Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 18

ট্রেকার্স || Bani Basu

ট্রেনটা যখন ছাড়ল তখন বন্ধুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কোনও তিনজনের এক জায়গায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। সেকেন্ড ক্লাস কামরা ঠাসাঠাসি ভিড়। ধ্রুবজ্যোতি চশমাটা একবার ভাল করে মুছে নিলেন। সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভেশনহীন। এখন সব সিট বোঝাই। শুকতারাকে বলতে শুনলেন, “আমি খড়্গপুরে নেমে যাব। এইরকম শুধু-শুধু গাদাগাদি—একে অ্যাডভেঞ্চার বলে না, এর নাম ম্যাডভেঞ্চার।”

আরিয়ান বলল, “আমিও তো এসি-তে থাকি। তুই না টেনিস খেলিস তোর স্ট্যামিনা এত কম হবে কেন?”

“স্ট্যামিনার কোয়েশ্চেন এটা নয়। কথা হচ্ছে শুধু-শুধু কেন এই নোংরা ঘেমো-ভিড়ে পিষতে-পিষতে যেতে হবে? দিস ওয়জ আননেসেসারি।”

কখন উজ্জ্বল তার জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে, ওরা লক্ষ করেনি।

সে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি শুকতারা। প্রয়োজনটা পরে বুঝতে পারবি, কখন যে মানুষের কোন অভিজ্ঞতাটা কাজে লেগে যায়!”

শুকতারা টয়লেটের দিকে যাচ্ছিল, ট্রেন স্পিড নিয়েছে। উজ্জ্বলও দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে দ্বিতীয় টয়লেটের দিকে গেল। শুকতারা কাছাকাছি হতেই সে আস্তে গলায় বলল, “ব্যাকিং আউট?”

“নট রিয়্যালি।”

উজ্জ্বলের পুরো ব্যাপারটাই কেমন রহস্যময় লাগল। ও কি আগেই ঠিক করে নিয়েছিল যাবে বলে যাবে না, কেন? ও এর মধ্যে থাকতে চায় না? না-ই থাকল, সে কথা বলতে দোষ কী? এই সমস্ত আপার ক্লাস মড মেয়েরা বড্ড খেয়ালি হয়। যা খুশি তাই করার লাইসেন্স নিয়েই যেন জন্মেছে, দায়িত্বজ্ঞান বলতে কিছু নেই। খুব বিরক্ত লাগছে তার। সে টয়লেটের ভিতরে গিয়ে ভাবতে লাগল। শুকতারা আবার কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো?

ঈশ্বর জানেন, শুকতারা কিন্তু খড়্গপুরে নামল না।

দিয়া তন্ময় হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও তখন রাতে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রূপরাজ। বাবাই পাশের সিট পেয়েছে। আরিয়ানকে উলটোদিক থেকে আসতে দেখল উজ্জ্বল। শুকতারাও বসার জায়গা পায়নি। নাঃ, কাজটা রূপের ভাল হয়নি। এত কষ্ট করার দরকার কী ছিল? নামেই ‘এক্সপ্রেস’ ট্রেন, বড্ড ঢিকিস-ঢিকিস করে চলেছে। তার উপর এইরকম রিজার্ভেশনহীন কামরা। পৌঁছতে রাত সাড়ে দশটা, লেট করলে ক’টা কে জানে!

দিয়া এইসময়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, “শুক, বোস। আমি তো কিছুক্ষণ বসলাম।”

বাবাইও তার সিটটা ছেলেদের কাউকে দিতে চাইল। উজ্জ্বল হেলাফেলার সঙ্গে বলল, “তোরা বোস, আমরা ঠিক আছি। একেবারে ফিট।”

“যা বলেছিস,” আরিয়ান বলল।

“ছেলে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি?” বাবাই বলল।

“মাথা তো প্রায় বিক্‌কিরি করে দিলুম রে,” ওদিক থেকে রূপরাজ বলে উঠল। আস্তে-আস্তে সবাই মোটামুটি জায়গা পেল। পাশের লোক বিড়ি খাচ্ছে বলে দিয়া আরিয়ানের সঙ্গে জায়গা বদল করল। শুকতারার পাশে এক দেহাতি মহিলা ছেলে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। শুকতারা গিয়ে উজ্জ্বলের সঙ্গে জায়গা বদল করল। মহিলাও গন্ধমাদন।

রূপরাজ বলল, “এইভাবেই তবে আমাদের ট্রেকিং শুরু হল, এক সিট থেকে আর এক সিটে?”

“যা বলেছিস!” উজ্জ্বল, শুকতারা একসঙ্গে হেসে উঠল।

কামরাটা যাকে বলে লোকে লোকারণ্য। দুটো সিটের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায়ও ছোট বাচ্চাদের বসিয়ে দিয়েছে লোকে। অনেকেই পরস্পরকে চেনে, গল্প জুড়ে দিয়েছে। সারা কামরাটা মানুষের এই গল্পগাছার আওয়াজে ঝমঝম করছে। উজ্জ্বল, বাবাই লম্বা-দৌড়ের বাসে উঠে অভ্যস্ত। এই ভিড়, এত আওয়াজ ওদের কাছে তেমন কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু বাকিরা? বিশেষত, দিয়া, শুকতারা আর আরিয়ান একেবারে আনকোরা। কিন্তু বিরক্তি দেখা যাচ্ছে একমাত্র শুকতারারই। আরিয়ান একরকম উপভোগ করছে জিনিসটা। আর দিয়া লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপ করে আছে। মাঝে-মাঝে অন্যমনস্কভাবে হাসছে। মাঝে মাঝে আবার তার কপালে ভাঁজ পড়ছে। কিন্তু কী ভাবাচ্ছে তাকে?

একটা দেহাতি লোকের সঙ্গে আরিয়ান খুব জমিয়েছে। লোকটি বলছে, “আপ তো ফিল্মস্টার যৈসা।”

আরিয়ান বলল, “ফিল্মস্টারই তো হুঁ!”

লোকটি সসম্ভ্রমে বলল, “টলিউড কা?”

আরিয়ান মুচকি হেসে বলল, “উও হম নহি বাতাউঙ্গা।”

“তো আপ এয়হি কামরে পে…কিঁউ জি?”

“উও ভি হম কিসিকো নহি বাতাউঙ্গা।”

রূপের সঙ্গে এক মাঝবয়স ভদ্রলোকের কথাবার্তা হচ্ছে, ভদ্রলোক বললেন, “না, ঠিক মাউন্টেনিয়ার নই, কিন্তু ট্রেকিং আমার নেশা ছিল। তোমাদের বয়সে ভাই নন্দাঘুণ্টি-টুন্টি কিছুদূর গিয়েছি। এভারেস্টেও ট্রাই করেছিলাম। বেস ক্যাম্প থেকেই ফিরিয়ে দিল।”

“সে কী, কোনও ট্রেনিং না নিয়েই?”

“ট্রেনিং ছিল বই কী! শুশুনিয়ায়, তারপর অযোধ্যা পাহাড়ে। হিমালয়ের ট্রেনিং ছিল না। অভিজ্ঞতা আর উপদেশের উপর নির্ভর করেই, তোমরা কি অযোধ্যা পাহাড়ে যাচ্ছ?”

“ছাড়লেন কেন?” এড়ানে উত্তর দিল রূপ।

“সংসারে জড়িয়ে পড়লুম, আর রিস্‌ক নেওয়াটা ঠিক হত না। তোমরা যদি সিরকাবাদ দিয়ে যাও তো প্রাকৃতিক শোভা একটু কম দেখবে, বুঝেছ? প্রাকৃতিক শোভাটাই ট্রেকিং-এর বিশল্যকরণী। তোমার যত কষ্টই হোক, ঝরনা, পাহাড়ি ফুল, উঁচু-উঁচু গাছ, এসব দেখতে-দেখতে ক্লান্তি ভুলে যাবে ভাই। যদি বাঘমুণ্ডি পার হয়ে ট্রেকিং শুরু করো, ঘণ্টা ন’য়েকের পথ। সুন্দর, ভারী সুন্দর। তবে কী জানো, ভীষণ মশা! মশার জন্যে তোমাকে প্রিকশন নিতেই হবে, নইলে…।”

উজ্জ্বল এতক্ষণে বাবাইয়ের উলটো দিকের সিটটা পেল। একবার তাকাল রূপ আর আরিয়ানের দিকে। ওরা এখনও গল্পে মত্ত, ট্রেন এবার খানিকটা ভদ্রস্থ স্পিড নিয়েছে। সে বসে পড়ল।

“কী রে বাবাই ঘুমোতে-ঘুমোতে চলেছিস?”

“ঘুমিয়ে নেওয়াই তো ভাল।”

“ভিতরে-ভিতরে জেগে আছিস তো?”

বাবাই হাসল শুধু।

“দিয়াও বোধহয় ঘুমোচ্ছে।”

বাবাই আস্তে বলল, “ভিতরে-ভিতরে জেগে আছে।”

“মেয়েটা খুব পালটে গিয়েছে, না?”

“আপাতদৃষ্টিতে,” বাবাই উত্তর দিল।

“কেন, ভিতরে পালটায়নি?”

“তুই কি ওর পালটে যাওয়ার ওপর নির্ভর করছিস?”

“শি টু হ্যাজ আ ভাইট্যাল রোল টু প্লে!”

“আমি কিন্তু অন্য অর্থে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলুম।”

“আমি তোদের মতো অর্থবিদ নই,” উজ্জ্বল যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলল।

বাবাই ভাবল, ছেলেরা বড্ড জটিল এবং আত্মম্ভরি।

উজ্জ্বল ভাবল, মেয়েরা বড্ড জটিল এবং হিংসুটে ফর নাথিং।

বাবাই ভাবল, উজ্জ্বলও! সে-ই উজ্জ্বল!

উজ্জ্বল ভাবল, বাবাইও। সে-ই বাবাই!

খুব আশ্চর্যের বিষয়, দিয়াই একমাত্র যে-পারিপার্শ্বিককে প্রায় পুরোপুরি টা-টা বাই-বাই করে নিজেকে তার মনের ভিতর বেশ গুটিয়ে নিয়েছিল। এবং এক ধরনের জাগর স্বপ্ন দেখছিল। এই প্রথম তার স্বপ্নে মা নেই, বাবা নেই, তার চিরসাথী সেই দুঃখ বা ডিপ্রেশন নেই। সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। একটা স্বাধীন রাজ্যের বাসিন্দা, তার পাশে একটা ছায়া আছে অবশ্য, জ্যোতির্ময় ছায়া। যতই অদ্ভুত হোক কথাটা, সেই ছায়া সব সময়ে তার ক্লান্তি, অবসাদ, রুক্ষ মেজাজ শুষে নিচ্ছিল। সে হয়ে উঠছিল শক্তিময় কর্মক্ষম, ভারসাম্য সমেত, বাস্তববোধসম্পন্ন অথচ ভাবুক এক মানুষ। এই দিবাস্বপ্ন এত আরামের যে, দিবাস্বপ্ন থেকে সে চলে গেল গভীর ঘুমে। কামরার কাঠে মাথা রেখে সে ঘুমোতে লাগল। চারপাশের কলরোল একটু ঝিমিয়ে এসেছে, আলো কিন্তু কটকট করে জ্বলছেই।

শুকতারা আবার বসতে পেয়েছিল দরজার পাশের সিটে। কিছুক্ষণ পর রূপ তার পাশে এসে বসল।

শুকতারা হঠাৎ বলল, “একটা জিনিস লক্ষ করেছিস রূপ?”

“কী?”

“এই যে আমরা, আমরা যে একদম এই কামরায় বেমানান, সেটা কিন্তু কেউ মার্ক করছে না। আমাদের দিকে তাকাচ্ছেই না। আমার কীরকম একটা অড ফিলিং হচ্ছে, উই আর ইনভিজিবল।”

রূপ হেসে বলল, “বন্যেরা বনে সুন্দর, শুকতারা টেনিস কোর্টে।”

শুকতারা বলল, “তোর কান মুলে দিতে ইচ্ছে করছে। আমি সুন্দর-টুন্দরের কথা বলছি না। ইন্ডিয়ানরা স্বভাবতই কৌতূহলী অথচ এরা আমাদের সম্পর্কে কৌতূহল দেখাচ্ছে না।”

“দেখিয়েছে ইয়ার। আরিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছে সে-ও ফিল্মস্টার কিনা, আমাকে কী করতে, কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করেছে। মেয়েদের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কথা বলাটা তো ইন্ডিয়ান সভ্যতা নয়, তাই-ই মনে হয়। তবে ঘাবড়াসনি শুক, মনে ওদের যথেষ্ট কৌতূহল। কোনও মহিলার পাশে বসলে টের পেতিস।”

“যাই বল, আমরা বড্ডই কনসপিকুয়াস। এখানে আমাদের তুলে তুই ভাল করিসনি।”

“তোদের একটু হার্ডন করতে চেয়েছিলুম, এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক করিনি।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress