক? চললেন ট্যাটু করতে, নাকি ইন-থিং! পত্রপত্রিকা, বোকা বাক্স যা খাওয়াচ্ছে, খেয়ে যাচ্ছে। খা বাবা, বোকা বন। তেরি লাইফ, তেরি চয়েস।”

আমার কতকগুলো প্রিন্সিপল আছে। প্রিন্সিপল ছাড়া কোনও অ্যাডাল্ট হয় আমি মানি না। প্রথম কথা, সব লোকে যা করছে জাস্ট দলে পড়ে, আমি তা করব না। যত প্রেশার দিবি, আমার কুকার তত চড়ে যাবে। ফার্স্ট ইয়ারেও কেউ আমাকে সিগারেট খাওয়াতে পারেনি। ঘুরতে-ফিরতে ঠাট্টা, ইয়ার্কি। আমি খাইনি। ইচ্ছে হলে স্মোক করব, মেরি মর্জি। ফ্যাশন বলে, ম্যাচো বলে, ইন-থিং বলে আমার ওপরে চাপিয়ে দিতে পারবি না কেউ কিছু। এখন খাচ্ছি, টেনশন হলে, ভাল দেখায় বলে, অনেক সময়েই সিগারেট ঝুলিয়ে রাখি ঠোঁটে।

উত্তর কলকাতা পুরনো, ঘিঞ্জি, সেকেলে। বেশ, কিন্তু এখানেই জন্মেছি, বড় হয়েছি এবং এই জায়গাটার একটা লম্বা ইতিহাস আছে। বিপ্লবও সেই ইতিহাসের অংশ। এখন এই জায়গাটাকে তাচ্ছিল্য করলে তো নিজেকেই তাচ্ছিল্য করা হয়, নিজের জন্মমাটির ইতিহাসকে তাচ্ছিল্য করতে হয়। নিজেকে তুচ্ছ করে কেউ কোনওদিন বড় হতে পারে? অন প্রিন্সিপল, আমি উত্তর কলকাতার হয়ে লড়ে যাই। আমি বলি বিবেকানন্দ। আমি বলি, পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো। আমি বলি, চিতপুরের যাত্রা পাড়া, হিন্দু কলেজ, বেথুন কলেজ, এবং বলি, নকশাল। এই রে, হাজরার মোড় থেকে জ্যাঠামশাই উঠলেন, হয়ে গেল আজ! একেবারে কোণ ঘেঁষে বসে পড়ি। বই খুলে পড়তে থাকি। জ্যাঠামশাই এখানে কী করছেন, এই বুড়োগুলো কি মন্তরে চলে নাকি? হেদুয়ার জ্যাঠামশাই, হাজরায়?

জ্যাঠামশাইটি আমার নিজের নয়। নিজেরও অবশ্য আছে, বহাল তবিয়তে আছে। তবে সেটিকে আমি গোয়াবাগানের বাড়িতে জুতো পালিশ করতে দেখে এসেছি। তিনি পালিশ-বিশারদ। এবং সক্কালবেলায় বাড়ির সব্বার জুতো ঝকঝকে করে পালিশ করাই এঁর বাতিক। তবে আপাতত বাসের অন্দরে যে জ্যাঠামশাইটিকে দেখে আঁতকে উঠেছি, তিনি সর্বজনীন। সবচেয়ে মজার কথা এঁকে আমি একা নই, প্রত্যেকে পরস্পরের সঙ্গে কনসাল্ট না করে ওই একই নাম দিয়েছে। অর্থাৎ ওঁর জ্যাঠামশাইত্ব একেবারে স্বপ্রকাশ। ওই যে শুরু করে দিয়েছেন, ‘আসলে কী জানেন, দি সিক্রেট অব সার্ভাইভ্যাল ইজ মেন্টাল স্ট্রেংথ। আর হাসবার ক্ষমতা। আজকাল সব লাফিং ক্লাব হয়েছে, আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ধরতে পারছে সকলে। তবে কী জানেন, হাসিটা যখন ভেতর থেকে অটোম্যাটিক্যালি আসে, তখনই সেটা আসল হাসি। উঁ হুঁহুঁ হল না, সেভেনটিএইট। সব্বাই এই ভুলটাই করে। এখনও রেগুলার ব্যায়াম করি। ধাঁ করে ঘরের এদিক থেকে ওদিক পিছলে চলে যাব ভাই শিঙি মাছের মতো, এমন বডি ফিট। আজ্ঞে কী বললেন, থামব? অ্যাঁ, শিয়োর। থামতেই তো এসেছি। আমিও থামব, আপনিও থামবেন। কেউই চিরদিন… যাক।’

কেউ স্নাবিং দিয়েছে আর কী! প্রায়ই স্নাবিংটা খান উনি। কে আর অত ভ্যাজর ভ্যাজর শোনে! তবু জ্যাঠামশায়ের শিক্ষা হয় না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress